বিরলে নিরালায়
দাড়ি কামাতে-কামাতে ব্যথাটা শুরু হল। শূন্য থেকে হঠাৎ উঠে আসা উল্কার মতন। খড়ের ঘরে দপ করে আগুন জ্বলে ওঠার মতন। এ ব্যথা চিনতে কখনও ভুল হয় না।
এক্ষুনি শুয়ে পড়া নিয়ম। এক পা-ও না হেঁটে, এই বাথরুমের মেঝেতেই। কিন্তু কতকগুলো। জিনিস করা যায় না। কিছুতেই যায় না। যতক্ষণ জ্ঞান থাকে। মুখের আধখানায় সাবান মাখানেনা, হাতে রেজার স্টিক, এই অবস্থায় প্রতুল সেনগুপ্ত বাথরুমের মেঝেতে শুয়ে পড়তে পারে না।
প্রতুল আয়নায় দেখল, তার কপালে, এই শীতের সকালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। বাঁ-হাতটা অবশ হয়ে আসছে। ব্যথাটা তরঙ্গের মতন এক-একবার প্রবল ঝাপটা মেরে তার চেতনা কেড়ে নিতে চাইছে, আবার একটু ফিকে হয়ে যাচ্ছে যেন।
ব্যথার চেয়েও প্রবল একটা রাগ ছড়িয়ে পড়ল তার মাথায়। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল, গডড্যম ইট! আমায় ভয় দেখাতে চাইছে!
আস্তে আস্তে বাথরুমের দরজার ছিটকিনিটা খুলে দিল সে। তারপর দরজাটা ফাঁক করে রাখল একটু। অনেক সময় দরজা ভেঙে বার করতে হয়, সে জানে। বন্ধ বাথরুমের মধ্যে এই রকম ব্যথা এর আগে অনেককে হানা দিয়েছে।
তারপর দাড়ি কামানো শেষ করল। মাথা নীচু করে মুখটা আর দেওয়া হল না, ব্যথাটা এবারে তার টুটি চেপে ধরেছে। বুকের তোয়ালেটা মুখে বুলিয়ে সে এক-পা এক-পা করে হেঁটে এল নিজের শোওয়ার ঘরে। বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে সে সাদা ছাদ দেখল। সদ্য কালি ফেরানো হয়েছে, ঘরের দেওয়াল ও ছাদ ধপধপে, এই প্রথম প্রতুলের মনে হল, ঠিক হাসপাতালের মতন।
বাইরে একটা চমৎকার সকাল। এত ভোরে প্রতুল সচরাচর জাগে না, তাই এরকম সকাল দেখা যায় না। জানলার গায়ে যে রোদ পড়েছে, তা ঠিক এক থোকা আঙুর ফলের মতন, হ্যাঁ, সেইরকমই মনে হয়। বাইরে পাখিটাখিও ডাকছে। ওই পাড়ায় পাখিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না প্রতুলের।
রাস্তায়, এমন কি বাড়ির মধ্যেও যেসব শব্দ, তার মধ্যে ফুটে উঠছে একটা চাপা উল্লাস। আজ একটি বিশেষ দিন।
দ্রুত হাতে চুলে চিরুনি চালাতে-চালাতে ঘরে ঢুকে রানী বলল, এ কী, তুমি শুয়ে পড়লে যে?
প্রতুল মুখে খানিকটা হাসি আঁকল। একটু হালকা গলায় বলল, তোমরা তৈরি হও না, আমি ততক্ষণ কাগজটা পড়ে নিই।
খবরের কাগজটা পাশেই, সেটা তুলে ধরতে হল মুখের সামনে। এতে মুখ আড়াল করা যায়। ব্যথাটা যেন তার বুক ফাটিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
সেই রাগের ভাবটা এখনও ধিকিধিকি করে জ্বলছে মাথায়, তার সঙ্গে একটু-একটু করে মিশছে নৈরাশ্য। আজই, এখনই এটা আসার দরকার ছিল? কাল রাত্তিরে, কিংবা ঘুমের মধ্যে এরকম হলে কী ক্ষতি ছিল। আজ যে একটা অন্যরকম দিন।
মামুন আর টোটো অনেকক্ষণ থেকেই নতুন পোশাকে তৈরি। ওরা ছুটোছুটি করছে সারা বাড়ি কাঁপিয়ে। এক একবার দুদ্দাড় করে নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে।
দমাস করে দরজা ঠেলে ঢুকে টোটো ঘোষণা করল, মাসীমণিরা এসে গেছে!
ঘরে এক ঝলক সোনালি আলো নিয়ে এল রানীর ছোট বোন বনানী। তার বড়-বড় চোখ, তার হাসিমাখা ওষ্ঠে আসে এই রকম আলো। তার অস্তিত্বেই আছে সুস্বাস্থ্যের আভা।
সামান্য ব্যাপারেই বনানীর মুখে বেশি বিস্ময় ফোটে। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, এ কী, প্রতুলদা, তুমি এখনও শুয়ে? কী ব্যাপার?
উচ্ছল, হালকা গলায় প্রতুল বলল, জানো না, আমার তৈরি হতে ঠিক দু মিনিট লাগে? তোমার দিদিকে তাড়া দাও!
—চান করবে না?
—আমি নদীতে গিয়ে সাঁতার কাটব!
প্রিয় শ্যালিকার জন্য কত কষ্ট করে যে প্রতুল তার কণ্ঠে এই লঘু সুর এনেছে, তা আর কেউ জানবে না। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কারডিয়াক অ্যারেস্ট বুঝি বলে একেই!
বনানী মুহূর্তে মুখ ফিরিয়ে বলল, এই দিদি, আমার ছেলের জন্য জল ফুটিয়ে নিতে হবে রে, আমি ফ্লাস্ক আনতে ভুলে গেছি।
একটা সুবিধে এই যে প্রতুল আগে থেকেই এরকম একটা রেকর্ড করে রেখেছে যে সে জিনিসপত্র গুছোবার ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারে না। সুতরাং সারা বাড়িতে যে প্রস্তুতি পর্ব চলছে, তাতে আপাতত আর কোনও ভূমিকা নেই।
ড্রাইভার এসে বলল, দাদাবাবু, একটা ফ্যান বেল্ট নিতে হবে। আর একটা অ্যাকসিলারেটারের তার—
রাস্তা থেকে শুধু এইটুকু বলে প্রতুল পাশ ফিরল। রানী খুব মনোযোগ দিয়ে রাস্তায় কী যেন দেখছে, এদিকে একবার মুখ ফেরাতেই প্রতুলের সঙ্গে চোখাচোখি হল, প্রতুল বলল, রানী—
সে বলতে যাচ্ছিল, রানী, সব বন্ধ করে দাও, শিগগির ডাক্তার ডাকো, আমি মরে যাচ্ছি!
কিন্তু সে কথা সে বলল। থেমে গিয়ে, একটু সময় নিয়ে সে বলল, আমার পার্সটা তোমার সঙ্গে নিও। আর হুইস্কির বোতলটা—।
এখন সবকিছু থামিয়ে দেওয়া যায় না। এমন চমৎকার শীতের সকালে স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা, শ্যালিকা, এক জোড়া বন্ধু ও বন্ধুপত্নী বেড়াতে যাওয়ার জন্য উৎফুল্ল হয়ে আছে। এর মধ্যে প্রতুল একবার তার ব্যথার কথা বললেই সব থেমে যাবে। বদলে যাবে রানী আর বনানীর মুখ। বাচ্চারা ঠিক বুঝতেই পারবে না। বন্ধু আর বন্ধুপত্নী মোটেই বিরক্ত বা দুঃখিত হবে না, বরং তারা দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে প্রতুলের খাটের পাশে এসে দাঁড়াবে।
এরকম স্বার্থপরের মতন কাজ প্রতুল কখনও করেছে আগে? তার নিজের কোনও কারণে অন্যদের সুখ নষ্ট করে দেওয়া?
যদি এমন হয়, ডাক্তার আসে, এত সকালে তাঁকে আনতে বেশ ঝামেলা করতে হবে, সঙ্গে ইসি জি যন্ত্র, বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম ক্যানসেলড, সারা বাড়ি থমথমে। সব পরীক্ষা করে দেখা হল। কিছুই হয়নি। ডাক্তার বললেন, গ্যাসের চাপ দিয়েছিল, তাতে অনেক সময় মনে হয় বটে…।
প্রতুল এত ভীতু? তার এই দর্শনটা সে এতকাল সগর্বে বলে এসেছে, আমি আগামীকালের কথা কখনও চিন্তা করি না, আমার আজকের জীবনটাই আসল জীবন!
প্রতুল উঠে বসল।
বনানী অর্থাৎ টিংকু এসে বলল, প্রতুলদা, একটা সিগারেট খাব!
কাল রাত্তিরেই দশ প্যাকেট সিগারেট এনে রেখেছে প্রতুল। বাইরে গেলে তার নিজস্ব ব্র্যান্ড যদি পাওয়া না যায়, সেইজন্য সেসব সময় স্টক রাখে। টিংকু চাইলে সে বরাবর দুটা সিগারেট একসঙ্গে ঠোঁটে চেপে ধরিয়েছে।
এই অবস্থায় সিগারেট? তার চেয়ে আর্সেনিক খেলেই বা ক্ষতি কী?
টিংকুর ঝলমলে মুখখানার দিকে তাকিয়ে প্রতুল বলল, নিশ্চয়ই! লাইটারটা ওই যে, এনে দাও তো!
দুটি সিগারেটই ধরাল প্রতুল। নিজেরটা ইনহেল না করলেই হল। ফুকফুক করে টানবে।
জামাইবাবুর কাঁধে হাত রেখে টিংকু বলল, এবারে উঠুন, আমরা সব রেডি।
টিংকু এত কাছে দাঁড়িয়ে বলেই বোধহয় ব্যথাটা এখন একটু কম লাগছে। তবে শ্বাসকষ্টের ভাবটা এখনও রয়েছে। বুকের ওপরে যেন একটা পাথর চাপানো।
প্যান্ট শার্ট পরতে গেলে, এ ঘর থেকে বেরিয়ে, বারান্দা দিয়ে হেঁটে অন্য ঘরে যেতে হবে। অন্তত কুড়িটা স্টেপ। প্রতুল কতবার ডাক্তার বন্ধুদের কাছে শুনেছে, চেষ্ট পেইন হলে এক পা-ও হাঁটা। উচিত নয়। প্রথম চিকিৎসাই হল সাবধানে শুয়ে থাকা।
খাট থেকে নেমে প্রতুল ধীর পায়ে হেঁটে গেল পোশাকের ঘরে। এ ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের দরজাটা হাট করে খোলা, সিগারেটটা ছুড়ে কমোডের মধ্যে ফেলে দিল প্রতুল। রানীর চোখে এটা একটা অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু ফেরা হবে তিনদিন পর। কিংবা, এটার জন্য আর কোনওদিনই রানী তাকে বকুনি দিতে পারবে না।
শার্ট গায়ে গলাবার পর, প্যান্টটা পরবার জন্য একটা পা তুলতেই ঠিক যেন একটা বন্দুকের গুলি লাগল প্রতুলের বাঁ-বুকে। অসহ্য ব্যথায় বসে পড়ল সে। সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। সে আর পারছে না। শার্টের নীচে শুধু জাঙ্গিয়া পরা, প্যান্টের এক চোঙার মধ্যে একটা পা ঢোকানন, এরকম অসহায় অবস্থায় বসে আছে প্রতুল, দরজা খোলা, যে-কোনও সময় বাচ্চারা, কিংবা রানী কিংবা টিংকু এসে পড়তে পারে।
সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ হিসহিসে গলায় প্রতুল বলল—ইফ ইউ ওয়ান্ট টু কিল মি, কিল মি হোয়েন আই অ্যাম অ্যালোন।
কথাটা বলেই, ব্যথার চেয়েও বেশি বিস্ময়ে অবসন্ন হল প্রতুল। এরকম কথাটা সে বলল কাকে! এরকম অদ্ভুত ইংরিজিতে? ইউ? সে, প্রতুল সেনগুপ্ত, যার কাছে অনির্দেশ্য কিছুই নেই, সে কাকে সম্বোধন করছে? দেওয়ালকে?
হুদা হেল ইজ দ্যাট ইউ? ড্যাম ইট!
তক্ষুনি বেশ দাপটের সঙ্গে উঠে দাঁড়াল প্রতুল। দ্রুত প্যান্ট পরে নিয়ে কোমরে বেল্ট বাঁধল; বেরিয়ে এসে বলল, টিংকু, চিরুনিটা দাও!
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেনীচে নেমে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অসহিষ্ণু গলায় বলছে, ওঠো, ওঠো, আর দেরি নয়! রোদ চড়ে যাচ্ছে!
তাকে ভয় দেখানো হচ্ছে? মৃত্যু ভয়? একটা থাপ্পড় কষাবে সে মৃত্যুর গালে। উনপঞ্চাশ বছর বয়েস, তার জীবনে কোনও অনুতাপ নেই। কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। হ্যাঁ, বেঁচে থাকা খুব সুন্দর, খুবই উপভোগ্য, কিন্তু মরতে হলেও সেটুসকি দিয়ে মরে যেতে পারে।
জেদ করে সে একটা সিগারেট ধরাল। ইউ? তার বেঁচে থাকার মধ্যে কোনও ইউ নেই। মৃত্যু তো জাস্ট একটা হ্যাপনিং, জন্মানোর মতনই।
সবাই পেছনে বসল, প্রতুল সামনে। লম্বা রাস্তা, ড্রাইভারকে মাঝে-মাঝে বিশ্রাম দিয়ে, তার গাড়ি চালাবার কথা। পথ থেকে প্রকাশ আর শ্রাবণীকে তুলে নিতে হবে।
যথারীতি প্রকাশ এখনও তৈরি হতে পারেনি। ওপরের বারান্দা থেকে পা-জামা পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় ঝুঁকে প্রকাশ বলল, এই ওপরে এসো তোমরা! চা খেয়ে যাবে!
টিংকু ছটফটে। বাইরে বেড়াতে যাওয়ার নামেই তার শরীরে একটা গতি এসে গেছে, সে বলল, না, না, আমরা আর চা খাব না। আপনারা চলে আসুন!
প্রকাশ বলল, আরে, ট্রেন ধরার তাড়া তো নেই। এসো এসো, লুচি ভাজা হচ্ছে।
—লুচি খাব না!
শ্রাবণীর স্নান হয়নি এখনও। আরও দশ পনেরো মিনিট তো লাগবেই!
স্নান না করে মেয়েরা বাড়ি থেকে বেরুতে পারে না, এটা যেন একটা ধর্মীয় নির্দেশ। রানী স্নান করেছে, টিংকু স্নান করেছে, শ্রাবণীও তো স্নান করবেই। প্রতুল স্নান করেনি। প্রকাশও করবে না নিশ্চয়ই।
রানী বলল, চল, তাহলে ওপরে গিয়ে বসি!
ওপর মানে তিনতলার সিঁড়ি। প্রতুল গ্যাসের ব্যথা চেনে। জল খেলে কমে যায়। একবার দার্জিলিং-এ এই অন্যরকম ব্যথা হয়েছিল। ডাক্তার পরে বলেছিল, ইসকিমিয়া। সিগারেট বন্ধ, রাত-জাগা একেবারেই চলবে না, মদ তিন পেগ। প্রতুল কোনওটাই মানেনি।
এবারে ব্যথা অনেক বেশি, একেবারে অমোঘ। আর যাই হোক, এখন তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে। ওঠার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আর কিছু না, যদি সিঁড়িতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তারপর ডাক্তার ডাকবার আগেই…। একটা বিশ্রী, নাটকীয় ব্যাপার। প্রতুল এইরকম নাটকই তো অপছন্দ করছে। কেন আজ সবাই মিলে আনন্দ করে বেড়াতে যাওয়ার দিনেই এই উৎপাত!
ইংরিজি বাক্য কিংবা ইউ সম্বোধনটার কোনও মানে হয় না, কিন্তু প্রতুল তখন বলতে চেয়েছিল— নিরালায়, নিরিবিলিতে আসুক মৃত্যু, তখন সে দেখবে, প্রতুল কত সহজভাবে তাকে গ্রহণ করতে পারে।
প্রতুল বলল, তোমরা ওপরে গিয়ে বসো, আমি ততক্ষণে সামনের পাম্প থেকে গাড়িতে তেল ভরে আনছি।
পাম্পে গিয়ে তেল ভরবার পর প্রতুলের মনে পড়ল তার কাছে টাকা নেই। মানি ব্যাগটা দিয়েছে রানীর কাছে। কেন সে তখন রানীর কাছে টাকা রাখার কথা বলল? কোনওদিন তো এমন হয় না। সে পুরুষ, সক্ষম দলপতি, বাইরে যাওয়ার পথে তাকে অনেক খরচ করতে হবে, তার কাছেই তো টাকা রাখবার কথা।
ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিল প্রকাশের বাড়িতে মানি ব্যাগ আনবার জন্য।
সাদা দেওয়ালকে সেই কথাটা শোনাবার পর কিন্তু ব্যথাটা যেন অনেকটা কমে গেছে। একেবারে থামেনি। ঢেউয়ের মতন ঝাপটা মারছে মাঝে-মাঝে। দমবন্ধ ভাবটাও একটু কেটেছে। এরকমই হয়, একটুখানি স্বস্তি ফিরে আসে, তখন অসাবধান হয়ে একটু পরিশ্রম করলেই আবার ক্যাঁক। করে ধরে। তখন এক ঝাপটায় একেবারে ফেলে দেয়। যেমন দিয়েছিল বিমলকে। আসানসোলে হোটেলের ঘরে। দরজা ভাঙার পর দেখা গিয়েছিল, সে বাইরে যাওয়ার পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে দরজার কাছেই মাটিতে লুটিয়ে আছে। হাতে দেশলাই।
প্রকাশ আর শ্রাবণী নেমে এসেছে, এবারে সামনে পেছনে করে বসতে হবে। ড্রাইভার বাদ দিয়ে তিনটি নারী, দুটি পুরুষ, চারটি বাচ্চা।
এর মধ্যে দুটি বাচ্চাকে সামনেই দিল, টিংকু বলল, আমি প্রতুলদার পাশে গিয়ে বসব। আমি কিন্তু জানলার ধারে, প্রতুলদা!
টিংকুর বর অমিতাভ অফিসের ট্রেনিং নিতে চেকোশ্লোভাকিয়া গেছে, প্রোষিতভর্তৃকা টিংকু এখন
তো জামাইবাবুর একটু আদর কাড়তেই পারে।
যদিও কপালে ঘাম, তবু মাঝে-মাঝে শীতে, কাঁপুনি দিচ্ছে প্রতুলের শরীরে। টিংকুর পাখির মতন শরীরের উত্তাপ বুকের কাছে পেয়ে তার ভালো লাগে। টিংকুর কাঁধে হাত রেখে সে তাকে বুকের সঙ্গে ছুঁইয়ে রাখে।
শহর ছাড়িয়ে বাইরে পড়তেই শ্রাবণী গান ধরে। শ্রাবণী চমৎকার গান করে, রানীরও গানের স্টক অনেক, সে-ও গলা মেলায়। টিংকু সব গান দু-এক লাইন করে জানে, তারও খুব উৎসাহ। রাস্তার ধারের গাছপালায় এই রিনরিনে কণ্ঠস্বরগুলির ঝাপটা লাগে।
একটু পরেই টিংকু তার অতি বিস্মিত চোখ দুটি ফিরিয়ে জিগ্যেস করে, এ কি, প্রতুলদা, তুমি গাইছ না?
প্রতুলের গলায় সুর নেই, কিন্তু কণ্ঠস্বর জোরালো। কোরাস গানে তার কণ্ঠস্বর থামের কাজ করে। প্রত্যেকবার বাইরে বেরুলেই এরকম হয়।
যেতে হবে বহরমপুরে, পাঁচ-ছঘণ্টার পথ, সঙ্গে বাচ্চারা আছে। দু-তিনবার থামতেই হবে। পৌঁছতে-পৌঁছতে সেই সন্ধে। সেখানে সিদ্ধার্থের বিরাট বাড়ি, অনেক রকম ব্যবস্থা সমেত সিদ্ধার্থ ব্যগ্র হয়ে বসে আছে সেখানে।
সুতরাং অনেকখানি পথ, অনেক গান হবে। এর মধ্যে প্রতুল চুপ করে বসে থাকলে সবাই ভাববে, প্রতুলের মুড নেই।
প্রতুল গান ধরতেই টিংকু বলল, এই, এই প্রতুলদা, তোমার স্কেল ঠিক হচ্ছে না!
শুধু স্কেল কেন, গলার আওয়াজও একেবারে অন্যরকম। প্রতুল নিজেই যেন চিনতে পারছে না। এ কার গলা? হ্যাঁ, এটা একটা স্পষ্ট লক্ষণ, গলার আওয়াজ বদলে যায়। মুখটাও যেন একটু বেঁকে যাচ্ছে প্রতুল চোয়ালে হাত বুলিয়ে দেখল, ঠিক, চোয়ালে অন্যরকম চাপ।
গান গাইবার জন্য চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্যথাটা আবার তীব্র হয়ে ফিরে এসেছে। মৃত্যুর আগে সিন্ধু সারসেরা শেষবারের মতন মধুরতম সুরে ডেকে ওঠে, মানুষ তা পারে না। ট্রেন যাত্রার মধ্যপথে এক অচেনা স্টেশনে নেমে পড়ে, দ্বিতীয় তানসেনপ্রতিম আবদুল করীম খাঁ, তানপুরাটা পাশে নিয়ে শুধু ঝংকার তুলেছিলেন, গান গাইতে পারেননি, ঠোঁট ফাঁক করলেও স্বর ফোটেনি।
যদি এই সময়টাতেই চরম মুহূর্ত আসে? প্রতুল গাড়ি থামাতে বলবে। আস্তে-আস্তে নেমে গিয়ে। একটা বড় গাছতলায় ঘাসের ওপর শুয়ে পড়বে। ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। আকাশ দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যাবে।
কিন্তু সেটাও কি নাটকীয় হয়ে যাবে না? মেয়েরা কাঁদবে। বাচ্চারা হতভম্ব, প্রকাশ বেচারা এমনই বিমূঢ় হয়ে পড়বে যে—না, না, তার দরকার নেই।
আমাকে এমনভাবে মেরো না। এমন নাটক করে সবাইকে বিব্রত করতে চাই না। তুমি আমাকে বিরলে, নিরালায় মৃত্যুর দ্বার দেখিয়ো। তখন দেখো প্রতুল সেনগুপ্তের জীবন দর্শন, হাসতে হাসতে টুপী তুলে মৃত্যুর দরজা ঠাস করে খুলে সে চলে যাবে। নো রিগ্রেটস নো অ্যাম্বিশানস!
তুমি? গড ড্যাম ইট!
কে তাকে মারবে? তার নিজের হৃৎপিণ্ড থেমে যাবে, সে মরবে, এতে কার কী বলার আছে? বেশি মদ, বেশি সিগারেট, বেশি পরিশ্রম, বেশি রাত-জাগা, এসবই তো তার নিজের সিদ্ধান্ত! তার স্বেচ্ছা-জীবন, স্বেচ্ছামৃত্যু! ওষুধ, একটা কিছু ওষুধ দিয়ে এই সংকটটা কাটিয়ে ওঠা যায় না? মধ্য বয়সের অন্য কোনও ব্যাধি স্পর্শ করেনি প্রতুলকে। একমাত্র অ্যান্টাসিড ছাড়া অন্য কোনও ওষুধ থাকে না তার কাছে। দুটো জেলুসিল সকালেই খাওয়া হয়ে গেছে। এটা জেলুসিলের কেস নয়।
দম আটকে আসছে, দম আটকে আসছে। একটা কিছু চাই। হঠাৎ প্রতুলের ইচ্ছে হল, টিংকুর প্রস্ফুটিত মুখখানি ফিরিয়ে একটা পরিপূর্ণ চুম্বন দিতে। জলে-ডোবা মানুষকে যেমন কৃত্রিম শ্বাস দেওয়া হয়, সেইরকম, টিংকু, তোমার অফুরন্ত জীবনী শক্তি থেকে একটুখানি আমায় দেবে? আমার নিশ্বাস বড় কম, আর খরচ করতে পারছি না, তোমার অবুদ সংখ্যক নিশ্বাস থেকে কয়েক লক্ষ অন্তত।
টিংকু যদি অবাক হয়, তা হলে প্রতুল মুখ ফিরিয়ে রানীকে আর প্রকাশদের বলবে, ওগো, আমার সময় ফুরিয়ে আসছে, এখন টিংকু যদি একটা উষ্ণ চুম্বন দিয়ে আমায় বাঁচাতে পারে, তোমরা অনুমতি দেবে?
না, না, এটাও বড্ড বেশি নাটক! প্রতুল এর কিছুই করতে পারবেনা।
বিদ্যুৎ চমকের মতন মনে পড়ল, আর একটা ওষুধ আছে।
মুখ নীচু করে ফিসফিসিয়ে প্রতুল বলল, টিংকু, পায়ের কাছের ব্যাগ থেকে হুইস্কির বোতলটা বার করো তো।
আঁতকে উঠে টিংকু বলল, হুইস্কি? এখন?
দৃঢ় গলায় প্রতুল বলল, বার করো!
পেছন থেকে রানী আর শ্রাবণী এক যোগে বলল, এই সকালবেলা হুইস্কি? তুমি/আপনি পাগল হলে/হলেন? প্রকাশ বলল, আর একটু বেলা হোক, বিয়ার খাব। আমি বিয়ার নিয়েছি সঙ্গে।
প্রতুল ততক্ষণে নিজেই ব্যাগটা তুলে নিয়েছে নীচু হয়ে। অত্যন্ত দ্রুত আঙুলে বোতলটা খুলেই সে কাঁচা একটা বড় চুমুক দিল। রক্তের গতিবেগ বাড়িয়ে দেয় অ্যালকোহল। এখন হৃৎপিণ্ডের। মাসলগুলোতে রক্ত পাম্প করা দরকার। হায়দ্রাবাদ থেকে এক কর্নেল ফিরছিলেন জিপে, এমন সময় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, সঙ্গে ছিল একটা ব্র্যান্ডির বোতল, একটু-একটু করে চুমুক দিতে লাগলেন তাতে। সতেরো মাইল দূরে হাসপাতালে পৌঁছবার পর ডাক্তার বললেন, ওই যে আপনি ব্র্যান্ডি খেয়েছিলেন, সেইজন্যই বেঁচে গেলেন। কে যেন বলেছিল গল্পটা?
পেছনের সিটে সকালে হুইস্কি বিষয়ে প্রবল সমালোচনা হচ্ছে। আর একটা বড় চুমুক দেওয়ার পর মুখ ফিরিয়ে হাসিমুখে প্রতুল বলল, আমার যখন যা ইচ্ছে হয় তা-ই করি, জানো তো, শুধু শুধু আমায় বারণ করে কী লাভ?
সারা রাস্তায় যখনই ব্যথাটা বাড়ে, প্রতুল একটা করে চুমুক দেয়। ফলে তার ঠিক নেশা না হলেও শরীরটা হালকা হয়ে যায় আস্তে-আস্তে। মাথাটা টলটলে। ঠোঁটে হুইস্কির স্বাদ থাকলে সিগারেট টানতেই হয়। ইনহেল না করলে সুখ নেই। যা চলছে চলুক।
রানী বেশ রাগ করেছে, গান বন্ধ। প্রতুল যদি মুখ ফিরিয়ে বলে, কেন হুইস্কি খাচ্ছি, জানো? আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে! তা হলে বিরাট শব্দে একটা বজ্রপাত হবে না? ওর কথা সবাই বিশ্বাস করবে, কারণ প্রতুল সচরাচর মিথ্যে কথা বলে না। নিজের সম্পর্কে এরকম মিথ্যে তো বলবেই না। এরকম হঠকারি দুঃসাহস ওর পক্ষেই সম্ভব।
এরকম নাটকও পছন্দ করে না প্রতুল। এমনকী, রানাঘাট বা কৃষ্ণনগর পেরিয়ে যাওয়ার সময়। হায়দ্রাবাদের সেই কর্নেলের মতন সে কোনও হাসপাতালেও গেল না। কৃষ্ণনগরে তার এক বন্ধু থাকে, তার খোঁজ করলে, কোনও ভালো ডাক্তারকে দিয়ে চেক আপের ব্যবস্থাও তো করা যেত অনায়াসে। কিন্তু এরকম একটা কিছু উচ্চারণ করলেই রানীর সমস্ত ভ্রমণের আনন্দ নষ্ট হয়ে। যাবে। সবাই তাকে ভালোবাসে কেউ আর সুস্থির থাকবে না।
বহরমপুরে পৌঁছে গেল সন্ধের একটু আগেই। সিদ্ধার্থ আর অরুণা দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়, নেমে এল তরতর করে।
ব্যবস্থা সব দোতলায়, কিন্তু সেখানে তখুনি না উঠে প্রতুল মাতালের ভান করে গা গলিয়ে দিল বসবার ঘরে। উপুড় হয়ে কৃত্রিম নাক ডাকতে লাগল। টিংকু তার পিঠে একটা কিল মেরে বলল, ভালো লাগে না!
গঙ্গায় বেড়াবার জন্য নৌকোর ব্যবস্থা করে রেখেছে সিদ্ধার্থ। সেখানে মাছ ভাজা আর হুইস্কি, সঙ্গে সোডা, আইস বক্সে বরফ। কতরকম আহ্লাদের স্বপ্ন। কিন্তু প্রতুল যেতে পারবে না। জড়িত গলায় সে বারবার বলতে লাগল, তোমরা ঘুরে এসো। আমি ঘুমোব! আমি কাল যাব!
সবাই জানে, প্রতুল গোঁয়ার, একবার না বললে তাকে দিয়ে হ্যাঁ করানো মুশকিল।
সবচেয়ে বেশি রেগে আছে রানী। তার স্বামী এরকম অসময়ে মাতলামি করছে বলে খুবই অপমানিত হয়েছে সে। সিদ্ধার্থ আর অরুণা কী ভাবছে? প্রতুলের সঙ্গে একটা কথাও বলল না। সে। প্রতুল ইচ্ছে করে নাক ডাকার শব্দ করছে। টিংকুও তুলতে পারল না তাকে। সবাই পোশাক বদলে, আকাশে পঞ্চমীর চাঁদ ওঠার পর চলে গেল নদীতে।
সারা বাড়ি নিস্তব্ধ হওয়ার পর উঠে বসল প্রতুল। বুকে সেই ব্যথার বোধটা আর নেই। অনেকটা ভালো লাগছে। তবে বুকে একটা কিছু দাগ ধরিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই, বেশ দুর্বল লাগছে শরীরটা।
এখন ভেবেচিন্তে একটা কিছু করতে হবে। সিদ্ধার্থ ছাড়াও আরও বন্ধু আছে এখানে প্রতুলের। তার সহপাঠী সুকুমার এখানকার কলেজে পড়ায়। নিশ্চয়ই তার চেনা কোনও ডাক্তার আছে। সুকুমারকে গোপনীয়তার শপথ নেওয়াতে হবে আগে। তার চেনা ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করাবে। সাময়িক ওষুধ। খুব গুরুতর কিছু না হলে কারুকে জানাবার দরকার নেই। এখন যদি কিছু হয়ও, সবাই কি বলবে না যে সে ওদের আনন্দে বাধা সৃষ্টি না করার জন্য সবরকম চেষ্টা করেছিল। এখানে সিদ্ধার্থ আছে, তাঁর তাঁবে আর কোনও চিন্তা নেই।
এখন একটা রিকশা নিয়ে সুকুমারের বাড়ি খুঁজে যাওয়া। কিন্তু সুকুমারকে ডেকে পাঠালে হয় না? মফঃস্বলের রাস্তায় রিকশার ঝাঁকুনি…সেটা এড়াতে পারলেই ভালো।
সিদ্ধার্থের একটি খুব বিশ্বাসী লোক আছে। প্রতুল আগেও তো এসেছে, সে জানে। সেই লোকটিও কি গঙ্গায় গেছে?
বসবার ঘর থেকে বাড়ির ভেতর দিয়ে চলে এল প্রতুল। উঠোনের বদলে চমৎকার একটি সবুজ লন। তার এক প্রান্তে একটি ছোট ঘর, সেখানে সেই বিশ্বাসী লোকটি থাকে। দশটি টাকা বকশিশ দিলে সে আরও বিশ্বাসী হবে। সে গোপনে সুকুমারের কাছে তার চিঠি নিয়ে যাবে।
সারা বাড়ি এত অন্ধকার কেন, লোডশেডিং? কোথাও আলো নেই। বাগানের প্রান্তে ঘরটিও অন্ধকার। তবু সে দিকে কয়েক পা বাড়াতেই আবার সাঁ করে উঠে এল সেই ব্যথাটা, নিশ্বাস যন্ত্রে যেন একটা মোটা ছাঁকনি বসে গেল।
অমনি তার সামনে ঝলকে উঠল একটা চকচকে খড়গ। একটি গভীর কণ্ঠস্বর তাকে বলল, এবার? এখন তুমি প্রস্তুত? এখন তো তুমি বিরলে, নিরালায়…
কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ল প্রতুল। পরাজিত সৈনিকের আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে। তার সারা শরীর কাঁপছে।
এখন? এখানে? কেউ জানতে পারবে না? ওরা সবাই গঙ্গায়, নৌকোর ওপরে, গান গাইছে, জলের ছলচ্ছল শব্দ…শেষবারের মতন সে রানীকে দেখতে পাবে না, ছেলেমেয়েদের না, টিংকুকে না, বন্ধুবান্ধবদের না, রেল লাইনের ধারে পলায়নপর স্মাগলারের গুলি খাওয়া দেহের মতন সে পড়ে থাকবে এই উঠোনে?
সে ভয়ংকর কাতরভাবে বলতে লাগল, না, না, বাঁচিয়ে দাও, এবারকার মতন অন্তত, প্লিজ, সিগারেট ছেড়ে দেব, প্লিজ, হেমৃত্যু, আমি তোমার পায়ে ধরছি, আমি তোমার সামনে নাকে খত দিতে পারি, তোমার নোংরা পা ধোওয়া জল খেতে পারি, বাঁচিয়ে দাও, বাঁচিয়ে দাও, অন্তত এবারকার মতন…
এখানে তার কাপুরুষতার কোনও সাক্ষী নেই বলে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতেও শুরু করল প্রতুল। কম্পিত গলায় বলতে লাগল, আর একবার সুযোগ দাও, অন্তত আর একবার…।