মসলার যুদ্ধ – ৪

চার

পুরানো ইতিহাসটাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে আবার আমরা ফিরে এলাম ১৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দে।

১৪৯৭ খ্রীস্টাব্দে ৮ই জুলাই তারিখে পোর্তুগালের ট্যাগাস নদীর মুখে বেলেম পোতাশ্রয় থেকে চারটি জাহাজ ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করল। প্ৰথম দু’টি জাহাজের নাম স্যান গাব্রিয়েল ও স্যান র‍্যাফেল। স্যান গাব্রিয়েলে ২০টি কামান সাজানো ছিল।

এই অভিযানের অধিনায়ক বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কো দ্য গামা; সাধারণের মধ্যে একটা চলতি ভুল ধারণা আছে যে, ভাস্কো দ্য গামা সর্বপ্রথম এই নতুন পথ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু পথ আবিষ্কারের ব্যাপারে ভাস্কো দ্য গামার বিশেষ কোন ভূমিকা ছিল না। আমরা আগেই দেখেছি, পোর্তুগালের সুশিক্ষিত নাবিকেরা ইতিপূর্বেই আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ধরে চলাচল করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কেপ অব গুড হোপ ছাড়িয়ে তারা ভারত মহাসাগরে এসে পড়ল। এখান থেকে মোজাম্বিক পর্যন্ত খুবই সহজ পথ। কিন্তু এর পরই কঠিন পথ। ভারত মহাসাগরকে সোজাসুজি পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষের উপকূলে গিয়ে পৌছতে হবে। এ সময় মিলিন্দির রাজা একজন ভারতীয় নাবিক দিয়ে ভাস্কো দ্য গামাকে সাহায্য করেন। মিলিন্দি মোজাম্বিকের উত্তরে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলবর্তী একটি রাজ্য।

এই ভারতীয় নাবিক পোর্তুগীজ বহরকে ভারতবর্ষের দিকে পথ প্ৰদৰ্শন করে নিয়ে গিয়েছিল। এর কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই এ সব পথ ঘাট ভারতীয় নাবিকদের কাচে বাল করেই জানা ছির। তারা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বন্দরে বন্দরে চলাচল করত। এমন কথাও শোনা গেছে যে, তারা নাকি কেপ অব গুড হোপ ছাড়িয়ে পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু সে কথা প্রমান করবার মত উপুক্ত তথ্য আমাদের হাতে নেই।

দশ মাস বারো দিনের একটানা দীর্ঘ ভ্রমণের পর ১৪৯৮ খ্রীস্টাব্দের ২০-এ মে তারিখে ভাস্কো দ্য গামা জামোরিনের রাজা কালিকটের ঘাটে এসে পৌছলেন। কামানে সুসজ্জিত এই পোর্তুগীজ বাণিজ্য বহরের আগমনকে আরব বণিকেরা প্রীতির চোখে দেখতে পারেনি, একথা না বললেও চলে। বন্ধুস্থানীয় আরব বণিকদের মুখে নবাগত বণিকদের প্রকৃতি-ও উদ্দেশ্যসম্পর্কে নানা কথা শুনে এবং বিশেষ করে তাদের জাহাজের কামানসজ্জা দেখে জামোরিন-যে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাস্কো দ্য গামা যখন কালিকটের বন্দরে বাণিজ্য করবার জন্য তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করলেন জামোরিন তা মঞ্জুর করতে দ্বিধা করেননি। ভাস্কো দ্য গামা কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হন নি। তিনি এক অসঙ্গত আবদার ধরে বসলেন যে, তাকে বন্দরের প্রচলিত শুল্কের দায় থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। সেদিন এর মধ্য দিয়েই ভবিষ্যৎ বিপদের সংকেত সূচিত হয়ে উঠেছিল।

কালিকটে এসে ভাস্কো দ্য গামা নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। কালিকট বন্দর-সম্পর্কে যে-সমস্ত খবর তারা সংগ্রহ করেছিলেন, তার মধ্যে প্রধান খবরটাই ছিল না। কালিকটে এসে আরব বণিকদের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি চমকে উঠলেন। আরও দেখলেন এরা-যে এখানে এসে শুধু পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়েছে তা নয়, রাজসভার উপরে তাদের যথেষ্ট প্রভাবও রয়েছে। এই আরবী মুসলমানরা তাদের নিকটতম শত্রু। দীর্ঘদিন ধরে তাদের সঙ্গে বিরোধ চলে আসছে। সুদূর ভারতবর্ষে এসেও কি আবার বাণিজ্য নিয়ে তাদের সঙ্গেই ঠোকাঠুকি করে চলতে হবে?

আরও একটা ভুল ধারণা ছিল তাদের। রোমের পোপের মত তারাও মনে করতেন ভারতবর্ষের মানুষ খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। সেই জন্য কালিকটের একটা হিন্দু মন্দিরকে গীর্জা মনে করে তিনি উল্লসিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু এই ভুলটা ভাঙ্গতে বেশী দেরী হয় নি। এই প্রাথমিক সফরের মধ্য দিয়ে কালিকটের অবস্থাটা ভাস্কো দ্য গামা ভাল করেই সমঝে নিলেন। এর পর দেশে ফিরে গিয়ে রাজা ডোম ম্যানুয়েলের কাছে সমস্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন।

পোর্তুগালরাজ এবার প্রকৃত অবস্থা-সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হলেন। বোঝালেন, ভারতবর্ষের মসলার বাণিজ্যকে করায়ত্ত করতে হলে তাঁদের মারাত্মক শত্রু ঐ সমস্ত আরবীদের সঙ্গে দীর্ঘকাল লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সেই সংকল্প নিয়েই কালিকটের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় অভিযান পাঠানো হোল’। এই বহরে ৩৩টি

জাহাজ ছিল। জাহাজগুলোর মধ্যে পণ্য দ্রব্যের পরিবর্তে ১৫০০ শো যোদ্ধা আর প্রচুর যুদ্ধসামগ্রী ছিল। অভিযানের নেতা ছিলেন পেড্রো আলভারেজ ক্যাব্রাল। তাদের উপর আদেশ ছিল, তোমরা কালিকটে গিয়ে জামোনিরনের কাছে একটি বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপনের জন্য এবং পাঁচজন পাদ্রীর ধর্মপ্রচারের জন্য অনুমতি দাবি করবে। জামেরিন যদি তাতে সম্মত না হয়। তবে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে তাকে পথে আনবে।

ক্যাব্রাল ছয়টি জাহাজ নিয়ে কালিকটের ঘাটে এসে পৌছলেন। বাকী জাহাজগুলো পেছনে দৃষ্টির বাইরে থেকে গেল।

জামোরিন ক্যাব্রালকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন এবং তাকে বাণিজ্য করবার জন্য স্থান নির্দিষ্ট করে দিলেন। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ও নিয়মসম্মতভাবে বাণিজ্য করবার উদ্দেশ্যে তারা এখানে আসে নি! তাদের উদ্ধত ব্যবহার স্থানীয় লোকদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। ক্যাব্রালের একজন সহকারী ছিল, তার নাম কোরিয়া। এই কোরিয়া একদিন এক হাঙ্গামা বাঁধিয়ে তুলল। মানুষ এদের ব্যবহারে এমনিতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ছিল; দেখতে দেখতে এই হাঙ্গামা গুরুতর আকার ধারণ করল। এর ফলে কোরিয়া এবং তাদের দলের আরো পঞ্চাশ জন লোক নিহত হয়।

এই ঘটনা ঘটবার পরেই ক্যাব্রাল তার জাহাজগুলোকে দূরে সরিয়ে নিয়ে নগরের উপর কামান দাগতে শুরু করলেন। এই বর্বর আক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্য জামেরিন ১৫০০ শো যোদ্ধাসহ ৮০টা জাহাজ পাঠালেন। কালিকটের জাহাজগুলোকে তাড়া করে আসতে দেখে ক্যাব্রাল তার জাহাজগুলোকে নিয়ে ভেগে পড়লেন। এখান থেকেই মসলা যুদ্ধের শুরু। কিন্তু কালিকট থেকে সরে পড়লেও পোর্তুগীজরা ভারত মহাসাগর ছেড়ে চলে যায় নি। এবার তারা নতুন মূর্তি ধরে আসরে নামল।

রাজা ডোম ম্যানুয়েল আপনাকে ইথিওপিয়া, আরব, পারস্য ও ভারতের নৌ-চলাচল, রাজ্যজয়ের ও বাণিজ্যের প্রভু বলে ঘোষণা করলেন। এ শুধু কথার কথাই নয়, এই প্রভুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য পোর্তুগাল রাজ্যে সাজ সাজ রব পড়ে গেল।

পৃথিবীর সকল দেশেই বণিকেরা প্রাচীনকাল থেকে বাণিজ্য করে আসছে। কিন্তু ইতিপূর্বে এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেছে বলে শোনা যায় নি। পোর্তুগীজরা এরকম ঘটনার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে ছিল। ডোম ম্যানুয়েল তো আগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, কামানের গর্জন আমাদের দাবি আদায় করে নেবে। আর ধর্মনেতা রোমের পোপ এজাতীয় ব্যাপারে পোর্তুগীজদের উপর তাঁর পবিত্র আশীর্বাদ ঢালাও ভাবে বর্ষণ করে গেছেন। নতুন যুগে নতুন বণিকজাতি বাণিজ্যের এ এক নতুন পথ উন্মুক্ত করে দিল। এ বিষয়ে পোর্তুগীজরাই প্রথম পথ-স্রষ্টা। ডাচ, ফরাসী ও ইংরাজ বণিকরা তাদের অনুসরণ করে পঙ্গপালের মত এই ভারতবর্ষ ছেয়ে ফেলেছিল। এবারকার অভিযানের অধিনায়ক ভাস্কো দ্য গামা। এই বহরে ১৫টা জাহাজ ছিল। তার মধ্যে ছয়টা বড়। শুধু আয়তনেই বড় নয়, শক্তিতেও বড়, অর্থাৎ আগেকার জাহাজগুলোর চেয়ে তাদের গোলাগুলি কামানের পরিমাণ অনেক বেশী। এই অভিযানে সামরিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত ৮০০ সৈন্য ছিল। কালিকটের পক্ষ থেকে প্রবল প্রতিরোধ আসবার সম্ভাবনা আছে একথা মনে করে এদের সাহায্যের জন্য পাঁচ মাস বাদে আরও পাঁচটা জাহাজ পাঠানো হয়েছিল। রাজা ডোম ম্যানুয়েল আপনাকে নৌ-চলাচলের প্রভু বলে ঘোষণা করেছিলেন। ভাস্কো দ্য গামা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে এই ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করলেন। আসতে আসতে যে-কোন জাহাজের সঙ্গে দেখা হোল, কোন রকম হাঁশিয়ারী না দিয়েই তিনি তাদের আটক করে তাদের মালপত্র লুটপাট ও ধ্বংস করতে লাগলেন। এ তো বর্বর জলদস্যুদের কাজ। কিন্তু মহামান্য পোপের বিধান-অনুযায়ী পোর্তুগালরাজ জলরাজ্যের অধিপতি। কাজেই তিনি যাই করুন না কেন তাকে জলদস্যু কখন বলা চলে না।

সেই থেকেই ভারত মহাসাগরের বুকে ভাস্কো দ্য গামা আর তার সহচরদের নৃশংস যথেচ্ছাচার অব্যাহত গতিতে চলল। সেই নিষ্ঠুর ও করুণ কাহিনীগুলোকে ইতিহাস ধরে রাখতে পারে নি। সেই অগণ্য কাহিনীগুলোর মধ্যে একটি কাহিনীর উল্লেখ করছি। ভাস্কো দ্য গামার কীর্তি-কাহিনীর স্বরূপ এই থেকেই বোঝা যাবে।

মক্কা থেকে হজ-যাত্রীদের নিয়ে কয়েকটা নিরস্ত্র জাহাজ ফিরে আসছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে তারা পোর্তুগীজ জাহাজের সামনে পড়ে গেল। জাহাজগুলোকে আটক করে তাদের মধ্যে মালপত্র যা ছিল, সব কিছু তুলে এনে জাহাজগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হোল। কিন্তু ভাস্কো দ্য গামার কড়া আদেশ ছিল, জাহাজে যে – সমস্ত আরবী আছে, তাদের যেন তুলে আনা না হয়। হতভাগ্য আরবীরা সেই জাহাজের মধ্যেই জ্বলে পুড়ে মরল। ভাস্কো দ্য গামা পরম আনন্দে সেই দৃশ্য উপভোগ করলেন।

মহাসমুদ্রের বুকে নৌ-চলাচলের অবাধ অধিকার সকলেরই আছে। এই অবস্থায় ভাস্কো দ্য গামা এই সমস্ত জাহাজগুলোকে আটক, বাজেয়াপ্ত ও ধ্বংস করে কি ন্যায়সংগত কাজ করেছিলেন? এ প্রশ্ন অনেকেই তুলেছিলেন। কিন্তু ভাস্কো দ্য গামার পক্ষ সমর্থন করে ওকালতি করবার মত লোকের অভাব ছিল না। তারা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ, একথা সত্য, সমুদ্রের বুকে নৌ- চলাচল করার ব্যাপারে সকলেরই সমান অধিকার আছে এবং ইউরোপে আমরা সকলেই এই অধিকারকে স্বীকার করে থাকি। কিন্তু এই অধিকারের সীমা ইউরোপের মধ্যেই, তার বাইরে নয়। কাজেই সমুদ্রের প্রভু পৌর্তুগীজদের নিকট থেকে অনুমতি না নিয়ে যারা নৌ-চলাচল করতে যায়, তাদের মালপত্র বাজেয়াপ্ত করে নেবার যুক্তিসংগত অধিকার পোর্তুগীজদের আছে।

শুধু পোর্তুগীজই নয় ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো সবাই তাদের প্রয়োজনের সময় অকুণ্ঠচিত্তে এই যুক্তি প্রয়োগ করে এসেছে। ইতিহাসের দলিলপত্রে তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। শোষণের প্রয়াজেনের তাগিদে শুধু বিবেক নয়, তারা সাধারণ চক্ষুলজ্জাটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছে। এই যুক্তিকে তারা শেষ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। তারা সবাই খোলাখুলিভাবেই একথা বলে দিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন? সে তো ইউরোপের জাতিগুলোর নিজেদের ভেতরকার ব্যাপার। লণ্ডন বা প্যারিসে যা বর্বরতা বলে আখ্যা পায়, পিকিং-এর বুকে তাকেই সভ্যজনোচিত আচার বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ইংল্যাণ্ডে আফিং সেবন আইন দ্বারা নিষিদ্ধ, কিন্তু চীনের আইন লঙ্ঘন করে তাদের দেশে আফিমের ব্যবসা চালু করবার জন্য চাপ দিতে ইংরাজের বিবেকে এতটুকু বাধে নি। ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে হংকং চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট স্বচ্ছন্দচিত্তে ঘোষণা করলেন, আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা আবদ্ধ বলে প্রত্যেক সভ্য জাতিই কতকগুলো অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, কিন্তু তাই বলে চীন-সম্বন্ধে সেকথা প্রযোজ্য হতে পারে না।

ভাস্কো দ্য গামা কালিকটে এসে পৌছবার আগেই তাঁর দস্যু-বৃত্তির কাহিনী সেখানে পৌছে গিয়েছিল। এই সমস্ত খবর শুনে সমস্ত নগরে আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে হজ-প্রত্যাগত যাত্রীদের পুড়িয়ে মারবার সংবাদটা কি মুসলমান কি হিন্দু সবার মনেই পোর্তুগীজদের বিরুদ্ধে দারুণ ঘৃণা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। এরা কি মানুষ না পশু, অবাক হয়ে সেকথাই ভাবছিল তারা। কিন্তু মানুষই হোক, আর পশুই হোক এদের প্রতিরোধ তো করতেই হবে।

তা তো হবে, কেউ কেউ প্রশ্ন তুলল, কিন্তু ওদের-যে কামান আছে, আর সে কামান সত্য সত্যই আগ্নিবর্ষণ করে। এ তো আর শোনা কথা নয়, নিজের চােেখই তারা দেখেছে কি ভয়ানক সেই দৃশ্য! আগুনের গোলাগুলো লাফিয়ে এসে পড়ে, ভেঙ্গে যায়, আর চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে।

কিন্তু কি হোল শেষ পর্যন্ত? ক্যাব্রাল পারলেন তাদের সঙ্গে? কি করল ওদের কামান? শেষকালে ক্যাব্রাল তো কোনমতে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন।

কথা ঠিক, সবাই সে কথা সমর্থন করল। কিন্তু তবু মনের মধ্যে কত রকম আশঙ্কা ঘনিয়ে উঠতে থাকে। তারা আফসোস করে বলল, আহা আমাদের যদি কামান থাকত!

আরব বণিকেরা শুধু বাইরে থেকেই এখানে বাণিজ্য করতে আসে না। অনেক আরব বণিক এখানে বাণিজ্য করতে এসে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। এখন কালিকটকেই তারা তাদের স্বদেশ বলে মনে করে। কালিকটের হিন্দু বণিক, আরব বণিক, সবাই এই দুর্দিনে একমন হয়ে দাঁড়ালেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন ওই পোর্তুগীজ দস্যুরা যদি জয়লাভ করতে পারে, তবে সর্বপ্রথমেই তারা এখানকার বণিকদের উৎসন্ন করে তাদের জায়গা দখল করে বসবে। এদেশের কাউকে আর বাণিজ্য করে খেতে হবে না। তারা সংকল্প নিল, এই বিদেশী আক্রমণকারীদের বিতারিত করবার জন্য, তারা ঐকবদ্ধ হয়ে রাজার পেছনে দাঁড়াবে। তাদের এই দৃঢ়-সংকল্প শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। বিদেশী চক্রীরা নানাভাবে চেষ্টা করেও তাদের এই ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারে নি।

জামোরিন বুঝতে পেরেছিলেন সামনে অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষায় পৌঁছোবার উপায় নেই। পোর্তুগীজ বণিকদের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য বুঝতে তাঁর বাকী ছিল না। আর একথাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এই যুদ্ধ একদল বণিকের বিরুদ্ধে নয়, স্বয়ং পোর্তুগাল-রাজের নির্দেশেই এই যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। এ সম্বন্ধে আরব বণিকরা তাকে প্রথমেই সতর্ক করে দিয়েছিল। তবু তিনি পোর্তুগীজ বণিকদের সঙ্গে যথাসম্ভব ভাল ব্যবহার করেই আসছিলো। যাতে সকলের সঙ্গে শান্তি বজায় রেখে চলা যায়, সেই ভাবে কাজ করাই তার চিরদিনের নীতি। দীর্ঘদিন ধরে শান্তি অব্যাহত আছে বলেই এখানকার বাণিজ্যের এত উন্নতি হয়েছে। আর বাণিজ্যের উন্নতির ফলে এই রাজ্যের এমন সমৃদ্ধি। এইজন্যই তিনি প্রথমে পোর্তুগীজদের বিরুদ্ধে আরব বণিকদের হুঁশিয়ারীটা তত গায়ে মাখেন নি।

কিন্তু এত ভাল ব্যবহারের প্রতিদানে ওদের কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পান নি কখনও। ওদের ব্যবহার উদ্ধত, চালচলন অসংযত, আর ওদের কার্যকলাপ পদে পদেই ধৈর্যচ্যুতির কারণ ঘটিয়েছে। তারপর ক্যারেল যখন নগর ধ্বংস করবার জন্য কামান দাগলেন, তখন তিনি বুঝলেন, বৃথা চেষ্টা, শুধুমাত্র এক পক্ষের চেষ্টায় শান্তিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। ও পক্ষ-যে শান্তি ভঙ্গ করবার উদ্দেশ্য নিয়েই মারমুখো হয়ে এসেছে। তখন থেকেই তিনি আত্মরক্ষার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়ে উঠলেন। প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর তুলনায় কালিকটের জাহাজ সংখ্যা অনেক বেশী। তা হলেও তিনি আরও নতুন নতুন জাহাজ নির্মাণ করতে লাগলেন।

ভাস্কো দ্য গামার সংবাদ এসে পৌছবার পর জামোরিন নগরের বণিকদের ডাকিয়ে এনে বললেনঃ আপনাদের জন্যই কালিকটের এত সমৃদ্ধি, দেশবিদেশে এত প্রতিষ্ঠা। এই দুঃসময়ে আমি আপনাদের উপর ভরসা করে বসে আছি। এই সংকট থেকে যাতে দেশকে মুক্ত করতে পারি, আপনারা সে বিষয়ে সাহায্যে করুন।

নিশ্চয়, নিশ্চয়, বণিকেরা বলে উঠলেন, এ তো আমাদের কর্তব্য। আমাদের যথাসাধ্য আমরা অবশ্যই করব।

জামোরিন প্রত্যাশা ভরা দৃষ্টি নিয়ে বৃদ্ধ আরব বনিক খোজা আম্বরের মুখের দিকে তাকালেন। খোজা আম্বর কালিকটের সবচেয়ে বড় বণিক। শুধু বণিক হিসেবেই তিনি বড় নন, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার জন্য তিনি নগরের সম্মানিত বণিকদের মধ্যে অন্যতম।

জামোরিনের চোখে যেই প্রশ্ন ছিল, যেন তার উত্তর দিয়েই খোজা আম্বর বিনয় সহকারে বললেনঃ আমর কিইবা আছে, আর কিইবা আমি দিতে পরি? তবে এইটুকু আমি বলতে পারি, আমার যে-সমস্ত জাহাজ আছে, আমি তার সবগুলোকেই আপনার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি প্রয়োজন বুঝে এগুলোর সদ্ব্যবহার করুন।

বণিকেরা ধন্য ধন্য বলে বৃদ্ধ খোজা আম্বরকে অভিনন্দন জানালেন। তারপর তারা সবাই রাজাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, আর বেশী কথা বলার দরকার কি? আপনি আমাদের যার কাছে যখন যা চাইবেন, আমরা অকুণ্ঠচিত্তে তাই দেব। জামোরিন প্রীত হয়ে বললেন, আপনারা আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন। কিন্তু চিন্তা করবার মত অনেক কিছুই ছিল। একজন আরব বণিক বললেন, এ তো হোল, কিন্তু আমাদের- যে একটা কামানও নেই। আমাদের সৈন্যরা কামানের বিরুদ্ধে কি দিয়ে লড়াই করবে? অত্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন! কিন্তু এর উত্তরে বলার মত কিছুই তার ছিল না। তিনি বললেন, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন আপনি। একথাটা ভেবে দেখতে হবে আমাদের।

কিন্তু একথা ভেবে দেখবার মতো সময় কোথায় তখন? সেই দিনই চরের মুখে সংবাদ পাওয়া গেল, ভাস্কো দ্য গামার বহর কোচিনের কাছাকাছি এসে পৌছে গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই পরামর্শ সভা বসল। নৌ-সেনাপতি কাশিম বললেন, আমরা ওদের আমাদের বন্দরের কাছে আসতে দেব না, এগিয়ে গিয়ে আক্রমণ করব।

তাই স্থির হোল। কোচিনের কাছে কালিকটের যুদ্ধবহর পোর্তুগালের যুদ্ধবহরের সঙ্গে মোকাবিলা করল।

কিন্তু এর নাম যুদ্ধ? একদিকে পোর্তুগীজদের জাহাজ থেকে কামানগুলো অগ্নি উদগিরণ করে চলেছে। অপর দিকে কালিকটের জাহাজে আস্ত্রের ঝঞ্চনা। ঢাল, তারোয়াল দিয়ে কি আর কামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা চলে? চলুক আর নাই চলুক, যুদ্ধ কিন্তু চলল। খোজা আম্বরের ভারী ভারী জাহাজগুলো কামানের গোলার ঘায়ে জখম ও অচল হয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু কালিকটের নৌ-সেনাপতি কাশিম সেদিন যে-রণচাতুর্য প্রদর্শন করলেন, তার তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিনি তাঁর ছোট ছোট জাহাজগুলোকে এমন কৌশলের সঙ্গে পরিচালিত করছিলেন যে, ওরা কিছুতেই তাদের উপর কামান দাগতে পারল না। এই ক্ষিপ্রগতি হালকা জাহাজগুলো পোর্তুগীজদের জাহাজগুলোকে বোলতার মত ঝাঁকে ঝাঁকে ঘিরে ফেলল। এমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ভাস্কো দ্য গামার জীবনে আর কখনও বোধ হয় নি। তিনি এদের হাত থেকে কোনমতে অব্যাহতি পেয়ে যুদ্ধে ইস্তফা দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলেন। এ যুদ্ধের-এ এমন পরিণতি ঘটতে পারে, একথা ভাবা খুবই কঠিন। এর পর ভাস্কো দ্য গামার নাম আমরা আর শুনতে পাই নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *