ভৌতিক মুখচ্ছবি
ঘটনাটি ঘটেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯১০-১১ সালে জার্মানির লাইপজিগ শহরতলীর এক লোহার কারখানায়। গ্রামের সীমানা যেখানে প্রায় শেষ হয়েছে, সেখানে এক ছোট নদীর ধারে ছিল এই কারখানা। এখানে ঢালাইয়ের কাজ হত। লোহা গলিয়ে তা থেকে স্কু, বন্টু, কেটলি প্রভৃতি তৈরি করা হত। আশপাশের শত শত লোক কাজ করত এই কারখানায়। যে ঘরে লোহা গলানো হত সেই ঘরটি ছিল এই কারখানার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক জায়গা। রাবণের চিতার মত দিনরাত সেখানে আগুন জ্বলত দাউ দাউ করে। সেই আগুনের লেলিহান শিখার দিকে চাইলে চোখ ঝলসে যেত। বিরাট কড়ার মধ্যে টগবগ করে ফুটত গলন্ত ধাতু। তার রক্তাভায় সারা ঘরের রঙ লাল হয়ে থাকত। সে-চুল্লি কখনও নিভত না।
কারখানার সেই ফার্নেস-ঘরের ধ্বময় কর্তা ছিল লস্ স্ নামে বুড়ো কারিগর। কাছেই এক গ্রামে তার বাড়ি, কিন্তু বুড়ো কখনও বাড়ি যেত না। এখানেই দিনরাত থাকতে হত তাকে। কারখানার মধ্যে গালাই-ঘরের কাছেই ছোট একটি ঘরে সে থাকত। বুড়োর বয়স প্রায় আশি বছর। কিন্তু এ বয়সেও ছিল যেমন অসুরের মত চেহারা, তেমনি গায়ের জোর। সেজন্যে কারখানার মালিকরা ঐ গালাই-ঘরের হেফাজতেই রেখে দিয়েছিল তাকে। এই ভয়াবহ জায়গার গুরুত্ত্বও খুব বেশি বলে, যে কোন নতুন লোককে সেখানে রাখা যেত না। তাছাড়া কারখানার গোড়া থেকেই সে এখানে কাজ করছিল। এর প্রতি তার আসক্তি ছিল দারুণ। কর্তব্যনিষ্ঠা আর দুর্জয় সাহস নিয়ে দিনের পর দিন আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলত বুড়ো। আগুনের তাপে তার সারা গায়ের রঙ ঝলসে খয়েরের মত হয়ে গিয়েছিল।
কারখানার মালিকরা তাকে মাসিক ভাতা দিয়ে অবসর গ্রহণের জন্য বহুবার বলেছিল, কিন্তু লস্ তাতে রাজী হয়নি। সে বলত, এ কাজ না করে বসে থাকলে সে মরে যাবে। অগ্নিদেব তার বন্ধু, আর এই আগুনই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সত্যিই মাঝে মাঝে আগুনের সঙ্গে যেন খেলা করত বুড়ো! বিড়বিড় করে কি-সব বকত, হাসত, ভেংচি কাটত ফার্ণেসটার দিকে তাকিয়ে। সবাই বলত, এই রে, বুড়োর এবার ভীমরতি ধরেছে! মরবে!
হলও তাই। যে রক্ষক সেই একদিন ভক্ষক হলো! নেশার ঘোরে অসাবধানতাবশতঃ বুড়ো একদিন লোহা গালাইয়ের জ্বলন্ত ধাতুপাত্রের মধ্যে পড়ে নিমেষে কর্পূরের মত উবে গেল। হ্যাঁ করে একটা শব্দ হলো কেবল। আর ফার্নেসের উপর থেকে খানিকটা ধোয়া চিমনীর ভেতর দিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল আকাশে। হাঁ হাঁ করে উঠল তার ঘরের অন্যান্য লোকেরা। সারা কারখানায় খবর ছড়িয়ে পড়ল চক্ষের নিমেষে। খবর পেয়ে মালিক নিজেই ছুটে এলো গালাই-ঘরে, কিন্তু তখন সেখানে লসের বাষ্প পর্যন্ত নেই!
এতদিনের পুরোনো কর্মচারী বুড়ো লসের এই অপঘাত-মৃত্যুতে সবাই মর্মাহত হলো। কারখানায় ছুটির বাঁশি বেজে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। মালিক তার সম্মানে কারখানা তখনি বন্ধ করে দিল। চারিদিকে নানা গল্প চলতে লাগল লসকে নিয়ে। ছুটির পর পথ চলতে চলতে কারিগরদের মধ্যে একজন বলল, মৃত্যুই ওর ভালো হয়েছে–যার সঙ্গে ওর সারাজীবনের সম্বন্ধ সেই ফার্নেসের মধ্যেই ও মিশে গেছে!
একজন বলল, এই বেশ, এ বয়সে পেটের অসুখে ভুগে মরার চেয়ে এ মৃত্যু অনেক ভালো- নায়কোচিত মৃত্যু!
দুতিন দিন ধরে এমনি সব বলাবলি চলতে লাগল পুরোনো কারিগরদের মধ্যে। বুড়ো লসের জয়গানে সবাই পঞ্চমুখ হয়ে উঠল।
আসলে বুড়ো একটু-আধটু নেশা-ভাঙ করলেও মানুষ হিসাবে ছিল খাঁটি। বৌ মরে যাবার পর বুড়ো আর গ্রামের বাড়িতে ফিরে যায়নি। এই কারখানায় ঢুকে কারখানাকেই ঘরবাড়ি করে নিয়েছিল। বাড়িতে যদিও তার এক বোম্বেটে ধরনের ছেলে ছিল, তার সঙ্গে বুড়োর এক তিল বনত না। অবসর-সময় কারখানার ছোকরাদের সঙ্গে গল্প করেই বুড়ো কাটিয়ে দিত, তাদের অনেককেই সে ভালোবাসত নিজের ছেলের মত। কিছু কিছু নিজের মাইনে থেকে লুকিয়ে দান ধ্যানও সে করত। সবসুদ্ধ এখানে লস্ কাজ করেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর। এইসব কারণে কারখানায় শুধু তার সহকর্মীদের নয়, মালিকের পর্যন্ত তার মৃত্যুতে দুঃখের সীমা-পরিসীমা ছিল না।
কদিন এইভাবে কাটবার পর শোকের বেগ একটু কমলে কারখানার কারিগররা সকলে মিলে তার মৃত-আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবার জন্য কারখানার ভিতরকার খোলা ময়দানে জড় হলো। এ সব সভায় সাধারণতঃ যেমন সব হয়, তেমনি এখানেও অনেকে লসের গুণাবলী নিয়ে কর্তব্যনিষ্ঠা, একাগ্রতা, দয়াদাক্ষিণ্য প্রভৃতি নিয়ে বক্তৃতা করল। কজনের বক্তৃতা হয়ে যাবার পর কারখানার মালিক যখন বক্তৃতা করতে উঠে তার স্মৃতিরক্ষার জন্যে বেশ কিছু টাকা দিয়ে একটি প্রস্তরমূর্তি তৈরি করাবার কথা ঘোষণা দিল, তখন ঘটল এক বিপদ। উপস্থিত জনতার ভিতর থেকে লসের ছেলে দাঁড়িয়ে উঠে প্রতিবাদ করে বলল, আমার বাবার কোন ছবি বা ফটোগ্রাফ নেই, কাজেই প্রস্তরমূর্তি করায় অসুবিধা আছে। এই টাকাটা এভাবে খরচ করে বরং আমাদের দরিদ্র সংসারে দিলে খুব উপকার করা হবে?
এ কথায় আশপাশের অনেকেই আপত্তি তুললো, কারণ তারা ছেলের চরিত্র জানত এবং বাপের সঙ্গে ছেলের যে কোন সম্পর্ক ছিল না, তাও অজানা ছিল না তাদের কাজেই তার হাতে একেবারে এ টাকা তুলে দিতে অনেকেই আপত্তি জানাল। কিন্তু অনেকে আবার সায় দিল ছেলের কথায়। সম্ভবতঃ লসের ছেলের কাছ থেকে ঐ টাকার কিছু অংশ পাবে বলে তারা আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
এই নিয়ে সভায় বেশ বাদানুবাদ এবং গণ্ডগোলের সৃষ্টি হলো। একপক্ষ বলল, লসের চেহারা আমরা কল্পনা থেকে আঁকিয়ে নিয়ে তা থেকে তার স্ট্যাচু করব। সেই ষ্ট্যাচু এই কারখানার মধ্যে থাকবে, এবং প্রতি বছর তার মৃত্যু-দিবসে সকলে আমরা একসঙ্গে সমবেত হব এখানে।
অপর পক্ষ বলল, যেহেতু কোন ফটো নেই, কাজেই কল্পনা থেকে যা-তা একটা কিছু করা ঠিক হবে না, তার চেয়ে টাকাটা তার গরীব ছেলেকে দিয়ে সাহায্য করাই ভালো।
দুদলের মধ্যে এই বাদানুবাদ যখন বেশ তীব্রতর হয়ে উঠেছে, তখন এক অলৌকিক অভূতপূর্ব ঘটনায় সকলেই বিস্ময়াভিভূত হলো। সকলের দৃষ্টি গেল। আকাশের দিকে। নির্মল নীলাম্বরের বুকের উপর দিয়ে কারখানার চিমনী থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে যে ধোঁয়া উঠছিল, তারই মধ্যে ভেসে উঠেছে বুড়ো লসের মুখ! হাওয়ার বেগে ধোয়ার রাশ যেমন ভেসে ভেসে যাচ্ছে, ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে তেমনি মুখখানাও এক একবার ভেঙে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে হাওয়ার সঙ্গে, আবার জোড়া লাগছে এসে! সে মুখ ঠিক জীবন্ত লসের মুখের মত না হলেও, তা থেকে চেনা যায় লসকে। মাংস পুড়ে জড়িয়ে গেলে যেমন হয়, মুখের চেহারা তেমনি পোড়া বীভৎস ভয়াবহ!
সকলে নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে- সেই ধূম্রকুণ্ডলীর মধ্যে ভৌতিক মুখচ্ছবির দিকে!
কারখানার মালিক ওয়াগনার প্রস্তাব দিল, এখনি ঐ মুখের একটা ফটো তুলে নেওয়া হোক, ঐ থেকেই মর্মরমূর্তি তৈরি হবে।
সঙ্গে সঙ্গে তাই করা হলো। আকাশে আলো ছিল তখনও, ছবি তুলতে অসুবিধা হলো না। খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে গ্রামের আশপাশ থেকে লোক এসে হাজির হলো সেখানে। সকলেই আকাশের গায়ে ঐ অদ্ভুত রোমাঞ্চকর ভৌতিক দৃশ্য দেখে একেবারে থ! তারপর রাত্রের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল বুড়ো লসের ঐ বিকৃত মুখ!
Unknown Worlds নামক মাসিক-পত্রিকায় বুড়োর মুখের ছবি বেরিয়েছিল।
এরপর প্রতি বছরই তার স্মৃতি-বার্ষিকীর দিনে ঐ মুখ আজও নাকি ভেসে ওঠে আকাশের বুকে ঐ চিমনীর ধোঁয়ার মধ্যে! সেদিন হাজার হাজার লোক দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসে এই দৃশ্য- আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকে তারা! তারপর হঠাৎ একসময় সকলকে আশ্চর্য, ভীত, সচকিত করে ভেসে ওঠে লসের মুখ সকলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিঃসাড়ে চেয়ে থাকে সে মুখের দিকে! ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে কেউ সঙ্গে নিয়ে যায় না সেখানে।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)