৫
১৯০২-১৯০৩৷ কেংটুং রাজ্য৷ এবার আমাদের ঢের দূরে যেতে হবে— রেলের লাইন থেকে প্রায় পঁচিশ-ছাবিবশদিনের পথ৷ আমার ঘাড়ে আবার দূরবিনের কাজ পড়েছে৷ সঙ্গে অনেক লোক আর ভারবাহী খচচর, বলদও প্রায় ষাট-পঁইষট্টিটা৷ আঠারো দিনের পথ চলে এসে আমরা একটা বড়ো নালার ধারে, এক ফুংগির আশ্রমে তাঁবু খাটিয়েছি৷
নদীতে বাঁধ দিয়ে ফুংগি মাছ পুষেছেন৷ মাছগুলোকে ফুংগি বড়ো ভালোবাসেন, রোজ ভাত রেঁধে তাদের খেতে দেন৷ মাছও ঢের, জলে একটা কিছু ফেললেই চল্লিশ-পঞ্চাশটা এসে জড়ো হয়৷ আমরা লেবুর খোসা ফেলে অনেকক্ষণ ধরে তাদের তামাশা দেখলাম৷ সঙ্গের লোকদের রকম-সকম দেখে মনে হল যেন মাছগুলো দেখে তাদের জিভ দিয়ে জল পড়ছে৷ আমি সেইজন্য তাদের সাবধান করে বললাম, ‘খবরদার, ফুংগির মাছ যেন ধোরো না৷’ তারা ব্যস্ত হয়ে জিভ কেটে বলল, ‘আরে রাম, ফুংগির মাছ ধরতে যাব?’ আমার কিন্তু সন্দেহ মিটল না, আর কাজেও তাই হল৷ রাত্রে আমি যেই ঘুমিয়েছি অমনি তারা গিয়ে দুটো মাছ ধরেছে৷ এ খবর অবশ্য আমি পরে পেয়েছিলাম৷
এর শাস্তি ভগবান হাতে-হাতেই দিয়েছিলেন৷ পরের দিন আমাদের সালউইন নদী পার হতে হবে৷ আমি আরও দুবার এই পথে যাওয়া-আসা করেছিলাম, কাজেই রাস্তা আমার বেশ ভালো করেই জানা৷ আমি আগের দিন বিকেলে সকলকে ডেকে একটা পাহাড় দেখিয়ে বললাম, ‘ওই পাহাড়ের নীচে গিয়ে দুটো পথ পাবে৷ যেটা পাহাড়ের উপর উঠে গেছে সেটাই আসল পথ৷ যেটা নালার ধারে-ধারে গেছে, সে পথে যেয়ো না, গেলে দু-দিনেও সালউইন নদীতে পৌঁছতে পারবে না৷’
তাদের কপালে দুর্ভোগ ছিল, তারা সেকথা শুনবে কেন? তারা আমার আধ-ঘণ্টা আগে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিল, আর গিয়েছিল ঠিক যে পথে যেতে আমি নিষেধ করেছিলাম, সেই পথে৷ পাহাড়ের নীচে এসেই তাদের পায়ের দাগ দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ব্যাপারখানা কী৷ আমি তখনই তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য একজন লোককে দৌড়িয়ে পাঠালাম, তারা তার কথা গ্রাহ্যই করল না৷
তাদের সঙ্গে একজন ভারি চালাক সার্ভেয়ার ছিল, সে নাকি আগের বছর এই সমস্ত জায়গা জরিপ করে গেছে৷ সে বলল, ‘পাহাড়ের রাস্তা বড়ো বিশ্রী, তাতে বেজায় চড়াই৷ আমি রাস্তা জানি, চলো নদী ধরে যাই, ওদের ঢের আগে পৌঁছব৷’
সেই ফাজিলের কথায় ভুলে বেচারারা বারোটা-সাড়ে-বারোটা পর্যন্ত নালায়-নালায় চলেছে, কখনো এপার, কখনো ওপার৷ তারপর কয়েকজন হাতিওয়ালার কাছে জানতে পারল যে সেদিকে আর পথ নেই৷ কাজেই তখন আবার সেই পাহাড়ের তলায় ফিরে আসতে হবে— এদিকে পা কিন্তু আর চলে না৷ দু-টাকা বকশিস কবুল করে, এই পথটুকু হাতিতে করে পৌঁছে দেবার জন্য হাতিওয়ালাদের রাজি করিয়েছিল, কিন্তু হাতিটা কিছুতেই তাদের বইতে রাজি হল না৷ দুপুরের রোদে তার মেজাজ বিগড়িয়ে গিয়েছিল, মাহুত যত তাকে বসতে বলে, হাতিটা ততই আরও চটে যেতে লাগল৷ কাজেই হেঁটে আসা ছাড়া অন্য উপায় আর রইল না৷
এদিকে আমি সমস্ত জিনিসপত্র, খচচর, বলদ সুদ্ধ নদী পার হয়েছি, আর বালির উপর তাঁবু খাটিয়ে, কতক্ষণ অবধি তাদের আশায় বসে রয়েছি৷ বসে-বসে সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমি খালি ভাবছি— ‘তাইতো, তারা এখনও এসে পৌঁছল না৷ ভোরে সাড়ে-চারটের সময় বেরিয়েছে আর এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে— রাস্তা তো মোটে দশ মাইল৷’ এমন সময় একজন খালাসি বলল, ‘ওই বাবুরা আসছে৷’ চেয়ে দেখি নদীর ওপারে তাদের দেখা যাচ্ছে, চলতে আর পারছে না৷ এক বেচারা তো নদীর কিনারায় পৌঁছে বালির উপর শুয়ে পড়ল, তার ওজন তিন মন ছাবিবশ সের! দেখে আমার বড়ো দুঃখ হল, তাড়াতাড়ি তাদের পার করিয়ে আনিয়ে, চা খাইয়ে একটু ঠান্ডা করলাম৷
সেই চুরি-করা মাছ দুটো আর তাদের খাওয়া হল না, সেগুলো রোদে একেবারে পচে গিয়েছিল৷ দোভাষীরা বলাবলি করতে লাগল, ‘ফুংগির মাছ চুরি করার সাজা!’
সেই রাত্রে আমার চাকর শশীকে খাবার জন্য তার তাঁবুতে এক বাঘ ঢুকেছিল আর ঘড়ির অ্যালার্মের শব্দে পালিয়ে গিয়েছিল৷ শশী কিন্তু আগে বুঝতে পারেনি যে ওটা বাঘ, সে মনে করেছিল খচচর৷ তাই সে খচচরওয়ালাদের গালি দিয়েছিল, ‘বেটারা বড়ো পাজি৷ রোজ বলি খচচর বেঁধে রাখ, তা শোনে না৷ একদিন খচচরের পা ভেঙে দেব তখন বুঝতে পারবে৷’
সকালে উঠেই আমাদের কাজে বের হতে হয়, তার আগে রান্নাবান্না তৈরি চাই, তাই শশী রাত চারটের সময় ওঠবার জন্য ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখে৷ রাত্রে যখন সকলে ঘুমে অচেতন, বাঘ এসে শশীর তাঁবুতে ঢুকেছে৷ একেবারে ভিতরে আসতে পারেনি, তাঁবুর কানাতের তলা দিয়ে বুক অবধি ঢুকিয়ে ঠেলাঠেলি করছিল আর চারদিকে হাতড়াচ্ছিল— এক বিঘত আর এলেই শশীর মাথাটা পাবে৷ এমন সময় ‘ক্ক-ড়-ড়-র-র’ শব্দে অ্যালার্ম বেজে উঠল৷ বাঘ বোধহয় ভাবল, ‘সর্বনাশ! বুঝি বা আকাশ ভেঙে পড়ল৷’ বেজায় চমকে গিয়ে অমনি সে এমন এক লাফ দিল যে, তাঁবুর দড়ি ছিঁড়ে, খোঁটা উপড়িয়ে, তাঁবু সুদ্ধু ওলটপালট! শশীর এতে ঘুম ভেঙে গেছে, সে উঠেই খচচরওয়ালাদের গাল দিতে লাগল৷ গোলমাল শুনে সকলে ছুটে এসে দেখি কী ভয়ানক ব্যাপার৷ তাঁবুর ভিতরে বাঘের বুকের দাগ আর নখের আঁচড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ ভগবানের কৃপায়, ঠিক সময়মতো অ্যালার্ম না পড়লে আর উপায় ছিল না৷
এ-বছর আমার সঙ্গে খানসাহেব আ- দূরবিনের কাজ শিখতে গিয়েছিলেন৷ খানসাহেবের বিশাল দেহ, ছ-ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, বুক ৪৮” কোমর ৫৪”, ওজন তিন মন ছাবিবশ সের, আজি জংশনে ওজন করেছিলাম তাঁকে৷
আমি তো দশ দিনের পথ চলে ঘোড়া কিনেছি, খানসাহেব পদব্রজেই চললেন এবং প্রায় দুশো মাইল হেঁটে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু যখন কাজ আরম্ভ হল, তখন তাঁর একটু কষ্ট হতে লাগল৷ তিনি তাঁর উপযুক্ত একটা ঘোড়া খুঁজতে লাগলেন৷ তাঁর উপযুক্ত ঘোড়া কি আর সে-দেশে মেলে?
আমরা এবার শ্যামরাজ্যের সীমানায় কাজ করছিলাম৷ প্রত্যেকের সঙ্গে কুড়িজন সেপাই ও একজন হাবিলদার ছিল পাহারার জন্য৷ একজন সুবেদারের অধীনে সবসুদ্ধ আশিজন সেপাই এসেছিল৷ এই সুবেদারের সঙ্গে খানসাহেবের চিন দেশে বক্সার লড়াইয়ের সময় আলাপ হয়েছিল আর বেশ ভাবও হয়েছিল৷ খানসাহেব ঘোড়া খুঁজছেন আর উপযুক্ত ঘোড়া মিলছে না শুনে সুবেদারসাহেব ঠাট্টা করে বললেন, ‘আরে খানসাহেব, ভঁইষী লে লেও, সাওয়ারী ভি করোগে, আউর দুধ ভি পিওগে!’ খানসাহেব তো মহা খাপ্পা! এখানে বলে রাখি খানসাহেব দুধের বড়ো ভক্ত৷ আমরা টিনের দুধ দিয়ে চা খাই, কিন্তু তাঁর রোজ টাটকা দুধ চাই, আর সেই দুধের জন্য দোভাষীর উপর রোজ তম্বি করতেন, সুবেদার সেটা লক্ষ করেছিলেন৷
খানসাহেব বাহাদুর লোক ছিলেন৷ নানা দেশে তিনি ঘুরেছিলেন, অনেক কাজ তিনি করেছিলেন৷ তার ফলে কুড়ি টাকায় কাজে প্রবেশ করে পাঁচশো টাকার পেনশান নিয়েছিলেন, আর প্রথমে ‘খানসাহেব’ ও পরে ‘খানবাহাদুর’ উপাধি লাভ করেছিলেন৷ শ্যাম দেশের সীমা কমিশন, চিনা সীমা কমিশন, বক্সার যুদ্ধ, তুরস্ক-পারস্য সীমা কমিশন প্রভৃতিতে খুব কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছিলেন৷
আমি যখন প্রথম শান স্টেটে কাজ করতে যাই, সেই বছর ও তার আগের দু-তিন বছর খানসাহেব ও আমাদের আপিসের আরও কয়েকজন চিন সীমা কমিশন-এ কাজ করতে গিয়েছিলেন৷ সেখানে একবার একটা বীভৎস কাণ্ড হয়েছিল, তার গল্প খানসাহেবের কাছে শুনেছিলাম৷
ওই সীমা কমিশনে তাঁদের সঙ্গে কে- নামে একজন মহারাষ্ট্রীয় সার্ভেয়ার ছিল৷ লোকটি খুব কাজের, কিন্তু বড়ো মাতাল, আর সেজন্য তাকে কখনো-কখনো মুশকিলে পড়তে হত৷ যে সময়ের কথা বলছি, তখন তাঁদের তাঁবু ছিল চিনের এলাকায়৷ সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, সকলেই তাঁবুতে পৌঁছে গেছে, কিন্তু ওই মহারাষ্ট্রীয় সার্ভেয়ারটি তখনও আসেনি৷
কী হল? শত্রুর দেশ এটা, কোথায় গেল? তাদের বড়ো সাহেব ব্যস্ত হয়ে তাকে খুঁজবার জন্য চারদিকে লোক পাঠালেন৷ সকলে ফিরে এল, কিন্তু কে-র কোনো খবর পাওয়া গেল না৷ সাহেবের দোভাষী ছিল একজন চিনা, সেও খুঁজতে গিয়েছিল৷ কোনো খবর না পেয়ে সেও তাঁবু-মুখো ফিরে চলল৷ গিয়েছিল গ্রামে-গ্রামে ঘুরে, কিন্তু ফিরবার সময় মাঠের মাঝখান দিয়ে সোজা তাঁবুর দিকে চলল৷ মাঠটার মাঝামাঝি এসে একটা বিকট দুর্গন্ধে তার দম বন্ধ হবার উপক্রম হল৷
‘কীসের গন্ধ? কোত্থেকে আসছে? নিশ্চয় গ্রামের জমানো সারের কুণ্ডের মুখ খোলা পড়ে আছে আর হাওয়াতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে৷’
ওই-দেশে গ্রামবাসী সকলের মল একটা প্রকাণ্ড কুণ্ডে জমা করে রাখা হয়, আর বৃষ্টির জলে সে এক বিটকেল ব্যাপার হয়৷ লম্বা বাঁশের ডগায় ‘হাতা’ বাঁধা, তা দিয়ে ওই নরক-কুণ্ড থেকে তুলে-তুলে জমিতে সার দেওয়া হয়৷ একটা প্রকাণ্ড কাঠের ঢাকনি দিয়ে কুণ্ডের মুখটা রাত্রে ঢেকে রাখা হয়৷ দোভাষী চিনা, কাজেই সে বুঝতে পারল যে নিশ্চয় আজ কোনো কারণে কুণ্ডের মুখ খোলা পড়ে রয়েছে৷ ভাবল ওটাকে বন্ধ করে যাই৷
কুণ্ডের কাছে গিয়ে তো চক্ষুস্থির! কুণ্ডের ভিতরে কী যেন নড়ছে আর হাবুডুবু খাচ্ছে৷ ডাকল— উত্তর শুনেই বুঝল যে ওই সার্ভেয়ার৷ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ক্যাম্পে এসে সকলকে খবর দিল৷ তখন সকলে গিয়ে তাকে তুলল৷ একটা মজবুত রশি গর্তে ফেলে দিল, কে- সেটাকে তার বুকে জড়িয়ে বাঁধল, আর সবাই মিলে টেনে তাকে ওই নরক-কুণ্ড থেকে তুলল৷
বলা বাহুল্য, মদের নেশা তার আগেই ছুটে গিয়েছিল৷
তারপর কত সাবান দিয়ে যে তাকে পরিষ্কার করা হয়েছিল তা বুঝতেই পার৷
সেদিন হাট ছিল৷ ও-দেশে হাটে খুব মদ বিক্রি হয়৷ হতভাগা কাজ শেষ করে খুব মদ খেয়েছিল৷ তারপর বোধহয় টলতে-টলতে ওই মাঠের মাঝখান দিয়ে তাঁবুতে আসছিল, আর পড়েছে ওই নরক-কুণ্ডের মধ্যে!
অত শাস্তিতেও সে মদ ছাড়েনি, পরিণামে মদ খেয়ে-খেয়েই শেষে মারা গিয়েছিল৷
ওই চিন সীমা কমিশনে বুড়ো সার্ভেয়ার রামশবদও এক বছর কাজ করতে গিয়েছিল৷ সেখানে তাদের একটা খুব খাড়া পাহাড় চড়তে হয়েছিল৷ পাহাড়টাতে গাছপালা নেই, খালি ছোটো-ছোটো ঘাস আর গুড়িগুড়ি পাথর আর বেজায় খাড়া৷ রামশবদের সঙ্গে এক সাহেব অতি কষ্টে পাহাড়ে চড়ে কাজ করলেন, কিন্তু নামবার সময় প্রাণ ওষ্ঠাগত! ওঠবার বেলা তবু ঘাস ধরে-ধরে উঠেছিলেন, নামবার বেলা আর ধরবার কিছু নেই, ছোটো-ছোটো নুড়ি পাথরে পাও রাখা যায় না, পিছলে যায়৷ দু-চারবার চেষ্টা কারবার পর সাহেব তো মাটিতে বসলেন আর পিছন ছেঁচড়ে দিব্যি নেমে এলেন৷ তাঁর মোটা কর্ডের পেন্টেলুনেরও কিছু ক্ষতি হল না৷ বুড়োর আর সে রকম করবার সাহসে কুলোচ্ছে না, এদিকে সাহেব বিষম তাড়া দিচ্ছেন, ‘আরে জলদি আও না! বৈঠ বৈঠ কর উৎরো!’
কী আর করা, অগত্যা তাই করতে হল৷
এদিকে সাহেব তাড়া দিয়েই পথ চলতে শুরু করেছেন, পিছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে জিগেস করলেন, ‘আয় গিয়া রামশবদ?’
‘হ্যাঁ হুজুর, আয়া তো, লেকেন আধা পাৎলুন পাহাড় পর রহগিয়া!’
বেচারার জিনের পাজামার পেছন দিকটা পাহাড়ে রেখে আসতে হয়েছে!
একদিন আমরা একটা বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি, পথে দেখি একটা গ্রামের ঘরদোর সব পড়ে রয়েছে কিন্তু জনমানুষ নেই৷ দিনের বেলায় পর্যন্ত বাঘ এসে গ্রাম থেকে মানুষ ধরে নিয়ে যেত, সেইজন্য সবাই গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে৷ কাজের জন্য এমন বনের মধ্যে দিয়েও চলতে হয়৷ একলাটি যাবার জো নেই, অমনি বাঘ এসে ধরে খাবে৷ আমাদের সঙ্গে একজন মুসো এসেছে পথ দেখাবার জন্য, সে আবার আরও দুজন মুসোকে সঙ্গে এনেছে, নয়তো আমাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরবার সময় তাকে বাঘে ধরবে৷ বনের মধ্যে রাত হয়ে গেলে তারা ‘আড্ডায়’ থাকবে৷ আড্ডাগুলো আবার পাঁচিলঘেরা বাড়িঘর নয়, শুধু বাঁশের ঝোপের আগায় একখানি মাচা, তাইতে চড়ে বসে কাঁপতে-কাঁপতে রাত কাটাতে হয়৷
বাঘেরা বেশ জানে যে সে-বনের ভিতর তারাই রাজা৷ বেলা সাড়ে-আটটার সময় ঘোড়ায় চড়ে একটা নদী পার হচ্ছি, সঙ্গে পাঁচ-ছজন লোক৷ নদীর মাঝামাঝি এসে দেখি এই বড়ো একটা বাঘ প্রায় আমাদের রাস্তার উপরে দাঁড়িয়েই জল খাচ্ছে৷ আমরা যে আসছি সেজন্য তার কোনো ভাবনাচিন্তাই নেই৷ দু-এক চুমুক জল খায় আর মাথা তুলে এক-একবার আমাদের দেখে নেয়৷ আমরা অনেক চ্যাঁচামেচি করাতে আস্তে আস্তে উঠে, রাজার মতো চালে সেখান থেকে চলল৷ দু-চার পা যায় আর ঘাড় ফিরিয়ে এক নজর আমাদের দেখে৷ ততক্ষণে পিছন থেকে আমাদের আরও ঢের লোকজন এসে পড়েছে, সকলে মিলে মহা শোরগোল তুললে পর বাঘটা ছুটে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল৷
সেখান থেকে একটা গ্রামে গিয়ে দুদিন ছিলাম৷ তারপর আমাদের ওই পথেই ফিরতে হবে আর ওই জায়গাতেই রাত কাটাতে হবে৷ গ্রামের প্রধান অনেক মানা করল, কিন্তু কিছুতে আমাদের ফেরাতে না-পেরে, শেষটা দু-জন লোক সঙ্গে নিয়ে নিজেই বন্দুক হাতে আমাদের সঙ্গে চলল৷
বিকেলে দুই নালার মোহানায় এসে তাঁবু খাটিয়েছি, চাকর-বাকররা কেউ রাঁধতে, কেউ খেতে, কেউ বা বাসন মাজতে ব্যস্ত৷ আমি তাঁবুর সামনে চেয়ারে বসে, পরদিনের কাজের পরামর্শ করছি৷ এমন সময় হঠাৎ আমার মনে হল, নালার দুই মোহানার কাছে একটা বড়ো গাছের আড়াল থেকে গলা বাড়িয়ে একটা কী যেন আমাকে দেখছে! বার কয়েক আমি হঠাৎ কথা বন্ধ করে সেইদিকে তাকাতে কিন্তু কিছু দেখতে পেলাম না৷ শেষটা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম দুটো কী জিনিস, জ্বল-জ্বল করে উঠল৷
আর বুঝতে বাকি রইল না ও-দুটো বাঘের চোখ৷ অমনি তো আমি ‘বন্দুক আন’ বলে লাফিয়ে উঠেছি, আর বাঘও আর লুকিয়ে থেকে কোনো লাভ নেই দেখে দুই লাফে একেবারে আমার পায়ের নীচে৷ ছ-সাত ফুট নীচে হবে, আর দূরও হবে ছ-সাত ফুট৷
এদিকে খালাসি মশাইরা বাঘের নাম শুনেই যে যার কাজ ফেলে, তাঁবুর মধ্যে ঢুকে দরজা এঁটে দিয়েছেন৷ বন্দুকটা এনে দিতে কারো সাহসে কুলোল না৷ অগত্যা নিজেই তাঁবুর ভিতর থেকে রিভলভারটা নিয়ে এলাম৷ কিন্তু এসে আর বাঘটাকে দেখতে পেলাম না৷ সে হল্লা শুনে বেগতিক বুঝে সরে পড়েছে৷ পাতার উপর মড়মড় পায়ের আওয়াজ শুনে, সেইদিকে দু-তিনবার আওয়াজ করলাম৷ এতক্ষণে খালাসিদের মুখে কথা ফুটল, একজন বলতে লাগল, ‘কেয়া দেখা হুঁ৷ এত্তা বড়া থা, উধারসে চলা গিয়া৷’
একটা পাহাড়ে কাজ করতে গিয়েছিলাম, সেটাকে দূর থেকে দেখলে একটা দেয়াল বলে মনে হত৷ ওই জঙ্গলে থাকতে হবে অন্তত দুই রাত, সেই মুসো বস্তি থেকে কুলি নিয়ে গিয়েছি৷ পাহাড়ের মাঝামাঝি আট-দশ ইঞ্চি চওড়া একটু পথ, মুসোদের শিকারের রাস্তা, তার নীচেই একেবারে খাড়া দেয়ালের মতো পাহাড়৷ সেই পথে আমরা যাতায়াত করি৷
একদিন সকালে উঠে আমি কাজে বেরিয়ে গিয়েছি, মুসো কুলিরাও জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে৷ পিছনে আছে আমার চাকর শশী, একজন দোভাষী আর শঙ্কর ও মঙ্গল নামে দুজন খালাসি৷
মঙ্গলের সঙ্গে দোভাষীদের কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে৷ মঙ্গল তাই চটে, ‘যাই, সাহেবের কাছে রিপোর্ট করি’ বলে চলে গেছে৷ তখন দোভাষী ভাবল যে তাড়াতাড়ি গিয়ে মঙ্গলের সঙ্গে ভাব করতে হবে, কী জানি যদি সত্যি রিপোর্ট করে বসে৷ বিদঘুটে রাস্তা, পা হড়কালেই একশো-দেড়শো ফুট নীচে গড়িয়ে পড়তে হবে৷ দোভাষী ভয়ে-ভয়ে মাথা হেঁট করে পথের উপর চোখ রেখে চলেছে, আবার ক্ষণে-ক্ষণে মুখ তুলে দেখছে মঙ্গলকে দেখা যায় কি না৷
মঙ্গলের আবার তামাক খাবার রোগ৷ পথ চলতে-চলতে ক্রমাগত তাকে কলকে হাতে নিয়ে দাঁড়াতে হয়৷ দোভাষী একবার মুখ তুলে দেখতে পেল যে একটু সামনেই বাঁশঝাড়ের আড়ালে লালপানা কী একটা দেখা যাচ্ছে৷ মঙ্গলের মাথায় লাল পাগড়ি, তাহলে নিশ্চয়ই মঙ্গল ওখানে বসে তামাক সাজছে৷ দোভাষী তো হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, আর মাথা নীচু করেই বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ ভাই মঙ্গল, এটা কি ভালো হল? এক জায়গায় দশ-পাঁচটা হাঁড়ি থাকলে একটু-আধটু ঠোকাঠুকি হয়ই, তাই বলে কি কথায় কথায় উপরওয়ালার কাছে রিপোর্ট করতে আছে? বলতে-বলতে সে বাঁশঝাড়ের সামনে এসে পড়েছে আর মুখ তুলেই দেখে— বাবা গো, কোথায় মঙ্গল? এ যে প্রকাণ্ড বাঘ ওঁৎ পেতে রয়েছে, আর দোভাষীর দিকে চেয়ে-চেয়ে লেজ ঘুরোচ্ছে!
দোভাষী তাড়াতাড়ি তার ছোট্ট তলোয়ারখানার মুখ বাঘের দিকে ধরে নিয়ে দাঁড়াল, যদি বাঘটা লাফিয়ে পড়ে!
বাঘটাও উঠে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু মাঝখানে বাঁশঝাড়, তাই আর লাফাবার সুবিধা পাচ্ছে না৷ দোভাষী ভাবছে শশী আর শঙ্কর তার পিছনে, শশী এখুনি বন্দুক চালাবে, কিন্তু শশী যে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছে তা কি আর সে জানে! শেষে যখন একটুখানি মুখ ফিরিয়ে দেখে বুঝল যে পিছনে কেউ নেই, তখন সে চিৎকার করে উঠল৷ চিৎকার কি সহজে বের হতে চায়? ভয়ে বেচারার গলা শুকিয়ে গেছে৷ যাই হোক, একটা গলাভাঙা গোছের আওয়াজ শশীর কানে পোঁছুল, আর তখুনি তারা ‘ভয় নেই, ভয় নেই’ বলে ছুটে এল৷ বাঘটাও তাই দেখে থতমত খেয়ে ‘হূপ’ বলে গাল দিয়ে ছুটে পালাল৷ দোভাষী তখন ঠকঠক করে কাঁপছে, ঘামে তার গায়ের কাপড় সমস্ত ভিজে গেছে, কথা বলতে পারছে না৷ অনেক কষ্টে বললে, ‘বাঘ!’
এরপর আর সে কখনো একলা পথ চলত না৷
এই শান স্টেট থেকে আমি দুটো বাঘের চামড়া এনেছিলাম৷ এই বাঘ-মারার ইতিহাসটি বেশ৷ একজন লোক বনে হরিণ মারতে গিয়েছিল৷ একটা হরিণের পায়ের দাগ ধরে তাকে খুঁজে বের করে সে গুলি করতে গেল, কিন্তু বন্দুকে আর আওয়াজ হল না, যাকে বলে মিস-ফায়ার হওয়া৷ ঘোড়া তুলে আবার মারতে গেল, এবারও আওয়াজ হল না৷ লোকটা ভাবল বুঝি ক্যাপটাই খারাপ, ট্যাঁকে আরও ক্যাপ ছিল, তার একটা বের করতে গেল৷ কোঁচড় থেকে ক্যাপ বের করতে গিয়ে মুখ ফিরিয়েই দেখে তার পিছনেই প্রকাণ্ড এক বাঘ, সাত-আট ফুট দূরেও নয়৷ এই তাকে ধরে আর কি! তখন সে ভয়ের চোটে সেই খারাপ ক্যাপসুদ্ধই বন্দুক তুলে ঘোড়া টিপে দিলে, আর কী আশ্চর্য! গুড়ুম করে বন্দুকের আওয়াজ হল, সঙ্গে-সঙ্গে বাঘের মগজও উড়ে গেল৷ ভগবান যাকে রক্ষা করেন, বাঘও তাকে মারতে পারে না৷
অন্য বাঘটাকে মেরেছিল একটি বারো বছরের ছেলে৷ দুপুরবেলা মুসোদের গ্রামের মেয়ে-পুরুষরা সকলে খেতে কাজ করতে গেছে, গ্রামে আছে কেবল ছেলেপিলের দল৷ সে-দেশের ঘর হয় মাচার উপর, উপরে মানুষরা থাকে আর নীচে থাকে তাদের পোষা জন্তুজানোয়ার৷ দিনের বেলাতেই একটা বাঘ একজনের ঘরের নীচে ঢুকে একটা শুয়োর ধরেছে, আর শুয়োরটা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলেছে৷
সেই ঘরে ছিল ওই বারো বছরের ছেলেটি আর তার বাবার গুলিভরা বন্দুক৷ সে আস্তে-আস্তে উঠে, মাচার বাঁশের ফাঁক দিয়ে এক গুলিতেই বাঘমশাইয়ের শুয়োর খাবার শখ মিটিয়ে দিল৷ তারপর গ্রামসুদ্ধ লোক মজা করে ওই বাঘের মাংস খেল!
.
ওই বছরই আমি একটা পাহাড়ে দূরবিনের কাজ করতে গিয়েছিলাম৷ গ্রাম অনেক দূরে, তাই মনে করেছিলাম যখন পাহাড়ের উপর জল আছে তখন সেখানেই জলের কাছে তাঁবু খাটাব আর দু-রাত ওইখানেই কাটাব৷ গ্রামের লোকরা কিন্তু বেঁকে দাঁড়াল৷ ‘ও-পাহাড় ভালো না৷ ওখানে ‘‘নাট’’ (অপদেবতা) আছে, লোকের উপর অত্যাচার করে, হাতি দিয়ে পিষিয়ে মারে,’ ইত্যাদি৷
হয়তো জঙ্গলে বুনো হাতি আছে সেইজন্য অনিচ্ছা৷ পাহাড়টার চুড়োয়-চুড়োয় বুনো হাতির রাস্তা৷ রাজার লোক আমার সঙ্গে ছিল, সে গ্রামের প্রধানকে অনেক বুঝিয়ে বলল, কিন্তু কোনো ফল হল না৷ তাদের মহা ভয় পাহাড়ে যদি সরকারের লোকের কোনো অনিষ্ট হয়, তাহলে রাজা হয়তো আবার তাদের ধরে টানাটানি করবেন৷
আমি দেখলাম তাদের যখন অত অনিচ্ছা, তখন জোর-জবরদস্তি করে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না৷ জিগগেস করলাম, ‘যদি আমরা খুব ভোরে, এই চারটে-সাড়েচারটেয় কাজে বেরোই তাহলে কখন চুড়োয় পৌঁছব?’ তারা হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘সূর্য এইখানে উঠলে পর,’ আন্দাজ বেলা দশটায়৷ আমি বললাম, ‘আমি যদি এইখানেই তাঁবু রেখে দিই আর ভোরে বেরিয়ে, কাজ সেরে, তোমাদের গ্রামেই শুই, তাহলে যেতে পারবে তো?’ তারা মহা খুশি হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই৷ যদি সন্ধ্যা হয়ে যায়, বড়ো-বড়ো মশাল জ্বেলে চলে আসব৷ সঙ্গে বন্দুক নেব৷’
সেই বন্দোবস্তই করলাম৷ ভোর সাড়ে-চারটে-পাঁচটায় বেরিয়ে, কাজ করে, সন্ধ্যা সাড়ে-সাতটা-আটটার মধ্যে তাঁবুতে ফিরে এলাম৷
এই ঘটনার দুবছর পরে আমাদের আপিসের এক সাহেব ওই পাহাড়ে জরিপের কাজ দেখতে গিয়েছিলেন৷ গ্রামের লোকেরা তাঁকেও বাধা দিয়েছিল, কিন্তু তিনি সে কথা শুনবেন কেন?
সকালে উঠে সাহেব সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে বেরিয়ে গেছেন, লোকজনদের হুকুম দিয়ে গেছেন যে পাহাড়ের সব চেয়ে উঁচু চুড়োটার নীচে যেন তাঁবু লাগায়৷ পথ নেই, সেইজন্য তারা হাতির রাস্তা ধরে, খচচরের পিঠে জিনিসপত্র বোঝাই করে উপরে উঠল৷ বিকেলে চুড়োর নীচে পৌঁছে দেখল সেখানে বেশ জল আছে, কাজেই সেখানেই তাঁবু ফেলল৷ গ্রামের লোকেরা তাদের পৌঁছে দিয়েই ফিরে এল, ও-পাহাড়ে তারা কিছুতেই থাকবে না৷
এদিকে সাহেব কাজে বেরিয়েছেন৷ তিনিও কাজ শেষ করে ওই জায়গাতেই আসবেন, তবে তাঁকে সমস্ত বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত ঘুরে সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে দেখতে আসতে হবে৷ সেদিন কিন্তু সাহেবের কপালে তাঁবুতে পৌঁছনো ঘটে উঠল না৷ বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে রাত হয়ে গেল৷ অন্ধকারে চলতে না পেরে সাহেব ও তাঁর সঙ্গের লোকরা পাহাড়ের উপরে এক জায়গায় গাছের নীচে ধুনি জ্বালিয়ে শুয়ে রইলেন৷ ভাবলেন সকালে উঠে তাঁবুতে যাবেন৷
এদিকে তাঁবুতে সকলে তাঁর পথ চেয়ে বসে রয়েছে, কখন সাহেব আসবেন, কিন্তু সাহেবের আর দেখা নেই৷ ডাকাডাকি করে বেয়ারাদের গলা ধরে গেল, কিন্তু সাহেব তখন ঢের দূরে, সে-ডাক শুনতে পেলেন না৷
শেষটা তারা আশা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল৷
অনেক রাত্রে খচচরগুলোর ছুটোছুটিতে সকলের ঘুম ভেঙে গেছে৷ ব্যাপারখানা কী? এই ভেবে যেমন একজন খালাসি তাঁবুর দরজা ফাঁক করে গলা বের করেছে, আর অমনি দেখে— ওরে বাবারে, এয়া বড়ো দাঁতওয়ালা হাতি, তার পিছনে আরও হাতি৷ সে আস্তে-আস্তে সকলকে সাবধান করে দিয়ে যেমন তাঁবুর পিছন দিক দিয়ে বেরোতে যাবে অমনি হাতিও তাঁবুর উপর এসে পড়ল৷ তখন সকলে গড়িয়ে-গড়িয়ে খাদের ভিতর ঢুকে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচাল, আর হাতিগুলো সেই রাস্তায় চলে গেল৷ তাঁবু-টাঁবু যা কিছু তাদের সামনে পড়েছিল, সব তারা শুঁড় দিয়ে ছুড়ে ছুড়ে খাদের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেল৷ খচচরগুলোও রাস্তার উপর বাঁধা ছিল তারা সকলে দড়ি-টড়ি ছিঁড়ে পালাল, শুধু একটা খচচর মজবুত নতুন দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল, সে বেচারা পালাতে পারেনি৷ হাতিরা সেটাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে একেবারে পিষে দিয়ে গেল৷
সকালে সাহেব তাঁবুতে ফিরে তো একেবারে হতভম্ব!
এবারকার মতো কাজ শেষ করে আমরা ব্যাঙ্গালোরে, আমাদের হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলাম৷