হলদে বেড়াল

হলদে বেড়াল

ঘটনার শুরু ওটা যখন এরফান মোল্লাকে অনুসরণ করে তার বাড়িতে এল তারপর থেকেই। মনমরা হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরছিল এরফান। পকেটে পয়সা নেই বলে বাসে চড়তে পারেনি। সবেধন নীলমণি ছাতাটা ছক্কু মিয়ার কাছে বন্ধক রেখে পঞ্চাশটা টাকা নিয়েছিল এরফান। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল জুয়োর টেবিল থেকে আজ ডাবল তুলে আনবে। কিন্তু বিধিবাম। গোহারা হেরেছে সে। আর এমনই কপাল, জুয়োর আসর থেকে বেরিয়ে দেখে ঢাকা শহর ভাসিয়ে দেয়ার মতলব নিয়ে আকাশ ফুটো করে বৃষ্টি নেমেছে। টানা দুই ঘণ্টা বর্ষণে নিউ মার্কেটে কোমর সমান জল। রাত দশটা নাগাদ বৃষ্টি ধরে এলে তাপ্পি মারা ঢোলা প্যান্টটা উরু পর্যন্ত গুটিয়ে, সুখতলা খয়ে যাওয়া স্যান্ডেল জোড়া হাতে নিয়ে নোংরা জলের মধ্যে নেমে পড়েছে এরফান, নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দিতে দিতে।

এরফান মোল্লার বাসা ঝিগাতলা, ট্যানারির মোড়ে। ঝিগাতলা বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি এসেছে সে, রাস্তা প্রায় জনশূন্য ভারী বর্ষণের কারণে, মাঝে মাঝে দু’একটা প্রাইভেট কার সাঁৎ করে ছুটে যাচ্ছে যে যার গন্তব্যে, ঠাণ্ডায় হি হি করে কাঁপছিল এরফান, হঠাৎ অস্বস্তি লেগে উঠল, মনে হলো কেউ তার পিছু নিয়েছে।

ঝট করে পেছন ফিরল এরফান।

একটা বেড়াল। হলুদ রঙের। ভেজা লোম সেঁটে আছে শরীরের সাথে, ভীষণ রোগা, কদ্দিন ঠিকমত খেতে পায়নি কে জানে। তবে ওটার চোখ জোড়া জ্বলছিল জ্বলজ্বল করে। এরফান মোল্লার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে, যাতে আগন্তুক লাথি মারলেও গায়ে না লাগে, নিঃশব্দে হাঁটছিল বেড়ালটা।

নিরীহ প্রাণীটাকে দেখে হেসে ফেলল এরফান। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, এত রাইতে কাম কি তোর?’

এরফানকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে হলদে বেড়ালও ব্রেক কষল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এরফানের দিকে। এরফান আর কথা না বলে হাঁটা শুরু করল। পিছু পিছু এগোল বেড়ালও। ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখল এরফান। বিড় বিড় করে বলল, —তুই যদি কালা বিলাই হইতি তাইলে তরে আমার বাড়িত লইয়া যাইতাম। হলুদ বিলাই দিয়া আমার কুনো কাম নাই।’

তকদিরে দারুণ বিশ্বাস এতিম এরফান মোল্লার। অবশ্য জুয়ো পুরো ভাগ্যের ব্যাপারই। বেশ কিছুদিন ধরে জুয়োয় হেরে যাচ্ছিল বলে পুল পারের মনা ফকিরের কাছ থেকে সে দশ টাকা দিয়ে একটা তাবিজ পর্যন্ত কিনেছে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। জমানো টাকা কবেই শেষ, ধার-দেনার চূড়ান্তে এসে পৌঁছেছে এরফান মোল্লা। তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। হপ্তাখানেকের মধ্যে ভাড়া দিতে না পারলে বোঁচকা-বুচকি নিয়ে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে তাকে। গাছতলায় দাঁড়াতে আপত্তি নেই এরফানের। কিন্তু মোসাম্মৎ রেহেনা বেগমকে যে তাহলে ঠারেঠোরে দুইবেলা দেখতে পাবে না। এটাই তার দুঃখ। পত্রপাঠ বাসা ত্যাগ করতে হলে দিলে বড়ই চোট পাবে এরফান মোল্লা।

জুয়োয় আজকেও হেরে গিয়ে বাড়িওয়ালার রক্ত চক্ষুর শাসানির বদলে রেহেনার কাজল টানা চোখ জোড়ার কথাই ভাবছিল সে। আর মাঝে মাঝেই বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। এভাবে রেহেনার কথা ভাবতে ভাবতে কখন নিজের বাড়ির গেটে চলে এসেছে এরফান নিজেও জানে না। চারতলা বিল্ডিং। পুরোটাই মেস। চিলেকোঠার ঘরটা ভাড়া নিয়েছে এরফান। শৌখিন মানুষ বলে এবং ওই সময় তার তকদির খুব জমে উঠেছিল বলে পুরো ঘরটাই একা ভাড়া করেছিল সে।

মোটামুটি রাত এগারোটা পর্যন্ত ছোট গেট খোলা থাকে। বড় গেটে দশটায় তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। সাবধানে ছোট গেট খুলল এরফান, পিঠ কুঁজো করে ঢুকতে যাচ্ছে, চোখে পড়ল বেড়ালটাকে। দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। খুবই অবাক হলো এরফান। বলল, ‘আরে, তুই আমার বাসা পর্যন্ত চইলা আইছস!’ হঠাৎ খুব মায়া হলো তার অবোধ প্রাণীটার প্রতি। ঠিক আছে। আয়।’ বিড় বিড় করল সে। ‘ভেতরে আয়।’

সিঁড়িটা অন্ধকার। বাড়িঅলা হুজ্জত আলী মহা কৃপণ। সিঁড়ি গোড়ার চল্লিশ ওয়াটের বাতিটা হুড খুলে কোন্ হারামজাদা চোর হাপিশ করে দিয়েছে আজ পনেরো দিন। হুজ্জত আলী বাল্ব কিনে দেয়নি। বলেছে, বারবার সে বাল্ব কিনতে পারবে না। ভাড়াটেদের নিজেদের খরচে কিনতে হবে। অথচ এর আগে মাত্র একবার বাল্ব চুরি হয়েছে। আর মেসের লোকগুলোও যেন কেমন। কোন প্রতিবাদ করে না। ‘সব হালারা বিলাই হইয়া গেছে। আন্ধারে চক্ষু জ্বলে!’ সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় হোঁচট খেলে প্রায়ই এই গালটা দেয় এরফান ভাড়াটেদের। ওরা বেড়াল হতে পারে, রাতে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায়, কিন্তু এরফান তো আর বেড়াল না। বরং খানিকটা রাতকানা সে। অন্ধকারে সিঁড়ি বাইতে তার খুবই কষ্ট হয়। আজকেও অন্ধকারে রেলিং হাতড়ে চারতলায় উঠতে তার জান শেষ হবার জোগাড়।

নিজের ঘরের তালা খুলল এরফান, আলোর সুইচ জ্বালল খুট্ করে। হলদে বেড়াল দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। তার দিকে তাকিয়ে, মৃদু হেসে ‘ভেতরে আয়,’ বলতেই এক লাফে ঘরে ঢুকে পড়ল সে।

এরফান শৌখিন মানুষ হলেও তার ঘরে একটা কাঠের চৌকি, কাঠের আলনা আর কাঠের একটা টেবিল এবং চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। এক সেট বেতের সোফা কিনেছিল শখ করে। পেটের দায়ে বেচে দিয়েছে।

খুব ক্লান্ত লাগছিল শরীর। জামা খুলে ভেজা প্যান্ট আর গেঞ্জি পরেই সে লম্বা হলো বিছানায়। খুব সিগারেট তেষ্টা পেয়েছে। হাত বাড়িয়ে ড্রয়ার খুলল। সিগারেট নেই, আকিজ বিড়ি আছে। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। কিন্তু স্যাতসেঁতে আবহাওয়ায় ড্যাম্প মেরে গেছে বিড়িগুলো। টান দিয়ে সুখ পাওয়া গেল না। এদিকে পেটের মধ্যে ছুঁচোর কেত্তন শুরু হয়ে গেছে। ঠিকা এক কাজের বুয়া ছিল। দুই বেলা রান্না করে দিত। বেতন পাচ্ছিল না বলে গত মাসে কেটে পড়েছে সে। গত একমাস ধরে মোড়ে, ছক্কু মিয়ার হোটেলে ভাত খায় এরফান বাকিতে। আজ আর যেতে ইচ্ছে করছে না। গেলেই ব্যাটা চশমখোর পাওনা টাকা চেয়ে বসবে। কিন্তু পেট যে কথা শুনতে চায় না।

বিছানায় উঠে বসল এরফান। দেখল বেড়ালটা কাঠের আলনার পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ‘কিরে, খিদা লাগছে?’ কোমল গলায় বলল সে। তারপর জানালার তাকে রাখা কয়েকটি প্লাস্টিকের বোয়েম থেকে একটা টেনে নিল। মাঝে মাঝে হোটেলে আলসেমির জন্যে খেতে যেতে ইচ্ছে না করলে বিস্কুট বা কেক খায় এরফান। ছক্কু মিয়ার হোটেলের সাথে নিজের একটা কনফেকশনারীও আছে। দিন পনেরো আগে কয়েক পিস ফ্রুট কেক আর কিছু বিস্কুট এনেছিল এরফান। বোয়েমের তলায় এখনও পড়ে আছে দু’এক টুকরো। নিজে এক টুকরো মুখে পুরে আরেক পিস ছুঁড়ে দিল বেড়ালটার দিকে। কেকের ওপর হামলে পড়ল বেড়াল। এক কামড়েই কম্ম সাবাড়। তারপর আবার জুলজুল করে তাকিয়ে রইল এরফানের দিকে।

‘তরে যে কি খাইতে দিই!’ মাথা চুলকাল এরফান মোল্লা। হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। চা খাবি? আয়, চা খাই। বিস্কুট আছে। চা দিয়া ভিজাইয়া খাইতে দারুণ মজা।’

গরিবী হালে থাকলেও এরফান মোল্লার বিলাসিতা বলতে ওই একটা-চা খাওয়া। সে আরেকটা প্লাস্টিকের বোয়েম খুলে তলায় পড়ে থাকা চা বের করল। ঘরে চিনি নেই তবে কনডেন্সড মিল্ক আছে। ওতেই চলবে। ভাড়া দিতে না পারলেও গ্যাস লাইন এখনও কেটে দেয়নি হুজ্জত আলী। ঝটপট পানি গরম করে চা বানিয়ে ফেলল এরফান। একটা বাটিতে করে দুধ সাদা চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে বেড়ালকে খেতে দিল। নিজেও খেল। দেখল বেড়াল খুব তৃপ্তি নিয়ে চা আর বিস্কুট খাচ্ছে। তারপর আলনার কোণে গিয়ে বসে রইল চুপচাপ। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা।

বেড়ালটা হিসি করে ঘর নষ্ট না করে ফেলে, শঙ্কিত হয়ে ভাবল এরফান। একবার ইচ্ছে করল ঘাড় ধরে বের করে দেয়। পরক্ষণে নাকচ করে দিল চিন্তাটা। এমন অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে বেচারা! থাক্, কালকে ওটাকে ভাগানোর ব্যবস্থা করা যাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘুমটা জমবে ভাল।

.

সকালবেলায় দেখা গেল বেড়ালটা আগের জায়গায়ই বসে আছে। এরফান মোল্লার চোখে চোখ পড়তে একটু যেন সিটিয়ে গেল লাথি-গুঁতা খেতে হয় কিনা ভেবে। এরফান বলল না ওকে কিছু। দাঁত-টাত ব্রাশ করে গায়ে একটা জামা গলিয়ে বাইরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলো। তার পিছু নেয়ার কোন লক্ষণ নেই বেড়ালটার মধ্যে।

আলনার কোণে বসেই আছে, যেন আলস্যি পেয়ে বসেছে।

‘কিরে মতলবখানা কি?’ ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করল এরফান। ‘আমার ঘাড় দিয়া নামবি না মনে হইতাছে।’

বেড়ালের চেহারায় কোন ভাবান্তর নেই। স্থির, নিষ্কম্প দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এরফানের দিকে।

‘এইখানে থাইকা কোন লাভ নাই বুঝছস,’ বলল এরফান। ‘আমারই খাওন জোটে না। তরে খাওয়ামু কি!’

চুপ করে রইল বেড়াল। দিমু নাকি হালারে ঘাড় ধইরা বাইর কইরা, ভাবল এরফান। এক পা এগোল বেড়ালের দিকে। চট করে উঠে দাঁড়াল বেড়াল। ভয় ফুটে উঠেছে চোখে, পিছু হঠতে শুরু করেছে। হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল এরফান। ওটা তো তার কোন সমস্যা করছে না। থাক না বসে।

‘তুই থাক,’ বলল সে। ‘তয় হাগামুতা করলে কিন্তু খবর আছে। আমি ছক্কু মিয়ার হোটেলে গেলাম। দেখি ব্যাটা চশমখোররে ভুজুং ভাজুং দিয়া কিছু খাওনের ব্যবস্থা করন যায় কিনা।’

দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে পড়ল এরফান। পুরানো শার্টের পকেট হাতড়ে দেখল সাত টাকা আছে। খুশি হয়ে গেল সে। যাক, ছক্কু মিয়ার কাছে বাকি চেয়ে তার বেজার মুখ দেখতে হবে না। সাত টাকায় দুই পরোটা আর এক চা হয়ে যাবে।

ছক্কু মিয়া এরফানকে দেখে নিমতিতা করে ফেলল মুখ। সে কিছু বলার আগেই এরফান বলে উঠল, ‘ছক্কু মিয়া, আমারে দেইখা বেজার হইবার কারণ নাই। এই লও সাত টেকা। দুই পরোটা আর চা দ্যাও। পার্সেল কইরা দিও। বাসায় লইয়া যামু।’

ছক্কু মিয়া চেহারা আরও অন্ধকার করে বলল, ‘আপনের কাছে ছয়শো টেকা বাকি পড়ছে।’

‘আরে মিয়া, টেকা তুমি যথাসময়ে পাইয়া যাবা। অফিসে একটু ঝামেলা হইতাছে। ঝামেলা শেষ হইলেই বেতন পাইয়া যামু। তুমিও তোমার টেকা পাইয়া যাবা। অহন নাস্তা দিবার কও জলদি। খিদায় নাড়িভুঁড়ি জ্বলতাছে।’

ছক্কু মিয়া হাঁক ছাড়ল, ‘ওই গেন্দা, দুই পরোটা আর এক চা পার্সেল কর।’

খবরের কাগজে দুই পরোটা আর স্টারশিপ দুধের টিনের কৌটায় তিন টাকার চা নিয়ে মেসের দিকে হাঁটা দিয়েছে এরফান, মোড়ের ধারে আসতে, পেছন থেকে কে যেন থাবড়া মারল কাঁধে। ‘আরে, এরফান মোল্লা কই যাও। তোমারেই তো খুঁজতাছি।’

থাবড়ার চোটে চা’র কৌটাটা আরেকটু হলে হাত থেকে ফস্কে যাচ্ছিল, কোনমতে সামলে নিয়ে রক্ত চক্ষু মেলে ফিরে চাইল সে আহাম্মকটার দিকে।

এক মোটাসোটা প্রৌঢ়, হাসছে এরফানের দিকে তাকিয়ে। দাঁতগুলো তরমুজের বিচির মত লাল। অতিরিক্ত পান খাওয়ার ফল। লোকটাকে চেনা চেনা লাগল তার কোথায় যেন দেখেছে। ফর্সা পাজামা-পাঞ্জাবি পরনে। চেহারা দিয়ে জেল্লা ফুটে বেরুচ্ছে। বোঝাই যায় মালদার পার্টি। এমন লোকের দিকে রাগি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকা যায় না। আর লোকটা যেভাবে তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে, লোকটার হাবভাবে মনে হচ্ছে এরফান যেন তার অনেক দিনের চেনা। দ্রুত স্মৃতি হাতড়াল এরফান আবার। চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু নামটা যেন কি…

‘তোমারে অনেক খুঁজছি, বুঝলা,’ বকবক করেই চলেছে লোকটা। ‘এইহানে পাইয়া যামু ভাবি নাই। থাকো কোথায় তুমি?’

আঙুল দিয়ে চারতলা সাদা বিল্ডিংটা দেখাল এরফান। ‘ওইখানে।

‘বেশ। বেশ। যাইতাম তোমার বাসায়। তয় টাইম নাইক্কা। বাড়ি যাইতাছি। গাড়ি ছাড়ব আটটায়। তোমারে দেইখা স্কুটার থামাইছি। এই লও, তোমার পাঁচশো টেকা। বিপদের সময় খুব হেল্প করছিলা, ভাই। দেনাদার থাইকা মরবার চাই না। তোমারে পাইয়া বুক থিকা একটা পাষাণ নাইমা গেল। আসি ভাই। স্কুটার দাঁড়াইয়া আছে। আসসালামু আলাইকুম।’

যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল মোটা লোকটা, তেমনি ঝড়ের বেগে চলে গেল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুটারে উঠে। ক্রমশ অপসৃয়মান স্কুটারের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল এরফান। কে লোকটা? পকেটে গুঁজে দেয়া ভাঁজ করা পাঁচশো টাকার নোটটার দিকে তাকাল সে। এভাবে সেধে সেধে এতগুলো টাকা দিয়ে গেল! কিন্তু এরফান মোল্লা হলফ করে বলতে পারে সে জীবনেও কাউকে পাঁচশো টাকা ধার দেয়নি। তাহলে…

মোটা লোকটার কথা ভাবতে ভাবতে বাসায় ঢুকল এরফান। হলুদ বেড়াল মুখ তুলে চাইল ওর দিকে। সাথে সাথে এরফানের মনে পড়ে গেল লোকটা কে। এবং গা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল তার।

মোটকুর নাম গাউস মোহাম্মদ। আরামবাগের মেসে ভাড়া থাকত। কি একটা সদাগরী অফিসে চাকরি করত। বেশ শৌখিন স্বভাবের ছিল মানুষটা। কিন্তু সে তো পাঁচ বছর আগে দেশের বাড়ি থেকে ফেরার পথে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। হ্যাঁ, মনে পড়ছে গাউস মোহাম্মদকে সে পাঁচশো টাকা ধার দিয়েছিল। তখন তার সুদিন ছিল। টাকা-পয়সাকে মনে হত হাতের ময়লা।

তা হলে এ লোকটা কে? এরফান নিজের মনকে প্রবোধ দিতে চাইল, তার কোথাও মস্ত ভুল হয়ে গেছে। যার সাথে তার দেখা হয়েছে সে আসলে গাউস মোহাম্মদের মত কেউ দেখতে। যদি তাই হয়, সে কেন এরফানকে পাঁচশো টাকা দেবে? গাউস মোহাম্মদের যমজ ভাই নয়তো? এরফানের যদ্দূর মনে পড়ে গাউস মোহাম্মদের যমজ ভাই-টাই ছিল না। উঁহু, মনকে যতই বোঝাক এরফান, সে ঠিকই জানে মৃত গাউস মোহাম্মদই এসেছিল একটু আগে তার টাকা ফেরত দিতে। মহা দুর্দিনের সময়ে কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট! অন্যসময় হলে জেনি কাবাব ঘরে ঢুকে গরম কাবাব আর তন্দুরের অর্ডার দিয়ে বসত এরফান। কিন্তু ওর কেমন অস্বস্তি লাগছে। গাউস মোহাম্মদের কথা ভাবতেই কাঁটা দিয়ে উঠছে গা। নোটটার দিকে তাকাল সে। ভেজাল মনে হচ্ছে না। চকচক করছে।

‘খিদেটা হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে গেল এরফানের। একটা পিরিচে চা ঢেলে, পরোটা দুটো বেড়ালটার সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘নে খা!’

দেরি না করে খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হলুদ বেড়াল।

পাঁচশো টাকার নোটটার দিকে তাকিয়ে রইল এরফান। দৃষ্টি ফেরাল বেড়ালের দিকে। চুকচুক করে চা খাচ্ছে ওটা। এরফান ভাবছে বেড়ালটাই তার ভাগ্য পরিবর্তন করে দিল কিনা। তার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে গাউস মোহাম্মদের কথা…

হলুদ বেড়ালটাকে আশ্রয় দেয়ার পর দিন থেকে এরফান মোল্লার জীবনের ভাগ্যের চাকা যেন ঘুরতে শুরু করল অবিশ্বাস্য গতিতে। পাঁচশো টাকার নোটটা নিয়ে নিউ মার্কেটের জুয়োর আড্ডায় গিয়েছিল সে সেদিন। জিতে এসেছে পাঁচ হাজার টাকা। তার পরদিন জিতল এর দ্বিগুণ। জুয়াড়ীদের ভাগ্যে মাঝে মাঝে অসম্ভব সুসময় আসে। এরফানের ধারণা, সেই সময়টা এসেছে তার জীবনে। জেতার নেশায় যেন পেয়ে বসল ওকে। যদিও প্রতিদিন রাতে ঘুমাবার সময় সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন আর জুয়োর আসরে যাবে না। কিন্তু সকাল হলেই তাকে দারুণ টানতে থাকে নিউ মার্কেট।

মাস খানেকের মধ্যে প্রায় লাখখানেক টাকা জিতে ফেলল এরফান। ছক্কু মিয়ার হোটেলের বাকি মিটিয়ে কিছু অ্যাডভান্সও করে রেখেছে সে। ছক্কু মিয়া এখন তাকে খুব খাতির-যত্ন করে। বাড়িঅলার তিন মাসের ভাড়া তো দিয়েইছে, দুই মাস আগামও দিয়ে রেখেছে। আসলে মেসটা ছেড়ে যেতে ভরসা পাচ্ছে না এরফান। মনে হচ্ছে ঘর ছেড়ে গেলে তার ভাগ্যও তাকে ছেড়ে চলে যাবে। সে কালার টিভি, ডেক সেট ইত্যাদি কিনে ঘরটাকে নিজের মত করে সাজিয়েছে। খুব দামী, আরামদায়ক একটা কুশন কিনে দিয়েছে হলুদ বেড়ালের জন্যে। বেড়াল প্রায় সারাক্ষণই কুশনের ওপর বসে থাকে। মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায়। কোথায় যায় জানে না এরফান। আবার কখন ফিরে আসে তাও জানে না। ওটার চলা-ফেরা খুবই রহস্যময় মনে হয় তার কাছে। তবে বেড়ালটাকে জামাই-আদরে রেখেছে সে। হঠাৎ এই ভাগ্য পরিবর্তনের পেছনে বেড়ালটার কোন না কোন ভাবে অবদান আছে, দৃঢ় বিশ্বাস এরফান মোল্লার। বেড়ালকে সে নিজের হাতে, ভাল ভাল জিনিস খাওয়ায় প্রতিদিন। রাতের বেলা মাঝে মাঝে বেড়ালটার সাথে কথা বলে। তার নানা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বেশিরভাগ জুড়ে থাকে মোসাম্মৎ রেহেনা বেগমের কথা। বেড়ালকে সে হেসে বলে রেহেনার চশমখোর বাপ নাকি রেহেনার সাথে তার আলগা ভাব দেখেও ইদানীং না দেখার ভান করে। রেহেনা বা তার বাপ অবশ্য জানে না তার অর্থ কামাইয়ের উৎসের কথা। বাড়িঅলা জানে এরফান আগে একটা গার্মেন্টসে চাকরি করত। ওখানে বেতন না পেয়ে একটা বায়িং হাউজে ঢুকেছে এবং ওখানে বেতন ছাড়াও মাল বিক্রি করে যে কমিশন সে পায় তা খুবই ভাল।

এরফান মোল্লা-রেহেনা প্রেমের কথা নীরবে শুনে যায় হলুদ বেড়াল। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। গত এক মাসে বেড়ালটাকে একবার ‘ম্যাও’ বলতেও শোনেনি এরফান। বেড়ালটা হলুদ চোখ মেলে, এমন ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, মাঝে মাঝে গা শিরশির করে ওঠে এরফানের। চাউনিটা অপার্থিব, ভৌতিক মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় ওটা ভূত না তো? এরফান শুনেছে ভূত বা প্রেতাত্মাদের নাকি মাটিতে ছায়া পড়ে না। এ বেড়ালটার ছায়া পড়ে দেয়ালে। তবে ভূতুড়ে বেড়াল হলেও এরফানের কিছু যায় আসে না। যত দিন যাচ্ছে ততই তার বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছে, এ বেড়ালের জন্যেই তার ভাগ্য ফিরেছে।

.

শবে-বরাতের দিন ঘরে বসে টিভিতে হামদ-নাত দেখছিল এরফান মোল্লা, এমন সময় কে যেন কড়া নাড়ল। বেশ গরম পড়েছে তাই শার্ট গায়ে দেয়নি এরফান, আর এমন পবিত্র দিনে জুয়ো খেলতে যাবার প্রশ্নই নেই। সে একটু রেস্ট নিচ্ছিল। অসময়ে কে বিরক্ত করতে এল? ওদিকে কড়া নাড়ার চোটে দরজা ভেঙে ফেলবে মনে হচ্ছে। সে ‘আইতাছি’ বলে হাঁক ছাড়ল, লুঙির আলগা গিঠ শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে, রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ঝড়াং করে খুলে ফেলল দরজা। এবং হাঁ হয়ে গেল।

সামনে দাঁড়িয়ে আছে মোসাম্মৎ রেহেনা বেগম। তার হাতে বড়সড় রেকাবি, ফুল আঁকা কাপড়ের ঢাকনা দেয়া। রেহেনার পাশে ৯/১০ বছরের একটা মেয়ে, ওদের বাসার কাজের মেয়ে। ফুলি। সে দাঁত বের করে হাসল এরফানের দিকে চেয়ে। বলল, ‘ভাইজান, কেমন আছেন?’

এরফানের বিস্মিত দৃষ্টি ফিরে এল রেহেনার দিকে। চোখাচোখি হতে সে যেন একটু কেঁপে উঠল, আয়ত চোখ মাটির দিকে নামিয়ে বলল, ‘আম্মায় পাঠাইয়া দিল। বলল…’

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ফুলি সোৎসাহে শুরু করল, বলল, ‘আপনে একলা মানুষ। হের লাইগা আম্মায় শবে-বরাতের পিঠা আর গোশত পাঠাইয়া দিছে। পিঠা আর গোশত কিন্তু আপায় রানছে, ভাইজান। খাইয়া দ্যাহেন। আপার রান্নার হাত যে কি! যেন মিডা!’

‘তুই চুপ কর,’ মৃদু ধমক দিল রেহেনা তাকে। এরফানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কই, ঢুকবার দিবেন না? না বাইরে দাঁড়াইয়া মেহমান খেদাইয়া দিবেন?’

ভয়ানক লজ্জা পেল এরফান। বলল, ‘আরে ছিঃ ছিঃ কি কও! আহো, আহো। ভেতরে আহো।’

এরফান মোল্লা দেখতে খারাপ নয়। গত এক/দেড় মাসে ভাল খেয়ে-দেয়ে চিকনাই এসেছে শরীরে। ফুলি ওর রোমশ বুকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে তাড়াতাড়ি একটা শার্ট টেনে নিল সে। জামাটা গায়ে গলাতে গলাতে বলল, ‘আমি তো স্বপ্নেও ভাবি নাই তুমি আমার ঘরে আইবা। বসো, ওই সোফাটায় বসো।’ সে নিজে বসল বিছানার ধারে।

টেবিলের ওপর রেকাবিটা রেখে সোফায় বসল রেহেনা। মৃদু গলায় বলল, ‘আব্বায় বলল এতদিন ধইরা আপনে আমাগো এইখানে আছেন। একটু ভাল-মন্দ খোঁজ-খবরও নেয়া হয় না…’

‘তোমার আব্বায় কইল এই কথা?’ নিজের কানকে বিশ্বাস হতে চাইল না এরফানের।

‘কইল তো। আব্বায় ওই কথা কওনের পরে আম্মায় আমারে পাঠাইয়া দিল। আর আমি তো জানি…’ হঠাৎ রেহেনার খেয়াল হলো ফুলি হাঁ করে তার কথা শুনছে। সে কড়া ধমক লাগাল, ‘অ্যাই, ফুলি। বাড়ি যা। বহুৎ কাম পইড়া আছে। আম্মারে কবি আমি শেফালিগো বাড়িতে আছি।’

ধমক খেয়ে মুখ কালো করে ফেলল ফুলি। মুখ নিচু করে চলে যাচ্ছিল, তাকে ডাকল রেহেনা, জামার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দশ টাকার একখানা নোট বের করল, ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘পিন্টুরা লটারি খেলতাছে। তুইও খেলিস। খবরদার, আমি যে এইখানে আছি আম্মারে ভুলেও কইবি না। কইবি শেফালির লগে আছি আমি।’

খুশিতে উদ্ভাসিত হলো ফুলি। ‘আইচ্ছা, আপা,’ সে লাফাতে লাফাতে চলে গেল খাবার টেবিলে সাজিয়ে, শূন্য প্লেট হাতে নিয়ে।

দরজা বন্ধ করার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল এরফান, রেহেনা মুখ টিপে হাসল, ‘দরজা বন্ধ কইরেন না, এরফান ভাই। মাইনষে কি ভাবব।’

‘না। না। বন্ধ করুম না। ভিজাইয়া রাখি,’ মুখ লাল হয়ে গেল এরফানের।

এরফান মোল্লা তার ত্রিশ বছরের জীবনে কোন মেয়ের প্রেমে পড়েনি। বলা যায় সুযোগ পায়নি। রেহেনার সাথে বহুদিন তার চোখাচোখি হয়েছে। ওরাও চারতলায় থাকে, এরফানদের মেসের ঠিক বিপরীত দিকে। প্রতি শুক্রবার বিকেলে সে ছাদে ওঠে এবং এরফান মোল্লাকে তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখ টিপে হাসে। সে মাঝে মাঝে ওড়না ছাড়াই ছাদে চলে আসে। তখন তার দিকে তাকালে বুকটুক শুকিয়ে খালি তেষ্টা পেতে থাকে এরফান মোল্লার। যেমন এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার সারা শরীরে আগুন ধরে গেছে, ইচ্ছে করছে পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে লাফ মেরে পড়তে। তার শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাবার কারণ, রেহেনা হঠাৎই ঝুঁকে বসেছে তার দিকে, কাঁচের মত স্বচ্ছ ওড়নাটা বুক না পেঁচিয়ে গলা জড়িয়ে আছে। হাল ফ্যাশনের কামিজের গলার দিকটা অনেকখানি চেরা, ফলে তার অসম্ভব ফর্সা বুকের অনেকখানিই দেখতে পাচ্ছে এরফান, গভীর গিরিখাদ সহ।

বাঁ গালে হাত ঠেকিয়ে, ঠিক সিনেমার নায়িকাদের মত পোজ নিয়ে প্রশ্ন করল রেহেনা, ‘শইলডা ভাল, এরফান ভাই?’

অনেক কষ্টে গিরিখাদ থেকে চোখ তুলল এরফান, ঢোক গিলে বলল, ‘হ ভালই। আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই তোমারে এত কাছাকাছি দেখুম। তুমি জানো না তোমারে নিয়া আমি…’ গলার স্বর বুজে এল তার, হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলল।

লজ্জা নয়, কৌতুক ঝিলিক দিল রেহেনার কাজল টানা চোখে। ‘আমিও ভাবি নাই আপনের এইখানে কোনদিন আসব। সেদিন আমি…’ বাধা পেল সে দরজা খোলার শব্দে, ওদিকে তাকাল এবং ‘মাগো’ বলে বিকট এক চিৎকার দিল।

ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে হলদে বেড়াল, ঘরের নতুন মানুষের দিকে ভীষণ দৃষ্টিতে চাইল সে, যেন রেহেনার আগমনে ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়েছে।

সমস্যা হলো, বেড়ালে ভীষণ এলার্জি রেহেনার। বেড়ালের কারণে ছোটবেলায় ডিপথেরিয়ায় একবার সে প্রায় মারা যেতে বসেছিল। লোকে যেমন সাপ বা বিছাকে ভয় পায়, রেহেনার বেড়াল-আতঙ্কও ঠিক তেমনি। হলুদ বেড়ালটাকে দেখে সে মৃগীরোগীর মত চেঁচাতে লাগল, ‘ওইটারে সরান। শিগগির হারামাজাদাটারে দূর করেন।’

হলুদ বেড়াল রেহেনার চিৎকার এবং লাফালাফিতে খুবই বিরক্ত হলো। দাঁত- মুখ খিঁচিয়ে চাপা গর্জন ছাড়ল সে। আর তা দেখে দাঁত-কপাটি লেগে গেল রেহেনার, দড়াম করে মেঝের ওপর পড়ে গেল।

রোমান্স মাথায় উঠল এরফান মোল্লার। উদ্ভিন্ন যৌবনা ষোড়শী এক কন্যা, তাও স্বয়ং বাড়িঅলার মেয়ে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তার ঘরে, এই দৃশ্য কেউ দেখে ফেললে আজকেই মহল্লা ছাড়া হতে হবে তাকে। হুজ্জত আলী বেইজ্জত করে ছাড়বে তাকে। বলা যায় না দু’টুকরো করে ট্যানারির খালেও ভাসিয়ে দিতে পারে। সেই সমূহ বিপদের কথা চিন্তা করে ‘রেহেনা! রেহেনা!’ বলে ডাকতে লাগল। রেহেনা চোখ বুজেই রইল, উঠল না। হঠাৎ বুদ্ধিটা মাথায় আসতে খাটের তলায় ঢুকল এরফান, পরিত্যক্ত জুতো জোড়া বের করল, ধরে রাখল রেহেনার মুখের ওপর।

পচা চামড়ার বমি ওঠা গন্ধে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জ্ঞান ফিরে এল রেহেনার, আরও কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল এরফানের দিকে। হঠাৎ কথাটা মনে পড়তে আঁতকে উঠল সে, ‘বিলাইডা কই?’

হলদে বেড়াল নেই। পালিয়েছে। ধরে রাখা গেল না রেহেনাকেও। সে কোরান শরীফের কসম খেয়ে বলল এরফান মোল্লা অমন খবিস একটা জানোয়ার পোষে জানলে জীবনেও এখানে পা দিত না। যে চোখে কিছুক্ষণ আগেও স্বপ্নিল আবেশে খেলা করত মহব্বত, সেই চোখে আগুন ঝরিয়ে যাবার আগে রেহেনা বলে গেল, ‘যে মানুষ অমন খবিস জানোয়ার ঘরে রাখে সে নিজেও একটা খবিস। আপনের লগে আমার আর কথা নাই, এরফান মিয়া। আপনে কাইলকাই আমগো ঘর ছাইরা দিবেন।’

এরফান মোল্লাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে দুপদাপ পা ফেলে চলে গেল তার ‘দিল কা টুকরা’ মোসাম্মৎ রেহেনা বেগম। ওর গমন পথের দিকে বেকুবের মত তাকিয়ে থাকল এরফান। অনেক সময় লাগল ঘোর কাটিয়ে উঠতে। তার জীবনে মহাসর্বনাশ ঘটানোর জন্যে দায়ী হলদে বেড়ালের প্রতি প্রতিহিংসায় জ্বলতে লাগল সে।

বেড়ালটা কোথায় ছিল কে জানে। রাত আটটার দিকে চোরের মত ঘরে ঢুকল। দরজা খোলাই ছিল। বেড়ালের অপেক্ষায় ছিল এরফান মোল্লা। বেড়াল ঘরে ঢুকতেই এক লাফে দরজা বন্ধ করে দিল সে। হিংস্র গলায় বলল, ‘শুয়ারের বাচ্চা! খাওনের টাইম হইছে আর আইসা পড়ছ, না? দাঁড়া, হারামীর পুত। তর খাওন বাইর করতাছি।’

মোটা একটা লাঠি আগেই জোগাড় করে রেখেছিল সে, ওটা দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করল হলদে বেড়ালটাকে। বেড়ালটা আত্মরক্ষার জন্যে খামোকাই ছুটোছুটি করল। মারতে মারতে ওটাকে আধমরা করে ফেলল এরফান। তার রাগ এখনও যায়নি। হারামজাদা বেড়ালটার জন্যে রেহেনাকে সে হারিয়েছে। কাজেই ওর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। সে মৃত প্রায় বেড়ালটার ঘাড় ধরে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে পুরে ফেলল। ব্যাগটার মুখ রশি দিয়ে বেঁধে বেরিয়ে পড়ল। রিকশা নিয়ে সোজা চলে গেল রায়ের বাজার, পুল পার। এদিকে একটা ব্রিজ আছে। ব্রিজের নিচে খাল। সে বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে ঝোলাসুদ্ধ বেড়ালটাকে খালের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। শব্দ হলো ঝপাৎ। অন্ধকারে বোঝা গেল না বস্তাটা ডুবে গেছে কিনা। ওদিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করল না এরফান মোল্লা। ফিরে এল নিজের ডেরায়।

.

হলুদ বেড়ালটাকে মেরে নিজের যে কি ক্ষতি করেছে এরফান তার প্রমাণ পেল হপ্তাখানেকের মধ্যেই। নিউ মার্কেটের জুয়োর আড্ডায় প্রথম খেলাতেই হেরে গেল সে। ভুরু কুঁচকে ভাবল বেড়ালটার অভিশাপ লাগেনি তো। হারানো টাকা উদ্ধারের আশায় সে আবার খেলল। এবারও হার। এবং জুয়োতে হেরে যাবার এই ধারা অব্যাহতই থাকল। মনা ফকিরের কাছ থেকে আবার তাবিজ এনেও কাজ হলো না।

প্রতিদিন এরফান যায় বাজি জিততে, গো-হারা হেরে ফিরে আসে। তার জমানো টাকা শেষ তো হয়েই গেল, এক পর্যায়ে কালার টিভি, ভিসিপিও বিক্রি করতে হলো জুয়োর টাকা জোগাড় করতে।

তারপর, একদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল তার জীবনে। সে রাতে শঙ্করে এক বন্ধুর বাড়িতে জুয়ো খেলে (এবং যথারীতি হেরে) হেঁটে বাড়ি ফিরছিল এরফান, টের পেল দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করছে সে রায়ের বাজার পুল পারের দিকে যাবার। কেন এমন লাগছে বুঝতে পারল না সে। শেষে একটা রিকশা পেয়ে চট্ করে তাতে উঠে বসে বলল, ‘ঝিগাতলা। জলদি।’

পরদিন জ্বর এল তার। সারা শরীর ব্যথায় ম্যাজ ম্যাজ করতে লাগল। ব্যাপারটাকে পাত্তা দিল না এরফান। কারণ এখন ঘরে ঘরে ফ্লু। সে-ও হয়তো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।

বাথরূম পাচ্ছে এরফানের। তলপেট ভারী হয়ে আছে অনেকক্ষণ। সে বিছানা ছেড়ে উঠল এবং আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করল চার হাত পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে বাথরূমের দিকে। হাত দুটো থাবার মত সামনে ছড়িয়ে হাঁটু ঘষটে ঘষটে হাঁটছে। বাথরূম থেকে ফিরেও এল একই ভঙ্গিতে।

বাজারে যাওয়া দরকার। ঘরে কিচ্ছু নেই। এখনও অত অভাবে পড়েনি যে ছক্কু মিয়ার দোকানে বাকি খেতে হবে। এরফান জামা-কাপড় পরল। অনেক কষ্ট হলো পরতে। হাত খুব কাঁপছে।

বাজারে মাছ তেমন কিছু নেই। যাও আছে আগুন দাম। এরফান আধা কেজি পুঁটি মাছ কিনল। গরম ভাতের সাথে মচমচে পুঁটি মাছ ভাজার তুলনা নেই। জ্বরের মুখে লাগবেও বেশ। পলিথিনের ব্যাগে মাছ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা দিল এরফান।

এরফান জানে না কখন ব্যাগটা নাকের কাছে এনে তাজা মাছের গন্ধ শুঁকতে শুরু করেছে। অবাক হয়ে লক্ষ করল মাছের গন্ধ শুঁকতে খুব ভাল লাগছে তার, মোটেও বমি আসছে না। শুধু তাই নয়, ইচ্ছে করছে ব্যাগ খুলে কাঁচা মাছ চিবিয়ে খায়।

ইচ্ছেটা অস্বস্তি এনে দিল এরফানের মনে। এসব কি হচ্ছে? জ্বর আগেও অনেক হয়েছে, এমন পাগলাটে আচরণ কখনও করেনি তো।

ঘরে ফিরল এরফান টলতে টলতে, শরীরে ব্যথাটা বেড়েছে প্রচণ্ড, এবার বমি বমিও লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। মুখ হাঁ করে শ্বাস করছে এরফান, কেমন বিদঘুটে গোঙানির মত আওয়াজ বেরুচ্ছে গলা থেকে। মাছের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলল সে এক কোণে, উঠে বসতে চাইল বিছানায়, কিন্তু বেদম ঘুরে উঠল মাথাটা, পড়ে গেল মেঝেতে। অজ্ঞান হয়ে গেল এরফান।

কতক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিল এরফান জানে না, জ্ঞান ফিরে দেখে রাত হয়ে গেছে। ঘরের বাতি জ্বালানো হয়নি। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। অবাক ব্যাপার, অন্ধকারেও প্রায় সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। অথচ রাত কানা মানুষ সে। সে হাত বাড়িয়ে বেড সুইচ জ্বালল এবং ভয়ানক চমকে উঠল।

তার লম্বা, সরু আঙুলগুলো মনে হচ্ছে শুকিয়ে চিমসে মেরে গেছে; নখ বলতে কিছু নেই, ও জায়গায় সরু, শিং-এর মত দাগ পড়ে গেছে। বুকটা রীতিমত ঢিবঢিব করতে লাগল দেখে দু’হাতই ঢেকে গেছে পাতলা, হলুদ লোমে।

কাঁপতে কাঁপতে বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াল এরফান। ফিরে চাইল সবেধন নীলমণি ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার দিকে। ‘না-আ-আ-আ’ তীব্র চিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা চিরে। আয়নায় এরফান মোল্লা দেখতে পেয়েছে তার কপালের দুপাশ ক্রমশ সরু এবং উঁচু হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আয়নায় বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে যে দুটি চোখ, তার তারার রঙও কালো নয়, কেমন ঘোলাটে, হলদে।

ভীষণ আতঙ্ক গ্রাস করল এরফানকে। কি ঘটতে চলেছে বুঝতে পেরেছে সে। চূড়ান্ত সর্বনাশ হতে আর বাকি নেই। যদি না…

যদি না হলদে বেড়ালটার সে সন্ধান পায়। ওটাই এখন একমাত্র তাকে এই মহা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

চারতলার সিঁড়ি বেয়ে নামল সে হামাগুড়ি দিয়ে। মাথা, হাত-পা এই গরমেও ঢেকে রেখেছে চাদর দিয়ে। একটা রিকশা ডাকল এরফান হাত ইশারায়। রিকশাঅলা জানতে চাইল, ‘কই যাইবেন?’ কথা না বলে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করল এরফান-সামনে। জানে মুখ খুললে গলা দিয়ে কি বেরিয়ে আসবে।

রায়ের বাজার পুল পারের ব্রিজের কাছাকাছি এসে রিকশা থামাল এরফান। রিকশাঅলার হাতে বিশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত নেমে পড়ল। রিকশাঅলা ক্ষীণ চাঁদের আলোয় নোটটা ভালমত দেখে নিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। কারণ ঝিগাতলা থেকে রায়ের বাজারের ভাড়া দশ টাকাও নয়। সে কিছু বলার আগেই অন্ধকার রাস্তায় মিলিয়ে গেল এরফান।

এদিকে ইলেকট্রিসিটি নেই। তাতে বরং সুবিধে হয়েছে এরফানের। অন্ধকারে তার চোখ জ্বলছে। সে সবকিছু দিনের আলোর মত দেখতে পাচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে বলে রাস্তায় পথচারীদের চলাচল কম। ব্রিজের কাছে কোন লোকই নেই। চাদরটা একটানে ফেলে দিল এরফান। চার হাত পায়ে উন্মাদের মত ছুটল ব্রিজের নিচে, খালের পারে।

নেই, খালের ধারে কিছু নেই, খালের কালো পানিতেও কিছু নেই। তবু ব্যাকুল হয়ে বেড়ালটাকে খুঁজতে লাগল সে।

হঠাৎ ওটাকে দেখতে পেল সে।

হাত নয়, থাবার মত দুটো জিনিস বাড়িয়ে দিল সে ভেসে থাকা বেড়ালটাকে তুলে আনার জন্যে। ঠিক তখন নিস্তরঙ্গ কালো পানিতে বিস্ফোরণ ঘটল, পাতালের গভীর থেকে যেন উঠে এল শক্তিশালী দুটো হলুদ থাবা, খামচে ধরল এরফান মোল্লাকে, বিপুল টানে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেল সে খালের মধ্যে। কয়েক সেকেন্ড হুটোপুটি হলো। তারপর আবার ঢেউগুলো মিলিয়ে গিয়ে কাঁচের মত স্থির হয়ে গেল কালো জল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *