পার্টনার

পার্টনার

আমি এবং এড, এক সাথে ব্যবসা করি। ওটার কথা এখন না, পরে। তবে কাজটা খুব মজার। আগে সেই আগন্তুকের কথা বলে নিই, তারপর আমাদের ব্যবসার কথা বলা যাবে।

ভূতের গল্প পছন্দ করেন আপনারা? নিশ্চয়ই করেন। ভূতের গল্প কে না পছন্দ করে! তবে এটা ভূতের গল্প নয়। এ গল্পে ভূত-ভূত নেই। তবে ভূতুড়ে ব্যাপার আছে। আসলে রোমহর্ষক বলাই ভাল। রোমহর্ষক এবং অদ্ভুত কিছু ব্যাপার আছে আমার গল্পে।

যাক, যা বলছিলাম। এড এবং আমি, দু’জনে পার্টনারশিপে ভালই ব্যবসা চালাচ্ছি। ও খুব বিশ্বস্ত পার্টনার আমার, সহজেই বিশ্বাস করা যায়, বিশ্বাস রাখা যায়। আসলে ব্যবসা-বাণিজ্য এমন জিনিস, বিশ্বাস না থাকলে হয় না। আমার ঠাকুর্দার কাছে কথাটা শুনেছি। আমার আইরিশ ঠাকুর্দা, ঈশ্বর তাঁর আত্মাকে ভাল রাখুন, উনি এসেছিলেন কাউন্টি কর্ক থেকে, ক্যানসাস সিটিতে এক পার্টনারের সাথে সেলুনের দোকান দিয়েছিলেন। কিন্তু লোকটা তাঁর বারোটা বাজিয়ে দেয়। ঠাকুর্দা বলতেন, ‘ব্যাটা আমাকে ডুবিয়েছে।’ বিশ্বাস করতেন তিনি লোকটাকে। কিন্তু পার্টনার যে তাঁকে এমন ‘ফক্কা’ (এ কথাটাও দাদুর কাছ থেকে শোনা) দেবে কল্পনাও করেননি তিনি।

ঠাকুর্দা আমার গত হয়েছেন বহু আগে, মিসৌরীর মাটিতে তাঁর দেহাবশেষ এতদিনে মিশে বিলীন হয়ে গেছে।

আমার বয়স এখন ঠাকুর্দার মতই। আমার নাম রেখেছিলেন তিনি ট্যাড। আমার ভাল নাম র‍্যালফ। কিন্তু দাদু ট্যাড নামেই ডাকতেন। ট্যাড মিলার। সাধারণ একজন মানুষের সাধারণ নাম।

জন্ম আমার সেন্ট লুইসে, শিকাগোতে যখন আসি তখন দশ বা এগারোতে পা দিয়েছি। শিকাগো থেকে কিভাবে ছোট্ট এই শহরে আস্তানা গাড়লাম সে সব প্যাচাল শোনার ধৈর্য আপনাদের না থাকারই কথা। এ শহরটা ইলিনয়ে, শিকাগো থেকে বেশ দূরে, লেকের ধারে।

যে শহরে আমি আছি তার নামটা জানা কি খুব দরকার? আমার মনে হয় না। নাম বললে আপনারা হয়তো একদিন এখানে এসে ভিড় জমাবেন। আর ভিড়-ভাট্টা একদম ভাল লাগে না আমার। এডও আমার মতই। অপরিচিত লোকজনের ভিড় তার একদম পছন্দ নয়। ঘরে থাকতেই ভালবাসে সে।

আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি অসামাজিক প্রকৃতির নই। আমাদের শহরে মাঝে সাঝে কেউ এলে নিজেই সেধে আলাপ জমাতে যাই। বলেছিলাম না একটা ব্যবসা আছে আমার? ওটারই অ্যাডভার্টাইজ করি আর কি। জানেনই তো, এ দুনিয়ায় নিজের ঢোল পেটাতে হয় নিজেকেই।

আমাদের শহরের পাশ দিয়ে একটা হাইওয়ে চলে গেছে শিকাগোর দিকে। হিচহাইকাররা মাঝে মাঝে আসে এ শহরে। ভবঘুরে, স্কুল পালানো ছেলে-মেয়ে যারা বড় শহর দেখার নেশায় বেরিয়ে পড়েছে, এমন নানা কিসিমের লোকজন। কেউ ছুটি কাটাতে যাচ্ছে, নেমে পড়ল রাস্তায় এক কাপ কফি খেয়ে শরীরটাকে চাঙা করে তুলতে। কফি হোক বা স্যান্ডউইচ, সবাইকে যেতে হয় স্যালি অ্যানে। এ শহরে কফির দোকান বলতে আছে সবেধন নীলমণি ওটাই। খিদে পেলে মানুষজন আসে স্যালির দোকানে। খাবার-টাবার বিক্রি করে মোটামুটি চলে যায় স্যালির।

স্যালি মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। ওকে পছন্দ হবে আপনার। বড় বড়, মায়াভরা চোখ। আমি আবার মানুষের চোখ দেখে বলে দিতে পারি লোকটার স্বভাব-চরিত্র কেমন। সবসময় মানুষের চোখের দিকে তাকাই আগে। চোখ আসলে মনের আয়না। স্যালির চোখদুটো হরিণের মত, নরম, ছলোছলো।

স্যালির সাথে আমার খুব ভাব। তবে সম্পর্কটাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার কোন অবকাশ নেই। সে সব দিন পার করে এসেছি আমরা অনেক আগে। স্যালি আমাকে বেশ পছন্দ করে। বেশিরভাগ মানুষই করে। ভালই লাগে। নিঃসঙ্গচারী মানুষও চায় তাকে অন্যেরা পছন্দের চোখে দেখুক। হয়তো আমার চেহারায় সরল ভাব আছে, বেশিরভাগ মানুষই পছন্দ করে ফেলে।

এবার সেই আগন্তুকের কথা বলব আপনাদেরকে। লোকটার সাথে মাসখানেক আগে পরিচয় আমার। তার আগে আমাদের শহরটার বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করে নিই।

শহরটা মরতে বসেছে। প্রতি বছর আকারে ক্ষীণতর হচ্ছে। এখানে তরুণ বা যুবকদের দেখা মেলা ভার। আমরা কোনমতে টিকে আছি। আমি, এড-একটা সময় আমাদের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। কারণ সে দিন খুব বেশি দূরে নয়, শহরটা পরিণত হবে একটা ধ্বংসস্তূপে। ব্যাপারটা আমার ও এড, দু’জনের জন্যেই দুঃখজনক হয়ে উঠবে। এডের সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও একজন অন্যজনকে ছাড়া চলা মুশকিল। হয়তো একদিন ওকে ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে। মা প্রায়ই বলত, কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়।

শিকাগো থেকে যেবার এলাম এ শহরে, তখন এটার দশা এত করুণ ছিল না। মা-বাবা মারা গেল। তখনও শহরের ওপর নরক ভেঙে পড়েনি। ঘটনাটা ঘটল মোফিট পেপার তাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ করে চলে যাবার পরপর। শহরের নব্বুই ভাগ রাজস্ব যোগান দিত ফ্যাক্টরিটা। ওরা কেন চলে গেল, কারণটা এখনও স্পষ্ট নয় আমার কাছে। নতুন নতুন রাস্তা হচ্ছিল ওদিকটাতে, বাণিজ্য আরও ভাল জমে উঠবে ওদিকে, এটা ভেবেই ফ্যাক্টরির মালিক ব্যবসা গুটিয়ে চলে গিয়েছিল কিনা কে জানে। তবে এটা ঠিক, মোফিট ফ্যাক্টরি পাততাড়ি গোটাল আর শহরও ভেঙে পড়তে লাগল।

ওই সময় হ্যাপিল্যান্ড থেকে চলে আসতে বাধ্য হলাম আমি। লেকের ধারের প্রমোদ পার্কটার ওই নামই দিয়েছিল শহরের মানুষ। আয়-উপার্জন বন্ধ। লোকজন চলে যেতে শুরু করল শহর ছেড়ে। আমাকেও পাততাড়ি গোটাতে হলো।

হ্যাপিল্যান্ডের মালিক ছিলাম আমি। টানা বিশ বছর ফান হাউজটা চালিয়েছি গ্রীষ্মের রাতগুলো ঘুমিয়ে কাটিয়েছি ওটার মধ্যে। বাড়িটার প্রতিটি কোনা আমার চেনা, কোথায় কোন গোপন প্যাসেজ আর অন্ধ গলি রয়েছে চোখ বুজে বলে দিতে পারি।

যদি তাড়া না থাকে (আমার একটুও তাড়া নেই) তাহলে নিজের ব্যাপারে এবং শহরটা সম্পর্কে আরও দু’চারটা কথা বলি আপনাদেরকে।

আমি বিয়ে করেছিলাম, জানেন? এ শহরেই। তবে প্রেম-ট্রেম করে নয়। ও সব রোমান্টিকতা আমার মধ্যে নেই। স্যালি প্রায়ই এ নিয়ে ঠাট্টা করে আমাকে বউটা আমার ভালই ছিল। আমাদের সন্তান নেই। বাচ্চা-কাচ্চা নিতে চায়নি বউ, তাই। ওর মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণ একা হয়ে যাই আমি। আমার ভাই-বোন নেই। চাচা- খালা-মামা কেউ নেই।

বউটা হঠাৎ মরে গেল একদিন। কষ্ট হচ্ছিল খুব। ভালমানুষ বউয়ের জন্যে কষ্ট হবেই। তবে কষ্টটা সামলে উঠতে পেরেছি। এখন আর একাকিত্বের যন্ত্রণা দগ্ধ করে না আমাকে। বরং মনে হয় একা আছি বেশ আছি। মাঝে মাঝে জঙ্গলে যাই, জলপ্রপাতটার পাশে বসে মাছ-টাছ ধরি। কখনও কখনও নিঝুম রাতে বউটার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে হ্যাপিল্যান্ডের কথাও। দুটোকেই হারাতে হয়েছে আমার। নিজেকে সান্ত্বনা দিই, এ পৃথিবীতে কোন কিছুই স্থায়ী নয়। এটাই হলো প্রকৃতির বিধান। একে মেনে নিতেই হবে। তাল মিলিয়ে চলতে হবে সময়ের সাথে।

বউকে লেকের ধারে কবর দিয়েছি আমি। লেকের ধারেই কবরস্থান, হ্যাপিল্যান্ডের প্রায় গা ঘেঁষে। গোরস্থান আর প্রমোদ পার্ক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে লেকের তীরে। হ্যাপিল্যান্ড দেখতে যারা আসত, পার্কটাকে ভূতুড়ে বলে আখ্যায়িত করত তারা। গত বিশ বছরে আমি এখানে ভূতের ‘ভ’ও দেখিনি। মাঝে মাঝে বিরাট সাইজের ইঁদুর গোরস্থানের গর্ত থেকে উঠে আসত, আর ওদের দেখে ভয়ে আঁতকে উঠত মেয়েরা। ব্যস, এই। এছাড়া আর ভয়ের কিছু ছিল না হ্যাপিল্যান্ডে।

আমার স্ত্রীকে ওখানেই কবর দিয়েছি। এতদিনে ইঁদুরগুলো ওর শরীরের হাড় ক’খানাও বোধহয় আস্ত রাখেনি। ব্যাপারটা ভাবলে গা কেমন শিরশির করে ওঠে। ইস্পাতের কফিন ছাড়া ওদের হাত থেকে লাশ রক্ষা করা মুশকিল। দানবাকৃতির ইঁদুরগুলোর দাঁত যেমন বড়বড়, তেমনি ধারাল। কাঠের কফিন ওদের কাছে কোন বাধাই নয়। কিন্তু আমার অত পয়সা কোথায় যে ইস্পাতের কফিনে বউকে কবর দেব? যা পাই সব খরচ হয়ে যায়। একটা পয়সাও কোনদিন জমাতে পারিনি। তবে কারও কাছ থেকে ধার করি না আমি, কাউকে ঋণীও রাখি না।

আসুন, এবার মূল কাহিনীতে ফিরে যাই। সেই বিশালদেহী আগন্তুকের গল্প বলি…

স্যালির দোকানে বসে গল্প করছিলাম আমি আর স্যালি। গল্প আর কি-ঠাট্টা তামাশা। আঙুলে নতুন পরা আংটিটা নিয়ে স্যালি ঠাট্টা করছিল। বলছিল আংটিটা নাকি রাস্তার বাতির মত আলো ছড়াচ্ছে। আমি ঠাট্টা করছিলাম ওর নতুন হেয়ার স্টাইল নিয়ে। বলছিলাম যেভাবে চুল বেঁধেছে স্যালি, খোপায় সহজে মৌমাছি এসে বাসা বাঁধতে পারবে। এভাবে গুলতানি করে সময় কাটাচ্ছি, এমন সময় লোকটা এল।

কাউন্টারে ঠনঠন শব্দে চামচ বাজিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। স্যালি দ্রুত এগিয়ে গেল তার দিকে, জিজ্ঞেস করল কি খাবে।

‘কফি, সেই সাথে আপনাদের স্পেশাল কিছু থাকলে দিন।’ ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল আগন্তুক। ‘এখন শুধু কফি আর টমেটো জুস নিয়ে আসুন।’

স্যালি বলল টমেটো জুস নেই, অরেঞ্জ জুস আছে। শুনে লোকটা যেন খেপে উঠল।

লোকটা গায়ে-গতরে মোষের মত। বিশাল চওড়া কাঁধ, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, হাতের পেশী ফুলে আছে। মুখে ঘন দাড়ি। তবে চোখ জোড়ায় ফুটে আছে সারল্য।

লোকটা অদ্ভুত একটা ঘড়ি পরেছে হাতে। অসংখ্য ডায়াল ওতে, ছোট্ট একটা প্যানেলে আলোও জ্বলছে। এমন অদ্ভুত ঘড়ি আগে দেখিনি আমি। সহজাত কৌতূহলে লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম, বসলাম ওর পাশের খালি টুলে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকাল সে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কারণ কাউন্টার খালি। মনে হলো লোকটা আমার উপস্থিতি পছন্দ করতে পারেনি।

‘হ্যালো মিস্টার,’ বললাম আমি। ‘আমার নাম ট্যাড মিলার।’

‘তাতে আমার কি?’

কঠিন গলা। বন্ধুসুলভ নয় মোটেই।

‘না, মানে, আপনার ঘড়িটি দেখে আলাপ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। এমন অদ্ভুত ঘড়ি জীবনে দেখিনি আমি।’

ধীরে সুস্থে ঘুরে বসল লোকটা, বাঁ হাত তুলে দেখাল। ‘এটাকে চি থেকে কিনেছি আমি। পছন্দ হয়েছে আপনার?’

‘পছন্দ হয়নি আবার! অদ্ভুত সুন্দর ঘড়ি আপনার।’

লোকটার চেহারার কঠিন রেখাগুলো এই প্রথম অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম আমি। মায়েদের কাছে সন্তানের প্রশংসা করলে কোন মা খুশি না হয়ে পারে? আমার কৌশলটা এবারও কাজে লেগে গেল।

‘ছোট ডায়াল আর কাঁটাগুলো কিসের?’ সরল মুখ করে জানতে চাইলাম

লোকটা আস্তিনের হাতা গোটাল যাতে ঘড়িটা আরও ভাল ভাবে দেখতে পারি। ‘এ ঘড়িতে বিশ্বের দশটা দেশের সময় দেখা যায়।’ বলল সে। ‘বছরের কোন মাস, হপ্তার কোন্ দিন সব পেয়ে যাবেন আমার ঘড়িতে।’

‘বেশ বেশ!’

ঘড়ির একপাশের এক চাবিতে মোচড় দিল সে। ‘এটা ঘোরালে,’ গর্বের সুরে বলল লোকটা, ‘প্রতি ঘণ্টায় বেল বেজে উঠবে।

স্যালিকে দেখলাম লোকটার জন্যে খাবার নিয়ে এসেছে। আমাদের আলোচনায় অংশ নেয়ার বাসনা দমন করতে পারল না সে। বলল, ‘ঘড়িটার দাম কত?’

বলেই বুঝল ভুল করে ফেলেছে। এভাবে সরাসরি দাম জিজ্ঞেস করতে নেই। আমি হলে কোনদিনই করতাম না। লোকটা বিষ দৃষ্টিতে তাকাল স্যালির দিকে, ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল, ‘দাম দিয়ে আপনার কাম কি?’

ঘড়িটা সম্ভবত চোরাই মাল, ধারণা করলাম আমি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি চোরাই জিনিসের দাম জিজ্ঞেস করলে জবাব দিতে চায় না কেউ। বিরক্ত হয়।

স্যালি কোন কথা না বলে রান্নাঘরে চলে গেল, চেহারা কঠিন।

লোকটা নিঃশব্দে খাওয়া শুরু করেছে। স্যালির প্রশ্ন ওর মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে বোঝাই যায়। কিন্তু লোকটা মুড অফ করে রাখলে আমার চলবে না।

‘ভাই, শোনেন…’ বললাম আমি, ‘মহিলার কথায় কিছু মনে করবেন না। এখানে লোকজন তেমন আসে না তো। তাই সেধে আপনার সাথে আলাপ জমাতে গিয়েছিল বেচারী। ওর কথায় দোষ নেবেন না।’

খেতে খেতে লোকটা ‘হুম’ করে শব্দ করল। বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। বীফ স্টুতে স্যালির হাত চমৎকার। কাজেই খেয়ে তো মজা পাবেই।

আমি আবার খেজুরে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। ‘এদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন?’

‘তেমন কোথাও না। লিফটের জন্যে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম সকাল থেকে। এদিকে গাড়ি-টাড়ি দেখলাম কম চলে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খিদে লেগে গেল।

সহানুভূতির ভঙ্গিতে মাথা দোলালাম আমি। ‘ঠিকই বলেছেন। এদিকে গাড়ি- ঘোড়ার সংখ্যা কম। তবে বছরের এই সময়ে ফলের ট্রাক দেখতে পাবেন। বিকেলের দিকে। চেষ্টা করলে লিফট নিতে পারবেন। ট্রাক ড্রাইভাররা লোক ভাল। হাত তুললেই অনেক সময় দাঁড়িয়ে পড়ে।’

‘খবরটার জন্যে ধন্যবাদ,’ বলল সে। ট্রাকে সাধারণত লিফট নেয়ার চেষ্টা করি না আমি।’

‘তবু একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?’

জবাবে কিছু বলল না আগন্তুক, চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগল। আমি কফির কাপে চুমুক দিতে লাগলাম। খানিক পরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলেবেলায় কখনও পার্কে গেছেন?’

মাথা দোলাল লোকটা। ‘অবশ্যই। ছেলেবেলায় সবাই পার্কে যায়।’

‘এক সময় একটা ফান হাউজ চালাতাম আমি,’ বললাম ওকে। ‘শহরের ওধারে লেকের পাশে আমার ফান হাউজ।’

হাসল লোকটা। এতক্ষণে এই প্রথম।

‘বেশ তো! ফান হাউজ আমার খুব প্রিয় জায়গা। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে সব টাকা ফান হাউজের পেছনে খরচ করে শেষে বাড়ি ফেরার টাকা ধার করেছি আরেকজনের কাছ থেকে। একবার একটা ফান হাউজে গেছি, ওখানে লুকানো এয়ার ভেন্ট থেকে বাতাস ছাড়ত, ফুলে উঠত মেয়েদের স্কার্ট। সে এক মজার দৃশ্য রে, ভাই।’ বলে হা হা করে হাসতে লাগল সে। হাসি থামলে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘শেষ ফান হাউজে গেছি আমি এগারো বছর বয়সে-ওমাহায়। গোলক ধাঁধা ছিল ওটাতে। আরও অনেক মজার মজার জিনিস ছিল।’

‘নেব্রাস্কায় কখনও যাইনি আমি। শুনেছি খুব সুন্দর জায়গা।’

‘আরে, আমি তো ওখানে ভয়েই মরে যাচ্ছিলাম। অন্ধকারে নাগরদোলায় চড়েছি…কিছু দেখা যায় না।’

‘পুরুষ মানুষই ভয় পেতে ভালবাসে,’ বললাম আমি। ‘ভয় মানুষের প্রকৃতিরই একটা অংশ।’

‘ওখানে ট্রিক ডোর ছিল…অন্ধ গলি, কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে কেউ জানে না…হঠাৎ অন্ধকার থেকে লাফ মেরে বেরিয়ে আসে ভূত! খিক খিক করে হাসল সে। ‘একবার একটা লাল গরিলা দেখেছিলাম, লাল চোখ…মেঝে ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল। আমি ভয়ে দিয়েছি এক লাফ। তারপর এক মাস শুধু, গরিলার স্বপ্নই দেখেছি। মা আলো না জ্বেলে দিলে বেডরূমে যাবার সাহস পেতাম না।’

একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি হ্যাপিল্যান্ডে: লোকে ফান হাউজের গল্প শুরু করলে আর থামতে চায় না। ছেলেবেলায় ফান হাউজে কে কিভাবে ভয় পেয়েছে সেটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, রঙ চড়িয়ে বলতে থাকে। কিভাবে অন্ধকার গুহায় তারা হারিয়ে গিয়েছিল এসব গল্প বলে খুব মজা পায়। অবশ্য ফান হাউজ মজার জন্যেই।

‘ফান হাউজটা বন্ধ হয়ে গেল। খুব মিস করছি আমি সে সব দিনগুলো,’ সত্যি কথাটাই বললাম ওকে। ‘দারুণ সব মজা ছিল আমার ফান হাউজে। দর্শক চিৎকার দিত, ভয় পেত। বিশেষ করে মেয়েরা। কিশোরীদের তো জানেনই, গলা ফাটিয়ে খামোকা চিৎকার জুড়ে দিতে ওদের জুড়ি নেই!’

মাথা দোলাল লোকটা সায় দেয়ার ভঙ্গিতে।

হঠাৎ ওর দিকে ঘুরে তাকালাম আমি, মুচকি হেসে বললাম, ‘একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়।’

‘কি?’ খালি প্লেটটা ঠেলে দিল সে, পেটে হাত বোলাতে বোলাতে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল।

‘দু’জনে মিলে চলুন না হ্যাপিল্যান্ড থেকে ঢুঁ মেরে আসি, মজা হবে।’

লোকটা আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল, পিটপিট করছে চোখ। ‘এখুনি?’

‘নয় কেন? পার্কটা বহুদিন ধরে বন্ধ, তবে আমাদের ঢুকতে অসুবিধে হবে না। আপনাকে স্বচ্ছন্দে ফান হাউজ ঘুরিয়ে দেখাতে পারব।’

প্রকাণ্ড মাথাটা এদিক-ওদিক নাড়ল সে। ‘বুঝতে পারছি না যাওয়া ঠিক হবে কিনা। ওসব তো শিশুদের জন্যে।’

‘আরে ভাই, আমরা তো শিশুই, তাই না? অস্বীকার করতে পারেন মন আমাদের শিশুর মত সরল নয়? শুধু শরীরটাই বড় মানুষের। শৈশবে ফিরে যেতে কে না চায়?’ হাসিটা ধরে রেখে ওকে প্রলোভন দেখালাম, ‘আরে, চলেন চলেন। খুব মজা হবে। এখনও দুপুর হয়নি। পার্ক ঘুরে আসার পরে বড় রাস্তায় সহজেই লিফট পেয়ে যাবেন। দরকার হলে আপনাকে লিফট পেতে সাহায্য করব।’

লোকটা খানিক ইতস্তত করল। তারপর কি মনে করে সজোরে চাপড় মারল কাউন্টারে। ‘কেন যাব না? অবশ্যই যাব।’

হাসিটা আরেকটু বিস্তৃত হলো আমার মুখে। ‘আপনাকে এত সাধাসাধি করছি কেন, জানেন? সঙ্গীর অভাবে আমারও অনেক দিন যাওয়া হয় না ওদিকে। আপনাকে পেলাম। মনে হচ্ছে নিজের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি আমি।’

আমার একটা ফোর্ড পিক আপ আছে। পুরানো, আমার মতই। একটা টেইল লাইট নেই ওটার, ক্লাচটাও খারাপ, টায়ারের রাবার উঠে ন্যাড়া দেখায়। গাড়ির রং যে কি ছিল এক সময়, নিজেই ভুলে গেছি। বাহনটার আগাপাশতলা মেরামতের দরকার। তবুও কাজ চলে যাচ্ছে। যেখানে যেতে চাই নিয়ে যায় গাড়িটা আমাকে।

শহর থেকে দশ মিনিটের রাস্তা হ্যাপিল্যান্ড। লেকের শেষ মাথায়। এক সময় অনেক নৌকা ভেসে বেড়াত লেকের পানিতে। এখন একটাও নেই। শুধু কালো পানি। এ সময় ঠাণ্ডা বেশি বলে কেউ পানিতে নামে না। লেকটা গভীর, বিশাল, স্থির কালো পানি। দেখলে ভয় ভয় লাগে।

গেটের পাশে দাঁড় করালাম গাড়ি, জং ধরা, ভাঙা লোহার বেড়া গলে সহজেই ঢুকে পড়লাম ভেতরে। পার্কের দশা দেখলে কষ্ট লাগে। গোটা পার্ক শূন্য, পুরানো খবরের কাগজ, বিয়ারের খালি ক্যানসহ নানা হাবিজাবিতে বোঝাই। যেন ময়লা ফেলার ভাগাড়। বোর্ডের গা বেয়ে লতা উঠেছে, মাটিতে বড় বড় গর্ত। আমার সঙ্গীকে দেখেশুনে পা ফেলতে বললাম।

জীর্ণ পেনী আর্কেড পার হয়ে এলাম আমরা। এখানে একটা মেশিনও নেই। ভেতরটা নোংরা গোলাঘরের মত। রং উঠে গেছে, দেয়াল এবং ছাদ থেকে ঝুলছে মাকড়সার জাল, কয়েকটা ইঁদুর ছুটে পালাল আমাদের পায়ের শব্দে।

মেরী গো রাউন্ড বা নাগরদোলাটারও একই দশা দেখলাম। মেঝেতে চিড় ধরেছে, কোথাও বড় বড় গর্ত, এক সময় এখানে রঙিন ঘোড়ার দল লাফিয়ে বেড়াত।

‘গরিলা-টরিলা নেই এখানে,’ ফান হাউজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম। ‘বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। যে সব জিনিস অবশিষ্ট ছিল সব নিয়ে গেছে শিকাগোতে। তবে টানেলগুলোর কোন ক্ষতি হয়নি। ওগুলো আগের মতই আছে। ওখানে ঢুকলে মজা পাবেন।’

ফান হাউজের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রবেশ পথে এক যন্ত্রচালিত মোটকু থাকত, দর্শকদের দেখলেই হা হা করে হাসত। মনে হলো কান পাতলে এখনও শুনতে পাব ওর সেই হাসি। বিশ বছরেই মানুষ সব ভুলে যায় না। আমি কোনদিনই ভুলতে পারব না।

টিকেট বুদটা তৈরি করেছিলাম হাঙরের মুখ দিয়ে, হাঁ করে থাকত। হাঙরের বেশিরভাগ দাঁত এখন নেই, চামড়া ঝুলে, কুঁচকে আছে একপাশে। এদের গ্লাসও ভেঙে গেছে, দুটো বোর্ড টাঙানো ছিল হাত আড়াআড়ি করে রাখার ভঙ্গিতে। এখন ও দুটো ভেঙে রাস্তা আটকে আছে।

‘ভেতরে ঢুকব কি ভাবে?’ জিজ্ঞেস করল আগন্তুক।

‘আলগা বোর্ড-টোর্ড থাকার কথা,’ বললাম আমি, ‘দেখুন তো ভাল করে।’

‘আচ্ছা, দেখছি,’ বলল সে মুচকি হেসে।

আলগা বোর্ডটা চোখে পড়ল আমারই। ওটাকে একপাশে ঠেলে সরালাম, তারপর ভেতরে ঢুকলাম দু’জনে। ইলিনয় সবুজে ভরা দেশ। প্রচুর বৃষ্টি পড়ে এখানে, গাছ-পালা দ্রুত বেড়ে ওঠে। ফান হাউজ ঢেকে গেছে লম্বা লম্বা ঘাস আর লতা-পাতায়। মনে হচ্ছে হাজার বছরের পুরানো।

সত্যি দুঃখজনক ব্যাপার।

আকাশে মেঘ জমছে। গ্রীষ্ম যাই যাই করছে। শেষ গ্রীষ্মের ঝড় আসছে। মাথায় ক’ফোঁটা পড়লেই হলো, পরক্ষণে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। আর যত বৃষ্টি হবে, প্রকৃতির সমৃদ্ধি ঘটবে ততই। এভাবে বর্ষণ হতে থাকলে আগামী পঞ্চাশ বছর পরে গোটা হ্যাপিল্যান্ড ঢেকে যাবে সবুজ বনানীতে- মেক্সিকোর জঙ্গল- মন্দিরের দশা হবে। গাছপালার আড়ালে হ্যাপিল্যান্ড কোথায় হারিয়ে যাবে কেউ খুঁজেও পাবে না।

‘ছাদ থেকে পেরেক বেরিয়ে আছে,’ আগন্তুককে সাবধান করে দিলাম আমি। ‘দেখেশুনে পথ চলুন। শার্টে লাগলে ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে যাবেন।

‘ধন্যবাদ,’ বলল সে।

ভেতরে চলে এসেছি আমরা। এদিকটাতে নিকষ অন্ধকার। আর গুমোট। ভ্যাঁপসা গরমে ঘেমে উঠলাম

‘সামনে কিছুই ঠাহর করতে পারছি না,’ বলল আমার সঙ্গী।

‘ভয় নেই। আমি আপনার পাশেই আছি। ফ্ল্যাশ আছে আমার কাছে,’ বলে টর্চ জ্বেলে দিলাম। কিন্তু তাতে অন্ধকার দূর হলো সামান্যই। নতুন ব্যাটারি ভরতে ভুলে গেছি। গাড়ির গ্লাভ কমপার্টমেন্টে অবশ্য একজোড়া নতুন ব্যাটারি আছে। কখন কি দরকার হয়ে পড়ে বলা যায় না তাই রেখে দিয়েছি।

‘মাকড়সার জাল-টাল মুখচোখে লাগতে পারে,’ হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ‘ভয় পান মাকড়সা?’

‘মাকড়সা ঘেন্না লাগে আমার,’ বলল বিশালদেহী। ‘বিষাক্ত মাকড়সা নয়তো?’

‘আরে, না না। এগুলো সাধারণ মাকড়সা। দাঁড়ান, আপনার রাস্তা সাফ করে দিচ্ছি।’

মোড়ানো খবরের কাগজ দিয়ে মাকড়সার জাল ছিঁড়তে ছিঁড়তে একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়লাম দু’জনে। .

‘আমরা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘মানে ফান হাউজের কোন অংশে চলে এসেছি?’

‘মাঝামাঝি জায়গায়,’ বললাম আমি। ‘তবে আসল মজা আরও সামনে। চলুন এগোই।’

পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ ‘উফ’ করে উঠল প্রকাণ্ডদেহী। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, ফ্ল্যাশের মিটমিটে আলোয় দেখলাম বাঁ পা ডলছে সে হাত দিয়ে।

‘লেগেছে?’

‘ও কিছু না। একটা ভাঙা তক্তায় পা বেধে গিয়েছিল।’

‘ভাঙা তক্তা-টক্তা এখানে আরও আছে। তবে ভয়ের কিছু নেই। আসুন, আপনাকে সাবধানে নিয়ে যাই।

সরু, কাঠের টানেল ধরে এগুচ্ছি, কানে ভেসে এল ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।

‘ও কিসের আওয়াজ?’ জিজ্ঞেস করল সঙ্গী।

‘লেকের,’ জবাব দিলাম আমি। ‘টানেলের এই অংশটা তীরের ওপর তৈরি হয়েছে। পাইলিং-এর গায়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। তার শব্দ পাচ্ছেন আপনি। বোধহয় ঝড় আসবে। নইলে শান্ত লেকে ঢেউ উঠত না।’

হাঁটা চালিয়ে গেলাম আমরা। সুড়ঙ্গের আরও গভীরে ঢুকে পড়লাম, মোড় ঘুরলাম, আরেকটা টানেলে ঢুকলাম, সেখান থেকে আবার আরেকটায়। এভাবে গোলক ধাঁধার মধ্যে ঘুরতেই থাকলাম লোকটাকে অবাক করে দেয়ার জন্যে, যেন মজা পায় সে।

‘কিন্তু কোন মজা পাচ্ছি না,’ নালিশের সুরে বলল লোকটা। ‘ছেলেবেলায় যে গোলকধাঁধায় ঢুকেছি এটা তার মত নয়। এ আমার ভাল লাগছে না।’

‘আরে, আসল মজা তো পড়েই রয়েছে সামনে,’ লোভ দেখালাম ওকে।

‘সে আপনি শুরু থেকেই বলে আসছেন। দেখুন, আমার মনে হয় আমরা—’

এমন সময় ফ্ল্যাশ গেল নিভে।

‘হেই!’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘কি হলো?’

‘ব্যাটারি শেষ,’ বললাম আমি। ‘ঘাবড়াবেন না। গাড়িতে আরেক জোড়া নতুন ব্যাটারি আছে। আপনি দাঁড়ান। আমি নিয়ে আসছি ওগুলো।’

‘এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না,’ আপত্তি করল লোকটা।

‘অন্ধকার ভয় পান?’ ঠাট্টার ছলে জিজ্ঞেস করলাম।

‘আরে না। অন্ধকার ভয় পাব কেন!’ অহমিকায় লেগেছে তার।

‘তাহলে অপেক্ষা করুন আমার জন্যে। টর্চ ছাড়া এগোনো যাবে না। বিশেষ করে মোড় ঘুরতে পারব না। ফেরার রাস্তা আমার চেনা আছে। যাব আর আসব।’

‘ঠিক আছে…আমি–’

‘একটা কথা-নড়াচড়া করবেন না যেন। যেখানে আছেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবেন। না হলে আপনাকে হারিয়ে ফেলতে পারি। এখানকার কিছু সাইড টানেল বিপজ্জনক। তক্তা-টক্তাগুলো ভাঙা। হাঁটতে গেলে পা ভেঙে বসতে পারেন। আর ভুলে এক টানেল থেকে আরেক টানেলে ঢুকে পড়লে আপনাকে আর খুঁজে নাও পেতে পারি। কাজেই, যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।’

‘ঠিক আছে। এখান থেকে আমি এক চুল নড়ব না। আপনি তাড়াতাড়ি টর্চ নিয়ে আসুন।’

‘দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।’ বললাম আমি।

তারপর ওকে অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ফেলে রেখে চলে এলাম আমি।

.

ব্যাটারির জন্যে গাড়িতে ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না, বদলে সোজা চলে এলাম বি টানেলের শেষ মাথায়, আমার কন্ট্রোল রূমে।

দরজায় তালা মারা। আমার কাছে চাবি আছে। লোকটার কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে আমি বেশ উত্তেজিত। এডকে জানাতে হবে লোকটার কথা। কাজটা খুব সহজ। কন্ট্রোল রূমে লো-ভোল্টেজের একটা জেনারেটর আছে, ওটা চালু করে দিলাম। তারপর দেয়ালের সাথে লাগানো একটা সুইচ টিপে দিতেই সুড়ঙ্গের নিচে জ্বলে উঠল লাল বাতি। এড এখন বুঝতে পারবে মক্কেল নিয়ে এসেছি আমি।

সন্দেহ নেই, মক্কেলের আগমন সংবাদ আমার মতই উত্তেজিত করে তুলবে এডকে। আমার হৃৎপিণ্ড ধুপধাপ লাফাতে শুরু করে দিয়েছে।

ফান হাউজে আবার জমবে মজা।

নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই একদম। এ কাজ আগেও বহুবার করেছি আমি, কাজেই এটা রুটিন ওয়ার্কে দাঁড়িয়ে গেছে: দরজা খোলো, ভেতরে ঢোকো, এডের জন্যে অন করো সুইচ এবং চালু করে দাও ফাঁদ।

ফাঁদ মানে ট্র্যাপডোর।

ট্র্যাপডোরটা দাড়িঅলার ঠিক পায়ের নিচেই। সে যদি এদিক-ওদিক দু’এক পা হেঁটেও বেড়ায় (দু’একজন ভীতু লোক করেছে অমন) তাতেও সমস্যা নেই কোন। কারণ সুড়ঙ্গের পুরো মেঝেটাকেই ট্র্যাপডোরে পরিণত করা হয়েছে, যেদিকে বা যেখানেই যাক না কেন, কাঠের মেঝে ফাঁক হয়ে যাবে এবং লোকটা হড়কে গিয়ে পড়বে পিচ্ছিল কাদার মধ্যে। পিছলা কাদায় নিজেকে সামাল দেয়ার কোন উপায় নেই। কাদার মধ্যে ডিগবাজি খেতে খেতে সোজা গিয়ে পড়তে হবে লেকের ধারে, বালুর ওপরে। ওখানে রয়েছে এড।

আলোক সঙ্কেত দেখামাত্র লেকের তীরে চলে আসবে এড। কালো পানিতে লাল বাতিটা ফুটকির মত জ্বলজ্বল করে। গোপন আস্তানা থেকে এডের এই সঙ্কেত দেখার কোন অসুবিধে নেই। লেকের গভীর থেকে উঠে আসবে সে এঁকেবেঁকে।

এডের চেহারা তেমন একটা সুবিধের নয়। দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। ওর বাপ, গোরস্থানের গর্তে থাকত, বিশাল ইঁদুরগুলোর একটা-আর ওর মা’র বাস লেকের গভীরে, পাতালের কোথাও। কুৎসিত, বিশাল, হিলহিলে।

কিভাবে যেন ওরা একবার মিলিত হয়েছিল-ইঁদুরটা আর সেই হিলহিলে, কুৎসিত জিনিসটা-এড তাদের ভালবাসার ফসল। তাদের ছেলে। ওর আসলে কোন নাম নেই। আমিই নাম দিয়েছি এড, ঠাকুর্দা যেমন আমাকে ডাকত ট্যাড বলে। ওর একটা নাম রেখেছি, ব্যাপারটা আমার কাছে মজার মনে হয়েছে, আর নামটা ওর মধ্যে একটা মানুষ মানুষ গন্ধ এনে দিয়েছে।

এড এবং আমি, ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে দুজনে মিলে গেছে চমৎকার। ওর জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করি আমি। ও আমার জন্যে টুকটাক জিনিস রেখে দেয়। যেমন ওয়ালেট, নগদ টাকা বা আংটি (এই আংটিটি নিয়েই স্যালি আমার সাথে মশকরা করছিল)। এছাড়া আমার ব্যবহারে লাগে এমন কিছু এড স্পর্শও করে না। আসলে খুব বুদ্ধি ওর।

এড জানে ও সব জিনিস আমার পেট চালানোর জন্যে দরকার। জানে, ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে চাকরি হারিয়ে দুর্দশার মধ্যে দিন কাটছে আমার। ওর প্রতি আমার যেমন সহানুভূতি আছে আমার প্রতিও ওর তেমন রয়েছে মমতা। এ জন্যেই আমাদের পার্টনারশিপের ভিতটা এত মজবুত। আমার যা যা দরকার সে সব জিনিস নিয়ে যাবার পরে (একবার খুব সুন্দর একজোড়া চামড়ার বুট পেয়েছিলাম) এড শরীরটাকে টেনে নিয়ে যায় লেকের ভেতরে।

তারপর খাওয়া শুরু করে।

সৌভাগ্যই বলতে হবে, একবার পেট ভরে খেলে এডের আর মাসখানেকের মধ্যে খাবারের দরকার হয় না। ফলে স্যালির দোকানে দুই, তিন বা চার হপ্তার মধ্যে খদ্দের না এলেও আমাকে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় না। মা বলতেন সবুরে মেওয়া ফলে। তাই সবুর করি।

তবে একটু আধটু সমস্যা হয় শীতকালে। বরফ পড়ে রাস্তাঘাট তখন বন্ধ হয়ে যায়, লোকজনও আসে না। এড আবার শীতের সময়টা ঘুমিয়ে কাটায় বলে রক্ষে।

একটু পরে সুড়ঙ্গে ঢুকলাম আমি। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে একটা ভাব ভেতরে। বৃষ্টি ভাল লাগে না আমার। কাঠের গা বেয়ে পানি পড়ছে, কয়েক ফোঁটা আমার চাঁদিতেও পড়ল। শিউরে উঠলাম।

দাড়িঅলা নেই সুড়ঙ্গে। এডের খপ্পরে পড়েছে সে। মাঝে মাঝে অনেকেই চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু আশপাশে কোন লোকালয় নেই যে কেউ চিৎকার শুনবে। কেউ কেউ এডকে মারার জন্যে ছুরিও ব্যবহার করতে চেয়েছে। এডের চামড়া খুব শক্ত আর রাবারের মত পিচ্ছিল, সহজে কাটে না।

একটা মই বেয়ে আমি লেকের তীরে চলে এলাম। এড পানির ধারে, ঘন ঘন শ্বাস করছে, হাঁ করে আছে চোয়াল, পুঁতির মত কালো চোখ জোড়া জ্বলজ্বল জ্বলছে। এড কখনও পলক ফেলে না। বরাবরের মত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে, লেজ নাড়ছে সাপের মত। শরীর ঝাঁকি খেল এডের। দ্রুত কাজে নেমে পড়লাম। আমার মতই বৃষ্টি পছন্দ করে না এড। বৃষ্টির সময় ওর মেজাজ বিগড়ে যায়। আমার ভয় লাগে। তাই পারতপক্ষে বৃষ্টির সময় ফান হাউজের ছায়াও মাড়াতে চাই না। এবার বাধ্য হয়ে আসতে হলো। টানাটানি চলছে খুব।

দাড়িঅলা লোকটার এতক্ষণে মরে যাবার কথা। তার মাথার অর্ধেকটাই নেই। তবে এড বুদ্ধিমান। মাথাটাকে প্রায় গুঁড়িয়ে দিলেও পরনের জামা-কাপড়ের তেমন ক্ষতি হয়নি। লোকটার ওয়ালেট, আংটি, টাকা-পয়সা ইত্যাদি হাতিয়ে নিতে পারলাম সহজেই।

মই বেয়ে আবার ফিরে আসছি, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম লোকটার দিকে এঁকেবেঁকে এগোতে শুরু করেছে এড। খিদে পেয়েছে ওর।

প্রায় মাসখানেক পরে এক লোক এল স্যালির কাউন্টারে, কফি খাবে। আমার হাতঘড়ির দিকে নজর আটকে গেল তার।

‘এমন অদ্ভুত ঘড়ি জীবনে দেখিনি,’ বলল সে।

‘পৃথিবীর দশ জায়গার সময় বলে দিতে পারে আপনাকে ঘড়িটি,’ বললাম আমি। ‘বছরের কোন্ মাস, কোন্ দিন সব বলে দেয়। তাছাড়া এক ঘণ্টা পরপর মিষ্টি শব্দে ঘণ্টাও বেজে ওঠে।’

আগন্তুককে মনে হলো আমার কথায় বেশ প্রভাবিত হয়েছে।

খানিক পরে, মুচকি হেসে, তার দিকে ঝুঁকে এলাম আমি, ফিসফিস করে বললাম, ‘ছেলে বেলায় কখনও ফান হাউজে গিয়েছেন?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *