ভয়াল রাত

ভয়াল রাত

শরতের এক বিশ্রী, স্যাঁতসেঁতে দিনে আমি যাত্রা শুরু করলাম আশারদের বাড়ির উদ্দেশে। বেশ কয়েকটা গ্রাম পার হবার পর, সন্ধ্যার দিকে ওদের প্রাসাদটা চোখে পড়ল।

আশার আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ওর পুরো নাম রডরিক আশার। বহুদিন ওর সাঁথে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। অবশ্য আমি থাকিও অনেক দূরে। তাই এদিকটাতে অনেকদিন আসা হয় না। আজকেও আসতাম না। কিন্তু দিন কয়েক আগে আশারের একটা চিঠি পেয়েছি আমি। ভয়ানক অসুস্থ সে, মানসিক ভারসাম্য নাকি হারিয়ে ফেলছে। এই মুহূর্তে একজন বন্ধুর সাহচর্য ওর খুব দরকার। আর পুরনো বন্ধু বলতে আমি ছাড়া আশারের কেউ নেই। আশারের আশা আমার সান্নিধ্যে সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। বাল্যবন্ধুর কাতর অনুরোধ ফেলতে পারিনি। তাই চিঠি পেয়ে ছুটে এসেছি।

রডরিক আশার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও ওর সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানি না।

আসলে ও মুখ ফুটে নিজের সম্পর্কে কখনও কিছু বলেনি। শুধু জানি কয়েক পুরুষ ধরে ওদের এই গ্রামে বাস। ওর পূর্ব-পুরুষদের অনেকেই শিল্পকলার চর্চা করতেন, ঝোঁক ছিল গানবাজনার প্রতি। কেউ কেউ ছিলেন বিখ্যাত দানবীর। গ্রামের সবচেয়ে পুরনো পরিবার বলে আশারদের কথা সবাই জানে। গ্রামটাও আশারদের গ্রাম বলে পরিচিত। আশারদের প্রাসাদটা বিশাল। কিন্তু কেমন যেন অশুভ একটা ব্যাপার আছে বাড়িটাকে ঘিরে। বিরাট প্রাসাদের কাঠামোটার দিকে তাকিয়ে আমার ভয়ই করতে লাগল। দেয়ালগুলো ধূসর, ঠাণ্ডা। দেয়াল ঢাকা পড়েছে শ্যাওলা আর লতানো উদ্ভিদের আড়ালে। জানালার দিকে চাইতে শিরশির করে উঠল গা। কোটরাগত শূন্য চোখে যেন চেয়ে আছে সবকটা জানালা। আয়ু ফুরিয়ে আসা কয়েকটা গাছ সাদা, মরাটে। এখনও ধুঁকতে ধুঁকতে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন বাড়িটির স্যাঁতসেঁতে মাটিতে।

আশারদের প্রাসাদের দিকে ভাল করে তাকাতে মনে হলো কুয়াশার অদ্ভুত একটা মেঘ যেন ঘিরে আছে ওটাকে। কাছের জলা আর মরতে বসা গাছ থেকে বাষ্প যেন উঠে আসছে। পাথুরে দেয়ালগুলোকে ধীরে ধীরে ঢেকে ফেলছে কুয়াশার মেঘটা। শেওলাপড়া হলেও বেশিরভাগ দেয়াল এখনও পোক্ত। শুধু দু’এক জায়গায় ফাটল ধরেছে। ভাল মত লক্ষ করে বুঝলাম ছাদ থেকে একটা সরু ফাটল আঁকাবাঁকা হয়ে নেমে গেছে নিচে। এসব দেখতে দেখতে সরু লন ধরে এগোলাম বাড়িটার দিকে। চাকর শ্রেণীর এক লোক আমাকে দেখে এগিয়ে এল। ঘোড়াটার দায়িত্ব তাকে বুঝিয়ে দিয়ে আমি ধনুকাকৃতির হলঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। আরেক লোক আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল রডরিক আশারের কাছে।

বেশ কিছু অন্ধকার এবং আঁকাবাঁকা প্যাসেজ পার হতে হলো। ঢেউ খেলানো সিলিং, দেয়ালে ভাঁজ খাওয়া কিছু ট্যাপেস্ট্রি, কালো কাঠের মেঝে ইত্যাদি কোন কিছুই আমার নজর এড়াল না। সিঁড়ি গোড়ায় পরিচয় হলো পারিবারিক ডাক্তারের সঙ্গে। কেন জানি তিনি গা মোড়ামুড়ি করতে লাগলেন, এদিক ওদিক তাকালেন সভয়ে, তারপর তড়িঘড়ি চলে গেলেন নিজের কাজে।

এক সময় একটা ঘরের দরজা খুলে দিল চাকরটা। দেখলাম আমার বন্ধু চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমাকে দেখে হাসি ফুটল তার মুখে, উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল।

রডরিক আশারের ঘরটা বেশ বড়। উঁচু ছাদ, জানালাগুলো লম্বা এবং সরু, এত উঁচুতে যে মই বেয়ে ওগুলো খুলতে এবং বন্ধ করতে হয়। দেয়ালে কালো পর্দা ঝোলানো। আসবাবগুলো পুরানো আমলের। ভাঙাচোরা, বিদঘুটে। প্রচুর বই আর বাদ্য বাজনার কয়েকটা সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা ঘরে। পুরো পরিবেশটাই আমার কাছে বিষণ্ণ আর নিষ্প্রাণ মনে হলো।

মানুষের জীবনে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বহু পরিবর্তন দেখেছি আমি। কিন্তু তাদের কারও সাথে রডরিক আশারের তুলনা হতে পারে না। ও বরাবরই রোগা-পাতলা ছিল, মুখটা ছিল সরু, ম্লান আর চোখ দুটো বড় বড়। কিন্তু এত দিন পর ওর চেহারা দেখে রীতিমত চমকে উঠলাম আমি। ভূতের মত লাগছে আশারকে, চোখ দুটো ভয়ঙ্কর উজ্জ্বল। চুল কাটে না কদ্দিন কে জানে। মাথায় চিরুনিও বোধহয় পড়ে না বহুদিন। মুখটাকে প্রায় ঢেকে আছে কোঁকড়া চুলের ঢেউ, চেহারাটা আরও শুকনো দেখাচ্ছে।

সৌজন্য বিনিময়ের পর রডরিক তার অসুখ সম্পর্কে বলতে লাগল। বলল, অসুখটা অদ্ভুত এবং বিচিত্র। তার বংশের মানুষ এর আগেও এই অসুখে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু কেউ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। ওর মতে এটা বংশগত একটা অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে রেহাই পাবার কোন উপায় নেই। ওর অবস্থা এমন হয়েছে যে খুব নরম এবং পাতলা কাপড় ছাড়া পরতে পারে না, বিস্বাদ খাবারগুলো খেতে ভাল লাগে, ক্ষীণ আলোও সহ্য হয় না চোখে। ফুলের গন্ধ নাকে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে আশারের, কিছু বিশেষ বাদ্যযন্ত্রের বাজনা ছাড়া অন্য যে কোন শব্দ ওকে আতঙ্কিত করে তোলে।

এক অদ্ভুত আতঙ্ক পেয়ে বসেছে রডরিক আশারকে। ‘সামনের দিনগুলোর কথা ভাবলেই আমার ভয় করে,’ বলল সে। মনে হয় ভয়ঙ্কর কোন ঘটনায় প্রাণ হারাব।’

রডরিকের সাথে কথা বলে বুঝলাম এই বিশাল প্রাসাদ সম্পর্কে প্রচুর কুসংস্কারে ওর অন্তর পূর্ণ। মনে হয় ঘরের দেয়াল, আসবাবপত্র, জলাভূমি পর্যন্ত ওকে থাবা মেরে ধরতে আসছে। ব্যাখ্যা করতে পারল না রডরিক, শুধু বলল, অজানা এক কারণে বহুদিন ঘরের বার হয় না সে।

খানিক ইতস্তত করে রডরিক এক সময় বলল ওর এই ভয়, ভীতি এবং আশঙ্কার পিছনে অনেকাংশে ভূমিকা রাখছে ওর বোন ম্যাডেলিনের দুরারোগ্য এক এক ব্যাধি। এই দুনিয়ায় রক্তের বন্ধন বলতে ম্যাডেলিন ছাড়া কেউ নেই রডরিকের। ‘ও মারা গেলে’ করুণ গলায় বলল আশার। ‘আশার বংশের দীপ জ্বালাতে আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।’

রডরিক কথা বলছে, এই সময় দূর প্রান্তের একটা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল ম্যাডেলিন, আশারের দিকে তাকাল না পর্যন্ত, বেরিয়ে গেল আরেক দরজা দিয়ে। আমি ওর দিকে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলাম। সেই সাথে কেন জানি ভয় ভয় করতে লাগল। ম্যাডেলিন চলে যেতে রডরিকের দিকে ফিরলাম আমি। দু’হাতে মুখ ঢেকে আছে সে, কংকালসার আঙুলের ফাঁক দিয়ে নামছে অশ্রুধারা।

ম্যাডেলিনের অসুখ ডাক্তাররাও ধরতে পারছেন না, বলল রডরিক। কোন কিছুর প্রতি আগ্রহ নেই ম্যাডেলিনের। ধীরে ধীরে একটা ছায়াতে যেন পরিণত হচ্ছে সে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীরবে বসে থাকে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকে ম্যাডেলিন। এক চুল নড়ে না।

ওই দিন সন্ধ্যায় রডরিক আমাকে জানাল ম্যাডেলিন বিছানা নিয়েছে। জানতাম না কয়েক ঘণ্টা আগে জীবিত অবস্থায় আমি তাকে শেষবারের মত দেখেছি।

তারপর আর নিজের বোন সম্পর্কে একটা কথাও বলল না রডরিক। পরের কয়েকটা দিন ওর বিষণ্ণতা দূর করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা চালালাম। এক সাথে বই পড়লাম, গিটারে সুর তুলল ও। আসলে পাগলের মত বাজাল সে বাদ্যযন্ত্রটা, যেন ভৌতিক একটা কণ্ঠ উঠে এল তারের ফাঁক দিয়ে, প্রতিধ্বনি তুলল দেয়ালে।

রডরিকের আঁকার হাত ভাল। পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে এই গুণটাও পেয়েছে। প্রচুর ছবি আঁকল সে এই ক’দিনে। তবে একটা ছবি আমার নজর কাড়ল। ছবিটা একটা সুড়ঙ্গের, একটানা লম্বা। দেয়াল বেশ নিচু, মসৃণ এবং ধবধবে সাদা, পরিষ্কার বোঝা যায় সুড়ঙ্গটা মাটির অনেক নিচে। বেরোবার কোন পথ নেই, নেই কোন মশাল। অথচ আলোকিত হয়ে আছে ওটা। যেন লুকানো সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার।

আশারের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করে কেটে যেতে লাগল দিন। একদিন আশার বলল ওর মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। আইডিয়াটা কি জানতে চাইলাম আমি। আশার বলল ওর ধারণা ইট পাথরেরও প্রাণ আছে। আর মানুষের মতই উদ্ভিদ এবং ইট পাথর বেঁচে থাকে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে। বুঝলাম অসুস্থ মস্তিষ্ক আবার প্রলাপ বকা শুরু করেছে। কা

‘এর প্রমাণও আমি তোমাকে দেখাতে পারব, বন্ধু’ বলে চলল সে। ‘তুমি তো আমাদের জলাটা দেখেছ। গোটা বাড়িটাকে বেড় দিয়ে রেখেছে ওটা। জলা থেকে এক খণ্ড মেঘ ভেসে উঠে ঘিরে রাখে বাড়িটাকে। দেয়ালগুলোর ওপর চাপও সৃষ্টি করে।’

আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম ওর দিকে। মনে পড়ল আশারদের বাড়িটা দেখার পরে ঠিক একই রকম অনুভূতি আমারও হয়েছিল।

বিআর জলা থেকে ভেসে আসা বাতাসটা আমার দম বন্ধ করে দিতে চায়। ওটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এভাবে হয়তো আমরা একদিন শেষ হয়ে যাব।’

রডরিকের কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে ভয় লাগল আমার। বিষয়টা বদলে বইয়ের মধ্যে একটু পরে ওকে ডুবে যেতে দেখে স্বস্তি পেলাম যাহোক।

এভাবে চলে যাচ্ছিল দিন। একদিন সন্ধ্যায় রডরিক ম্লান মুখে জানাল মারা গেছে তার বোন ম্যাডেলিন।

রডরিক, কথাটা শুনে সত্যি আমার খুব খারাপ লাগছে, বলতে গেলাম আমি। কিন্তু রডরিক মাঝ পথে থামিয়ে দিল আমাকে। যেন আমার সান্ত্বনা বাক্য শোনেইনি।

‘আমি ঠিক করেছি’ বলল সে–‘কবর দেয়ার আগে সপ্তাহ দুই ম্যাডেলিনের লাশ লুকিয়ে রাখব। ডাক্তাররা তার অদ্ভুত অসুখের ব্যাপারে এখনও যথেষ্ট কৌতূহলী। ওরা ম্যাডেলিনকে আরও পরীক্ষা করে দেখতে চায়। আমি যদি এখন ওকে কবর দেই তাহলে হয়তো কবর খুঁড়েই ওরা ম্যাডেলিনের লাশ পরীক্ষা করে দেখতে চাইবে। কিন্তু আমরা কয়েকটা দিন দেরি করলে ওরা জানতেও পারবে না কোথায় ম্যাডেলিনকে কবর দিয়েছি।’

‘ওকে কোথায় লুকিয়ে রাখতে চাও, রডরিক?’ জানতে চাইলাম আমি।

‘আমাদের পারিবারিক গোরস্থান এখান থেকে বেশ দূরে। কিন্তু এই বাড়িতে প্রচুর গোপন ঘর আছে যেখানে…।’ কথাটা শেষ করার আগেই সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ল। সিদ্ধান্তটা অস্বাভাবিক, ভাবলাম আমি। কিন্তু ডাক্তারের শয়তানী চাহনির কথা মনে পড়ে গেল আমার। মৃত ম্যাডেলিনের লাশ নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করবে ওই ব্যাটা ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তারচেয়ে রডরিক ওকে লুকিয়ে রাখবে তাও ভাল।

কফিনে শোয়ানো ম্যাডেলিনের লাশ আমি আর রডরিক একটা ভূগর্ভস্থ কক্ষে নিয়ে গেলাম। ঘরটাকে একটা ভল্ট বলাও চলে, বাড়ির ফাউন্ডেশন দেয়ালের সাথে। ঘরটা ছোট, স্যাঁতসেঁতে, আলো-টালো নেই। আমি যে ঘরে শুই সেটার ঠিক নিচে এই ঘরটা।

বহু আগে এই ঘরটা কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা হত। তারপর এটার রূপান্তর ঘটে গোলাবারুদের স্টোর রূম হিসেবে। ঘরটার দেয়াল, মেঝে, ভারি লোহার দরজাটা পর্যন্ত তামা দিয়ে মোড়ানো। ড্যাম্পের হাত থেকে রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা। লক্ষ করলাম খোলার সময় তীক্ষ্ণ, খরখর আওয়াজ করল দরজাটা

ভল্টের ভিতরে, কাঠের কতগুলো স্ট্যান্ডের ওপর কফিনটা রাখলাম দু’জনে। কফিনের ঢাকনা খুলে শেষবারের মত তাকালাম মৃত ম্যাডেলিন আশারের মুখের দিকে।

এই প্রথমবারের মত ভাই আর বোনের মধ্যে চেহারায় গভীর একটা মিল নজর কাড়ল আমার। আমার মনোভাব বুঝতে পেরেই বোধ হয় বিড়বিড় করে রডরিক বলল ওরা যমজ ছিল। জানাল দু’জনের মধ্যে কিছু অদ্ভুত ব্যাপারে বোঝাপড়া ছিল যা সচরাচর ভাই-বোনদের মাঝে দেখা যায় না।

ম্যাডেলিনের মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা গেল না। ওর মুখটা লালচে হয়ে আছে, অদ্ভুত এক টুকরো হাসি ঠোঁটে। গা শিরশির করে উঠল হাসিটা দেখে। ঢাকনা নামিয়ে দিলাম। বন্ধ করলাম কফিন। তারপর চলে এলাম বাইরে।

দিন যত যাচ্ছে রডরিকের আচার-আচরণ ততই পাল্টে যেতে লাগল। সে এখন আর গিটার বাজায় না, তুলি ছুঁয়েও দেখে না। এমনকি বই নিয়ে বসে না পর্যন্ত। সারাক্ষণ দেখি এঘর ওঘর করছে, চেহারায় উদ্ভ্রান্ত ভাব। ঝকঝকে চোখের ঔজ্জ্বল্য নিষ্প্রভ হয়ে এল ক্রমশ, বিমর্ষ মুখটা ভীতিকর হয়ে উঠল।

ও আমার সাথে যখন কথা বলে মনে হয় অজানা কোন ভয়ে কাঁপতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় রডরিক যেন একটা গোপন কথা বলার চেষ্টা করছে আমাকে। কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওকে শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে হয় পাগল হয়ে গেছে রডরিক। কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করে সে কখনও কখনও।

রডরিকের এরকম অবস্থা দেখে আমি ভীত হয়ে উঠলাম। ওর ভয় গ্রাস করল আমাকেও। মনে হলো আতঙ্কের অক্টোপাস যেন শুঁড় নেড়ে ধরতে আসছে আমাকে। আতঙ্কটা ধীরে ধীরে আমাকে পেয়ে বসল। তারপর ম্যাডেলিনকে কবর দেয়ার এক সপ্তাহ পরে ঘটল সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা যার কথা জীবনেও ভুলব না।

সেদিন বাইরে প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছিল। ঘুম আসছিল না। অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে ছিলাম। খুব নার্ভাস বোধ করছিলাম। চেষ্টা করছিলাম অস্বস্তিকর অনুভূতিগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে। বারবার মনে হচ্ছিল আমার ঘরের আসবাবপত্র আর দেয়ালের ছবিগুলো যেন জ্যান্ত হয়ে উঠছে। মনকে প্রবোধ দিলাম ভয় পেয়েছি বলে এরকম ভাবছি আমি। আসলে সবই ভুয়া।

কিন্তু ভয় ভয় ভাবটা গেল না কিছুতেই। আরও যেন চেপে বসল মনের গভীরে। বিছানায় উঠে বসলাম, একটা শব্দ কানে এসেছে। ঝড়ো বাতাসের গোঙানি ছাপিয়েও ওই শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি। নিচু, অস্পষ্ট একটা আওয়াজ। একটু পর মিলিয়ে গেল ওটা, আবার শুরু হলো। গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল অজানা ভয়ে।

এভাবে ঘুমের চেষ্টা বৃথা। তাই উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে, জামাকাপড় পরতে শুরু করলাম। হঠাৎ মেঝেতে কার যেন পায়ের শব্দ! বারান্দা ধরে হাঁটছে। এই ঝড়ের রাতে কে এল?

দড়াম করে খুলে গেল দরজা। ঝড়ের গতিতে ভেতরে ঢুকল রডরিক আশার। বিস্ফারিত চোখ, হাঁ হয়ে আছে মুখ। কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল রডরিক, যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে। তারপর হঠাৎ কথা বলতে শুরু করল।

‘তুমি দেখোনি ওটা?’ জিজ্ঞেস করল সে, ‘না দেখলে এখুনি দেখতে পাবে!’ বলে ক্ষিপ্র পায়ে রডরিক এগোল জানালার দিকে, ঝট করে খুলে ফেলল কবাট।

বাতাসের তীব্র একটা ঝাপটা ঢুকল ভেতরে, আমাদের প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল। বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আমি। অদ্ভুত সুন্দর একটা রাত। বাড়িটার ছাদের ওপর যেন ঝুলে আছে ঘন মেঘের সারি। বাতাস শোঁ শোঁ গর্জন শুরু করেছে। মেঘগুলো সার বেঁধে উড়ছে, হঠাৎ দলছুট হয়ে গেল। উড়ন্ত মেঘের নিচের অংশ আর গাছের গুঁড়িগুলোকে যেন ঘিরে আছে অস্বাভাবিক একটা আলোর ছুটা। আকাশে চাঁদ নেই: তারাও জ্বলছে; ঝলসে উঠছে না সাপের জিভের মত বিদ্যুৎ। তাহলে ওই অদ্ভুত আলোটা এল কোত্থেকে? মনে হলো পুরনো প্রাসাদটাকে যেন বৃত্ত করে ঘিরে রেখেছে ওটা।

‘না, ঝড় দেখতে হবে না তোমাকে,’ গলার স্বর কেঁপে উঠল আমার কথা বলার সময়। আশারকে জোর করে জানালার কাছ থেকে ঠেলে আনলাম, বসিয়ে দিলাম একটা চেয়ারে। ‘তুমি যা দেখে অবাক হয়েছ’, বললাম আমি। তার মধ্যে অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নেই। ঝড়ের সময় এরকম আলো প্রায়ই দেখা যায়। হতে পারে দীঘির বুকে যে বাষ্প জমেছে তার থেকে এই আলোর সৃষ্টি। যা-হোক, আমি এখুনি জানালাটা বন্ধ করে দিচ্ছি। ঠাণ্ডা বাতাসে তোমার ক্ষতি হতে পারে।’

জানালা বন্ধ করে দিলাম আমি। রডরিক কোন প্রতিবাদ করল না। হাতের কাছে টেবিলের ওপর যে বইটা পেলাম তুলে নিলাম। বললাম, ‘এসো, বই পড়ে আজকের ঝড়ের রাতটা কাটিয়ে দেই।’

গল্পটা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। গল্পের নায়ক ইথেলরেড, এক শয়তান সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে অভিযানে বেরিয়েছে। আমি পড়তে লাগলাম। সন্ন্যাসীর বাড়ির দরজার সামনে এসে ইথেলরেড হাতের তরবারি দিয়ে কাঠের তক্তার ওপর প্রচণ্ড জোরে কয়েকটা বাড়ি মারল। দরজা ভেঙে টুকরো হয়ে গেল।

বাক্যটা মাত্র পড়া শেষ করেছি, দারুণ চমকে উঠলাম আমি। মনে হলো (নাকি স্রেফ আমার কল্পনা?) বাড়ির কোন চোরা কুঠুরি থেকে ঠিক একই রকম শব্দ ভেসে এল যার বর্ণনা একটু আগে আমি দিয়েছি। তক্তা ভাঙার শব্দ!

ঝড়ের মধ্যে কত কি শব্দ হতে পারে, ব্যাপারটাকে আমল দিতে চাইলাম না। মনোনিবেশ করলাম পড়ায়-’ঘরে ঢুকে সন্ন্যাসীর কোন চিহ্নও দেখল না ইথেলরেড। তার বদলে ওর নজর আটকে গেল একটি ড্রাগনের দিকে। ড্রাগনটার মুখ দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে, রুপোর মেঝে আর সোনার তৈরি একটা প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছে ওটা। ইথেলরেড তরবারির এক কোপে ধড় থেকে মুণ্ডু নামিয়ে ফেলল ড্রাগনটার। সাথে সাথে বীভৎস এবং ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার দিল ওটা…।’

এই লাইনটা পড়া মাত্র আমার কানে দূরাগত ক্ষীণ একটা চিৎকার ভেসে এল। মনে হলো গল্পের ড্রাগনের মতই গগনবিদারী আর্তনাদ করে উঠেছে কেউ অনেক দূর থেকে। এই অপার্থিব আর্তনাদ আমার কানের ভ্রম নয়, নয় কল্পনাও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমি। ভয়ের শীতল একটা স্রোত যেন জমিয়ে দিল আমাকে। সত্যি সত্যি এবার চিৎকারটা শুনতে পেয়েছি। কিন্তু নিজের মনের অবস্থা টের পেতে দিলাম না রডরিককে। তাহলে উত্তেজিত হয়ে ও হয়তো কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। হয়তো চিৎকারটা ও শুনতেই পায়নি। নাকি এবারও আমি ভুল শুনেছি?

তবে রডরিকের মধ্যে হঠাৎ একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। এতক্ষণ দু’জনে মুখোমুখি বসেছিলাম, এবার রডরিক চেয়ার ঘুরিয়ে দরজার দিকে মুখ করে বসল। ওর ঠোঁট কাঁপতে লাগল; মাথাটা নিচু হতে হতে বুকে গিয়ে ঠেকল; চোখজোড়া বিস্ফারিত। এই অবস্থায় সে এদিক ওদিক দুলতে শুরু করল।

রডরিক কিছু শুনেছে কিনা জানি না কিন্তু ওর মনোযোগ এদিকে আকর্ষণ করার জন্য আমি একটু ইতস্তত করে আবার পড়া শুরু করলাম।

‘এবার ইথেলরেড ড্রাগনের লাশটা ঠেলে সরিয়ে সাহসের সাথে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেল, ওর পায়ের শব্দ উঠল রূপালি মেঝেতে।’

‘প্রাসাদের দরজায় একটা সুদৃশ্য, ঝকমকে ঢাল ঝুলছিল-ড্রাগনকে যে হত্যা করতে পারবে তার জন্য পুরস্কার। ইথেলরেড ঢালের দিকে এগোতেই ওটা খসে পড়ল পায়ের কাছে, মেঝের ওপর। বিরাট এবং ভয়ঙ্কর ঝনঝন শব্দ ছড়াল চারদিকে।’

বাক্যটা শেষ করতেও পারিনি, লাফিয়ে উঠলাম আরেকটা শব্দে। দূর থেকে ভারী, ধাতব শব্দটা ভেসে এসেছে। রডরিকের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর কোন ভাবান্তর নেই। আগের মতই চেয়ারে দোল খাচ্ছে সে, চোখ দুটো ভাষাহীন।

ওর দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, কাঁধ চেপে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। গায়ে হাত রাখতেই সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল রডরিকের। কথা বলতে শুরু করল সে। নিচু গলায় বিড়বিড় করছে, আমি যে আছি তাও লক্ষ করল না।

‘শোনোনি তুমি? কিন্তু আমি শুনেছি!’ কাঁপা গলায় বলল সে। ‘বহু মিনিট, বহু ঘণ্টা আর বহুদিন ধরে আমি ওটা শুনে চলেছি। তবু সাহস পাইনি-ওহ্, বলতে সাহস করিনি আমরা ওকে জ্যান্ত কবর দিয়েছি! হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। ওকে আমরা জ্যান্ত কফিনে পুরেছি। কিন্তু কথাটা বলার সাহস পাইনি-কিছুতেই পাইনি। আর এখন আজ রাতে ইথেলরেড হা!, হা!। সন্ন্যাসীর দরজা ভাঙল-মৃত্যু চিৎকার দিয়ে উঠল ড্রাগন। ঝন ঝন শব্দে পড়ে গেল ঢাল-বরং বলো কফিনের ডালা ভেঙে আর্তনাদ করে উঠল ম্যাডেলিন। তারপর তামায় মোড়া সরু বারান্দায় ছুটোছুটি শুরু করল ঝনঝন শব্দে। ওহ্! এখন আমি কোথায় পালাব? ও এক্ষুণি এসে হাজির হবে এখানে! মৃত্যুর আগেই জ্যান্ত কবর দিয়েছি বলে আমাকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দেবে। ওই যে, শুনতে পাচ্ছ না সিঁড়িতে ওর পায়ের আওয়াজ। শুনছ না ওর হৃৎপিণ্ডের প্রচণ্ড শব্দ!’

বলে বিরাট এক লাফ মারল রডরিক।

‘পাগল!’ গলা চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার। ‘পাগল! ওই দেখো ও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।’

রডরিকের কথা শেষ হবার সাথে সাথে খুলে গেল দরজা। বাতাসের আবার একটা ঝাপটা এল ভিতরে। আর আমি দেখলাম…দেখলাম চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা লেডি ম্যাডেলিন। ওর কাপড়ে রক্তের ছোপ স্পষ্ট, যেন প্রচণ্ড যুদ্ধ করে এসেছে।

এক মুহূর্ত ম্যাডেলিন দাঁড়িয়ে থাকল দোর গোড়ায়। তারপর অমানুষিক একটা চিৎকার করে যেন উড়ে এল, ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ভাইয়ের ওপর। গা হিম করা আরেকটা চিৎকার শুনলাম আমি। রডরিকের মৃত্যু চিৎকার। প্রতি মুহূর্তে যে আতঙ্কের অপেক্ষায় ছিল, সেই আতঙ্কের শিকার হয়ে ওকে নৃশংসভাবে মরতে হলো।

আর দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন মনে করলাম না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলাম প্রাসাদ ছেড়ে।

হঠাৎ তীব্র আলোর একটা ঝলক দেখলাম। পিছন ফিরে তাকালাম। এদিকে শুধু আশারদের বাড়িটা বিরাট ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে।

এই সময় বুঝতে পারলাম আলোর উৎস কোথায়। রক্তলাল একখানা চাঁদ উঠেছে আকাশে, আলোর ঝলকটা এসেছে ওখান থেকেই। প্রাসাদের বিরাট ফাটলটা আলোকিত হয়ে উঠেছে ঝলকানিতে।

ওদিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ দেখি ফাটলটা ক্রমে চওড়া হতে শুরু করেছে। এমনসময় দমকা একটা বাতাস ছুটে এল, সশব্দে আছড়ে পড়ল বাড়িটার ওপরে।

হাঁ করে দেখলাম বাতাসের আঘাতে বিশাল খিলান আর দেয়ালগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গোটা প্রাসাদ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। আর ঠিক তখন কানে ভেসে এল উন্মত্ত জলরাশির গর্জন। জলার পানি যেন সাগরের ঢেউ হয়ে উঠে এল ওপরে, বানের জলের মত ভাসিয়ে নিয়ে গেল আশারদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। আর হাঁটু পানিতে আতঙ্কিত এবং হতবুদ্ধি আমি স্থির দাঁড়িয়ে দেখলাম ভয়াল এই রাতের সর্বশেষ ধ্বংসযজ্ঞ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভয়াল রাত

ভয়াল রাত

ভয়াল রাত

অনেক অনেক দিন আগে জাপানের ছোটো একটি গাঁয়ে বাস করত এক গরিব চাষি ও তার বউ। তারা দুজনই ছিল বেজায় ভালোমানুষ। তাদের অনেকগুলো বাচ্চা। ফলে এতগুলো মানুষের ভরণপোষণ করতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যেত চাষার। বড় ছেলেটির বয়স যখন চোদ্দ, গায়ে-গতরে বেশ বলিষ্ঠ, সে বাবাকে কৃষি কাজে সাহায্য করতে নেমে পড়ল। আর ছোটো মেয়েগুলো হাঁটতে শেখার পরপরই মাকে ঘরকন্নার কাজে সহযোগিতা করতে লাগল।

তবে চাষী-দম্পতির সবচেয়ে ছোটো ছেলেটি কোনও শক্ত কাজ করতে পারত না। তার মাথায় ছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি–সে তার সবগুলো ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে চালাক ছিল। কিন্তু খুব দুর্বল শরীর এবং দেখতে নিতান্তই ছোটোখাটো ছিল বলে লোকে বলত ওকে দিয়ে কোনও কাজ হবে না। কোনও কাজেই লাগবে না সে। বাবা-মা ভাবল কৃষিকাজের মতো কাজ করা যেহেতু ছোটো ছেলের পক্ষে সম্ভব নয় কাজেই ওকে পুরোহিতের কাজে লাগিয়ে দেয়া যাক। বাবা-মা একদিন ছোটো ছেলেকে নিয়ে গায়ের মন্দিরে চলে এল। বুড়ো পুরোহিতকে অনুনয় করল, তিনি যেন তাদের ছেলেটিকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ওকে পড়ালেখা শেখান। যাতে বড়ো হয়ে সে মন্দিরে যজমানি (পুরোহিতগিরি) করতে পারে।

বৃদ্ধ ছোটো ছেলেটির সঙ্গে সদয় আচরণ করলেন। তাকে কিছু কঠিন প্রশ্ন করা হলো। ছেলেটি এমন চতুর জবাব দিল যে তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে কোনওই আপত্তি করলেন না ধর্মগুরু। তিনি ওকে মন্দিরের টোলে ভর্তি করে দিলেন। ওখানে ধর্ম শিক্ষা দেয়া হতো।

বৃদ্ধ পুরোহিত ছেলেটিকে যা শেখালেন, সবকিছু দ্রুত শিখে নিল সে। সে গুরুর অত্যন্ত বাধ্যগত ছাত্র। তবে তার একটা দোষ ছিল। সে পড়ার সময় ছবি আঁকত। এবং তার ছবির বিষয়বস্তু ছিল বেড়াল। ওই সময় মন্দিরে বেড়ালের ছবি আঁকার ব্যাপারে নিষেধ ছিল।

একা যখন থাকত ছেলেটি, তখনই এঁকে ফেলত বেড়ালের ছবি। সে ধর্মগুরুর ধর্মীয় বইয়ের মার্জিনে ছবি আঁকত, মন্দিরের সমস্ত পর্দা, দেয়াল এবং পিলারগুলো ভরে গিয়েছিল বেড়ালের ছবিতে। পুরোহিত বহুবার তাকে এসব ছবি আঁকতে মানা করেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ছেলেটি ছবি আঁকত কারণ না এঁকে পারত না। ছবি না আঁকলে কেমন অস্থির লাগত তার। সে ছিল অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন চিত্রকর। ছবি এঁকেই একদিন নাম কামানোর স্বপ্ন দেখত ছেলেটি। এ জন্য ধর্ম শিক্ষায় মন দিতে পারত না। ভালো ছাত্র হওয়ার খায়েশও তার ছিল না। ভালো ছাত্র হতে হলে বই পড়তে হয়। কিন্তু পড়ার চেয়ে আঁকাআঁকিই তাকে টানত বেশি।

একদিন এক দেবতার পোশাকে বেড়ালের ছবি আঁকতে গিয়ে ধর্মগুরুর কাছে হাতেনাতে ধরা খেল ছেলেটি। বুড়ো খুবই রেগে গেলেন। বললেন, তুমি এখনই এখান থেকে চলে যাও। তুমি কোনোদিনও পুরোহিত হতে পারবে না। তবে চেষ্টা করলে একদিন হয়তো বড়ো মাপের চিত্রকর হতে পারবে। তোমাকে শেষ একটি উপদেশ দিই শোনো। উপদেশটি কখনও ভুলো না। রাতের বেলা বড়ো জায়গা এড়িয়ে চলবে; ঘুমাবে ছোটো জায়গায়!

গুরুর এ কথার মানে কিছুই বুঝতে পারল না ছেলেটি। এ কথার মানে ভাবতে ভাবতে সে তার ছোটো বোঁচকা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মন্দির থেকে। গুরুকে তাঁর কথার অর্থ জিজ্ঞেস করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু ধমক খাওয়ার ভয়ে প্রশ্ন করল না। শুধু বিদায় বলতে পারল।

মনে দুঃখ নিয়ে মন্দির ছেড়েছে ছেলেটি। কোথায় যাবে, কী করবে বুঝতে পারছে না। যদি বাড়ি যায়, পুরোহিতের কথা না শোনার অভিযোগে বাবা ওকে বেদম পিটুনি দেবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাই বাড়ি যাওয়ার চিন্তা নাকচ করে দিল সে। হঠাৎ বাড়ির পাশের গায়ের কথা মনে পড়ল। এখান থেকে চার ক্রোশ দূরে। ওই গাঁয়ে বিশাল একটি মন্দির আছে। মন্দিরে তরুণ-বুড়ো অনেক পুরোহিত আছেন। ছেলেটি শুনেছে ওখানেও একটি টোল আছে। সেখানে ধর্ম শিক্ষা দেয়া হয়। সে ঠিক করল ওই গাঁয়ে যাবে। মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের হাতে-পায়ে ধরে বসবে তাকে টোলে ভর্তি করানোর জন্য। ওর কাতর অনুরোধ নিশ্চয় ফেলতে পারবেন না ঠাকুর মশাই।

কিন্তু ছেলেটি জানত না বড়ো মন্দিরটি বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ওখানে একটা পিশাচ এসে আস্তানা গেড়েছে। পিশাচের ভয়ে পুরোহিতরা অনেক আগেই মন্দির ছেড়ে পালিয়েছেন। গাঁয়ের কজন সাহসী মানুষ পিশাচটাকে মারতে গিয়েছিল। তারা এক রাতে ছিল ওই মন্দিরে। কিন্তু পরদিন কাউকে জীবিত পাওয়া যায়নি। তাদের রক্তাক্ত, খাবলানো শরীর পড়ে ছিল মন্দিরের চাতালে। তারপর থেকে ভুলেও কেউ ওই মন্দিরের ছায়া মাড়ায় ্না। পরিত্যক্ত মন্দিরটি এখন হানাবাড়িতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসব কথা তো আর ছেলেটি জানত না। সে মন্দিরের টোলে ভর্তি হওয়ার আশায় পথ চলতে লাগল।

চার ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে গায়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা নেমে এল। গ্রামের মানুষ এমনিতেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, মন্দিরে পিশাচের হামলা হওয়ার পর থেকে তারা সূর্য পশ্চিমে ডুব না দিতেই ঘরের দরজা এঁটে, বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। আর মন্দির থেকে ভেসে আসা বিকট, বীভৎস সব চিৎকার শুনে শিউরে শিউরে ওঠে।

মন্দিরটি গাঁয়ের শেষ প্রান্তে, একটি টিলার ওপরে। ছেলেটি মন্দিরে আলো জ্বলতে দেখল। ভূতুড়ে মন্দিরে কেউ পুজো দিতেই যায় না, আলো জ্বালা দূরে থাক। তবে লোকে বলে পিশাচটা নাকি সাঁঝবেলা আলো জ্বেলে রাখে পথ ভোলা পথচারীদের আকৃষ্ট করার জন্য। আলোর হাতছানিতে দূর গাঁ থেকে আসা মুসাফির আশ্রয়ের খোঁজে মন্দিরে ঢুকলেই পিশাচের শিকার হয়।

ছেলেটি মন্দিরের বিশাল, কারুকাজ করা পুরু কাঠের দরজার সামনে দাঁড়াল। আঙুলের গাঁট দিয়ে টুক টুক শব্দ করল। কেউ সাড়া দিল না। আবার নক্ করল সে। জবাব নেই। মন্দিরের সবাই এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল নাকি! অবাক হয় ছেলেটি। একটু ইতস্তত করে দরজায় ধাক্কা দিল সে। ক্যাআআচ শব্দে মেলে গেল কপাট। ভেতরে ঢুকল ছেলেটি। মাটির একটি প্রদীপ জ্বলছে কেবল। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

ছেলেটি ভাবল কেউ না কেউ নিশ্চয় আসবে। সে মেঝেতে বসে পড়ল। অপেক্ষা করছে। ছেলেটি লক্ষ করল মন্দিরের সব কিছুই ধুলোয় ধূসর হয়ে আছে। মাকড়সার জালে ছেয়ে গেছে প্রায় পুরোটা জায়গা। বোঝাই যায় অনেক দিন ঝাঁটা পড়েনি। হয়তো ঝাঁটা দেয়ার লোক নেই। ছেলেটি মনে মনে আশান্বিত হয়ে উঠল তাকে ঠাকুর মশাই শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন ভেবে। কারণ ঘর ঝাঁট দেয়ার জন্য হলেও তো ওদের একজন লোক লাগবে।

জানালায় বড়ো বড়ো পর্দা ঝুলতে দেখে খুশি হয়ে গেল ছেলেটি। বাহ, ছবি আঁকার চমৎকার ক্যানভাস পাওয়া গেছে। রঙ পেন্সিলের বাক্স সে সঙ্গেই নিয়ে এসেছে। দ্বিরুক্তি না করে বেড়ালের ছবি আঁকতে বসে গেল।

পর্দাগুলো ভরে ফেলল সে বড়ো বড়ো বেড়ালের ছবিতে। পথ চলার ক্লান্তিতে তার ঘুম এসে গেল। সে পুঁটুলি খুলে চাদর বিছিয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়ার তোড়জোর করছিল, এমন সময় মনে পড়ে গেল ধর্মগুরুর কথা–রাতের বেলা বড়ো জায়গা এড়িয়ে চলবে; ঘুমাবে ছোটো জায়গায়!

মন্দিরটি প্রকান্ড; আর সে একা। গুরুর কথাগুলো মনে পড়তে, অর্থ না। বুঝলেও, এবার তার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। সে ঘুমাবার জন্য ছোটো ঘর খুঁজতে লাগল। ক্ষুদ্র একটি কুঠুরিও পেয়ে গেল। কুঠুরির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। তারপর ছিটকিনি লাগিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। একটু পরেই ঘুমিয়ে গেল।

গভীর রাতে ভয়ঙ্কর একটা শব্দে জেগে গেল সে। মারামারি করছে কারা যেন। ফ্যাঁচফ্যাঁচ, অপার্থিব আওয়াজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জান্তব চিৎকার। এমন ভয় পেল ছেলেটি, দরজার ফাঁক দিয়েও মন্দিরের ভেতরে তাকাতে সাহস পেল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল তাকালেই এমন ভয়াবহ কিছু একটা সে দেখবে যে হার্টফেল হয়ে যাবে। সে মেঝেতে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।

আলোর যে সূক্ষ্ম রেখা ঢুকছিল দরজার ছিলকা দিয়ে তা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। ছেলেটি বুঝতে পারল নিভে গেছে মন্দিরের বাতি। নিকষ আঁধারে ডুবে গেল ঘর। তবে ভীতিকর শব্দগুলো চলল বিরতিহীন। ফোঁস ফোঁস নিশ্বাসের আওয়াজ, রক্ত হিম করা গলায় কে যেন আর্তনাদ করে উঠছে মাঝে মঝে। গোটা মন্দির থরথর করে কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে দরজার বাইরে মরণপণ লড়াইয়ে মেতে উঠেছে দুটি পক্ষ। অনেকক্ষণ পরে নেমে এল নীরবতা। কিন্তু ছেলেটি ভয়ে নড়ল না এক চুল। অবশেষে ভোর হলো। সোনালি আলো দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ল ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে।

লুকানো জায়গা থেকে খুব সাবধানে বেরিয়ে এল ছেলেটি। তাকাল চারদিকে। দেখল মন্দিরের মেঝেতে রক্ত আর রক্ত! রক্তের পুকুরের মাঝখানে মরে পড়ে আছে গরুর চেয়েও আকারে বড়ো একটি দৈত্যকার ইঁদুর। মন্দিরের পিশাচ!

কিন্তু এটাকে হত্যা করল কে? মানুষজন কিংবা অন্য কোনও প্রাণী দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ ছেলেটি লক্ষ করল সে গতরাতে পর্দায় যে সব বেড়ালের ছবি এঁকেছে, সবগুলো বেড়ালের গায়ে রক্ত মাখা! সে তক্ষুনি বুঝতে পারল পিশাচ ইঁদুরটাকে তারই আঁকা বেড়ালরা হত্যা করেছে। এবং এখন সে বুঝতে পারল বৃদ্ধ পুরোহিতের সেই সাবধান বাণীর মানে-রাতের বেলা বড়ো জায়গা এড়িয়ে চলবে; ঘুমাবে ছোটো জায়গায়।

ওই ছেলেটি বড় হয়ে খুব বিখ্যাত চিত্রকর হয়েছিল। আর তার আঁকা বেড়ালের সেই ছবিগুলো এখনও ওই মন্দিরে আছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *