বাড়িওয়ালি
লন্ডন থেকে শেষ বিকেলের ট্রেনে চেপে বসল বিলি উইভার। পথে সুইনডনে যাত্রা বিরতি হলো। গন্তব্য স্থল বাথ-এ যখন পৌঁছাল সে, ঘড়ির কাঁটা ন’টার ঘর ছুঁয়ে গেছে। প্লাটফর্মের বিপরীত দিকের উঁচু দালান-কোঠার মাথায় উঁকি দিতে শুরু করেছে চাঁদ, বরফ ঠাণ্ডা বাতাস ক্ষুরের পৌঁচ বসাল বিলির খোলা মুখে।
‘আচ্ছা,’ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে জানতে চাইল সে, ‘ধারে কাছে কোন সস্তা হোটেল নেই?’
‘বেল অ্যান্ড ড্রাগনে যেতে পারেন,’ জবাব দিল পোর্টার রাস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে। ‘খালি ঘর মিলতে পারে। এখান থেকে সিকি মাইল দূরে হোটেলটা। ওই যে ওদিকে!’
বিলি লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে হাতে সুটকেস তুলে নিল, তারপর হাঁটা দিল বেল অ্যান্ড ড্রাগনের উদ্দেশে। বাথ-এ এই প্রথম এসেছে বিলি। এখানে পরিচিত কেউ নেই। তবে লন্ডনে, ওদের হেড অফিসের কর্তা মি. গ্রীনস্লেড বলেছিলেন জায়গাটা ভারি সুন্দর। ‘থাকার একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে,’ বলেছিলেন তিনি, ‘ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার কাজ বুঝে নিও।’
সতেরোতে পা দিয়েছে বিলি। একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানীতে কিছুদিন হলো ঢুকেছে। ট্রেনিং শেষে এই শহরতলিতে পাঠিয়েছে ওকে কোম্পানী। গায়ে নেভী-ব্লু ওভারকোট, মাথায় নতুন ট্রিবলী হ্যাট আর কয়েকদিন আগে কেনা বাদামী সুট পরে বিলি রাস্তা দিয়ে চলেছে খোশমেজাজে। জীবনের প্রথম চাকরি এটা বিলির। সেই আনন্দে সারাক্ষণ সে আত্মহারা।
চওড়া রাস্তাটার আশেপাশে কোন দোকানপাট নেই, শুধু সমান আকৃতির লম্বা, উঁচু কিছু বাড়িঘর ছাড়া। প্রতিটি বাড়ির সামনে উন্মুক্ত বারান্দা, চার-পাঁচটা সিঁড়ির ধাপ পেরুলে সদর দরজা। এক সময় বাড়িগুলোর বেশ জৌলুস ছিল, লক্ষ করলে বোঝা যায়। তবে এখন প্রায় সবগুলোরই দৈন্যদশা, অযত্ন আর অবহেলায় দরজায় কাঠের কাজ দাঁত ভেংচে তাকিয়ে আছে, জানালাগুলোর গরাদ নেই একটারও, চাঁদের আলোয় হাঁ করে আছে নর কঙ্কালের খুলির মত।
হঠাৎ, কয়েক হাত দূরে, একটা স্ট্রীট ল্যাম্পের পাশের বাড়িটার জানালার দিকে চোখ আটকে গেল বিলির। জানালার কাঁচের গায়ে একটা সাইনবোর্ডে, বড় বড় অক্ষরে লেখা: বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট। বোর্ডটার ঠিক নিচে ভারি সুন্দর একটা ফুলদানী আঁকা।
দাঁড়িয়ে পড়ল বিলি। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। মখমলের সবুজ পর্দা ঝুলছে জানালার দু’পাশ থেকে। ফুলদানীটাকে ওগুলোর মাঝে অপূর্ব লাগছে। জানালার কাঁচে মুখ ঠেকাল বিলি। তাকাল ভেতরে। প্রথমেই চোখে পড়ল ফায়ার প্লেসটা। আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি। আগুনের সামনে, কার্পেটের ওপর পেটের কাছে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছে ছোট্ট একটা রোমশ কুকুর। আধো অন্ধকারে যতটুকু দেখা গেল, বিলি বুঝতে পারল ঘরটা বেশ দামী আর রুচিসম্মত আসবাবে সাজানো হয়েছে। ঘরের এক কোণে একটা পিয়ানো, বড় একটা সোফা আর বেশ কিছু পেটমোটা আর্ম-চেয়ার; আরেক কোণে বড় আকারের একটা কাকাতুয়া দেখতে পেল বিলি। এ ধরনের সুরুচিসম্পন্ন পরিবেশে এ রকম পশুপাখি ঘরের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে, মনে মনে ভাবল সে। হোটেলের চেয়ে জায়গাটা ভাল হবে, ধারণা করল বিলি। বয়সে তরুণ হলেও নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ তার, হৈ-হল্লা ভাল লাগে না। হোটেলে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি আশা করা বাতুলতা মাত্র। আর এখানে হোটেলের চেয়ে সস্তায় ঘর ভাড়া পাবার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। তবে এর আগে কখনও বোর্ডিং-হাউজে থাকেনি বিলি। সত্যি বলতে কি, বোর্ডিং-হাউজ সম্পর্কে তার একটা ভীতিও আছে। বিলি শুনেছে বোর্ডিং-হাউজের মালিকরা মারকুটে স্বভাবের হয়। কেউ কেউ নাকি সুযোগ পেলে খদ্দেরের গলা কাটে। মানে পকেট একেবারে আলগা করে দেয়।
বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো মনে পড়তে এখানে থাকার আগ্রহ চুপসে গেল ফুটো বেলুনের মত। নাহ্, বেল অ্যান্ড ড্রাগনে আগে একবার চেষ্টা করে দেখা উচিত। ঘুরে দাঁড়াল বিলি, চলে যাবে।
আর তখনি ভারি অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটল। বিলির চোখ জোড়া সম্মোহিতের মত আটকে থাকল সাইন বোর্ডের দিকে। কানে যেন বারবার ভেসে এল ওই শব্দগুলো: বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট, বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট, বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট। প্রতিটি অক্ষর আকৃতি পেল একেকটি বড় চোখে, কাঁচের মধ্য থেকে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। সাইন বোর্ডটার দিকে আঠার মত লেগে থাকল বিলির চোখ, ওকে আটকে রাখল, দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করল। এক পাও নড়তে পারল না বিলি উইভার। হঠাৎ, বিলি টের পেল, যেন এক অদৃশ্য শক্তি ওকে আবার ঠেলে দিচ্ছে সামনের দিকে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও জানালার পাশ থেকে সরে আসছে সে, এগোচ্ছে বাড়িটার সদর দরজার দিকে, এইবার সিঁড়ি বেয়ে উঠল সে, হাত বাড়াল কলিংবেলে।
বেলে চাপ দিল বিলি। দূরে, পেছনের দিকে কোন ঘরে বেজে উঠল ঘণ্টী টুং টাং শব্দে, আর তখুনি, প্রায় সাথে সাথে, বেল-বাটন থেকে তখনও হাত সরাতে পারেনি বিলি, দড়াম করে খুলে গেল দরজা। চৌকাঠে একজন মহিলা। এত দ্রুত কাউকে আশা করেনি বিলি। লাফিয়ে উঠল সে।
ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। বিলিকে দেখে আন্তরিক হাসি ফুটল তাঁর ঠোঁটে। ‘এসো, ভেতরে এসো,’ বলার ঢঙেও আন্তরিকতার টান। দরজাটা পুরো মেলে ধরে একপাশে সরে দাঁড়ালেন তিনি। চিন্তা ভাবনা না করেই চট করে ভেতরে ঢোকার প্রবল ইচ্ছে জাগল বিলির মনে। কেন, নিজেরও কারণটা জানা নেই।
‘জানালায় আপনার ঘর ভাড়ার নোটিশটা দেখলাম,’ বলল সে।
‘বুঝতে পেরেছি।’
‘একটা ঘর খুঁজছি থাকার জন্যে।
‘সেজন্যে তোমাকে আর ভাবতে হবে না, মাই ডিয়ার,’ বললেন তিনি। ভদ্রমহিলার গোলাপী মুখখানা গোল, নীল চোখ জোড়া সাংঘাতিক উজ্জ্বল।
‘আমি বেল অ্যান্ড ড্রাগনের দিকে যাচ্ছিলাম,’ সাফাই দেয়ার ভঙ্গিতে বলল বিলি। ‘হঠাৎ আপনার নোটিশটা চোখে পড়ল।
‘এসেছ খুব ভাল করেছ। এখানে তোমার কোন অসুবিধা হবে না। বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছি বলে কিছু মনে করছ না তো?’
‘না না, ঠিক আছে। আচ্ছা, আপনার ঘর ভাড়া কত করে?’
‘এক রাতের জন্য সাড়ে পাঁচ ডলার, সকালের নাস্তা সহ।’
দারুণ সস্তা। বিলি যে টাকা ঘর ভাড়ার জন্যে বাজেট করেছে এটা তার অর্ধেকেরও কম।
বিলিকে চুপ করে থাকতে দেখে ভদ্রমহিলা তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ভাড়া বেশি মনে হলে আমি কিছুটা কমাতে পারব। নাস্তায় কি ডিম লাগবে তোমার? এদিকে ডিম-টিম এখন তেমন পাওয়াও যায় না। তাই দাম খুব বেশি। ডিম না খেলে আরও সস্তা পড়বে তোমার ঘর ভাড়া।’
সাড়ে পাঁচ ডলার ঠিক আছে,’ বলল বিলি। ‘আমি এ টাকাটা দিতে পারব।’
‘বেশ। ভেতরে এসো। ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে আছ তখন থেকে!’
ভদ্রমহিলার মাতৃসুলভ ব্যবহার মুগ্ধ করল বিলিকে। কৈশোরের প্রিয় বন্ধুটির স্নেহময়ী মায়ের মতই লাগছে ওঁকে, যেন বিলিকে ক্রিস্টমাসের ছুটি কাটাতে দাওয়াত করছেন। বিলি মাথা থেকে হ্যাট খুলল, পা রাখল চৌকাঠের ভেতরে।
‘ওটা ওখানে ঝুলিয়ে রাখো,’ বললেন তিনি ‘দেখি, কোটটা আমাকে খুলতে দাও।’
হলঘরে আর কোন কোট বা হ্যাট চোখে পড়ল না বিলির। নেই ছাতা, ওয়াকিংস্টিক-কিচ্ছু না।
‘এখানে আমাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরকে করতে হয়,’ বিলির কাঁধে হাত রেখে ভদ্রমহিলা দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। ‘আমার এই ছোট্ট বাড়িতে মানুষজন বলতে গেলে কেউ আসেই না।’ হাসি তাঁর মুখে। ‘তাই তোমাকে পেয়ে খুব ভাল লাগছে।’
মহিলা বড্ড বেশি বকবক করেন, ভাবল বিলি। তবে সাড়ে পাঁচ ডলারে রাত্রি যাপনের সুযোগ পেয়ে এটুকু বকবকানি সইতে রাজি আছে সে। ‘আমি ভেবেছিলাম আপনার এখানে পেয়িংগেস্টদের অভাব নেই,’ মৃদু গলায় বলল বিলি।
‘তা অবশ্য নেই। তবে সবাইকে তো আমি ঘর ভাড়া দিই না। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে খুব খুঁতখুঁতে বলতে পারো।’
‘আচ্ছা!’
‘তবে তরুণ গেস্টদের জন্যে আমার দরজা সবসময়ই খোলা। তেমন কেউ
এলে আমি বরং খুশিই হই,’ সিঁড়ির অর্ধেক ধাপ পেরিয়েছেন মহিলা, রেলিং-এ ভর দিয়ে থামলেন, ঘাড় ঘুরিয়ে হাসিমুখে তাকালেন বিলির দিকে। ‘ঠিক তোমার মত,’ কথাটা শেষ করলেন তিনি। তাঁর নীল চোখ জোড়া অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে যেন জরিপ করল বিলিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত
একতলার ল্যান্ডিং দেখিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এই ফ্লোরে আমি থাকি।’
ওরা উঠে এল দোতলায়। ‘এই ফ্লোর পুরোটা তোমার।’ বললেন ভদ্রমহিলা। ‘এই যে এটা তোমার ঘর। আশা করি অপছন্দ হবে না।’ ছোট, সুসজ্জিত একটি বেডরূমে ঢুকলেন তিনি বিলিকে নিয়ে, জ্বেলে দিলেন আলো।
‘সকাল বেলায় সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে ঘরের ভেতর, পারকিন্স, পারকিন্স ই তো নাম, নাকি?’
‘জ্বী না।’ বলল বিলি। ‘উইভার, বিলি উইভার।
‘বেশ সুন্দর নাম! তো বিলি সাহেব আপনার আশা করি কোন সমস্যা হবে না এ ঘরে থাকতে। ঠাণ্ডা লাগলে গ্যাসের চুলাটা জ্বালিয়ে নিও। ঘর গরম হবে।’
‘ধন্যবাদ,’ বলল বিলি। ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’ সে লক্ষ করেছে বিছানা ঢেকে রাখার শুজনিটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে, পেতে রাখা হয়েছে পরিষ্কার চাদর। যেন কেউ আসবে জানতেন বাড়িউলি।
‘তোমার পছন্দ হয়েছে জেনে আমারও বেশ ভাল লাগছে,’ গভীর চোখে তাকালেন তিনি বিলির দিকে। ‘ভাবছিলাম যদি পছন্দ না হয়…’
‘না না, ঠিক আছে,’ তাড়াতাড়ি জবাব দিল বিলি। ‘আমাকে নিয়ে আপনার অযথা চিন্তা করতে হবে না।’ সে সুটকেসটা চেয়ারের ওপর রেখে তালা খুলতে শুরু করল।
‘রাতে কিছু খাবে, খোকা? নাকি খেয়ে এসেছ?’
‘ধন্যবাদ। কিছুই খাব না,’ বলল বিলি। ‘আমাকে আবার কাল ভোরে উঠেই অফিসে দৌড়াতে হবে। তাই সকাল সকাল শুয়ে পড়তে চাইছি।’
‘বেশ তো, শুয়ে পড়ো। তবে সম্ভব হলে ঘুমাবার আগে একবার নিচতলায় এসো। রেজিস্টার বুকে নাম সই করতে হবে। বোর্ডিং-হাউজ বা হোটেলের নিয়ম এটাই, জানো বোধ হয়। আমাদেরও নিয়ম ভঙ্গ করা ঠিক হবে না, তাই না?’ হাত নেড়ে ভদ্রমহিলা দ্রুত বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে।
মহিলা একটু বেশি কথা বললেও মনটা ভাল, ভাবল বিলি। হয়তো যুদ্ধে তিনি তাঁর সন্তানকে হারিয়েছেন। সেই শোক এখনও ভুলতে পারেননি।
সুটকেস খুলে ঘুমাবার যাবতীয় জিনিসপত্র বের করে ফেলল বিলি। তারপর হাত মুখ ধুয়ে নেমে এল নিচে, ঢুকল লিভিং রূমে। বাড়িউলি এখানে নেই, তবে ছোট্ট কুকুরটা এখনও ফায়ার প্লেসের সামনে গভীর ঘুমে মগ্ন। ঘরটা আরামদায়ক, গরম। নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবছে বিলি।
পিয়ানোর ওপর রেজিস্টার বুকটা দেখতে পেল সে, খাতা খুলে নিজের নাম এবং ঠিকানা লিখল গোটা গোটা অক্ষরে। এই পৃষ্ঠায় মাত্র দু’জন অতিথির আগমনের কথা লেখা আছে। একজন কাড্রিফের ক্রিস্টোফার মুল হোল্যান্ড, অন্যজন ব্রিস্টলের গ্রেগরী ডব্লিউ টেম্পল।
নাম দুটো চেনা চেনা লাগল বিলির। কোথায় যেন এই অদ্ভুত নাম দুটো দেখেছে সে, এখন ঠিক মনে করতে পারছে না। খাতার দিকে আবার তাকাল বিলি। মুল হোল্যান্ডের নামটা বেশি চেনা চেনা লাগছে ওর কাছে। কিন্তু নামটা শুনেছে কোথায়?
‘গ্রেগরী টেম্পল?’ বেশ জোরেই নামটা উচ্চারণ করল বিলি, স্মৃতি হাতড়াচ্ছে। ‘ক্রিস্টোফার মুল হোল্যান্ড?’
‘ভারি চমৎকার দুটি ছেলে,’ পেছন থেকে ভেসে এল একটি কণ্ঠ, ফিরে তাকাল বিলি। বাড়িউলি। হাতে সিলভারের বড় একটা চায়ের ট্রে, দু’কাপ পানীয় ওতে।
‘নাম দুটো বড্ড চেনা চেনা লাগছে,’ বলল বিলি।
‘তাই নাকি? অদ্ভুত ব্যাপার তো!’
‘নাম দুটো অবশ্যই আগে কোথাও দেখেছি, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই আমার,’ বেশ জোর দিয়ে বলল বিলি। ‘সম্ভবত খবরের কাগজে। তবে বিখ্যাত কেউ ছিল না ওরা। বিখ্যাত ক্রিকেটার বা ফুটবলার, কোনটাই নয়।’
‘আমারও তাই ধারণা,’ ভদ্রমহিলা সোফার সামনে নিচু একটা টেবিলের ওপর ট্রে নামিয়ে রাখলেন।
‘তবে বিখ্যাত কেউ না হলেও দু’জনেই ছিল অপূর্ব সুন্দর দেখতে। লম্বা, বয়সে তরুণ, সুদর্শন, ঠিক যেমন তুমি।
আবার সেই প্রশংসা। বিলি খাতার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। ‘এই যে দেখুন, ‘ তারিখটা আঙুল দিয়ে দেখাল সে। ‘এখানে শেষ লোকটি এসেছে দু’বছর আগে।
‘তাই বুঝি?’
‘হ্যাঁ। আর ক্রিস্টোফার মুল হোল্যান্ড এসেছে তারও এক বছর আগে—অর্থাৎ প্রায় তিন বছর আগে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা। ‘সত্যি, এভাবে কখনও হিসেব করে দেখিনি। সময় কি দ্রুত যায়, পারকিন্স।’
‘বিলি,’ তাঁকে আবার নিজের নামটা মনে করিয়ে দিল বিলি, ‘বিলি উইভার।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিলি! বিলি!’ মুখস্থ করার ভঙ্গিতে বললেন তিনি। ‘আসলে কানে ভাল শুনতে পাই না আমি। স্মরণশক্তিও কমে আসছে।’
‘ওদের ব্যাপারে জানেন কিছু? এই দু’জনের সম্পর্কে?’
‘না, তেমন কিছু জানি না।’
‘আমার এখন সব কথা মনে পড়ছে। ওরা দু’জন ছিল হরিহর আত্মা। দুই বন্ধু। সবাই এক নামে চিনত ওদেরকে। যেমন লোকে রুজভেল্ট এবং চার্চিলের নাম এক সাথে বলে, সেভাবে।
‘আচ্ছা!’ সরল বিস্ময় প্রকাশ করলেন ভদ্রমহিলা। ‘আমার পাশে এসে বসো তো, খোকা। চা খেতে খেতে ওদের গল্প শুনি।’
‘আপনি ব্যস্ত হবেন না,’ পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল বিলি। পিরিচের ওপর কাপে দ্রুত চামচ নাড়ছেন তিনি। তাঁর হাত জোড়া ছোট্ট, ফ্যাকাসে, নখে লাল টকটকে নেইল-পলিশ।
‘আমি ওদের ছবি দেখেছিলাম খবরের কাগজে’ বলে চলল বিলি। ‘ক্রিস্টোফার মুল হোল্যান্ড বছর তিন আগে ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়। ইটন স্কুলে পড়ত সে। ভ্রমণের সাংঘাতিক বাতিক ছিল। তারপর হঠাৎ একদিন…’
‘তোমার চায়ে দুধ চলবে? আরেকটু চিনি?’
‘দিতে পারেন। আচ্ছা, যা বলছিলাম হঠাৎ একদিন…’
‘ইটন স্কুলের ছাত্র? উঁহু, আমার কাছে যে মূল হোল্যান্ড এসেছিল সে তাহলে অন্য কেউ হবে। কারণ সে ইটনে পড়ত না। সে ছিল ক্যামব্রিজের আন্ডার গ্রাজুয়েট। এখানে এসে ওই ফায়ার প্লেসের সামনে বসে অনেক গল্প করেছে সে আমার সাথে। এসো, চা রেডি।’ সোফার পাশে খালি জায়গাটায় বিলিকে বসতে বললেন ভদ্রমহিলা হাসি মুখে।
ধীর পায়ে হেঁটে এল বিলি, বসল সোফার এক কোণে। বাড়িউলি ওর সামনে, টেবিলের ওপর চায়ের কাপটা রাখলেন। বিলি চায়ে চুমুক দিতে শুরু করল। প্রায় আধ মিনিট কেউ কথা বলল না। শুধু ফুড়ৎফাড়ৎ শব্দ শোনা গেল চা পানের। বিলি জানে উনি ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন, কীপের কিনারে চোখ রেখে ওকেই দেখছেন। বোটকা, পচা একটা গন্ধ লাগছে নাকে, মহিলার গা থেকে আসছে। শরীর গুলিয়ে উঠল বিলির।
‘মি, মুল হ্যান্ড চা খেতে খুব ভালবাসত,’ উদাসীন গলায় বললেন তিনি। ‘আমার জীবনেও কাউকে এত বেশি চা খেতে দেখিনি।’
‘মুল হোল্যান্ড কবে গেছে এখান থেকে?’ জানতে চাইল বিলি।
‘গেছে?’ ভুরু কোঁচকালেন ভদ্রমহিলা। ‘যায়নি, খোকা। মুল হোল্যান্ড আছে এখনও এ বাড়িতেই। মি. টেম্পলও আছে। দু’জনেই তিনতলায় থাকে।’
খুব আস্তে চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল বিলি, আড়চোখে তাকাল মহিলার দিকে। হাসলেন মহিলা প্রত্যুত্তরে, ফ্যাকাসে হাত বাড়িয়ে বিলির হাঁটুতে চাপড় দিলেন আদর করে। ‘তোমার বয়স কত, খোকা?’
‘সতেরো।’
‘সতেরো!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘একদম সমান বয়স। মি. মুল হোল্যান্ডেরও বয়স ছিল সতেরো। তবে সে তোমার চেয়ে খানিকটা খাটো, আর তার দাঁতগুলোও তোমার মত এত ঝকঝকে নয়। খুবই সুন্দর দাঁত তোমার, বিলি, তা কি তুমি জানো?’
‘যতটা সুন্দর বলছেন ততটা নয়,’ বলল বিলি। ‘আমার কয়েকটা দাঁতের পেছনে ফিলিং করতে হয়েছে।’
‘তাতে কিছু আসে যায় না। মি. টেম্পল ছিল তোমার চেয়ে বয়সী। আটাশ বছর ছিল বয়স। অবশ্য সঠিক বয়সটা সে নিজে থেকে না বললে ধরতেই পারতাম না আসলে তার বয়স কত। খুবই তরুণ দেখাত তাকে। চামড়ায় একটা দাগও ছিল না।’
‘মানে?’
‘মানে তার ত্বক শিশুদের মতই কোমল আর মসৃণ ছিল।’
একটু বিরতি। বিলি চায়ের কাপটা আবার তুলে নিয়ে চুমুক দিল, তারপর নিঃশব্দে পিরিচের ওপর নামিয়ে রাখল ওটাকে। ভদ্রমহিলার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে সে, কিন্তু তিনি হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন। সিধে হয়ে বসে ওপর দিকে চাইল বিলি, ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বলল, ‘ওই কাকাতুয়াটা…রাস্তা থেকে ওটাকে প্রথম দেখে জ্যান্ত ভেবেছিলাম।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বী। দেখলে মনেই হয় না ওটা মৃত। সাংঘাতিক একটা কাজ হয়েছে পাখিটাকে নিয়ে। কে করেছে কাজটা?’
‘আমি।’
‘আপনি?’
‘অবশ্যই,’ বললেন তিনি। ‘বেসিলকেও নিশ্চই দেখেছ?’ ফায়ার প্লেসের সামনে চোখ বোজা রোমশ কুকুরটার দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। বিলি তাকাল ওটার দিকে। হঠাৎ বুঝতে পারল ঘুমাচ্ছে না কুকুরটা, কাকাতুয়ার মত একই দশা হয়েছে ওটারও। হাত বাড়িয়ে কুকুরটার পিঠ ছুলো বিলি। শক্ত এবং ঠাণ্ডা লোমের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দেখতে পেল চামড়াটা ধূসর-কালো এবং শুকনো, দারুণভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
‘সাংঘাতিক ব্যাপার তো!’ বলল বিলি। সপ্রশংস দৃষ্টিতে সে তাকাল পাশে বসা ছোটখাট মহিলাটির দিকে। ‘কাজটা করতে নিশ্চয়ই আপনার প্রচুর খাটুনি গেছে।’
‘একেবারেই না,’ বললেন তিনি। ‘আমি আমার প্রিয় প্রাণীগুলোকে স্টাফ করে রাখি তারা মারা যাবার পরে। এটা আমার শখ বলতে পারো। তোমাকে আরেক কাপ চা দেব?’
‘না, ধন্যবাদ,’ বলল বিলি। বাদাম মেশানো চা খাবার পর মুখের ভেতরটা এখন তেতো লাগছে।
‘এখানে তো মজা পাবার মত কিছু ঘটে না,’ আপন মনে বকবক করে চলেছেন মহিলা। ‘তাই কদাচ যখন কিছু স্টাফ করার সুযোগ পাই, ছাড়ি না। এটা তো এক ধরনের শিল্পই, নাকি?’
‘জ্বী,’ ঢোক গিলে বলল বিলি। এই শীতেও ঘামতে শুরু করেছে সে।
‘ভাল কথা। তুমি রেজিস্টার বইতে নাম সই করেছ?’
‘জ্বী, করেছি।’
‘গুড। সত্যি বলতে কি, পরে যদি তোমার নামটা ভুলে যাই, তখন নিচে এসে খাতা দেখে নামটা স্মরণ করতে পারব। এখনও তো প্রায়ই কাজটা করি ওদের দু’জনকে নিয়ে। ওই যে মি. মুল হোল্যান্ড আর মি…. মি…’
‘টেম্পল, বলল বিলি। ‘গ্রেগরী টেম্পল। মাফ করবেন, একটা কথা জানতে চাইছি। গত দু’তিন বছরে কি ওরা দু’জন ছাড়া সত্যি আর কেউ আসেনি এখানে?’
হাতে চায়ের কাপ, মাথাটা সামান্য বাঁয়ে হেলিয়ে তিনি তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন বিলির দিকে, তাঁর হাসি দেখে গায়ের রোম সড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেল ছেলেটার।
‘না, খোকা,’ নরম গলায় বললেন তিনি। ‘তিন বছর পরে শুধু তুমিই এসেছ।’