প্রেতচক্র

প্রেতচক্র

সীন নদীর উপরের সেতু পার হলো রাউল। মনটা খুশিতে ভরা, আপন মনে সে গানের কলি ভাঁজছিল। ফরাসী যুবক রাউল বয়সে তরুণ। ও দেখতে বেশ সুন্দর। সুন্দর মুখে ছোট সাইজের বাহারী কালো গোঁফটি চমৎকার মানিয়েছে। চাকরিটাও তার ভালো। রাউল একজন ইঞ্জিনীয়ার।

কারদোনে এল রাউল, ঢুকল সতেরো নম্বর বাড়িতে। পরিচারিক কেতামাফিক সুপ্রভাত জানাল বটে, কিন্তু জানাল অত্যন্ত বেজার মুখে। রাউল বোধ হয় সেটা লক্ষ্যই করল না। সে হাসিমুখেই প্রত্যুত্তর দিল।

রাউলের গন্তব্যস্থল চারতলার একটি ফ্ল্যাট। খুশি মনেই সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে দরজা খুলবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল রাউল। গলায় আবার গানের সুরটা এসে গেল, গুন গুন করে একটা কলি গাইতে লাগল সে। আজ সকালে মনের মধ্যে যেন খুশির জোয়ার এসে গিয়েছে। ফ্ল্যাটের দরজা খুলল- খুলে দিল একজন বৃদ্ধা ফরাসী মহিলা, রাউলকে দেখে তার বলিরেখাঙ্কিত মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

সুপ্রভাত, মঁশিয়ে মহিলা হাসিমুখে বলল।

সুপ্রভাত, এলিস হাসিমুখে রাউল উত্তর দিল।

ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করল এলিস, তারপর রাউলের দিকে তাকিয়ে বলল, বৈঠকখানায় একটু বসুন আপনি, আমি মাদামকে খবর দিচ্ছি। একটু পরেই তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হবে।

মাদাম কি ব্যস্ত? কি করছেন তিনি?

একটু বিশ্রাম করছেন, এলিস উত্তর দিল।

বিশ্রাম করছেন? এখন? একটু অবাক হয়েই রাউল প্রশ্ন করল, কেন মাদামের কি শরীর খারাপ হয়েছে?

খারাপ হবে না তো কি? এলিস একটু মুখঝামটা দিয়ে বলল।

ছোট বৈঠকখানার দরজা খুলে দিল এলিস তারপর রাউল সোফায় বসতেই আগের কথায় জের টেনে বলল, মাদামের শরীর তো খারাপ হবেই, এরকম বারবার চক্রে বসতে হলে কারো শরীর কি ভালো থাকে! আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করছি। মাদাম দিন দিন কেমন রোগা আর ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছেন, ওর শরীরটা রক্তশূণ্য তাই বিছানায় শুয়ে থাকেন।

রাগ করছ কেন এলিস? ওর কাঁধে হাত দিয়ে মিষ্টি গলায় রাউল বলল, ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পারছ না, এর মধ্যে শয়তানের কোন ব্যাপারই নেই। অনর্থক শয়তান বোরাকে নিয়ে টানাটানি করছ কেন?

রাউলের কথায় আশ্বস্ত হতে পারল না এলিস। আপন মনে নিচু গলায় সে বলতে লাগল, এসব শয়তানী কাণ্ড-কারখানা আমার মোটেই পছন্দ হয় না, মাদামের শরীরের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন- দেখুন দিনের পর দিন কি হাল হচ্ছে। আমরা ইহজগতের মানুষ। পরলোকের আত্মাদের নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার কি আমাদের? আমাদের এটুকু জানলেই হলো যে, ভালো আত্মারা স্বর্গে যান আর খারাপ আত্মাদের যেতে হয় নরকে। পাপীরা তাদের পাপ অনুযায়ী শাস্তি পায় নরকে।

পরলোক সম্পর্কে তোমার চিন্তা-ভাবনা দেখছি একেবারে জটিলতা মুক্ত। এ সম্পর্কে তোমার হিসেব-নিকেশও দেখছি খুবই সহজ।

আপনাদের বিয়ের পরে আর প্রেতাত্মা নিয়ে এসব চক্র-টক্র করবেন না তো, মঁশিয়ে? এলিস প্রশ্ন করল, তার কণ্ঠস্বরে অনুরোধের সুর।

আরে না, না, এলিসের দিকে তাকিয়ে রাউল হাসল।

সত্যি বলছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি মাদামকে খুব ভালোবাস, তাই না এলিস?

হ্যাঁ, বৃদ্ধা অকপটে স্বীকার করল।

মাদামও তোমাকে খুব বিশ্বাস করেন?

আমার তো তা-ই মনে হয়।

চিন্তা করো না এলিস, বিয়েটা একবার হয়ে যাক, তারপর এসব প্রেতাত্মা আর পরলোকের কারবার একেবারে তুলে দেব, আমার স্ত্রীকে আর এসব অপ্রাকৃত ব্যাপার নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে দেব না। এ নিয়ে কোন ঝামেলায়ই পড়তে হবে না তাকে।

এলিসের মুখখানা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ব্যগ্রভাবে সে বলল।

সত্যি?…সত্যি বলছেন মঁশিয়ে?

হ্যাঁ, গম্ভীরভাবে রাউল জবাব দিল।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল স্নেহময়ী এলিস, বৃদ্ধা পরিচারিকা সত্যি সত্যিই তার তরুণী মাদামকে ভালোবাসে।

চাপা গলায় রাউল বলতে লাগল, সত্যি, সিমোনের মধ্যে একটা অদ্ভুত-একটা আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। আর সে অলৌকিক ক্ষমতা ও প্রয়োগ করেছে বারবার। কিন্তু আর নয়। এবার এ ব্যাপার ইতি টানা উচিত। আমি সিমোনকে ভালোবাসি। আমি কি আর ওর অবস্থা লক্ষ্য করিনি? তুমি মাদামকে ভালোবাস এলিস, তুমি ঠিক কথাই বলেছ। তোমার মাদাম যে দিন দিন রোগা আর ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছেন তা আমার নজর এড়ায়নি। সবই জানি আমি। জানি, একজন মিডিয়াম-এর দেহ এবং মনের উপর কি প্রচণ্ড চাপ পড়ে সেই দারুণ স্নায়বিক চাপ সহ্য করা খুবই শক্ত। কিন্তু এলিস, একটা কথা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে। কথাটা হলো এই যে তোমার মাদাম প্যারিস শহরের সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়াম। কিন্তু না, কেবল প্যারিস শহর নয়, সারা ফরাসী দেশে ক্ষমতার দিক দিয়ে মাদামের সমতুল্য মিডিয়াম আর নেই। আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না এলিস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক তোমার মাদামের কাছে আসে। তাদের ধারণা এ মিডিয়ামের কাছে কোন ভণ্ডামি বা জালিয়াতি নেই। এখানে এলে তারা ঠকবেন না।

ঠকবে? মাদামের কাছে? তপ্তস্বরে এলিস বলল, আমার মাদামের মতো সৎ মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। উনি চেষ্টা করলেও কাউকে ঠকাতে পারবেন না এমনকী একটা হাবাগোবা বাচ্চাও ঠকবে না তার কাছে।

ঠিকই বলছ তুমি। এক এক সময় মনে হয় তোমার মাদাম যেন এ পৃথিবীর কেউ নয়, ও যেন নেমে এসেছে স্বর্গের নন্দনকানন থেকে। মর্ত্যলোকে নিয়ে এসেছে স্বর্গলোকের অমৃত বার্তা।

এলিস খুশি নিয়ে তাকিয়ে রইল রাউলের দিকে।–আচ্ছা এলিস, তোমার মাদামকে তো আর মিডিয়ামের কাজ করতে হবে না; এরপর থেকে তো তিনি মনের সুখে ঘরকান্না করবেন। এ কথা শুনে তুমি নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছ?

এলিস হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। রাউল ভেবেছিল খবরটা শুনে বৃদ্ধা খুবই খুশি হবে। কিন্তু ও হঠাৎ গম্ভীর গেল কেন?

কি ব্যাপার, এলিস?

ভাবছি একটা কথা, গম্ভীর মুখে এলিস বলল।

কি কথা?

মঁশিয়ে, আপনি তো বলছেন মাদাম প্রেতাত্মাদের সঙ্গে কাজ-কারবার ছেড়ে। দেবেন, কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রেতাত্মারা যদি মাদামকে ছেড়ে না দেয়?

তার অর্থ?

প্রেতাত্মারা যদি না ছাড়ে?

কি বলতে চাইছ তুমি? একটু অসহিষ্ণু স্বরেই রাউল প্রশ্ন করল।

ব্যাপারটা কি জানেন মঁশিয়ে, পরলোকের বাসিন্দাদের নিয়ে বেশি কারবার করলে অনেক সময় তারা আর মিডিয়ামকে ছাড়তে চায় না। আমার ভয় তো সেখানে।

আমার ধারণা ছিল তোমার মধ্যে কোন কুসংস্কার নেই, রাউল বলল।

অহেতুক কুসংস্কার আমার মধ্যে নেই মঁশিয়ে, তবে…

তবে কি? তুমি বলতে চাইছ গুছিয়ে বল।

আমি যা বলতে চাই, তা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না সঁশিয়ে। আগে ভাবতাম মিডিয়ামরা হলো ধূর্ত এবং প্রতারক। প্রিয়জনের বিয়োগে ব্যথাতুর মানুষদের তারা নানা কৌশলে ঠকায়। কিন্তু মাদামকে দেখে বুঝেছি যে আমার ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়। আমার মাদাম সহজ-সরল মানুষ, উনি অত্যন্ত সৎ।

সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, রাউল বলল।

চাপা গলায় শঙ্কা-বিহ্বল গলায় এলিক বলল, এখানে যা ঘটে তার মধ্যে কোন কৌশল বা চাতুরি নেই। যা দেখা যায় তা সত্যি সত্যিই ঘটে। আর… আর সে জন্যই আমার ভয় হয়… খুব ভয় হয়। মঁশিয়ে, এসব কাজ করা মোটেই উচিত নয়। এ জগৎ আর পর জগতের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন প্রকৃতির বিধান নয়। আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করছি- কাজ করছি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এই অস্বাভাবিক কাজের জন্য একদিন চরম মূল্য দিতেই হবে।

এলিসের দুকাঁধে হাত রেখে রাউল তাকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করল। বলল, স্থির হও এলিস, কেন ঘাবড়ে যাচ্ছ? শোন, তোমাকে একটা সুসংবাদ দেই। আজকেই আমার শেষ প্রেত-বৈঠক। এরপর আর পরলোক বা ভূত প্রেত নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব না।

আজকেও আবার একটা বৈঠক আছে? আতংকভরা গলায় এলিস প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, আর এটাই শেষ বৈঠক।

এলিস যে অসন্তুষ্ট হয়েছে, ওর মুখের ভাবে তা স্পষ্ট বোঝা গেল। মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু মাদাম বোধহয় আজ চক্রে বসতে পারবেন না।

কেন? রাউলের কণ্ঠে স্পষ্ট অসন্তোষের সুর।

মাদাম অসুস্থ, মাথার যন্ত্রণায় তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। আজ চক্রে বসলে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

কিন্তু আমরা যে কথা দিয়েছি। শুধু তা-ই নয়, আগাম টাকা পর্যন্ত নিয়েছি।

তাতে কি, জানিয়ে দিন মিডিয়াম অসুস্থ। আজ তিনি চক্রে বসতে পারবেন না।

ওদের কথার মাঝখানে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল এক সুতনুকা নারী, দীর্ঘকায়া, গৌরবর্ণা, ক্ষীণদেহে কমনীয়তা আর লাবণ্যের অভাব নেই, মেয়েটির মুখখানা মহাশিল্পী বতিচেলির আঁকা ম্যাডোনার ছবির মত। রাউলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এলিস তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সিমোন! রাউলের কণ্ঠে আবেগ।

রাউল, প্রিয়তম।

নিজের দুহাত বাড়িয়ে রাউল সিমোনের দীর্ঘ শ্ৰদ্ৰ হাত দুখানি ধরল। তারপর দুবার চুমু খেল সুন্দর হাত দুখানিতে। সুতনুকা নারী আবেগভরে মৃদুস্বরে বলতে লাগল, রাউল, প্রিয়…প্রিয়তম!

রাউল আবার ওর সাদা হাত দুটোতে চুম্বন করে ব্যগ্রভাবে তার দিকে তাকিয়ে উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, সিমোন, তোমার চেহারাটা বড় ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, এলিস বলল তোমার নাকি মাথায় যন্ত্রণা, বলল তুমি বিশ্রাম করছ। তোমার কি শরীর খারাপ হয়েছে? তুমি কি অসুস্থ?

না না, ঠিক অসুস্থ নই, ইতস্তত গলায় সিমোন বলল।

সিমোনের হাত ধরে সোফার দিকে এগোল রাউল। ওকে সোফায় বসাল। নিজে বসল ওর পাশে, তারপর জিজ্ঞেস করল,

তাহলে বল কি হয়েছে তোমার?

রাউলের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল সিমোন, কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসে রইল, ওর দৃষ্টি মেঝের কার্পেটের দিকে। তারপর নিচু গলায় দ্রুত বলে ফেলল,

আমি ভয় পেয়েছি…বড্ড ভয় পেয়েছি, রাউল।।

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল রাউল। ভাবল সিমোন হয়তো আরো কিছু বলবে। কিন্তু যখন দেখল মেয়েটি আর কিছু বলছে না তখন তাকে কিছুটা সাহস আর উৎসাহ দেবার জন্য বলল,

ভয়! কিসের জন্য ভয়? কাকে ভয়?

জানি না, তবে ভয় পেয়েছি।

কিন্তু কেন? বিস্ময় বিমূঢ় দৃষ্টিতে রাউল তাকাল সিমোনের দিকে।

রাউলের প্রশ্নের উত্তর এল সঙ্গে সঙ্গেই। তার দিকে তাকিয়ে সিমোন বলল,

জানি তুমি অবাক হবে। কিন্তু আমি যে ভয় পেয়েছি তার মধ্যে একবিন্দু মিথ্যে নেই। কিসের ভয়… কেন ভয়… কাকে ভয় এসব আমি কিছু জানি না, সব সময়েই এক অজানা আতংক কালো মেঘের মত আমার মনের আকাশকে ছেয়ে ফেলেছে। মনে হয় আমার জীবনে একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, তার উপর এই অজানা আতংক, রাউল, আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব।

শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল সিমোন। নরম হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে রাউল বলল, না ডার্লিং, এভাবে হাল ছাড়ছ কেন? এমন করে ভেঙে পড়লে তো চলবে না, তোমার কি হয়েছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। অতি পরিশ্রমের ফলেই এসেছে এই ক্লান্তি। মিডিয়ামের জীবনে এরকম ক্লান্তি আসতেই পারে। তোমার এখন যা দরকার তাহলো বিশ্রাম-পরিপূর্ণ বিশ্রাম। আর সেই সঙ্গে চাই মানসিক শান্তি।

সিমোনের মুখে ফুটে উঠল কৃতজ্ঞতার ছাপ। রাউলের দিকে কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ রাউল। এখন আমার দরকার পরিপূর্ণ বিশ্রাম আর শান্তি।

চোখ বুজে রাউলের বাহুমূলে মাথা রাখল সিমোন। নিজের দেহটাকে এলিয়ে দিল রাউলের হাতের ওপর। আমি তোমার উপর এমনি করে নির্ভর করতে চাই, একটুখানি সুখ চাই। আমার চাহিদাটা খুব বেশি নয় রাউল, অস্ফুটস্বরে সিমোন বলল।

তাকে আরও কাছে টেনে নিল রাউল, সিমোনের চোখ দুটি তখনও বন্ধ। তার বুক থেকে বেরিয়ে এল দীর্ঘনিঃশ্বাস। মৃদুকণ্ঠে সে বলল, রাউল, প্রিয়তম, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমি সবকথা ভুলে যাই। ভুলে যাই কি ধরনের জীবন আমাকে কাটাতে হচ্ছে। মিডিয়ামের জীবন বড় দুর্বিষহ-বড় ভয়ংকর। কিন্তু তোমার আলিঙ্গনে বাঁধা পড়লে এ শঙ্কাতুর জীবনের কথাও আমি ভুলে যাই। তখন নিজের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আমার মনে আর কোন সংশয় থাকে না। তুমি তো অনেকেটাই জান রাউল, তবু বলব মিডিয়ামের জীবনের সবকিছু তুমি জানো না।

রাউলের মনে হলো তার আলিঙ্গনে বাঁধা সিমোনের শরীরটা যেন ক্রমেই শক্ত। হয়ে উঠছে, একটা আড়ষ্টতা যেন আচ্ছন্ন করে ফেলছে তার সুন্দর দেহ-লতাটিকে।

চোখ খুলল সিমোন। শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই সে বলতে লাগল।

ছোট একখানা অন্ধকার ঘর। তার মধ্যে আমি বসে থাকি। অপেক্ষা করি। আমার চারপাশে পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার। বড় ভয়ঙ্কর এই নিরন্ধ্র অন্ধকার। এ অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে কেবল শূন্যতা আর শূন্যতা। স্বেচ্ছায় এই অন্ধকার রাজ্যে নিজেকে ছেড়ে দিই। আমার চারপাশে অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আরো ঘন হয়ে ওঠে। সেই অন্ধকারে অপেক্ষা করতে করতে আমার চেতনার উপরও ধীরে ধীরে নেমে আসে অন্ধকার। আমি অচেতন হয়ে পড়ি। তারপর যা ঘটে তার কিছুই জানতে পারি না আমি। আমার কোন অনুভূতি পর্যন্ত থাকে না। শেষ পর্যন্ত ধীরে ধীরে অনেক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে ফিরে আসে আমার চেতনা, মনে হয় দীর্ঘ ঘুমের পর আমি যেন জেগে উঠলাম, তারপর এক অপরিসীম ক্লান্তিতে আমার সমস্ত দেহ মন যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

জানি ডার্লিং, আমি জানি, নরম গলায় রাউল বলল।

সে যে কি ভয়ঙ্কর ক্লান্তি তা আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না,নিস্তেজ গলায় সিমোন বলল, একথা বলতে বলতে সিমোনের শরীরটা যেন আরো এলিয়ে পড়ল।

তোমার তুলনা নেই সিমোন, নিজের দুহাত দিয়ে সিমোনের হাত দুটো চেপে ধরে রাউল বলল, তুমি অনন্যা। তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়াম। এ ব্যাপারে তোমার শ্রেষ্ঠতা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য।

একটু হেসে নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সিমোন।

তুমি মাথা নাড়লে কি হবে, আমি সত্যি কথাই বলছি। এই দেখ… পকেট থেকে দুখানা চিঠি বের করল রাউল, বলল, এই যে, এই চিঠিখানা এসেছে। অধ্যাপক রোশের কাছ থেকে আর এই চিঠিখানা লিখেছেন ডক্টর জেনির, দুজনে একই অনুরোধ করেছেন।

কি অনুরোধ? ভীরু গলায় সিমোন জিজ্ঞেস করল।

দুজনেই অনুরোধ করেছেন তুমি যেন মাঝে মাঝে মিডিয়াম হিসেবে তাদের প্রেত-চক্রে অংশগ্রহণ করো।

না-না-না-মোটেই না! সোফা ছেড়ে একলাফে উঠে দাঁড়াল সিমোন, কক্ষনো করব না ও কাজ। সবকিছুরই একটা সীমা আছে। এবার এ কাজে ইতি টানব। তুমি… তুমি… নিজেও তো আমায় কথা দিয়েছ। রাউল।

অবাক হয়ে সিমোনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাউল। ভয়ে, উত্তেজনায় সিমোন কাঁপছে। ওকে দেখাচ্ছে কোণঠাসা প্রাণীর মত। সোফা থেকে উঠে ওর হাত ধরল রাউল, যেন সাহস দিতে চাইল ওকে। তারপর আশ্বস্ত করবার সুরে বলল, হ্যাঁ, ও সব প্রেত-চক্রের ব্যাপার-স্যাপার তো শেষই হয়ে গিয়েছে। তোমাকে নিয়ে আমার খুব অহংকার সিমোন, তাই চিঠি দুটো দেখালাম।

সন্দেহের দৃষ্টিতে রাউলের দিকে তাকাল সিমোন, বলল, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে তুমি আর কখনও আমাকে প্রেত-চক্রে বসতে বলবে না।

না না, রাউল আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে বলল, তবে…

তবে কী? রাউলের তার বক্তব্য শেষ করতে না দিয়েই সিমোন প্রশ্ন করল।

মানে…এসব বিখ্যাত লোকদের জন্য তুমি যদি স্বেচ্ছায় মাঝে মাঝে বসতে রাজী হও তবে।

না না, মোটেই না। আর কখনও চক্রে বসব না আমি, উত্তেজিতভাবে রাউলকে বাধা দিল সিমোন, চক্রে বসার মধ্যে বিপদ আছে। সে বিপদ বড় ভয়ঙ্কর।

দুহাতে নিজের কপাল টিপে ধরল সিমোন, দাঁড়াল গিয়ে জানালার কাছে। রাউলের দিকে মুখ ফিরিয়ে অনুনয়ের সুরে বলল, কথা দাও, আর কখনও আমাকে চক্রে বসতে বলবে না।

রাউল এগিয়ে গেল ওর দিকে। সিমোনের দুকাঁধের উপর নিজের হাত রেখে কোমল কণ্ঠে বলল, সিমোন, ডার্লিং। কথা দিচ্ছি আজ রাতের পর আর কোনদিন তোমায় প্রেত-চক্রে বসতে বলব না।

চমকে উঠল সিমোন। রাউল পরিষ্কার বুঝতে পারল ওর চমকানি।

আজ! ভীরু গলায় সিমোন বলল, হ্যাঁ, আজকেই তো মাদাম একস্-এর আসবার কথা। আমি তো একদম ভুলেই গিয়েছিলাম তার কথা।

ঘড়ির দিকে তাকাল রাউল। বলল, মাদাম একস-এর আসবার সময় হয়ে গিয়েছে। যে কোন মুহূর্তে তিনি এসে যাবেন। কিন্তু সিমোন, তোমার শরীর যদি সুস্থ না থাকে…

রাউলের কথা যেন শুনতেই পেল না সিমোন। সে নিজের চিন্তায় ডুবে গিয়েছে।

মাদাম একস্! সত্যি বলছি রাউল, খুব অদ্ভুত এক মহিলা উনি। ওকে দেখলে আমার বড় ভয় হয়।

সিমোন।

রাউলের গলায় ভৎর্সনার সুর বেজে উঠল। সে সুরটা ধরতে পারল সিমোন। রাউলের দিকে তাকিয়ে সে বলতে লাগল, জানি রাউল, তুমি অন্য ফরাসীদের মত। তোমার কাছে মা হলো অত্যন্ত পবিত্র। সন্তানহারা শোকাকুলা মা সম্পর্কে এরকম ধারণা পোষণ করা যে উচিত নয় তা আমি ভালো করেই জানি। এটা আমার নির্বুদ্ধিতা, নিষ্ঠুরতাও বলতে পার। কিন্তু রাউল… আমি তোমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না… ভদ্রমহিলা এত মোটা… ওঁর গায়ের রঙটা কেমন অদ্ভুত রকমের তামাটে। তার উপর আবার মহিলার হাত দুখানা… হাত দুটো লক্ষ্য করে দেখেছ? কি বিরাট… কি বলিষ্ঠ হাত দুখানা! ঠিক যেন পুরুষের হাত! উঃ কি ভয়ানক!

কেঁপে উঠল সিমোন। চোখ বুজল। কাঁধের উপর থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল রাউল তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না সিমোন।

কেন?

আচ্ছা, তুমি তো একটা মেয়ে, আর অপর একজন নারীর প্রতি তোমার সহানুভূতি এবং সমবেদনা থাকা উচিত। ভদ্রমহিলা সদ্য সন্তানহারা হয়েছেন। মেয়েটি ছিল ওর একমাত্র সন্তান। সন্তানহারা শোকাকুলা মায়ের উপর তোমার দয়া হয় না? হওয়া উচিত।

অস্থির হয়ে উঠল সিমোন। তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না রাউল। মনের এই অনুভূতি কারো চাওয়া-না-চাওয়ার উপর নির্ভর করে না। মাদাম একসূকে যখন প্রথম দেখলাম তখনই এ আতংকের অনুভূতি আমার মনকে গ্রাস করে ফেলেছে।

তোমার ধারণার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই, রাউল বোঝাবার চেষ্টা করল।

অস্থিরভাবে নিজের হাত সরিয়ে দিল সিমোন, উত্তেজিতভাবে বলতে লাগল, তোমাকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারব না রাউল। তুমি বুঝতেই চাইছ না, মাদাম একস্-কে দেখলে আমি আঁতকে উঠি। দারুণ ভয়ে আমার মনটা কুঁকড়ে যায়। তোমার বোধহয় মনে আছে তার হয়ে প্রেত-চক্রে বসতে আমি দ্বিধা করছিলাম-রাজী হয়েছিলাম অনেক পরে। আমার ধারণা হয়েছিল, তার জন্য আমার ভয়ঙ্কর কোন অমঙ্গল হবে। যেমন করেই হোক তিনি জীবনে মহাবিপদকে আহ্বান করে আনছেন।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে রাউল বলল, আসলে ব্যাপারটা হয়েছিল ঠিক উল্টো। মাদাম একস্-এর জন্য তুমি যে কটা প্রেত-চক্রে বসেছ তার সবকটিই খুব সফল হয়েছে। ছোট্ট অ্যামেলির বিদেহী আত্মা খুব সহজেই তোমার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। মৃত অ্যামেলির দেহধারণগুলো হয়েছিল অতি চমৎকার। শেষ বৈঠকের সময় যদি অধ্যাপক রোশ উপস্থিত থাকতেন তবে খুব ভালো হত।

দেহধারণের কথা বলছ, গলায় স্বর নামিয়ে সিমোন বলল, ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে বল, রাউল। তুমি তো জান, আমি যখন আবিষ্ট অবস্থায় থাকি তখন বাইরের জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অসচেতন থাকি। এই রূপধারণের ব্যাপারগুলো কি সত্যি ঘটে?

হ্যাঁ।

খুব সুন্দর হয়?

সিমোন আবার জিজ্ঞেস করল।

বিপুল উৎসাহে ঘাড় নাড়ল রাউল। বলল, প্রথমে দিকের কয়েকটা প্রেত-চক্রে অ্যামেলিয়াকে দেখা যাচ্ছিল একটা অস্পষ্ট কুয়াশার বৃত্তের মধ্যে। তাকে ঠিক পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু শেষবারে যা হলো তা একেবারে অকল্পনীয়।

কি হলো শেষবারে? সিমোনের স্বরে একই সঙ্গে উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল। ধীর গলায় রাউল বলল, শেষবারে বাচ্চাটা একেবারে রক্ত-মাংসের শরীর নিয়ে এসেছিল। দেখে মনে হচ্ছিল শিশুটি যেন সত্যিই জীবন্ত! আমি তাকে স্পর্শ পর্যন্ত করে দেখেছিলাম। কিন্তু দেখলাম তাতে তোমার খুব কষ্ট হয়। মাদাম এক-ও বাচ্চাকে স্পর্শ করবার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আমি তাকে স্পর্শ করতে দেইনি, কারণ আমার মনে হয়েছিল যে প্রয়াত সন্তানকে স্পর্শ করার সুযোগ পেলে সন্তানহারা জননীর ধৈর্যের বাধ হয়তো ভেঙ্গে যেতে পারে। তার ফলে নিজের অজ্ঞাতসারেই হয়তো তিনি তোমার কোন মারাত্মক ক্ষতি করে ফেলতে পারেন।

জানালার দিকে মুখ ফেরালো সিমোন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। তারপর নিস্তেজ গলায় বলল,

যখন জ্ঞান হলো তখন আমি বড় ক্লান্ত। দেহ-মনে তখন আমি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছি। কিন্তু রাউল, এসব কাজ কি ঠিক হচ্ছে? আমরা কোন অন্যায় কাজ করছি না তো? এলিস কি বলে জান?

কি বলে?

ও বলে আমরা নাকি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শয়তানের সঙ্গে কাজ-কারবার করছি।

সিমোন হাসল। কিন্তু কেন যে হাসল তা সে নিজেই জানে না।

আমি কি বিশ্বাস করি জানো? গম্ভীরভাবে রাউল বলল, অজানাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করবার মধ্যে সব সময়েই বিপদের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কাজের পিছনের উদ্দেশ্যটা যদি ভালো হয় তবে বিজ্ঞানের স্বার্থে এটুকু বিপদের ঝুঁকি নেওয়াটা আমি সঙ্গত বলেই মনে করি। মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য-বিজ্ঞানের স্বার্থে বহু লোক জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রাণ দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে এটা চলে আসছে। এক যুগের মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়ে অনুপ্রাণিত করে গিয়েছে পরের যুগের মানুষদের। তুমি যে প্রেত-চক্রে বসছ, তা বিজ্ঞানের জন্যই বসেছ। জ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবার কাজে তোমার প্রচুর অবদান রয়েছে। দীর্ঘদিন এ কাজ করবার ফলে আজ তুমি দুর্বল হয়ে পড়েছ, এবার তোমার কাজের ইতি টানা হবে। আজকেই তোমার শেষ প্রেত-চক্র। এরপর থেকে শুরু হবে তোমার জীবন।

একটানা এতক্ষণ কথা বলে রাউল থামল।

রাউলের দিকে তাকাল সিমোন। একটুখানি হাসল, স্নেহের হাসি বলেই মনে হলো তার, এতক্ষণে তার উত্তেজনা বোধহয় কেটে গিয়েছে। ফিরে এসেছে। আগেকার স্বাভাবিক স্থিরতা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ গলায় সে বলল, মাদাম একস্-এর আসবার সময় পার হয়ে গিয়েছে। উনি তো দেরি করেন না। হয়তো আজকে আর আসবেনই না উনি।

আমার কিন্তু মনে হয় উনি ঠিকই এসে যাবেন। তোমার ঘড়িটা বোধহয় ঠিক সময় দিচ্ছে না, হয়তো সঠিক সময় থেকে এগিয়ে রয়েছে।

ঘরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ছোটখাট জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে সিমোন বলল।

মাদাম একস্ কে? তার সত্যিকারের পরিচয় কি? কোথা থেকে এলেন তিনি? তিনি কোন্ দেশের-কোন্ জাতের? তার আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব কে আছে?–এর একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারব না আমরা। আসলে তার সম্বন্ধে কিছুই জানি না আমরা। একস্ তার আসল নাম হতে পারে না। তিনি আমাদের কাছে এসেছেন ছদ্ম পরিচয়ে।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে রাউল বলল, এর মধ্যে আর অবাক হবার কি আছে? অনেক লোকই মিডিয়ামের কাছে আসল পরিচয় গোপন করেই আসে। সাবধানতার জন্যই এটা করা হয়।

বোধহয় তাই, নিরুত্তাপ গলায় সিমোন বলল। ওর হাতে ছিল একটা ছোট চীনেমাটির ফুলদানী। হঠাৎ সেটা পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। চমকে সেদিকে ফিরে তাকাল সিমোন। তারপর রাউলের দিকে ফিরে বলল, দেখেছো আমার মধ্যে আর আমি নেই। আচ্ছা রাউল, আমি যদি মাদাম একত্সকে বলি যে, আজ চক্রে বসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে কি খুব অন্যায় কিছু হবে?

রাউলের মুখে ফুটে উঠল একই সঙ্গে বিস্ময় এবং বেদনাবোধ। তা দেখে সিমোনের মুখখানা লাল হয়ে উঠল।

ধীর গলায় রাউল বলল, তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে, সিমোন।

পিছিয়ে গেল সিমোন। তার পিঠ দেওয়াল স্পর্শ করল। আর্তকণ্ঠে সে বলল, এ কাজ থেকে আমাকে মুক্তি দাও রাউল। আমি আর পারছি না…সত্যিই পারছি না…।

রাউলের চোখে ফুটে উঠল নরম ভর্ৎসনার দৃষ্টি। সে দৃষ্টির সামনে সিমোন আবার গুটিয়ে গেল।

রাউল বলতে লাগল, টাকার জন্য আমি মোটেই ভাবছি না, সিমোন। অবশ্য এই শেষ প্রেত-চক্রের জন্য মাদাম একস্ যে টাকাটা দিতে চাইছেন তার অঙ্কটা বিরাট।

তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সিমোন বলল, সবকিছু কি টাকা দিয়ে কেনা, যায় রাউল?

নিশ্চয়ই যায় না। এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু লক্ষ্মী সিমোন, একটা কথা ভেবে দেখ।

কি কথা?

মনে কর তুমি সত্যিই অসুস্থ নও। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কোন ধনী মহিলার অনুরোধে চক্রে-বসা বা না-বসাটা সম্পূর্ণভাবে তোমার ইচ্ছাধীন। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। ভেবে দেখ, মাদাম একস্ একজন মা। এই মা সদ্য তার একমাত্র সন্ত নিকে হারিয়েছেন। তিনি যদি শেষবারের মত তার সন্তানকে দেখতে চান, তুমি তাঁকে দেখার সুযোগ দেবে না? সন্তানহারা মাকে তুমি এটুকু দয়া দেখাবে না?

গম্ভীর হতাশায় সিমোন নিজের হাত ছুঁড়তে লাগল। ও যে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছে তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।

একটু আত্মস্থ হয়ে নিস্তেজ গলায় ও বলল, তোমার কথায় বড় কষ্ট পাচ্ছি রাউল। হয়তো তুমি যা বলছ তা-ই ঠিক। তোমার কথামতই কাজ করব আমি। কিন্তু এবার বুঝেছি আমি ভয় পাচ্ছি কেন। আমার ভয়ের কারণ হলো ছোট্ট একটা শব্দ।-আর সেই শব্দটি হলো, মা।।

কি বলছ সিমোন!

ঠিকই বলছি। জানো রাউল, প্রকৃতির রাজ্যে কিছু আদিম মৌলিক প্রবৃত্তির অস্তিত্ব রয়েছে। অবশ্য সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাদের অনেকগুলিই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মাতৃত্ব-মায়ের প্রবৃত্তি কিন্তু আগের মতই রয়েছে। এ নষ্ট হয়ে যায়নি। এর রূপও পাল্টায়নি। এ ব্যাপারে পশু আর মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার কোন তুলনা নেই পৃথিবীতে। এ ভালোবাসাকে আইনের বাঁধনে বাঁধা যায় না। এ ভালোবাসা নির্ভয়ে যে কোন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াতে পারে। এই অন্ধ ভালোবাসা নিজের পথে দাঁড়ানো যে কোন বাধাকে নিমর্মভাবে-নৃশংসভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে। আমার ভয় এই প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন মৌলিক প্রবৃত্তিটিকে।

একটানা এতক্ষণ কথা বলে সিমোন থামল। উত্তেজনা ও ক্লান্তিতে হাঁফাচ্ছে। রাউলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল ও। তারপর বলল, আজ আমি নিতান্ত নির্বোধের মত কথা বলছি-আচরণ করছি, তাই না, রাউল?।

সস্নেহে সিমোনের হাত ধরে রাউল বলল, বুঝতে পেরেছি, তুমি খুব ক্লান্ত। যাও, যতক্ষণ মাদাম একস্ না আসেন, ততক্ষণ একটু বিশ্রাম নাও। শোবার ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে থাক।

বেশ, রাউলের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে সিমোন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

চিন্তায় ডুবে গেল রাউল। তারপর বসবার ঘরের দরজা খুলে চলে এল পাশের হলঘরে। ছোট হলঘরটা পার হয়ে এবার সে এল পাশের আর একখানা ঘরে। এ ঘরখানাও আগের ঘরখানারই মত। ঘরের একপ্রান্তে রয়েছে একটি ক্ষুদ্র কুঠুরী। কুঠুরীর মধ্যে রয়েছে একখানা বড় হাতলওয়ালা বিরাট ইজিচেয়ার। কালো ভেলভেটের ভারী পর্দাগুলো এমনভাবে সাজানো যে ইচ্ছে করলে যে কোন মুহূর্তে এই ছোট ঘরখানাকে ঢেকে ফেলে দেওয়া যায়। আবার প্রয়োজন হলে পর্দার আবরণ সহজেই সরিয়ে ফেলে ছোট কুঠুরীখানাকে লোকচক্ষুর সামনে আনা যায়।

এলিস ঘর সাজাচ্ছিল। কুঠুরীর সামনে দুখানা চেয়ার আর একখানা গোল টেবিল। টেবিলের উপর একটা খঞ্জনি, একটা শিঙে, কয়েকখানা কাগজ আর পেন্সিল।

রাউলকে দেখে এলিস বলল, মঁশিয়ে, আজই কিন্তু শেষ প্রেত-চক্র। আজকের ব্যাপারটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে রক্ষে পাই।

কলিংবেল-টা বেজে উঠল তীব্র তীক্ষ্মস্বরে।

যাও, দেখ গিয়ে কে এসেছেন। মনে হয় মাদাম একসই এসেছেন।

ঐ মহিলা তো গীর্জায় গিয়ে সন্তানের আত্মার মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করতে পারেন। গম্ভীর গলায় অনুযোগের সুরে এলিসা বলল।

কলিংবেল-টা আবার আর্তনাদ করে উঠল।

যাও, দেখ গিয়ে কে এসেছেন, আদেশের সুরে রাউল বলল।

গজগজ করতে করতে এলিস চলে গিয়ে একটু পরেই ফিরে এল। তার সঙ্গে একজন মহিলা। মহিলার দিকে তাকিয়ে এলিস বলল,

আপনি একটু বসুন মাদাম। আমার মাদামকে খবর দিচ্ছি যে আপনি এসেছেন।

মাদাম এক-এর সঙ্গে করমর্দন করবার জন্য রাউল এগিয়ে গেল। সিমোন ঠিকই বলেছে। বিরাট চেহারা ভদ্রমহিলার। যেমন লম্বা তেমনি মোেটা তার গায়ের রঙ অদ্ভুত রকমের তামাটে। হাত দুখানা সত্যিই পুরুষালি। ফরাসী দেশের প্রথা অনুযায়ী তার পরনে ফরাসী দেশের কালো পোশাক। মহিলার কণ্ঠস্বরও অত্যন্ত গম্ভীর।

আমার বোধ হয় আসতে একটু দেরি হয়ে গেল, গমগমে গলায় মাদাম একস্ বললেন।

হাসিমুখে রাউল বলল, হ্যাঁ, দেরি হলো। তবে বেশি নয়, মাত্র কয়েক মিনিট।

মাদাম সিমোন কোথায়?

মাদাম সিমোনের শরীরটা সুস্থ নয়। তিনি শুয়ে আছেন, রাউল উত্তর দিল। করমর্দনের পর ভদ্রমহিলা হাত সরিয়ে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি শক্তভাবে রাউলের হাতটা চেপে ধরলেন। গম্ভীর অথচ তীক্ষ্মস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ও তাই বুঝি, তা মাদাম সিমোন আজ চক্রে বসতে পারবেন তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বসবেন, রাউল দ্রুত উত্তর দিল।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মহিলা। তারপর মুখের কালো আবরণটার বাঁধন খুলতে খুলতে একখানা চেয়ারে বসে পড়লেন।

আপন মনে নিচু গলায় তিনি বলতে লাগলেন, মঁশিয়ে রাউল, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না এরকম প্রেত-চক্র আমার মনে কত আনন্দের সৃষ্টি করে। আমি অবাক হয়ে যাই। আমার একমাত্র সন্তান অ্যামেলি! সে আর আমার কাছে নেই। কিন্তু মাদাম সিমোন চক্রে বসলে আমি আমার ছোট্ট বাচ্চাকে দেখতে পাই… তার সঙ্গে কথা বলতে পারি… হয়তো সম্ভব হলে তাকে আমি স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারব।

দ্রুত কণ্ঠে রাউল বলল, না মাদাম একস, স্পর্শ করবার চেষ্টা মোটেই করবেন না। আমার নির্দেশ ছাড়া আপনি কোন কিছুই করতে পারবেন না। করলে সাংঘাতিক বিপদ হতে পারে।

আমার বিপদ হবে?

না মাদাম, বিপদের সম্ভাবনা মিডিয়ামের। প্রেত-চক্রে বিদেহী আত্মার দেহধারণের সময় যা ঘটে বিজ্ঞান তার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছে। খুঁটিনাটি বা জটিলতার মধ্যে না গিয়ে আমি সহজভাবে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করছি। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন।

বলুন, মাদাম একস্-এর স্বর গগ করে উঠল।

কোন বিদেহী আত্মা যদি স্থূলদেহ ধারণ করতে চায় তবে মিডিয়ামের দেহ থেকে তাকে দেহধারণের উপাদান গ্রহণ করতে হয়। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে প্রেত-চক্রের সময় মিডিয়ামের মুখ থেকে সূক্ষ্ম ধোঁয়ার মত বাষ্প বেরোয়। এই বাস্পই ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে প্রেতাত্মার নিখুঁত দেহের সৃষ্টি করে। মিডিয়ামের দেহ থেকে যে সূক্ষ্ম বাষ্প বেরিয়ে আসে তাকে বলে এক্টোপ্লাজম্। যারা প্রেততত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন তারা বলেন যে এই এক্টোপ্লজ মিডিয়ামেরই দেহের অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওজনের সাহায্যে এ জিনিসটা প্রমাণ করা যাবে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও বিপদের সম্ভানা রয়েছে। কারণ দেহধারী প্রেতাত্মাকে স্পর্শ করলেই মিডিয়ামের দেহে অসহ্য যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। রূপধারী প্রেতাত্মাকে স্পর্শ করলে মিডিয়ামের ভয়ংকর বিপদ হতে পারে। এমনকি এক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটাও অসম্ভব নয়।

গভীর মনোযোগের সঙ্গে মাদাম একস্ শুনছিলেন রাউলের কথা।

রাউল আবার বলতে লাগল, তা হলেই বুঝতে পারছেন মাদাম, মিডিয়ামের গুরুত্ব কোথায়। মিডিয়ামের সাহায্য ছাড়া বিদেহী আত্মা দেহধারণই করতে পারে না। মিডিয়াম হলো ইহলোক আর পরলোকের মধ্যে সংযোগের সেতু। যে কেউ চাইলেই মিডিয়াম হতে পারে না। কারণ সবার মধ্যে মিডিয়াম হবার প্রয়োজনীয় গুণগুলো নেই। দুএকজনের মধ্যে এ দুর্লভ ক্ষমতার স্ফুরণ হয়।

আশ্চর্য! আচ্ছা মঁশিয়ে রাউল, এমন দিন কি আসবে না যখন এই দেহধারণের ব্যাপারটা উন্নতির এমন স্তরে পৌঁছবে যে দেহধারী আত্মা মিডিয়ামের দেহ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারবে?

এ যে সাংঘাতিক কল্পনা, মাদাম।

হোক সাংঘাতিক, অসম্ভব তো নয়?

হ্যাঁ, সম্পূর্ণ অসম্ভব। অন্তত এখনও পর্যন্ত যতদূর জানা গিয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় এটা একেবারেই অসম্ভব।

কিন্তু আজকের কথাই তো শেষ কথা নয়, আজকে যা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে তা তো সম্ভব হয়ে উঠতে পারে?

এ কূট প্রশ্নের উত্তর আর রাউলকে দিতে হলো না। সিমোন ঘরে ঢুকল। ওকে অত্যন্ত ক্লান্ত এবং বিবর্ণ দেখাচ্ছে। তাহলেও ও যে অনেকটা সামলে উঠেছে তা। বেশ বোঝা যায়।

সিমোন এগিয়ে এসে মাদাম একস্-এর সঙ্গে করদর্মন করল। হাত মেলাবার সময় সে যে শিউরে উঠল তা লক্ষ্য করল রাউল।

শুনে দুঃখিত হলাম যে, আপনার শরীর নাকি ভালো নেই, মাদাম একস্ বললেন।

ঠিক আছে, ও নিয়ে চিন্তা করবেন না।

আজকে চক্রে বসতে পারবেন তো? মাদাম এক প্রশ্ন করলেন।

নিশ্চয়ই পারব, একটু রুক্ষস্বরেই সিমোন বলল। ওর স্বরের রুক্ষতায় রাউল তো বটেই, মাদাম একস্ পর্যন্ত যেন চমকে উঠলেন।

দেরি করে লাভ কি, তাহলে কাজ শুরু করা যাক, একথা বলে সিমোন ঢুকে পড়ল ছোট কুঠরীখানার মধ্যে। বসল গিয়ে বড় হাতলওয়ালা ইজিচেয়ারখানায়।

আচমকা এক অজানা আতংকের তুহিন-শীতল স্রোত যেন বয়ে গেল রাউলের মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে। আবেগের সঙ্গে সে বলল।

আজকে তোমার শরীরটা ভালো নেই, সিমোন। আজ প্রেত-চক্র বন্ধ থাক। আশা করি মাদাম একস্ কিছু মনে করবেন না।

একি কথা মঁশিয়ে! কুদ্ধস্বরে মাদাম একস্ বললেন।

ঠিকই বলছি আমি, রাউলও দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, অসুস্থ শরীর নিয়ে আজ চক্রে না বসাই ভালো।

কিন্তু মঁশিয়ে, মাদাম সিমোন তো আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে, আজ আমার জন্য শেষবারের মত উনি চক্রে বসবেন, মাদাম একস্-এর কণ্ঠ থেকে একই সঙ্গে ক্রোধ আর ঘৃণা ঝরে পড়ল।

ঠিক, আমি কথা দিয়েছি। আর সে কথার খেলাপও আমি করব না, ঠাণ্ডা গলায় সিমোন বলল।

এই তো চাই, কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে মাদাম একস্ বললেন। রাউলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ধীরকণ্ঠে সিমোন বলল, ভয় পাচ্ছ কেন রাউল? ভয় পেয়ো না। আমি তো শেষবারের মত প্রেত-চক্রে বসছি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! এই আমার শেষবারের মত কষ্ট পাওয়া। আর… আর কখনও এই অসহ্য কষ্ট পেতে হবে না আমাকে। এই শেষ… এই শেষ।

সিমোনের ইঙ্গিতে রাউল কুঠরীর কালো ভারী পর্দাটা টেনে দিল। তারপর জানালার পর্দাগুল টেনে দিতেই আধো আলো আধো ছায়ার পরিবেশ সৃষ্টি হলো ছোট ঘরখানার মধ্যে। মাদাম একত্সকে একখানা চেয়ারে বসবার ইঙ্গিত করে রাউল অন্য চেয়ারখানায় বসল। মাদাম একস্ একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন। কথাটা।

আমাকে মাফ করবেন সঁশিয়ে, আমি আপনার বা মাদাম সিমোনের সতোকে অবিশ্বাস করছি না। জানি আপনার দুজনেই অত্যন্ত সৎ। আর এই প্রেত-চক্রের মধ্যেও কোন জালিয়াতি বা কারচুপি নেই। কিন্তু তবুও আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহে হতে চাই আর তাই এই জিনিসটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।

একথা বলে নিজের হাত-ব্যাগ থেকে একটা সরু শক্ত দড়ি বের করলেন মাদাম একস্।

মাদাম, রাউল চিৎকার করে উঠল, এ তো অপমান… ভীষণ অপমান!

না, এ হলো নিছক সাবধানতা, অদ্ভুত ঠাণ্ডা গলায় মাদাম একস্ বললেন।

না না, এ হলো অপমান…মারাত্মক অপমান…আপনি আমাদের দুজনকেই অপমান করেছেন, উত্তেজিতভাবে রাউল চিৎকার করে উঠল।

মঁশিয়ে রাউল, আপনার আপত্তির কারণ তো আমি বুঝতে পারছি না, বিদ্রুপের সুরে মাদাম একস্ বললেন, আপনাদের চক্রে যদি কোন জালিয়াতি বা কারচুপি না থাকে তাহলে আপত্তি করছেন কেন? আপনাদের মধ্যে যদি কোন ছলনা থাকে তবে ভয় পাওয়ার তো কোন কারণ নেই।

দারুণ ঘৃণায় রাউলের মুখ বিকৃত হলো। তারপর একটা অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। মাদাম একস্-এর দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপ-ভরা স্বরে সে বলতে লাগল,

আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন মাদাম একস্, এ ব্যাপারে আমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। ভয় পাওয়ার কোন প্রশ্নই নেই এখানে। বেশ তো, যদি আমার হাত পা দড়ি দিয়ে বাধলে খুশি হতে পারেন, তবে বাঁধুন।

রাউল ভেবেছিল এই বিদ্রুপের পর মাদাম একস্ আর বাঁধার্বাধির মধ্যে যাবেন না। কিন্তু তার ভাবনটা যে একেবারেই ভুল তা বোঝা গেল সঙ্গে সঙ্গেই।

মাদাম একস্ অবিচলিত স্বরে বললেন, ধন্যবাদ সঁশিয়ে, তারপর দড়িটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন রাউলের দিকে।

আচম্বিতে পর্দার পিছন থেকে সিমোনের তীব্র তীক্ষ্ম কণ্ঠস্বর শোনা গেল,

না না রাউল, মাদাম একস্-এর অপমানকর প্রস্তাবে কিছুতেই রাজী হয়ে না। ব্যঙ্গের হাসি হেসে মাদাম একস্ বললেন, মাদাম সিমোন, আপনি ভয় পাচ্ছেন নাকি!

হ্যাঁ, স্বীকার করছি আমি ভয় পেয়েছি।

রাউল চিৎকার করে উঠল, কি বলছ, সিমোন? মাদাম এক ভাবছেন আমরা তাকে ঠকাতে যাচ্ছি। আমরা জালিয়াত- জোচ্চোর।

আমাকে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হতে হবে, গম্ভীর গলায় মাদাম একস্ বললেন। তারপর রাউলকে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধলেন খুব শক্ত করে।

বাঁধতে আপনি খুব ওস্তাদ, বিদ্রূপ-ভরা গলায় রাউল বলল। মাদাম এক এর বাধার কাজ শেষ হলো।

এবার খুশি হয়েছেন তো?

মাদাম একস্ কোন উত্তর দিলেন না। তিনি যেন রাউলের উপহাস গায়েই মাখলেন না। তিনি ঘরের দেওয়ালগুলি ভালো করে পরীক্ষা করলেন। হলঘরে যাবার দরজাটায় তালা লাগিয়ে চাবিটা খুলে নিলেন। চাবিটা রাখলেন নিজের কাছেই। তারপর এগিয়ে এসে বসলেন চেয়ারে।

হ্যাঁ, এবার আমি তৈরি। প্রেত-চক্র শুরু হোক, অদ্ভুত সুরে বললেন তিনি।

কিছুক্ষণ কেটে গেল। পর্দার পিছনে সিমোনের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ক্রমেই ভারী হয়ে উঠতে লাগল। একসময় সে শব্দ প্রবল হয়ে উঠল। তারপর থেমে গেল। কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ। তারপর শোনা গেল একটা চাপা গোঁ-গোঁ আওয়াজ। একটু পরে তা-ও থেমে গেল। আবার নিস্তব্ধতা, আচমকা খঞ্জনির ঝনঝন আওয়াজে নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল। টেবিল থেকে লাফিয়ে উঠে শিঙে পড়ে গেল ঘরের মেঝেতে। কোন অদৃশ্য শক্তি যেন ওটাকে ছুঁড়ে ফেলল। খল খল করে কে যেন হেসে উঠল, মহাবিদ্রুপের হাসি। কুঠরীর ভারী পর্দাটা একটু সরে গেল। দেখা গেল মিডিয়াম সিমোনকে। মিডিয়াম চেতনা হারিয়েছে, তার মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে বুকের উপর।

হঠাৎ মাদাম একস্ জোরে শ্বাস টানলেন। মিডিয়াম সিমোনোর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে হাল্কা কুয়াশা। মনে হচ্ছে যেন একটা সরু ফিতে বের হয়ে আসছে সিমোনের ঈষৎ উন্মুক্ত মুখ থেকে।

কুয়াশা ক্রমেই ঘন হতে লাগল। মিডিয়ামের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুকণা, কণাগুলো অতিসূক্ষ্ম। কণাগুলির মধ্যে একটা আলোড়ন উঠেছে। সূক্ষ্মকণাগুলো জমাট বাঁধছে-ঘনীভূত হচ্ছে। আকার নিচ্ছে। সে আকার একটা শিশুর… একটি বাচ্চা মেয়ের।

অ্যামেলি… আমার ছোট্ট অ্যামেলি… আমার বাচ্চা আসছে আমার সামনে।

মাদাম একস্ বলে উঠলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ফিসফিসে হলেও তীক্ষ্ণ।

অস্পষ্ট মূর্তিটা ক্ৰমে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে লাগল। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ওদিকে তাকিয়ে রইল রাউল। এমন নিখুঁত দেহধারণ এর আগে কখনই দেখেনি সে।

সত্যিকারের রক্ত-মাংসে গড়া একটা জীবন্ত শিশু যেন এসে দাঁড়িয়েছে ঐ ছোট্ট কুঠরীখানার প্রবেশপথে।

মা…মামণি, শিশুর মত কচি গলার ডাক শোনা গেল।

আমার মেয়ে…আমার অ্যামেলি সোনা… চিৎকার করে বলতে বলতে উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে অর্ধেকটা উঠে পড়লেন মাদাম একসা।।

সাবধান মাদাম, অত উত্তেজিত হবেন না, রাউল চেঁচিয়ে উঠে সতর্ক করল। ইতস্তত করতে করতে বাচ্চা মেয়েটি এগিয়ে আসতে লাগল সামনের দিকে। দুখানি ছোট হাত সামনে বাড়িয়ে ছোট্ট অ্যামেলি আবার ডাকল, মা…মামণি…।

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

মাদামের গলা থেকে এক অদ্ভুত স্বর বেরিয়ে এল। তিনি আবার উত্তেজিতভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।

ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল রাউল, একি করছেন মাদাম? বসুন, বসে পড়ন, নইলে মিডিয়ামের…। রাউলের কথায় কান না দিয়ে মাদাম এক তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠলেন, আমার একমাত্র সন্তান অ্যামেলি- ওকে আমি ধরব… ওকে আমি বুকে নেব…

পাগলের মত সামনের দিকে এক পা এগিয়ে গেলেন মাদাম একস্।

ঈশ্বরের দিব্যি! নিজেকে সংযত করুন মাদাম। নিজের চেয়ারে বসুন। বসে পড়ন এক্ষুণি।

রাউল খুব ভয় পেয়েছে।

আমার বাচ্চা! আমি ওকে ধরবই। আমি ওকে কোলে নেবই। কেউ আমকে ঠেকাতে পারবে না।

সাবধান মাদাম! আমি আদেশ করছি, আপনি বসে পড়ন। আর একটি পা-ও এগোবেন না।

বাঁধনের মধ্যে রাউলের শরীরটা ছটফট করতে লাগল। বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য সে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। মাদাম এক তার কাজটি বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছেন।

আসন্ন বিপদের চিন্তায় রাউলের মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। আর্তকণ্ঠে সে চিৎকার করে উঠল, ঈশ্বরের দিব্যি! দয়া করে বসে পড়ন… বসে পড়ন দয়া করে। মিডিয়ামের কথাটা আপনি ভুলে যাচ্ছেন… দয়া করে তার কথাটা মনে রাখুন।

মাদাম একস্ যেন শুনতেই পাননি রাউলের কথা। এক অদ্ভুত আনন্দ আর উন্মাদনার ভাব ফুটে উঠেছে তাঁর মুখমণ্ডলে। বাচ্চা মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছিল পর্দার ফাঁকে। মাদাম এক হাত বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করলেন।

সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়াম সিমোনের মুখ থেকে বেরিয়ে এক তীব্র আর্তনাদ। অসহ্য যন্ত্রণায় যেন কষ্ট পাচ্ছে মিডিয়াম।

-হাঁ ঈশ্বর! এ কি সাংঘাতিক ব্যাপার! এ যে সহ্য করা যায় না, মিডিয়াম যে… রুক্ষ গলায় হেসে উঠে মাদাম একস্ বললেন, মঁশিয়ে রাউল, আপনার মিডিয়ামের জন্য আমার একটুও মাথাব্যথা নেই। আমি কেবল আমার হারানো মেয়েকে ফিরে পেতে চাই।

-আপনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন, মাদাম। ঐ শিশু এ জগতের নয়। ওকে আর স্পর্শ করবেন না।

-স্পর্শ করব না মানে? ওকে যে আমার চাই। আমার দেহের মধ্যে ও তিল তিল করে গড়ে উঠেছে। আমার কাছ থেকে বহুদূরে চলে গিয়েছিল বাছা। কিন্তু মৃতের রাজ্য থেকে আমার অ্যামেলি সোনা আবার ফিরে এসেছে আমারই কাছে। ও তো মরে যায়নি… ও বেঁচে আছে। আয়.. আমার সোনা আমার কোলে আয়।

রাউল আবার চিৎকার করে উঠতে গেল। কিন্তু অপরিসীম আতংকে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। একটি শব্দও বেরোল না তার মুখ থেকে।

মাদাম এক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছেন। পৃথিবীর সমস্ত নির্দয়তা, নির্মমতা, আদিম অসভ্যতা যেন মূর্তিমতী হয়ে উঠছে তার মধ্যে। অন্যের কথা ভাববার মত মানসিকতা আর তার মধ্যে নেই। নিজের অন্ধ আবেগেই তিনি মত্ত।

শিশু অ্যামেলির দুঠোঁট ফাঁক হলো। তৃতীয়বারের মত শোনা গেল কচি গলার ডাক, মা… মামণি!

-ও আমার সোনা… ও আমার মণি… কে বলে তুই মরে গিয়েছিস! …আয় আয় আমার কোলে আয়… আমার ভাঙা বুকখানাকে জুড়ে দে…

উন্মাদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলেন মাদাম একস্। পর্দার ওপাশ থেকে ভেসে এল অসহ্য যন্ত্রণার এক দীর্ঘায়িত আর্তনাদ।

-সিমোন…সিমোন। রাউল চিৎকার করে উঠল। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে রাউল দেখল শিশুটিকে কোলে নিয়ে মাদাম একস্ দ্রুত চলে গেলেন তার পাশ দিয়ে। তালা খুলবার শব্দ শোনা গেল। তারপর শোনা গেল সিঁড়ির উপর পায়ের শব্দ। দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন মাদাম একস্।

পর্দার ওপাশ থেকে তখনও ভেসে আসছে আর্তনাদ। অসহ্য যন্ত্রণা ছাড়া এরকম আর্তনাদ কেউ করে না। এরকম আর্ত বিলাপ-ধ্বনি রাউল তাঁর জীবনে কোনদিন শোনেনি। আর্তনাদ ক্রমে মিলিয়ে গেল। শোনা গেল একটা বিশ্রী-বীভৎস ঘড় ঘড় শব্দ। তারপর ধপাস করে একটি শব্দ শোনা গেল। শব্দটা দেহপতনের।

উন্মাদের মত দেহের বাঁধন খুলবার চেষ্টা করতে লাগল রাউল। শেষ পর্যন্ত তার উন্মত্ত চেষ্টার কাছে মাদাম একস্-এর কঠিন বাঁধনও হার স্বীকার করতে বাধ্য। হলো। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলল রাউল। সে শক্ত বাঁধন থেকে মুক্ত হলো।

রাউল উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই এলিস ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকে চিৎকার করে উঠল, মাদাম!… মাদাম! গলা চিরে, সিমোন! ডাকটা বেরিয়ে এল রাউলের।

দুজনে ছুটে গেল কালো পর্দাটার দিকে। একটানে সরিয়ে দিল পর্দাটা।

আর তক্ষুণি চমকে গিয়ে পিছিয়ে এল রাউল। উদ্ভ্রান্তভাবে সে বলে উঠল, হায় ঈশ্বর! রক্ত, এত রক্ত! জায়গাটা যে লালে লাল হয়ে গিয়েছে।

রাউলের পাশে শোনা গেল এলিসের রুক্ষ কণ্ঠস্বর। সে স্বর ভয়ে, বিস্ময়ে এবং উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে।

তাহলে শেষ পর্যন্ত আমার মাদামকে জীবনটাই দিতে হলো! কিন্তু মঁশিয়ে রাউল, সত্যি করে বলুন কি হয়েছে? কি করে মাদাম একটুকুন হয়ে গেলেন। তার দেহটা যে ছোট হয়ে গিয়েছে-অর্ধেকেরও বেশি ছোট হয়ে গিয়েছে। এ কি করে হলো? কি কাণ্ড হচ্ছিল এখানে। বলুন মঁশিয়ে… বলুন… বলুন।

জানি না! রাউল উন্মাদের মত চিৎকার করে উঠল আমি জানি না।…আমি কিছু জানি না। একি হলো। এ আমি কি করলাম… ওই…। মৃত্যুপুরীর বাসিন্দাকে জীবনলোকে নিয়ে এসে সিমোন নিজেই যে মৃত্যুপুরীতে চলে গেল! আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না এলিস। আমি জানি না… কিছু জানি না… সিমোন! সিমোন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *