মসলার যুদ্ধ – ৫

পাঁচ

ভাস্কো দ্য গামার যুদ্ধবহরকে হটিয়ে দিলেও কালিকটের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে নি। তারা বুঝতে পেরেছিল, পোর্তুগীজদের সঙ্গে যুদ্ধ এইখানেই শেষ নয়, সবেমাত্র শুরু। দুর্ধর্ষ পোর্তুগীজরা বহরের পর বহর পাঠাতে থাকবে, কতদিন পর্যন্ত তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে?

কালিকট কোনদিনই এই নৌ-যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দেশবিদেশের বণিকরা এই বন্দরে পণ্যের লেন-দেন করে আসছে, মিশরীরা এসেছে, গ্রীকরা এসেছে, রোমকেরা এসেছে, আরবীরা এসেছে, চীনারা এসেছে, ভারতবর্ষের নানা অঞ্চল থেকে বণিকরা এসেছে, কিন্তু বাণিজ্য নিয়ে যুদ্ধ–বিগ্রহের কথা কেউ কোনদিন শোনে নি। কালিকটের জাহাজের মধ্যে বেশীর ভাগই বাণিজ্য—জাহাজ, তবে সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ বলে আত্মরক্ষার জন্য কিছু কিছু যুদ্ধজাহাজও তাদের ছিল। কিন্তু সেগুলো উপকূলের নিকটবর্তী অঞ্চলে যুদ্ধ করবার পক্ষে উপযোগী। শত্রুদের জাহাজ যখন উপকূল ছেড়ে গভীর সমুদ্রে গিয়ে প্রবেশ করে, কালিকটের যুদ্ধজাহাজের নাবিকরা তখন নিরুপায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয়ের কথা ওদের কামান। দূর থেকে ওরা অগ্নিবর্ষণ করে চলে। তার বিরুদ্ধে কি করতে পারে এরা? ভাস্কো দ্য গামা যেতে না যেতেই চৌদ্দটা জাহাজের আর একটা বহর কালিকটের সমুদ্রকে আলোড়িত করে তুলল। এই বহরের অধিনায়ক হয়ে এসেছিলেন লোপো সোর্স। লোপো সোর্স ঝানু ও বিচক্ষণ নৌ-যোদ্ধা। মম্মলির নেতৃত্বে কালিকটের এক বহর যুদ্ধ-জাহাজ ক্রাঙ্গানোরে নোঙর ফেলে অবস্থান করছিল। এ অবস্থায় তাদের উপর যে-কোন রকম হামলা হতে পারে এটা এদের চিন্তার মধ্যে ছিল না। লোপো সোর্স তাদের এই নিশ্চিন্ততার সুযোগ নিয়ে ঝটিকা আক্রমণ করে বসল। তার কামানের গোলায় জাহাজগুলো ধ্বংস হয়ে গেল। আর একটা বন্দরে কতগুলো বাণিজ্য–জাহাজ জড় করা ছিল। কতগুলো যুদ্ধ-জাহাজ তাদের রক্ষা করবার জন্য পাহারা দিচ্ছিল। এখানে দুপক্ষে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলল। কিন্তু পোর্তুগীজদের কামানের গোলার সামনে কতক্ষণ তারা দাঁড়াবো! দেখতে দেখতে তাদের রক্ষাব্যুহ ভেঙ্গে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। কলিকটের জাহাজগুলোর অপরিমিত ক্ষতি ঘটল।

কামান-যে কত বড় শক্তি কালিকট এবার তা হাড়ে হাড়ে বুঝল। জামোরিন দেখলেন, এভাবে যুদ্ধ চালানো কোনমতেই সম্ভব নয়। আরব বণিকরা পরামর্শ দিল, মিশরের সুলতানের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠান। ওদের হাতে কামান আছে। গোলন্দাজবাহিনী যদি আমাদের সঙ্গে থাকে, তাহলে পোর্তুগীজদের আমরা দেখে নিতে পারব। জামোরিন তাদের এই পরামর্শ মেনে নিলেন। মিশরের সুলতানের সঙ্গে জামেরিনের অনেকদিন থেকেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক চলে আসছিল। তা ছাড়া কালিকটের মসলার বাণিজ্য থেকে সবচেয়ে বেশি মুনাফা লুটে আসছিল মিশরের বণিকরা। মিশরের সমৃদ্ধি প্রধানত তার উপর নির্ভর করছিল। এই মসলার বাজার যদি পোর্তুগীজদের দখলে চলে যায়, তবে তার ছিটেফোটাটুকুও আর তাদের ভোগে আসবে না।

মিশরের সুলতান এই সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিলেন। দেড় হাজার যোদ্ধা আর কামান বোঝাই এক মিশরী বহর আরব সাগরে এসে উপস্থিত হোল। প্রাচীন সেনাপতি মীর হুসেন এই অভিযানের অধিনায়ক হয়ে এসেছিলেন। মীর হুসেন দিউ দ্বীপে ঘাঁটি গেড়ে বসলেন। এটা ১৫০৭ খ্রীষ্টাব্দের কথা। তাঁর পরিকল্পনা ছিল এখান থেকে যাত্রা করে জামোরিনের নৌ-বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে একযোগে পোর্তুগীজদের আক্রমণ করবেন।

সে সময় পোর্তুগীজরা কোচিনের উপকূলে স্থায়ী ঘাটি পত্তন করে বসেছিল। তাদের রাজপ্রতিনিধি অর্থাৎ স্থানীয় শাসনকর্তার নাম ছিল ডন ফ্রান্সেসকো দ্য আলমেইডা।

পরিকল্পনা-অনুযায়ী মীর হুসেন ও জামোরিনের নৌ-বাহিনী মিলিত হয়ে কোচিনের দিকে যাত্রা করলেন। এ সমস্ত খবর পোর্তুগীজদের কাছে আগেই পৌছে গিয়েছিল। তাদেরও আয়োজনের ত্রুটি ছিল না। শাসনকর্তার পুত্র লোরেনকো দ্য আলমেইডার নেতৃত্বে পোর্তুগীজ নৌ-বাহিনী তাদের মোকাবিলা করবার জন্য কোচিন ছেড়ে উত্তর দিকে এগিয়ে গেল। কালিকট আর কোচিনের মাঝামাঝি চাওল নামে একটি স্থান ছিল। তারই কাছে দুপক্ষে সংঘর্ষ বাধল। এবার যুদ্ধ হোল সামনে সামনে, দুপক্ষের হাতেই কামান ছিল। আরব সাগর এই প্রথম এক নতুন ধরনের যুদ্ধ দেখল। দুদিন ধরে উভয় পক্ষে গোলাবর্ষণ চলল। শেষ পর্যন্ত অবস্থা বেগতিক বুঝে পোর্তুগীজরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাল। কিন্তু যে-জাহাজে সেনাপতি ছিলেন, কামানের গোলায় তা ঘায়েল হয়ে পড়ল। জাহাজটা বিধ্বস্ত হল শুধু এই নয়, সেনাপতি নিজেও নিহত হলেন।

পোর্তুগীজরা চোখে অন্ধকার দেখল। ডোম ম্যানুয়েলের এত স্বপ্নসাধ সবই কি ব্যর্থ হয়ে যাবে? সুদূর প্রাচ্য অঞ্চলে গিয়েও-যে কামানে কামানে লড়াই করতে হবে, এটা তারা ভাবতে পারে নি। ভেবেছিল তাদের হাতে থাকবে কামান, আর অপর পক্ষের হাতে ঢাল, তলোয়ার, বল্লম, বর্শা, সড়কি। হাসতে হাসতে যুদ্ধ জয় করে নেবে। কিন্তু আপাতত সে ইচ্ছা পূর্ণ হোল না।

কিন্তু শাসনকর্তা ডন ফ্রান্সেসকো দ্য আলমেইডা উদ্যোগী পুরুষ। চাওলের পরাজয় তাঁর মন ভেঙ্গে দিতে পারল না। নতুন উদ্যোগ নিয়ে তিনি আবার শক্তি সংগ্রহ করতে লাগলেন। আয়োজন সম্পূর্ণ হোল। তখন তাঁর হাতে আঠারোটা জাহাজ আর বারো শো যোদ্ধা। ১৫০৯ খ্রীস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারী তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে মিশরী বহরের ঘাঁটি দিউর সামনে এসে রণডঙ্কা বাজালেন।

কিন্তু এবার আর অস্ত্র হিসেবে শুধু কামানই ছিল না, তার চেয়েও অনেক সূক্ষ্ম ও কুটিল অস্ত্র প্রয়োগ করলেন তিনি। দিউ দ্বীপ গুজরাট রাজ্যের অন্তর্গত। মালিক আয়াজ নামে এক ব্যক্তি গুজরাটের সুলতানের প্রতিনিধি হয়ে দিউ দ্বীপ শাসন করছিল। মালিক আয়াজ গোপনে পোর্তুগীজদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধের সময় মালিক আয়াজ সমস্ত রকম রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিল। রসদ অভাবে মীর হুসেন কঠিন সংকটের মধ্যে পড়ে গেলেন। কিন্তু তা হলেও তিনি যুদ্ধ করাই সিদ্ধান্ত করলেন। ৩রা ফেব্রুয়ারী তারিখে উভয় পক্ষ যুদ্ধে নামল। কিন্তু এবারকার যুদ্ধে জয় পরাজয়ের কোন মীমাংসা হোল না। কেউ কাউকে পরাস্ত করতে পারল না। এর অল্প কিছুদিন বাদেই মীর হুসেন গুজরাটের সুলতানের এই বিশ্বাসঘাতকতায় বিরক্ত হয়ে সমস্ত জাহাজ নিয়ে তার দেশে ফিরে গেলেন।

পোর্তুগীজদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোল। তারা কালিকটকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। পোর্তুগীজদের সঙ্গে নৌ যুদ্ধ পরিচালনা করবার মত কোন শক্তি রইল না আর। কিন্তু মীর হুসেন শত্রুর শেষ না করে স্থায়ী ভাবে মিশরে ফিরে গিয়ে যে-অদূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন সেদিন, মিশরকে একদিন সেজন্য খুবই অনুশোচনা করতে হয়েছিল। কেননা পোর্তুগীজ তো শুধু কালিকটেরই শত্রু নয়, সে তো মিশরেরও শত্রু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *