মসলার যুদ্ধ – ১

এক

১৪৮৮ খ্রীষ্টাব্দের কথা বলছি। কালিকটের বন্দরে অজস্র জাহাজের ভিড়। ছোট, বড় নানা আকারের নানা রকমের পালতোলা জাহাজ বাণিজ্যের পসরা বয়ে বন্দর ছেড়ে দেশবিদেশে যাত্রা করছে। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ চারদিক থেকে জাহাজের পর জাহাজ এসে ভিড়ছে। কালিকটের বন্দর নিমেষ মাত্র বিশ্রাম পায় না। প্রতিটি জাহাজের সামনে নিশান ওড়ে। বন্দরের লোকেরা তাই দেখে দূরে থাকতেই বলে দিতে পারে, কোনটা কোন দেশের জাহাজ। আরব বণিক, হিন্দু বণিক, গুজরাটের মুসলমান বণিক, এদের জাহাজই সংখ্যায় বেশী। চীনা বণিকদের জাহাজের আসা যাওয়া আছে। তাছাড়া এদিক ওদিক থেকে আরও জাহাজ যাতায়াত করে। কিন্তু আরবের বণিকরা সমস্ত বণিকদের ছাড়িয়ে উঠেছে। বাণিজ্যে তাদের সঙ্গে কেউ এঁটে উঠতে পারে না।

ভারতবর্ষের দক্ষিণতম প্রান্তে বর্তমান ব্যাঙ্গালোর থেকে কুমারিকা প্ৰণালী পর্যন্ত আরব সাগর-তীরবর্তী যেই ভূভাগ তার নাম মালাবার বা কেরল। এই ভূভাগের পূর্বদিকে হিন্দু রাজ্য বিজয়নগর। দুয়ের মাঝখানে দুর্ভেদ্য পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। এই মালাবার অঞ্চল বহু প্রাচীন কাল থেকেই গোলমরিচের দেশ বলে খ্যাত। দু’হাজার বছর ধরে এখানকার বণিকরা মসলাপাতি, বস্ত্র, মণিমুক্তা, গজদন্ত প্রভৃতি পণ্যে জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্য করে আসছে। মালাবার অঞ্চলে কতগুলো ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্য ছিল। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার নিরাপদ আড়ালে তারা আপনাদের স্বাধীনতা রক্ষা করে চলতে পেরেছে। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে কালিকট। কালিকটের রাজার বংশগত নাম জামোরিন।

কালিকট রাজ্য হিসেবে বড় না হলেও তার শক্তি ও সম্পদ ছিল প্রচুর। এই শক্তি ও সম্পদের মূল কারণ মসলা। কয়েক শতাব্দী ধরে কালিকট মসলার বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র বলে গণ্য ছিল। মালাবার অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে গোলমরিচ, এলাচি প্রভৃতি মসলা উৎপন্ন হোত। কিন্তু সবচেয়ে বেশী মসলা উৎপন্ন হোত প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে অর্থাৎ, মালয়, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে। কিন্তু এখানকার সমস্ত মসলাও কালিকট বন্দরে চলে যেত। পরে সেখান থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে চালান করা হোত। তখনকার দিনের ইউরোপীয়দের রান্নায় এসব মসলা ছাড়া কিছুতেই চলত না। আর এসব মসলা ভারতবর্ষ, মালয় আর ইন্দোনেশিয়া ছাড়া আর কোথাও পাওয়া সম্ভব ছিল না। এক গোলমরিচের কথাই ধরা যাক। গোলমরিচ আজকাল আমাদের কতটুকু কাজেই বা আসে! কিন্তু যে-সময়ের কথা বলছি তখন এই গোলমরিচ মনিমুক্তার মত মূল্যবান বলেই গণ্য হোত, এ কথা শুনালে কে বিশ্বাস করবে? এই গোল মরিচের জন্য মানুষ কী না করেছে? জীবন হাতে নিয়ে বিপদ-সংকুল সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে, কত লোক এরই জন্য যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। কাজেই সে সময় কালিকট বন্দরের খ্যাতি বলতে গেলে সমস্ত পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছিল। বন্দরের ব্যবস্থা ছিল খুবই ভাল। পারস্যের রাজদূত আবদুর রাজ্জাক একবার সে সময় এদেশে এসেছিলেন। কালিকট বন্দর দেখে তিনি বলে গেলেন, প্রত্যেকটি জাহাজ, যে-কোন দেশ থেকে আসুক না কেন, যে-কোন দিকেই যাক না কেন, তাকে অন্যান্য জাহাজের মতই সমদৃষ্টিতে দেখা হয়ে থাকে।

১৪৮৮ খ্রীষ্টাব্দ। এই সময় কালিকট বন্দরের সমৃদ্ধি উপছে পড়ছিল। বাণিজ্যসূত্রে বা বাণিজ্য উপলক্ষে কত দেশের কত লোকই না। এই বন্দরে আর নগরে ভিড় জমিয়েছে! তাদের কার মনে কি ছিল কে জানত!

এই সময় একদিন একটা আরবী জাহাজ থেকে এক সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক নামলেন। তার মুখের গড়ন আর গায়ের রঙ আরবদের মত নয়। তিনি আরবের মুসলমানের পোশাক পরে এসেছিলেন। কিন্তু এদেশের লোক আরব দেশের লোকদের ভাল করেই চেনে। সেইজন্যই ভদ্রলোক কারো কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তারা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। কিন্তু ভদ্রলোক যখন একজন আরব বণিককে আস্সালামু ওয়ালায়কুম জানিয়ে বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগলেন, তখন আর কারো মনে কোন সন্দেহ রইল না। ভদ্রলোক স্বচ্ছন্দে এখানকার আরবদের সঙ্গে মিশে গেলেন।

কিন্তু এই ছদ্মবেশী লোকটির প্রকৃত পরিচয় সেদিন কেউ পায় নি। লোকটি পোর্তুগীজ। তার নাম পেরো দ্য কোভিলহাম। পোর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় ডোম জোয়াও কালিকট বন্দর ও কালিকট রাজ্যের ভেতরকার খবরাখবর সংগ্রহ করে নিয়ে আসবার জন্য গুপ্তচর হিসেবে তাকে পাঠিয়েছিলেন।

এর ঠিক দশ বছর বাদে পোর্তুগীজরা প্রকাশ্যেই এল। ভারত-বর্ষের সঙ্গে মসলার বাণিজ্য করবার জন্য জাহাজ সাজিয়ে নিয়ে এল। এই পোর্তুগীজ বণিক দলের অধিনায়কের নাম ছিল ‘ভাস্কো দ্য গামা’। এ নামটা অনেকের কাছেই পরিচিত। ইউরোপীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম আফ্রিকা মহাদেশ প্রদক্ষিণ করে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। এই হিসেবেই তাঁর নাম সুপরিচিত। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ভারতবর্ষের মাটিতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির এই প্রথম পদক্ষেপ। সেইজন্যই ভাস্কো দ্য গামার নাম আর ১৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দটা আমাদের পক্ষে স্মরণ করে রাখবার মত।

পোর্তুগীজদের জাহাজগুলো সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। যেমন মজবুত গঠন তেমনি ক্ষিপ্র তাদের গতি। বন্দরের লোকরা অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে লাগল। জাহাজ তো নয় যেন জলচর প্রাণী। জলচর প্রাণীর মতই স্বচ্ছন্দ তাদের গতি।

কিন্তু শুধু তাই নয়, তার চেয়েও বেশী আকর্ষণের জিনিস ছিল। ওরা ওদের জাহাজের সামনে কামান সাজিয়ে এনেছে। এদেশের মানুষ তার আগে কখনও কামান দেখে নি। কামানের নামও খুব কম লোকেই শুনেছে। ওরা অবাক হয়ে বলাবলি করতে লাগল। ওগুলো আবার কিগো? কত দেশের কত জাহাজ এখানে এসে ভিড়ে, কিন্তু কই, এগুলো তো কোনদিন দেখি নি।

কামানের মর্ম জানে আরব বণিকরা। তারা দেশবিদেশে সফর করে বেড়ায়, কামানের সঙ্গে তাদের ভাল করেই পরিচয় আছে। তারা কামানের বৃত্তান্ত বুঝিয়ে বলল। ওরা শুনল বটে, কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারল না! বলল, তোমরা এ সমস্ত কাহিনী কোথায় পাও? হ্যাঁ, ছিল বটে এক কালে। রামায়ণে অগ্নিবানের কথা আছে। কিন্তু এই কলিযুগে সে কি আর সম্ভব? তাছাড়া সে তো মন্ত্রপূত বাণ, এই ম্লেচ্ছরা কেমন করে তাদের আয়ত্ত করবে?

এই কামানের কথা নিয়ে আরব বণিকদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনার ভাব দেখা দিল। কালিকটের রাজা জামোরিনের কপালেও উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *