2 of 3

বহুলাড়া

বহুলাড়া

জায়গাটির নাম ওন্দা। রিনির মতে, খুব মিষ্টি নাম। যে-সব শব্দের কোনও মানে বোঝা যায় না, সেইসব শব্দ রিনির খুব পছন্দ।

কোথায় ওই ওন্দা? যদি জানা যায় যে বাঁকুড়া জেলার মধ্যেই, তাহলে খুঁজে পাওয়া মোটেই শক্ত নয়। বাঁকুড়া শহর আর বিষ্ণুপুরের মধ্যে কোনও এক জায়গায়। বাস যায়, রেল স্টেশন আছে।

রিনি আর প্রতুল ভিড়ের বাসে চেপেই পৌঁছোল সেখানে।

বাঁকুড়া শহরে প্রতুলের অফিসের কাজ ছিল। সে ওষুধের ফেরিওয়ালা, তাকে অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়। কলকাতা থেকে ট্রেনে দুর্গাপুর, তারপর শেয়ারের ট্যাক্সিতে বাঁকুড়া। সেইভাবেই ফেরার কথা ছিল, কিন্তু এবারে রিনি তার সঙ্গে এসেছে।

অফিসের কাজে স্ত্রী-কে সঙ্গে নিয়ে বেরুলে দু-একদিনের ছুটি করিয়ে নেওয়া যায়। মুকুটমণিপুর বাংলোতে দু-এক রাত কাটাতেও প্রতুল রাজি ছিল। কিন্তু রিনির শখ অন্যরকম, সে প্রাচীন মন্দির দেখবে। বেশ তো, বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত মন্দিরগুলো দেখে আসা যাক, রিনি তাতেও রাজি নয়। ছাত্রী বয়েসে সে একটা বড় দলের সঙ্গে এদিককার সব বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখে গেছে। সে। সব জায়গায় সে আর যেতে চায় না। সে একটা নিজস্ব তালিকা টুকে এনেছে।

তার প্রথম নাম বহুলাড়া। আর একটি দুর্বোধ্য শব্দ। কাজের জন্য অন্তত দশ-বারোবার প্রতুলকে আসতে হয়েছে বাঁকুড়ায়, কক্ষনো সে ওই নাম শোনেনি। এবারে এসে বাঁকুড়ায় কয়েকজনকে জিগ্যেস করা হল বহুলাড়ার কথা, তারা মুখ শোঁকাকি করে।

—কী আছে বহুলাড়ায়?

—জৈন আমলের বিখ্যাত প্রাচীন মন্দির। প্রায় হাজার-হাজার পুরোনো। পশ্চিম বাংলায় এত পুরোনো মন্দির আর কটা আছে?

—এত বিখ্যাত মন্দির অথচ কেউ নাম শুনলে চিনতে পারে না?

রিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, লোকাল লোকেরা বেশির ভাগ সময়েই এইসব জিনিসের কোনও খবর রাখে না। কোনও ইন্টারেস্ট নেই তো! দূর থেকেই মানুষ এইসব দেখতে আসে। চলো, ওন্দায় গেলে ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে।

বাস থেকে নামা হল বাজারের সামনে। খুব ছোট বাজার নয়, লোকজনের ব্যস্ততা আছে বেশ, বাঁধাকপি, লাউ, বেগুনগুলো যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান। একজন সাইকেল-আরোহীকে মন্দিরটির কথা জিগ্যেস করতেই সে বলল, চলে যান এই সামনের রাস্তা ধরে, একেবারে সোজা।

রাস্তাটি কিন্তু একেবারে সোজা নয়। বাজার পেরিয়ে, জনপদের মধ্যে দিয়ে গেছে ঘুরে-ঘুরে। খানিক পরেই অবশ্য গ্রাম ছাড়িয়ে রাঙা মাটির পথ। সামনে লেভেল ক্রসিং।

রিনির তথ্য অনুযায়ী বড় রাস্তা থেকে মন্দিরের দূরত্ব মাত্র চার মাইল। মাত্র? গ্রামের দিকে চার মাইল যে কতখানি লম্বা সে সম্পর্কে রিনির কোনও ধারণা আছে? যাই হোক, শীতের মনোরম দুপুর, প্রতুলের হাঁটতে আপত্তি নেই।

লেভেল ক্রসিং-এর সামনে একটু দাঁড়াতে হয়। প্রতুলের সন্দেহ বাতিক, সে একটি তেল চুকচুকে চুলওয়ালা, পা-জামার ওপর সবুজ গেঞ্জিপরা কিশোরকে মিষ্টি করে জিগ্যেস করল, হ্যাঁ ভাই, বহুলাড়া মন্দিরটা এই দিকেই তো?

ছেলেটি চোখ কুঁচকে জিগ্যেস করে, কী?

যদিও কথা বলছে প্রতুলের সঙ্গে কিন্তু ছেলেটি তাকিয়ে আছে রিনির দিকে। সে প্রতুলের কথা বুঝতে পারে না, সে জানে না। ইতিমধ্যে ট্রেন এসে যায়।

লাইন পেরিয়ে ওপারে আসার পর রিনি বলল, ও বাচ্চা ছেলে, ওরা পুরোনো মন্দিরের কথা জানবে কী করে?

প্রতুল বলল, খুব বাচ্চা নয়, বয়ঃসন্ধি হয়ে গেছে, তোমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল…

এবারে দেখা গেল একটি সাইকেল রিকশা। একজন মাত্র যাত্রী। রিকশাওয়ালাকে জিগ্যেস করতেই সে বলল, মন্দির তো? এই টানা রাস্তা, সামনে একখানা গাঁ পাবেন।

—কত দূর?

—তা একটুখানি দূর আছে!

রিকশাওয়ালাকে অনায়াসে বলা যেতে পারে যে তোমার সওয়ারি নামিয়ে ফিরে এসো। তারপর যাত্রা সুখকর হবে, রিকশাওয়ালাই হবে গাইড।

কিন্তু রিনির সে রকম কোনও অভিপ্রায় আছে কি না বোঝা গেল না। সে প্রতুলকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে।

বাঁ-কাঁধ থেকে ক্যামেরাটা ডান কাঁধে ঝোলাল প্রতুল। বাঁ-পকেটে সিগারেট ধরিয়ে সে জিগ্যেস করল, মন্দিরটা কত উঁচু, দূর থেকে দেখা যাবে? রিনি বলল, বেশ উঁচুই তো হওয়ার কথা। পশ্চিম বাংলায় এত বড় প্রাচীন মন্দির খুব বেশি নেই।

সামনের মাঠ চিরে চলে গেছে রাস্তা। অনেক দূরে গাছপালা-ঘেরা গ্রাম, তার মাথা ছাড়িয়ে কোনও কিছুই আকাশের দিকে ওঠেনি। এই শীতেও আকাশ মেঘলা, এদিককার পৃথিবী এখন ছায়াময়।

প্রতুল বলল, এই মাঠের মধ্যে কেন অত বড় মন্দির বানাবে? মন্দির তো মানুষের জন্য, তাই না?

—এক সময় নিশ্চয়ই এখানটা সমৃদ্ধ জায়গা ছিল, হয়তো কোনও রাজধানী ছিল!

—সেসব লোপাট হয়ে গেল, শুধু মন্দিরটা বেঁচে রইল? ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, হয়তো গিয়ে দেখব একখানা মাত্র ভাঙা দেয়াল।

—মোটেই না, আমি পুরো মন্দিরের ডেসক্রিপশান পড়েছি।

—কিন্তু, আমিও যেন কোথায় পড়েছি যে একসময় এই পুরো জায়গাটাই ছিল গভীর জঙ্গল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুটো ব্যাটেলিয়ান একশো কুড়ি মাইল হেঁটেও তাদের তাঁবু খাটাবার জন্য ফাঁকা জায়গা খুঁজে পায়নি।

রিনির চটিতে কাঁকর ঢুকেছে। সে নীচু হয়ে তার ফর্সা পা থেকে লাল রঙের চটিটা খুলল। সে ইতিহাসের ছাত্রী ছিল, ইতিহাস তার সম্পত্তি।

রিনি মুখ তুলে চোখে কৌতুক ঝলসে বলল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, সে তো মাত্র শ দুয়েক বছর আগেকার কথা। দেড়-দুহাজার বছর আগেও এখানে সভ্যতার বিস্তার ঘটেছিল, এখানে। ছোটখাটো স্বাধীন রাজ্য ছিল…রাজা সিংহবর্মা আর চন্দ্রবর্মার নাম শুনেছ? শশাঙ্করও আগে এঁরা ছিলেন বাঙালি রাজা। চন্দ্রবর্মাকে হারিয়েই সমুদ্রগুপ্ত রাঢ় বঙ্গের দিকে এগিয়েছিলেন।

ইতিহাস যেন একটা ফুটবল, কাছাকাছি পেলে সবাই একবার লাথি কষাতে চায়।

প্রতুল অবজ্ঞার সুরে বলল, বাঙালি রাজাই হোক আর বিদেশি রাজাই হোক সবই তো ছিল ডেসপট। আর মন্দির মানেই কলোসাল ওয়েস্টেজ অফ মানি! আগেকার দিনের রাজারা গরিব লোকদের শোষণ করা টাকায় বড়-বড় মন্দির বানিয়ে নিজেদের নামে ঢাক পেটাত! এই ধাধধাড়া গোবিন্দপুরে মন্দির না বানিয়ে একটা ভালো রাস্তা বানাতে পারেনি?

রিনি বলল, এককালে এখানে বিখ্যাত রাস্তা ছিল, তাম্রলিপ্ত থেকে পাটলিপুত্র, সেই রাস্তা গিয়েছিল বহুলাড়ার ওপর দিয়ে…

—তা রাজাদের যুগ শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তাটাও কি হাপিস হয়ে গেল? রাজারা নিজেদের বানানো রাস্তা কি স্বর্গে নিয়ে গেছে?

রাস্তাটা সত্যি বেশ খারাপ। বড়-বড় খানাখন্দের ওপর সদ্য কিছু খোয়া ফেলা হয়েছে। কয়েকদিন বৃষ্টি নেই, তবু কোনও-কোনও জায়গায় জমে আছে কাদা। রিনি শাড়ি উঁচু করে তুলে পা ফেলছে খঞ্জনা পাখির মতন।

মনে হচ্ছে যে ঘণ্টাখানেক হাঁটা হয়ে গেছে, তবু পথের শেষ নেই। তবে এখন মাঠ ছাড়িয়ে চোখে পড়ে জনবসতি। দূরে একটা লম্বাটে, সাদা রঙের একতলা বাড়ি, সম্ভবত স্কুল। কিন্তু মন্দির। কোথায়?

আকাশের অবস্থা দেখলে মনে হয় বিকেল শেষ হওয়ার আগেই অন্ধকার নেমে আসবে।

প্রতুল বলল, কালাপাহাড় নামে একটা লোক এদিককার সব হিন্দু মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল না? তোমার ওই মন্দিরেরও নিশ্চয়ই সেই দশাই হয়েছিল।

রিনি বলল, তোমাকে অনেকবার বলেছি, বহুলাড়ার মন্দিরটা হিন্দুদের নয়, জৈনদের।

প্রতুল একটু থতমত খেয়ে গেল। কালাপাহাড় শুধু হিন্দু মন্দির ভেঙে জৈন্য-বৌদ্ধদের মন্দিরগুলো রেয়াত করেছিল কি না সে সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু অন্য একটা কথা তার মনে পড়ে যায়। সে জিগ্যেস করল, তুমি বোধগয়ার মন্দিরে গেছ?

রিনি মুখ ফিরিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে বলল, না, কেন?

—বোধগয়ার বিখ্যাত মন্দির, বৌদ্ধদের মন্দির, যেখানে গৌতম বুদ্ধ একসময় গাছতলায় বসে তপস্যা করেছিলেন, সেই মন্দিরের সামনের দিকে শিবঠাকুরের পুজো হয়।

—হ্যাঁ, তাকে কী?

—অনেক বৌদ্ধ আর জৈন মন্দির হিন্দুরা পরে দখল করে নিয়েছে। তোমরা হিন্দুরাও অন্য ধর্মের ওপর কম অত্যাচার করোনি!

তোমরা হিন্দুরা এটা জোর দিয়ে বলার কারণ হল প্রতুল কনফার্মড নাস্তিক এবং সেকথা সে প্রায়ই জোরে জানান দিতে চায়।

এর উত্তরে রিনি শুধু বলল, আমরা সামনের বছর ওই দিকটায় বেড়াতে যাব, অ্যাঁ?

কাছাকাছি দুটি লোককে দেখে প্রতুল জিগ্যেস করল, এদিকে একটি মন্দির আছে?

সে না শুনবে আশা করেছিল, কিন্তু লোকদুটি আগ্রহের সঙ্গে বলল, হ্যাঁ আছে, ওই তো ইস্কুলটা ছাড়িয়ে ডান পাশে…।

পাঁচ মিনিট হেঁটে সেই মন্দিরের সামনে পৌঁছে রিনির মুখে একই সঙ্গে রাগ, দুঃখ, বিরক্তি, ক্ষোভ, অবিশ্বাস ইত্যাদি অনেক কিছুর ছায়া মিশে গেল। না, না, না, এ মন্দির নয়, এটা হতেই পারে না! এটার জন্য কেউ কষ্ট করে এতদূর হেঁটে আসে না।

প্রতুল মিটিমিটি হাসছে।

একটা অতি সাধারণ শিবমন্দির, পনেরো-কুড়ি বছরের বেশি পুরোনো নয়, বাইরের দেয়ালটা সদ্য গেরুয়া রং করা, ভেতরের দেয়ালে অনেকগুলি ক্যালেন্ডারের ছবি। শিবলিঙ্গটি মনে হয় স্লেট পাথরের তৈরি, নাকে আসে পচা দই-এর গন্ধ।

একজন বলল, এই শিবঠাকুর নাকি খুব জাগ্রত

রিনি জোর দিয়ে কান্না-কান্না গলায় বলতে লাগল, এটা নয়! বহুলাড়ার প্রাচীন মন্দির। জৈনদের মন্দির!

দু-তিনজন জিগ্যেস করল, কোন জায়গা বলছেন?

—বহুলাড়া! বহুলাড়া!

ওরা কেউ রিনির কথা বুঝতে পারছে না। এ ওর দিকে চোখ নাচাচ্ছে।

প্রতুল এবার এগিয়ে এল রিনিকে সাহায্য করবার জন্য। সে সবিস্তারে বোঝাল, তারা দেখতে এসেছে এমন একটা মন্দির যার কথা ইতিহাস বইতে লেখা থাকে। সেটা ভাঙাচুরো হলেও ক্ষতি নেই–।

ওরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ পরামর্শ করে তারপর জানাল যে সেরকম একটা মন্দির আছে বটে। প্রতুলদের রাস্তা ভুল হয়েছে। একটু আগের ডান দিকের রাস্তা ধরে যেতে হবে, একটা গ্রাম পেরিয়ে খানিকটা দূরে!

একজন বলল, কিন্তু সে মন্দিরে তো এখন পুজো হয় না!

রিনি ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, না হোকগে, আমরা কি পুজো দিতে এসেছি নাকি?

খানিকটা ফেরাপথে গিয়ে ওরা ডানদিকের রাস্তা ধরল। সামনেই একটা গ্রাম।

রিনি জিগ্যেস করল, এত কাছে থাকে, তবু ওরা বহুলাড়া মন্দিরের নাম শোনেনি?

—ওরা তোমার কথা বুঝতে পারেনি। তুমি বইতে নাম পড়েছ বহুলাড়া, আর ওরা বলছিল বেউল্যাড়া না কী যেন! আমাদের উচ্চারণ আলাদা।

একটু থেমে প্রতুল বলল, আমাদের অনেক কিছুই তো ওদের চেয়ে আলাদা!

রিনি বলল, কী বিচ্ছিরি একটা মন্দির বানিয়েছে, দেখলেই গা কিটকিট করে। আগেকার দিনের মানুষদের রুচি ছিল, সৌন্দর্যবোধ ছিল, তাই কত সুন্দর-সুন্দর মন্দির বানাত!

সামনেই একটা গরুর গাড়ি গাড্ডায় পড়েছে। একজন বুড়ো গাড়োয়ান আর তার খুদে অ্যাসিস্টেন্ট প্রাণপণ ঠেলাঠেলি করেও তুলতে পারছে না।

প্রতুল ক্যামেরাটা খুলল। তারপর মনোযোগ দিয়ে দেখে বলল, এই রে, দুটো মোটে ফিলম আছে। আর একটা রোল ফেলে এসেছি!

রিনি বলল, তুমি কী যে কর! এত কষ্ট করে যাচ্চি, তুমি মন্দিরের ছবি তুলবে না?

প্রতুল শাটারে হাত দিয়ে বলল, তুমি পুরোনো মন্দির দেখতে যাচ্ছ তো, ওই গরুর গাড়িটাও অন্তত দু-তিন হাজার বছরের পুরোনো তো হবেই। গৌতম বুদ্ধের সময়ও এই রকমই গরুর গাড়ি চলত! এই রকমই কাদায় পড়ত।

ছবিটা তোলার পর সে এগিয়ে গেল গরুর গাড়িটা ঠেলে তোলার জন্য হাত লাগাতে। কিন্তু ঠিক। তখনই চাকাটা উঠে এল ওপরে। টাল সামলাতে না পেরে প্রতুল একটা হোঁচট খেল এবং বাঁ পা টা একটু মুচকে গেল। পরোপকারের তো অভ্যেস নেই।

মেয়েরা অদ্ভুত-অদ্ভুত সময়ে হাসতে পারে। এই দৃশ্যে রিনির এতখানি হাসি পাওয়ার কোনও মানে হয়!

কিছুই হয়নি এরকম একটা ভাব করে প্রতুল আর একটা সিগারেট ধরাল।

বৃদ্ধ গাড়োয়ানটি জিগ্যেস করল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন?

প্রতুল বলল, কলকাতা থেকে। ভাঙা, পুরোনো মন্দিরটা আর কত দূরে?

বৃদ্ধ ওদের দুজনের দিকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে জিগ্যেস করল, বেশি দূরে নয়, রাতে থাকবেন কোথায়?

—কেন, এখানেই কোথাও থাকার জায়গা পাওয়া যাবে না? আপনার বড়িতে?

বৃদ্ধটি রহস্যময় ভাবে হাসল।

—আপনার বাড়ি কোথায়? এই গ্রামে?

—নাঃ!

গরুর গাড়িটিতে কিছু থালাবাসন, হাঁড়ি-কুড়ি, একটা টিনের বাক্স, দু-একটা বস্তা, একটা ভাঙা সাইকেল, একটা কানভাঙা মাটির কলসি রয়েছে, যেন কাদের গোটা সংসার। কেউ যেন এক জায়গার বাড়ি ভেঙে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে।

বৃদ্ধটির হাসির ধরন-ধারণ দেখে প্রতুল আর কোনও প্রশ্ন করতে সাহস পেল না।

কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে ওদের পেছন-পেছন আসছে। রাস্তার ধারে পুকুরে গা ধুতে-ধুতে স্ত্রীলোকরা অবাকভাবে চাইছে ওদের দিকে। দুটো কুকুর ঘেউঘেউ করে উঠল।

রিনি এখন হাঁটছে প্রতুলের খুব কাছ ঘেঁষে। বাচ্চাদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে, রীতিমতন পনেরো-কুড়িজনের একটা দল। সব খালি গা, কারু বা শুধুইজের পরা। যে-বয়েসে বালিকাদের বুক ঢাকতে হয় সেই বয়েসি বালিকারা বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখেছে দু-হাত।

প্রতুলের পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে, তবু যথাসাধ্য স্বাভাবিকভাবে চলবার চেষ্টা করছে সে। রাস্তা কি ফুরোবে না?

বাচ্চারা কিছু বলছেনা, শুধু হাঁ করে দেখছে ওদের। রাস্তার ধারের বাড়িগুলো থেকে বয়স্ক লোকেরা উঁকি মারছে। শিশুরা এসে যোগ দিচ্ছে মিছিলে।

এতগুলো চোখের দৃষ্টিতে অস্বস্তি লাগেই। তাছাড়া, এরা সবাই মিলে পয়সা চাইবে না তো?

একটা কালো কুচকুচে সাত-আট বছরের সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছেলে একেবারে ছুটে এল ওদের কাছাকাছি।

প্রতুল জিগ্যেস করল, এই তোর নাম কী রে?

ছেলেটি কোনও উত্তর না দিয়ে নাকের সিকি খুঁটে নিয়ে টপ করে মুখে পুরে দিল।

রিনি দুঃখিতভাবে মুখ ফিরিয়ে নিলে বলল, এ!

প্রতুল বলল, এখানে স্বাধীন রাজ্য ছিল, এত বড় মন্দির, কাছাকাছি নিশ্চয়ই মন্ত্রী-সেনাপতিদের বাড়ি ছিল। এই ছেলেটা হয়তো সেই রকমই কারু বংশধর।

কাছাকাছি একটা বাড়ি থেকে একঘেয়ে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। একটু আগে ছাড়িয়ে আসা একটি কিশোরী মেয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ধর্মরাজের ঘোড়া, বাঁ-পাটি লটর পটর ডান পাটি খোঁড়া!

প্রতুল হেসে বলল, আমাকেই বলছে নাকি?

রিনি উত্তর দিল না। সে তার মনটাকে এই পরিবেশ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে।

মস্ত বড় একটা কাঠের বোঝা নিয়ে আস্তে-আস্তে হেঁটে যাচ্ছে এক বুড়ি। কত বয়েস হবে এই বুড়ির, মুখের চামড়া দেখলে মনে হয় শ-খানেক বছরের কম নয়। কাছাকাছি জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ কুড়িয়ে এনেছে মনে হয়, অত বড় একটা বোঝা প্রতুল নিজেই বইতে পারবে কি না সন্দেহ।

এইরকম এক বৃদ্ধাকেও যখন এত পরিশ্রম করতে হয় তখন ওর সংসারের অবস্থাটা কীরকম তা অনুমান করতে বেশি কল্পনাশক্তির দরকার হয় না।

বুড়িটি মাঝে-মাঝে থেমে আকাশের দিকে চাইছে। মেঘলা আকাশে ওর কীসের কৌতূহল? রিনি আর প্রতুল ওর পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল, বুড়িটি একবার ভ্রূক্ষেপও করল না!

এক-একটা কুকুর যেমন অচেনা মানুষের সঙ্গ নেয়, ন্যাংটো বাচ্চাটা সেই রকম ওদের কাছ ছাড়ছে না। ছেলেটার পেটটা তার মাথার চেয়েও অনেক বড়। রিনি এমনিতে বাচ্চাদের ভালোবাসে কিন্তু ছেলেটার দিকে একবারও তাকাচ্ছেনা।

এবার একটা বাঁক ঘুরেই চোখে পড়ল মন্দির। বড় একটা আমগাছে ঢাকা পড়ে ছিল। সত্যিই বেশ বড় মন্দির, তার গায়ে প্রাচীনত্বের গাম্ভীর্য ও কারুকাজ। বেশ একটা ইতিহাস-ইতিহাস ছাপ আছে। সামনে প্রশস্ত চত্বর। পুরাতত্ব বিভাগের একটি নোটিশও টাঙানো আছে। কে জানে, ওই নোটিশটি টাঙিয়ে যাওয়ার পর পুরাতত্ত্ব বিভাগের এই মন্দিরটার কথা মনে আছে কি না!

রিনির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে উচ্ছ্বসিতভাবে বলে উঠল, দ্যাখো বলেছিলুম না! কী ম্যাজেস্টিক!

প্রতুল উলটো দিকে ফিরে দেখল একটা নিরানন্দ নিঝুম গ্রাম, আর কতগুলো মলিন ছেলেমেয়ে। ইতিহাস এই মন্দিরটাকে টিকিয়ে রেখেছে আর কাছাকাছি মানুষগুলোকে ক্রমশই ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে।

আজকের বর্তমানও তো একদিন ইতিহাস হবে, তখন এখানে এসে মানুষ কী দেখবে?

ন্যাংটো বাচ্চাটা চোখ গোল-গোল করে তাকিয়ে আছে রিনির দিকে।

প্রতুল জিগ্যেস করল, এই, কী দেখছিস রে? এখানে আর আমাদের মতন কেউ আসে না?

ছেলেটি বলল—হ্যাঁ। আগের বছর এসেছিল একজন সাহেব আর মেম।

প্রতুল ক্যামেরা তুলে বলল, তুই এই মেমসাহেবের পাশে দাঁড়া, তোর ছবি তুলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *