লালমৃত্যু

লালমৃত্যু

সেই সময় গোটা দেশজুড়ে রক্তাক্ত মৃত্যুর প্রতিধ্বনি। দেশটা যেন ধ্বংসের মুখের খাবারের মতো গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। এই রক্তাক্ত মৃত্যুটাও একধরনের ব্যাধি, যে ব্যাধির আক্রমণে সমস্ত জায়গাজুড়ে রক্তবন্যা বয়ে চলে।

এই রোগের লক্ষণ হলো প্রথমে তীব্র একটা যন্ত্রণার অনুভূতি, তারপর মাথা ঘোরা, সবশেষে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে অবিরত রক্ত ঝরা। সারা শরীরটাই রক্তের দাগে ভরে ওঠে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো এই রোগের শিকার যাতে বাইরের কোনো সাহায্য কিংবা তার পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে কোনোরকম সহানুভূতি পেতে না পারে তার জন্য শিকারের মুখটা আঠালো ফিতে দিয়ে আঁটা থাকে। এই শিকার ধরা থেকে তাকে শেষ করতে সময় লাগে মাত্র আধঘণ্টা। এই আধঘণ্টার মধ্যেই সমস্ত ঘটনাটা নিখুঁতভাবে ঘটে যায়।

এ রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের ফলে রাজকুমার প্রসপেরোর রাজ্যের লোকসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল। রাজকুমার প্রসপেরো খুব সুখী আর ভীষণ আমুদে স্বভাবের ছিলেন। তাঁর ছিল খুব সাহস আর ছিলেন বিচক্ষণ ব্যক্তি। যখন দেখলেন তার রাজ্যের লোকসংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে তখন তিনি তাঁর দরবারের হাজারখানেক যোদ্ধা আর অভিজাত মহিলাদের নিজের কাছে ডেকে পাঠালেন। তারপর নিজের তৈরি করা নির্জন দুর্গগুলোর একটাতে ওদেরকে পাঠিয়ে দিলেন।

ওদের যে দুৰ্গটায় পাঠানো হলো সেটা অদ্ভুত ধরনের দেখতে। এ থেকে রাজকুমারের নিজস্ব অভিজাত আর অদ্ভুত রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। দুর্গার চারদিক জুড়ে উঁচু আর শক্ত দেওয়াল। আর দেওয়ালটার চারদিকেই মাঝে মাঝে লোহার গেট। মানুষগুলোকে লোহার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার পর দরজার বগুলো গরম করে হাতুড়ি পিটে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হলো। এর ফলে দুর্গের মধ্যে কোনোরকম উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটলে কারো পক্ষেই বাইরে আসার উপায় ছিল না। আবার তেমনি কেউ ইচ্ছা করলেই ভিতরে ঢুকতে পারত না।

তবে দুর্গের ভিতরে সবকিছুর ব্যবস্থা ছিল। বেঁচে থাকার জন্যে যা যা প্রয়োজন সবকিছুরই সুব্যবস্থা ছিল। আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য সবরকম ব্যবস্থা এই দুর্গের ভিতরে করা হয়েছিল। আনন্দ দেওয়ার জন্য একদল সুন্দরী রমণী ছিল আর খাওয়ার জন্য ঢালাও মদের ব্যবস্থা ছিল। দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটাও ছিল খুব নিখুঁত, কোনো ভয় ছিল না। শুধু দুর্গে একটাই জিনিস ছিল না তা হচ্ছে–রক্তাক্ত মৃত্যু।

রক্তাক্ত মৃত্যুর কথা বলার আগে দুৰ্গটার বর্ণনা দিয়ে নিই। এই দুৰ্গটা ছিল সাতটা ঘর বিশিষ্ট একটা রাজকীয় অট্টালিকা। এই বিরাট ঘরগুলোর সবটা একনজরে দেখা যায় না। কারণ ঘরগুলোর দরজাগুলো অদ্ভুত ধরনের। আসলে এইরকম অসম্পূর্ণ দেখানোটাই ছিল ঘরগুলোর বৈশিষ্ট্য। কুড়ি কিংবা তিরিশ গজ অন্তর একটা করে বাঁক আর বাঁকগুলো দেখলে কেমন রহস্যময় মনে হতো। দেওয়ালের ডান-বা দুদিকেই ঠিক মাঝখানে একটা করে লম্বাটে ধরনের ভূতুড়ে জানালা। ঘরের বাইরে টানাবারান্দা। প্রতিটি ঘরেই হু হু বাতাস বইত। প্রত্যেকটা জানালায় কাঁচ লাগানো ছিল। কিন্তু জানালার কাঁচের রং অদ্ভুত ধরনের। প্রত্যেক ঘরের প্রতিটি সরঞ্জাম যে রঙের ছিল সেই ঘরের জানালার কাঁচের রঙটা ওই ঘরের সাজ-সরঞ্জামের রঙের মতো ছিল। যেমন পূর্বদিকের প্রথম ঘরের প্রতিটি সাজসরঞ্জাম নীল রঙের, তাই ঐ ঘরের জানালার কাঁচের রঙটাও নীল রঙের ছিল। দ্বিতীয় ঘরটায় বেগুনী রঙের জিনিসপত্র সাজানো ছিল, তাই ঘরের জানালার কাঁচও বেগুনী রঙের ছিল। এইভাবে তৃতীয় ঘরের জানালার কাঁচের রঙ সবুজ! চার নম্বর ঘরের জানালার কাঁচের রঙ কমলা। পাঁচ নম্বর ঘরের জানালার কাঁচের রঙ সাদা। ছয় নম্বর ঘরটার জানালার কাঁচের রঙ ছিল ধূসর। আর পশ্চিমদিকের সাত নম্বর ঘরটার প্রতিটি সাজ-সরঞ্জাম ছিল কালো রঙের। এই ঘরের কড়িকাঠ থেকে মেঝে পর্যন্ত সবকিছুই কালো রঙের ছিল। এমনকি ঝুলে থাকা পর্দাগুলো আর মেঝেয় বিছানো কার্পেটটাও কালো রঙের ছিল। কিন্তু এই সাত নম্বর ঘরের জানালার কাঁচের রঙটা ছিল আলাদা। কালো না হয়ে লাল রঙ ছিল। এই লাল রঙটা দেখলেই মনে হতো–তাজা ঘন রক্তের মতো।

দুর্গের সাতটা ঘরের মধ্যে কোনোটাতেই কিন্তু আলোর ব্যবস্থা নেই। এমনকি কড়িকাঠে ঝোলানো ঝাড়বাতি কিংবা প্রদীপ কোনোকিছুরই ব্যবস্থা ছিল না। শুধু মাঝখানে কিছু সোনার অলংকার ছাদ বেয়ে নেমে এসে এদিক-ওদিক ঝুলছে। ফলে সবগুলো ঘর ছিল আলোবিহীন। শুধু ঘরের বাইরে লম্বা বারান্দায় প্রতিটি জানালার ঠিক উলটোদিকের বারান্দাতে একটা করে তিনপায়া টুল রাখা আর এই টুলের উপর থাকত জ্বলন্ত অঙ্গারের পাত্র। এই জ্বলন্ত অঙ্গার থেকে যে আলো বের হতো তা রঙিন জানালাগুলোর কাঁচ ভেদ করে ঘরের মধ্যে যখন পড়ত তখন প্রতিটি ঘরই কেমন রহস্যময় হয়ে উঠত। যেন একটা ভৌতিক আবহাওয়া সৃষ্টি হতো। এই সাতটা ঘরের মধ্যে সবচেয়ে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হতো পশ্চিমদিকের সাত নম্বর ঘরটায়। অঙ্গারের আলো যখন ওই লাল ঘরের রক্তের কাঁচের জানালা ভেদ করে ঘরের মধ্যে দিয়ে কালো পর্দাগুলোর ও মেঝের কার্পেটের উপর পড়ত তখন ভয়ানক গা-ছম্ছ- করা একটা ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হতো। এই পরিবেশে যদি কেউ এই ঘরে ঢুকতো তখন তার মুখটায় একটা নিষ্ঠুর, ভয়ংকর ভাব ফুটে উঠত, যার জন্যে এই ঘরটাকে দুর্গের সবাই এড়িয়ে চলত। খুব কম লোকই এই সাত নম্বর ঘরটায় ঢুকতে সাহস পেতো।

সাত নম্বর ঘরটার পশ্চিমদিকের দেওয়ালে আরও একটা অদ্ভুত জিনিস রাখা ছিল। তা হচ্ছে আবলুস কাঠের মস্তবড় ঘড়ি। এই ঘড়ির পেণ্ডুলামটা ছিল বিশ্রী, কেমন যেন একঘেয়ে বিশ্রীভাবে শব্দ করে দুলতে থাকত, মিনিটের কাঁটাটা ঘুর পাক খেয়ে যখন একটা ঘণ্টা পুরো হতো তখনই ঘড়িটার পেতলের হৃৎপিন্ড ফুড়ে একটা অদ্ভুত ধরনের শব্দ বেরিয়ে আসত। শব্দটা ছিল পরিষ্কার, জোরালো ও গম্ভীর। এই শব্দের মধ্যে একটা জাদু আছে, যখনই শব্দটা হতো তখন যারা বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজাত তারা বাজনা থামিয়ে চুপটি করে শব্দ শুনত। নাচ, গান তখন সব থেমে যেত, সমস্ত কিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে যেত। সবাই যেন এই শব্দ থেকে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করত আর সবাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ত।

শব্দটা যখন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেত তখন আবার সবাই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠত। একে অন্যের দিকে তাকাত, হাসত, গল্প করত। ওদের এই হাসি, কানো দেখলেই মনে হতো সবটাই ওদের ভয়ের জন্যে। তারপর ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত, বলত আবার যখন এই শব্দটা হবে তখন ওরা এমনি করে বোকার মতো চুপ করে থাকবে না, কিন্তু ওদের বালাই সার হতো। সেই ষাট মিনিট অর্থাৎ তিন হাজার ছশো সেকেন্ড পরে ঘড়িটা আবার এই অদ্ভুত সুরে বেজে উঠত, তখন ওদের আগের কথা মনে থাকত না। আগের মতো সবকিছু থেমে যেত, মানুষগুলো সব বোকার মতো নিশ্চুপ হয়ে যেত, ওরা সবাই কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করত। প্রতি ঘণ্টায় এইরকম অদ্ভুত শব্দ শুনে চুপ করে গেলেও ওদের আনন্দের অনুষ্ঠান ঠিকভাবেই চলত। তাতে কোনোরকম ত্রুটি ছিল না।

এই সাত নম্বর ঘরের সমস্ত সাজসজ্জা রাজকুমার প্রসপেনোর রুচি অনুযায়ীই সাজানো হয়েছে, এতেই ওঁর অদ্ভুত ধরনের রুচির পরিচয় আমরা পাই। তাছাড়া তার পরিকল্পনা অনুযায়ী সমস্ত অনুষ্ঠনগুলো চলত। এই সব কিছু মিলিয়ে শুধু একটাই পরিবেশ সৃষ্টি হতো যেটা হচ্ছে গতিময় ও ভৌতিক আবহাওয়ার, অবশ্য হারমানি দেখার পর থেকেই রাজকুমারের মাথায় এইসব অদ্ভুত অদ্ভুত পরিকল্পনাগুলো এসেছে। তাছাড়া এখানকার মানুষগুলো সবকিছুই দেখলে মনে হয় কোনোকিছু সুস্থ নয়, সব কেমন এলোমেলো, অগোছালো।

নির্জন, নিখুঁত নিরাপদ থাকার দুর্গের মধ্যে সবাই খুবই আনন্দের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। এইভাবে প্রায় পাঁচ-ছয় মাস কেটে গেল। হঠাৎ ষষ্ঠ মাস শেষ হওয়ার আগেই সেই অভিশপ্ত ব্যাধির আক্রমণ শুরু হলো। ঘটনাটা যেদিন ঘটে সেদিন রাজকুমার প্রসপেরো তার হাজারখানেক প্রজার সঙ্গে নাচ গানের আসরে আনন্দে, উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন। ঘরগুলো সব যেন ভয়াবহ মনে হতে থাকে। মনে হলো, ঘরের রঙ যেন তারা চুষে নিচ্ছে। হঠাৎ আবলুস কাঠের সেই ঘড়িটার শব্দ বাজতে থাকে যার ফলে বাদ্যযন্ত্রের বাজনা থেমে যায়, চারদিকে নিস্তব্ধ-নীরবতা নেমে আসে। সবাই যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

শব্দটা থামতেই আবার বাদ্যযন্ত্রগুলো বেজে ওঠে; সবাই হাসি-গল্পে মুখর হয়ে ওঠে। আনন্দ-ফুর্তির বন্যা বয়ে চলে। তিনপায়া টুলে রাখা সেই জ্বলন্ত অঙ্গারের আলো রঙিন কাঁচের জানালাগুলো ভেদ করে ঘরে বিভিন্ন রঙের পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে। সবগুলো ঘরের মধ্যে সাত নম্বর ঘরটা আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ( উৎসবের রাত ক্রমশ বেড়ে চলে। লাল জানালার কাঁচ খুঁড়ে রক্তের মতো লাল আলো সাত নম্বর ঘরটার কালো রঙের সাজ-সরঞ্জামের উপর এসে পড়তে থাকে আর ঠিক তখনই একটা মূর্তি সাত নম্বর ঘরের কালো কার্পেটে পা রাখে, তার দেহটা লাল আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঠিক সেই সময়ে আবলুস কাঠের ঘড়িটা সুরেলা ছন্দে বেজে ওঠে, অন্যসব ঘরের লোকেরা সেই শব্দ শুনতে পায়, শুধু সাত নম্বর ঘরটা ছাড়া বাকি ঘরগুলোতে লোকের ভিড়। ওদের এই উৎসব চলে মাঝরাত অবধি।

প্রতিদিনই প্রতি ঘণ্টায় ঘড়ির শব্দে ওদের নাচ, গান, কথাবার্তা সব থেমে যায়। আজ আবার শব্দটা আরম্ভ হতেই রোজকার মতো সব থেমে গেল। মানুষগুলোর মধ্যে একটা বিহ্বলতা নেমে আসে। তারপর যখন ঘড়িটার শেষ শব্দটা খুব আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়, ঠিক তখনই ভিড়ের মধ্যে অনেকেই একজন মুখোশধারীর অস্তিত্ব টের পায়, যাকে একমুহূর্ত আগেও দেখা যায়নি। সকলেই এই অদ্ভুত আকৃতির লোকটার উপস্থিতি নিয়ে চাপারে ফিসফিস করে আলোচনা করতে থাকে। সবার চোখে বিস্ময়, তীব্র আতঙ্ক, ভয়ে সবাই মরিয়া হয়ে ওঠে। অদৃশ্য মূর্তিটার আকৃতিটাও বীভৎস, বিরাট লম্বা দৈত্যের মতো দেখতে, পা থেকে মাথা যেন রহস্যের আবরণে ঢাকা, মুখে মুখোশ, পোশাক-পরিচ্ছদগুলো সব ঘন লাল রক্তবর্ণ, দেখলেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে।

সেই সময় রাজকুমার প্রসপেনোর চোখ ঐ ভূতুড়ে মূর্তিটার উপর গিয়ে পড়ে। মূর্তিটাকে লক্ষ্য করে কর্কশ গলায় বলে ওঠেন–এতদূর স্পর্ধা?

মূর্তিটা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, রাজকুমার ওর সাহস দেখে খেপে ওঠেন। রুক্ষস্বরে বলেন–ওর স্পর্ধা তো কম নয়। আমাদের উপহাস করছে, অপমান করছে। ওকে তোমরা সবাই মিলে ধরো, ওর মুখোশটা খুলে দাও। তাহলে বুঝতে পারব আগামীকাল ভোরে কাকে আমরা ফাঁসিকাঠে ঝোলাচ্ছি।

রাজকুমার প্রসপেরো পূর্বদিকের নীল ঘরটায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন। আর এই ঘরেই ঘটনার প্রথম সূত্রপাত। ওঁর হাতের ইশারায় সমস্ত বাজনা থেমে গেল। রাজকুমার তখন নিজের দলের লোকজনদের নিয়ে একইভাবে ঘরটার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকেন। দলের লোকজন মুখোশধারী দৈত্যের দিকে এগিয়ে যায় তাকে ধরার জন্য।

কিন্তু মূর্তিটা সেদিক কোনোরকম লক্ষ্য না করেই এগিয়ে যায় রাজকুমারের দিকে। একটা অজানা আতঙ্কে সবাই থেমে যায়, কারও সাহসে কুলোয় না মূর্তিটাকে জাপটে ধরতে। ততক্ষণে মূর্তিটা রাজকুমার প্রসপেয়োর সবচাইতে কাছের লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওদের মধ্যে দূরত্ব মাত্র গজখানেকের মতো। এবার মূর্তিটা ঘরের মাঝখানটা পার হয়ে একেবারে শেষপ্রান্তে দেওয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ভয়ংকর মূর্তিটা নিজের যাওয়ার রাস্তা করে নেয়, ওর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন মাপা আর জোরালো। প্রথমে মূর্তিটা নীল রঙের ঘর থেকে ছুটে যায় বেগুনী রঙের ঘরে, সেখান থেকে যায় সবুজ রঙের ঘরে, তারপর কমলা রঙের ঘরে ঢোকে। এ ঘরে এসে মূর্তিটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

রাজকুমার প্রসপেরোর মধ্যে ক্রোধ আর ভয় দুটোই কাজ করতে থাকে। মনে মনে ভীষণ খেপে ওঠেন। তার সঙ্গে একটা ভয়মিশ্রিত লজ্জা আর অপমানে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি মূর্তিটার পিছন পিছন ধাওয়া করে চলেন। কিন্তু ওঁর সঙ্গীরা কেউই তাকে অনুসরণ করে না। রাজকুমার প্রসপেরো মূর্তিটার পিছন পিছন একের পর এক ঘরে ঢোকেন, হাতে তার ঝকঝকে ছুরি, যার তীক্ষ্ণ ফলাটা চৰ্চ করে ওঠে প্রতিহিংসা, অপমান ও ক্রোধে।

সবশেষে রাজকুমার প্রসপেরো আর দৈত্যটা সাত নম্বর ঘরে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। রক্তের মতো লাল আলো ঘরের মধ্যে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। একটু পরে ঘরের ভেতর থেকে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ গোটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। রাজকুমারের তীক্ষ্ণ ফলাওয়ালা ছুরিটা কালো কার্পেটের উপর ছিটকে যায় আর রাজকুমার প্রসপেয়োর রক্তাক্ত মৃতদেহটা কালো কার্পেটের উপর আছড়ে পড়ে।

তারপরের ঘটনাগুলো খুবই দ্রুত ঘটে যায়। সবাই তখন আতঙ্কে, ভীত বিহ্বল হয়ে পড়ে। কারও কোনোকিছু করার ক্ষমতা থাকে না। হঠাৎ রাজকুমারের তীক্ষ্ণ চিৎকার ওদের সবাইকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। এবার সবাই মরিয়া হয়ে মনের সাহস জোগাড় করে ছুটে যায় লাল রঙের ঘরটার দিকে। হুড়মুড় করে সবাই ঘরে ঢুকে পড়ে দেখতে পায় সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা, যা দেখে ওরা আতঙ্কে শিউরে ওঠে, মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে যায়।

সবাই আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখে সামনে সেই আবলুস কাঠের ঘড়িটার ঠিক পিছনে লম্বা, বিকট আর ভয়ঙ্কর দৈত্যটা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হয় পাথরের খোদাই-করা একটা মূর্তি নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে। কবর থেকে উঠে আসা মুখোশধারী মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে মৃত্যুভয়ে সবার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। প্রত্যেকেই রক্তাক্ত মৃত্যুর উপস্থিতি টের পায়। সবাই বুঝতে পারে এই মূর্তিটা হচ্ছে একটা পিশাচ। মানুষের রক্তেই যার খিদে মেটে। মাঝরাতে যে সকলের অলক্ষ্যে চোরের মতো এই দুর্গে ঢুকে পড়েছে।

তারপর থেকে চলে একের-পর-এক রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড। আর তার সাথে সাত নম্বর ঘরটায় রক্তের স্রোত বয়ে চলে। দুর্গের সবাই মৃত্যুভয়ে দিশেহারা হয়ে ওঠে। এই ভয়ংকর রক্তাক্ত মৃত্যুর থেকে বাঁচার জন্য সবাই মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু পালানোর কোনো পথই নেই ওদের। এইভাবে একের-পর-এক মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে, তার সাথে দুৰ্গটা জনশূন্য হয়ে পড়ে। আবলুস কাঠের অদ্ভুত ঘড়িটা স্তব্ধ হয়ে যায়, বাইরের বারান্দায় রাখা জ্বলন্ত অঙ্গারগুলো নিভে যায়, মানুষহীন দুর্গ জুড়ে একটা রহস্যময় গভীর অন্ধকার নেমে আসে। শুধু এই দুৰ্গটার মধ্যে বেঁচে থাকে একরাশ অন্ধকার আর মৃত্যু। রক্তাক্ত মৃত্যু তার আধিপত্য বিস্তার করে বেঁচে থাকে এই রহস্যময় দুর্গের মধ্যে। আর তার অভিশপ্ত ব্যাধির বিস্তার ঘটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *