মসলার যুদ্ধ – ৩

তিন

কিন্তু এই পরিকল্পনাকে কাজে পরিণত করতে বহু তেল নুন কাঠ খরচ করতে হয়েছে। এই দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর ধরে তারই প্রস্তুতি চলেছে। এই প্রস্তুতির ব্যাপারে পোর্তুগাল নেতৃত্ব নিয়েছিল। একথা সত্য বহু দেশের বহু লোকের দীর্ঘ দিনের মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এই কাজ শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা হলেও পোর্তুগালের রাজা ডোম হেনরীর, যিনি নাবিক হেনরী নামে সুপরিচিত, এ বিষয়ে ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

মসলা আমদানির প্রশ্নটা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত হয়ে গিয়েছিল। এই দুনিয়াটা মুসলমান না খ্রীষ্টান কার প্রভাবে আসবে, ক্রুসেডের মধ্য দিয়ে তারই পরীক্ষা চলছিল। ক্রুসেড শেষ হয়ে গেলেও তার শেষ মীমাংসা হয় নি। পনেরো শতকে পোর্তুগাল রাজা ডোম হেনরী খ্রীষ্টান শক্তি হিসেবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নেতার স্থান অধিকার করেছিলেন, এ কথা বলা চলে। অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিদের মধ্যেও যে মুসলিম আতঙ্ক ছিল না তা নয়। কিন্তু পোর্তুগালের কথা স্বতন্ত্ৰ।

পোর্তুগাল ও স্পেনকে সব সময়ই নিকটবর্তী মুসলিম রাজ্যগুলোর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতে হোত। কাজেই তাদের মধ্যে ক্রুসেডের মনোভাব তখনও অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে।

তখন ভারতবর্ষ ও ইন্দোনেশিয়ার মসলার বাজার সম্পূর্ণ ভাবে মুসলমানদের হাতে। তাদের সম্পদ ও শক্তির প্রধান উৎস সেইখানে। কোন ইউরোপীয় শক্তির সেখানে দন্তস্ফুট করবার সুযোগ ছিল না। এইখানেই তাদের দুর্বলতা। এইখানেই তাদের আতঙ্ক। মুসলমানদের পতন ঘটাতে হলে সেই মোক্ষম জায়গায় আঘাত করতে হবে, মসলার বাজারকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে হবে তাদের মুঠো থেকে। ডোম হেনরী প্রথম থেকেই এ বিষয়ে সজাগ ছিলেন। অবশ্য খ্রীষ্টাননের পবিত্র দায়িত্বই একমাত্র কথা নয়, তার চেয়েও বড় কথা ছিল।

মসলা যে-দেশে জন্মায়, পোর্তুগালের বাণিজ্যের জাহাজ যদি সেখানে গিয়ে পৌছতে পারে, তাহলে তার ভবিষ্যৎ উজ্জল হয়ে উঠবে। তখন কোথায় পড়ে থাকবে ভেনিস, কে মনে রাখবে তার কথা? ইউরোপের বণিকেরা মসলার আশায় দলে দলে ছুটে আসবে তার কাছে, মুঠো মুঠো সোনা ঢালবে তার পায়। আর সেই সোনার দৌলতে ক্ষুদ্র ও নগণ্য পোর্তুগাল একদিন সারা ইউরোপের সমাট হয়ে দাঁড়াবে।

সমস্ত পৃথিবী একদিন খ্রীষ্টান পৃথিবীতে পরিণত হয়ে যাবে, আর তাদের সবার সামনে পুরোভাগে থাকবে পোর্তুগাল-এই মহাপ্রেরণা হেনরীকে উদ্বুদ্ধ করে তুলল। তিনি বাছা বাছা গাণিতিক, মানচিত্রকারক, জ্যোতির্বেত্তা ও সুদক্ষ নাবিক এনে জড় করলেন। তাদের সাহায্যে আফ্রিকা ঘুরে ভারতবর্ষে যাবার এই একটানা জলপথ অন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান চলল।

পোর্তুগীজদের প্রধানত দু’রকম জাহাজ ছিল। একরকম হালকা দ্রুতগতি জাহাজ, তার নাম ক্যারাভেল। আর এক রকম জাহাজের নাম গ্যালিওন। এগুলো ভারী আর ধীরগতি, এগুলোই কামান বয়ে নিয়ে যেত। হেনরী বুঝতে পেরেছিলেন, তখনকার দিনের প্রচলিত ধরনের জাহাজ দিয়ে এই দীর্ঘ সমুদ্রপথ অতিক্রম করা সম্ভব নয়। সেইজন্যই তাঁর উদ্যোগে জাহাজগুলোর যথেষ্ট উন্নতি সাধন করা হয়। পোর্তুগীজদের সাফল্যের এটাও একটা কারণ।

অজানা এই মহাদেশ আফ্রিকা। তার সুদীর্ঘ পশ্চিম উপকূলে কোনদিন কোন নাবিক তার জাহাজ ভিড়ায় নি। দুরদর্শী হেনরী তার নাবিকদের শিক্ষাদানের জন্য নৌ-বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সুশিক্ষিত নাবিকরা পথের সন্ধানে উপকূল ধরে এগিয়ে চলল। এই অজানা দেশে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। বহু বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তারা উপকূলের স্থানে স্থানে যেখানে সম্পদের গন্ধ পেয়েছে, সেখানে স্থানীয় আদিম অধিবাসীদের হটিয়ে দিয়ে সেই সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। পথের সন্ধানে এগিয়ে চলতে চলতে আফ্রিকা মহাদেশে পোর্তুগীজ সাম্রাজ্যের বীজ বুনে চলছিল তারা। এই অনুসন্ধান শেষ করতে বহু বৎসর কেটে গিয়েছিল।

পোর্তুগীজদের এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা চারদিকে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। খ্রীস্টান জগতের ধর্মীয় নেতা রোমের পোপ এই অভিযানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন। পোপ পঞ্চম নিকোলাস ১৪৫৪ খ্রীষ্টাব্দে ভারতবর্ষ পর্যন্ত পোর্তুগীজরা যা কিছু আবিষ্কার করবে, তার উপর রাজা হেনরীর একমাত্র অধিকার দান করেন। এই উপলক্ষে তারা নিম্নোক্ত ঘোষণা জারী করেছিলেন :

“আমরা একথা জানতে পেরে বিপুল পরিমাণ আনন্দলাভ করেছি যে, আমাদের প্রিয় সন্তান পোর্তুগাল-রাজা হেনরী তাঁর স্মরণীয় পিতা রাজা জনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে খ্রীস্টের নির্ভীক সৈনিকের মত উৎসাহে অনুপ্রাণিত চিত্তে বহুদূরবর্তী ও অজানা দেশগুলোতে ঈশ্বরের নাম বহন করে নিয়ে গিয়েছেন এবং আরব-জাতি ও অবিশ্বাসীদের মত ঈশ্বর ও খ্রীস্টের বিশ্বাসঘাতক শত্রুদেরও ক্যাথলিক খ্রীস্টান সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন।

রাজা হেনরী মহাসমুদ্রের ভেতরে জনশূন্য দ্বীপগুলোতে কতগুলো খ্রীস্টান পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি প্রতিপালনের জন্য গীর্জা স্থাপন করেছেন। যতদূর জানা আছে এ পর্যন্ত কেউ সমুদ্রপথে প্রাচ্যদেশের দূর উপকূলে পৌঁছতে পারে নি। একথা স্মরণ রেখে রাজা হেনরী এই বিশ্বাস পোষণ করেন যে, যদি তাঁর চেষ্টার ফলে সমুদ্রপথে ভারতবর্ষে পৌঁছা সম্ভবপর হয়-যে- ভারতবর্ষের মানুষ খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেছে বলে কথিত আছে, তাহলে তিনি ঈশ্বরের প্রতি তার আনুগত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন উপস্থিত করতে পারবেন। যদি তিনি সেই দেশের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন, তাহলে ধর্মের শত্রুদের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য অঞ্চলের খ্রীস্টানদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারবেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে সে সব দেশের যে- সকল লোক ধর্ম থেকে বঞ্চিত এবং এখন পর্যন্ত ইসলামের কালব্যাধিতে যারা আক্রান্ত হয় নি, সেখানকার রাজার অনুমতি নিয়ে তাদের মধ্যে খ্রীস্টধর্মের জ্ঞান বিতরণ করতে পারবেন।

গত পঁচিশ বছরে পোর্তুগাল সৈন্যবাহিনীর সাহায্য ছাড়াই কঠিনতম বিপদের মধ্য দিয়ে এবং কঠিনতম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে তিনি তার দ্রুতগামী ক্যারাভালের সাহায্যে মহাসাগরের পরপারে কুমেরুর অঞ্চলগুলোতে অবিরাম অনুসন্ধান করে চলেছেন। এবং বহু সমুদ্র অতিক্রম করে গিনি প্রদেশে পৌঁছেছেন।

আমরা সতর্কভাবে পর্যালোচনা করে এবং আমরা ইতিপূর্বে আমাদের ঘোষণার মাধ্যমে খ্রীস্টের শত্রু আরবজাতি বা অবিশ্বাসীদের দ্বারা শাসিত দেশগুলোকে আক্রমণ, জয় ও অধীন করে রাখবার জন্য রাজা অ্যাফনসোকে যে- অধিকার প্রদান করেছি, সে কথা বিবেচনা করে এই ঘোষণা দ্বারা আমাদের এই ইচ্ছাই জ্ঞাপন করছি যে, রাজা অ্যাফনসো ও তাঁর উত্তরাধিকারিগণ পূর্বোক্ত দ্বীপ ও বন্দরগুলো এবং নিম্নোক্ত সমুদ্রগুলো অধিকার ও ভোগ করে চলুন। পূর্বোক্ত অ্যাফনসো ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের অনুমতি ছাড়া ওগুলো সম্পর্কে তাদের প্রভুত্বের উপর হস্তক্ষেপ করতে যাওয়া যে-কোন বিশ্বাসী খ্রীস্টানের পক্ষে নিষিদ্ধ। যা কিছু জয় করা হয়েছে বা জয় করা হবে, বাজাডোর প্রণালী, নন্ প্রণালী ও গিনি উপকূল পর্যন্ত যত দেশ জয় করা হয়েছে এবং প্রাচ্য অঞ্চল সকল সময়ের জন্য ও ভবিষ্যতের জন্য রাজা অ্যাফনসোর প্রভুত্বাধীন থাকবে।”

.

১৪৫৬ খ্রীষ্টাব্দে পঞ্চম নিকোলাসের এই ঘোষণাকে অনুমোদন করে তৃতীয় ক্যালিকেটাস অনুরূপ একটি ঘোষণা দেন।

পোপের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সমগ্র প্রাচ্য অঞ্চলকে জয় করবার ও ভোগ করবার একচ্ছত্র অধিকার পোর্তুগালের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তার ফলেই প্রাচ্যের বাজার দখল করতে গিয়ে পোর্তুগালকে বহুদিন পর্যন্ত খ্রীস্টান প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয় নি।

এই ঘোষণার মধ্যে দুটো জিনিস লক্ষ্য করবার মত। প্রথম কথা ক্রুসেডের যুগ পার হয়ে এলেও, ক্রুসেডের মনোভাবের কোনই পরিবর্তন হয় নি। তাই দেখতে পাই কি তীব্র মুসলমান-বিদ্বেষ এই ঘোষনার মধ্য দিয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে!

দ্বিতীয় কথা, খ্রীস্টান জগতের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপের ধারণা ছিল যে, ভারতবর্ষের লোকেরা খ্রীষ্টানধর্মাবলম্বী। রাজা হেনরী পথ রচনা করে দিয়ে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার পরিণতি দেখে যাবার সুযোগ তিনি পান নি। ১৪৬০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেও তার প্রদর্শিত পথ ধরেই এই অভিযান এগিয়ে চলতে থাকে। ১৪৮৭ খ্রীস্টাব্দে বার্থেলেমি ডিয়াজ কেপ অব গুড হোপ আবিষ্কার করেন। ভারত মহাসাগারের জলরাশি তাদের চোখের সামনে ঝলসে উঠল।

দীর্ঘদিনের কঠোর সাধনার পর এতদিনের স্বপ্ন এবার পূর্ণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিল। অবশেষে এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য গ্র্যাণ্ড কাউন্সিলের অধিবেশন বসল। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ নাকি এর বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, এ একটা অবাস্তব কল্পনা। এই মরীচিকার পেছনে ছুটলে শুধু রাজ্যের অর্থনাশই সার হবে।

কিন্তু রাজা ডোম ম্যানুয়েল স্বয়ং এই অভিযানের পক্ষে। কোন আপত্তি মানলেন না। তিনি, আদেশ দিলেনঃ জাহাজ প্রস্তুত করো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *