প্রেতশক্তি
এক
গত ১৪ এপ্রিল একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের জীবনে। আমরা মানে আমি, জাহিদ, সুবর্ণা, প্রদীপ্ত আর রাজেশ তিওয়ারী-র জীবনে। ঘটনাটা এতই ভয়াবহ, রোমহর্ষক এবং অবিশ্বাস্য যে লিখতে গিয়ে আমার গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। জানি না যে গল্প আমি বলতে যাচ্ছি তা পাঠক কতটুকু বিশ্বাস করবেন। তবে শতকরা একশোভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি এর মধ্যে কল্পনার রেশ নেই একরত্তি। লেখকরা তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ, গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদতেও তাদের জুড়ি নেই, এমন কথা বহু শুনেছি আমি। ভাগ্যিস আমি লেখক নই। সাহিত্যের মারপ্যাচও আমার জানা নেই। শুধু যা ঘটেছে তারই একটা প্রাঞ্জল বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করব সাধ্যে যতটুকু কুলোয়। যুক্তিতর্ক বা বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন পরে।
মূল গল্প শুরুর আগে নিজেদের পরিচয় পর্বটা সেরে নিই।
আমরা চার বন্ধ। জাহিদ মোস্তফা একটা বহুজাতিক কোম্পানীর সেলস এক্সিকিউটিভ। ইডেন কলেজের ছাত্রী সুবর্ণা ওর একমাত্র বোন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া লালমাটিয়ার বিরাট এক ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক ওরা।
পুরানো ঢাকার জেলখানা রোডে দুই বিঘা জমির ওপর ভিক্টোরিয়ান কাঠামোতে তৈরি প্রদীপ্তর প্রাসাদোপম বাড়িখানাও দেখার মত। প্রদীপ্ত পেশায় শখের চিত্রকর। তার দাদু ত্রৈলোক্যনাথ রায় চৌধুরীকে বৃটিশ আমলে লর্ড কার্জন ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দিয়েছিলেন সমাজ সেবার জন্য। প্রদীপ্তর বাবা নেই। রায় বাহাদুরের অগাধ সম্পত্তি সে একাই ভোগ করছে। পরমা সুন্দরী স্ত্রী সুদীপাকে নিয়ে তার সোনার সংসার।
আর আমি আবরার আমিন একটা কলেজে পড়াই। জাহিদের অনুরোধে সুবর্ণাকে মাঝে মধ্যে ইংরেজীটা দেখিয়ে দেই। তবে লক্ষ করছি, ইদানীং সুবর্ণা পড়াশোনায় বেশ ফাঁকি দিচ্ছে। ওর জন্য হয়তো একটা নোট করছি, মাথা তুলে চাইতেই দেখি সুবর্ণা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেমন ঘোরলাগা একটা চাউনি ওর কালো চৌখে। ব্যাপারটাকে আমি বিশেষ পাত্তা দিই না। কারণ সুবর্ণাকে যে পাঁচ বছর বয়সে হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় কোলে নিয়ে আদর করেছি সেটা স্মৃতিতে এখনও বেশ নাড়া দেয়।
সর্বশেষে রাজেশ তিওয়ারী। না থাক, তিওয়ারীর কথা এখন না, পরে।
১৪ এপ্রিল যে ঘটনাটা ঘটেছে তার মুখবন্ধ হিসেবে আরও ছোটখাট দু’একটা ঘটনার সূত্রপাত বেশ কিছুদিন আগে।
উদ্ভট বুদ্ধিটা প্রথম মাথায় আসে আমার বাল্যবন্ধু জাহিদের উর্বর মস্তিষ্কে। ‘উদ্ভট’ এই কারণে এরকম ব্যাপার যে হতে পারে তা প্রথমে আমি বিশ্বাসই করতে চাইনি। ‘প্ল্যানচেট’ করে আত্মা আনার কথা গল্প-উপন্যাসে প্রচুর পড়েছি। শুনেছি রবীন্দ্রনাথও নাকি ব্যাপারটা বিশ্বাস করতেন। ব্ল্যাক আর্ট বা পিশাচ তত্ত্বের ওপর জাহিদের প্রচুর পড়াশোনা আছে। হরর গল্পের পোকা সে। হাস্যকর শোনালেও সত্যি, রাত দুটোয় স্টার মুভিজে ভয়াল ছায়াছবি দেখার পরে জাহিদ এখনও রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বাথরূমে যেতে বুক কাঁপে ওর। কি রকম ছেলেমানুষী কাণ্ড-শোয়ার আগে দাঁত মাজার সময় সে ভুলেও বেসিনের আয়নার দিকে তাকায় না। তার ধারণা তাহলেই দগদগে ঘায়ে ভরা প্রকাণ্ড এবং কুৎসিত একটা চেহারা দেখতে পাবে সে ওখানে। এসব কথা সুবর্ণা আমাকে জানিয়েছে এবং হাসতে হাসতে প্রায় দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু এই সুবর্ণাই যেদিন মুখ গম্ভীর করে আমাকে বলল, ‘জানেন, আবরার ভাই, ভাইয়া না কাল আত্মা এনেছিল বাসায়।’ আমি তখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছি ওর সিরিয়াস চেহারা দেখে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সুবর্ণার সুন্দর মুখখানার ফর্সা রঙ বদলে গিয়ে যখন লালচে হয়ে ওঠে, সে তখন বেশ মারমুখী একটা ভাব নেয় এবং তার কথাকে হাসি ঠাট্টা বলে উড়িয়ে দিতে চাইলে প্রতিপক্ষের খবর আছে। তার কথা অবিশ্বাস করার সামান্য ভাবও তখন চেহারায় ফুটতে দেয়া হারাম। ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে ধরে নিয়ে সুবর্ণা শুধু কেঁদেই ফেলবে না অবিশ্বাসীর সাথে বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ করে দেবে দিনের পর দিন। তখন তার মান ভাঙানোর চেয়ে চৈত্রের খর-দুপুরে খালি পায়ে হিমু হয়ে মিরপুর টু গুলিস্তান হেঁটে যাওয়া অনেক সোজা। হিমু হবার কোন শখ আমার নেই এই কারণে যে, সুবর্ণা পর পর দু’দিন আমার সাথে কথা না বললে অক্সিজেনের অভাবে আমি মারাই যাব। কাজেই ওকে না চটিয়ে সাবধানে জানতে চাইলাম, ‘তাই নাকি? কখন? কিভাবে আত্মা আনল, বলো তো?’
আমার কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে সুবর্ণা ঝাড়া দেড় মিনিট এক নিশ্বাসে যে কথাগুলো বলে গেল তার সারমর্ম এই: বেশ কিছুদিন ধরে জাহিদ প্ল্যানচেট নিয়ে খুব মাতামাতি করছিল। সুবর্ণাকে সে দলে ভিড়িয়ে ফেলে সহজেই। (একটা কথা বলে রাখি, সুবর্ণা জাহিদকে ভৌতিক ছবি দেখা নিয়ে যতই হাসাহাসি করুক না কেন, প্রতি রোববার ‘জি হরর শো’ দেখার পরে সে নিজে কিন্তু একা ঘরে ঘুমাতে ভয় পায়। ফ্লোরে ওদের কাজের বুয়া আমিনাকে তখন সুবর্ণার সঙ্গী হতে হয়। জাহিদ এই গোপন খবরটা আমাকে দিয়েছে। কিন্তু সুবর্ণা জানে না ব্যাপারটা আমি জানি। আমি এও জানি বড় ভাইয়ের মতই স্টিফেন কিং-এর ভৌতিক উপন্যাস পেলে একবেলা সে দিব্যি না খেয়ে থাকতে পারে। কাজেই বড় ভাইয়ের নতুন নেশা প্ল্যানচেটের প্রতি সুবর্ণার আগ্রহ যে জন্মাবে তা আর বিচিত্র কি!) তাছাড়া সুবর্ণা তুলা রাশির জাতিকা। কে না জানে তুলা রাশির জাতিকারা প্ল্যানচেটের জন্য সবচে’ ভাল মিডিয়াম হয়। মিডিয়াম ছাড়া প্ল্যানচেটে আত্মা আনা সম্ভব নয়। তো প্রথমে ভয় ভয় করলেও সুবর্ণা আবিষ্কার করে ব্যাপারটাতে যেমন রোমাঞ্চ আছে তেমনই আছে শিহরণ। ধাক্কা খেলাম ব্যাপারটার মধ্যে ওরা প্রদীপ্তকে জড়িয়ে ফেলেছে শুনে।
‘প্রদীপ্ত এসব বিশ্বাস করে?’ বিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি।
‘বিশ্বাস করেন মানে! উনি তো কাল আমাদের এখানেই ছিলেন,’ সোৎসাহে বলে চলল সুবর্ণা। ওর ফর্সা গালে গোলাপী আভা। অস্বীকার করব না দেখতে ভালই লাগছে আমার। ‘প্রদীপ্তদা ওদের বাসায় আমাদের দাওয়াত দিয়েছেন সামনের শনিবার। বলেছেন নেক্সট সিটিং ওখানে হবে। আপনিও চলুন না, আবরার ভাই। বেশ মজা হবে।’ আগ্রহে চকচক করছে সুবর্ণার মুখ। ঢাকায় ছিলাম না কয়েকদিন। মা’র অসুস্থতার কথা শুনে দেশের বাড়ি গিয়েছিলাম। অসুস্থতা না ছাই। মা আসলে আমাকে পাত্রী দেখানোর জন্য মিথ্যা অজুহাতে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি আগামী পাঁচ বছরেও বিয়ে করার ইচ্ছে আমার নেই।
ভূত-প্রেত বা প্ল্যানচেট ইত্যাদিতে আমার বিশ্বাস নেই শুরুতেই বলেছি। কিন্তু এক কথায় সুবর্ণার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। আসলে ওকে নিরাশ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর মেয়েটা হয়তো ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়ে বসেছে আগামী প্রেতচর্চার আসরে প্রধান অতিথির আসনটা আমিই অলংকৃত করব।
থট-রীডিং জানে বোধ হয় সুবর্ণা। চট করে বলল, ‘আমি প্রদীপ্তদা আর সুদীপা বৌদিকে বলেছি শনিবার আপনাকে নিয়ে হাজির হয়ে যাব তাঁদের বাসায়।’
‘আমি তো বাড়ি গিয়েছিলাম। তুমি কি করে জানলে আজ-কালের মধ্যে তোমাদের বাসায় আমি আসব?’
‘আমি জানতাম,’ স্বচ্ছ, টলটলে চোখ জোড়া আমার চোখে রেখে গভীর গলায় বলল সুবর্ণা। ওর চোখের কালো অংশটা আশ্চর্য কালো, সাদা জমিনটার বিস্তৃতি অনেকখানি। চাউনিটাকে আমার কাছে অপার্থিব, স্বর্গীয় মনে হলো। ‘আমি এও জানি আপনি ১৪ এপ্রিল প্রদীপ্তদার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবেন।’ শেষের দিকে প্রায় ফিসফিসে শোনাল সুবর্ণার কণ্ঠস্বর।
‘নিয়ে যাব,’ ওর চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট গলায় বললাম। শনিবার বিকেলে আসব আমি। রেডি হয়ে থেকো।’
দুই
শনিবার, ১৪ এপ্রিল বাসা থেকে বেরোবার সময় খচখচ করতে লাগল মন। কেন জানি বারবার মনে হতে লাগল কাজটা ভাল করছি না আমি। গোটা ব্যাপারটাই প্রহসন হতে পারে। কারণ ভূতুড়ে ব্যাপার-স্যাপারগুলো আমার কাছে এতই অবাস্তব, উদ্ভট এবং যুক্তিহীন মনে হয় যে, জাহিদকে এ নিয়ে অতীতে বহুবার অপদস্থ করেছি। একবার জাহিদ তো প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘ব্ল্যাক আর্টকে তোর ভাঁওতাবাজী মনে হয়, না? দাঁড়া, একদিন নরকের পিশাচকে সওয়ার করাব তোর ঘাড়ের ওপর। তখন মজা বুঝবি।
ক্ষীণ সন্দেহ হলো সুবর্ণাকে জাহিদ ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে না তো? সুবর্ণা তার ভাইয়ের সাংঘাতিক ন্যাওটা। জাহিদ হয়তো তাকে বুঝিয়েছে আমাকে নিয়ে সে খানিকটা নির্দোষ মজা করতে চায় ‘প্ল্যানচেট’ নাটক করে। নাটকই তো! প্ল্যানচেট করে আবার আত্মা ডাকা যায় নাকি? আমার ধারণা, মৃত্যুর সাথে সাথে আত্মাও ধ্বংস হয়ে যায়। অস্তিত্বহীন একটা জিনিস নিয়ে মাতামাতি করাকে আমার কাছে স্রেফ ভণ্ডামি মনে হয়। কিন্তু তারপরও আমি সুবর্ণাদের বাসায় গেলাম। গেলাম শুধু ওর কারণেই। নিশ্চিত জানি আজ না গেলে সুবর্ণা আগামী এক সপ্তাহ আমার দিকে ফিরেও চাইবে না। সে আমার জন্য ভারী কষ্টের ব্যাপার হবে।
রেডি হয়ে ছিল সুবর্ণা। আমাকে দেখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
‘জাহিদ কোথায়?’ জানতে চাইলাম আমি। ‘ও যাবে না?’
‘ভাইয়া একটু বাইরে গেছে। বলেছে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে প্রদীপ্তদার বাড়িতে। এখন চলুন তো!’
সুবর্ণা নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে। আজ আর ওকে গাড়ি চালাতে দিলাম না। যেরকম উত্তেজিত হয়ে আছে অ্যাক্সিডেন্ট না করে বসে। ওর উত্তেজনার কারণ আজ প্রদীপ্তের বাসায় প্ল্যানচেটের বিশেষ আসর বসবে। সুবর্ণা ঠিক করেছে সে অ্যাডগার অ্যালান পো-র আত্মা আনার চেষ্টা করবে।
শুনে বিষম খেলাম আমি। অল্পের জন্য একটা রিকশাকে চাপা দিলাম না। হাসি চাপার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, ‘বলো কি! দেড়শো বছর আগে মরে যাওয়া একটা মানুষের আত্মা আনবে তুমি? বেচারা কবরে শুয়ে আছে শান্তিতে। ওকে নিয়ে আবার টানা-হ্যাঁচড়া কেন, বাপু?’
আমার ঠাট্টা গায়ে না মেখে সুবর্ণা বলল, ‘আমরা এর আগে হেমেন্দ্র কুমার রায়ের আত্মাও এনেছিলাম।’
‘তাই নাকি? বেশ বেশ! তাহলে শেক্সপীয়রের আত্মা আনারও ব্যবস্থা করতে হয় একদিন। হ্যামলেট-এর কিছু দুর্বোধ্য বিষয় নিয়ে ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করা যেত।’
‘ঠাট্টা করছেন, না?’ হাসিমুখে বলল সুবর্ণা। ‘দাঁড়ান, আজকেই মজা টের পাবেন। অ্যালান পো-র ভূত ছেড়ে দেব আপনার ওপর।’
‘রক্ষে করো বাপু!’ কৃত্রিম ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। ‘ভূতের সাথে মোলাকাত করার কোন খায়েশ আমার নেই।’ বলে অ্যাকসিলারেটরে দাবিয়ে দিলাম পা। বাঘের মত লাফ মারল টয়োটা সামনে।
তিন
প্রদীপ্তকে পাওয়া গেল তার স্টুডিওতে। গভীর মনোযোগে ছবি আঁকছে। ছবির ব্যাপারে আমি সমঝদার নই মোটেই, তবে ক্যানভাসে প্রস্ফুটিত কয়েকটা ছবি দেখে মনে হলো যেন ফ্যান্টাসী ফিল্ম দেখছি। কিম্ভূতকিমাকার সব প্রাণীর ছবি এঁকে রেখেছে প্রদীপ্ত। তবে আমার দৃষ্টি কাড়ল একটা সাদা ঘোড়া। প্রকাণ্ড শরীর, ধবধবে গা থেকে যেন আলো ফুটে বেরুচ্ছে, মাথায় খাড়া একটা শিং।
‘কেমন বুঝছ, আবরার,’ আমার সাড়া পেয়ে পেছন ফিরল প্রদীপ্ত।
‘কিছুই বুঝতে পারছি না,’ বললাম আমি। রূপকথার প্রতি কবে থেকে আবার আকৃষ্ট হলে?’
‘এগুলোকে একরকম রূপকথার প্রাণীই বলতে পারো। তবে সবগুলোর বর্ণনাই তুমি পাবে গ্রীক আর রোমান সাহিত্যে। প্রত্যেকটারই রয়েছে পৈশাচিক ব্যাখ্যা।’
‘তবে সাদা ঘোড়াটা বেড়ে এঁকেছ, ভাই।’
‘এটা ঘোড়া নয়,’ একটু বিরক্ত দেখাল প্রদীপ্তকে। ওর আচরণে অবাক হলাম আমি। সামান্য কথায় মাইন্ড করে বসার মত ছেলে সে নয়।
‘তাহলে কি ওটা?’
‘মাথায় শিং দেখতে পাচ্ছ না? এটা একটা ইউনিকর্ন। সাহিত্যের ছাত্র তুমি ইউনিকর্ন চেনো না।’
‘সরি, প্রদীপ্ত,’ ও রেগে উঠছে দেখে নরম গলায় নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করলাম আমি।
বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে বুঝতে পেরে হেসে উঠল প্রদীপ্ত, ‘কিছু মনে কোরো না, আবরার। এই ব্যাটার পেছনে সারাটা দিন লেগে ছিলাম আমি। জ্যান্ত, ছুটন্ত ইউনিকর্ন-এর ইমেজটা কিছুতেই আনতে পারছিলাম না ছবির মধ্যে। বারবার মুছেছি আর এঁকেছি। অবশেষে সফল হয়েছি। তাই তুমি ওটাকে চিনতে পারোনি দেখে মেজাজ একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সরি ভাই, এক্সট্রিমলি সরি।’
‘না, না, ঠিক আছে, বললাম আমি। ‘খুব ভাল এঁকেছ তুমি ছবিটা। অন্যগুলোর ব্যাপারে কোন সমস্যা হয়নি?’
‘নাহ্। বাকিগুলো একটানে এঁকে ফেলেছি। তবে ইউনিকর্ণটার গায়ে আরও দু’একটা টাচ বাকি আছে। ওগুলো কাল করব। এসো, গল্প করি।’
‘ইলিশ মাছের ডিমের বড়া আর চা দিয়ে গল্প করলে আসর আরও জমবে, কি বলেন, আবরার ভাই?’ মস্ত একটা ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে সুদীপা। বড়াগুলো দিয়ে এখনও ভাপ বেরুচ্ছে। পেছনে সুবর্ণা।
‘এজন্যেই তো আপনাকে আমি এত পছন্দ করি, বৌদি,’ সহাস্যে বললাম আমি।
‘বেগুনিটা কিন্তু আমার ভাজা।’ একটা প্লেট আমার হাতে ধরিয়ে দিল সুবর্ণা। ‘দেখুন, কারটা বেশি মজার হয়েছে।’
আবরার ভাই তোমার পক্ষেই ভোট দেবেন,’ ফোড়ন কাটল সুদীপা। ‘বিচারক থাকুক প্রদীপ্ত,’ সায় পাবার আশায় বন্ধুর দিকে তাকালাম আমি। ‘তাহলেই হয়েছে!’ হেসে উঠল সুদীপা। ‘আর্টিস্ট বাবুর কাছে মুড়ি মুড়কি সব একদর।’
জবাবে কি যেন বলতে যাচ্ছিল প্রদীপ্ত, চোখ আটকে গেল দরজায়। হাজির হয়েছে জাহিদ, সাথে লম্বা চওড়া এক শিখ, বয়সে প্রৌঢ়।
অবাক হলাম আমি। কারণ সুবর্ণা আমাকে বলেছে ওদের প্ল্যানচেটের আসরে বাইরের কারোর প্রবেশ নিষিদ্ধ। আত্মা আনার পরবর্তী সময়ে বেশ কিছুক্ষণ সুবর্ণা কাহিল হয়ে থাকে বলে প্রদীপ্ত ভাড়া করা মিডিয়ামের প্রস্তাব দিয়েছিল জাহিদকে। রাজি হয়নি জাহিদ। ভাড়া করা মিডিয়ামে তার বিশ্বাস নেই। তাছাড়া অপরিচিত কাউকে সে এর মধ্যে টেনে আনতেও চায় না। কাজেই ওর সাথে শিখ ভদ্রলোককে দেখে সবারই ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
‘পরিচয় করিয়ে দেই’ মুখখানা হাসি হাসি করে বলল জাহিদ। ইনি রাজেশ তিওয়ারী। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ান, তবে প্রেত শাস্ত্রে ওনার প্রচুর পড়াশোনা আছে। নিজেও একজন উঁচুদরের মিডিয়াম।’
সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিল প্রদীপ্ত। সালাম করল সুবর্ণা। আগ্রহে চকচক করছে মুখ। বুঝলাম ‘প্রেতশাস্ত্র’ রোগে এদের ভালই ধরেছে।
রাজেশ তিওয়ারী প্রায় ছ’ফিটের মত লম্বা, ঘন, কুচকুচে দাড়ির জঙ্গলে ঢাকা পড়েছে মুখ। চোখ জোড়া ভাসাভাসা, বড় এবং অত্যন্ত উজ্জ্বল। যেন সম্মোহন করছে। পরনে দামী গ্যাবার্ডিনের সুট, পায়ের চকচকে কালো জুতো জোড়া থেকে জেল্লা বেরুচ্ছে। প্রথম দর্শনেই পছন্দ করার মত একজন মানুষ।
জাহিদ জানাল, রাজেশ তিওয়ারীর সাথে তার পরিচয় মাস খানেক আগে। প্রতিষ্ঠানের কাজে দিল্লী যেতে হয়েছিল তাকে। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য দূরীকরণ বিষয়ক এক সেমিনারে রাজেশ তিওয়ারীর সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের দিল্লীস্থ প্রতিনিধি। ভদ্রলোক জিটিভির ‘হরর শো’র জন্য কয়েকটা চিত্রনাট্য লিখেছেন শুনে উৎসাহী হয়ে ওঠে জাহিদ। তিনি নিজেও ভূত প্রেত বিশ্বাস করেন শুনে কৌতূহল বোধ করে সে। আলাপে দেখা যায় ওরা দু’জনেই অকাল্ট শাস্ত্রের প্রতি প্রচণ্ড অনুরাগী। ফলে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে যেতে সময় লাগেনি। ঢাকায় এসেছেন ‘ফাও’-র একটা প্রজেক্টের কাজে। আগামীকাল দিল্লী ফিরে যাবেন। জাহিদ তাদের প্ল্যানচেটের আসরে তাঁকে অতিথি হতে আমন্ত্রণ করলে সানন্দে রাজি হয়ে যান।
জাহিদের কাছ থেকে রাজেশ তিওয়ারীর নাড়ি নক্ষত্রের খবর জানার পরে ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল প্ল্যানচেটের আসর বসানোর কাজে। সুদীপা আগে ভাগে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। আত্মা-টাত্মার ব্যাপারে তার ভীষণ ভয়। ও চলে যাবার পরে ঘরের বাতি কমিয়ে দেয়া হলো, স্টুডিওর মাঝখানের কালো মেহগনি কাঠের বড় টেবিলটার চারপাশে পাঁচটা চেয়ার রাখা হলো। আলো কম হলেও পরস্পরের চেহারা অস্পষ্ট নয়।
‘কেয়া বাত!’ আমার দিকে ফিরে বললেন অর্থনীতির অধ্যাপক। ‘জাহিদ সাহেবের কাছে শুনলাম অকাল্টিজমে আপনার বিশ্বাস নেই। তাহলে…’
‘তাহলে আমি এখানে কেন, এই তো? জাস্ট কৌতূহল, মি. রাজেশ। আপনাদের বিশ্বাসে আঘাত না দিয়ে বলছি, ব্যাপারটার সত্যাসত্য যাচাই করতে এসেছি আমি।’
‘আপনার কৌতূহল আশাকরি ভালভাবেই মিটবে, আবরারজী,’ ভাঙা বাংলায় গম্ভীর গলায় বললেন রাজেশ তিওয়ারী। তাকালেন সুবর্ণার দিকে। ‘আপনিই তো মিডিয়াম, হ্যায় না?’
‘জ্বী,’ ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল সুবর্ণা।
‘প্ল্যানচেটের সময় আপনি কি পুরোপুরি সমাধিস্থ হয়ে পড়েন?’
‘খুব কম,’ বলল সুবর্ণা। ‘সমাধিস্থ হবার চরম পর্যায়ে পৌঁছাবার আগে সব সময়ই আমি সতর্ক হয়ে যাই।’
‘তাহলে আপনি এখনও ফার্স্ট স্টেজে আছেন। পুরোপুরি সমাধিস্থ হতে পারলে আপনি সরাসরি আত্মার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারবেন। এমনকি তার সাথে কথাও বলতে পারবেন।’
‘আর দেরি না করে কাজ শুরু করে দেই, আসুন।’ তর সইছে না জাহিদের।
‘কিন্তু তার আগে বলুন এখানে ইউনিকর্নের কথা কে ভাবছেন?’ অনুযোগের মত শোনাল রাজেশ তিওয়ারীর কণ্ঠ।
লাফিয়ে উঠল প্রদীপ্ত। ‘আমি! আমি ভাবছিলাম! কিন্তু আপনি বুঝলেন কি করে?’
‘আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি যা অন্যদের বোধের অগম্য। কিন্তু আপনি ইউনিকর্নের কথা ভাবছিলেন কেন বলুন তো?’
‘ওটার পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি আমি সারাদিন। ফিনিশিং টাচটা কিভাবে দেব তাই নিয়ে চিন্তা করছিলাম।
‘কিন্তু কল্পনা সময় সময় বাস্তবেও রূপ নেয় জানেন তো, বন্ধু। আপনি যখন কোন কিছু কল্পনা করেন, তার মানে আপনি একটি বস্তু তৈরি করেন।’
‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যেটার কোন অস্তিত্বই নেই সেটাও আমি কল্পনার মাধ্যমে সৃষ্টি করতে পারব?’
‘অবশ্যই। কল্পনা থেকেই তো বাস্তবের সৃষ্টি। এজন্যই অশুভ কিছু নিয়ে চিন্তা করা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে কারও কারও জন্য।
‘কিন্তু কল্পনার জিনিসগুলোর অবস্থান তো ভৌতিক স্তরে, নাকি?’ জানতে চাইল জাহিদ।
‘পুঁথি পুস্তকে তেমনই লেখা। তবে তাদের অস্তিত্ব সর্বত্র, সবখানে। আমি ওদের দেখতে পাই। কিন্তু ছুঁতে পারি না।’
‘আপনি আমাদের দেখাতে পারবেন?’ চ্যালেঞ্জের সুরে প্রশ্নটা করলাম আমি। ‘ওদের একটা আকৃতিতে তাহলে নিয়ে আসতে হবে। তবে এজন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন। আর ব্যবস্থাটাও করতে হবে সেভাবে। আমি কি আমার নিজের ইচ্ছেমত সার্কেলটা সাজাতে পারি?’
‘এসব ব্যাপার আপনি আমাদের চেয়ে অনেক ভাল বোঝেন, প্রশংসার সুর প্রদীপ্তর কথায়। ‘গোটা ব্যাপারটাই আমরা আপনার ওপর ছেড়ে দিতে রাজি আছি।
‘কতটা সফল হব জানি না। তবে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? ম্যাডাম যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন। আমি তার পাশে বসব। আমার পরে এই ভদ্রলোক, বাবুজী আপনি আপনার জায়গায় থাকুন। আর জাহিদ সাহেব বসুন ম্যাডামের পাশে। বাহ্, বেশ! এবার আপনাদের অনুমতি পেলে আলোগুলো নিভিয়ে ফেলতে চাই।’
‘কেন, আলো নেভাবেন কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘কারণ যে শক্তিটাকে নিয়ে আমরা কাজ করব ওটা আসলে ইথারের একটা ভাইব্রেশন, আলোও তাই। ম্যাডাম, অন্ধকারে ভয় পাবেন না তো ভয়ের কিছু নেই।’
বাতি নেভানোর পরে মনে হলো আলকাতরার কুয়ায় ডুব দিয়েছি। অবশ্য একটু পরেই অন্ধকার সয়ে এল চোখ, টেবিল ঘিরে বসা মানুষগুলোকে আবছাভাবে দেখা গেল।
‘সবাই টেবিলে একজনের ওপর আরেকজন হাত রাখুন,’ বললেন রাজেশ তিওয়ারী। ‘শরীরের পেশীতে ঢিল দিতে শুরু করুন, ম্যাডাম। ঘুম আসলে তাড়াবার চেষ্টা করবেন না। এবার সবাই চুপ হয়ে ভাবতে থাকুন। ভাবুন নীল রঙের ভাইব্রেশনের কথা।’
আমি আলতো ভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম পাশে বসা সুবর্ণার দিকে। খুব অস্পষ্ট হলেও দেখলাম চোখ বুজে আছে সে। নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। ওর হাতের ওপর আমার হাত। টের পেলাম, দ্রুত উষ্ণতা চলে যাচ্ছে ওর শরীর থেকে। ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আমারও কেমন শীত শীত করতে লাগল। এটা এপ্রিল মাস। মগজ গলানো রোদ্দুরের সীজন। শীত লাগার প্রশ্নই আসে না। এসি চলা সত্ত্বেও এতক্ষণ একটা গুমোট ভাব ছিল ঘরের মধ্যে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম গুমোট ভাবটাকে কাটিয়ে শীতল একটা ভাব যেন ঢুকে পড়েছে ভেতরে। টকাশ টকাশ করে আমার তর্জনীটা লাফাল দু’বার। শিরদাঁড়া বেয়ে সরসর করে ঘামের ধারা নামছে নিচে, শিরশির করে উঠল গা।
স্টুডিও রূমটা আশ্চর্য রকম নীরব। দেয়াল ঘড়ির টক টক শব্দ আসছে বাইরের কোন একটা ঘর থেকে। দূরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল বার কয়েক। রাস্তা দিয়ে চলে গেল একটা গাড়ি, হেডলাইটের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঝিলিক মারল মুহূর্তের জন্য। আমার কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। মাথাটা ভার ভার ঠেকছে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছি এই সময় শুনতে পেলাম শব্দটা।
অন্ধকারে যেন গড়িয়ে এল ওটা। নিচু, হিসহিসে একটা আওয়াজ। দ্রুত হয়ে উঠল শব্দটা, যেন ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে কোন নারী। হঠাৎ নিঃশ্বাসের শব্দটা হালকা হয়ে এল, দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে, কাপড়ের খসখস শুনলাম এক মুহূর্তের জন্য, তারপর বিরাট এক দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ।
‘কি হলো? সব ঠিক আছে তো?’ কে যেন কথা বলে উঠল নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। ‘হ্যাঁ, সব ঠিক আছে,’ জবাব দিলেন রাজেশ তিওয়ারী। ‘ম্যাডাম শ্বাস করছেন, সমাধির পর্যায়ে চলে গেছেন। আপনারা একটু চুপ করে থাকুন। একটু পরেই একটা জিনিস দেখতে পাবেন।’
ঘড়িটা টিক টক টিক টক শব্দে সমানে বেজে চলেছে। নিঃশ্বাসের শব্দ আরও ঘন হয়ে উঠেছে। গাড়ির হেডলাইটের ঝিলিকে সেকেন্ডের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার। হঠাৎ মনে হলো টেবিলটা যেন কাঁপতে শুরু করেছে। একটা নির্দিষ্ট ছন্দে ওটাতে ঝাঁকুনি শুরু হলো। ভূমিকম্প হচ্ছে না তো! ভাবলাম আমি।
‘টেবিলের দিকে তাকান!’ উত্তেজিত শোনাল রাজেশজীর কণ্ঠ। ‘দেখুন ওটা কি?’
প্রথমে মনে হলো নিকষ আঁধারে ধন্ধ লেগে গেছে, তাই মরীচিকা দেখছি। হাতের তালু দিয়ে জোরে চোখে ডলা দিলাম একবার। কি ওটা? টেবিলের ওপর হলদে সবুজাভ ফসফরাসের মত একটা আলো, বাষ্পের মত দানা বাঁধতে শুরু করেছে। দানাটা গড়াগড়ি দিল, ধোঁয়ার মেঘের মত মোচড় খেতে শুরু করল। অশুভ আলোতে আমি রাজেশ তিওয়ারীর চওড়া হাতখানা দেখতে পেলাম স্পষ্ট, পোকার মত কিলবিল করছে টেবিলের ওপর।
‘কেয়া বাত!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘এসে গেছে আমাদের জিনিস।’
‘আমরা কি অ্যালফাবেটিকাল অর্ডারে প্রশ্ন শুরু করব?’ জানতে চাইল জাহিদ। না,’ বললেন রাজেশ। ‘এবিসিডি মার্কা গতানুগতিক প্রশ্ন করে লাভ নেই। ম্যাডামের মত ভাল মিডিয়াম থাকতে আমরা আরও চমৎকারভাবে যোগাযোগ করতে পারব।’
‘হ্যাঁ, আপনারা তা পারবেন,’ একটা কণ্ঠ কথা বলে উঠল।
‘কে, কে কথা বলে? জাহিদ সাহেব নাকি?’
‘না, আমি কোন কথা বলিনি।’
‘তাহলে নিশ্চয়ই ম্যাডাম।’
‘তার কণ্ঠ অমন নয়।’
‘আপনি কি কথা বলেছেন, ম্যাডাম সুবর্ণা?’
‘মিডিয়াম কথা বলেননি, বলেছে ম্যাডামের শরীর ধারণ করে থাকা শক্তি,’ অদ্ভুত, গম্ভীর কণ্ঠটা বলে চলল। ‘তবে তাঁর কোন ক্ষতি হবে না। শুধু কিছু সময়ের জন্য আমি তাঁর জায়গা দখল করেছি, তিনি আমারটা।’
‘আপনি কে?’
‘আমি কে সেটা আপনাদের না জানলেও চলবে। আমি সেই যে আপনাদের মত এক সময় জীবিত ছিল, আর আপনারা যেভাবে একদিন মারা যাবেন আমিও সেভাবে মারা গিয়েছি।’
পাশের বাড়ির গেট খোলার শব্দ ভেসে এল কানে। একটা রিকশা থেমেছে। ভাড়া নিয়ে যাত্রীর সাথে বচসার আওয়াজও শোনা গেল। টেবিলের ওপর হলদে সবুজাভ মেঘটার রঙ এখন অনেকটাই ম্লান, সুবর্ণার ঠিক সামনে ওটা আভা ছড়াচ্ছে। মনে হলো যেন জট পাকিয়ে উঠছে ওটা। আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। শুনলাম প্রদীপ্ত প্রশ্ন করছে, ‘আপনি নিজেকে আত্মা বলে পরিচয় দিচ্ছেন। আপনি সত্যি আত্মা কিনা প্রমাণ হয়ে যাক। বলতে পারবেন আমার পকেটে কয়টা কয়েন আছে?’
‘আমরা পৃথিবীতে আসি কিছু শেখাতে, বাচ্চাদের মত ধাঁধা খেলতে নয়,’ বলল অদৃশ্য কণ্ঠ।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, দ্রুত বলে উঠল জাহিদ। যেন অদৃশ্য শক্তিটাকে চটাতে চায় না। ‘আপনি নিজের পরিচয় দিতে না চাইলে বলুন কতদিন ধরে এই অবস্থায় আছেন?’
‘সময়ের হিসেব আমরা রাখি না। আমাদের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা।’
‘আপনি কি ওই জগতে সুখী?’
‘হ্যাঁ।’
‘পুনর্জন্ম লাভ করতে ইচ্ছে করে না?’
‘কক্ষনো না।’
‘আপনি কি খুব ব্যস্ত থাকেন?’
‘ব্যস্ত না থাকলে সুখী হতে পারতাম না।’
‘ওখানে কি কাজ করেন আপনি?’
‘বলেছিই তো আমাদের পৃথিবী সম্পূর্ণ ভিন্ন।’
‘দেখলি তো, আবরার,’ অন্ধকারে বিজয় উল্লাসের মত শোনাল জাহিদের গলা, ‘আত্মা আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। আর তুই কিনা এসব বিশ্বাসই করিস না। নে, তোর কোন প্রশ্ন থাকলে করে ফেল।’
গোটা ব্যাপারটাই আমার কাছে এখনও অবিশ্বাস্য ঠেকছে। সুবর্ণা বলেছিল তারা এ পর্যন্ত যে সব আত্মা এনেছে, সেগুলোর কারও সাথেই কথা বলা সম্ভব হয়নি। সুবর্ণাদের প্ল্যানচেটের ব্যাপারটা ছিল এরকম: একটা সাদা কাগজে ইংরেজী বর্ণমালার ‘এ’ থেকে ‘জেড’ পর্যন্ত বর্গাকারে লিখে মাঝখানে তিনটে গোল বৃত্ত আঁকতে হয়। মাঝের বৃত্ত বা কেন্দ্রে একটা নতুন দশ পয়সা তর্জনী দিয়ে চেপে রেখে চোখ বুজে আত্মার চিন্তা করতে হয়। আত্মার আগমন বোঝা যাবে আঙুলটা কাঁপতে থাকলে। তারপর একজন প্রশ্ন করবে। প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ হলে আঙুলটা অন্য গোল বৃত্ত দুটোর দিকে (একটাতে ‘ইয়েস’ অন্যটাতে ‘নো’ লেখা) এগোতে থাকবে। আর বিশেষ কারও নামের আদ্যাক্ষর জানতে হলে পয়সাটা এবিসিডি লেখা হরফগুলোকে স্পর্শ করবে। কিন্তু এ দেখছি একেবারে আলাদা জিনিস। প্রায় ঘোরের মধ্যে আমি বলে ফেললাম:
‘আপনি যন্ত্রণা বা ব্যথা অনুভব করেন?’
‘না; যন্ত্রণা শরীরের একটা ব্যাপার।’
‘মানসিক যন্ত্রণাও নেই আপনার?’
‘হ্যাঁ, সবাই কোন না কোনভাবে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে।’
‘আচ্ছা, আমরা যে কাজটা করছি তা কি ঠিক?’
‘যদি ভাল আত্মা আনা যায় তাহলে ঠিক।’
‘আর মন্দ আত্মা আনলে?’
‘ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে।
‘কি রকম ক্ষতি?’
‘আপনি এমন কোন আত্মাকে ডেকে আনতে পারেন যার ওপর আপনার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।’
‘প্রেত-শক্তি?’
‘অনুন্নত শক্তি।’
‘বললেন যে ওগুলো বিপজ্জনক। শরীর নাকি মনের জন্য বিপজ্জনক?’
‘কখনও কখনও দুটোর জন্যই।’
একটুক্ষণ নীরবতা, অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে আসছে, হলদে-সবুজ কুয়াশার আবরণটা এখনও ভাসছে টেবিলের ওপর।
‘আর কারও কোন প্রশ্ন আছে?’ জিজ্ঞেস করল জাহিদ।
কেউ কথা বলল না। অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখলাম আমি। দ্রুত একবার পাক খেল টেবিলের ওপরের জিনিসটা, তারপর যেন সাঁৎ করে জানালা গলে বেরিয়ে গেল।
বেশ খানিকক্ষণ সবাই চুপ হয়ে রইল। তারপর কথা বললেন রাজেশ তিওয়ারী:
‘আমাদের অবিশ্বাসী বন্ধুটি নিশ্চয়ই এতক্ষণ বিশ্বাস করেছেন যে প্ল্যানচেট কোন আজগুবী বিষয় নয়।’ রীতিমত ব্যঙ্গ তাঁর কণ্ঠে।
আমি চুপ করে থাকা শ্রেয় মনে করলাম। একবার মনে হলো ব্যাপারটায় কোন বুজরুকী নেই তো? আমাদের মধ্য থেকে কেউ হয়তো কণ্ঠস্বর নকল করে আত্মা সেজেছে। তাহলে আলোর ব্যাপারটা? কে জানে আমাকে বোকা বানানোর জন্য প্রদীপ্ত আগে ভাগে তার স্টুডিওতে আলোর কোন কারসাজি করে রেখেছে। বাইরে থেকে হয়তো কলকাঠি নাড়ছে সুদীপা। সন্দেহটা এত প্রবল হয়ে উঠল যে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম:
‘আমাকে আপনার ইউনিকর্ন দেখাতে পারবেন? তাহলে বুঝব আপনাদের প্ল্যানচেটের ক্ষমতা অসীম।’
‘ও। তারমানে তুই স্বচক্ষে দেখেও ব্যাপারটা বিশ্বাস করিসনি।’ রীতিমত ক্ষুব্ধ শোনাল জাহিদের গলা।
‘আমি আপনাকে ইউনিকর্নও দেখাতে পারব, আবরারজী,’ শান্ত গলায় বললেন রাজেশ তিওয়ারী। তবে শুনলেনই তো মন্দ আত্মা কখনও কখনও অমঙ্গল ডেকে আনে।
আত্মাই বিশ্বাস করি না-তার আবার মঙ্গল-অমঙ্গল!’ জেদের সুরে কথাটা বললাম আমি। একবারও ভেবে দেখলাম না আমার জেদ অন্যদের জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে।
‘বেশ। অন্যদের যদি আপত্তি না থাকে আমি তাহলে আপনার ইচ্ছে পূরণ করতে পারি।’ বললেন রাজেশজী।
‘এখানে? সত্যি?’ আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল প্রদীপ্ত। ‘তাহলে আর দেরি কেন? আপনার কোন ভয় নেই। আমরা সবাই আছি না? সুবর্ণার কোন ক্ষতি হবে না।’
‘ঠিক আছে,’ বললেন রাজেশ তিওয়ারী। ‘আপনারা স্থির হয়ে বসুন। কেউ শব্দ করবেন না। হাতগুলো আবার টেবিলের ওপর রাখুন আগের মত। নীলের ভাইব্রেশন ভাবতে শুরু করুন। মনে করুন নীলের সমুদ্রে ডুবে আছেন সবাই।’
ঘরটাকে আরও অন্ধকার আর নীরব মনে হতে লাগল। এবার সত্যি সত্যি চোখ বুজে নীলের সাগরে নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করলাম আমি। রাজেশ বারবার অনুরোধ করেছেন মনোযোগ যেন ছুটে না যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ভেতর আবার আগের সেই অনুভূতিটা ফিরে এল। তখন বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম ঘরে এসি চলছে তাই শীত শীত লাগছে। কিন্তু কোনরকম শব্দ যাতে না হয় এজন্য এবার এসিও বন্ধ রাখা হয়েছে। তাহলে এত শীত লাগে কেন? মাথাটাও কেমন ভার ভার ঠেকছে। যেন বিশ কেজি ওজন চাপিয়ে দিয়েছে কেউ আমার মাথায়। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম ডান হাতের তর্জনীটা আবার ঘোড়ার মত লাফাতে শুরু করেছে। তলপেটে ঠাণ্ডা, বিচিত্র একটা অনুভূতি। কেন জানি সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল ঘাড়ের পেছনের চুল।
‘কাজ হচ্ছে! কাজ হচ্ছে!’ ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠলেন শিখ ভদ্রলোক। সাথে সাথে দৃশ্যটা দেখতে পেলাম আমি।
কুয়াশার একটা মেঘ আলগোছে ঢুকে পড়ল জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে। দুলতে দুলতে চলে এল ঘরের মাঝখানে, শূন্যে ঝুলে রইল স্থির হয়ে। মেঘটা আঁধারে ফসফরাসের মত জ্বলছে, তবে আলোর কোন বিচ্ছুরণ নেই। এটার রঙও সবুজ-হলুদ, একটু পরেই কালচে লাল রঙ ধারণ করল। গোলাকার জিনিসটার ঠিক মাঝখানে কুণ্ডলী পাকাল গাঢ়, ধোঁয়াটে একটা পদার্থ, ঘন এবং শক্ত হয়ে উঠল ওটা দেখতে দেখতে, মিশমিশে কালো রঙে পরিণত হতে শুরু করল। তারপরই উজ্জ্বল আলোটা নিভে গেল দপ করে।
‘আরে, ওটা তো চলে গেল।’ বলল কে যেন।
‘চুপ–কি যেন ঢুকেছে ঘরের মধ্যে,’ ফিসফিস করল আরেকজন।
একটা শব্দ শুনলাম সবাই। ওদিক থেকেই রহস্যময় আলোটা এসেছিল। ‘কিসের শব্দ ওটা?’ জাহিদের গলা শুনতে পেলাম।
‘রাজেশজী, আপনি কি করেছেন?’
‘ভয় নেই। কোন ক্ষতি হবে না’। রাজেশজীর গলা কেঁপে গেল। ভয় না উত্তেজনায় বোঝা গেল না।
‘হা ঈশ্বর! জাহিদ,’ আর্তনাদ করে উঠল প্রদীপ্ত, ‘বড় একটা প্রাণী ঢুকেছে ঘরে। এই তো আমার চেয়ারের কাছে! যা-সর! সর!’
তারপরই ধপাস্ করে একটা শব্দ। প্রদীপ্ত চেয়ার দিয়ে শক্ত একটা কিছুতে আঘাত করেছে। আর তারপর…তারপর…যা ঘটতে শুরু করল তার বর্ণনা কিভাবে দেব আমি?
বিরাট এবং প্রকাণ্ড আকৃতির একটা প্রাণী যেন প্রচণ্ড শক্তিতে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল অন্ধকার ঘরটাতে। ওটা ছুটছে, হিসহিস শব্দ করছে, আছড়ে পড়ছে আসবাবপত্রের গায়ে। টেবিলটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। আমরা ছিটকে পড়লাম চারপাশে। ভয়ঙ্কর দানবটা উন্মাদের মত ছুটে চলেছে ভয়ানক গতিতে, একবার ঘরের এদিকে আরেকবার ওকোণে যাচ্ছে। সীমাহীন আতঙ্কে চিৎকার শুরু করে দিলাম আমরা, হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ ভীষণ শক্ত কি যেন চাপ দিল আমার বাঁ হাতে, মট করে একটা শব্দ হলো। তীব্র ব্যথায় চোখে সর্ষে ফুল দেখলাম আমি।
‘আলো! আলো!’ হাহাকার করে উঠল একজন।
‘জাহিদ, ম্যাচ জ্বালাও! ম্যাচ জ্বালাও!’ হিসিয়ে উঠল প্রদীপ্ত।
‘ম্যাচ নেই আমার কাছে,’ ফুঁপিয়ে উঠল জাহিদ।
‘খুঁজে বের করো, শিগগির।’
‘অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না! ওহ্, রাজেশজী। থামান ওটাকে! থামান!’
‘পারছি না!’ আর্তনাদ করলেন রাজেশ তিওয়ারী। ‘ওটাকে পারছি না থামাতে। আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। শিগগির পালান সবাই! দরজা কোনদিকে? দরজা!’
ভাগ্যই বলতে হবে, অন্ধকারে আমি দরজা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ হাতলে ঠেকে গেল হাত। দরজা খোলার আগ মুহূর্তে বিশালদেহী প্রাণীটা ঝড়ের বেগে পাশ কাটিয়ে গেল আমার, একটুর জন্য লাগল না গায়ে, ওক কাঠের পার্টিশনের দরজা খুলে ফেললাম টেনে, পর মুহূর্তে বাইরে চলে এলাম সবাই, ঝট করে আবার আটকে দিলাম কবাট। ভেতর থেকে আসবাব ভাঙার বিকট শব্দ ভেসে আসতে থাকল।
‘কি ওটা? খোদার কসম, কি ওটা?’ তারস্বরে চেঁচাল জাহিদ।
‘একটা ঘোড়া,’ বলল প্রদীপ্ত। ‘দরজা খোলার সময় এক পলক দেখেছি।’
‘আরে, সুবর্ণা কোথায়?’ চিৎকার করে উঠলাম আমি। ‘তোরা কেউ সুবর্ণাকে বের করে আনিসনি?’
‘হায়! হায়! আমার বোনটা বুঝি এবার মারাই পড়ল,’ রীতিমত কপাল চাপড়াতে শুরু করল জাহিদ।
আমি ততক্ষণে ছুটে গেছি স্টুডিও ঘরে। এক ঝটকায়, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ভাঙা চেয়ারের পাশে, মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে সুবর্ণা। অজ্ঞান। অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলাম, ছুটলাম ডাইনিং রূমের দিকে। পেছন ফিরে একবার তাকাতেই দেখি অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ভীষণ একজোড়া চোখ। দরজা বন্ধ করতে আর এক সেকেন্ড দেরি করলেই ওটার খুরের আঘাতে ভর্তা হয়ে যেতাম আমি। প্রচণ্ড জোরে লাথি হাঁকাল অশুভ শক্তিটা কবাটের গায়ে। মেঝে থেকে খিলান পর্যন্ত দরজার গায়ে চিড় ধরল সাথে সাথে।
‘ওটা আসছে! আসছে!’ চিৎকার করে বললাম আমি।
‘পালান সবাই! শিগগির!’ সবার আগে দৌড় দিলেন, রাজেশ তিওয়ারী।
আরেকটা প্রবল সংঘর্ষের শব্দ, যেন কামানের গোলা পড়ল দরজার গায়ে। তারপরই ভেঙে পড়ল ওটা। বুলেটের গতিতে বেরিয়ে এল লম্বা, সাদা একটা আলোর রেখা, শক্ত গজালের মত, ঝিকিয়ে উঠল আলোতে। এক মুহূর্তের জন্য ওটাকে দেখলাম আমরা, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘কুইক কুইক! এই দিকে!’ ঘন ঘন চিৎকার করল প্রদীপ্ত। ‘সুর্বণাকে এদিকে নিয়ে এসো! তাড়াতাড়ি।’
ডাইনিং রূমে আশ্রয় নিলাম সবাই। ভারী সেগুন কাঠের দরজার খিল লাগিয়ে দিলাম। সুবর্ণাকে শোয়ালাম একটা সোফায়। ওর মুখ নীল হয়ে গেছে। জাহিদ ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। পরীক্ষা করল পালস। ঢিল পড়ল মুখের পেশীতে। মাথা ঝাঁকাল সে আমার দিকে চেয়ে। ঠিক আছে সুবর্ণা।
ডাইনিং রূম থেকেও আমরা উন্মত্ত দানবের ধ্বংসযজ্ঞের শব্দ শুনতে পেলাম। স্টুডিও ভেঙে তছনছ করছে ওটা। নাক দিয়ে হিসহিস শব্দটা এতদূর থেকেও স্পষ্ট শোনা গেল। গোটা বাড়ি যেন তীব্র শক্তিতে ঝাঁকাতে শুরু করেছে প্রেত শক্তিটা প্রচণ্ড রাগে। প্রদীপ্তর দিকে তাকালাম আমি। সাদা খড়িকাঠের মত চেহারা হয়ে গেছে ওর, কাঁপছে। সাধের স্টুডিও টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে এই বেদনায় নাকি ভয়ে বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হলো। আমার জন্যই এই অবস্থা, প্রেত ঘোড়াটা যদি ডাইনিং-এর দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে তাহলে কি হবে?
‘বন্দুক!’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল জাহিদ, ‘গুলি করলে কাজ হবে?’ ও ড্রইং রূমের দিকে ছুটে যাচ্ছিল বন্দুক আনতে, রাজেশ তিওয়ারী ঠেকালেন।
‘না, না। বন্দুকে কাজ হবে না। শক্তিটা দুর্বল হয়ে পড়লে নিজে থেকেই মিলিয়ে যাবে।’ বললেন তিনি।
‘তোর জন্যই তো, ঝট করে আমার দিকে ফিরল জাহিদ। ‘তুই কেন মাতব্বরী করে ইউনিকর্নটাকে ডেকে আনতে বললি।’
আমি অধোবদন হয়ে রইলাম। জাহিদ প্রচণ্ড ক্রোধে আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ ভেতর ঘর থেকে ভেসে এল নারী কণ্ঠের সুতীব্র আর্তচিৎকার।
‘সুদীপা!’ গুঙিয়ে উঠল প্রদীপ্ত। ‘হায় ভগবান! ওর কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।’
এক টানে দরজা খুলে প্যাসেজ ধরে দৌড় দিল সে। ‘আপনি সুবর্ণার কাছে থাকুন,’ রাজেশ তিওয়ারীকে কথাটা বলে আমি আর জাহিদ ছুটলাম প্রদীপ্তর পিছু পিছু।
দোতলায় ওঠার সিঁড়ির নিচে সুদীপা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। হয়তো ভয়াবহ কিছু একটা দেখেছে। চকিতে এদিক-ওদিক তাকালাম আমরা। কিছুই চোখে পড়ল না। প্রচণ্ড ঝড়ের পর হঠাৎই যেন সব শান্ত হয়ে গেছে।
ভয়ে ভয়ে এগোলাম আমি স্টুডিওর দিকে। প্রতিটি পা ফেলার মুহূর্তে মনে হলো বুঝি পেছন থেকে এক শিংঅলা বিশালদেহী কোন প্রাণী ঝাঁপিয়ে পড়বে গায়ের ওপর। কিন্তু কিছুই ঘটল না।
স্টুডিও রূমের দরজার চৌকাঠের কাছে এসে উঁকি দিলাম ভেতরে। অন্ধকার। কোন শব্দ নেই, তবে ঘরের এক কোণে কুয়াশার সেই মেঘটাকে আবার দেখা গেল। ধীরে ধীরে ওটা তার ঔজ্জ্বল্য হারাল, ম্লান হতে হতে এক সময় ফিকে হয়ে এল, তারপর মিশে গেল আঁধারের মাঝে। কে যেন খুট করে জ্বেলে দিল বাতি।
অবর্ণনীয় অবস্থা স্টুডিওটার। ঘরের একটা জিনিসও আস্ত নেই। যেন ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। মেঝের এখানে ওখানে ছিটিয়ে থাকতে দেখলাম লদলদে কফের মত ফেনা। ওগুলো কি জিনিস বুঝিয়ে দিতে হলো না কাউকে।
‘কেয়া বাত!’ উল্লসিত কণ্ঠ শোনা গেল পেছন থেকে। ‘আমরা সবাই প্রায় বহাল তবিয়তে আছি। অথচ এমন একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম যা আগে কখনও দেখিনি।’
‘এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি আর কোনদিন হতে চাই না,’ দৃঢ় গলায় বলল জাহিদ।
‘আমিও আর এসবের মধ্যে নেই, ভাইয়া,’ কোমল কণ্ঠ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম আমি। সুবর্ণা।
‘তুমি ঠিক আছ তো?’ উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলাম আমি। বিধ্বস্ত লাগছে ওকে আমাদের মতই।
‘তুই সাথে থাকলে ও ঠিক না থেকে পারে?’ অনেকক্ষণ পর জাহিদের মুখে হাসি দেখলাম আমি। হাসিটা সংক্রমিত হলো বোনের চোখের তারায়।
‘হ্যাঁ, আমি ভাল আছি,’ মৃদু গলায় বলল সুবর্ণা আমার হাতটা মুঠিতে চেপে ধরে।