মসলার যুদ্ধ – ৭

সাত

পোর্তুগীজরা গোয়াকে সুরক্ষিত নগরে পরিণত করল। ১৫১০ খৃস্টাব্দে তারা গোয়া অধিকার করেছিল। গোয়ার দুর্ভেদ্য দুর্গ তাদের দিগন্ত-বিস্তারিত সমুদ্র সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়াল।

এবার অ্যালবুকার্কের শিকার-সন্ধানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোর দিকে নিবদ্ধ হোল। তাঁর কর্মসূচী পূর্ব থেকেই নির্ধারিত ছিল। এতদিন তার বাণিজ্যতরী ও রণতরী ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যেই চলাচল করত। এবার প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অশান্তির আলোড়ন জাগিয়ে তুলল।

প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জের আধুনিক নাম ইন্দোনেশিয়া। এইগুলোর সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। দ্বীপগুলো মসলার জন্য বিখ্যাত। প্রাচীনকাল থেকে এদের সঙ্গে ভারতবর্ষের যোগাযোগ চলে আসছিল। বহু শতাব্দী আগে ভারতীয়েরা মালয়ে, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে, কাম্বোডিয়ায় এবং চম্পা প্রভৃতি স্থানে অনেক উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ভারতের বণিকরা ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলো থেকে জাহাজ বোঝাই করে মসলা নিয়ে আসত, আর তাই নিয়ে দেশে দেশে বাণিজ্য করে ফিরত। ইন্দোনেশিয়ার এই মসলা নিয়ে বাণিজ্য তারা কবে থেকে শুরু করেছিল, সে কথা নির্দিষ্টকরে বলা যায় না। তবে কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যেও আমরা তার উল্লেখ পাই। কবি সমুদ্রের ওপারের দ্বীপগুলো থেকে সুগন্ধী মসলায় বোঝাই ভারতীয় জাহাজের বর্ণনা করেছেন। প্রাচীন-কালে ভারতবর্ষ, এই মসলার জন্যই ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তারা জানত না এই মসলা শুধু ভারতবর্ষেই জন্মায় না, তার অধিকাংশই আসে ইন্দোনেশিয়া, থেকে।

বহুদিন আগে থেকে এই অঞ্চলে চীনাদেরও যাতায়াত ছিল। কিন্তু মিঙ বংশের রাজত্ব থেকেই নিয়মিত ভাবে জাহাজ চলাচল হতে থাকে : মসলা তাদের আকর্ষণের অন্যতম কারণ, এটা অনুমান করা অসঙ্গত হবে না। মিঙ সম্রাট ইয়াংলোর রাজত্বকালে চীনাদের নৌ-অভিযান চরম উন্নতি লাভ করে। বিখ্যাত নৌ-সেনাপতি চেংহো এই অভিযানের পরিচালক ছিলেন, দোভাষী মাহুয়ান তাঁর এই অভিযানের সঙ্গী ছিলেন। মাহুয়ানের লিখিত বৃত্তান্ত থেকেই আমরা চেংহোর দক্ষিণ সমুদ্র অভিযানের পূর্ণ বিবরণ জানতে পারি। চেংহোর একটি নৌ-বহরে কমপক্ষে ৬৫টি জাহাজ ছিল। তার মধ্যে কতকগুলো বৃহদাকার জাহাজ ছিল। চেংহো যে, শুধু প্রশান্ত মহাসাগরেই বিচরণ করতেন তা নয়। তার নৌ-বহর বহুবার সিংহল, কালিকট, এমন কি এডেন পর্যন্ত গেছে। চেংহোর মৃত্যুর পর চীনাদের নৌ-অভিযানের আর কোন বিবরণ আমরা পাই না।

চেংহোর উপর্যুপরি নৌ-অভিযানের ফলে মালয় এবং ইন্দোনেশিয়ার কয়েকটি দ্বীপে চীনাদের সাম্রাজ্য বিস্তারিত হয়ে পড়ে। এখানকার শাসকরা চীনের প্রভুত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাঁকে কর যোগাতেন। কিন্তু এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য কোন রকম যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটেছিল বলে জানা যায় নি। ইন্দোনেশিয়ার জনৈক আধুনিক ঐতিহাসিক এ সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছে তাতে দেখা যায় তারা যে পদ্ধতিতে এখানে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার মধ্যে নূতনত্ব আছে। তিনি বলেছেন, “চীনের রাষ্ট্রদূতরা বন্দরে বন্দরে গিয়ে শাসনকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্যসূচক আলাপের মধ্য দিয়ে বোঝাতেন যে, তারা যেন ব্যক্তিগত ভাবে পিকিং-এ গিয়ে সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করে তাকে করদান করেন। এই প্রচারের আশ্চর্য রকম ফল পাওয়া গেছে। কয়েক বছরের মধ্যে অনেকেই ধাওয়া করলেন পিকিং-এর দিকে। সবচেয়ে প্রথমে গেলেন ‘পুনি’র রাজা। এই পুনি হয় পশ্চিম বোর্নিও, নয় তো ব্রুনেই। এই সময় মালাক্কার রাজাও চীন সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করেন।

একশত বছর পর্যন্ত তারা চীনের করদ রাজা ছিলেন। এরা সবাই ছোট ছোট রাজা। সম্ভবত বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্যই তারা স্বেচ্ছায় প্রবল পরাক্রমশালী চীনের পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মিঙ রাজত্বের অবসানে সাম্রাজ্যের বাঁধনটা অনেক পরিমাণ শিথিল হয়ে গেলেও এ সমস্ত অঞ্চলের উপর চীনের প্রভাব সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ হয়ে যায় নি। এই সময় মসলা-সন্ধানী পোর্তুগীজদের নৌ-বহর এখানকার সমুদ্রে এসে প্রবেশ করল।

বহু শতাব্দী আগে দক্ষিণ-ভারতের হিন্দুরা এই সমস্ত দ্বীপে কবে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, তার স্মৃতিচিহ্ন এখনও একেবারে লুপ্ত হয়ে যায় নি। কিন্তু বর্তমানে এ সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রায় সবাই মুসলমান। ভারতবর্ষের গুজরাট রাজ্য থেকে সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম এখানে আসে। বাণিজ্যবৃদ্ধির সাথে সাথে ইসলামেরও প্রসার হতে থাকে; পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বন্দর অঞ্চলে মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দুদের সমাজবন্ধন শিথিল হয়ে যায় এবং নানাভাবেই তাদের অবনতি ঘটতে থাকে। পোর্তুগীজরা যখন এখানে প্রবেশ করল তখন এসব অঞ্চলের মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে খুবই ঠোকাঠুকি চলছিল। কোন বিদেশী আক্রমণকারীর পক্ষে এ একটা সুবর্ণ সুযোগ। পোর্তুগীজরা এই সুযোগটাকে তাদের নিজেদের কাজে লাগাতে ত্রুটি করল না।

এবার পোর্তুগীজদের প্রবেশপর্বের কথা বলি। আগেই বলেছি, প্রাচ্য অঞ্চলের সবচেয়ে বেশী মসলা উৎপন্ন হোত ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে। সেই মসলা মালয়ের মালাক্কা হয়ে ভারতের কালিকট ও অন্যান্য বন্দরে পৌছত। তারপর আরব বণিকরা এই মসলার বোঝাই জাহাজ নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লোহিত সাগরের বন্দরে বন্দরে ভিড়ত। সেখান থেকে সেই মসলা সারা ইউরোপের বাজারে ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু পোর্তুগীজরা আপনাদের সমুদ্রের প্রভু বলে ঘোষণা করে পূর্বদেশের এই মসলার বাণিজ্যিকে নিজেদের এক-চেটিয়া করে নিতে চাইল। এই জলদস্যুদের উৎপাতে অন্যান্য বণিকদের সমুদ্র-পথে চলাচল কঠিন হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু পোর্তুগীজরা বুঝতে পেরেছিল, যে-পথ দিয়ে মসলা আসে, সেই মালাক্কা প্রনালীতে কর্তৃত্ব স্থাপন করতে না পারলে ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যকে করায়ত্ত করা সম্ভব হবে না।

১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে লোগো দ্য সিকুইয়েরা এই উদ্দেশ্যে ছয়টি জাহাজ নিয়ে মালাক্কা গিয়েছিলেন। অবস্থাটা তদন্ত করে দেখাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। অনুমতি চাইতেই সুলতান রাজী হয়ে গেলেন। বললেন, বেশ তো, আপনারা আমার এই বন্দরে আর সব দেশের বণিকদের মতই বাণিজ্য করুন, আমার এতে কোন আপত্তি নেই।

কিন্তু মালাক্কায় যে-সব আরব বণিকরা ছিল, পোর্তুগাল-সম্পর্কে তাদের হাড়ে হাড়ে অভিজ্ঞতা আছে। এদের অত্যাচারে আরব সাগর আর ভারত মহাসাগরে তাদের বহু দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে। পোর্তুগীজদের চিনতে তাদের বাকী নেই। সেই কথাই তারা অনেক করে বুঝিয়ে বলল সুলতানকে। এরা কি মতলব নিয়ে এসেছ, কি করছে, সব কথাই তারা খুলে বলল। তা ছাড়া মুসলমানদের এমন দুশমন কে আছে আর? এদের আশ্রয় দেওয়া মানে সর্বনাশকে ডেকে নিয়ে আসা।

সুলতান তাদের মুখে এসব কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন। জেনে শুনে এমন শত্রুকে কেমন করে জায়গা দেওয়া যায়! তিনি স্থির করলেন, অনুমতি ফিরিয়ে নেবেন। কথাটা কানাকানি হয়ে সিকুইয়েরার কানে এসে গিয়েছিল। তিনি সুলতানের আদেশ পাবার আগেই মালাক্কা ছেড়ে দ্রুত চম্পট দিলেন।

যে-সময়ের কথা বলছি, তখন মালাক্কা একটি আন্তর্জাতিক বন্দর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জাভা, মোলাক্কাস এবং ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপে এমন সমস্ত মসলা জন্মত যা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। সেই সমস্ত মসলা এসে জমত সেই মালাক্কার বন্দরে। এই মসলা নিয়ে বাণিজ্য করবার জন্য পূর্বে চীন, জাপান এবং পশ্চিমে ভারতবর্ষ, আরব ও পারস্য থেকে বণিকরা এই বন্দরে নিয়মিত যাতায়াত করত। এই সম্পর্কে অ্যালবুকার্ক নিজেই লিখে গেছেন, “প্ৰতি বৎসরে মালাক্কায় ক্যাম্বে, চাওল, দুবুল, কালিকট, এডেন, মক্কা, শেহর, জেদ্দা, করমণ্ডল, বাংলা, চীন, গোর (?), জাভা, পেগু ও অন্যান্য জায়গা থেকে জাহাজ আসে।”

কুইয়েরার কাছে সমস্ত অবস্থাটা শোনবার পর অ্যালবুকার্ক স্থির করলেন, তিনি নিজেই যাবেন মালাক্কায়। আঠারোটা জাহাজ সাজিয়ে তিনি কোচিন থেকে যাত্রা করে মালাক্কায় এসে পৌছলেন। সেটা ১৫১১ খ্রীস্টাব্দের কথা। বন্দরে নানা দেশের বণিকদের জাহাজ ছিল। একসঙ্গে আঠারোখানি সশস্ত্র পোর্তুগীজ রণতরীকে আসতে দেখে বণিকেরা ভয়ত্রস্ত হয়ে উঠল। সে সময় পোর্তুগীজদের নামে সকলেরই হৃৎকম্প। বণিকের কাজ বাণিজ্য, যুদ্ধ তাদের বৃত্তি নয়। কিন্তু পোর্তুগীজদের তো তা নয়। এদের বাণিজ্য আর দস্যুবৃত্তি একই সঙ্গে চলে। ওরা গায়ের জোরে ব্যবসা করে। এদের ভয়ে সবদেশের বণিকরাই সমুদ্রেপথে চলাবার সময় সশস্ত্র হয়ে চলে। কিন্তু বন্দর নিশ্চিন্ত বিশ্রামের স্থান। এখানে মারামারি কাটাকাটির জন্য কেউ তৈরি হয়ে থাকে না। ওরা কি পৃথিবীর কোথাও শান্তিতে থাকতে দেবে না?

অ্যালবুকার্ক বন্দরের কাছে এসে ঘোষণা করলেনঃ তোমাদের মধ্যে যারা মুসলমান নও, তারা কোন ভয় করো না। আমরা তাদের কিছু বলন না। কিন্তু মুসলমান যারা, তাদের একটাকেও আমরা ছাড়ব না। আর ঐ হতভাগা মুসলমানদের যারা সাহায্য করতে বা বাঁচাতে চেষ্টা করবে, তাদেরও একই গতি হবে। তোমরা ভাল মানুষেরা যে যেখানে আছ, সেইখানেই চুপ করে থাক। তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখ, আমাদের কাজ আমরা করি। পোর্তুগীজদের সামনে যে-দুটো জাহাজ, তার মধ্যে কামানগুলো উদ্যত হয়ে আছে। একটু মাত্র সংকেতের অপেক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে কামানগুলো গর্জে উঠে অগ্নিবর্ষণ শুরু করবে। এ রকম দৃশ্য বণিকদের অনেকেরই দেখা আছে। তারা, কি মুসলমান, কি অমুসলমান, সবাই ভয়ে চুপ করে রইল।

অ্যালবুকার্কের নির্দেশে আরব বণিকদের ও ক্যাম্বের মুসলমান বণিকদের জাহাজগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হোল। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন! সেই আগুনের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল।চারদিক। পুড়ে মরার হাত থেকে বাঁচবার জন্য সেই সব জাহাজের লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল পানির মধ্যে। যারা পারল, সাঁতরে প্রাণ বাঁচাল। কিন্তু অধিকাংশ পানি থেকে উঠতে পারল না। শিকারী পোর্তুগীজরা উল্লাসধ্বনি তুলে জলচর প্রাণীর মত তাদের শিকার করল। চীনা ও হিন্দু বণিকরা আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে সে দৃশ্য দেখল।

সে দিন ছিল পোর্তুগীজদের পেট্রন সেন্ট জেমসের উৎসব দিবস। অ্যালবুকার্ক আর তার পোর্তুগীজ বাহিনী এইভাবেই সেই পবিত্র দিবস উদযাপন করল। এটাও তাদের সেই ধর্মযুদ্ধেরই একটা অংশ, অ্যালবুকার্ক সে দিন তার লোকদের উদ্দেশ্যে এই কথাই বলেছিলেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, এইভাবেই আমরা সমস্ত আরবীদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করব, মহম্মদের ধর্মের শিক্ষা চিরদিনের মতো নিবিয়ে দেব, যাতে এরপর তা আর কোন দিন জ্বলে উঠতে না পারে। এইভাবেই আমরা আমাদের প্রভুর প্রতি পবিত্র কর্তব্য সম্পন্ন করব। প্রভুর প্রতি কর্তব্যের কথা উল্লেখ করবার পর রাজার প্রতি কর্তব্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমি এ কথা নিশ্চিত ভাবেই জানি, যদি আমরা আরবীদের হাত থেকে মালাক্কার বাণিজ্য ছিনিয়ে নিতে পারি, তাহলে কায়রো ও মক্কা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এবং ভেনিসের বণিকরা যদি পোর্তুগালে গিয়ে মসলা না কিনে নিয়ে আসে, তবে তাদের মসলা পাওয়ার কোন পথ খোলা থাকবে না।

ধর্মীয় প্রেরণা এবং নগ্ন ও নৃশংস স্বার্থ বুদ্ধির কি এক অপূর্ব সমাবেশ! কিন্তু এটা পোর্তুগীজদেরই একচেটিয়া নয়। এ দৃষ্টান্ত কোন দেশে নেই? মানবতাবিরোধী অতি জঘন্য কাজের সাথে যদি কোন মতে ধর্মকে সংশ্লিষ্ট করে রাখা যায়, তবে তার সব দোষ কেটে যায়। শুধু দোষ কেটে যাওয়াই নয়, সময় সময় তা অতি মহৎ ও পবিত্র কাজ বলেও কীর্তিত হয়ে থাকে।

অ্যালবুকার্ক চীনা বণিকদের কাছ থেকে নৌকা চেয়ে নিয়ে তারই সাহায্যে তাঁর সৈন্যদের মাটিতে নামালেন। পোর্তুগীজরা যুদ্ধ করে নগর অধিকার করবার জন্য তৈরি হয়ে এসেছিল। যুদ্ধ বাঁধল। প্রথম আক্রমণে পোর্তুগীজদের হটে আসতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বারের আক্রমণে দুপক্ষে ভীষণ সংঘর্ষ হয়। এইবার নগর পোর্তুগীজদের দখলে এসে গেল। কিন্তু সুলতান আর তার সৈন্যবাহিনী আগেই নগর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

নগরবাসীদের ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয়। যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল, তাদের পণ্যের মতই ক্রীতদাসরূপে বিক্রী করা হয়েছিল। কিন্তু তারা নগরের চীনা, হিন্দু ও বর্মীদের কারু গায়ে হাত দেয় নি। মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেশের একটা অংশকে হাত করে রাখবার জন্য এই নীতি তারা প্রথম থেকেই অনুসরণ করে এসেছে। এটা খুবই স্পষ্ট যে, তাদের এই তীব্র মুসলমান – বিদ্বেষের মূল কারণ ধর্ম নয়। এর আসল কারণ তাদের বৈষয়িক স্বার্থ বুদ্ধি। এ-বিষয়ে কি রণক্ষেত্রে, কি বাণিজ্যক্ষেত্রে, মুসলমানদেরই তারা সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করত। কিন্তু তাই বলে হিন্দু কালিকটকে, তারা রেহাই দেয় নি। কালিকট অধিকার করবার জন্য তারা চেষ্টার ত্রুটি করে নি। তার কারণ এখানে মুসলমান অমুসলমানের প্রশ্নটা মূল প্রশ্ন নয়, মূল প্রশ্ন মসলার বাণিজ্য। নগরের ধনসম্পদ যা-কিছু ছিল, তার প্রায় সবই লুণ্ঠিত হয়ে ছিল। অভিযানে যোগদানকারীদের মধ্যে লুণ্ঠিত দ্রব্য ভাগ বাটোয়ারা করে দেবার পরও রাজার ভাগ হিসেবে তার কাছে পাঠান হয়েছিল ২,০০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা (ক্রুজোডো)

মালাক্কা অধিকারের পর অ্যালবুকার্ক তার একজন ক্যাপ্টেন পেরেজ দ্য অ্যানটেডকে চীনসাগরে নৌ-সেনাপতির পদে নিয়োগ করলেন। অপর ক্যাপ্টেন এনটয়ন এব্রিওকে পাঠালেন ইন্দোনেশিয়ার মসলা দ্বীপগুলোর অনুসন্ধানে। কিন্তু পথে বিপদ ঘটার ফলে তিনটা জাহাজের জায়গায় মাত্র একটা জাহাজ ফিরে এল। ভীষণ ঝড়ের ফলে ক্যাপ্টেন সেররাওয়ের জাহাজ ডুবি হোল। তবু অতি কষ্টে তিনি এমবিয়ানা দ্বীপে এসে স্থানীয় সুলতানদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। সে সময় ইন্দোনেশিয়ার অবস্থাটা তাদের পক্ষে খুবই অনুকূলে ছিল। জাভার নতুন মুসলমান সুলতানরা এবং পুরানো হিন্দু প্রজাদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছিল। পোর্তুগীজরা সেই সুযোগটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল। এ সময় সেখানকার রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন ডেমাকের সুলতান। রাজ্যচ্যুত মালাক্কার রাজা সাহায্যপ্রার্থী হয়ে তার কাছে গিয়েছিলেন। ডেমাকের সুলতান তার সাহায্যের জন্য ১০০ জাহাজ পাঠালেন। মালাক্কা প্রণালীতে পোর্তুগীজদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ঘ ঘটল। কিন্তু পোর্তুগীজদের অগ্নিবর্ষী কামানের সামনে কি করবে তারা? তাদের কামানের গোলার যোগ্য প্রত্যুত্তর দেবার মত সামর্থ্য ছিল না তাদের। তারা দেখতে দেখতে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল! এই যুদ্ধে জয়লাভ করে পোর্তুগীজরা জাভার সমুদ্রে তাদের প্রভুত্ব কায়েম করে বসল।

এইভাবে আপনাদের সমুদ্র-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠান করে পোর্তুগীজরা প্রাচ্যের মসলা-বাণিজ্যকে মুষ্টিগত করে নিল। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার মত কোন শক্তি অবশিষ্ট রইল না। অবশ্য শেষ মুহূর্তে তুর্কীর সুলতান একবার তাদের বিতারিত করবার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শেষরক্ষা করতে পারেন নি। মিশর তখন তুর্কসম্রাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। প্রাচের এই মসলার বাজারকে হস্তগত করে নিতে পারলে প্রবল প্রতিদ্বন্দী মুসলমানদের শক্তিকে দুর্বল করে দেওয়া যাবে, পোর্তুগাল-রাজ রাজা হেনরীর পরিকল্পনার মধ্যে এই অভিসন্ধিটা প্রথম থেকেই ছিল। মিশর দখল করবার পর থেকেই তুর্কীর সুলতান সুলেমানের কাছে এই সমস্যাটা প্রত্যক্ষভাবে দেখা দিল। যে-ভাবে আরব বণিকদের হাত থেকে এতদিনের পুরানো মসলা-বাণিজ্যকে পোর্তুগীজরা ক্রমে ক্রমে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তাতে খুবই উদ্বিগ্ন বোধ করলেন তিনি। এ তো শুধু আরব বণিকদের নিজস্ব ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে সমস্ত মুসলিম রাজ্যগুলোর সমৃদ্ধির প্রশ্ন জড়িত হয়ে আছে যে।

কিন্তু কাজটা যে সহজ নয়, সেটা তিনি ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলেন। সেইজন্যই তিনি এ সম্পর্কে মিলিতভাবে কাজ করবার জন্য কালিকটের জামোরিন ও ক্যাম্বের মুসলমান রাজার সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করলেন। কালিকট ও ব্যাম্বে এই দুই রাজ্যের বণিকরা দীর্ঘকাল ধরে মসলার বাণিজ্য করে আসছে। পোর্তুগীজদের জোর জুলুমের ফলে তাদের স্বার্থ বিশেষভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। কাজেই এই দুই রাজ্যের রাজা তুরস্কের সুলতানের এই আহ্বানে সাড়া দিলেন। পোর্তুগীজদের বিরুদ্ধে এই তিন শক্তি মিলিত হোল। বহুদিন আগে পোর্তুগীজদের প্রতিরোধ করবার জন্য কালিকট ও মিশর আরও একবার মিলিত হয়েছিল। সেই মিলিত প্রতিরোধের সামনে পোর্তুগীজদের থমকে দাঁড়াতে হয়েছিল। কিন্তু সেই মৈত্রী বেশী দিন টিকল না। তার ফলে পোর্তুগীজদের অভিযান বিজয় থেকে বিজয়ে এগিয়ে চলছিল।

কিন্তু সেদিন আর এখনকার মধ্যে অনেক তফাত। সেদিন পোর্তুগীজরা সবে মাত্র প্রবেশ করছিল। আর এখন তারা তিন সমুদ্র জয় করে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলছে। এখন তাদের হটিয়ে দেওয়া সহজ নয়।

এই চুক্তি সম্পন্ন করবার পর তুরস্কের সুলতান মিশরের শাসনকর্তা সুলেমান পাশা আল খাদিমকে নির্দেশ পাঠালেন :

“মিশরের শাসনকর্তা সুলেমান পাশা, আমার এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই আপনি প্রয়াজেনীয় মালপত্র নিয়ে সুয়েজে চলে যাবেন, এবং ধর্মযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি করবেন। একটি যুদ্ধ বহর সুসজ্জিত করে এবং যথেষ্ট-সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে নিয়ে অবিলম্বনে সুয়েজ থেকে ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করুন। যে-সকল স্থানে পোর্তুগীজরা মক্কা ও মদিনা যাবার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে সেই স্থানগুলো দখল করে নিন। ওরা যে-সমস্ত কুকর্ম করেছে, তার প্রতিকার করুন এবং সমুদ্র থেকে ওদের নিশান অপসারিত করে দিন।”

এই নির্দেশ পেয়ে মিশরের শাসনকর্তা সুলেমান পাশা এক বিরাট বহর নিয়ে ভারতসমুদ্রের দিকে যাত্রা করলেন। সেটা ১৫৩৮ খ্রীস্টাব্দ। খবরটা পোর্তুগীজদের কাছে অজানা ছিল না। ১৫৩৮ খ্রীস্টাব্দের ২০-এ ফেব্রুয়ারী তারিখে তুর্কী বহর যখন ভারতবর্ষের কাছাকাছি এসে পৌছেছে, ঠিক সেই সময় পোর্তুগীজ শাসনকর্তা মার্টিন দ্য সুজা কালিকটের যুদ্ধজাহাজগুলোকে আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। এই খবর পেয়ে সুলেমান পাশা পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়ে মিশরে ফিরে গেলেন। শেষ পর্যন্ত ত্রিশক্তি চুক্তির এই শোচনীয় পরিণতি ঘটল। এর পর তুরস্কের সুলতান এই ব্যাপার থেকে একেবারেই হাত গুটিয়ে নিলেন। পোর্তুগীজ নৌ-বাহিনী আরও ষাট বছর পর্যন্ত অপ্রতিহত প্রভাবে তাদের এই সমুদ্র-সাম্রাজ্য শাসন করে চলেছিল।

একটা জিনিস বিশেষ করে ভেবে দেখবার মত। পোর্তুগীজদের এত বড় শক্তির ভিত্তিটা কোথায়? সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে তাদের ঘাঁটি ছিল, কোচিনের দুর্গ, ক্ষুদ্র গোয়া আর বোম্বাই। তখনকার দিনে বোম্বাইর গুরুত্ব খুব কমই ছিল। এই সামান্য ঘাঁটির উপর নির্ভর করে সমস্ত সমুদ্রকে শাসন করত তারা। এ কি শুধু তাদের রণতরী আর কামানের জোরেই? এটা খুব বিশ্বাস্য বলে মনে হয় না। আর এক কথা। মসলার বাণিজ্যকে মুষ্টিগত করবার জন্য সমুদ্রের উপর এক বিভীষিকার সৃষ্টি করে তুলেছিল তারা। নির্দোষ বণিকদের জানমাল নিয়ে তারা ছিনিমিনি খেলত। কিন্তু তা হলেও একমাত্র কালিকট ছাড়া ভারতবর্ষের আর কোন অঞ্চলে পোর্তুগীজদের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় নি। এরই বা কারণ কি?

পোর্তুগীজ নেতাদের কূটনীতি এই সাফল্যের প্রধান কারণ, এটা বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। প্রথম থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল যাতে তারা তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আরব বণিকদের উপর তাদের আক্রমণকে কেন্দ্রীভূত করতে পারে। আমরা দেখেছি মালাক্কা পোতাশ্রয়ে প্রবেশ করে তারা সমস্ত আরবী জাহাজগুলোকে পুড়িয়ে ছাই করেছিল, কিন্তু চীনা বা হিন্দু বা বর্মী জাহাজগুলোর কোন ক্ষতি করে নি। এও আমরা দেখেছি, চীনা বণিকরা তাদের নৌকা দিয়ে পোর্তুগীজ সৈন্যদের নামবার জন্য সাহায্য করছিল। কি মালাক্কায়, কি ভারতবর্ষে তারা সব সময় এইটাই দেখাতে চেয়েছে যে, তারা একমাত্র আরব বণিকদের শত্রু আর সকলেরই বন্ধু! এইখানেই তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র। কিন্তু কালিকটে সেই নীতি প্রয়োগ করা সম্ভব হয় নি। কেননা, সেখানে ছিল প্রত্যক্ষভাবে খাদ্য-খাদক সম্বন্ধ।

দক্ষিণ-ভারতে প্রতিবেশী হিন্দু আর মুসলমান রাজ্যগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ঠোকাঠুকি চলে আসছিল। এই নবাগত বিদেশী শক্তির মুসলিম-বিদ্বেষে দক্ষিণ-ভারতের হিন্দুরাজ্যগুলো বেশ প্রীতির চক্ষেই দেখেছিল, মোটামুটি এ কথা বলা চলে। কোচিন হিন্দুরাজ্য। পোর্তুগীজরা যখন প্রথম এল কোচিন রাজ্যের অনুমতি নিয়ে কোচিনের এক দ্বীপে, তারা প্রথম দুর্গ গঠন করে বসল। কোচিন রাজ্যের সঙ্গে তাদের আগাগোড়া প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। এর পর তারা গোয়া অধিকার করে বসল; তাও হিন্দুপ্রধান তুলাজীর সাহায্যে, সে কথা আগেই বলেছি। গোয়ায় আসবার পর হিন্দু রাজ্য বিজয়নগরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ঘটল। মুসলমানের শত্রু হিসেবে এখানেও তারা সাদর অভ্যর্থনা পেল। বিজয়নগরের রাজা তার বিস্তীর্ণ রাজ্যে তাদের বাণিজ্য করবার অনুমতি দিয়েছিলেন। এছাড়া সমুদ্র-উপকূলে যে-সব ছোট ছোট হিন্দু রাজ্য ছিল, পোর্তুগীজরা তাদের সঙ্গেও সম্প্রীতির সঙ্গে বাণিজ্য করত। এক কথায় বলতে গেলে একমাত্র কালিকট ছাড়া আর কোন হিন্দু রাজ্য থেকে তারা বাধা পায় নি, বরঞ্চ প্রশ্রয়ই পেয়েছে।

হিন্দু রাজারা মনে করতেন, তাদের দেশের বণিকরা তাদের পণ্য পোর্তুগীজ বণিকদের কাছেই বিক্র করুক কি আরব বণিকদের কাছেই বিক্রী করুক তাতে তাদের কি আসে যায়! বরঞ্চ পোর্তুগীজদের সঙ্গে বাণিজ্য করলে অতিরিক্ত লাভটা এই যে, ওদের কাছে প্রয়োজনীয় এমন সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায় যা অন্য কারু কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।

দেশীয় বণিকরা শ্রীঘ্রই পোর্তুগীজদের সঙ্গে একটা বন্দোবস্তের মধ্যে এসে গেল। তারা ওদের কাছে অনুমতিপত্র নিয়ে বাণিজ্য করত। বাণিজ্য পোর্তুগীজদের একচেটিয়া হয়ে যাওয়ার ফলে প্রদেশের বণিকরা আর এক বিষয়ে নিজদের লাভবান মনে করল। তারা আরব বণিকদের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারত না। আরব বণিকদের উচ্ছেদ সাধনের ফলে এদিক দিয়ে তারা নিষ্কন্টক হোল। সম্ভবত সেই একই কারণে ক্যাম্বে ও গুজরাট এই দু’টি মুলসমান রাজ্যকে কখনও পোর্তুগীজদের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করতে দেখা যায় নি। মনে হয়, পোর্তুগীজরা তীব্রভাবে মুসলমান- বিদ্বেষী হলেও ভারতীয় মুসলমানদের উপরে হামলা করতে চাইত না। এটা তাদের বিচক্ষণ কূটনীতির পরিচয় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই নীতির ফলেই তারা মূল শত্রুকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে একমাত্র কালিকট ছাড়া আর কোন রাজ্য থেকেই সক্রিয় বিরুদ্ধতা পায়নি। বরঞ্চ প্রশ্রয় ও সাহায্যই পেয়েছে। এইটাই পোর্তুগীজদের শক্তি ও সাফল্যের প্রধান ভিত্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *