নেকড়ে মানবী
রূপোর গোল থালার মত একখানা চাঁদ উঠেছে আকাশে, ঝিলমিল প্রতিচ্ছবি ফেলেছে লেকের স্বচ্ছ কালো জলে। মুগ্ধ হয়ে জানালা দিয়ে দেখছি দৃশ্যটা, এই সময় হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকল আমার স্ত্রী ভায়োলেট। বিস্ফারিত হয়ে আছে ডাগর চোখজোড়া, চেহারায় রাজ্যের ভয়।
‘কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘ওয়েয়্যার উলফ,’ গুঙিয়ে উঠল ভায়োলেট।
ঠোঁট থেকে পাইপ নামালাম আমি, আর্ম চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালাম সোজা হয়ে, তারপর এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল ভায়োলেট আমার দিকে; চকচকে চাউনি। অবিকল চীনা পুতুল। ওর কাঁধ ধরে জোরে নাড়া দিলাম। নিভে গেল চকচকে চাউনিটা। ‘কি যেন বললে তুমি?’ হুকুমের সুরে জানতে চাইলাম।
‘একটা ওয়েয়্যার উলফ,’ ফিসফিস করে বলল ভায়োলেট। ‘ওটা আমাকে জঙ্গলে অনুসরণ করছিল। পায়ের শব্দ পেয়েছি আমি। কিন্তু পেছন ফিরে দেখার সাহস পাইনি। চাঁদ ওঠার সাথে সাথে ভয়ঙ্কর গলায় ডেকে উঠল ওটা।
‘নেকড়ের ডাক?’
‘সেরকমই মনে হলো।’
‘ওহ্, মনে হয়েছে!’
ঘন আঁখি পল্লবের নিচে ভায়োলেটের চোখের মণিজোড়া কেঁপে উঠল দ্রুত। মাথা নামাল ও, গালে গোলাপী আভা। লজ্জা পেয়েছে। আমি চুপচাপ কিছুক্ষণ দেখলাম ওকে। তারপর বললাম, ‘তুমি শুনেছ নেকড়ে ডাকছে?’
‘তুমি…শোনোনি…’ লাফিয়ে উঠল ভায়োলেট। চুপ হয়ে গেল হঠাৎ করেই।
আমি কঠিন ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়লাম। ‘প্লীজ, ভায়োলেট। একটু যুক্তিবাদী হবার চেষ্টা করো। গত হপ্তায় এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা অন্তত ছ’সাতবার কথা বলেছি। ঠিক আছে, আবারও তোমাকে বোঝাতে চেষ্টা করছি।’
ভায়োলেটের হাত ধরে আদর করে একটা চেয়ারে বসালাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে দিলাম। কেঁপে উঠল ভায়োলেটের ঠোঁট জোড়া, প্রায় গিলে ফেলছিল ও সিগারেট। কাশতে কাশতে কোনমতে সামলে নিল নিজেকে। ‘শোনো, ডার্লিং,’ শুরু করলাম আমি। ‘এখানে নেকড়ে-টেকড়ে কিচ্ছু নেই। কানাডার জঙ্গলে বা এদিকটাতে গত বিশ বছরে কোন নেকড়ের টিকিটিও দেখা যায়নি। ওল্ড লিওন-এর মালিক নিজে আমাকে এই তথ্য দিয়েছে। আর অদ্ভুত কোন কারণে দলছুট দু’একটা নেকড়ে উত্তর থেকে এদিকে, লেকের ধারে চলে এলে আসতেও পারে। তবে সেটা যে ওয়েয়্যার উলফই হবে তার কোন মানে নেই।
‘ওয়েয়্যার উলফের ব্যাপারটাই হচ্ছে কল্পনাপ্রসূত। আমাদের এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করলে চলে না। দয়া করে ভুলে যেতে চেষ্টা করো যে তোমার পূর্ব পুরুষরা ছিল কানুক সম্প্রদায়ের। তুমি এখন বিখ্যাত এক লেখকের স্ত্রী, কথাটা মনে রাখলে খুশি হব।’
ভায়োলেট আদিবাসী কানুক বংশের মেয়ে। এরা খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিল। খোঁচাটা ইচ্ছে করেই মেরেছি যাতে ভায়োলেট আঘাতটা সামলে নিতে পারে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। থরথর করে কেঁপে উঠল সে।
‘চার্লস; সত্যি বলছ কোন শব্দ শোনোনি তুমি?’
‘না, শুনিনি,’ বিড়বিড় করে বললাম আমি।
‘রাতের বেলা ওটা যখন ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়ায় তার শব্দও তোমার কানে যায়নি?’
‘না।’
‘তোমাকে তো সে রাতে আমি ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিলাম। দেয়ালে কারও ছায়া দেখোনি?’
আবার মাথা নাড়লাম। জোর করে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ‘আসলে আমার হরর স্টোরিগুলো পড়ে তোমার মাথাটা গেছে, ডার্লিং। জানি না কিভাবে বোঝাব তোমাকে যে গোটা ব্যাপারটাই আসলে ভিত্তিহীন কল্পনা।’
ভায়োলেট ঘনঘন কয়েকটা টান দিল সিগারেটে। ‘তুমি কখনও এই নেকড়ে বাঘটার কথা শোনোনি? একবারও ওটা জঙ্গলে তোমার পিছু নেয়নি? যখন একা ছিলে তখনও কিছু চোখে পড়েনি?’ অবিশ্বাসের সুর ভায়োলেটের গলায়।
‘না, এসব কিছুই ঘটেনি। নিরিবিলিতে লেখালেখি করব বলে তোমার এ আগে এখানে এসেছি আমি। কই, কোন ওয়েয়্যার উলফ, ভূত-প্রেত, জি- ভ্যাম্পায়ার তো চোখে পড়ল না। শুধু ইন্ডিয়ান, কানুক প্রজাতির লোক আর অল্প ক’জন সাদা চামড়ার মানুষ ছাড়া আর কাউকে দেখিনি আমি। ও হ্যাঁ, একবার লিওন থেকে ফেরার পথে রাস্তায় একটা গোলাপী হাতি দেখতে পেয়েছিলাম। তবে ওটা ছিল নিতান্তই দৃষ্টি বিভ্রম।’ হাসলাম আমি, যদিও হাসিটা স্পর্শ করল না ভায়োলেটকে। ‘সত্যি বলছি, ভায়োলেট। এমন হবে জানলে কিছুতেই তোমাকে এখানে আসতে বলতাম না। ভাবলাম গাছ-গাছালি, অরণ্য আর গ্রাম ভাল লাগবে তোমার। এখন দেখছি-’
‘দেখছ যে আমি পাগলামি শুরু করে দিয়েছি!’ কথাগুলো বিস্ফোরণের মত বেরিয়ে এল ভায়োলেটের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে।
‘আরে দূর! কি আবোল তাবোল বকছ! মেডিকেলের যে কোন ছাত্রও বলতে পারবে একটা কিছু ভুল দেখা বা শোনার মানে এই নয় যে, সে পাগল হয়ে গেছে বা মানসিক ভারসাম্যহীনতার শিকার হয়েছে।’ আমতা আমতা করে কথাগুলো বললাম বটে, কিন্তু চিড়ে ভিজল না তাতে।
‘তুমি আমাকে বোকা বানাতে পারবে না, চার্লস। আর আমি বোকার মত কিছু বিশ্বাস করার মত মেয়েও নই। এখানে নির্ঘাত রহস্যময় কিছু একটা ঘটেছে বা ঘটছে।’
‘দূর, দূর। বাদ দাও তো ওসব,’ আমি জোর করে হেসে বললাম। ‘মানুষ কত কিছুই ভাবে। বিয়ের আগে, কুইবেকে বসে তোমাকে ডাইনী সম্বোধন করে কত কবিতা লিখেছি। ভুলে গেলে সব? তাতে তুমি তো আর সত্যি সত্যি ডাইনী হয়ে যাওনি।’
এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল ভায়োলেট। ‘এটার সাথে ওটার কোন তুলনাই হতে পারে না।’
গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ঠিক আছে। এবার একটা জিনিস তোমার কাছ থেকে পরিষ্কার জানতে চাই, ডিয়ার। তুমি যে ইদানীং অকারণে ভয় পাচ্ছ এ কথা আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কি বলেছ?’
‘না।’
‘আর ঘটনাটা ঘটছে গত দু’সপ্তাহ ধরে। তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ। আমি আর এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। আমরা শীঘ্রি ডা. মেরক্সের সাথে এ নিয়ে কথা বলব। কনসালট্যান্ট হিসেবে এ তল্লাটে উনিই সেরা, জানো বোধহয়। উনি শুধু ডাক্তার নন, দারুণ একজন সাইকিয়াট্রিস্টও। আমার বিশ্বাস, উনি তোমার কথা শুনবেন। হয়তো ডায়াগনোসিসের মাধ্যমে অবাস্তব এবং উদ্ভট চিন্তাটা মাথা থেকে দূর করেও দিতে পারবেন।’
‘না, চার্লস। আমি ডা. মেরক্সকে দেখাতে চাই না।’
ভুরু কোঁচকালাম আমি। ‘বেশ। ইচ্ছে না হলে যাবে না। তবে তোমার রহস্যময় ওয়েয়্যার উলফ সম্পর্কে আমার আরও কিছু তথ্য জানা দরকার। তোমার হাফ-ইন্ডিয়ান নানী নিশ্চয় ছেলেবেলায় ভূত-প্রেতের নানা গল্প তোমাকে শোনাতেন। ভয়ঙ্কর সে সব গল্প শুনে ভয়ে আঁতকে উঠতে, না?’
ভায়োলেট মাথা ঝাঁকাল, ‘উই—মানে, হ্যাঁ।’
ছেলেবেলার কথা ওঠাতে ভায়োলেট অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। ‘তোমার নানী তোমাকে লিকানথ্রোপ মানে নেকড়ে-মানবদের গল্প বলেননি? নেকড়ে-মানবরা চাঁদ উঠলে শরীরের আকৃতি বদলে ফেলে, চার হাত পায়ে দৌড়াতে থাকে, তাদের ভূতুড়ে ছায়া পড়ে মাটিতে। নানী বলেনি নেকড়ে- মানবরা কিভাবে শিকারের পিছু নেয়, তারপর সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা লক্ষ্য করে। নেকড়ে-মানবদের কামড় যে খায় সে-ও পরবর্তীতে নেক’ড় হয়ে যায়, বলেনি নানী এসব?’
‘হ্যাঁ, বলেছে। বহুবার বলেছে।’
‘হুম্। এবার বুঝতে পেরেছি। যখন জঙ্গলে যাও তুমি, ছেলেবেলার ভয়টা ফিরে আসে মনে। কিন্তু ওয়েয়্যার উলফ বলে আসলে কিছু নেই, ডিয়ার। এটা স্রেফ বানোয়াট একটা গল্প। তুমি খামোকা একটা কল্পনা-আশ্রিত প্রাণীকে ভয় পাচ্ছ। আমার সাথে ফ্রি হবার চেষ্টা করো। দেখবে ওয়েয়্যার উলফ তোমার ঘাড় মটকে, শরীর ফালাফালা করতে ছুটে আসছে এই ভয়টা চলে যাবে-’
‘না! চুপ করো! প্লীজ-আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’ কান্নায় ভেঙে পড়ল ভায়োলেট।
‘সরি। তুমি এত ভয় পেয়েছ বুঝতে পারিনি। এসো, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভুলে থাকার চেষ্টা করি ব্যাপারটা। চলো, ঘরে চলো। বিশ্রাম নেবে।’
ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরে বেডরুমে ঢুকলাম আমি। কাপড় ছেড়ে উঠে পড়লাম বিছানায়, হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দিলাম বাতি। গাঢ় অন্ধকারে প্রায় ডুবে গেল ঘর। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। মাখন কোমল আলোয় ভিজছে গাছ-গাছালি। লেকটা থেকে যেন ছিটকে আসছে তরল রূপো। চোখ ঝলসে যায়। আমি পাশ ফিরে শুলাম। ভায়োলেট আড়ষ্ট হয়ে আছে। ঘন হয়ে এলাম ওর শরীরের কাছে। কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিক হয়ে এল ভায়োলেট। তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল কাঁধে ব্যথা পেয়ে। খামচে ধরে আছে ভায়োলেট আমাকে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে।
‘শোনো, চালর্স!’ ভয়ার্ত গলায় বলল ও।
কান খাড়া করলাম আমি।
‘শুনতে পাচ্ছ? ঘরের বাইরে-দরজার কাছে ওটা ঘষটাচ্ছে?’
আমি ব্যাপারটা পাত্তা দিতে না চেয়ে পাশ ফিরে শুতে গেলাম, ভায়োলেট টেনে ধরল আমাকে।
‘ওঠো, চার্লস, প্লীজ। জানালার নিচে চলে এসেছে ওটা। ওই শোনো আবার দরজার কাছে ছুটে গেল। কিছু একটা করো!’
আমি লাফিয়ে নামলাম বিছানা থেকে। ভায়োলেটের হাত ধরে বললাম, ‘চলো, গিয়ে দেখি কি ওটা।’
ফ্ল্যাশলাইট খুঁজতে গিয়ে আর্ম চেয়ারটার সাথে ধাক্কা খেলাম জোরে।
‘চলে যাচ্ছে ওটা।’ ফোঁপাতে শুরু করেছে ভায়োলেট। ‘তাড়াতাড়ি!’
এক হাতে ফ্ল্যাশলাইট ধরে অন্য হাতে ভায়োলেটকে প্রায় টানতে টানতে পা বাড়ালাম দরজার দিকে। ওকে ছেড়ে দিয়ে এক টানে দরজার খিল খুলে ফেললাম। ধাক্কার চোটে হাঁ হয়ে গেল দরজার দুই পাট।
বৃত্তাকারে ফ্ল্যাশলাইট ঘোরালাম আমি। আমাদের বাড়িটাকে ঘিরে থাকা চারপাশের উঠান সম্পূর্ণ ফাঁকা, ঝোপঝাড়গুলোতেও প্রাণের চিহ্ন নেই।
এবার পায়ের কাছে, মেঝেতে আলো ফেললাম আমি।
চিৎকার করে উঠল ভায়োলেট। ‘দেখো, চার্লস! বাইরে দেখো! পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে—দেখতে পাচ্ছ না তুমি?’
ওদিকে তাকালাম। দরজার বাইরে, মাটিতে বিরাট বিরাট পায়ের ছাপ। চতুষ্পদ প্রাণীর পায়ের ছাপ।
আমি ঘুরে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ওর মুখের দিকে। তারপর মাথা নাড়লাম। ‘নো, ডিয়ার,’ ফিসফিস করে বললাম। ‘ভুল করছ তুমি। আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কিছুই না।
পরদিন সকালে, ভায়োলেট তখনও ঘুমুচ্ছে, আমি গেলাম লিসার সাথে দেখা করতে।
লিসা থাকে চৌমাথায়, ওর বাবার সঙ্গে। বুড়ো লোকটা প্যারালাইজড হয়ে বহুদিন ধরে শয্যাশায়ী। লিসা ট্যুরিস্টদের কাছে ঝুড়ি, জপ মালা ইত্যাদি বিক্রি করে সংসার চালায়। সৌখিন এরকম দু’একটা জিনিস কিনতে গিয়ে গতমাসে লিসার সঙ্গে আমার পরিচয়।
সেদিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল লিসা ঝুড়ি ভর্তি নানা জিনিস নিয়ে। ভায়োলেটের জন্যে একটা ব্রেসলেট কেনার ইচ্ছে ছিল আমার, ওকে পাঠাব বলে। একা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। এই সময় লিসাকে চোখে পড়ল আমার।
আধা ইন্ডিয়ান আর আধা দেবীর চেহারা নিয়ে এক অপূর্ব, অলৌকিক নারী মনে হয়েছিল আমার লিসাকে সেই মুহূর্তে।
লিসার চুল কালো। রাতের অন্ধকারের চেয়েও কালো কেশ। চোখ দুটো আকর্ষণ করল সবচেয়ে বেশি। এত উজ্জ্বল, ঝকঝকে, তীব্র আবেদনময় চোখ জীবনে দেখিনি আমি। ডিমের মত মুখ, অসম্ভব মসৃণ ত্বক, যেন ক্রীম মেখেছে, চিকমিক করছে। বেশ লম্বা লিসা, মেদহীন একহারা গড়ন, কিন্তু এই শরীরটাই পরে মাখনের মত গলে গিয়েছিল আমার বুকের ভেতর তীব্র আলিঙ্গনে।
সেই ঘটনাটা ঘটেছিল লিসার সাথে পরিচয় হওয়ার ঠিক দুই দিন পরে।
অগ্রপশ্চাৎ কিছু বিবেচনা করিনি আমি। লিসার তীব্র শারীরিক আকর্ষণ আমার সমস্ত বোধ-বুদ্ধিকে স্রোতের বেগে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
নিষিদ্ধ ফল আস্বাদনে যে এত তীব্র রোমাঞ্চ আর শিহরণ মিশে থাকে লিসার সাহচর্যে না এলে হয়তো কোনদিনই জানতে পারতাম না।
এক অমাবস্যার রাতে, নিঃশব্দে এসেছিল লিসা আমার কাছে। নিঃসীম অন্ধকারে মিলিত হয়েছিলাম আমরা সর্বগ্রাসী খিদে নিয়ে। তারপর থেকে নিয়মিত চলল আমাদের এই নিষিদ্ধ অভিসার।
কিন্তু ভায়োলেটের আকস্মিক আগমন আমাদের মিলনে বেশ বড় বাধার সৃষ্টি করল। লিসাকে সমস্যাটার কথা খুলে বললাম আমি।
উঁচু গলায় হেসে উঠল লিসা। ‘এটা কিছুই না।’ বলল সে। ‘সাময়িক সমস্যা মাত্র।’
‘দূর, তুমি জানো না। ও আমাকে না নিয়ে আর এখান থেকে নড়ছে না।’ মাথা দোলাল লিসা, ঝিকিয়ে উঠল চোখ জোড়া। ‘সমস্যাটা আমাদের পোহাতে হচ্ছে ততদিন, যতদিন তোমার স্ত্রী বেঁচে থাকবে। তাই না?’
হালকা, স্বাভাবিক গলায় কথাটা বলল লিসা। যেন এটা একটা ঠাট্টা। কিন্তু ব্যাপারটা স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারলাম আমি-ঠাট্টা নয়, ঠাট্টাচ্ছলে সত্যি কথাটাই বলেছে লিসা। আমাদের মাঝে সমস্যার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভায়োলেট। প্রাচীরটাকে ভেঙে ফেললে আর কোন সমস্যা থাকে না।
ভায়োলেটকে আমার আর প্রয়োজন নেই। ওর প্রতি আমার আর কোন আকর্ষণও নেই। লিসাকে আমি ভালবাসি না, তবে তীব্র একটা আকর্ষণ অনুভব করি। লালসা আর কামনা ছাড়া আর কিছু নেই এই আকর্ষণের মাঝে। তবে ভয়াবহ শক্তি এই আকর্ষণের। আমাকে ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ সব ভুলিয়ে দিচ্ছে। লিসার জন্য আমি এই মুহূর্তে সব কিছু ছাড়তে পারি। সব কিছু করতে পারি।
লিসার দিকে তাকালাম। তুমি কি ওকে খুন করার কথা ভাবছ?’
‘না। খুন ছাড়াও আরও অনেক উপায় আছে।’
‘ইন্ডিয়ান ম্যাজিক?’
প্রেত চর্চা করে লিসা। বংশানুক্রমে করে আসছে ওরা। এক মাস আগে হলে ব্যাপারটা নিয়ে মশকরা করার সুযোগ ছাড়তাম না। কিন্তু এখন, লিসার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরে ওকে বুকের মাঝে ধরে রাখার এই মুহূর্তটিতে, আমি জানি, লিসার কথায় কতখানি যুক্তি আছে।
‘না, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। ধরো, তোমার স্ত্রীর মৃত্যু হলো না। কিন্তু ও যদি
অন্য কোথাও চলে যায়?’
‘ও আমাকে তালাক দিয়ে চলে যাবে, তাই বলতে চাইছ?’
‘ধ্যাৎ, তুমি আমার কথা বুঝতেই পারছ না। মানুষের হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেলে তাকে কোথায় রাখা হয়? পাগলা গারদেই তো?’
‘ভায়োলেটের মাথা খারাপ হয়নি। ও বেশ ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। ওকে পাগল বানাতে হলে অস্বাভাবিক কোন ঘটনা ঘটাতে হবে।’
‘ধরো, ও যদি বারবার চোখের সামনে নেকড়ে বাঘ দেখতে থাকে?’
‘নেকড়ে বাঘ?’
‘বাঘটা তোমার স্ত্রীকে শুধু অনুসরণ করতে থাকবে। ও যখন একা থাকবে, বাঘটা তখন শুধু ওকে ভয় দেখাবে, ডাক ছাড়বে, ওকে রাতে ঘুমাতে দেবে না, তাড়া করে ফিরবে। তোমার কাছে তখন সে সাহায্যের জন্যে ছুটে যাবে, ব্যাখ্যাও হয়তো চাইবে এখানে নেকড়ে বাঘ এল কোত্থেকে। তুমি তখন তার কথা অস্বীকার করবে। বলবে সে ভুল দেখেছে চোখে। এভাবে কয়েকদিন চললে একসময় তীব্র মানসিক চাপে সে…. কাঁধ ঝাঁকাল লিসা চুপ করে রইলাম আমি। ওর আইডিয়াটা মনে ধরেছে আমার। ঘটনাটা কিভাবে ঘটবে সে সম্পর্কে কোন আভাস দিল না লিসা। হয়তো এ ব্যাপারে ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাহায্য নেবে সে।
তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করলে আমি লিসার কথামত নিজের ভূমিকায় নিখুঁত অভিনয় করে যেতে লাগলাম। ভায়োলেট প্রতিদিনই একটা নেকড়েকে দেখেছে বলে আমার কাছে মুখ চোখ শুকনো করে অভিযোগ করে গেল। আর আমি যথারীতি বলে গেলাম, কিছু শুনিনি বা দেখিনি। লিসা যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল খাপে খাপে তাই মিলে গেল। মাথা খারাপ হয়ে যেতে লাগল ভায়োলেটের। ওয়েয়্যার উলফের দুঃস্বপ্ন ওকে পাগল বানিয়ে দিতে শুরু করল ধীরে ধীরে।
আরও খারাপ কিছু ঘটার অপেক্ষায় থাকল লিসা, তার মুখে ফুটতে যাচ্ছে বিজয়িনীর হাসি।
লিসা আজ সকালে আমার জন্যে চৌমাথার ধারে অপেক্ষা করবে বলেছিল। আমি যথাসময়ে গিয়ে হাজির হলাম ওর কাছে।
.
দিনের বেলা লিসাকে সাধারণ বেদেনীদের মত লাগে। যখন আঁধার ঘনিয়ে আসে, ঠিক তখন ওর চোখ জ্বলে উঠতে দেখি আমি।
আমার হাতে হাত রাখল লিসা, মনে হলো চামড়ার নিচে কিছু একটা ফেটে পড়তে চাইছে তীব্র উত্তেজনায়। লিসা আমার শরীর স্পর্শ করলে এমনই হয়। কখনও আগুনের ছ্যাকা খাই, কখনও শিরদাঁড়া চিরে নামতে থাকে ধারাল বরফ।
‘তোমার বউ কেমন আছে?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল সে।
‘ভাল না। কাল রাতে দরজার সামনে নেকড়ের থাবা দেখেছি। সেই থেকে মৃগী রোগীর মত কাঁপছে।’
হাসল লিসা।
‘ওর ধারণা, ওটা একটা ওয়েয়্যার উলফ। লিসার হাসিটা আরেকটু প্রসারিত হলো।’
‘আসল ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলবে, ডার্লিং? নেকড়েটাকে কোত্থেকে জোগাড় করেছ তুমি? ওটা ওর পেছনে লেগে আছে কেমন করে?’
ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসতেই থাকল লিসা।
হাল ছেড়ে দিলাম। ‘আমার বোধহয় এতটা কৌতূহল দেখানো ঠিক হচ্ছে না।’
‘ঠিক বলেছ, চার্লস। প্ল্যান মাফিক কাজ এগোচ্ছে, এটাই কি যথেষ্ট নয়? ভায়োলেট পাগল হতে চলেছে। আর কদিন পরে ওর জায়গা হবে পাগলা গারদে। ব্যস, তারপর আমরা আবার মিলিত হতে পারব আগের মত। তাহলেই তো হলো?’
আমি ওর চোখে চোখ রাখলাম। ‘হ্যাঁ, তাহলেই হলো। তবে এরপর কি ঘটবে সে সম্পর্কে একটু আভাস অন্তত দিতে পারবে, নাকি?’
‘তোমার স্ত্রী নেকড়েটাকে চাক্ষুষ করবে। আক্ষরিক অর্থেই জন্তুটাকে দেখতে পাবে সে। আরও আতঙ্কিত হয়ে উঠবে ভায়োলেট। তুমি আগের মতই ওর কথায় কোন আমল দেবে না। তারপর হয়তো ভায়োলেট গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে যাবে। ওদেরকে নেকড়ের গল্পটাকে বিশ্বাস করাতে চাইবে। কেউ ওর কথা বিশ্বাস করবে না। উল্টো সবাই ওকে পাগল ভাববে। তোমার কাছেও ওরা আসতে পারে। তুমি এ ব্যাপারে কিছুই জানো না বলে দেবে। ইতিমধ্যে ভায়োলেটের অবস্থা এমন হবে যে ডাক্তারী পরীক্ষা ওর জন্যে অনিবার্য হয়ে উঠবে। তারপর…’
‘নেকড়েটাকে ভায়োলেট দেখতে পাবে?’ প্রশ্ন করলাম। ‘সত্যি দেখবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কবে?’
‘তুমি যদি বলো তা হলে আজ রাতেই।’
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলাম। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। ‘কিন্তু ভায়োলেট যে রকম ভয় পেয়েছে তাতে জঙ্গলে আর নাও যেতে পারে।’
‘সেক্ষেত্রে নেকড়েটা নিজেই ওর ঘরে ঢুকবে।’
‘তাহলে আর সমস্যাই নেই। আজ সকালে যেভাবে করেছি, নিখুঁতভাবে মুছে ফেলব পায়ের সমস্ত দাগ।’
‘ভাল কথা। আজ রাতে তোমার ঘরে না থাকাই মঙ্গল, চার্লস। তুমি আবেগপ্রবণ মানুষ। নিজের স্ত্রীকে চোখের সামনে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে দেখলে খারাপই লাগবে হয়তো তোমার।’
আমি হাসলাম শুধু। কিছু বললাম না। লিসাও হাসল। চলে আসছি, পেছনে খল খল করে হাসতেই লাগল লিসা। অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে ওর হাসিতে। কেন যেন গা-টা শির শির করে উঠল।
ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হলো, লিসা নিজেও আসলে স্বাভাবিক মেয়ে নয়। রাতের খাওয়াটা সারলাম প্রায় নিঃশব্দে। লেকের ওপর চাঁদ উঠে এসেছে, মুখ অন্ধকার করে জানালার পর্দা টেনে দিল ভায়োলেট।
‘কি হলো আবার? এত সুন্দর চাঁদের আলো ভাল লাগছে না তোমার?’ অবাক হলাম আমি।
‘চাঁদনী রাত ঘৃণা করি আমি, চার্লস।’
‘এত চমৎকার ঝলমলে জোছনা!’
‘আমার কাছে চমৎকার নয়। রাত আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মত।
আমি নরম গলায় বললাম, ‘ভায়োলেট, আমার মনে হয় এখানে নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছ না তুমি। সম্ভবত তোমার মনের ওপর খুব চাপ পড়ছে। শহরে ফিরে যাবে?’
‘একা?’
‘কাজ শেষ হলে আমিও চলে আসব।’
কপালের ওপর এক গোছা চুল পড়েছিল, আঙুল দিয়ে ওগুলোকে পেছন দিকে ঠেলে দিল ভায়োলেট। আমি এই প্রথম লক্ষ করলাম ওর কেশরাজিতে আগের সেই চকচকে, মসৃণ ভাবটা নেই। ম্লান, বিবর্ণ চাউনির মতই চুলও তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। ‘না, চার্লস। একা কোথাও যেতে পারব না আমি। ওটা ঠিক আমার পিছু নেবে।’
‘কি?’
‘নেকড়ে।’
‘কিন্তু নেকড়েরা কখনও শহরে ঢোকার সাহস পায় না।’
‘সাধারণ নেকড়েরা পায় না। কিন্তু এটা–’
‘তোমার কি করে ধারণা হলো এই নেকড়েটা…ইয়ে মানে… সাধারণ নয়?’
আমার আড়ষ্ট ভাবটুকু ভায়োলেট হয়তো লক্ষ করে থাকবে। কিন্তু চিন্তিত থাকায় ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। দ্রুত বলতে লাগল, ‘কারণ নেকড়েটা আসে শুধু রাতের বেলায়। তাছাড়া এখানে সত্যিকার অর্থে আর কোন নেকড়েও নেই। ওটা যে শয়তান নেকড়ে তা আমি ভাল করেই টের পাই। ওটা খালি খালি ঘুর ঘুর করে না, চালর্স-ওটা আমাকে দুঃস্বপ্নের মত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর একা শুধু আমাকেই। যেন কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় আছে নেকড়েটা। আমি কোথাও গেলেও ওটা পিছু ছাড়বে না। যেখানে যাই ছায়ার মত লেগে থাকবে। আমার পক্ষে তাই পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’
‘পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কারণ নেকড়ের ভয় তোমার মনের ভেতর গভীরভাবে ঢুকে গেছে।’ রেগে গেলাম আমি। ‘ভায়োলেট, আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি। তোমার জন্যে আমার কাজের ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। গত দুই হপ্তা ধরে তোমার কল্পিত নেকড়ের একঘেয়ে গল্প শুনতে শুনতে কান পচে গেছে আমার। তোমার আসলে ডাক্তার দেখানো উচিত। আমি বিকেলে ডা. মেরক্সের সাথে তোমার বিষয়ে কথা বলেছি। উনি তোমাকে পরীক্ষা করে দেখতে চান।’
কুঁকড়ে গেল ভায়োলেট আমার কথার তোড়ে। মুখখানা কালো হয়ে গেছে। কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠল ও, ‘তার মানে…তুমি বলতে চাও আমার মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে?’
‘ওয়েয়্যার উলফের কোন অস্তিত্বই নেই,’ বললাম আমি। ‘অতিপ্রাকৃত কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই, ভাল করেই জানো। কাজেই আমার ধারণা, মানসিক চাপের কারণে তুমি উদ্ভট কিছু একটা কল্পনা করে বসে আছ।’ কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
ভায়োলেট মুখ তুলে চাইল, চোখে বিস্ময়। ‘কোথায় যাচ্ছ?’ ফিসফিসানির মত শোনাল কণ্ঠ।
‘লিওনে। একটু ড্রিঙ্ক করে আসি। মাথাটা ধরে আছে। ঠাণ্ডা বাতাসটা কাজে দেবে।’
‘আমাকে একা রেখে যেয়ো না, চার্লস!’
‘কেন, জুজুর ভয় পাচ্ছ,’ ভর্ৎসনা করলাম আমি। ‘নাকি ভাবছ তোমার কল্পনার সেই ওয়েয়্যার উলফ আসবে আমি চলে গেলে?’ কঠিন গলায় বললাম। ‘শোনো, ভায়োলেট, যদি তুমি আমাকে বিশ্বাস করাতে চাও যে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ আছ তা হলে সেটা প্রমাণ করার এখনই সুযোগ। আমি তোমাকে একা রেখে যাচ্ছি। আশা করি এসে দেখব দাঁত-কপাটি লাগিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে নেই তুমি।’
‘চার্লস-’
দরজার কাছে চলে এলাম আমি, খুললাম কপাট। মেঝের ওপর ভরা জোছনার আলো থই থই করছে, যেন রূপোর একটা পুকুর। সেদিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল ভায়োলেট। আমি ওর দিকে ফিরে হাসলাম। ‘ভায়োলেট,’ কোমল গলায় বললাম, ‘তোমার উদ্ভট কথাবার্তা ধৈর্য ধরে অনেক শুনেছি। কিন্তু তুমি যদি ডাক্তারের কাছে না যেতে চাও, এখানে থাকার জেদ দেখাও আর নিজের মানসিক চাপকে অস্বীকার করতে চাও-তা হলে প্রমাণ করে দেখাও যে তোমার কথাই ঠিক।’
ঘুরে দাঁড়ালাম আমি, বন্ধ করলাম দরজা, তারপর ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে গটগট করে হাঁটা শুরু করলাম।
সত্যি, চমৎকার একটি রাত। ঠাণ্ডা বাতাস টানলাম বুক ভরে। ভায়োলেটকে মিথ্যা কথা বলেছি। লিওনে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। আসলে যাচ্ছি আমার লিসার কাছে।
লিসার ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। অন্ধকার ঘর। লিসা শুয়ে পড়েছে নাকি? ওর বুড়ো বাপ তাড়াতাড়িই ঘুমায়। কানের কাছে বোমা ফাটালেও সে ঘুম সহজে ভাঙার নয়। কাজেই ঘরে ঢুকলেও বুড়ো কিছুই টের পাবে না।
আমি ঢুকে পড়লাম ভেজানো দরজা ঠেলে। লিসা হয়তো বিছানায় আমার জন্যেই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল শরীর। এমন রাত তো মিলনেরই রাত। কোন্ আহাম্মক হেলায় হারায় এ সুযোগ?
.
মাত্র ক’পা এগিয়েছি, হঠাৎ দরজার চৌকাঠে শব্দ হতে দাঁড়িয়ে পড়লাম, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।
খুলে যাচ্ছে দরজা, আস্তে আস্তে। মানুষের একটা আকৃতি যেন মাটি ফুঁড়ে বেরুল। চট করে পিছিয়ে গেলাম ঘরের অন্ধকার কোণটার দিকে।
‘লিসা!’ ফিসফিস করে ডাকলাম। ঘুরে দাঁড়াল সে, এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তুমিও তাহলে আমার মতই চমক সৃষ্টি করতে চেয়েছিলে,’ ওর কোমল বাহু ধরে বিড়বিড় করলাম আমি। ‘চলো, অন্য কোথাও যাই।’ ওকে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম আমি। লেকের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। লিসা চুপচাপ চলেছে আমার সঙ্গে।
লেকের ধারে এসে আর তর সইল না আমার। শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলাম ওর সরু কোমর। আমাকে অবাক করে দিয়ে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল লিসা।
‘না, চার্লস। আজ নয়। আজ একটা কাজ আছে আমার। এখুনি চৌমাথায় যেতে হবে একবার।
‘কেন?’
‘ওখানে কিছু জিনিস নিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে একজন।’
‘তাহলে অপেক্ষা করতে থাকুক তোমার লোক।’ বলে দু’হাতের চেটোতে লিসার অপরূপ মুখখানা বন্দী করলাম আমি, ঝুঁকে এলাম। চুমু খাব। মুখ সরিয়ে নিল সে।
‘কি হলো, লিসা?’
‘বললাম তো, আমার কাজ আছে।’
‘উঁহু, অন্য কিছু একটা হয়েছে তোমার। কি হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি। তুমি এখন যাও, চার্লস।’
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ওর কাছ থেকে এ ধরনের প্রত্যাখ্যান এই প্রথম। অভিমান আর ক্ষোভ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি, এই সময় চোখে পড়ল ব্যাপারটা। লিসার মুখখানা অস্বাভাবিক চকচকে দেখাচ্ছে না? চোখ দুটো বিস্ফারিত, ভীষণ ঝিকমিক করছে, ফাঁক হয়ে গেল টসটসে ঠোঁট জোড়া-প্রেমের আবেগে নয়, প্রত্যাখ্যানের ভঙ্গিতে।
লিসা আমার দিকে তাকিয়ে নেই, তার দৃষ্টি যেন আমাকে ভেদ করে গেছে, চেয়ে আছে চাঁদের দিকে। ওর চোখের তারায় দুই চাঁদের চিকচিকে প্রতিচ্ছবি। মণি দুটো বড় হচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে আয়তনে, রূপোলি আগুন থই থই করছে চোখে, পাপড়িগুলো হয়ে উঠল ঘন লাল।
‘চলে যাও, চার্লস,’ বিড়বিড় করল সে। ‘যাও–জলদি!’
কিন্তু আমি আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। কি ঘটতে যাচ্ছে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি। মানুষ থেকে নেকড়েতে রূপান্তরের ঘটনা এতদিন বইতে পড়েছি। আজ চোখের সামনে সেটা ঘটতে দেখতে পাচ্ছি
লিসার রূপান্তরটা আক্ষরিক অর্থেই দেখার মত হলো। প্রক্রিয়াটা শুরু হলো শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে। শ্বাস নিতে গিয়ে প্রথমে হাঁপিয়ে উঠল লিসা; হাঁপানোটা অতি দ্রুত রূপান্তর ঘটল কর্কশ গোঙানিতে। ওর সুগঠিত বুক দুটো বারবার উঁচু হলো, আবার নিচু হলো, সেই সাথে ঘটতে লাগল ব্যাপক পরিবর্তন।
মসৃণ, চওড়া কাঁধ জোড়া নুয়ে গেল সামনের দিকে। শরীর বেঁকে গেল না বটে, তবে পেছনের দিকটা ক্রমশ ঢালু হতে লাগল। কাঁধের জয়েন্টের মধ্যে বাহু জোড়া ঢুকে যাচ্ছে, উঁচু হয়ে উঠল জায়গাটা।
মাটিতে শুয়ে পড়েছে লিসা এখন; শরীরের অর্ধেক অংশ গাছের ছায়ায়, বাকিটা চাঁদের আলোতে। কাটা সাপের মত মোচড় খাচ্ছে ও। ত্বকের চকচকে, মাখন কোমল ভাবটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য, কালো এবং গাঢ় হয়ে উঠল চামড়া, শরীর ফুঁড়ে বেরুতে শুরু করল থোকা থোকা লোম।
আসন্ন প্রসবা নারী সন্তান জন্মদানের সময় যেভাবে গোঙায়, লিসার গলা চিরে সে রকম গোঙানি বেরিয়ে আসতে লাগল। আর এক অর্থে সেও জন্ম দিতে চলেছে, তবে নতুন কোন সৃষ্টিকে নয়, নিজের আরেক সত্তাকে।
খুলির আকৃতি বদলে গেল অদ্ভুত ভাবে-যেন অদৃশ্য এক কারিগর জীবন্ত কাদা দিয়ে ইচ্ছেমত পিষে, ঠেসে, ময়দা তাল পাকানোর মত হাড়সর্বস্ব কাঠামোটাকে নতুন একটা রূপ দিচ্ছে।
এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো প্রসারিত মাথাটা যেন এক কোপে কেউ দু’ভাগ করে ফেলল, পরক্ষণে চকচকে লোম বেরিয়ে এল তালু ফুঁড়ে, সড়সড় করে কান দুটো ছুঁচাল আর আকারে বড় হয়ে উঠল, ঘাড় হয়ে গেল মোটা, তাতে গোলাপী রঙের ছিটে। লিসার চোখ দুটো লম্বাটে হলো, পাতলা ফালির মত। একই সাথে মুখের মাংসপেশীতে ধরল খিঁচ, সরু হয়ে এল মুখ, সৃষ্টি করল ফোলা নাক। মুখ হাঁ হয়ে গেল লিসার, চোয়ালে ক্ষুরধার দাঁতের সারি।
লিসার শরীরে এখন কাপড় চোপড়ের বালাই নেই, দেখলাম পেশীগুলো গলতে শুরু করেছে, শরীরটা ছোট হয়ে আসছে, গজাচ্ছে লোম, নমনীয় হয়ে নতুন একটা আকৃতি পেতে চলেছে। তীব্র যন্ত্রণায় হাত দিয়ে মাটি খামচে ধরেছিল লিসা। চোখের সামনে ও দুটো পরিণত হলো রোমশ থাবায়।
লিসার নেকড়ে-মানবীতে রূপান্তরের পুরো ঘটনাটা ঘটতে লাগল প্রায় সাড়ে তিন মিনিটের মত। সঠিক হিসেবটা দিতে পারলাম। কারণ ঘড়ির দিকেও নজর ছিল আমার।
ভয়ঙ্কর এই দৃশ্যটা দেখে অনেকে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যেত। আমি যে ভয় পাইনি তা বলব না, তবে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা চাক্ষুষ করতে পারার বিস্ময়বোধ এবং মুগ্ধতার প্রবলতা আমার ভেতরে ভীতি বোধটাকে সেভাবে জাগিয়ে তুলতে পারেনি।
রূপান্তরের প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল দেহী নেকড়ে, হাঁপাচ্ছে।
.
এখন আমি বুঝতে পারছি লিসা কেন বেশ কয়েকটা রাত একা কাটিয়েছে আমাকে ছাড়া, কেন আমাকে সে চলে যেতে বলেছিল-কেনই বা ভূতুড়ে নেকড়ের ভৌতিক কাণ্ডকারখানা সম্পর্কে আগেভাগে সে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিল।
আমি মৃদু হাসলাম।
পাশবিক, বুনো দৃষ্টি প্রাণীটার চোখে; আমাকে দেখছে যেন অবাক হয়ে। অবশ্য অবাক হওয়ার কারণ আছে ওর। ও ভেবেছিল আমি ভয় পাব, আঁতকে উঠব, অন্তত কিছু একটা প্রতিক্রিয়া আমার হবেই। উল্টো আমি কিনা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছি।
গুঙিয়ে উঠল নেকড়ে, একটু পরে প্রায় বেড়ালের মত আদুরে গলায় গরগর করতে লাগল। এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়েছে ওটা, আমি ওর কোন ক্ষতি করব না।
‘এখনই রওনা হয়ে যাও,’ ফিসফিস করে বললাম আমি।
এখনও আড়ষ্টভাব ওর চেহারায়। আমি ঝুঁকে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, চটচটে আঠাল একটা ভাব আছে চামড়ায়। ‘ঠিক আছে, লিসা,’ বললাম আমি। ‘আমার ওপর তুমি বিশ্বাস রাখতে পারো। আমি আগের মতই তোমাকে ভালবাসি। তোমার এই রূপান্তর আমাদের দু’জনের পারস্পরিক আকর্ষণের অনুভূতিতে কোন দেয়াল তুলতে পারবে না।’
লোমশ বুকের গভীর থেকে এবার গরগর আওয়াজটা বেরিয়ে এল।
‘যাবার এখনই সময়,’ তাগাদা দিলাম আমি। ‘ভায়োলেট বাড়িতে একা। যাও, ওকে তোমার চেহারাটা দেখিয়ে এসো।’
ঘুরে দাঁড়াল ধূসর প্রাণীটা, এক লাফে ঢুকে পড়ল পেছনের জঙ্গলে।
আমি লেকের তীরে গিয়ে বসলাম, তাকিয়ে থাকলাম পানির দিকে। ঝিলমিলে আলোর খেলা হ্রদের স্বচ্ছ জলে।
ঠিক ওই মুহূর্তে অন্য ধরনের একটা আবেগ চলে এলু আমার ভেতরে। সবকিছু যেন পরিষ্কার হয়ে গেল নিমিষে। বুঝতে পারলাম শরীরের তাড়নায় মস্ত একটা ভুল করে ফেলেছি আমি। একটা মেয়ে, যে নিজেই মোটে স্বাভাবিক নয়, তার পাল্লায় পড়ে আমার ভাল মানুষ বউটাকে আমি পাগল বানিয়ে ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছি। আর এমন একটা মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যে আসলে মানুষ নয়, ওয়েয়্যার উলফ। আসলে আমার নিজেরই মাথার ঠিক নেই। নইলে কি করে এ কাজ করতে পারলাম।
এখন কি করব আমি? ছুঁড়ে দেয়া ঢিল আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এবার ঘটতে শুরু করবে ছকে বাঁধা ঘটনা। যা চেয়েছিলাম তাই হয়তো পাব আমি শেষে। কিন্তু আসলে কি এই প্রত্যাশাই ছিল আমার?
বুক ভেঙে কান্না এল। ফুঁপিয়ে উঠলাম। না, অনুতাপে দগ্ধ হয়ে কাঁদছি না, কাঁদছি না বুক হালকা করতে বা ভয়ে। হঠাৎই চিন্তাটা মাথায় খেলে গেছে আমার-লিসাকে আমি বাহুডোরে বন্দী করে রেখেছি, টের পাচ্ছি তার শারীরিক পরিবর্তন; ওর রক্ত লাল ঠোঁটে চুমু খাওয়ার জন্যে মুখ নামালাম, এই সময় দেখলাম আমার মুখের সাথে ঠেসে ধরা কোন সুন্দর নারী নয়, একটা নেকড়ের কামনা ভরা বীভৎস মুখ।
হঠাৎ ফোঁপানি বন্ধ হয়ে গেল আমার জঙ্গল ভেদ করে আসা দূরাগত নেকড়ের প্রলম্বিত চিৎকারে।
কানে হাত চাপা দিলাম আমি। শিউরে উঠলাম।
.
জঙ্গলের মাঝ দিয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করেছি। নেকড়ের ডাক আর শুনতে পাইনি, তবে নিজের বাড়ি লক্ষ্য করে জানবাজি রেখে ছুটছি। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফিয়ে উঠলাম, গোঙাচ্ছি, ঘামে ভিজে গোসল হয়ে গেছি। তবুও এক সেকেন্ডের জন্যেও কোথাও দাঁড়ালাম না জিরোবার জন্যে।
আমাদের ঘরটা অন্ধকার। দরজায় ধাক্কা দিলাম। ভেতর থেকে বন্ধ।
ভায়োলেটের চিৎকার শুনলাম ঘরের ভেতর থেকে। দেহ-মনে স্বস্তির পরশ বয়ে গেল। ও আছে-বেঁচে আছে।
হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল আমার।
ওয়েয়্যার উলফরা শুধু ভয় দেখায় না…হত্যাও করে।
আমার সাড়া পেয়ে দরজা খুলে দিল ভায়োলেট, পরমুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল বুকে। কাঁদছে ও। কান্নার চোটে হেঁচকি উঠে গেছে।
‘ওটাকে দেখেছি আমি!’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল ভায়োলেট। ‘জানালা দিয়ে উঁকি মারছিল। নেকড়ে হলেও চোখ দুটো ছিল মানুষের মত।
‘সবুজ চোখ মেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে-তারপর দরজা খোলার চেষ্টা করল—থেকে থেকে ডাকছিল-আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম-ওহ্, চার্লস, বাঁচাও আমাকে-বাঁচাও!’
আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দিলাম না আমি। আতঙ্কিত, অসহায় মুখটা দেখে প্ল্যান মাফিক কাজটা করতে সায় দিল না মন। তার বদলে ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলাম। ‘হ্যাঁ, ডিয়ার,’ বিড়বিড় করে বললাম, ‘আমি জানি তুমি ওটাকে দেখেছ। আমিও দেখেছি-জঙ্গলে। তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। ওটার ডাকও শুনতে পেয়েছি। ঠিকই বলেছ তুমি-ওটা নেকড়েই বটে।’
‘নেকড়ে নয়, ওয়েয়্যার উলফ,’ আমার ভুল শুধরে দিল ভায়োলেট।
‘ওই হলো আর কি। কাল চৌমাথায় যাব আমি দলবল নিয়ে। নেকড়েটাকে খুঁজে পাই কিনা দেখব।’
আমার দিকে তাকিয়ে হাসল ভায়োলেট। এখনও কাঁপুনি থামেনি, তারপরও জোর করে হাসছে।
‘ভয়ের কিছু নেই, ডার্লিং,’ অভয় দিলাম ওকে। ‘আমি তো আছি তোমার সাথে। এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সে রাতে আমরা সন্ত্রস্ত বাচ্চাদের মত পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালাম।
ঠিক যেমন ঘুমাতাম আগে।
দুপুরের পরে ঘুম ভাঙল আমার। ভায়োলেটকে দেখলাম নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত।
বিছানা ছেড়ে সোজা ঢুকলাম বাথরূমে। শেভ-টেভ সেরে, মুখ ধুয়ে দেখি টেবিল সাজিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে ও।
বাড়ির চারপাশে নেকড়ের পায়ের ছাপ,’ খেতে খেতে বলল ভায়োলেট। এই প্রথম এ প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলল ও, একটুও গলা কাঁপল না।
‘ও নিয়ে ভাবতে হবে না,’ বললাম ওকে। ‘এখন চৌমাথা যাব। লিওন, ডা. মেরক্সসহ আরও যে ক’জনকে পাই, সবাইকে খুলে বলব ঘটনা। তারপর চেষ্টা করব শেরিফের হেডকোয়ার্টারে যেতে।’
‘তোমরা কি নেকড়ে শিকারে বেরুবে?’
‘অবশ্যই। ওটাকে নিজের হাতে খুন করতে পারলে শান্তি পাব আমি। নইলে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্যে জীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।
আমাকে চুমু খেলো ভায়োলেট।
আমি বাইরে গেলে একা থাকতে ভয় লাগবে না তোমার?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘মোটেও লাগবে না। ‘
‘ভেরী গুড।’
চৌমাথা যাওয়ার পথে আবোল-তাবোল অনেক চিন্তা ভিড় করে এল মাথায়। পাত্তা দিলাম না। চৌমাথার ধারে লিওনে ঢুকে মদের অর্ডার দিলাম।
মোটকু লিওন বাঁটকু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিল বারের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে। হাত ছুঁড়ে, চোখ ঘুরিয়ে কথা বলছিল লিওন। আমার চোখে চোখ পড়তে আচমকা ব্রেক কষল সে, হেলেদুলে এগিয়ে এল।
‘মি. কোলবি যে! কেমন আছেন?’
‘আছি আর কি। কাজের চাপে এদিকে আসাই হয় না।’
‘ঘরে বসেই বুঝি সময় কাটাচ্ছেন?’ নিপাত
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিওন আমার দিকে। আমার অস্বস্তি লাগল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালাম, জবাব দিতে ইতস্তত করছি দেখে নিজের কাছেই অবাক লাগল। ‘হ্যাঁ। আমার স্ত্রীর ক’দিন ধরে শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। তাই ওকে বেশি সঙ্গ দিতে হচ্ছে।’
‘আপনাদের ওদিকটা তো লোকালয় থেকে বেশ দূরে, তাই না?’
‘জানেনই তো। আবার জিজ্ঞেস করলেন যে?’
‘এমনি। ভাল কথা, ইদানীং রাতে আপনারা কিছু শুনতে-টুনতে পাচ্ছেন?’
‘কি শুনব? ব্যাঙের ডাক আর ঝিঁঝির কোরাস ছাড়া-
‘নেকড়ের ডাক শোনেননি কখনও?’
চোখ পিটপিট করলাম আমি। লিওন আগের মতই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কো’নেকড়ের ডাক সত্যি শোনেননি?’ গলা খাদে নামাল লিওন।
মাথা নাড়লাম। মনে মনে প্রার্থনা করলাম লোকটা যেন ভুলেও আমার হাতের দিকে না তাকায়। ও দুটো কাঁপতে শুরু করেছে।
আশ্চর্য তো! লেকের পাড় থেকে ডাকটা আরও স্পষ্ট শোনার কথা।’
‘এদিকে নেকড়ে-টেকড়ে নেই বলেই তো জানি…’
‘হ্যাঁ!’ নাক দিয়ে বিদঘুটে শব্দ করল লিওন।
‘আপনি দেখছি কিছুই জানেন না।’নায়া
‘মানে?’
‘বিগ পিয়েরেকে চেনেন-আরে, আপনাদের লেকের ধারেই নিগ্রো লোকটার বাড়ি।’
‘হ্যাঁ। চিনতে পেরেছি।’
‘সে গতকাল শহরে গিয়েছিল কি একটা কাজে। তার মেয়ে ইভোন একা ছিল ঘরে। ওর কাছ থেকে নেকড়েটার কথা জানতে পারলাম।
‘ও নিজে বলেছে আপনাদেরকে?’
‘তা বলেনি। আজ সকালে ডা. মেরক্স ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসছিলেন, ওকে শুভেচ্ছা জানাতে ভেতরে ঢুকেছিলেন তিনি। দেখলেন উঠানে পড়ে আছে ইভোন। নেকড়েটা ওকে ফালাফালা করে রেখে গেছে। ঈশ্বর ওর আত্মাকে শান্তি দিক।’
‘মারা গেছে!’
জ্বী। সে বড় বীভৎস মৃত্যু। ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। নেকড়েটার পায়ের ছাপ ধরে জঙ্গল পর্যন্ত গিয়েছিলেন ডা. মেরক্স। ওখানে ছাপ হারিয়ে ফেলেন তিনি। তবে বিগ পিয়েরে ফিরে এলে নেকড়েটাকে তিনি শিকার করতে বেরুবেন।’
ডা. মেরক্স হেলান দিয়ে আছেন বার-এ, তাঁর ঝাঁটার মত গোঁফ জোড়া লাফাচ্ছে উত্তেজনায়।
‘ঘটনাটা শুনে কি মনে হলো, চার্লস? একটা দলছুট খুনে নেকড়ে ঢুকে পড়েছে এ অঞ্চলে? আমি শেরিফের সাথে দেখা করব, বলব সবাইকে যেন নেকড়েটার ব্যাপারে সাবধান করে দেন তিনি। আপনি যদি বেচারী মেয়েটার ক্ষতবিক্ষত লাশটা একবার দেখতেন…’
আমি এক ঢোকে সাবাড় করলাম বাকি মদটুকু। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এগোলাম দরজার দিকে।
‘ভায়োলেট।’ কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বললাম। ‘ও বাড়িতে একা। আমাকে এক্ষুণি বাড়ি ফিরতে হবে।’
বেরিয়ে এলাম বার থেকে, সূর্যালোকিত রাস্তা ধরে প্রায় দৌড়ের ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করলাম।
.
এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি লিসা ভায়োলেটকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছিল। বুঝতে পারছি ওয়েয়্যার উলফরা নিজেদের আকৃতি পরিবর্তন ছাড়াও অনেক কিছুই করতে সক্ষম।
সোজা লিসাদের রাস্তার ধারের বাড়িতে চলে এলাম। বন্ধ। দরজায় টোকা দিলাম। বুড়ো লোকটার গোঙানি শুনতে পেলাম শুধু ভেতর থেকে।
ফিরে আসছি, এই সময় খুলে গেল দরজা। লিসা দাঁড়িয়ে চৌকাঠে, সূর্যের আলো পড়েছে মুখে, পিটপিট করছে চোখ, ওর চেহারাটা ম্লান, বিবর্ণ, চুলগুলো আলুথালু ঝুলছে পিঠের ওপর।
‘চার্লস-কি ব্যাপার?’
আমি ওকে বাড়ির পেছনে গাছ-গাছালির ছায়ার নিচে টেনে নিয়ে গেলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকল বিস্মিত দৃষ্টিতে, মুখখানা অসম্ভব শুকনো, চোখে ক্লান্তির ছাপ।
টেনে চড় বসালাম লিসার গালে। ঝাঁকি খেলো ও, সরে যেতে চাইল, কিন্তু আমি শক্ত করে কাঁধ চেপে ধরে আরেকটা থাপ্পর মারলাম। উঁউঁ করে কাঁদতে শুরু করল লিসা, যেভাবে কুকুর কাঁদে বা নেকড়েরা।
আবারও আঘাত করলাম আমি, শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে, ঘৃণায় থরথর করে কাঁপছে গা, গলায় কি যেন ডেলা পাকিয়ে গেছে, বলতে চাইছি অনেক কিছু, কিন্তু শব্দগুলো বেরিয়ে আসছে না পরিষ্কারভাবে।
‘গর্দভ, হিসিয়ে উঠলাম আমি। ‘কেন এ কাজ করতে গেলে?’
লিসা কাঁদতেই থাকল, ওকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলাম। ‘নাকি কান্না থামাও! তুমি ভেবেছ কাল রাতের কথা আমি কিছু জানি না, না? শুধু আমি নই, এখানকার সবাই জানে। কেন কাজটা করলে, লিসা? জবাব দাও!’
কান্না বন্ধ হয়ে গেল লিসার। বুঝতে পেরেছে কেঁদে আমার মন গলাতে পারবে না।
‘বাধ্য হয়ে করেছি,’ ধরা গলায় বলল ও। ‘তুমি জানো না ব্যাপারটার প্রকৃতি কি। তোমার স্ত্রীকে ছেড়ে আমি লেকের ধারে চলে আসি। এই সময় ওটা গ্রাস করে বসে আমাকে।’
‘কি গ্রাস করে বসে?
‘খিদে,’ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে লিসা। ‘প্রচণ্ড খিদে। যখন খিদে পায় তখন শরীরের ভেতর যে কি উথাল-পাথাল শুরু হয় তা তোমাকে বোঝাতে পারব না, চার্লস। মনে হয় পেটের ভেতর কেউ ক্রমাগত আঁচড় কাটছে, মগজ চাচ্ছে। তখন মাথা খারাপ হয়ে যায়। বিগ পিয়েরের ঘরের সামনে দিয়ে আসছিলাম, ইভোনকে চোখে পড়ল হঠাৎ। কুয়োতলায় ছিল ও, অন্ধকারে পানি তুলছিল। ওকে দেখলাম আমি। তারপর কি হয়েছে মনে নেই আমার।’
ওকে ধরে আবার ঝাঁকি দিতে শুরু করলাম, দাঁত-কপাটি লেগে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ছেড়ে দিলাম। ‘মনে নেই, না? মেয়েটা মারা গেছে।’
‘ওহ্, ঈশ্বর! তাহলে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে,’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল লিসা। ‘মানে?’ কপালে ভাঁজ পড়ল আমার, ‘বেঁচে গেছে মানে?’
‘ও যদি মারা না যেত-আমার কামড় খেয়েও বেঁচে যেত-তাহলে আমার মতই অভিশপ্ত হতে হত ওকে। ওয়েয়্যার উলফ হয়ে বেঁচে থাকতে হত ইভোনকে।’
‘সর্বনাশ!’ আঁতকে উঠলাম আমি।
‘ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না তুমি? এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এ সবের ওপর আমার কোন হাত নেই। তীব্র খিদে সব কিছু ওলোট পালোট করে দেয়। আগে যখন টের পেতাম শরীরের ভেতর কিছু একটা ভজকট শুরু হয়ে যাচ্ছে, চলে যেতাম লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে। কিন্তু গত রাতে নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি আমি। তার আগেই খিদেটা গ্রাস করে ফেলে আমাকে। ভাগ্য ভাল বেচারা মারা গেছে।’
‘তোমার তো তাই মনে হবে,’ বললাম আমি। ‘কিন্তু আমাদের প্ল্যান আর কাজে লাগছে না।’
‘বুঝলাম না!’
‘ভায়োলেট আর কাল্পনিক নেকড়ের কথা চিন্তা করে ভয় পাবে না। তার দরকারও হবে না। কারণ এখন যদি নেকড়ের গল্প বলে ও, সবাই নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করবে। সবাই জানে, এ তল্লাটে একটা খুনে নেকড়ে এসেছে।’
‘আচ্ছা! তা তুমি এখন কি করবে?’
‘কিছুই করব না। এখানেই সব কিছুর সমাপ্তি হয়ে গেল।’
আমাকে জড়িয়ে ধরল লিসা দু’হাতের আলিঙ্গনে। মুখটা চেপে ধরল আমার মুখের সাথে। ‘চার্লস,’ কাঁদো কাঁদো গলা ওর। তার মানে আমরা আর মিলিত হতে পারব না…’
এমন একটা কাণ্ড ঘটানোর পর তুমি আবার তা আশা করো কি ভাবে?’
‘তুমি কি আমাকে আর ভালবাস না, চার্লস?’
চুমু খাচ্ছে লিসা আমাকে নরম, ভেজা ঠোঁট দিয়ে। নেকড়ের চুমু নয়, সুন্দরী এক নারীর উষ্ণ, আন্তরিক চুম্বন। কোমল হাতে জড়িয়ে আছে ও আমাকে। টের পেলাম ওর আলিঙ্গনে সাড়া দিয়ে জেগে উঠছে আমার শরীর। প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে ওর পেলব দেটাকে দলিত-মথিত করতে। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লাম আমি।
‘ব্যাপারটা নিয়ে পরে ভাবব দু’জনে,’ বললাম আমি। ‘ভেবে একটা উপায় বের করব। তবে তোমাকে কথা দিতে হবে- কাল রাতে যে কাণ্ড ঘটিয়েছ আর কখনও তার পুনরাবৃত্তি করবে না। আর আমার স্ত্রীর ধারে কাছেও যাবে না।’
‘কথা দিলাম,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিসা। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা খুব কঠিন।। ব আমি চেষ্টার ত্রুটি করব না। আজ সন্ধ্যায় তুমি আসছ তো? তা হলে আবার মিলিত হতে পারব আমরা, তুমি আমাকে রক্ষা করতে পারবে সর্বগ্রাসী খিদেটা থেকে।’
‘আসব,’ ছোট্ট করে জবাব দিলাম। হঠাৎ ভয় ফুটল লিসার চোখের তারায়, ‘চার্লস, ফিসফিস করে বলল সে। চাঁদ ওঠার আগেই কিন্তু আসতে হবে।’
.
বাড়ির কাছে এসে দেখি ভায়োলেট আমার জন্যে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
‘ঘটনাটা শুনেছ?’ জিজ্ঞেস করল ও।
বা তুমি জানলে কি করে?’ পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
‘এক লোক এসেছিল তোমার খোঁজে। সে বলেছে। আমিও ওকে নেকড়েটাকে দেখার কথা বলেছি। সে আছে এখনও। অপেক্ষা করছে তোমার জন্য ভেতরের ঘরে। লোকটার নাম ক্রেগিন। পুলিসের লোক।’
অগত্যা লোকটার সাথে দেখা করতেই হলো।
উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়ী পুলিসের সাথে আমার আগে কখনও মোলাকাত হয়নি। ক্রেগিন বিশাল দেহী। আমাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ‘মি. চার্লস কোলবি?’
‘জ্বী। আপনার জন্যে কি করতে পারি?’
‘কেন এসেছি আশা করি ধারণা করতে পেরেছেন। ইভোন বিউচ্যাম্বসের অপঘাত মৃত্যু সম্পর্কে তদন্ত করতে এসেছি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা। ‘লিওনের লোকজন আমাকে বলল নেকড়ে বাঘ নাকি হত্যা করেছে মেয়েটাকে। আমি ওটার সম্পর্কে কিছু জানি কিনা জানতে চাইছেন?’
‘জানেন কিছু?’
জবাব দিতে ইতস্তত করলাম। আর ভুলটা করলাম তখুনি। ইউনিফর্মধারী আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
‘এতে গোপন করার কিছু নেই। আপনাদের বাড়ির পাশে কেউ এলে নেকড়ের পায়ের ছাপ পরিষ্কার দেখতে পাবে। তবে লক্ষ্যযোগ্য ব্যাপার হলো, পায়ের ছাপগুলো এখান থেকে শুরু হয়ে লেক ঘুরে বিউচ্যাম্বদের বাড়ির সামনে গিয়ে থেমেছে। আমি নিজে দেখে এসেছি।’
কোন মন্তব্য করলাম না। সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করলাম, হাত কাঁপতে লাগল।
ছাতা ছাড়া,’ বলে চলল ক্রেগিন। ‘আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। মনে হলো
নেকড়েটা সম্পর্কে উনি অনেক কিছুই জানেন।
‘তাই নাকি? গত রাতে ও একটা নেকড়ে দেখেছে। বলেছে আপনাকে?’
‘বলেছেন।’ হাসিটা অদৃশ্য হয়ে গেছে ক্রেগিনের মুখ থেকে। ‘ভাল কথা, আপনার স্ত্রীকে একা রেখে কাল রাতে কোথায় গিয়েছিলেন?’
’শহরে।’
‘লিওনে?’
‘না। এমনি হাঁটাহাঁটি করছিলাম।’
‘স্রেফ হাঁটাহাঁটি, অ্যাঁ? যাকগে, শুনুন। আমি মোটামুটি এ ব্যাপারে যে-সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি তাতে মনে হয়েছে ওটা একটা দলছুট নেকড়ে। আর প্রাণীটা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তাই ঠিক করেছি নেকড়ে শিকারে বেরুব, হান্টিং পার্টি নিয়ে। আপনি আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন?
আমি চুপ করে রইলাম।
‘যাবেন না?’ আবার জিজ্ঞেস করল সে। ‘আপনি তো লেখক মানুষ, এ থেকেও হয়তো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারতেন। শুনেছি লেখকরা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঞ্চয়কে উপজীব্য করেই বেশিরভাগ সময় লেখালেখি করেন।’ টিটকারি মারল সে।
রাগতে গিয়েও, চট করে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ‘আপনার কি ধারণা দৈত্য দানবের গল্পও আমি লিখি নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে? আমাকে কি আপনার ভ্যাম্পায়ারের মত লাগছে?’ শেষের দিকে ইচ্ছে করেই খোঁচা দিলাম।
জোর করে হাসল ক্রেগিন। ‘আমার কাজই হচ্ছে মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখা। আপনার প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে আমাকে আপনার দাঁত দেখতে হবে।’ ঠাট্টা আর কি।
আমি মুখ হাঁ করে ভেংচি কাটলাম।
বলাবাহুল্য ব্যাপারটা পছন্দ হলো না পুলিস অফিসারের। মুখ বেজার করে থাকল সে।
এবার সরাসরি আক্রমণ করে বসলাম। ‘আপনি আসলে কি চাইছেন, ক্রেগিন? জানেন যে কাল রাতে আমার স্ত্রী এদিকে একটা নেকড়ে বাঘকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। তারপর ওটা লেকের ধারে যায়, মেয়েটাকে খুন করে। ভায়োলেট তো আপনাকে বলেছেই সব কথা। তারপরও এত জেরা করছেন কেন? নাকি আপনাদের পুলিসী থিওরী দিয়ে আবিষ্কার করে ফেলেছেন আমি নিজেই নেকড়ে বাঘ হয়ে আমার স্ত্রীকে ভয় দেখিয়েছি, তারপর রাতের আঁধারে খুন করে ফেলেছি অসহায় মেয়েটাকে?’
ক্রেগিন চুপ করে থাকল। গায়ের ঝাল ঝাড়তে বলে চললাম, ‘গোয়েন্দা কাহিনীর মত আপনাদের এসব জেরায় আমি অভ্যস্ত নই, মি. ক্রেগিন। এখানকার কিছু উপজাতি ভূত-প্রেত ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে। কিন্তু পাহাড়ী পুলিসরাও এ ধরনের কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হবে, এ আমার বিশ্বাস হয় না।‘
‘তা অবশ্য ঠিক. মি. কোলবি। আমি আসলে…’
দরজার হাতলে হাত রেখে বাইরের দিকে ইঙ্গিত করে হাসলাম আমি। আমার পরামর্শ হচ্ছে, এখানে সময় নষ্ট না করে নেকড়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’
আমার পরামর্শ বোধহয় মনঃপূত হলো ক্রেগিনের। আর কিছু না বলে চলে গেল সে। ভেতরে এসে ঢুকল ভায়োলেট। ক্রেগিনের সাথে কি কথা হয়েছে সব বললাম ওকে। কোন প্রশ্ন না করে নীরবে শুনে গেল ও।
‘এখন বুঝতেই পারছ,’ উপসংহারে বললাম আমি। ‘ওটা সাধারণ একটা নেকড়ে ছাড়া কিছু নয়। দলছুট বুদ্ধিমান একটা প্রাণী। ডাক্তার মেরক্স আমাকে বলেছেন দলছুট নেকড়েরা স্বভাবে খুবই ধূর্ত হয়। তবে আজ রাত বোধহয় ওটার মউতের রাত। ওরা বাগে পেলে নেকড়েটাকে মেরে ফেলবে, তোমাকেও আর ভয় পেতে হবে না।’
ভায়োলেট আমার হাতে হাত রাখল, ‘তুমি বাসায় থাকছ তো?’
‘না,’ বললাম আমি, ‘হান্টিং পার্টির সাথে যোগ দেব। ওদের সাথে থাকা উচিত মনে হচ্ছে আমার।’
জানা গেলে হয় না? মানে, আমার ভয় করবে…’
দরজা বন্ধ রেখো। নেকড়েরা দরজার খিল খুলতে জানে না।’
‘কিন্তু…’
‘আমি নেকড়ে শিকারে যাচ্ছি। বিশ্বাস করো, আজ রাতে আমি বাইরে থাকলেই বরং তুমি বেশি নিরাপদ থাকবে।’
.
লিসাদের বাড়িতে যখন পৌছুলাম তখন আকাশে উঠি উঠি করছে চাঁদ।
লিসা বাড়ির পেছনে, ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। এক মুহূর্তের জন্যে ধক করে উঠল বুক। ওটা সত্যি লিসা, নেকড়ে নয় তো?
আমাকে আশ্বস্ত করতে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল লিসা, মধুর ভঙ্গিতে হাসল।
‘জানতাম তুমি আসবে,’ বলল ও। ‘আবার আমরা মিলিত হতে পারব। জানো চার্লস, আমার খুব ভয় ভয় লাগছে।’
‘কেন?’
তুমি শোনোনি-ক্রেগিন, ওই যে পুলিস অফিসারটা, সে আজ এসেছিল আমার কাছে। জিজ্ঞেস করেছে নেকড়ে বাঘটা সম্পর্কে কিছু জানি কিনা। লিওনের লোকজন নাকি নানা কথা বলছে আমাকে নিয়ে। ক্রেগিন বলল সবার ধারণা ওটা সাধারণ কোন নেকড়ে নয়, একটা ওয়েয়্যার উলফ।’
বেহুদা চিন্তা কোরো না তো!’ ওকে সান্ত্বনা দিলাম। তারপর ক্রেগিনের সাথে আমার আলাপের বিষয় খুলে বললাম।
‘আজ রাতে ওরা নেকড়ে শিকারে বেরুবে,’ বলল লিসা। ‘লিওন এজন্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, বেশিরভাগ লোক ক্রেগিনের সাথে যোগ দিয়েছে। ওরা বিগ পিয়েরের বাড়ি থেকে রওনা হবে, পায়ের ছাপ ধরে নেকড়েটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাবে।’
‘তাতে তোমার কি?’ হাসি মুখে বললাম আমি। ‘আজ রাতে রাস্তায় কোন নেকড়ে বেরুচ্ছে না। আজ রাতে তুমি আমি এক সাথে থাকব।’
‘অবশ্যই থাকব,’ বলল লিসা। ‘তোমার সাথে যতক্ষণ আছি আমি, নিরাপদেই থাকব।’ ঝাঁকড়া একটা গাছের নিচে টেনে নিয়ে গেল আমাকে।
‘এখানে বসে গল্প করি, কেমন?’ প্রস্তাব দিল ও। ‘সকালে লিওনে গিয়েছিলাম দোকান বন্ধ হওয়ার আগে। তোমার জন্য মদ কিনে এনেছি। তুমি তো ওয়াইন খুব ভালবাস!’
একটা বোতল বের করল লিসা, আমরা ঘাসের ওপর শরীর এলিয়ে দিলাম। মদটা মিষ্টি তবে বেশ তেজী। পুবাকাশে চাঁদ উঠছে, ম্লান আলো। সেদিকে তাকিয়ে চুমুক দিতে লাগলাম বোতলে।
হঠাৎ কাঁধ আঁকড়ে ধরল লিসা আমার, ‘শোনো!’
শুনলাম, দূর থেকে, লেক পেরিয়ে আরও দূর থেকে, ভেসে আসছে মানুষের গলা। চিৎকার, চেঁচামেচি করছে ওরা, শোনা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে। একটু পরে তীক্ষ্ণ, একঘেয়ে ডাক ভেসে এল। কুকুর ডাকছে।
‘শিকারে বেরিয়েছে ওরা। সাথে শিকারী কুত্তাও আছে।’
শিউরে উঠল লিসা। আমি ওকে বুকের কাছে টেনে নিলাম, ‘ভয়ের কিছু নেই,’ আশ্বস্ত করতে চাইলাম ওকে। কিন্তু নিজেরই কেমন ভয় ভয় করতে লাগল।
ওরা ওয়েয়্যার উলফ শিকারে বেরিয়েছে-আর সে এই মুহূর্তে রয়েছে আমার বাহু বন্ধনে।
লিসার লম্বা, সুগঠিত শরীরে চাঁদের আলো পড়েছে, ও স্থির, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে ওদিকে। আমি একবার চাঁদের দিকে তাকালাম, তারপর ওর দিকে। ‘লিসা,’ ফিসফিস করে বললাম, ‘কি হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি। তুমি খাও।
‘কিছু ঘটবে নাকি আজ রাতে…’
‘না। আজ রাতে কিছু ঘটবে না। আমি ঠিক আছি। তুমি আছ না সাথে!’ হাসল লিসা, চুমু খেলো। আমি ঢকঢক করে বোতলের মদ গিলতে লাগলাম। আমার ভেতরের ভয়টাকে তাড়াতে চাইলাম।
‘তুমি ভায়োলেটকে আবার ভয় দেখাবে না তো? ওদের খোঁজাখুঁজির পালা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাচ্ছ না তো?’
‘না, যাচ্ছি না।’
‘তুমি আমার জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারবে? তোমাকে নিয়ে আমার মাথায় নতুন একটা আইডিয়া এসেছে।’
‘কি সেটা?’ জানতে চাইল লিসা
‘ডিভোর্স ছাড়া ভায়োলেটের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোন উপায় আমি দেখতে পাচ্ছি না। তবে সঙ্গত কারণেই ভায়োলেট ডিভোর্স দিতে চাইবে না। আদালতে লড়াই করে যাবে। ফলে পুরোপুরি মুক্ত পুরুষ হতে আমার কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। তুমি অতদিন অপেক্ষা করতে পারবে? যদি পারো তাহলে শপথ করো তুমি ভায়োলেট বা অন্য কারও কোন ক্ষতি করবে না। আর না হলে তোমার সঙ্গে আমার মিলন সম্ভব নয়।’
শুয়ে ছিল, উঠে বসে আমার মুখোমুখি হলো লিসা। তারপর ঝুঁকে পড়ল, আমার ঠোঁট খুঁজল ওর মুখ দিয়ে। দীর্ঘ চুম্বন শেষে লিসা বলল, ‘ঠিক আছে, চার্লস; এটাই যদি একমাত্র উপায় হয়, তাহলে আমি রাজি। অপেক্ষা করব আমি তোমার জন্যে।’
বোতলে আবার চুমুক দিলাম। চারপাশের প্রকৃতি আশ্চর্য রকম সতেজ আর পরিষ্কার লাগল। তারপর হঠাৎ ঝাপসা হয়ে এল দৃষ্টি। কিছুক্ষণ পরে না অনেকক্ষণ পরে ঠিক বলতে পারব না, আবার সবকিছু পরিষ্কার হয়ে এল। কানের পাশে শিকারী কুকুরের গর্জন শুনতে পেলাম পরিষ্কার, তারপর আবার দূরে সরে গেল শব্দটা। লিসার মুখখানা মনে হলো খুব উজ্জ্বল, পরক্ষণে অন্ধকার সবকিছু।
অ্যালকোহলের কারণে এসব ঘটছে, বুঝতে পারছি। বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। তবে গ্রাহ্য করলাম না। লিসা আমাকে কথা দিয়েছে, এখন আর আমার ভেতরে কোন টেনশন নেই। অতীতে যা ঘটেছে সবই ছিল সাময়িক দুঃস্বপ্ন। ওসব ভুলে যাব আমি।
আবার মদ ঢাললাম গলায়, ঠোঁটে লিসার নরম ওষ্ঠের ছোঁয়া।
পৃথিবীটা আস্তে আস্তে দুলতে শুরু করল। ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।
‘উঠুন! উঠুন!’ দূর থেকে ভেসে এল যেন কণ্ঠটা। কানের কাছে মুখ নিয়ে কেউ জরুরী তাগাদার সুরে ডাকছে আমাকে। ‘উঠে পড়ন, কোলবি! জলদি!’
ঘুমের রেশ কাটতে শুরু করেছে, চোখ মেলে উঠে বসলাম ঘাসের ওপর, মাথার কাছে চলে এসেছে চাঁদ, বিবর্ণ আলো ছড়াচ্ছে আমার দিকে ঝুঁকে পড়া মুখটার ওপর-ডাক্তার মেরক্স।
‘হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,’ লজ্জিত গলায় বললাম, ‘লিসা কোথায়?’
‘লিসা? এখানে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি আমি। উঠে পড়ুন- আসুন আমার সাথে।’
দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠলাম।
‘আপনি ঠিক আছেন তো?’
‘হ্যাঁ, ডাক্তার। কি হয়েছে?’
‘জানি না যদি-’ ডাক্তারের গলা, কেঁপে উঠল। ভয় পেয়েছেন তিনি কোন কারণে। হঠাৎ কারণটা ধরে ফেললাম আমি। মদের নেশা, ঘুমের নেশা কেটে গেল মুহূর্তে। প্রায় চেঁচিয়ে বললাম, ‘কি হয়েছে, ডাক্তার? জলদি বলুন।
‘বিপদটা আপনার স্ত্রীকে নিয়ে, আস্তে আস্তে বললেন ডাক্তার। ‘আপনি যখন বাইরে নেকড়েটা তখন আপনাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আমি ওই রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আপনারা কেমন আছেন একটু দেখে যাই। আমি বাড়িতে ঢুকেছি, প্রায় সাথে সাথে লাফ মেরে বেরিয়ে গেল নেকড়েটা। দেখলাম…’
‘বলুন?’
‘নেকড়েটা ভায়োলেটের গলার মাংস ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।’
.
অন্ধকারে শুরু করলাম দৌড়, আতঙ্ক আর ভয়ে শুকিয়ে গেছে কলজে।
মিথ্যে কথা বলেছে লিসা আমাকে। মদ খাইয়ে আমাকে মাতাল করেছে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, সেই সুযোগে-
আর কিছু ভাবতে পারলাম না আমি।
পরে ঘরে ঢুকলাম ঝড়ের বেগে। ডাক্তার মেরক্স উবু হয়ে বসলেন ভায়োলেটের পাশে। পাশ ফিরে শুলো ভায়োলেট, দুর্বলভাবে হাসল আমার দিকে চেয়ে।
‘তুমি বেঁচে আছ এখনও?’ হাঁপিয়ে উঠলাম আমি।
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলেন ডাক্তার। ‘ওর গলার মাংস ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল জানোয়ারটা। তবে মারাত্মক কোন ক্ষতি করতে পারেনি। আমি ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গেছি। এখন আর রক্ত পড়ছে না। তবে আপনার স্ত্রী ভয় পেয়েছেন খুব। কয়েকদিন ওর ওপর খেয়াল রাখবেন।’
আমি ভায়োলেটের পাশে বসলাম, ব্যান্ডেজ বাঁধা গলার ওপরে, গালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম আলতো করে। ‘ভাগ্যিস বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয়নি,’ বিড় বিড় করে বললাম আমি।
চেতনা ‘ওঁর সঙ্গে এখন কোন কথা বলবেন না,’ পরামর্শ দিলেন ডাক্তার। ওঁকে বিশ্রাম নিতে দিন। নেকড়েটা নির্ঘাত জানালা ভেঙে ঢুকেছিল। জানালার কাঁচ ভাঙা। তবে পায়ের ছাপ কোথায় নেই!
বাইরে এসে দেখলাম ডাক্তারের কথাই ঠিক। যত্রতত্র ছড়ানো পায়ের ছাপ।
‘শিকারীর দল শিগগির এসে পড়বে এদিকে,’ বললেন ডাক্তার। ‘ট্রেইল ধরে এবার ওটাকে খুঁজে বের করা সহজ হবে আশা করি।’
আমি শুধু মাথা ঝাঁকালাম।
হঠাৎ জঙ্গল থেকে ভেসে এল নেকড়ের ডাক। মানুষের চেঁচামেচি আর কুকুরের চিৎকার শুনতে পেলাম একই সাথে
ডাক্তার মেরক্সের ঝাঁটার মত গোঁফ উত্তেজনায় লাফাতে শুরু করল। ‘ওরা নেকড়েটাকে দেখতে পেয়েছে! চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘ওই যে শুনুন!’
ঝোপের আড়ালে হুটোপুটির শব্দ। তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার। এবং তারপর-
একসাথে গর্জে উঠল কয়েকটা রাইফেল। ‘এবার আর রক্ষা নেই! ওরা পেড়ে ফেলেছে ওটাকে!’ লাফিয়ে উঠলেন ডাক্তার।
শিকারী কুকুরদের সম্মিলিত ঘেউ ঘেউ শব্দ কাছে চলে এল। ঝোপঝাড় ভেঙে দৌড়ে আসছে কারা যেন। হল্লার আওয়াজ আরও পরিষ্কার শোনা গেল।
আর তখন, আমাদের ঘরের সামনের উঠানে দেখলাম ওটাকে, হামাগুড়ি দিয়ে আসছে নেকড়েটা।
.
ধূসর রঙের বিশাল আকারের প্রাণীটা হাঁপাচ্ছে, সারা গা রক্তে মাখামাখি। মস্ত মাথাটা ঝুলে পড়েছে মাটিতে, হাঁ করা মুখ, বেরিয়ে আছে ক্ষুরধার দাঁত সহ চোয়াল। আমাদের দিকে এগোতে শুরু করল নেকড়ে, গুঙিয়ে উঠল যন্ত্রণায়।
মেরক্স পকেট থেকে রিভলভার বের করলেন। তারপর কক করলেন সেটা। আমি ধরে ফেললাম ডাক্তারের হাত।
‘না!’ ফিসফিস করে বললাম। ‘না!’
হেঁটে গেলাম নেকড়েটার দিকে। চোখে চোখ রাখলাম। চিনতে পেরেছে বলে মনে হলো না-চোখের তারায় মৃত্যুর ছায়া।
‘লিসা,’ গলা নামিয়ে বললাম আমি। ‘তুমি আর অপেক্ষা করতে পারলে না!’
ডাক্তার আমার কথা শুনতে পাননি, তবে নেকড়েটা শুয়েছে। ঝাঁকি দিয়ে মাথা তুলল ওটা, এক মুহূর্তের জন্যে গলা থেকে ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল।
তারপর মারা গেল নেকড়ে মানবী।
এরপর শুরু হলো সেই আশ্চর্য ঘটনাটা।
মিনা লাশের শরীর আকারে হঠাৎ বেড়ে যেতে লাগল, মোচড় খেলো, গড়ান দিল। কান দুটো ঢুকে গেল খুলির মধ্যে, সম্প্রসারণ ঘটল পেশীগুলোর, বেরিয়ে পড়ল সাদা মাংস। ডাক্তার মেরক্স আমার পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে চিৎকার শুরু করলেন, কিন্তু কি বলছেন কিছুই আমার কানে গেল না। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম নেকড়ের শরীরটা অদৃশ্য হয়ে গেল, সদ্য ফোটা পদ্ম ফুলের মত সেখানে পড়ে রইল লিসার অপূর্ব নগ্ন দেহ।
ফ্যাকাসে সাদা শরীর নিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকল লিসা, প্রাণহীন। ফুঁপিয়ে উঠে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম আমি।
‘না-এ কিছুতেই সম্ভব নয়।’ কর্কশ গলায় বলে উঠলেন ডাক্তার। আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন তিনি পায়ের কাছে পড়ে থাকা লাশটাকে।
আবার ফিরে তাকালাম আমি। অদ্ভুত আরেকটা ঘটনা ঘটতে শুরু করল। আবার পরিবর্তন শুরু হয়েছে লিসার দেহে।
এই পরিবর্তনের সঠিক বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। লিসা আমাকে কোনদিন বলেনি সে কিভাবে এবং কবে ওয়েয়্যার উলফে পরিণত হয়েছিল। শুধু বলেছিল মানুষের রক্ত এবং মাংস খেয়ে ওয়েয়্যার উলফরা অনন্ত যৌবন ধরে রাখতে পারে।
আমাদের পায়ের নিচে পড়ে থাকা ভারি দেহটাতে অবিশ্বাস্য গতিতে ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছে। চোখের পলকে লিসার শরীরের কমনীয় খাঁজ ভাঁজগুলো দূর হয়ে সেখানে একশো বছরের বুড়ির জীর্ণ শীর্ণ শরীর এসে যেন ভর করল।
নারী থেকে নেকড়ে মানবীতে রূপান্তরের দৃশ্য দেখেই সেটা হজম করা মুশকিল। কিন্তু এটার শেষ পরিণতি যে আরও কত ভয়ঙ্কর তা ধারণারও বাইরে ছিল আমার। সুন্দরী মেয়েটা যেন যাদুমন্ত্রের বলে খড়িমাটিতে তৈরি কুৎসিত এক বুড়িতে পরিণত হলো।
তবে ঘটনার শেষ এখানেই নয়-আমাদের আরও অনেক কিছু দেখার বাকি ছিল। বুড়িটার চেহারাও ক্রমশ বদলাতে লাগল। ঝোলা চামড়া আরও ঝুলে পড়ল, কাঠি কাঠি হাত-পাগুলো চাঁদের আলোতে ভয়ঙ্কর দেখাল। শেষে মনে হলো হাজার বছরের পুরানো, আকৃতিহীন, ভাঙাচোরা একটা মমি আমাদের দিকে তাকিয়ে বিকটভাবে হাসছে।
লিসার শেষ রূপান্তরটা ঘটল এভাবেই।
.
শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে জানি না। কারণ অতিরিক্ত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। পরদিন বিকেলে জ্ঞান ফিরল আমার, ডাক্তার মেরক্স ভায়োলেটের ক্ষত পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। ও আগের চেয়ে অনেক সুস্থ, হাঁটা চলা করতে পারছে। আমার জন্যে সুপ বানিয়ে আনল। আমি সুপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে আবার এলেন মেরক্স। এখন উঠে বসতে পারছি আমি। উনি আমাকে গল্পটা বললেন।
কদ ওয়েয়্যার উলফের নারকীয় পরিবর্তনের কথা ডাক্তার কাউকে বলেননি। ক্রেগিনের সাহায্যে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়া হয়। অবশ্য আর তদন্তের প্রয়োজনও ছিল না। কেউ এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্যও করেনি। স্থানীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সবাই।
ভায়োলেট আস্তে-ধীরে প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল।
তারপর একদিন সুযোগ বুঝে সমস্ত ঘটনা ভায়োলেটকে খুলে বললাম। লিসার সাথে আমার পরকীয়া প্রেমের কোন অংশই বাদ দিলাম না।
শুনে ভায়োলেট হাসল শুধু।
আমি ধরেই নিয়েছি ওর কাছ থেকে ক্ষমা পাব না। হয়তো শহরে ফিরেই ও আমাকে ডিভোর্স দেবে। জানি না ঠিক। ঘটনাটা শোনার পর থেকে খুব চুপচাপ হয়ে গেছে ভায়োলেট। আমিও সেধে কথা বলতে সাহস পাই না।
এই ঘটনার কয়েকদিন পরে ভায়োলেট বাইরে গেল ঘুরতে। আমি ঘরে বসে সন্ধ্যা পর্যন্ত লেখালেখি করলাম। সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসার পরেও ভায়োলেট ফিরল না দেখে উদ্বিগ্ন বোধ করলাম।
ঘর-গেরস্থালীর কাজ সব করলেও গলার ক্ষতটা এখনও সম্পূর্ণ শুকোয়নি। এই অবস্থায় ওর বেশিদূর যাওয়ার কথা নয়। নাকি আমাকে না বলে শহরেই চলে গেল? হতেও পারে। কারণ ভায়োলেট আমাকে এখন ঘৃণা করে। ঘৃণা করাটাই স্বাভাবিক। কারণ আমি একটা ওয়েয়্যার উলফকে পাঠিয়েছিলাম ওকে হত্যা করতে।
নাহ্, ওই ভয়ঙ্কর স্মৃতিটা আমি আর মনে করতে চাই না।
আমি চুপচাপ বসে থাকলাম ঘরে। আজকেও মস্ত থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে। লেকের জলে তার প্রতিবিম্ব। ওদিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। ভাবছি ভায়োলেটের কথা।
আজকেই ওর বাইরে যাওয়ার কি দরকার পড়ল? গলায় অমন একটা ক্ষত নিয়ে বেরুনো ঠিক হয়নি।
গলার ওই ক্ষত-লিসা কামড় দিয়েছিল ওকে।
ক্ষত নিয়ে ভাবতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ল না। লিসাই বলেছিল।
কি যেন বলেছিল?
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ে গেল কথাটা। টা
ভয়ে শিউরে উঠলাম আমি। সমস্ত অন্তর-আত্মা দিয়ে প্রার্থনা করলাম আর যেন ফিরে না আসে ভায়োলেট।
আজ সকাল থেকে ওকে অস্থির লাগছিল আমার। অস্থিরতার কারণটা এখন আমার কাছে স্পষ্ট। এখন আমি জানি ভায়োলেট কেন একা জঙ্গলে গিয়েছে। রা
ক্ষতটা তার কাজ শুরু করে দিয়েছে!
.
ইভোনের মৃত্যু সংবাদ দেয়ার পরে লিসা আমাকে কি বলেছিল সব মনে পড়ে গেছে আমার। ও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল- কারণ ইভোন ওর কামড় খেয়ে বেঁচে গেলে সে-ও হয়ে উঠত…
ভায়োলেটও কামড় খেয়েছে। কিন্তু মরেনি ভায়োলেট। আর সেই কামড়ের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া অবশেষে শুরু হতে যাচ্ছে। চাঁদ উঠে এসেছে লেকের অনেক ওপরে। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে আসছে একটা…
ওই তো! জানালার বাইরে দেখতে পেলাম ওকে! ওকে না, ওটাকে। তা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল ওটা। চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সবকিছু। ওটার পিঠের চকচকে লোমে পিছলে যাচ্ছে জোছনা। ঝিঁকিয়ে উঠল কালো নাক। ধারাল, ছুঁচাল দাঁতগুলো চিকমিক করছে আলোতে।
ভায়োলেট আমাকে ঘৃণা করে।
ফিরে এসেছে ভায়োলেট। তবে নারী রূপে নয়।
কারন এক মিনিট! দরজাটা বন্ধ তো? হ্যাঁ। বেশ। তাহলে আর ও ঢুকতে পারবে না। দরজার সামনে থাবা মেরে বসল ওটা। আঁচড় কাটছে মাটিতে নাক দিয়ে। এবার গলার গভীর থেকে বেরিয়ে এল ঘরঘরে একটা শব্দ।
মনে মনে আশা করলাম ক্রেগিন বা ডাক্তার মেরক্স যে কেউ একজন এসে পড়বেন শিগগির। না এলেও ক্ষতি নেই। রাতটা এখানে বসেই কাটিয়ে দেব। ভোর হলে ওটা এমনিতেই চলে যাবে। তারপর আবার যদি আসে তখন ওকে তাড়াবার ব্যবস্থা করে রাখব আগেভাগেই।
তাই ভাল, বসে থাকি।
হঠাৎ গর্জে উঠল নেকড়ে। আঁতকে উঠলাম আমি। স্নায়ু ছিঁড়ে যেতে চাইল ভয়ঙ্কর শব্দে। নিজেকে প্রবোধ দিলাম-এখানে ওর ঢোকার কোন সুযোগ নেই। আমি বরং সারারাত বসে টাইপ করব। ও বাইরে দাঁড়িয়ে টাইপের খটখট্ শব্দ শুনবে। হয়তো বিরক্ত হয়ে একসময় চলেও যেতে পারে।
আমার চিন্তা কি? আমি তো ঘরের ভেতর নিরাপদেই আছি।
নেকড়েটাকে হঠাৎ দেখলাম নেই হয়ে গেছে। দরজার সামনেটা ফাঁকা। গেল কোথায় তাহলে? হঠাৎ জানালার কাছে ওটার পায়ের শব্দ পেলাম।
জানালা!
জানালা ভেঙে লিসা ঘরে ঢুকেছিল। জানালায় আর কাঁচ লাগানো হয়নি। ওটা খোলা-
গর্জে উঠল ও। লাফ দিতে যাচ্ছে। দিল।
ওটাকে দেখতে পাচ্ছি আমি এখন…জানালা দিয়ে এক লাফে চলে এল ঘরে, হাঁ করা মুখ, ধক্ ধক্ করে জ্বলছে চোখজোড়া…ভায়োলেট…না…ভায়ো…