ঘাতক
খুন হয়ে যাচ্ছে, এই ভয়টা যেদিন থেকে পেয়ে বসল ওকে, সাহস করে কথাটা কাউকে বলতে পারেনি। আশঙ্কাটা একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল, গত কয়েকমাস ধরে, ধীরে ধীরে প্রবল হচ্ছিল সন্দেহ, ছোট্ট কয়েকটা ঘটনা সেটাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। গভীর এবং তীব্র এক স্রোতের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে সে এই মুহূর্তে, নিচের দিকে প্রচণ্ড জোরে কে যেন টানছে ওকে, কালো এবং বিশাল এক গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে। অষ্টগুড়, টেনিস বল সাইজের ড্যাবডেবে চোখওয়ালা বিকট চেহারার কী ওটা? গোল গোল, চাকা চাকা দাগ শুড়লোর, এক সঙ্গে প্রসারিত হলো সবকটা একটা ঝিলিক দেখল সে শুধু, পরক্ষণে টের পেল হিলহিলে গুঁড়গুলো তাকে বেঁধে ফেলেছে ঠাণ্ডা, কঠিন নিষ্পেষণে। মুখ হাঁ হয়ে গেল তার, চিৎকার দিতে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে..
ঘরটাকে তার মনে হলো বিশাল এক সমুদ্র, ভেসে আছে সে। কিন্তু চারপাশে ওরা কারা? সাদা মুখোশ পরা, হাতে ধারাল যন্ত্রপাতি, কথা বলছে নিচু স্বরে। কে আমি, ভাবার চেষ্টা করল সে; কি নাম আমার?
শায়লা হক। বিদ্যুৎচমকের মত নিজের নামটা মনে পড়ল তার। মাহবুবুল হকের স্ত্রী। কিন্তু তারপরও অস্বস্তিবোধটা দূর হলো না। নিজেকে তার ভীষণ একা এবং অসহায় মনে হচ্ছে মুখোশধারী লোকগুলোর মাঝে। প্রচণ্ড ব্যথা তার শরীরে, বমি উগরে আসতে চাইছে, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মৃত্যুভয়।
আমি ওঁদের চোখের সামনে খুন হয়ে যাচ্ছি, ভাবল শায়লা। এই ডাক্তার কিংবা নার্সরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারছেন না আমার শরীরে কি ভয়ঙ্কর একটা জিনিস ঘাপটি মেরে আছে। জানে না মাহবুবও। শুধু আমি জানি। আর জানে ওই খুনেটা-খুদে গুপ্তঘাতক।
মারা যাচ্ছি আমি। কিন্তু কাউকে কথাটা বলতে পারছি না। আমার সন্দেহের কথা শুনলে ওঁরা হাসবেন, বিদ্রূপ করে বলবেন প্রলাপ বকছি। কিন্তু খুনেটাকে ওরা ঠিকই কোলে তুলে নেবেন, ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করবেন না আমার মৃত্যুর জন্যে ওটাই দায়ি। শুধু সবাই শোক প্রকাশ করবে আর আমার খুনীর জন্যে সবার দরদ উথলে পড়বে।
মাহবুব কোথায়? অবাক হলো শায়লা। নিশ্চয়ই ওয়েটিং রূমে। একটার পর একটা সিগারেট ফুকছে আর ঘড়ির দিকে একঠায় তাকিয়ে অপেক্ষা করছে কখন শুনবে সংবাদটা। শায়লার শরীর হঠাৎ ঘেমে গোসল হয়ে গেল, প্রচণ্ড ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল ও। এবার! আসছে ওটা! আমাকে খুন করতে আসছে! চিৎকার শুরু করল সে। কিন্তু আমি মরব না! কিছুতেই মরব না!
বিশাল এক শূন্যতা গ্রাস করল শায়লাকে। খালি খালি লাগল পেট। ব্যথাটা হঠাই চলে গেছে। প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগল নিজেকে। অন্ধকারের একটা পর্দা দ্রুত নেমে আসছে চোখের ওপর। হে খোদা, আঁধারের রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে ভাবল শায়লা, শেষ পর্যন্ত ঘটেছে তাহলে ব্যাপারটা…।
পায়ের শব্দ শুনতে পেল শায়লা। আস্তে আস্তে কে যেন হেঁটে আসছে। দূরে, একটা কণ্ঠ বলে উঠল, ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ওকে এখন ডিস্টার্ব কোরো না।
পরিচিত শেভিং লোশনের সুঘ্রাণ স্বর্গের শান্তি বইয়ে দিল শায়লার শরীরে। মাহবুব। ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কণ্ঠটা ডা. মোখলেসুর রহমানের।
চোখ খুলল না শায়লা। নরম গলায় বলল, আমি জেগে আছি। অবাক কাণ্ড। কথা বলছে সে। তার মানে মারা যায়নি তো!
শায়লা! অনুভব করল ওর হাতদুটো উষ্ণ আবেগে চেপে ধরেছে মাহবুব।
তুমি খুনেটার সঙ্গে দেখা করতে চাইছ, মাহবুব, ভাবল শায়লা। আমি শুনতে পাচ্ছি তুমি ওটাকে দেখতে চাইছ, তাহলে আমার আর কিছুই বলার নেই। চোখ খুলল শায়লা। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মাহবুব। দুর্বল হাতটা বাড়াল শায়লা, শুজনিটা সরাল একপাশে।
ঘাতক তাকাল মাহবুবের দিকে। তার ছোট্ট মুখটা লাল, কালো গভীর চোখ জোড়া শান্ত। ঝিকমিক করছে।
ইসসিরে! হেসে উটল মাহবুব। কি সুন্দর আমার সোনাটা! চুমু খাওয়ার জন্য ঝুঁকল সে, আস্তিন ধরে টান দিলেন ডা. মোখলেসুর রহমান।
না, না, এখন নয়, পরে, বললেন তিনি। নবজাতক শিশুকে এভাবে চুমু খেতে নেই। তুমি আমার চেম্বারে এসো। কথা আছে।
যাওয়ার আগে শায়লার হাতে চাপ দিল মাহবুব। কৃতজ্ঞ গলায় বলল, ধন্যবাদ, শায়লা। অসংখ্য ধন্যবাদ।
ক্লিষ্ট হাসল শায়লা। কিছু বলল না।
ডাক্তারের রূমে ঢুকল মাহবুব। হাত ইশারায় ওকে বসতে বললেন মোখলেসুর রহমান। একটা সিগারেট ধরালেন। গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ চুপচাপ টানলেন ওটা। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। সোজা তাকালেন মাহবুবের চোখে।
বাচ্চাটাকে তোমার স্ত্রী মেনে নিতে পারছে না, মাহবুব।
কি!
ওর জন্য খুব কঠিন সময় গেছে। তোমাকে তখন বলিনি তোমার টেনশন বাড়বে বলে। ডেলিভারী রূমে শায়লা হিস্টিরিয়া রোগীর মত চিৎকার করে অদ্ভুত সব কথা বলছিল- আমি ওগুলো রিপিট করতে চাইছি না। তবে বুঝতে পারছি বাচ্চাটাকে সে নিজের বলে ভাবতে পারছে না। তবে এর কারণটা আমি তোমাকে দুএকটা প্রশ্ন করে জানতে চাই। সিগারেটে বড় একটা টান দিলেন ডাক্তার, একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললেন, বাচ্চাটা কি ওয়ান্টেড চাইল্ড মাহবুব?
একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
জানাটা খুব জরুরি।
অবশ্যই সে ওয়ান্টেড চাইল্ড, আমরা একসঙ্গে এ নিয়ে প্ল্যান করেছি। শায়লা তখন কত খুশি–।
হুমম-সমস্যা তো হয়েছে ওখানেই। যদি বাচ্চাটা আনপ্ল্যানড হত তাহলে ব্যাপারটাকে সাধারণ একটা কেস বলে ধরে নিতাম। অপ্রত্যাশিত শিশুকে বেশিরভাগ মা-ই ঘৃণা করে। কিন্তু শায়লার ক্ষেত্রে এটা ঠিক মিলছে না।
মোখলেসুর রহমান সিগারেটটা ঠোঁট থেকে আঙুলের ফাঁকে ধরলেন, অন্য হাত দিয়ে চোয়াল ঘষতে ঘষতে বললেন, তাহলে ব্যাপারটা অন্যকিছু হবে। হয়তো শৈশবের কোন ভীতিকর স্মৃতি ওর তখন মনে পড়েছে। কিংবা আর সব মায়ের মতই সন্তান জন্ম দেবার সময় মৃত্যুভয় ওকে কাবু করে ফেলেছিল। যদি এরকম কিছু হয় তাহলে দিন কয়েকের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে, মাহবুব একটা কথা-শায়লা যদি তোমাকে বাচ্চাটার ব্যাপারে কিছু বলে… মানে… ইয়ে, সে চেয়েছিল বাচ্চাটা মৃত জন্ম নিক, তাহলে কিন্তু শ হয়ো না। আশা করছি সব ঠিক থাকবে। আর যদি কোন সমস্যা দেখা দেয় তাহলে ওদেরকে নিয়ে এই ব্যাচেলর বুড়ো ডাক্তার চাচার চেম্বারে চলে এসো কেমন? তোমাদেরকে এমনিতেও দেখতে পেলে খুবই খুশি হব।
ঠিক আছে, চাচা। শায়লা একটু সুস্থ হলেই সপরিবারে আপনার বাসায় আবার যাব।
.
চমৎকার একটি দিন। মৃদু গুঞ্জন তুলে টয়োটা স্কারলেট ছুটে চলেছে লালমাটিয়ার দিকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মাহবুব। আহা, কি সুন্দর নীল আকাশটার রঙ! কাঁচ নামিয়ে দিল ও। রাস্তার পাশের একটা ফুলের দোকান থেকে রজনীগন্ধার সুবাস ঝাঁপটা মারল নাকে। প্রাণভরে গন্ধটা টানল মাহবুব। বেনসনের আনকোরা প্যাকেটটার সেলোফেন ছিঁড়ে একটা সিগারেট জল ঠোঁটে। টুকটাক কথা বলছে। শায়লার সঙ্গে। শায়লা হালকাভাবে জবাব দিচ্ছে। বাচ্চাটা ওর কোলে। মাহবুব খেয়াল করল আলগোছে ধরে আছে সে ছোট্ট মানুষটাকে। মাতৃসুলভ কোন উষ্ণতা প্রকাশ পাচ্ছে না শায়লার আচরণে। যেন কোলে শুয়ে আছে চীনে মাটির একটা পুতুল। ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করল মাহবুব।
আচ্ছা! শিস দিয়ে উঠল ও।খোকন সোনার কি নাম রাখব আমরা?
শায়লা বাইরের সবুজ গাছগাছালি দেখতে দেখতে উদাসীন গলায় বলল, এখনও ঠিক করিনি। তবে একদম ভিন্নরকম কোন নাম রাখতে চাই আমি। এখনই এ নিয়ে গবেষণায় বসতে হবে না। আর দয়া করে বাচ্চার মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ো না তো। বলল বটে, কিন্তু এ যেন নিছক বলার জন্যই বলা।
শায়লার গা ছাড়া ভাব আহত করল মাহবুবকে। সিগারেটটা ফেলে দিল জানালা দিয়ে। দুঃখিত, বলল ও।
বাচ্চাটা চুপচাপ শুয়ে আছে তার মায়ের কোলে। দ্রুত অপসৃয়মান গাছের ছায়ারা খেলা করছে তার মুখে। কালো চোখ দুটো খোলা। ছোট্ট, গোলাপি, রবারের মত মুখ হাঁ করে ভেজা শ্বাস ফেলছে।
শায়লা একপলক তাকাল তার বাচ্চার দিকে। শিউরে উঠল।
ঠাণ্ডা লাগছে? জানতে চাইল মাহবুব।
অল্প। কাঁচটা উঠিয়ে দাও, মাহবুব, ঠাণ্ডা গলায় বলল শায়লা।
মাহবুব ধীরে জানালার কাঁচ ওঠাল।
.
দুপুর বেলা।
মাহবুব খোকন সোনাকে নার্সারী রূম থেকে নিয়ে এসেছে, উঁচু একটা চেয়ারের চারপাশে অনেকগুলো বালিশ রেখে তার মধ্যে শোয়াল ওকে।
শায়লা প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, ওকে অত উঁচু চেয়ারে শুইয়ো না। পড়েটড়ে যাবে।
আরে না, পড়বে না। দেখো টুটুবাবু এখানেও দিব্যি আরামে ঘুমাবে। হাসছে মাহবুব। খুব ভালো লাগছে ওর। দেখো, দেখো, বাবু সোনার মুখ দিয়ে লালা পড়ে কেমন চিবুক ভিজিয়ে দিয়েছে! তোয়ালে দিয়ে বাচ্চার মুখ মুছে দিল মাহবুব। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল এদিকে তাকিয়ে নেই শায়লা।
বুঝলাম সন্তান জন্ম নেবার সময়টা খুব সুখকর কিছু নয়, চেয়ারে বসতে বসতে বলল মাহবুব। কিন্তু সব মায়েরই তার বাচ্চার প্রতি কিছু না কিছু মায়া থাকে।
ঝট করে মুখ তুলল শায়লা। ওভাবে বলছ কেন? ওর সামনে এসব কথা কক্ষনো বলবে না। পরে বোলো। যদি তোমার বলার এত ইচ্ছে থাকে।
কিসের পরে! সংযম হারাল মাহবুব। ওর সামনে বললেই বা কি আর পেছনে বললেই বা কি? হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল ও। ডাক্তারের কথা মনে পড়ে গেছে। শায়লার মানসিক অবস্থা এখন ভালো নয়। ওর সঙ্গে রাগারাগি করা চলবে না। ঢোক গিলল মাহবুব। নিচু গলায় বলল, দুঃখিত, শায়লা।
কোন কথা বলল না শায়লা। প্রায় নিঃশব্দে শেষ হলো ওদের মধ্যাহ্ন ভোজন।
রাতে, ডিনারের পর, মাহবুব বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেল ওপরে। শায়লা ওকে কিছু বলেনি। কিন্তু ওর নীরব অভিব্যক্তি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছিল কাজটা মাহবুবকেই করতে হবে।
নার্সারীতে খোকন সোনাকে রেখে নিচে নেমে এল মাহবুব। ক্যাসেট প্লেয়ারে রবীন্দ্র সঙ্গীত চাপিয়েছে শায়লা, সম্ভবত-শুনছে না। ওর চোখ বন্ধ, আড়ষ্টভাবে শুয়ে আছে বিছানায়। শব্দহীন পায়ে এগিয়ে এল মাহবুব। দাঁড়াল শায়লার পাশে। একটা হাত রাখল চূর্ণ কুন্তলে। চমকে চোখ মেলে চাইল শায়লা। স্বামীকে দেখে স্বস্তি ফুটে উঠল দুচোখের তারায়। যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর শরীরে, জড়িয়ে ধরল সে মাহবুবকে। মাহবুব টের পেল ওর আড়ষ্ট শরীর ধীরে ধীরে নমনীয় হয়ে যাচ্ছে, যেন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল কোন কারণে, এখন পরম আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে স্বামীর বুকে। মাহবুব ওর ঠোঁট খুঁজল। অনেকক্ষণ এক হয়ে থাকল দুজোড়া অধর।
তুমি, তুমি খুব ভালো, মাহবুব! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল শায়লা। কত নিশ্চিন্তে তোমার ওপর ভরসা করতে পারি আমি! এত নির্ভরযোগ্য তুমি!
হাসল মাহবুব। বাবা বলতেন- পুত্র মনে রেখো, তোমার সংসারে তুমিই একমাত্র অবলম্বন।
কালো, উজ্জ্বল কেশরাজি ঘাড় থেকে সরাল শায়লা। তোমার বাবার যোগ্য পুত্রই হয়েছ বটে। তোমাকে পেয়ে এত সুখী আমি। জানো, প্রায়ই আমি ভাবি এখনও যেন আমরা নবদম্পতিই রয়ে গেছি। আমাদের নিজেদের ছাড়া আর কারও কথা ভাবতে হচ্ছে না, কারও দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না, আমাদের কোন সন্তান নেই।
মাহবুবের হাত দুটো নিজের গালে ছোঁয়াল শায়লা। হঠাৎ অস্বাভাবিক সাদা হয়ে উঠেছে তার মুখ।
ওহ, মাহবুব, একটা সময় ছিল যখন ছিলাম শুধু তুমি আর আমি। আমরা পরস্পরকে নিরাপত্তা দিতাম। আর এখন এই বাচ্চাটাকে আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে, কিন্তু বদলে তার কাছ থেকে কোন নিরাপত্তা পাব না। আমি কি বলতে চাইছি তুমি বুঝতে পারছ। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে আমি কত কিছু চিন্তা করেছি। দুনিয়াটা হচ্ছে একটা মন্দ জায়গা
তাই কি?
হ্যাঁ, তাই। কিন্তু আইন সকল মন্দ থেকে আমাদের রক্ষা করে। যখন আইন বলে কিছু থাকে না তখন ভালোবাসা নিরাপত্তার সন্ধান দেয়। আমি তোমাকে আঘাত করছি, কিন্তু আমার ভালোবাসা তোমাকে রক্ষা করছে। যদি ভালোবাসা না থাকত তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই অসহায় হয়ে পড়ত। আমি তোমাকে ভয় পাই না। কারণ আমি জানি তুমি আমার ওপর যত রাগ করো, বকা দাও, খারাপ ব্যবহার করো, সবকিছুর ওপর ছাপিয়ে ওঠে আমার প্রতি তোমার গভীর প্রেম, নিবিড় ভালোবাসা। কিন্তু বাচ্চাটা? ও এত ছোট যে ভালোবাসা কিংবা অন্য কোন কিছুই সে বুঝবে না যতক্ষণ না আমরা তাকে ব্যাপারটা বোঝাই। যেমন ধরো, ও কি এখন বুঝবে কোনটা ডান আর কোনটা বাম?
এখন বুঝবে না। তবে সময় হলে শিখে নেবে।
কিন্তু…। কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল শায়লা, নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মাহবুবের বাহুবন্ধন থেকে।
কিসের যেন শব্দ শুনলাম!
মাহবুব চারদিকে চাইল। কই, আমি তো কিছু শুনিনি…।
লাইব্রেরি ঘরের দরজার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে শায়লা। ওই ওখানে, ফিসফিস করে বলল সে।
ঘর থেকে বেরুল মাহবুব, খুলল লাইব্রেরি ঘরের দরজা। আলো জ্বেলে এদিক ওদিক চাইল। কিছু চোখে পড়ল না। আলো নিভিয়ে আবার ফিরে এল শায়লার কাছে। নাহ্, কিচ্ছু নেই, বলল ও। তুমি আসলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। নাও, এখন শুতে চলো দেখি।
নিচতলার সব আলো নিভিয়ে ওরা উঠে চললো ওপরে। সিঁড়ির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে শায়লা বলল, অনেক আজেবাজে কথা বলেছি, মাহবুব। কিছু মনে কোরো না। আসলেই আমার শরীরটা তেমন ভালো নেই।
শায়লার কাঁধে হাত রাখল মাহবুব। মৃদু চাপ দিল। কিছু মনে করেনি সে।
নার্সারী রূমের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল শায়লা, ইতস্তত করছে। তারপর হাত বাড়াল পেতলের নবের দিকে, দরজা খুলে পা রাখল ভেতরে। খুব সাবধানে এগিয়ে চলল বাচ্চার দোলনার দিকে। ঝুঁকল শায়লা, সঙ্গে সঙ্গে কাঠ হয়ে গেল শরীর। মাহবুব! চিৎকার করল ও।
দৌড় দোলনার কাছে চলে এল মাহবুব।
.
বাচ্চাটার মুখ টকটকে লাল, সম্পূর্ণ ভেজা; ছোট্ট হাঁ-টা বারবার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে; চোখদুটো যেন জ্বলছে রাগে। হাতজোড়া সে উঠিয়ে রেখেছে শূন্যে, যেন বাতাস খামচে ধরার চেষ্টা করছে।
আহারে, দরদ ঝরে পড়ল মাহবুবের গলায়, বাবু সোনাটা না জানি কতক্ষণ ধরে কেঁদেছে!
কেঁদেছে? শায়লা দোলনার একটা পাশ আঁকড়ে ধরল ভারসাম্য রক্ষার জন্য। কই, কান্নার আওয়াজ তো শুনলাম না।
দরজা বন্ধ, শুনবে কি করে?
এ জন্যই বোধহয় ওর মুখ এত লাল আর এত জোরে শ্বাস টানছে?
অবশ্যই। আহারে, আমার সোনা রে। অন্ধকারে একা কেঁদে কেঁদে না জানি কত কষ্ট পেয়েছে। আজ রাতে ওকে আমাদের ঘরে নিয়ে যাই, কি বলো? এখানে একা থাকলে আবার যদি কাঁদে।
আদর দিয়ে দিয়ে তুমিই ওকে নষ্ট করবে, বলল শায়লা।
কোন কথা না বলে বাচ্চাটাকে দোলনা সহ নিজেদের শোবার ঘরে নিয়ে চলল মাহবুব। টের পেল শায়লার চোখ তাদেরকে অনুসরণ করছে।
.
নিঃশব্দে কাপড় ছাড়ল মাহবুব। বসল খাটের এক কোনায়। হঠাৎ কি মনে পড়তে হাতের তালুতে ঘুসি মারল ও।
ধুত্তুরি ছাই! তোমাকে তো বলতে ভুলেই গেছি। আমাকে সামনের শুক্রবার আবার হংকং যেতে হবে।
আবার হংকং কেন?
যাওয়ার কথা ছিল তো আরও দুমাস আগে। তোমার কথা ভেবে যাওয়াটাকে পিছিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওদিকের অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে না গেলেই নয়।
কিন্তু তুমি গেলে যে আমি একদম একা হয়ে পড়বে।
তোমার জন্য নতুন কাজের একটা বুয়া ঠিক করেছে আউয়াল। মহিলা শুক্রবার আসবে। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া আমি তো মাত্র অল্প কটা দিন থাকব।
তবুও আমার ভয় করছে। কেন জানি না এত বড় বাড়িতে একা থাকার কথা ভাবলেই বুকটা গুড়গুড় করে ওঠে। আমি যদি তোমাকে সব কথা খুলে বলি তুমি নির্ঘাত আমাকে পাগল ঠাওরাবে। আমার মনে হচ্ছে আমি বুঝি পাগল হয়ে যাব।
বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল মাহবুব। ঘরের বাতি নেভানো। অন্ধকারে বিছানার ধারে হেঁটে এল শায়লা, লেপটা তুলল, ঢুকল ভেতরে। ক্রিমের মিষ্টি গন্ধ নাকে ভেসে এল, রমণীর উষ্ণ শরীর উত্তেজিত করে তুলল মাহবুবকে, সে শায়লাকে জড়িয়ে ধরল। তুমি যদি আমাকে আরও কয়েকটি দিন পরে যেতে বলল তাহলে আমি–
না, শরীর থেকে মাহবুবের হাতটাকে আস্তে সরাল শায়লা। তুমি যাও। আমি জানি ব্যাপারটা জরুরী। আমি আসলে তোমাকে যে কথাগুলো তখন বললাম সেগুলো সম্পর্কে এখন ভাবছি। আইন, ভালোবাসা এবং নিরাপত্তা। আমার ভালোবাসা তোমাকে নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু বাচ্চাটা- শ্বাস টানল ও। তোমাকে সে কী নিরাপত্তা দেবে, মাহবুব?
কি বলা যায় ভাবছিল মাহবুব। বলবে কিনা যে সে যতসব আজগুবি ব্যাপার নিয়ে অহেতুক চিন্তা করে মরছে? এমন সময় খুট করে বেড সুইচ টিপল শায়লা। সাদা আলোয় উদ্ভাসিত হলো বেডরূম।
দ্যাখো, আঙুল দিয়ে নির্দেশ করল শায়লা।
বাচ্চাটা শুয়ে আছে দোলনায়। কালো চকচকে চোখ মেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
আবার বাতি নেভালো শায়লা। সরে এল মাহবুবের দিকে। থরথর করে কাঁপছে ওর শরীর।
যাকে আমি জন্ম দিয়েছি তাকে এত ভয় পাব কেন, সায়লার ফিসফিসে কণ্ঠ কর্কশ এবং দ্রুত হয়ে উঠল। কারণ ও আমাকে খুন করতে চেয়েছে। ও ওখানে। শুয়ে আছে, আমাদের সব কথা শুনছে, সব বুঝতে পারছে। অপেক্ষা করছে কবে। তুমি বাইরে যাবে আর সে আবার আমাকে খুন করার চেষ্টা চালাবে। খোদার কসম বলছি! কান্নায় গলা বুজে এল শায়লার।
প্লীজ! ওকে থামাতে চেষ্টা করল মাহবুব। কেঁদো না প্লীজ!
অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল শায়লা অন্ধকারে। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে থাকল। আস্তে-আস্তে কাঁপুনিটা কমে এল, নিঃশ্বাস হয়ে উঠল স্বাভাবিক এবং নিয়মিত। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
চোখ লেগে এল মাহবুবেরও।
ঘুমের গভীরতর স্তরে যেতে যেতে একটা শব্দ শুনল সে।
ছোট্ট, ভেজা, রবারের ঠোঁট থেকে চটচটে শব্দ। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল মাহবুব।
.
সকালবেলা ঝরঝরে মন নিয়ে ঘুম থেকে জাগল ওরা। শায়লা মধুর হাসল স্বামীর দিকে চেয়ে। হাতঘড়িটা দোলনার ওপর দোলাল মাহবুব, সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল কাঁচ। দেখো, বাবু, দেখো, কি চকচকে, কি সুন্দর! কি চকচকে, কি সুন্দর! সুর করে বলছে সে।
আবারও হাসল শায়লা স্বামীর ছেলেমানুষী দেখে। মনে এখন ওর আর কোন শঙ্কা নেই। মাহবুব নিশ্চিন্তে তার ব্যবসার কাজে হংকং যেতে পারে। ভয় পাবে না শায়লা। বাবুর যত্ন ঠিক নিতে পারবে সে।
শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ বিমানের ডিসি-১০-এ উড়াল দিল মাহবুব। নীল আকাশ, পেঁজা তুলো মেঘ আর সূর্যের ঝকঝকে সোনালি রশ্মি ছুঁয়ে গেল ওকে। ফ্রেশ মুড নিয়ে হংকং-এর এয়ারপোর্টে পা রাখল ও। শেরাটন হোটেলে আগেই রূম বুক করা ছিল। ওখানে উঠে প্রথমেই লং ডিসট্যান্স কলে শায়লাকে ফোন করে জানাল, সে ঠিকঠাক মত পৌঁছেছে। এক্সপেক্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা ওর। পরবর্তী ছটা দিন ঝড় বয়ে গেল ওর ওপর দিয়ে একটা বিজনেস ডিল করতে গিয়ে। এর মধ্যে একদিন ঢাকায় ফোন করল ও। কিন্তু ওদিক থেকে কোন সাড়া পেল না। ফোন ডেড। তবে চিন্তিত হলো না মাহবুব। মাঝে মাঝে এভাবে ফোন ডেড হয়ে। পড়ে ওদের বাসায়। এক্সচেঞ্জে কমপ্লেন জানালে আবার ঠিক হয়ে যায়। এবারও ওরকম কিছু একটা হয়েছে ভেবে ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবল না সে। কাজের মধ্যে এমন বুঁদ হয়ে গেল যে বাড়ির কথা প্রায় মনেই পড়ল না। সপ্তম দিনে, ব্যাংকোয়েট হলে একটা কনফারেন্স সেরে রূমে ফিরেছে মাহবুব, জামা কাপড় ছাড়ছে বিশ্রাম নেয়ার জন্য, ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল ফোন। অপারেটর জানালা ঢাকা থেকে ট্রাঙ্ককল। খুশি হয়ে উঠল মাহবুব। নিশ্চয় শায়লা। যাক, তাহলে এবার ওদের বাসার ফোনটা তাড়াতাড়িই ঠিক হয়েছে।
শায়লা? আগ্রহ ভরে ডাকল মাহবুব।
না, মাহবুব। ডা. মোখলেসুর রহমান বলছি।
ডাক্তার চাচা!
একটা খবর দেব। কিন্তু ভেঙে পড়া চলবে না। শোনো, শায়লা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার ক্লিনিকে আছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে এসো, ওর নিউমোনিয়া হয়েছে, তবে ভেব না, আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব শায়লার জন্যে করব আমি। তবে ওর পাশে এখন তোমাকে খুব দরকার।
হাত থেকে ফোন খসে পড়ল। কোন মতে উঠে দাঁড়াল, পায়ের তলাটা ফাঁকা ঠেকল। মনে হলো অসীম এক ঘূর্ণির মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে ও। ঘরটা অস্পষ্ট হয়ে উঠল, দুলছে।
শায়লা, আর্তনাদ করে উঠল মাহবুব। অন্ধের মত এগোল সে দরজার দিকে।
.
তোমার স্ত্রী মা হিসেবে খুব চমৎকার, মাহবুব। নিজের কথা সে একটুও ভাবেনি। বাচ্চাটার জন্যে চিন্তায় চিন্তায়…।
ডা. মোখলেসুর রহমানের একটা কথাও শুনছে না মাহবুব। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে শায়লার পাণ্ডুর মুখের দিকে। শায়লার মুখের পেশী বার কয়েক কাপল, চোখ মেলে চাইল ও। অস্ফুট একটা হাসি ফুটল ঠোঁটে, তারপর কথা বলতে শুরু করল। আস্তে আস্তে কথা বলছে শায়লা। মা হিসেবে বাচ্চার প্রতি একজন তরুণীর কি দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাই বর্ণনা দিচ্ছে সে। ধীরে ধীরে গলা চড়ল ওর, ভয় ফুটল কণ্ঠে, তীব্র বিতৃষ্ণা বিষোদগার হলো। ডাক্তারের মুখাবয়বে কোন পরিবর্তন হলো না, কিন্তু মাহবুব বারবার কেঁপে উঠল। থামাতে চাইল ও শায়লাকে, কিন্তু পারল না।
বাচ্চাটা ঘুমাতে চাইত না। আমি ভেবেছিলাম ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ও দোলনায় শুয়ে থাকত আর শুধু চেয়ে থাকত। আর গভীররাতে উঠে কাঁদতে শুরু করত। প্রচণ্ড জোরে কাঁদত ও, সারারাত। একের পর এক রাত। আমি কত চেষ্টা করেছি থামাতে পারিনি। আর আমিও ওর কান্নার চোটে একটা রাতও ঘুমাইনি।
মাথা নাড়লেন ডা. মোখলেসুর রহমান। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। কিন্তু এখন ও দ্রুত আরোগ্যের পথে। কয়েকদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে আশা করি।
অসুস্থবোধ করছে মাহবুব। বাচ্চা? আমার বাচ্চাটার কি অবস্থা?
ও ঠিকই আছে।
ধন্যবাদ, ডাক্তার চাচা। আপনাকে যে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাব…।
ওকে, ওকে সান। এমনিতেই খাটো মানুষ আমি। কৃতজ্ঞ করে আরও খাটো কোরো না। বরং ধন্যবাদ প্রাপ্য তোমাদের ওই কাজের বুয়ার, জামালের মা না কি যেন নাম, তার। শায়লা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল বাথরূমে। এমনিতেই ক্লান্ত শরীর, তারপর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ভাগ্যিস নিউমোনিয়াটা ওকে খুব বেশি কাবু করার আগেই আমি উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। তোমাদের ওই কাজের বুয়াটা যদি বাথরূমের দরজা ভেঙে শায়লাকে বের করতে আরও ঘণ্টাখানেক দেরি করত তাহলে ওকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে উঠত। এনি ওয়ে, শায়লাকে তুমি শিগগিরই বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে। কাজেই চিন্তার কিছু নেই।
ডাক্তার দরজাটা ভেজিয়ে চলে গেলেন। শায়লা দুর্বল গলায় ডাকল, মাহবুব!
ঘুরল মাহবুব। জড়িয়ে ধরল শায়লাকে। শায়লা ওর হাত দুটো শক্ত করে ধরে থাকল। ভীত গলায় বলতে শুরু করল, আমি নিজের সঙ্গে প্রতারণা করেছিলাম। তোমাকে বুঝতে দেইনি যে হাসপাতাল থেকে ফেরার পরেও আমি শরীরে পুরো। শক্তি ফিরে পাইনি। কিন্তু বাচ্চাটা আমার দুর্বলতা টের পেয়ে গিয়েছিল। তাই প্রতি রাতে ওটা কাঁদত। কিন্তু যখন কাঁদত না তখন অস্বাভাবিক রকম নীরব থাকত। আমি রাতে ঘরের বাতি জ্বালাতে সাহস পেতাম না। জানতাম আলো জ্বাললেই দেখব ও আমার দিকে একঠায় তাকিয়ে আছে।
মাহবুব জড়িয়ে ধরে আছে শায়লাকে। শায়লার প্রতিটি কথা ও উপলব্ধি করতে পারছে অন্তরে অন্তরে। বাচ্চাটাকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ও, টের পাচ্ছে ওর উপস্থিতি। এই বাচ্চা প্রতিদিন গভীররাতে ঘুম থেকে জাগে যখন আর সবার বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবে ঘুমায়। এই বাচ্চা জেগে থাকে, যখন কাঁদে না তখন। চিন্তা করে। আর তার দোলনা থেকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকে। এসব কি হচ্ছে? নিজেকে ভর্ৎসনা করল মাহবুব। এত চমৎকার তুলতুলে একটা বাচ্চাকে নিয়ে এসব কি ভাবছে সে। শায়লার দিকে মনোযোগ ফেরাল সে।
শায়লা বলে চলেছে, আমি বাচ্চাটাকে খুন করতে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তাই। তুমি যেদিন হংকং গেলে তার পরদিনই আমি ওর ঘরে ঢুকে ঘাড়ের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু হাত ঢুকিয়েই থাকলাম। অনেকক্ষণ নড়তেই পারলাম না। ভীষণ ভয় লাগছিল আমার। তারপর বিছানার চাদর দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে, উল্টো অবস্থায় রেখে দৌড়ে পালালাম ঘর থেকে।
মাহবুব ওকে থামাতে চাইল।
না, আমাকে আগে শেষ করতে দাও। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ফোঁসফেঁসে গলায় বলল শায়লা। ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভাবলাম ঠিক কাজটাই করেছি আমি। বাচ্চারা দোলনায় কাপড় পেঁচিয়ে এভাবে শ্বাসরোধ হয়ে কতই তো মারা যায়। কেউ জানবেই না যে আমিই কাজটা করেছি। কিন্তু ওকে মৃত অবস্থায় দেখব বলে যেই ঘরে ঢুকেছি…মাহবুব, বিশ্বাস করো, দেখি কি ও মরেনি! হ্যাঁ, মরেনি। বেঁচে আছে। তোষকে পিঠ দিয়ে হাসছে ও আর বড় বড় শ্বাস ফেলছে। তারপর ওকে আর আমার ধরার সাহসই হলো না। আমি সেই যে ও ঘর থেকে চলে এলাম আর সেদিকে গেলাম না। আমি ওকে খাওয়াতেও যাইনি কিংবা একবার দেখতেও যাইনি। হয়তো বুয়া ওকে খাইয়েছে। ঠিক জানি না আমি, শুধু এটুকু জানি সারারাত সে চিৎকার করে কেঁদে আমাকে জাগিয়ে রাখত। আর মনে হত সমস্ত বাড়িতে ওটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় আমি ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়লাম। হাঁফিয়ে উঠেছে শায়লা। দম নিতে একটু থামল। তারপর আবার শুরু করল, বাচ্চাটা ওখানে সারাদিন শুয়ে থাকে আর খালি আমাকে খুন করার পরিকল্পনা আঁটে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ ও বুঝতে পেরেছে ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। ওর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা নেই; আমাদের মধ্যে কোন নিরাপত্তার বন্ধন নেই; কোনদিন হবে না।
দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ক্লান্ত হয়ে পড়ল শায়লা। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল। মাহবুব অনেকক্ষণ বসে থাকল ওর শিয়রে, নড়তে ভুলে গেছে যেন। ওর রক্ত জমাট বেঁধে গেছে শরীরে। কোথাও একটা নার্ভও কাজ করছে না।
.
দিন তিনেক পর শায়লাকে বাড়িতে নিয়ে এল মাহবুব। তারপর সিদ্ধান্ত নিল পুরো ব্যাপারটা সে জানবে ডাক্তার চাচাকে। মোখলেসুর রহমান অখণ্ড মনোযোগে মাহবুবের সব কথা শুনলেন।
তারপর বললেন, দেখো, মাহবুব, তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করো। কখনও কখনও মায়েরা তাদের সন্তানদের ঘৃণা করেন, এটা এক ধরনের দ্বৈতসত্তা। ভালোবাসার মধ্যেই ঘৃণা, প্রেমিক প্রেমিকারা তো হরহামেশা খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করছে। কয়েকদিন মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। বাচ্চারাও তাদের মায়েদের ঘৃণা করে…।
বাধা দিল মাহবুব, আমার মাকে আমি কখনও ঘৃণা করিনি।
করেছ। কিন্তু স্বীকার করবে না। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ তার প্রিয়জনদের ঘৃণা করার কথা কখনও স্বীকার করতে চায় না।
কিন্তু শায়লা তার বাচ্চাকে ঘৃণা করার কথা স্পষ্ট করে বলছে!
বরং বলল সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ঘৃণা এবং ভালোবাসার যে স্বাভাবিক দ্বৈতসত্তা রয়েছে, সে ওটা থেকে একটু এগিয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক ডেলিভারীর মাধ্যমে ওর বাচ্চার জন্ম। নরকযন্ত্রণা সহ্য করেছে সে সন্তান জন্ম দেয়ার সময়। এই প্রায় মৃত্যুর অভিজ্ঞতা এবং নিউমোনিয়ার জন্যে শায়লা বাচ্চাটাকেই একমাত্র দায়ী মনে করছে। নিজের সমস্যা সে নিজেই সৃষ্টি করছে, কিন্তু দায়ভারটা তুলে দিচ্ছে হাতের কাছে যাকে সবচেয়ে সহজ টার্গেট হিসেবে পাচ্ছে, তার ওপর। আমরা সবাই এটা করি। চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেলে দোষ দেই ফার্নিচারটার। অথচ নিজেরা যে সাবধান নই সেদিকে খেয়াল রাখি না। ব্যবসায় ফেল করলে অভিসম্পাত করি খোদা, আবহাওয়া কিংবা আমাদের ভাগ্যকে। তোমাকে নতুন করে কিছু বলার নেই। আগেও যা বলেছি আজও তাই বলছি। লাভ হার। ওকে আরও বেশি বেশি ভালোবাসো। পৃথিবীর সেরা ওষুধ হলো এই ভালোবাসা। ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে ওর প্রতি তোমার স্নেহটাকে ফুটিয়ে তোলো, ওর মধ্যে নিরাপত্তাবোধ জাগিয়ে তোলো। ওকে বোঝাও বাচ্চারা কত নিষ্পাপ আর মোটেও অনিষ্টকারী নয়। বাচ্চাটার মূল্য কারও চেয়ে কম নয় এই অনুভূতি ওর মধ্যে জাগিয়ে তোলে। দেখবে কয়েকদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে। মৃত্যুভয় ভুলে যাবে শায়লা, ভালোবাসতে শুরু করবে তার বাচ্চাকে। যদি আগামী মাসের মধ্যে ওর কোন পরিবর্তন না দেখো, তাহলে আমাকে জানিও। আমি ওকে কোন ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠাব। এখন তুমি যেতে পারো। তবে দয়া করে চেহারা থেকে অসহায় ভাবটা মুছে ফেলো।
.
শীত ফুরিয়ে বসন্ত এল। বসন্তকে বিদায় জানাল গ্রীষ্ম। মাহবুবদের লালমাটিয়ার বাড়িতে সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল মাহবুব তার কাজে ব্যস্ত থাকছে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ সময় সে ব্যয় করছে স্ত্রীর জন্যে। শায়লা এখন অনেকটাই সুস্থ। বিকেলে দুজনে মিলে হাঁটতে যাচ্ছে ক্রিসেন্ট লেকের পাড়ে, কখনও সামনের লনে ব্যাডমিন্টনের নেট ঝুলিয়ে পয়েন্ট গুণে খেলছে, মাহবুবকে হারাতে পারলে হাততালি দিয়ে উঠছে বাচ্চাদের মত। আস্তে আস্তে শক্তি ফিরে পাচ্ছে শায়লা। মনে হচ্ছে ভয়টার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে ও।
তারপর একদিন রাতে প্রবল কালবৈশাখী ঝড় হলো ঢাকা শহরে। আকাশের বুক চিরে সাপের জিভের মত ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, ভীষণ শব্দে বাজ পড়ল কাছে কোথাও, হাওয়ার ক্রুদ্ধ গর্জন যেন কাঁপিয়ে দিতে লাগল বাড়িটাকে। সেই সঙ্গে কেঁপে উঠল শায়লা। ঘুম ভেঙে জড়িয়ে ধরল সে স্বামীকে, ওকেও ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য করল। শায়লাকে আদর করতে করতে মাহবুব জানতে চাইল, কি হয়েছে।
ভয়ার্ত গলায় শায়লা বলল, কে যেন আমাদের ঘরে ঢুকেছে। লক্ষ করছে আমাদেরকে।
আলো জ্বালাল মাহবুব। আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছ, সস্নেহে বলল সে। এতদিন তো ভালোই ছিলে। আবার কি হলো? আলো নেভালো সে।
অন্ধকারে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শায়লা। তারপর হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে বুকে চেপে ধরে থাকল মাহবুব, ভাবল তার এই মিষ্টি বউটা কি সামান্য কারণেই না ভয় পায়।
হঠাৎ ঘুম চটে যাওয়ায় আর ঘুম আসছিল না মাহবুবের। অনেকক্ষণ আগড়ম বাগডুম ভাবল সে। শব্দটা হঠাৎ কানে এল। খুলে যাচ্ছে বেডরূমের দরজা। ইঞ্চিকয়েক খুলে গেল পাল্লা দুটো।
কেউ নেই ওখানে। বাতাস থেমেছে বহুক্ষণ।
চুপচাপ শুয়ে থাকল মাহবুব। মনে হলো একঘণ্টারও বেশি সময় সে অন্ধকারে শুয়ে আছে।
তারপর, অকস্মাৎ গোঙানির মত কান্নার আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে। কাঁদছে বাচ্চাটা।
গোঙানির শব্দটা অন্ধকারের মধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে এল, ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, যেন প্রতিধ্বনি তুলল দেয়ালে। এই সময় আবার শুরু হলো ঝড়।
মাহবুব খুব আস্তে আস্তে একশো পর্যন্ত গুণল। থামছে না বাচ্চা, একভাবে কেঁদেই চলেছে।
সাবধানে শায়লার বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করল মাহবুব, নামল বিছানা থেকে। স্যাণ্ডেলে পা গলিয়ে এগোল দরজার দিকে।
ও এখন নিচে, রান্নাঘরে যাবে, ঠিক করল মাহবুব। খানিকটা দুধ গরম করে চলে আসবে ওপরে, অরপর…।
মিশমিশে অন্ধকারটা যেন মুহূর্তের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল সামনে থেকে, পা পিছলে গেছে মাহবুবের। নরম কি একটা জিনিসের ওপর পাটা পড়েছিল ওর, টের পেল অসীম শূন্যের এক কালো গহ্বরের মধ্যে ছিটকে যাচ্ছে সে।
উন্মাদের মত হাত বাড়াল মাহবুব, প্রচণ্ড ঝাঁকি খেলো কব্জি জোড়া, ধরে ফেলেছে রেলিং। নিজেকে গাল দিল একটা।
কিসের ওপর পা দিয়ে পিছলে পড়েছিল মাহবুব? জিনিসটা কি বোঝার জন্যে হাতড়াতে শুরু করল অন্ধকারে। মাথায় দ্রিম দ্রিম ঢাক বাজছে। হৃৎপিণ্ড যেন গলার কাছে এসে ঠেকেছে, প্রচণ্ড ব্যথা করছে হাত।
নরম জিনিসটা খুঁজে পেল মাহবুব। ওটার গায়ে আঙুল বুলিয়েই বুঝতে পারল, একটা পুতুল। বিদঘুঁটে চেহারার বড়সড় এই পুতুলটা সে কিনেছিল তার বাবু সোনার জন্যে।
হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না মাহবুব। কে যে এভাবে জিনিসপত্র ছড়িয়ে রাখে! নাহ্, কাজের বুয়াটা ছুটিতে দেশের বাড়ি গিয়ে মুশকিলই হলো দেখছি। আরেকটু হলেই ভবলীলা সাঙ্গ হতে যাচ্ছিল মাহবুবের। অত উঁচু থেকে সরাসরি সিমেন্টের মেঝেতে আছড়ে পড়লে বাঁচত নাকি সে? ভাগ্যিস রেলিংটা ধরে ফেলেছিল।
.
পরদিন, নাস্তার টেবিলে কথাটা বলল শায়লা। আমি দিন কয়েকের জন্য একটু বরিশাল যেতে চাই। আব্বা-আম্মাকে দেখি না অনেকদিন। তুমি যদি সময় করতে না পারো, আমাকে একাই যেতে দাও, প্লীজ। জামালের মা বুধবার আসবে তার দেশের বাড়ি থেকে। সে একাই বাবুর যত্ন নিতে পারবে। আমি ওকে সঙ্গে নিতে চাচ্ছি না। আসলে বলতে পারো আমি কয়েকদিনের জন্যে ওর কাছ থেকে পালাতে চাইছি। ভেবেছিলাম এই ব্যাপারটা-মানে ভয়টা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। কিন্তু তা আর পারলাম না। ওর সঙ্গে একরূমে আর থাকতে পারছি না আমি। ও এমনভাবে আমার দিকে তাকায় যেন প্রচণ্ড ঘৃণা করে আমাকে। এভাবে আরও কিছুদিন চললে আমি সত্যি পাগল হয়ে যাব। আমার মন বলছে খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সেটা ঘটার আগেই কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে চাই।
থমথমে মুখে চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রাখল মাহবুব। তোমার আসলে এখন দরকার একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট। তিনি যদি তোমাকে বাইরে যেতে বলেন তাহলে যেয়ো। কিন্তু এভাবে আর চলে না। তোমার টেনশনেই আমি মরলাম!
মুখ কালো হয়ে গেল শায়লার। অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থাকল। তারপর ওর দিকে না চেয়ে আস্তে আস্তে বলল, তুমিই বোধহয় ঠিক বলেছ। আমাকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার। ঠিক আছে, তুমি কারও সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। তুমি যেখানে বলবে সেখানেই আমি যেতে রাজি, মাহবুব।
মাহবুব ওর ঠোঁটে চুমু খেলো। ডোন্ট টেক ইট আদার ওয়ে, ডার্লিং। তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে কথাটা বলিনি। তুমি তো জানোই, তুমি আমার কাছে কতখানি! তোমার সামান্য কষ্ট হলেও আমি দিশেহারা হয়ে যাই।
মুখ তুলল শায়ালা। হাসল। জানি, মাহবুব। আমি কিছু মনে করিনি। যাকগে, তুমি আজ ফিরবে কখন?
অন্যান্য দিনের মতই। কেন, হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? এমনিই। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরলে আমি একটু স্বস্তি পাই। চারদিকে এত অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আর যে জোরে গাড়ি চালাও তুমি, আমার খুব ভয় হয়।
ওতো আমি সবসময়ই চালাই। অ্যাক্সিডেন্টে মরব না, একশোভাগ গ্যারান্টি দিলাম। শায়লার ফর্সা গাল টিপে দিল সে। হাসতে হাসতে বলল, চলি, দৃঢ় পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মাহবুব ফ্রেশ মুড নিয়ে।
.
অফিসে পৌঁছেই ডাক্তার মোখলেসুর রহমানকে ফোন করল মাহবুব। জানতে চাইল তাঁর জানাশোনা ভালো কোন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে কিনা। ডা, সানোয়ারা বেগমের কথা বললেন রহমান সাহেব। অত্যন্ত দক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য একজন মনোবিজ্ঞানী। জানালেন ভদ্রমহিলার সঙ্গে তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখলেন, মাহবুবকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিল মাহবুব। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কাজে।
সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর যখন ফ্রী হলো মাহবুব, অনুভব করল বাসায় যাওয়ার জন্যে কতটা ব্যগ্র হয়ে আছে মন। লিফটে নামার সময় গতরাতের ঘটনাটা মনে পড়ল ওর। শায়লাকে আছাড় খাওয়ার কথা বলেনি সে। পুতুলটার কথা বললে সে যদি অন্যভাবে রিঅ্যাক্ট করে! থাক, দরকার নেই বলার। অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট।
সূর্য ডুবে গেছে টয়োটা বিল্ডিং-এর আড়ালে। টকটকে লাল আভা ছড়িয়ে আছে ওদিকের আকাশে। সিঁদুর রঙা মেঘগুলো আশ্চর্য সব মূর্তি এঁকে রেখেছে আকাশের বুকে। অপূর্ব! একটা সিগারেট ধরিয়ে ফুরফুরে মেজাজে গাড়ি চালাচ্ছে মাহবুব।
গাড়ি-বারান্দায় টয়োটা রাখল মাহবুব। শায়লাকে নিয়ে এখনই আবার বেরুবে সে। ঠিক করেছে লং ড্রাইভে গাজীপুরের দিকে যাবে। ফেরার পথে রাতের খাবারটা সেরে নেবে কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে।
হাত ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙল মাহবুব। বুক ভরে টেনে নিল তাজা বাতাস। পেছন থেকে মিষ্টি স্বরে ডেকে উঠল একটি পাখি। কলিংবেলে চাপ দিল। পিয়ানোর টুং টাং শব্দ বাজতে শুরু করল দোতলায়। দেড় মিনিট পার হওয়ার পরেও শায়লা আসছে না দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠল ওর। ঘুমিয়ে পড়েনি তো শায়লা। কিন্তু এ সময় তো ওর ঘুমাবার কথা নয়। দরজার নবে হাত রাখল মাহবুব। মোচড় দিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা। কপালে আরও একটা ভাঁজ পড়ল ওর। সদর দরজা কখনও ভোলা রাখে না শায়লা। দিনকাল ভালো নয় জানে। তাহলে হলো কি আজ মেয়েটার।
ঘরে ঢুকেই উঁচু গলায় ডাকল মাহবুব, শায়লা! কোন উত্তর নেই। আবারও ডাকতে গেল, কিন্তু হাঁ হয়েই থাকল মুখ। দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছে সে, ভয়ের তীব্র একটা ঠাণ্ডা স্রোত জমিয়ে দিল ওকে।
কিম্ভূত পুতুলটা পড়ে আছে সিঁড়ির গোড়ায়। কিন্তু পুতুল নয়, মাহবুব তাকিয়ে আছে শায়লার দিকে। শায়লার হালকাঁপাতলা দেহটা দুমড়ে মুচড়ে আছে সিঁড়ির গোড়ায়। যেন একটা ভাঙা পুতুল, আর কোনদিন খেলা করা যাবে না। কোনদিন না।
মারা গেছে শায়লা।
বাড়িটি আশ্চর্যরকম নিঃশব্দ, শুধু মাহবুবের বুকে হাতুড়ির আঘাত পড়ছে দমাদম।
মারা গেছে শায়লা।
মাথাটা দুহাতে আঁকড়ে ধরল মাহবুব, স্পর্শ করল চম্পক অঙ্গুলি। ভীষণ ঠাণ্ডা। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে থাকল মাহবুব শায়লাকে। কিন্তু ও তো আর বেঁচে উঠবে না, আর কখনও জলতরঙ্গ কণ্ঠে ডাকবে না তার নাম ধরে। বাঁচতে চেয়েছিল শায়লা। তার কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ মাহবুব বাঁচাতে পারেনি তার প্রিয়তমাকে, পারেনি নিরাপত্তা দিতে।
উঠে দাঁড়াল ও। ডাক্তার চাচাকে ফোন করতে হবে। কিন্তু নাম্বারটা মনে আসছে না। ভূতগ্রস্তের মত উঠে এল মাহবুব দোতলায়। সম্মোহিত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল নার্সারী রূমের দিকে। খুলল দরজা। পা রাখল ভেতরে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল দোলনার দিকে। পেটের মধ্যেটা গুলিয়ে উঠছে। কোনকিছু ঠাহর করতে পারছে না। ভালো মত।
বাচ্চাটা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, কিন্তু মুখখানা লাল, ঘামে চকচক করছে, যেন অনেকক্ষণ একভাবে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
ও মারা গেছে, ফিসফিস করে বলল মাহবুব। মারা গেছে শায়লা।
তারপর হঠাৎ হাসতে শুরু করল। নিচু গলায় হাসতেই থাকল। সংবিৎ ফিরে পেল গালে সজোরে চড় খেয়ে। চমকে উঠল ডাক্তার মোখলেসুর রহমানকে দেখে। তিনি একের পর এক চড় মারছেন ওকে আর চেঁচাচ্ছেন, শান্ত হও, মাহবুব। প্লীজ, কাম ডাউন!
শায়লা মারা গেছে, ডাক্তার চাচা, মোখলেসুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেলল মাহবুব। পড়ে গেছে ও দোতলা থেকে পা পিছলে। গত রাতে আমিও পুতুলটার গায়ে পা পিছলে প্রায় মারা যাচ্ছিলাম। আর এখন
মোখলেসুর রহমান ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। কোন কথা বললেন না।
উন্মাদের মত মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল মাহবুব। জানেন, ডাক্তার চাচা, আমি ওর সুন্দর একটা নাম দেব ভেবেছিলাম। এখন কি নাম দেব জানেন? আজরাইল!
রাত এগারোটা। শায়লাকে আজিমপুর গোরস্থানে কবর দিয়ে এসেছে মাহবুব। শুকনো মুখে বসে আছে লাইব্রেরি ঘরে। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল, ভেবেছিলাম শায়লাকে ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব। ভেবেছিলাম ও মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। কিন্তু এখন বুঝছি বাচ্চাটাকে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা অমূলক ছিল না।
ডাক্তার সশব্দে শ্বাস ফেললেন। শায়লার মত তুমিও দেখি ছেলেমানুষী শুরু করলে। অসুস্থতার জন্য শায়লা বাচ্চাটাকে দোষ দিত আর এখন তুমি ওর মৃত্যুর জন্যে তাকে দায়ী করছ। খেলনাটার ওপর পা পিছলে দোতলা থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙেছে শায়লার। এজন্যে তুমি কোনভাবেই বাচ্চাটাকে অভিযুক্ত পারো না।
ওটা আজরাইল।
চুপ করো! ওই শব্দটা আর কখনও মুখে আনবে না।
মাথা নাড়ল মাহবুব। শায়লা রাতে অদ্ভুত সব শব্দ শুনত, কে যেন হাঁটছে ঘরে। আপনি জানেন, ডাক্তার চাচা, কে ওই শব্দ করত? বাচ্চাটা। ছয়মাসের একটা বাচ্চা, অন্ধকারে ঘুরে বেড়াত, আমাদের সবকথা শুনত! চেয়ারের হাতল চেপে ধরল মাহবুব। আর আমি যখন আলো জ্বালাতাম, কিছু চোখে পড়ত না। বাচ্চাটা এত ছোট যে কোন ফার্নিচারের আড়ালে লুকিয়ে পড়াটা ওর জন্য কোন সমস্যা ছিল না।
থামবে তুমি! বললেন ডাক্তার।
না চাচা, আমাকে বলতে দিন। সব বলতে না পারলে আমি পাগল হয়ে যাব। আমি গতবার ব্যবসার কাজে হংকং গেলাম। তখন কে শায়লাকে সারারাত জাগিয়ে রেখেছিল, কে তার নিউমোনিয়া বাধিয়েছিল? ওই বাচ্চা। কিন্তু এত চেষ্টার পরেও যখন শায়লা মরল না, তখন সে আমাকে খুন করতে চাইল। ব্যাপারটা ছিল স্বাভাবিক; সিঁড়িতে একটা খেলনা ফেলে রাখো, বাপ তোমার জন্যে দুধ না নিয়ে আসা পর্যন্ত কাঁদতে থাকো, তারপর সে অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পিছলে পড়ে ঘাড় ভাঙুক। সাধারণ একটা কৌশল, কিন্তু কাজের। আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি। কিন্তু ফাঁদটা শায়লাকে শেষ করেছে।
একটু থামল মাহবুব। হাঁপিয়ে গেছে। খানিকপর বলল, বহু রাতে আমি আলো জ্বেলে দেখেছি ঘুমায়নি ওটা, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশিরভাগ শিশু ওই সময় ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু ও জেগে থাকত, চিন্তা করত।
বাচ্চারা চিন্তা করতে পারে না।
ও পারে। আমরা বাচ্চাদের মন সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি? শায়লাকে ওর ঘৃণা করার কারণও ছিল। শায়লা ওকে মোটেও স্বাভাবিক কোন শিশু ভাবত না। ভাবত অস্বাভাবিক কিছু। ডাক্তার চাচা, আপনি তো জানেনই জন্মের সময় কত বাচ্চা তাদের মায়েদের খুন করে। এই নোংরা পৃথিবীতে জোর করে টেনে আনার ব্যাপারটা কি ওদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে? মাহবুব ক্লান্তভাবে ডাক্তারের দিকে ঝুঁকল। পুরো ব্যাপারটা এক সুতোয় বাঁধা। মনে করুন, কয়েক লাখ বাচ্চার মধ্যে কয়েকটা জন্মাল অস্বাভাবিক বোধ শক্তি নিয়ে। তারা শুনতে পায়, দেখতে পায়, চিন্তা করতে পারে, পারে হাঁটাচলা করতে। এ যেন পতঙ্গদের মত। পতঙ্গরা জন্মায় স্ব-নির্ভরভাবে। জন্মাবার কয়েক হপ্তার মধ্যে বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখি পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু সাধারণ বাচ্চাদের কয়েকবছর লেগে যায় হাঁটতে, চলতে কথা বলা শিখতে।
কিংবা ধরুন, কোটিতে যদি একটি বাচ্চা অস্বাভাবিকভাবে জন্মগ্রহণ করে? জন্মাল একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মেধা এবং শক্তি নিয়ে। কিন্তু যে ভান করল আর দশটা বাচ্চার মতই। নিজেকে দুর্বল হিসেবে প্রমাণ করতে চাইল, খিদের সময় তারস্বরে কাঁদল। কিন্তু অন্য সময় অন্ধকার একটা বাড়ির সব জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে সে, শুনছে বাড়ির লোকজনের কথাবার্তা। আর তার পক্ষে সিঁড়ির মাথায় ফাঁদ পেতে রাখা কত সোজা! কত সহজ সারারাত কেঁদে তার মাকে জাগিয়ে রেখে অসুস্থ করে তোেলা।
ফর গডস শেক! দাঁড়িয়ে পড়লেন ডাক্তার, উত্তেজিত। এসব কি উদ্ভট কথা বলছ তুমি!
উদ্ভট শোনালেও ব্যাপারটা সত্যি, ডাক্তার চাচা, মানুষটা ছোট বলেই আমরা ওকে সন্দেহ করতে পারছি না। কিন্তু এই খুদে সৃষ্টিগুলো ভীষণ রকম আত্মকেন্দ্রিক। কেউ ওদের ভালো না বাসলে ঠিকই টের পায়। তখন তাদের প্রতি ওদের ঘৃণা উথলে ওঠে। আপনি কি জানেন ডাক্তার চাচা, পৃথিবীতে সবচেয়ে স্বার্থপর হচ্ছে শিশুরা?
মোখলেসুর রহমান জাকুটি করে অসহায়ভাবে মাথা নাড়লেন।
মাহবুব বলল, আমি বলছি না বাচ্চাটার ওপর কোন অস্বাভাবিক শক্তি ভর করেছে। কিন্তু সময়ের আগেই ও যেন দ্রুত বেড়ে উঠেছে। আর এই ব্যাপারটাই আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকছে।
ঠাট্টা করতে চাইলন ডাক্তার। ধরো, বাচ্চাটা শায়লাকে খুনই করেছে। কিন্তু খুনের তো একটা উদ্দেশ্য থাকে। বাচ্চাটার উদ্দেশ্য কি ছিল?
জবাবটা তৈরিই ছিল। ত্বরিতগতিতে বলল মাহবুব, যে বাচ্চা জন্মগ্রহণ করেনি তার সবচেয়ে শান্তির জগৎ কোথায়? তার মায়ের জরায়ু। ওখানে সময় বলে কিছু নেই, আছে শুধু শান্তির অপার সমুদ্র, একমনে গা ভাসিয়ে থাকো। কোন কোলাহল নেই, নেই দুশ্চিন্তা। কিন্তু তাকে যখন জোর করে টেনে আনা হলো এই মাটির পৃথিবীতে, নিরবচ্ছিন্ন শান্তির জগৎ থেকে মুহূর্তে সে পতিত হলো এক নরকে। স্বার্থপর এই পৃথিবীতে তাকে বেঁচে থাকতে হলে মানুষের ভালোবাসা আদায় করতে হবে। অথচ যার সঙ্গে তার কোন পরিচয় নেই। পরিচিত জগৎ থেকে হঠাৎ এই অপরিচিত দুনিয়ায় এসে নিজেকে সে প্রচণ্ড অসহায় ভাবতে থাকে, তখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তার ছোট্ট মগজে তখন শুধু স্বার্থপরতা আর ঘৃণা ছাড়া অন্যকিছু থাকে না। মোহময় জগৎ থেকে কে তাকে এই নিষ্ঠুর পরিবেশে নিয়ে এল, ভাবতে থাকে সে! এ জন্য দায়ী কে? অবশ্যই মা। তার অপরিণত মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে তখন মায়ের প্রতি ছড়িয়ে পড়ে প্রবল ঘৃণা। বাপও মায়ের চেয়ে ভালো কিছু নয়। সুতরাং তাকেও ঘৃণা করো। খুন করো দুজনকেই।
বাধা দিলেন ডাক্তার। তুমি যা বললে এই ব্যাখ্যা যদি সত্যি হত তাহলে পৃথিবীর সব মহিলাই তাদের বাচ্চাদের ভয়াবহ কিছু একটা ভাবত।
কেন ভাববে না? আমাদের বাচ্চাটা কি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ নয়? হাজার বছরের ডাক্তারী শাস্ত্রের বিশ্বাস তাকে প্রটেক্ট করছে। প্রকৃতিগতভাবে সবার ধারণা
সে খুব অসহায়, কোন কিছুর জন্য দায়ী নয়। কিন্তু এই বাচ্চাটা জন্মেইছে বিপুল ঘৃণা নিয়ে। যত দিন যাচ্ছে ততই প্রবল হয়ে উঠছে তার ঘৃণা। সে রাতে শুয়ে থাকে দোলনায়, ফর্সা টুকটুকে মুখখানা ভেজা, শ্বাস ফেলতে পারছে না। অনেকক্ষণ কেঁদেছে বলে এই অবস্থা? অবশ্যই নয়। সে দোলনা থেকে নেমেছে, মাগুড়ি দিয়ে বেড়িয়েছে সারা ঘরে। তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ও আমার শায়লাকে খুন করেছে। আমিও ওকে খুন করব।
ডাক্তার মাহবুবের দিকে একগ্লাস জল আর কয়েকটা সাদা বড়ি এগিয়ে দিলেন। তুমি কাউকে খুন করবে না। তুমি এখন আগামী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য ঘুমাবে। নাও, এগুলো গিলে ফেলল। একটা ভালো ঘুম হলেই এসব উদ্ভট চিন্তা মাথা থেকে দূর হয়ে যাবে।
মাহবুব পানি দিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলল ঘুমের বড়িগুলো। ওপরে উঠল ও। কাঁদছে। শুয়ে পড়ল বিছানায়। মোখলেসুর রহমান ওর ঘুম আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর চলে গেলেন।
ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে মাহবুবের, এই সময় শব্দটা শুনল।
কে? অস্পষ্ট গলায় বলল সে।
কে যেন হলঘরে ঢুকেছে।
ঘুমিয়ে পড়ল মাহবুব।
.
পরদিন খুব ভোরে মাহবুবের বাসায় হাজির হলেন ডাক্তার মোখলেসুর রহমান। মাহবুবকে নিয়ে খুব টেনশনে আছেন তিনি। ছোটবেলা থেকে ওকে চেনেন। আবেগপ্রবণ, অস্থির। ভাগ্যিস গতরাতে তিনি ওদের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ড্রপ করেছিলেন। নইলে ছেলেটা শায়লার শোকে ওভাবে হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যেত। শায়লার কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেল তার। এত লক্ষ্মী একটা মেয়ে! কি চমৎকার সুখের জীবন ছিল ওদের। সব গেল ছারখার হয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। মাহবুবকে তিনি কিছুদিনের জন্যে দূরে কোথাও ঘুরে আসতে বলবেন। এভাবে একা থাকলে মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটতে পারে ছেলেটার।
কলিংবেল বাজালেন ডাক্তার। কোন উত্তর নেই। তার মনে পড়ল মাহবুব বলেছিল কাজের মহিলা দেশের বাড়িতে গেছে। নব ঘোরালেন তিনি। খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকলেন। ডাক্তারি ব্যাগটা রাখলেন কাছের একটা চেয়ারে।
সাদামত কি একটা সরে গেল দোতলার সিঁড়ি থেকে। মোখলেসুর রহমান প্রায় খেয়ালই করলেন না। তার নাক কুঁচকে উঠেছে। কিসের যেন গন্ধ পাচ্ছেন।
গন্ধটা গ্যাসের!
বিদ্যুৎ খেলে গেল ডাক্তারের শরীরে, ঝড়ের বেগে সিঁড়ি টপকালেন তিনি, ছুটলেন মাহবুবদের বেডরূমে লক্ষ্য করে।
বিছানায় নিশ্চল পড়ে আছে মাহবুব, সারা রূম ভরে আছে গ্যাসে। দরজার পাশে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিণ্ডারের মুখ ভোলা। হিসহিস শব্দে বেরিয়ে আসছে সাদা পদার্থটা। মোখলেসুর রহমানের চকিতে মনে পড়ল মাহবুব একবার বলেছিল সে তার বেডরূমে অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিণ্ডার লাগিয়েছে। কারণ তার কোন এক বন্ধু নাকি বিছানায় শুয়ে সিগারেট খেতে গিয়ে নেটের মশারিতে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরার জোগাড় হয়েছিল। মাহবুবেরও শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। শায়লার তাগিদেই নাকি সে নিরাপত্তার জন্যে ওই সিলিণ্ডার লাগিয়েছে দেয়ালে।
মোখলেসুর রহমান দ্রুত সিলিণ্ডারের মুখ বন্ধ করলেন। বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিলেন। তারপর দৌড়ে এলেন মাহবুবের কাছে।
ঠাণ্ডা হয়ে আছে শরীর। অনেক আগেই মারা গেছে মাহবুব।
কাশতে কাশতে ঘর থেকে বেরোলেন ডাক্তার। চোখ দিয়ে অবিরল ধারায়। পানি ঝরছে। মাহবুব কিছুতেই ওই সিলিণ্ডারের মুখ খোলেনি। ঘুমের মধ্যে ওর হাঁটার অভ্যাস আছে, বলেছিল শায়লা। কিন্তু যে পরিমাণ ঘুমের ওষুধ ডাক্তার ওকে খাইয়েছেন তাতে দুপুর পর্যন্ত মাহবুবের অঘোরে ঘুমাবার কথা। সুতরাং এটা আত্মহত্যাও হতে পারে না। তাহলে কি…!
হলঘরে মিনিট পাঁচেক পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন ডাক্তার মোখলেসুর রহমান। তারপর এগোলেন নার্সারী রূমের দিকে। দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিয়ে খুললেন তিনি দরজা। দাঁড়ালেন দোলনার পাশে।
দোলনাটা খালি।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন ডাক্তার দোলনা ধরে। তারপর অদৃশ্য কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলেন:
নার্সারীর দরজাটা বন্ধ ছিল। তাই তুমি তোমার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান দোলনাতে ফিরে আসতে পারোনি। তুমি বুঝতে পারোনি যে বাতাসের ধাক্কায় দরজাটা অমনভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি তুমি এই বাড়ির কোথাও লুকিয়ে আছ। ভান করছ এমন কিছুর, আসলে যা তুমি নও। মাথার চুল খামচে ধরলেন ডাক্তার, বিবর্ণ একটুকরো হাসি ফুটল মুখে। আমি এখন শায়লা আর মাহবুবের মত কথা বলছি, তাই না? কিন্তু আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না। আমি অপার্থিব কোন কিছুতে বিশ্বাস করি না। তারপরও আমি কোন ঝুঁকি নেব না।
নিচে নেমে এলেন ডাক্তার। চেয়ারে রাখা ডাক্তারি ব্যাগ খুলে একটা যন্ত্র বের করলেন।
হলঘরে ঘড়ঘড় একটা আওয়াজ শোনা গেল। কে যেন ঘষটে ঘষটে আসছে এদিকে। পাঁই করে ঘুরলেন ডাক্তার।
আমি তোমাকে এই দুনিয়ায় এনেছি, ভাবলেন তিনি। আর এখন আমিই তোমাকে এখান থেকে সরিয়ে দেব…!
শব্দ লক্ষ্য করে ঠিক ছপা হেঁটে গেলেন ডাক্তার। হাতটা উঁচু করে ধরলেন সূর্যালোকে।
দেখো বাবু! কি চকচকে, কি সুন্দর!
সূর্যের আলোতে ঝিকিয়ে উঠল স্কালপেলটা।