মসলার যুদ্ধ – ২

দুই

মসলা-যুদ্ধের কাহিনী বর্ণনা করতে গেলে আরও পেছনের দিকে ফিরে খেতে হয়। ক্রুসেডের গল্প অনেকেরই জানা আছে। যেরূযালেম খ্রীষ্টানদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র, –এইখানে যীশু খ্রীষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। এই যেরুযালেম মুসলমানদের অধিকারে আসে। সে সময় এশিয়া, ইউরোপ আর আফ্রিকা, এই তিন মহাদেশেই মুসলমান ও খ্রীস্টানরা পরস্পরে ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী। যেরুযালেমকে মুসলমানদের হাত থেকে উদ্ধার করবার জন্য খ্রীস্টান রাজ্যগুলো পরস্পর হাত মিলাল। ক্রসেড অর্থাৎ ধর্ম-যুদ্ধের আহ্বানে সে সময় সারা ইউরোপময় প্রবল ধর্মোন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল।

ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, হল্যাণ্ড, জার্মানী এরা সবাই এই জোটের মধ্যে ছিল। তাদের এই জোটবাঁধার পেছনে ধর্মীয় কারণ-যে ছিল না তা যায়। কিন্তু এই উপলক্ষে প্রতিযোগী শত্রুকে দমন করবার অভিপ্রায়টাও বেশ স্পষ্ট ভাবেই ফুটে উঠেছিল। প্রবল উচ্ছাসের মুখে প্রথম তিনটি ক্রুসেডে খ্রীস্টানরা সাফল্য লাভ করল, কিন্তু এই পর্যন্ত। তারপরই তাদের দুঃসময় দেখা দিল। ১১৮৭ খ্রীস্টাব্দে বীর সালাদিন খ্রীষ্টানদের হাত থেকে যেরুযালেমকে পুনরাধিকার করে নেন। তারপর থেকে এই জোট-বাধা শক্তিগুলো আর কোনদিন যেরুযালেমকে দখল করে নিতে পারে নি।

এই সময় মিশর মুসলমানদের হাতে চলে আসবার ফলে খ্রীস্টান রাজ্যগুলো খুবই অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেল। ইউরোপ আর এশিয়া, তার মাঝখানে মিশর। মুসলমানদের এই শক্তিশালী কেন্দ্রটিকে এড়িয়ে ভারতবর্ষে যাবার কোনই উপায় ছিল না। অথচ ভারতবর্ষের বিপুল সম্পদের কাহিনী তখন ইউরোপময় ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রুসেডের মধ্য দিয়ে আরও কাছাকাছি আসবার ফলে এসব খবর আরও বেশী করে তাদের কানে আসত। সত্যে, মিথ্যায় জড়িয়ে কত কথাই না এসে পৌছত! মধুর গন্ধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে মধুকরের দল। কিন্তু পথের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিশর। এখন কি করবে তারা?

অথচ ভারতবর্ষের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগ বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের বহুকাল আগে থেকেই গ্রীস আর ভারতবর্ষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মিশর এই সময় রোমের অধীন ছিল। সেই সময় মিশরের বন্দর থেকে রোমের জাহাজগুলো নিয়মিত ভাবে ভারতবর্ষের বন্দরে বন্দরে মাল কেনা-বেচা করত। আরিক্ক্যামেদুর খননের ফলে যে-সমস্ত তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রথম শতকে রোম সামাজ্য ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল; গ্রীক ও রোমীয় ভৌগোলিকেরা ভারতবর্ষের উপকূল সম্পর্কে ভাল ভাবেই ওয়াকিফহাল ছিলেন। এমন কি তারা ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলো সম্পর্কেও বর্ণনা দিয়ে গেছেন।

ইউরোপের অন্ধকার যুগে এই সম্পর্কের ছেদ পড়ে গিয়েছিল। ইসলামের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আরবের বণিকেরা তাদের জায়গা দখল করে নিল। কিন্তু জায়গা দখল করে নিয়েই তারা ক্ষান্ত থাকে নি। দেশবিদেশের ঐশ্বর্যকে করায়ত্ত

করবার জন্য দুঃসাহসিক আরব বণিকরা জীবন পণ করে দুরন্ত সমুদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করেছে এবং শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। ফলে আরব সাগর, লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগর আরব বণিকদের বাণিজ্য জাহাজে ছেয়ে গিয়েছিল। ক্রুসেডের মধ্য দিয়ে আরবদের বাণিজ্যের এই বিরাট অগ্রগতি ইউরোপীয় রাজনৈতিকদের দৃষ্টিপথে এল। তারা বুঝলেন ভাগ্য- লক্ষ্মীকে জয় করতে হলে ঐশ্বর্যের মণিকোঠা ভারতবর্ষে পৌছবার পথ খুঁজে বার করতেই হবে।

কিন্তু ইসলামধর্মী মিশর আর সিরিয়ার উপকূল এই পথের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সম্বন্ধে সজাগ ছিলেন বলেই ইউরোপীয় রাজনৈতিকরা সোজাসুজি মিশরের বিরুদ্ধেই তাদের পঞ্চম ধর্মযুদ্ধ পরিচালিত করেছিলেন। ফ্রান্সের সেন্ট লুই ছিলেন এই ধর্মযুদ্ধের নেতা। আরও অনেক রাজা তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই যুদ্ধেও তাদের হার মানতে হোল। মিশর ও সিরিয়ার উপকূল মুসলমানদের হাতেই থেকে গেল।

মসলা ছাড়া ইউরোপীয়দের চলে না। যে-কোন ভাবেই হোক মসলা পেতেই হবে। মসলা আসবার দুটো পথ-একটা মিশরের মধ্য দিয়ে, আর একটা পারস্যের মধ্য দিয়ে। ইউরোপকে এ বিষয়ে একান্তভাবে মিশরের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। মিশরের একচেটিয়া ব্যবসা, তার বণিকরা মসলার দাম চড়িয়ে দিয়ে আসল দামের তিনগুণ আদায় করতে লাগল। ওদিকে পারস্যের লোক ও ইসলামধর্মী, খ্রীষ্টান বণিকদের সেই পথ ধরে মসলার সন্ধানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু পারস্যে যখন তাতারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হোল তখন এই পথটা খুলে গেল। তাতার খানরা তখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। তারা ইতালীর বণিকদের মসলা আনবার জন্য পারস্যের উপর দিয়ে ভারতবর্ষে যাবার অনুমতি দিলেন। তার ফলেই তখনকার দিনের ইউরোপীয়েরা জানতে পারল, মসলা কোন্ দেশে জন্মায়, আর তার সত্যিকারের দামই বা কি রকম। কিন্তু সে পথ বেশী দিনের জন্য খোলা রইল না। মুসলমানদের বাধা ও যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে তাদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল।

কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্যগুলো সরাসরি মিশরের আরব বণিকদের কাছ থেকে মসলা বা পূর্বাঞ্চল থেকে আমদানি করা অন্যান্য পণ্য কিনতে পারত। সোল এজেন্ট বললে যা বোঝায়, ভেনিস রাজ্য ছিল তাই। ভেনিসের বণিকরা এ বিষয়ে খুই ধুরন্ধর ছিল। যে-কোন ভাবেই হোক মিশরের বণিকদের সঙ্গে তাদের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। মিশরের বণিকরা কেবলমাত্র তাদের হাতেই এই সমস্ত পণ্য বিক্রী করত। আর তাই দিয়ে ভেনিসের বণিকরা সমস্ত ইউরোপের মধ্যে একচেটিয়া ব্যবসা চালাত।

বিভিন্ন রাজ্যের বণিকদের ভেনিস থেকে এই সমস্ত পণ্য কিনে নিয়ে যেতে হোত। এরই ফলে ভেনিস অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়েছিল।

ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ভেনিসের সঙ্গে তার প্রতিবেশী জেনোয়া রাজ্যের প্রতিযোগিতা বহুদিন ধরেই চলে আসছিল। জেনোয়া ভেনিসের একচেটিয়া মসলার ব্যবসায় ভাগ বসাবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করে নি। তাদের পরিকল্পনা ছিল যে, তারা পারস্য উপসাগরে তাদের বাণিজ্য জাহাজ মোতায়েন করবে, যাতে মসলার বাণিজ্য-টাকে লোহিত সাগর থেকে পারস্য উপসাগরের পথে সরিয়ে নিয়ে আসতে পারে। তারা পারস্যের ইলখান আরঘুনের কাছে এই প্রস্তাবটি দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনাকে কাজে লাগানো গেল না।

এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও জেনোয়া কিন্তু হাল ছাড়ল না। তারা সন্ধান করতে লাগল, একটানা জলপথে ভারতবর্ষে যাবার কোন পথ আবিস্কার করা যায় কিনা। শুধু জেনোয়া নয়, ইউরোপের আরও কতগুলো দেশের নাবিকরা এই একই চেষ্টা করছিল। কেননা এই হচ্ছে একমাত্র পন্থা যায় সাহায্যে একই সঙ্গে মুসলমানদের ও ভেনিসের একচেটিয়া ব্যবসার উপর ঘা মারা যায়। এদের মধ্যে জেনোয়ার উগোলিনো দ্য ভিডাগডোর অভিযানই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তিনি ১২৯১ খ্রীষ্টাব্দে জেনোয়া থেকে যাত্রা করে জিব্রালটার হয়ে আফ্রিকার উপকূল ধরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেছিলেন।

সমুদ্রে নৌ-চালনার ব্যাপারে পোর্তুগাল নানাভাবেই জেনোয়ার কাছে ঋণী। সত্য কথা বলতে হলে তাকে এ বিষয়ে জেনোয়ার উত্তরাধিকারী বলা চলে। ১৩১৭ খ্রীস্টাব্দে পোর্তুগালের জাহাজগুলোর যিনি অধিনায়ক ছিলেন, তিনি একজন জেনোয়াবাসী। তার নাম ম্যানুয়েল পেসানহা। শুধু তিনি নন, তাঁর অধীন কাপ্তানরা সবাই ছিল জেনোয়াবাসী। এটা অনুমান করে নেওয়া যায়, আফ্রিকা মহাদেশকে প্রদক্ষিণ করে ভারতবর্ষে যাবার পরিকল্পনাটা সর্বপ্রথম জেনোয়াবাসীদের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনাকে কাজে পরিণত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে নি।

জেনোয়ার এই অসমাপ্ত কাজ পোর্তুগাল নিজের হাতে তুলে নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *