খিদে

খিদে

ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছে বাস স্পেসপোর্ট বিল্ডিং আর টেক-অফ পয়েন্টের মাঝখানের মাঠ ধরে, আমেনা বেগম কটমট করে তাকালেন অপেক্ষমাণ স্পেসশিপের দিকে। মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ওটা-বিশাল, নিঃসঙ্গ, রূপালি একটা পেন্সিলের মত লাগছে দেখতে। উজ্জ্বল, নীল আলো জ্বলছে মাথায়, ওড়ার জন্যে প্রস্তুত। জাহাজের প্রকাণ্ড লেজের নিচে, এতদূর থেকে, মানুষ আর যন্ত্রগুলোকে পুতুলের মত লাগল। শেষ প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সবাই। দৃশ্যটা দেখে প্রচণ্ড ক্রোধ অনুভব করলেন আমেনা বেগম, একই সাথে উড়োজাহাজ আর মানুষের যাবতীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রতি তীব্র ঘৃণা বোধ হলো তাঁর।

স্পেসশিপ থেকে চোখ ফেরালেন তিনি, চাইলেন তাঁর জামাতার দিকে। সামনের সীটে বসে আছে সে। জামাইয়ের প্রতিও ঘৃণা হলো তাঁর।

এবার পাশে বসা মেয়ের দিকে ঘুরলেন আমেনা বেগম। নিশাতকে খুব বিষণ্ণ লাগছে, স্থির তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। খানিক ইতস্তত করে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি, শেষ চেষ্টাটা করে দেখবেন।

‘মা,’ মোলায়েম গলায় বললেন আমেনা, ‘এখনও সময় আছে। তুই তোর মত পরিবর্তন কর। কেউ তোকে দোষ দেবে না। সবাই জানে মঙ্গল-’

‘চুপ করো, মা,’ খেঁকিয়ে উঠল মেয়ে।

কিন্তু মেয়ের ধাতানিতে দমলেন না আমেনা বেগম, বলে চললেন, ‘যেখানে যাচ্ছিস সেখানকার জীবন যাত্রার সাথে নিজেকে তুই খাপ খাওয়াতে পারবি না। ও জায়গা মেয়েমানুষের জন্যে নয়। ও ভারি কঠিন স্থান। তাছাড়া, খোরশেদকে মাত্র পাঁচ বছর থাকতে হবে ওখানে। ও যদি সত্যি তোকে ভালবাসে তাহলে তোর ভালর জন্যেই তোকে এখানে রেখে যাওয়া উচিত ওর। তুই এখানে নিরাপদে থাকবি। আর পাঁচ বছরের চুক্তি তো। সে দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’

ঠাণ্ডা গলায় নিশাত বলল, ‘এ ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আগেও কথা বলেছি, মা। আমি কচি খুকী নই। নিজের ভালমন্দ বোঝার, নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার মত বয়স আমার হয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে আমি বহুবার ভেবেছি, উল্টেপাল্টে দেখেছি পরিকল্পনাটার কোথাও কোন খুঁত আছে কিনা। শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি যাবই। আমাকে বাধা দিয়ে কোন লাভ হবে না।’

কয়েক মুহূর্ত চুপ হয়ে রইলেন আমেনা বেগম। বাস আগের গতিতেই চলছে, তবে যত সামনে এগুচ্ছে, স্পেসশিপটাকে মনে হচ্ছে ততই যেন আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে।

‘তুই সন্তানের মা হলে বুঝতিস…’ বিড়বিড় করে কথাটা যেন নিজেকেই শোনালেন আমেনা, তারপর অনুচ্চ স্বরে বললেন, ‘একদিন ঠিকই বুঝতে পারবি আমার কষ্টটা। তোকে আমি জন্ম দিয়েছি। আমার চেয়ে ভাল তোকে আর কে চেনে? তুই কর্কশ আর কঠিন স্বভাবের মেয়ে হলে এত দুশ্চিন্তা করতাম না। কিন্তু তুই তা নোস। এ জন্যেই তোকে নিয়ে এত ভাবনা আমার।’

‘যতটা দাবি করো অতটা ভাল করে আমাকে বোধহয় তোমার চেনা হয়ে ওঠেনি, মা,’ নিরুত্তাপ শোনাল নিশাতের কণ্ঠ। ‘আমি আর শিশুটি নেই। আমার জীবন আমিই যাপন করব। সত্যিকারের একজন মানুষ হতে হবে আমাকে…’

হঠাৎ মৃদু ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল বাস। দানব আকারের স্পেসশিপের পাশে ওটাকে খেলনার মত লাগছে। মনে হচ্ছে এত প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে উড়োজাহাজটা হয়তো মাটি ছেড়ে উঠতেই পারবে না। বাস থেকে নেমে পড়ল যাত্রীরা, ঝকঝকে স্পেসশিপের দিকে মুখ তুলে তাকাল। নিশাতের বাবা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন, তাঁর বুকের সাথে মিশে থাকল নিশাত কয়েক মুহূর্ত চোখে জল নিয়ে। অবশেষে মেয়েকে আলিঙ্গন মুক্ত করলেন পিতা, ধরা গলায় বললেন, ‘ভাল থাকিস, মা।’

ঝুঁকে বাবাকে সালাম করল নিশাত, তারপর মাকে। আমেনা বেগম মেয়েকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ছে টপটপ করে। শ্বশুরকে সালাম করতে এগিয়ে এল খোরশেদ আলম। তার দু’কাঁধে হাত রেখে চৌধুরী ভাঙা গলায় বললেন, ‘আমার মেয়েটাকে দেখো, বাবাজী। জানোই তো ও ছাড়া আমাদের-’

‘ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, আব্বা। নিশাতের কোন সমস্যা হবে না,’ বলল খোরশেদ আলম।

আমেনা বেগমকেও পা ছুঁয়ে সালাম করল সে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন আমেনা।

‘সকল যাত্রীকে ভেতরে আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে, হঠাৎ পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ধাতব একটি কণ্ঠ ভেসে এল, প্রতিধ্বনি তুলল টেক-অফ এলাকায়। মঙ্গলের যাত্রীরা লিফটে ঢুকল বিদায় জানাতে আসা স্বজনদের উদ্দেশে হাত নাড়তে নাড়তে।

মি. চৌধুরী আমেনা বেগমের হাত ধরে নিঃশব্দে উঠে পড়লেন বাসে। ছেড়ে দিল বাস। স্পেসপোর্ট বিল্ডিং-এ নামিয়ে দেবে বাকি যাত্রীদের। সারাটা পথ স্বামীর হাত ধরে অঝোরে কাঁদলেন আমেনা বেগম। এক পর্যায়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন:

‘ব্যাপারটা এখনও আমার বিশ্বাস হতে চাইছে না। ওর মত মেয়ে এমন কাজ করে বসবে কল্পনাও করিনি। ছোটবেলা থেকে এত চুপচাপ স্বভাবের ছিল নিশাত, ওকে নিয়ে কত না দুশ্চিন্তা করেছি আমি। ভেবেছি মেয়েটা অতিমাত্রায় লাজুক হয়ে শেষ পর্যন্ত লোকের কাছে বিরক্তি আর ঠাট্টার পাত্রী না হয়ে ওঠে। মনে আছে তোমার, নিশাতকে পাড়ার বাচ্চারা নেংটি ইঁদুর বলে ডাকত? আর আমার সেই লাজুকলতা মেয়ে কিনা খোরশেদের মত লোককে বিয়ে করে পাঁচ বছরের জন্যে অমন ভয়ঙ্কর জায়গায় থাকতে যাচ্ছে। জীবনেও ওই পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না নিশাত। তুমি ওকে কেন নিষেধ করলে না? কেন ওকে যেতে দিলে?’

‘নিষেধ করতে পারতাম,’ জবাব দিলেন মি. চৌধুরী। ‘ওকে জোর করে আটকে রাখতেও পারতাম। কিন্তু তাহলে জীবনেও আমাকে ক্ষমা করতে পারত না নিশাত।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ‘কারও জীবন-যাপনের স্বাধীনতায় আমাদের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। নিশাত এখন বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে। বাপ হয়ে কি করে ওর স্বাধীনতা খর্ব করি?’

‘আমার মন কুডাক দিচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে ওর সাথে এটাই আমাদের শেষ দেখা। কিন্তু কেন? কেন ও জেনেশুনে ওই ভয়ঙ্কর জায়গাটায় যাচ্ছে? নিশাত আমার সেদিনের মেয়ে। নাক টিপলে দুধ বেরোয়। এত জেদ কিসের ওর? ও কেন আমার নেংটি ইঁদুর হয়ে আমার সাথে রইল না?’ বলতে বলতে আবার ফুঁপিয়ে উঠলেন আমেনা বেগম।

স্ত্রীর হাতে হালকা চাপড় দিতে দিতে সান্ত্বনার সুরে মি. চৌধুরী বললেন, ‘তোমার মেয়ে কিন্তু সত্যি বড় হয়ে গেছে, নিশাতের মা। সবাইকে নেংটি ইঁদুর ভেবে কল্পনার জগতে বাস করলে তো চলবে না। সব মেয়ে নেংটি হয়ে মায়ের আঁচলের তলায় বসে থাকলে জীবনকে চিনবে কিভাবে?’

স্পেসশিপ বিজয়ের পাইলট অফিসার ক্যাপ্টেনের হাতে এক তাড়া কাগজ ধরিয়ে দিল। ‘এটা লেটেস্ট ভয়েজ রিপোর্ট, স্যার,’ বলল সে।

ক্যাপ্টেন বোরহান আহমেদ তাড়াগুলোর ওপর গভীর মনোযোগে চোখ বোলাতে বোলাতে মন্তব্য করলেন, ‘হুমম। মন্দ নয়। আমাদের নির্দিষ্ট কোর্স থেকে মাত্র ১.৩৬৫ ডিগ্রি সরে আছি। আরও দূরে সরে যাবার আগে এটা ঠিক করে নাও।’ ক্যাপ্টেন তাঁর সামনের কমিপউটরে কিছু ফিগার ঢোকালেন। ‘চেক করো, অসীম,’ নির্দেশ দিলেন তিনি পাইলট অফিসারকে।

সাথে সাথে নির্দেশ পালন করল অসীম চক্রবর্তী।

‘জাহাজের অবস্থা কি?’

‘সাইডওয়েতে ঝুঁকে আছে আর অল্প অল্প রোলিং করছে, স্যার,’ জবাব দিল অসীম।

‘ওটাও ঠিক করে নাও, প্লীজ,’ হুকুম করলেন ক্যাপ্টেন। ‘ডান দিকের সাইড- রকেটে ফোর্স থ্রী-র সাহায্যে দশ সেকেন্ডের বিস্ফোরণ ঘটাও। মোট ত্রিশ মিনিট সময় লাগবে এতে। বিশ সেকেন্ড লাগবে শিপের নাক খাড়া হতে। তারপর ফোর্স টু-র সাহায্যে বামের সাইড-রকেট দিয়ে জাহাজকে সিধে রাখো।’

‘ঠিক আছে, স্যার।’ কন্ট্রোল চেয়ারে বসে বেল্ট বেঁধে নিল অসীম। ক্যাপ্টেন বোরহান আহমেদ পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমের বোতাম টিপে মাইক্রোফোনটা টেনে নিলেন মুখের কাছে। ‘অ্যাটেনশন, প্লীজ!’ গমগম করে উঠল ক্যাপ্টেনের গলা। ‘আমরা জাহাজের কোর্স অ্যাডজাস্ট করতে যাচ্ছি। সাইড-রকেটগুলো সামান্য ঝাঁকি দিতে পারে। তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। প্রবল ঝাঁকাঝাঁকির কোন ব্যাপার ঘটবে না। তারপরও সহজে ভেঙে যেতে পারে, এমন কোন জিনিস বেঁধে রাখাই ভাল। আপনারা যে যার আসনে বসে সেফটি বেল্ট দিয়ে নিজেদেরকে বেঁধে ফেলুন। গোটা ব্যাপারটা ঘটতে বড়জোর আধঘণ্টা লাগবে, আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। কাজ শেষ হলে আবার আপনাদের খবর দেব,’ বলে মাইক্রোফোনের সুইচ অফ করে দিলেন ক্যাপ্টেন।

‘আমি ভাবছি ওই মেয়েটার কথা,’ বললেন তিনি। ‘নিশাত আলম। মেয়েটা নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হতে পারে। ওর মত নরমসরম চেহারার মেয়েকে এই নীরস যাত্রায় নয়, মানায় নিজের বাড়ির ড্রইংরুমে বসে সেলাই করার কাজে।

‘জাহাজে ওঠার পর থেকে ভদ্রমহিলা ওই কাজটিই করে চলেছেন, স্যার,’ বলল অসীম।

‘কিন্তু মেয়েটা মঙ্গলে যাচ্ছে কোন্ আক্কেলে?’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন ক্যাপ্টেন। ‘ওখানে সাংঘাতিক হোম সিকনেসে ভুগবে সে, জায়গাটা দেখামাত্র ঘৃণা ধরে যাবে মনে। মেয়েটার স্বামীর কমনসেন্স বলে কিছু নেই। এ যেন ইচ্ছে করে শিশুদের সাথে এক ধরনের অত্যাচার।’

‘দোষ বোধহয় স্বামী বেচারীর নয়, স্যার,’ বলল অসীম। ‘আসলে কিছু মেয়ে আছে দেখলে মনে হবে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু ভীষণ জেদী। আর খুব চুপচাপ স্বভাবের বলে আপনি চাইলেও ওদের সাথে লাগতে পারবেন না। এরা প্রতিবাদ করতে জানে না বলে মনে হলেও নিজেদের পাওনা শেষ পর্যন্ত আদায় করে নেয় ঠিকই।’

‘কি জানি, বাপু মেয়েদের এসব ব্যাপার-স্যাপার আমি বুঝতে পারি না,’ নাক চুলকাতে চুলকাতে বললেন চিরকুমার ক্যাপ্টেন। ‘তবে আমার বউ থাকলে সে যদি আমার সাথে মঙ্গলে যাবার গোঁ ধরত, স্রেফ মুখের ওপর না বলে দিতাম। কারণ ওখানে নরম মনের নরম স্বভাবের বঙ্গ ললনারা টিকতে পারবে না। দেখো না, মেয়েটা মঙ্গলে পৌঁছার পরপরই বাড়ি ফেরার জন্যে কান্না জুড়ে দেয় কিনা।’ ঘড়ির দিকে তাকালেন বোরহান আহমেদ। ‘যাকগে, বাদ দাও এসব। এখন কাজ শুরু করা দরকার।’ নিজের সেফটি-বেল্ট বেঁধে নিলেন ক্যাপ্টেন। সামনের স্ক্রিনের সুইচ টিপলেন। দেখলেন নানা রঙের তারা আস্তে ধীরে ভেসে যাচ্ছে দু’পাশ দিয়ে। ‘তুমি রেডি, অসীম?’ জানতে চাইলেন তিনি।

মাথা ঝাঁকাল অসীম চক্রবর্তী, হাত বাড়াল একটি সুইচের দিকে। ‘সব রেডি, স্যার,’ জবাব দিল সে।

‘ঠিক আছে। জাহাজ সিধে করো।’ হুকুম দিলেন ক্যাপ্টেন।

সুইচ টিপল অসীম। কিন্তু কিছুই ঘটল না। আবার বোতামে চাপ দিল সে। এবারও কোন সাড়া নেই।

‘আমি বলেছি জাহাজ সিধে করতে!’ উষ্মা প্রকাশ পেল ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে।

বিব্রত দেখাল অসীমকে। সে অন্য কায়দায় জাহাজ চালানোর চেষ্টা করল। বাম হাতের নিচে, একটা বোতামে চাপ দিল। এবার সাথে সাথে জবাব পাওয়া গেল। গোটা জাহাজ প্রচণ্ড জোরে লাফিয়ে উঠল সাইডওয়েতে, কেশে উঠল দারুণভাবে। কোথাও বিকট শব্দে কিছু একটা ভেঙে যাবার প্রতিধ্বনি উঠল ধাতব দেয়ালে।

সেফটি বেল্ট বাঁধা না থাকলে সীট থেকে ছিটকে পড়ে যেত অসীম। ডায়ালের দিকে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল সে। নিডলগুলো বন বন ঘুরতে শুরু করেছে ওখানে। পর্দায় তারা দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুৎগতিতে ছিটকে যাচ্ছে দু’পাশ দিয়ে তরল আগুনের ফুলঝুরি ছড়িয়ে।

ক্যাপ্টেন সেফটি বেল্ট খুলে এগোলেন অসীমের দিকে। চুম্বক বসানো জুতো ধাতব মেঝেতে বিচিত্র ঢং ঢং শব্দ তুলল, প্রতিটি পদক্ষেপে পা আটকে যেতে চাইল মেঝের সাথে। অসীমকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ওর আসনে বসে পড়লেন তিনি।

দ্রুত ইন্সট্রুমেন্টগুলো চেক করলেন ক্যাপ্টেন, তারপর সুইচ চালু করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন কাজ হলো না। অন্যান্য সুইচগুলোরও একই অবস্থা। শত টেপাটেপিতেও সাড়া দিল না। ডায়ালের নিডল আর তারাগুলো এখনও সমানে পাক খাওয়া লাটুর মত ঘুরে চলেছে।

অনেকক্ষণ পর উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন, ফিরে এলেন নিজের সীটে। একটা বোতাম চেপে কথা বললেন চীফ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। ‘তুষার,’ বললেন তিনি। ‘সাইড-রকেটগুলো কাজ করছে না। ওগুলো আর ফায়ার করবে না।’

‘কি-একটাও না, স্যার?’ তুষারের গলা ভেসে এল ইন্টারন্যাল রেডিওতে। ‘বামদিকের রকেটগুলো একবার ফায়ার করেছিল, কিন্তু অত জোরে ঝাঁকি দেয়ার কথা নয় ওদের। কাউকে বাইরে পাঠাও তো। দেখে আসুক কি ব্যাপার। অবস্থা তেমন সুবিধের ঠেকছে না।’

‘ঠিক আছে, স্যার। দেখছি আমি।’

এবার ক্যাপ্টেন পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমের সুইচ টিপলেন। ‘অ্যাটেনশন, প্লীজ। আপনারা আপনাদের বেল্ট খুলে ফেলতে পারেন। আমরা জাহাজের ফোর্স অ্যাডজাস্ট করার প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রাখছি। আবার কাজ শুরু হলে আপনাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে।’

ক্যাপ্টেন এবং পাইলট পরস্পরের দিকে তাকালেন। দু’জনেরই মুখ গম্ভীর, চোখে ফুটে আছে উদ্বেগ।

.

ক্যাপ্টেন বোরহান আহমেদ তাঁর যাত্রীদের ওপর নজর বুলালেন। চোদ্দজন পুরুষ, একজন শুধু মহিলা। এদের মধ্যে ছ’জন তাঁর ক্রু, আর সবাই প্যাসেঞ্জার। পুরুষ যাত্রীগুলো ঝামেলা পাকাতে পারে। মঙ্গলে কাজ করার জন্যে চুক্তি ভিত্তিতে এদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শক্তিশালী, কর্মঠ দেখেই বাছাই করা হয়েছে। নইলে মঙ্গলে বাস করা সহজ কাজ নয়। মেয়েটাও ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারত। তবে দেখে মনে হচ্ছে খুব চুপচাপ আর লাজুক। ঝামেলা পাকাবে না। মেয়েটা কঠিন-কঠোর আর অপরূপ সুন্দরী নয় বলে অনেকটা নিশ্চিত বোধ করছেন ক্যাপ্টেন। অমনটি হলে মেয়েটাকে নিয়ে সত্যি ঝামেলায় পড়তে হত। অসীমের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। মেয়েটাকে একেবারে অবলা ভাবার কারণ নেই। ওপরে দুর্বল মনে হলে কি হবে, ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই খুব শক্ত মনের মানুষ। না হলে এ ধরনের যাত্রায় জেনেশুনে শরীক হত না সে। এখন পর্যন্ত কোন নালিশ করেনি মেয়েটা।

যাত্রীরা যে যার আসনে বসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন ক্যাপ্টেন, তারপর শুরু করলেন। ‘ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, এই মীটিং ডেকেছি আসলে আপনাদের সবাইকে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি জানিয়ে দেয়ার জন্যে। আমাদের সাইড-রকেটগুলো কাজ করছে না। আমরা জানি না কেন ডান দিকের সাইড- রকেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বাম সাইড-রকেটে বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং সেগুলো মেরামত করা এ মুহূর্তে আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, সাইড-রকেটগুলো আমরা ব্যবহার করি হাল ধরা, এবং সবচে’ জরুরী কাজ গতি কমিয়ে জাহাজ অবতরণ করাবার জন্যে।’

কয়েক মুহূর্তের জন্যে অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল ঘরে। তারপর ধীর, সতর্ক কণ্ঠে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমরা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছি এবং ল্যান্ড করার সুযোগও আমাদের হবে না?’

প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। বিশালদেহী এক লোক। চেহারায় সুস্পষ্ট কর্তৃত্বের ভাব তাকে আলাদা করে রেখেছে অন্যদের কাছ থেকে।

‘ঠিক তাই বোঝাতে চেয়েছি আমি,’ জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন।

বিপদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে উপস্থিত লোকজন রীতিমত আঁতকে উঠল। এক যাত্রী জানতে চাইল, ‘আমাদের কি মঙ্গলের গায়ে আছাড় খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে?’

‘না,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ‘আমাদের নির্দিষ্ট কোর্স থেকে আমরা খানিকটা দূরে সরে গেছি। ফলে মঙ্গলের সাথে আমাদের সংঘর্ষের সম্ভাবনা নেই।’

‘তারমানে আমাদের আউটার স্পেসে চলে যেতে হবে,’ মন্তব্য করল সেই যাত্রী।

‘এ ব্যাপারটা অবশ্য ঘটত যদি আমরা কোর্স পরিবর্তন না করতাম,’ ব্যাখ্যা করলেন ক্যাপ্টেন। ‘তবে আমাদের করণীয় কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে। বাম দিকের সাইড-রকেটগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটার সময় জাহাজ ডিগবাজি খেয়ে উল্টে যায়। এখনও সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ ডিগবাজি খাচ্ছে। তবে আমাদের স্পেসশিপ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে ব্যাপারটা আপনারা টের পাচ্ছেন না। এখন আমরা যদি দ্রুত আমাদের মূল রকেটগুলো ফায়ার করতে পারি, তাহলে আমাদের কোর্স বদলাতে পারব। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব কাজটা করতে। সেক্ষেত্রে আমরা মঙ্গলের কক্ষপথে ঘুরপাক খেতে থাকব। কাজটা করা সম্ভব হলে না আমরা মঙ্গলের গায়ে আছড়ে পড়ব, না আমাদের আউটার স্পেসে চলে যেতে হবে। তবে কাজটা করা সম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। অবশ্য পুরোপুরি সফল হতে পারব এমন নিশ্চয়তাও আমি দিচ্ছি না।’ বক্তৃতা থামালেন ক্যাপ্টেন, তাকালেন যাত্রীদের দিকে। ভয় ফুটে উঠেছে তাদের চেহারায়। নিশাত আলম তার স্বামীর হাত ধরে আছে শক্ত করে। ওর ম্লান চেহারা, আরও বিষণ্ণ লাগছে।

‘কক্ষপথে ঢোকার পরে কি হবে?’ সেই প্রকাণ্ডদেহী প্রশ্ন করল অনুচ্চ কণ্ঠে।

‘আমি পৃথিবী এবং মঙ্গলের সাথে রেডিওতে কথা বলেছি। ওরা সব সময় আমাদের ওপর নজর রাখবে এবং যত দ্রুত সম্ভব পাঠিয়ে দেবে সাহায্য। তবে কপাল মন্দই বলতে হবে, আমাদের জন্যে মঙ্গলের কিছুই করণীয় নেই। জাহাজটা আসবে পৃথিবী থেকে, আর দু’টি গ্রহ এ মুহূর্তে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে আমাদের এখানে এসে পৌঁছতে ওদের কয়েকমাস লেগে যেতে পারে।’

‘অতদিন বাঁচব তো?’ উদ্বেগ প্রকাশ পেল বিশালদেহীর কণ্ঠে।

‘আমি হিসেব করে দেখেছি আমাদের কাছে যে সব জিনিস আছে তাতে মোটামুটি সাত-আট হপ্তা চলে যাবে,’ জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন।

‘ওতে কি হবে?’ জানতে চাইল আরেকজন।

‘হওয়াতে হবে,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ‘ব্যাপারটা কারও জন্যেই তেমন একটা সুখকর অভিজ্ঞতা হবে না। কারণ বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের বাতাস, পানি এবং খাবার দরকার। তবে বাতাস নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমাদের যে-সব ইকুইপমেন্ট আছে তা দিয়ে তাজা বাতাসের ব্যবস্থা করা যাবে স্বচ্ছন্দে। আর কাউকে চব্বিশ ঘণ্টায় এক লিটারের বেশি পানি দেয়া যাবে না। তবে সবচে’ সমস্যা হবে খাবার নিয়ে।’

কিভাবে সবার মাঝে খাবার ভাগ করে দেয়া হবে সে ব্যাপারে নিজের পরিকল্পনার কথা যাত্রীদেরকে খুলে বললেন ক্যাপ্টেন। এরপর তাদের নানা খুঁটিনাটি প্রশ্নের জবাব দিলেন। তবে কাউকেই অতিরিক্ত আশা দিলেন না আবার খুব বেশি আশাহতও করলেন না।

মীটিং শেষে সবাই চলে যাচ্ছে, নিশাত আলম এবং তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে মায়া লাগল ক্যাপ্টেনের। অন্য পুরুষদের চেয়ে খোরশেদকে কষ্ট করতে হবে বেশি। কারণ তার দুশ্চিন্তা থাকবে নিশাতকে নিয়ে। কিন্তু নিশাতকে আলাদা চোখে দেখার কোন অবকাশ নেই ক্যাপ্টেনের। তার জন্যে বিশেষ কিছু করতে গেলে অন্যরাও তখন তা পাবার দাবি করে বসবে। ফলে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হবে। না, নিশাতকে তিনি অন্যদের মতই দেখবেন। মনে মনে প্রার্থনা করলেন, নিশাতের যেন সবার আগে মৃত্যু না হয়। সে বেঁচে থাকলে সবার জন্যেই তা মঙ্গলজনক হবে…

.

তবে সবার আগে নিশাতের মৃত্যু ঘটল না। অন্তত তিন মাসের আগে কেউ মারাও গেল না।

ক্যাপ্টেন বোরহান আহমেদ তাঁর স্পেসশিপ বিজয়কে মঙ্গলের কক্ষপথে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেন। তারপর থেকে তাঁদের অপেক্ষার পালা শুরু হলো। মঙ্গলের কক্ষপথে ঘুরতে লাগল বিজয় আর তার যাত্রীরা। দিন গুনতে লাগল কবে পৃথিবী থেকে সাহায্য আসবে সে আশায়।

অল্প ক’দিন যেতেই বিজয়-এর যাত্রীদের প্রায় সবার মেজাজ খিটখিটে হয়ে উঠল, তাদের পেট ব্যথা করতে লাগল, মনে হলো ভেতরটা স্রেফ ফাঁকা হয়ে আছে। প্রত্যেকেই নানা শারীরিক দুর্বলতায় ভুগতে শুরু করল। খাবার ভাগ করার সময় তারা একে অন্যের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, কেউ আবার বেশি ভাগ পেয়েছে কিনা। ওদের সবাই এখন ঘুমুতে যায় পেটে খিদে নিয়ে, ঘুম ভাঙে ক্ষুধার্ত হয়ে, খাবারের স্বপ্ন দেখে।

মোটা-তাজা, চর্বিদার যাত্রীরা কিছুদিন যেতেই রোগাটে হয়ে পড়ল। তাদের চোখ কোটরে ঢুকে গেল, চেহারা হয়ে উঠল পাণ্ডুর বর্ণ, একেকজন হয়ে উঠল চাপা ভাঙা, শুধু কোটরাগত চোখগুলো অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ল সবাই। কারও কারও অবস্থা এমন হলো, শয্যাশায়ী হয়ে পড়ার পর নড়াচড়ার শক্তিও রইল না। এদের দেখে অন্যরা মনে মনে বলল, ‘ওরা তো মারা যাচ্ছে। খামোকা ওদের ভাগ দিয়ে খাবার নষ্ট করা কেন?’ কিন্তু তিন মাস কেটে যাবার পরেও কেউ মরল না।

ক্যাপ্টেন বোরহান আহমেদ যা ভেবেছিলেন তার চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করল পরিস্থিতি। কিছু টিনজাত মাংস, ভালভাবে প্যাক করা হয়নি, টেক-অফের সময় ওগুলোর বারোটা বেজে গেছে। পচা, নষ্ট মাংসগুলো ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না ক্যাপ্টেনের। কারণ ক্ষুধার্ত লোকগুলো ওই মাংস খেয়ে ফুড পয়জনিং-এ আক্রান্ত হতে পারত। ইমার্জেন্সী কিছু প্যাকেট আছে শুকনো খাবারের। পানি মিশিয়ে খেতে হয়। কিন্তু মহার্ঘ পানি নষ্ট করার সাহস হয়নি ক্যাপ্টেনের। ফলে কষ্ট হলেও যাত্রীদের গিলে খেতে হয়েছে সেই শুকনো খাবার, স্বাদ পাবার প্ৰশ্নই নেই।

ক্যাপ্টেন প্রত্যেকের ভাগ থেকে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে আনলেন। তারপরও যে পরিমাণ খাবার থাকল তা দিয়ে সতেরো হপ্তা টিকে থাকা সম্ভব নয়।

জাহাজের একজন যাত্রী একদিন সত্যি মারা গেল। তবে অসুস্থতা বা খাদ্যাভাবে নয়, দুর্ঘটনায়।

চীফ ইঞ্জিনিয়ার তুষার এবং আরেকজন ক্রু, আসাদ, সাইড-রকেটগুলো মেরামতের শেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিল। তারা রকেটের যে অংশ পরীক্ষা করে দেখবে তা জাহাজের ভেতর থেকে করা সম্ভব নয়। জাহাজের ভেতর থেকে গর্ত কেটে তারপর রকেটের কাছে পৌঁছুতে হবে। ক্যাপ্টেন ওদের চেষ্টা করে দেখার অনুমতি দিলেন, তবে গ্যাস কাটার ব্যবহার করা যাবে না। কারণ বাতাস তৈরির কাজে ওগুলোর দরকার হয়। ওরা বলল খামোকা বসে না থেকে বরং হাত দিয়ে গর্ত কাটার চেষ্টা করবে, সে-ও ভাল।

তারপর কাজে লেগে গেল দু’জনে। প্রতিদিন স্পেসসুট গায়ে চাপিয়ে কাজ করতে লাগল। জাহাজের কাঠামো খুবই শক্ত ধাতুতে তৈরি, তাই কাজটা মোটেই সহজসাধ্য হলো না। যতদিন গেল, কাজের গতি মন্থর হয়ে এল তত, ওরাও দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল।

একদিন, হঠাৎ, প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল জাহাজ। সবাই ছুটে গেল জানালার কাছে, মুখ ঠেকিয়ে দেখল আসাদ জাহাজের খোলের সাথে ভাসছে। তার স্পেসসুটে বড় একটা গর্ত।

চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে আসাদ বলেনি সে কি করছিল বা করতে যাচ্ছিল। কাজেই তার মৃত্যু রহস্যাবৃতই হয়ে রইল। হতে পারে হাত দিয়ে গর্ত কাটতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে সে বিস্ফোরকের সাহায্য নিতে গিয়েছিল।

জাহাজের গায়ে, শূন্যে, তাদেরই একজন সহকর্মীর লাশ ভেসে আছে, ব্যাপারটা মর্মাহত করে তুলল সবাইকে। মহাশূন্যে আসাদকে কবর দেয়ার ব্যবস্থা না থাক, ওকে ভেতরে এনে ফ্রিজারে রেখে দিলেও তো হয়। পৃথিবীতে যদি কোনদিন ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়, তখন যথাযোগ্য মর্যাদায় ওকে কবর দেয়া যাবে। যাত্রীদের পরামর্শে আসাদের লাশ ভেতরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন ক্যাপ্টেন। ফ্রিজার রূমে খাবার নেই বললেই চলে। সহজেই লাশের স্থান সংকুলান হয়ে গেল ওখানে।

আসাদের মৃত্যুর পরের দিন, ক্যাপ্টেন কন্ট্রোল রূমে বসে ডায়েরী লিখছেন, কে যেন মৃদু টোকা দিল দরজায়। ‘ভেতরে আসুন,’ বললেন তিনি I

একজনের ঢোকার মত জায়গা নিয়ে ফাঁক হয়ে গেল দরজা, নিশাত আলম পা রাখল ঘরে। ওকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন। যাত্রা শুরু হবার পর থেকে সব সময় সবার পেছনে ওকে দেখেছেন তিনি। ছোটখাট অনুরোধ বা দাবিগুলোও সরাসরি আসেনি ওর কাছ থেকে, স্বামীর মারফত জানিয়েছে তার চাহিদার কথা। মেয়েটাকে সাংঘাতিক নার্ভাস লাগছে, মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেনের কাছে যা চাইতে এসেছে তা মুখ ফুটে বলাটাও ওর কাছে খুব কঠিন।

নিশাতকে সাহস যোগানোর জন্যে মিষ্টি করে হাসলেন ক্যাপ্টেন, নরম, সহৃদয় গলায় বসতে বললেন। অপরূপ সুন্দরী বলা যাবে না নিশাতকে, তবে একেবারে মন্দও ছিল না সে দেখতে। কিন্তু এখন তার চেহারায় সৌন্দর্যের বালাই নেই, শুকিয়ে হাড্ডি হয়ে গেছে। মেয়েটাকে এমন যাত্রায় নিয়ে আসাটা খুবই নিষ্ঠুরতা হয়ে গেছে, ভাবলেন ক্যাপ্টেন। ওর স্বামীটা মস্ত গাধা। নিশাতকে বাড়ি রেখে আসাই উচিত ছিল তার। তবে অবাক লাগছিল ক্যাপ্টেনের এমন বৈরী পরিবেশেও মেয়েটা তার শরীর ও মনের শক্তি ধরে রেখেছে ভেবে।

‘আপনার জন্যে কি করতে পারি, মিসেস আলম?’ জিজ্ঞেস করলেন বোরহান আহমেদ।

‘করতে পারেন অনেক কিছুই,’ বলল নিশাত। ‘তবে…তবে কাজটা সহজ নয়।’

‘কেউ কি আপনাকে বিরক্ত করেছে?’

‘না, না, ক্যাপ্টেন,’ দ্রুত বলল নিশাত। ‘ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। ইয়ে মানে খাবারের কথা বলছিলাম। আমি প্রয়োজনমত খাবার পাচ্ছি না।’

এবার রুক্ষই শোনাল ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ, ‘তা আমরা কেউই পাচ্ছি না।’

‘সে আমি জানি, তবে…মানে, কাল রাতে যে লোকটা মারা গেল…ভাবছিলাম ওর ভাগটা যদি পেতাম…’ থেমে গেল নিশাত ক্যাপ্টেনের চাউনি দেখে।

হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন তিনি, চেহারা দেখেই বোঝা যায়। এমন স্বার্থপরের মত কেউ খাবারের ভাগ চাইতে পারে, নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাসই হত না তাঁর। কটমট করে তিনি তাকিয়ে রইলেন নিশাতের দিকে। আশ্চর্য, নিশাত তাতে মোটেও লজ্জা পেল না। এমনকি ওকে এখন আর নার্ভাসও লাগছে না।

‘আমার আরও খাবার দরকার,’ জরুরী আবেদনের সুর ফুটল তার কণ্ঠে।

হঠাৎ প্রচণ্ড রেগে গেলেন ক্যাপ্টেন। ‘তা হলে আপনি নিজেরটার পাশাপাশি মরা মানুষের খাবারেরও ভাগ চাইছেন! আপনাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, ম্যাডাম-খাবারের ভাগ সমান ভাবে ভাগ করা হয়, ভবিষ্যতেও তাই হবে। আসাদ মারা গেছে। ওর খাবারটা এখন সবার মাঝেই সমান ভাগ করে দেয়া হবে। ব্যস, আর কথা নয়। এবার আপনি যেতে পারেন।’

কিন্তু নড়ল না নিশাত। নিজের জায়গায় ঠায় বসে রইল। ক্যাপ্টেন লক্ষ করলেন ওর হাত দুটো কাঁপছে। অবাক লাগল। মেয়েটা যেন হঠাৎ বদলে গেছে। বেড়ালের বাঘিনীতে আকস্মিক রূপান্তর ঘটেছে।

‘আমি আপনার কাছে আজ পর্যন্ত কিছু চাইনি,’ শুরু করল নিশাত। ‘আজ চাইতে এসেছি অনন্যোপায় হয়ে। ওই লোকটার মৃত্যু আমাদের অতি সামান্যই অতিরিক্ত খাবারের ভাগ যোগাতে পারবে। কিন্তু আমার দরকার অনেক বেশি খাবার।’

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে রীতিমত বেগ পেতে হলো ক্যাপ্টেনের। ‘আপনার কি ধারণা, বেশি খাবার শুধু আপনার একারই দরকার? আমি জীবনেও এত স্বার্থপর মানুষ দেখিনি-‘

হাড্ডিসার একটা হাত তুলে বাধা দিল নিশাত ক্যাপ্টেনকে, চোখে ফুটে উঠেছে কঠিন দৃষ্টি। ওকে এখন মোটেই নরম-সরম, অসহায় মেয়ে মনে হচ্ছে না। ‘ক্যাপ্টেন, আমার দিকে তাকান!’ চিলের মত তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল নিশাত, গলার স্বরে কর্তৃত্বের ভাব সুস্পষ্ট।

তাকালেন ক্যাপ্টেন। রাগ নয়, বিস্মিত দেখাল তাঁকে, সেই সাথে খানিকটা শড়ও। নিশাতের বিবর্ণ গালে গোলাপী রঙ ধরল।

‘হ্যাঁ,’ বলল সে। ‘আপনি এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন অতিরিক্ত খাবার দরকার আমার। আমার গর্ভের সন্তানকে বাঁচানোর জন্যে আমার প্রচুর খাবার চাই।’

চোখ বুজলেন ক্যাপ্টেন, বিড়বিড় করলেন, ‘এ ভয়ঙ্কর!’

‘না, এটা ভয়ঙ্কর কোন ব্যাপার নয়,’ বলল নিশাত। ‘আমি কারও খাবারে জোর করে ভাগ বসাতে যাচ্ছি না। মৃত আসাদের খাবারের দরকার নেই-কিন্তু আমার অনাগত সন্তানের দরকার। ব্যস, সহজ সমীকরণ। আর এখানে স্বার্থপরতারও প্রশ্ন নেই। আমি এখন একা নই, দু’জন। কাজেই আমার বেশি খাবার দরকার। আপনি সে ব্যবস্থা না করলে বলব জেনেশুনে আমার বাচ্চাকে হত্যা করছেন। কাজেই আপনাকে অবশ্যই অতিরিক্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। আমার বাচ্চাকে বাঁচাতে হবে।’

নিশাত চলে যাবার পরে ক্যাপ্টেন বোরহান আহমেদ তার ব্যক্তিগত ড্রয়ার খুলে, সযত্নে লুকানো একটি হুইস্কির বোতল বের করলেন। এক ঢাক পেটে যাবার পরে শরীরটা চনমনে লাগল। তবে তাঁর চেহারায় এখনও দুশ্চিন্তার ভাব স্পষ্ট।

নিশাতকে কি সত্য কথাটা খুলে বলবেন তিনি? বলবেন কি সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার কোন সুযোগই ওর নেই? জানাবেন কি ওদেরকে তিনি দিনের পর দিন যে সব আশার বাণী শুনিয়ে চলেছেন তা সব মিথ্যা? কিন্তু নিশাতকে এ কথা বললে সে তার স্বামীকে বলে দেবে, দ্রুত ব্যাপারটা জেনে যাবে সবাই। জানবে যে রেসক্যুশিপের কথা তাদের বলা হয়েছে মঙ্গলের দিকে ছুটে আসছে, এখন পর্যন্ত মাটি থেকে আকাশেই ওড়েনি সেটা। সবাই যখন জেনে যাবে তাদের বেঁচে থাকার কোনই আশা নেই, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে তখন।

ক্যাপ্টেন ডেস্কের টপ ড্রয়ার খুলে একটা বন্দুক তুলে নিলেন। এটাকে এখন সবসময় সঙ্গে নিয়ে বয়ে চলার সময় এসেছে। তিনি বুঝতে পারছেন, খুব শিগগির আগ্নেয়াস্ত্রটা হয় ওদের ওপর ব্যবহার করতে হবে-নতুবা নিজের ওপর।

দরজায় নক্ করল কেউ। এক সেকেন্ড পর ভেতরে ঢুকল পাইলট অসীম চক্রবর্তী।

ওর দিকে মুখ তুলে চাইলেন ক্যাপ্টেন, সাথে সাথে আঁতকে উঠলেন। ‘একি, এমন লাগছে কেন তোমাকে!’

অসীমকে দেখাচ্ছে বিধ্বস্ত, পরাজিত সৈনিকের মত। চোখে কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টি। সে কোন কথা না বলে দুটো জিনিস এগিয়ে দিল ক্যাপ্টেনের দিকে। একটা চাবি, অন্যটা নাম লেখা ব্রেসলেট। ব্রেসলেটটা আসাদের। রেকর্ড করার জন্যে ক্যাপ্টেনের এটা দরকার ছিল। তিনি অসীমকে পাঠিয়েছিলেন ফ্রিজার থেকে ওটা নিয়ে আসতে। মৃত মানুষের গা থেকে ব্রেসলেট খুলে আনাটা নিশ্চয়ই খুব একটা প্রীতিকর কাজ নয়। তাই বলে অসীমকে এমন দেখাবে কেন?

‘কি হয়েছে তোমার বলো তো?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করলেন ক্যাপ্টেন। ভূত দেখেছ নাকি?’

‘তারচে’ও ভয়ানক ব্যাপার, স্যার,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল অসীম।

‘মানে?’ ভুরু কুঁচকে গেল ক্যাপ্টেনের।

বুক ভরে দম নিল অসীম, তারপর বলল, ‘আসাদের-আসাদের পা নেই, স্যার।‘

‘কি আবোল তাবোল বকছ! ওকে ভেতরে নিয়ে আসার সময় তুমি-আমি দু’জনেই দেখেছি আসাদের দু’টি পা-ই যথাস্থানে আছে।’

‘ছিল, স্যার। ওই সময় ওর পা ছিল-কিন্তু এখন নেই!’ শিউরে উঠল অসীম।

পাথর হয়ে বসে রইলেন ক্যাপ্টেন। কয়েক সেকেন্ড কন্ট্রোল রূমে নিঃশ্বাস পড়ার শব্দও শোনা গেল না। তারপর, অনেক কষ্টে, শব্দ হাতড়ে, মাত্র দুটি কথা উচ্চারণ করতে পারলেন তিনি, ‘তার মানে–

‘এছাড়া আর কি হতে পারে, স্যার?’ বলল অসীম।

‘ওহ্, খোদা!’ গুঙিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন।

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি অসীমের দিকে। তাঁর মত, অসীমের চোখেও ফুটে উঠেছে তীব্ৰ ভয়।

করিডর ধরে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে দু’জন মানুষ। দাঁড়িয়ে পড়ল শিপের ফ্রিজার রূমের দরজার সামনে। একজন দু’পাশে লক্ষ রাখছে, অপরজন পকেট হাতড়ে বের করল লম্বা, সরু একটি চাবি। তালায় চাবি ঢোকাল সে, মোচড় দিতে খুলে গেল তালা। মৃদু শব্দে দরজাও খুলে গেল। সাথে সাথে ঘরের ভেতর থেকে কে যেন পরপর দু’বার গুলি করল চাবি হাতে লোকটাকে। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল চাবিঅলা, তারপর মেঝের ওপর, শূন্যে ভাসতে লাগল সে।

তার সঙ্গী তখনও করিডরে দাঁড়িয়ে, পকেট থেকে বন্দুক বের করে দরজার একপাশে সরে গেল। তারপর ফ্রিজার লক্ষ্য করে গুলি করল। স্পেসসুট পরা একটা __ ছিটকে বেরিয়ে এল ফ্রিজার থেকে, লোকটার পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকে লক্ষ্য করে আবার গুলি করল সে। স্পেসসুট বাড়ি খেল বিপরীত দিকের দেয়ালে, তারপর ওটার সাথে শরীর লেগে থাকল তার, নিস্পন্দ ভেসে রইল।

বন্দুকবাজ এবার ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল অসীম চক্রবর্তী দৌড়ে আসছে তার দিকে। পাইলটকে গুলি করল সে, প্রত্যুত্তরে অসীমের হাতের বন্দুকও গর্জে উঠল। কয়েক সেকেন্ড গোলাগুলি চলল দু’পক্ষে। একসময় থেমে গেল বন্দুকবাজ, কিন্তু অসীম থামল না।

বন্দুকবাজকে হত্যা করার পর অসীম এগিয়ে গেল স্পেসসুট পরা, শূন্যে ভাসমান আগন্তুকের দিকে। একটানে খুলে ফেলল মাউথপিস। ক্যাপ্টেন বোরহান আহমেদ। ধীরে ধীরে চোখ মেললেন তিনি, ফিসফিস করে বললেন, ‘ভাল কাজ দেখিয়েছ, অসীম। গুড লাক!’

জবাবে অসীম কিছু বলতে গেল, শব্দ নয়, ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত। দ্রুত গাঢ় হয়ে উঠল তার ইউনিফর্মের রঙ। কয়েক মুহূর্ত পরে সে-ও সাথী হলো ক্যাপ্টেনের, দেয়ালের সাথে ভাসতে লাগল তার নিষ্প্রাণ দেহ।

‘ভেবেছিলাম ওরা আমাদের মতই বেঁচে থাকতে পারবে,’ বলল বেঁটেখাট এক লোক, ঠোঁটের ওপর হালকা বাদামী গোঁফ। ‘কিন্তু ফ্রিজার রূমে গোলাগুলি করে মরেছে সব ক’জন।

‘ঠিক বলেছেন,’ মন্তব্য করল সেই বিশালদেহী। শুকিয়ে লম্বা তালগাছ হয়ে গেছে সে এতদিনে। আগের মতই অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘ওরা ছিল মোট সাতজন। তবে আপনার হিসেব মত টিকে থাকতে পারেনি ওরা। লিভিংরুমের চারপাশে চোখ বুলাল সে, মাথা গুনছে। স্পেসশিপ ‘বিজয়’-এ এখনও ন’জন যাত্রী বেঁচে আছে।

‘আসুন, শুরু করা যাক,’ প্রস্তাব দিল সে। ‘এটা একটা বাজি, সবাই জানেন। এই বাটিতে ভাঁজ করা যে কাগজগুলো আছে, তা প্রত্যেককে একটা করে তুলতে হবে। আমি বিশেষ শব্দটা উচ্চারণ না করা পর্যন্ত কেউ হাতের কাগজ খুলে দেখবেন না। সবাই একসাথে কাগজ খুলব। এই কাগজগুলোর একটির মধ্যে ‘এক্স’ চিহ্ন দেয়া আছে। মকবুল সাহেব, আপনি কাগজগুলো আবার গুনে নিন। দেখুন, ন’টুকরো আছে কিনা-

‘আট!’ তীব্র গলায় বলে উঠল নিশাত।

সবগুলো মাথা ঘুরে গেল তার দিকে। সবার চেহারায় ফুটে উঠেছে বিস্ময়ের ভাব, যেন নিশাতের এখানে কথা বলাটা অনধিকার চর্চা হয়ে গেছে। ওদের চাউনির সামনে বিব্রত বোধ করল নিশাত, তবে নিজের জায়গায় স্থির বসে রইল সে, চেহারায় অদ্ভুত কাঠিন্য।

‘বেশ, বেশ,’ বলল দলনেতা তালগাছ, ‘আপনি আমাদের খেলায় তাহলে অংশ নিতে চাইছেন না?’

‘না,’ জবাব দিল নিশাত।

‘এতদিন তো সব কিছু আমাদের সাথে সমানভাবে শেয়ার করেছেন, এখন চূড়ান্ত দুর্যোগের মুহূর্তে কেন দলে থাকতে চাইছেন না?’

‘চাইছি না কারণ আপনাদের খেলার উদ্দেশ্য আমার পছন্দ হয়নি,’ ধারাল গলায় বলল নিশাত। ‘যে লোকটি ‘এক্স’ চিহ্নিত কাগজ তুলবে, তাকে নিশ্চয়ই মরতে হবে?’

‘জ্বী, বলল দলনেতা। ‘তাকে মরতে হবে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। আপনি ভাল করেই জানেন দুর্ভাগ্যজনক এই পরিকল্পনা কাজে না লাগিয়ে আমাদের উপায় নেই।’

‘কিন্তু আমার ভাগ্যে যদি ওই কাগজ ওঠে তা হলে দু’জনকে মরতে হবে। আমি এবং আমার বাচ্চা। এটাকে আপনি ‘ফেয়ার’ গেম বলবেন?’

গোটা দল চুপ হয়ে রইল। দলনেতাও কথা বলল না। বাদামী গোঁফঅলা, নাম যার মকবুল, খানিক পরে নীরবতা ভাঙল, ‘এক্ষেত্রে একটা কাজ করা যায়। আসুন, আমরা ভোটাভুটির ব্যবস্থা করি। মিসেস আলম আমাদের খেলায় যে অংশ নিতে চাইছেন না এ ব্যাপারে আপনাদের সবার মতামত জানতে চাইছি।’

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান,’ জোরাল হয়ে উঠল নিশাতের কণ্ঠ, এত তীক্ষ্ণ গলায় এর আগে কেউ তাকে কথা বলতে শোনেনি। ‘ভোটাভুটি শুরু করার আগে আমার একটা কথা শুনুন।’ গোটা ঘরে নজর বুলাল সে, সবাই তার কথা শুনছে কিনা বুঝতে চাইল। হ্যাঁ, শুনছে। ‘প্রথম কথা হলো, আপনাদের যে কারও চেয়ে এখানে আমার গুরুত্ব অনেক বেশি। না, না। দয়া করে হাসবেন না। আমি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করছি।

‘রেডিও নষ্ট হয়ে যাবার আগে ক্যাপ্টেন বোরহান আহমেদ পৃথিবীতে আমাদের সবার খবর পাঠিয়ে দেন। সংবাদপত্রগুলো যে কারও চেয়ে আমার খবর পেতেই বেশি আগ্রহী ছিল। কারণ ওরা জেনে গেছে আমি সন্তানসম্ভবা। মিডিয়ার আমার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে আমিই প্রথম স্পেসশিপে সন্তান জন্ম দিতে চলেছি। কাজেই বুঝতেই পারছেন ওদের চোখে আমি হিরোইন হয়ে উঠেছি, আপনারা ওদের কাছে তেমন কোন গুরুত্বই বহন করছেন না।

বিরতি দিল নিশাত, কথাটা হজম করার সময় দিল ওদেরকে, তারপর আবার শুরু করল, ‘অবশ্য আমি প্রেগন্যান্ট এ কথা ক্যাপ্টেন জানাবার আগেই আমি ওদের কাছে বিশাল আকর্ষণ হয়ে উঠি। কারণ মঙ্গলগ্রহের মত বৈরী গ্রহে কোন মেয়ে মানুষের যাত্রা এই প্রথম। তারওপর আমি মা হতে চলেছি, এটা জানার পরে ওখানে যে কি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে তা আমি না দেখতে পেলেও অনুভব করতে পারি। এখন বুঝতে পারছেন তো আমার গুরুত্ব কতখানি?’

‘এবার আসল কথায় আসি। আপনাদের জন্যে একটা চমৎকার গল্প রেডি আছে। তা হলো-সাইড রকেট রিপেয়ার করতে গিয়ে আসাদ, আমার স্বামী, ক্যাপ্টেন বোরহান সহ আরও কয়েকজন মারা গেছেন। বিস্ফোরণের কারণে এদের সবার দেহ উড়ে গেছে মহাশূন্যে। এ গল্পটা লোকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু লোকে যদি আমার বা আমার সন্তানের কোন চিহ্ন খুঁজে না পায়-তখন ব্যাপারটার কি ব্যাখ্যা দেবেন আপনারা?’

দলটার ওপর আবার চোখ বুলাল নিশাত। কেউ কিছু বলছে না দেখে নিজেই ব্যাখ্যা করল, ‘আপনারা কি বলবেন আমিও রকেট মেরামত করতে গিয়েছিলাম? বা নিজেই গুলি করে আত্মঘাতী হয়েছি? ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে দেখুন একবার। সারা দুনিয়ার সংবাদপত্রগুলো আমার ব্যাপারে বিস্তারিত খবর পেতে চাইছে। আর আপনাদের ব্যাখ্যা যদি তাদের মনঃপূত না হয়, জীবনেও এখান থেকে বেরুতে পারবেন না। যদি কখনও পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারেন, পৃথিবীর মানুষ আপনাদের ফাঁসিতে ঝোলাবে। আবার এমনও হতে পারে পৃথিবীতে পৌঁছার আগেই ওরা আপনাদের খুন করে ফেলতে পারে।’

নিশাতের কথার সত্যতা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে রইল সবাই। শেষে দলনেতা বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি আইনজীবী হলে খুব ভাল করতেন। আমাদের পরের মীটিং-এ ব্যাপারটা অবশ্যই বিবেচনাধীন রাখব। তবে, মকবুল সাহেব, আপনি বরং আট টুকরো কাগজ দিয়েই আজকের খেলা শুরু করুন…’

‘ওই যে ওটা!’ ক্যাপ্টেনের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে বলল সেকেন্ড অফিসার।

‘হ্যাঁ, আমারও তাতে কোন সন্দেহ নেই,’ জবাব দিলেন রেসক্যুশিপের ক্যাপ্টেন অনিরুদ্ধ রায়। স্ক্রীন গভীর মনোযোগে দেখতে দেখতে মন্তব্য করলেন, ‘কিন্তু ওখানে জীবনের কোন চিহ্নই দেখতে পাচ্ছি না।’

‘কেউ বেঁচে আছে বলে মনে করছেন, স্যার?’

‘কি, এতদিন পরেও! না, জাহিদ। তার কোন চান্সই নেই,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ‘আমরা ওখানে ঢুকব কি করে, স্যার?’ জানতে চাইল সেকেন্ড অফিসার জাহিদ হোসেন।

‘যদি স্টীলের একটা লাইন বিজয়-এর সাথে হুক সহ লাগাতে পারি, তাহলে বড়শিতে আটকানো মাছের মত ওটাকে ধীরে ধীরে টেনে আনতে পারব।’ জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন

তবে কাজটা সহজ নয়। পাঁচ বার স্টীল লাইন ছুঁড়ে মারা হলো ‘বিজয়’কে লক্ষ্য করে। পাঁচবারই ব্যর্থ হলেন ক্যাপ্টেন। ছ’বারের চেষ্টায় আটকে গেল হুক। তারপরও পুরো তিনটা ঘণ্টা লাগল ‘বিজয়’-এর পাক খাওয়া থামাতে। অবশেষে স্পেসশিপের কাছে আসতে পারলেন তাঁরা। কিন্তু শিপের ভেতরে জীবিত কেউ আছে বলে মনে হলো না।

ক্যাপ্টেন, থার্ড অফিসার এবং একজন ডাক্তার স্পেসসুট পরে নিলেন। রেসক্যুশিপ থেকে ইস্পাতের তার ধরে ধরে ‘বিজয়’-এর এন্ট্রান্সে পৌঁছুলেন তাঁরা। থার্ড অফিসার তার কোমরের বেল্ট থেকে একটা টুল বের করে খুটুর খাটুর কাজ শুরু করে দিল। প্রথমে এন্ট্রান্স ডোরে ছোট একটা গর্তে টুল বা চাবিটা, যতদূর যায়, ঢুকিয়ে দিল সে। তারপর দ্বিতীয় গর্তে ঢুকিয়ে মোচড় দিল, এতে প্রবেশ পথের এয়ারলক বন্ধ হয়ে গেল, তারপর মোটরের সুইচ অন করে দিল সে লক থেকে বাতাস বেরিয়ে যাবার জন্যে।

ক্যাপ্টেন স্পেসশিপের গায়ে একটা মাইক্রোফোন চেপে ধরলেন, কান পাতলেন। ভ্রমরের গুঞ্জনের মত একটা শব্দ শোনা গেল।

‘মোটর চলছে,’ বললেন তিনি। শব্দটা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন, তারপর হুকুম দিলেন, ‘ঠিক আছে, এবার দরজা খোলো।’

থার্ড অফিসার তৃতীয় গর্তে ঢোকাল তার চাবি, মোচড় দিল। ভেতর থেকে খুলে গেল দরজা। পরস্পরের দিকে একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন ওঁরা, ক্যাপ্টেন খুব আস্তে উচ্চারণ করলেন; ‘চলুন, ভেতরে ঢোকা যাক।’

সাবধানে পা বাড়ালেন তাঁরা, ঢুকে পড়লেন অন্ধকার রাজ্যে।

কিছুক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন প্রশ্ন করলেন, ‘বাতাসের কি অবস্থা, ডাক্তার?’

‘ঠিকই আছে,’ জবাব দিলেন ডাক্তার মোস্তাফিজুর রহমান। খানিকটা বিস্মিত মনে হলো তাকে। ব্রেদিং ইকুইপমেন্ট খুলে ফেললেন তিনি, তাঁর দেখাদেখি অন্যেরাও।

‘জায়গাটা কেমন গা ছমছমে,’ অস্বস্তি নিয়ে বললেন ক্যাপ্টেন। ‘আসুন, তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিই।’

হাঁটতে হাঁটতে আলোকিত, সেন্ট্রাল রূমে ঢুকে পড়লেন ওঁরা। বিজয় এখন আর বনবন ঘুরছে না, তারপরও নানা জিনিসপত্র ভেসে আছে বাতাসে।

‘এখানে কেউ নেই বোধহয়,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ‘ডাক্তার, আপনার কি মনে হয়—’ মোস্তাফিজুর রহমানের চেহারায় বিচিত্র একটা ভাব ফুটে উঠতে দেখে কথা আর শেষ হলো না তাঁর।

যে সব জিনিস শূন্যে ভেসে আছে, তার মধ্যে একটা হাড়ও দেখা যাচ্ছে। হাড়টা লম্বা, ধবধবে সাদা, সামান্য মাংসের কণাও কোথাও লেগে নেই। হাড়টা দু’এক জায়গায় ভাঙা। যেন দাঁত দিয়ে চিবানো হয়েছে। ডাক্তার ওটার দিকেই তাকিয়ে আছেন বিস্ফারিত চোখে।

‘ওটা মানুষের পায়ের হাড়, ক্যাপ্টেন,’ কথা বলার সময় গলা কেঁপে গেল ডাক্তারের।

ঠিক সেই মুহূর্তে, বিজয়-এর নীরবতা ভেঙে ভেসে এল সরু এবং পরিষ্কার গলার গুনগুনানি

ঘুমো আমার মেয়ে
চোখ বুজে ঘুম দে…

গান গাইছে নিশাত। বিছানায় বসে, ছোট্ট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দোল দিচ্ছে। বাচ্চাটা হাসছে। হাসতে হাসতে সরু একটা হাত বাড়িয়ে ছুঁলো মায়ের মুখ। মা চকচকে চোখে তার দিকে তাকিয়ে গুন-গুন করে গাইতে লাগল-

তুই ঘুমুলে পরে
আমি খাবার পাব যে

হঠাৎ গান থেমে গেল নিশাতের দরজা খোলার শব্দে। দোরগোড়ায় দাঁড়ানো তিনজনকে দেখে তার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। ওঁরাও বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন জ্যান্ত কঙ্কালটার দিকে। নিশাতের গায়ে মাংস নেই, হাড়ের সাথে লেপ্টে আছে চামড়া, হাত জোড়া কাঠির চেয়েও সরু; মুখ নয়, যেন কঙ্কালের একটা মুখোশ পরে আছে। তবে গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল। ওখানে জ্বলজ্বল করছে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা।

বিস্ময়ের ভাবটা কেটে গিয়ে মুখে হাসি ফুটল নিশাতের, ধকধক জ্বলে উঠল চোখ। বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামাল সে, হালকা শরীর নিয়ে শূন্যে উঠে গেল বাচ্চা, খিকখিক হাসছে। বালিশের নিচে হাত ঢোকাল নিশাত, বের করে আনল ভয়ঙ্কর দর্শন একটা বন্দুক।

তার সরু, কাঠি কাঠি হাতে বন্দুকের কালো ব্যারেলটা প্রকাণ্ড এবং বিকট দেখাল। চৌকাঠে দাঁড়ানো তিনজনের দিকে অস্ত্রটা তাক করে ধরল নিশাত। তাঁরা ঘটনার আকস্মিকতায় এতই অবাক হয়ে গেছেন, নড়াচড়া করতেও ভুলে গেলেন।

ট্রিগার টেপার আগের মুহূর্তে নিশাত বলল, ‘দেখো, মা দেখো! খাবার! কি চমৎকার, মজাদার খাবার এসেছে! দেখো…’

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *