১৩
(১৯১০-১৯১২ আসাম৷ খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়) এবার খাসিয়া পাহাড়ে কাজ করতে গেলাম৷ রাস্তার কষ্ট আমার আর গেল না৷ বর্মা, ত্রিপুরা, লুশাই হিলস সব জায়গায় রাস্তার কষ্ট ভোগ করেছি, আবার এখানেও সেই রাস্তার কষ্ট! দু-বছর খাসিয়া পাহাড়ে কাজ করেছিলাম আর দুবছরই হাড়ভাঙা খাড়া রাস্তা, আর বাঁশ আর লতার পোল নিয়ে সার্কাস করার মতো কসরত করতে হয়েছে৷
খাসিয়া পাহাড়ের গড়নটা একটু অদ্ভুত৷ যেন একটা প্রকাণ্ড বড়ো টেবিলের উপরটার একদিক উঁচু করে তুলে ধরা হয়েছে, আর উপরের কাঠটা করাত দিয়ে তিনকোনা ফালি-ফালি করে চেরা হয়েছে৷ খাসিয়া পাহাড় একটি অধিত্যকা, টেবল-ল্যান্ড৷ মাঝে-মাঝে নদী-নালা সব প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড খাদ কেটে বয়ে গেছে৷ অধিত্যকার উপরটা বেশ, বেশি চড়াই-উতরাই নেই, যেদিকে খুশি যাতায়াত করা যায় কিন্তু ওই খাদগুলো পার হওয়া প্রাণান্তকর ব্যাপার৷ উপরের অংশে জঙ্গল নেই বললেই হয়, অনেক জায়গাতেই পাহাড়ের উপর শুধু ঘাস, কোথাও বা পাথর, আর মাঝে-মাঝে গাছ৷
চেরাপুঞ্জিতে ছিলাম৷ একজন সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে যেতে হবে৷ পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য একজন খালাসি এসেছে৷ তাকে জিগগেস করলাম, ‘বাবুর ডেরা কত দূর?’
‘দশ-বারো মাইল হবে৷’
‘রাস্তা কেমন?’
‘পাকডাণ্ডি রাস্তা হুজুর, বহুৎ খারাব৷’
ঘোড়াও যাবে না, ধরে-ধরে উঠতে হয়৷
সকালে সার্ভেয়ারের ক্যাম্পে যাব, আগের দিন বিকেলে দেখতে গেলাম রাস্তা কেমন৷ বাপ! ও রাস্তায় যাওয়া আমার কর্ম নয়৷ কিছু দূর ধরে-ধরে বেশ চলে যাওয়া যায়৷ তারপর পঞ্চাশ-ষাট ফুট একেবারে খাড়া পাথর৷ সে জায়গায় দুখানা বাঁশ পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে, মাঝে-মাঝে আবার লতা দিয়ে পাথরের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন পড়ে না যায়৷ ওই মই দিয়ে ওঠা-নামা আমার কর্ম নয়!
খালাসিকে জিগগেস করলাম, ‘এমন কটা আছে?’
সে বললে যে চার-পাঁচ জায়গায় এমনি করে বাঁশ বা বড়ো গাছের ডালের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করতে হবে৷ শুনেই তো আমি ফিরে এলাম৷ ওই প্রকাণ্ড খাদের তিনদিক ঘুরে সার্ভেয়ারের তাঁবুতে পৌঁছতে আমার চারদিন লাগল৷ খাসিয়া পুরুষ-মেয়েরা কিন্তু পিঠে বোঝা নিয়ে অক্লেশে এই সব পথ দিয়ে যাতায়াত করে৷ এই রকম গোটা কয়েক খাদ আমার কাজের এলাকার মধ্যে ছিল৷ প্রাণের দায়ে সবকটাই তিন-চার দিনের রাস্তা ঘুরে যাওয়া-আসা করতে হত৷
কিনসি নদীতে পোল পার হওয়াও এক ব্যাপার, বিশেষত এক পশলা বৃষ্টি হবার পর৷ নদী সেখানে প্রায় একশো গজ চওড়া, সাধারণত তাতে কোমর জল৷ তার উপর পোল৷ দু-খানা করে বাঁশ আড়াআড়ি (ক্রস করে) পাতা কুড়ি-পঁচিশ ফুট দূরে-দূরে, আর তার উপরে দু-খানা করে বাঁশ লম্বালম্বি পাতা, ভালো করে জড়িয়ে বাঁধাও নয়৷ আড়াআড়ি বাঁশের এক দিকে মোটা এক-গাছি লতা বেঁধে দিয়েছে, সেইটাই হল ধরবার রেলিং!
এই তো পোল, এরই উপর দিয়ে পার হতে হবে! বুটসুদ্ধ সে যে কী ব্যাপার তা বুঝতেই পার৷ রেলিংটা যদি শক্ত বাঁশের হত তবুও একটু ভর দিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নেওয়া যেত, এই ল্যাকপ্যাকে লতায় সে উপায়ও নেই৷ পোলের উপর উঠে চার-পাঁচ পা যেতে-না-যেতেই সমস্ত পোলটা দুলতে থাকে আর পাতা বাঁশ দুটো ক্যাঁচম্যাচ করতে আরম্ভ করে! এই বুঝি ভেঙে জলে পড়লাম৷ আর বৃষ্টি পড়লে তো পাথরে পাঁচ কিল! নদীর জল পাগলা কুকুরের মতো দৌড়তে থাকে আর সমস্ত পোলটা থরথর করে কাঁপতে থাকে৷
বড়ো সাহেব কাজ পরিদর্শনে এসেছিলেন৷ তাঁকে কিনসি নদী পার হতে হবে৷ নদীর ধারে এসে জিগগেস করলেন, ‘পার হব কী করে?’
‘ওই পোলের উপর দিয়ে৷’ বলেই আমি গিয়ে পোলের উপর উঠলাম৷ সাহেব একটুক্ষণ পোলের রকমসকম দেখলেন, তারপর ঝপ-ঝপ করে জলে নামলেন৷ বললেন ওই সব বাঁদুরে কায়দার আর তাঁর বয়স নেই! সমস্তদিন বেচারাকে ভিজে কাপড়ে থাকতে হয়েছিল৷
মনে পড়ল শান স্টেটে একবার এমনি এক পোল পার হতে গিয়ে আমাদের অফিসার মিস্টার ফে- র বড়ো দুর্দশা হয়েছিল৷ রামশরণ হল গাড়ওয়ালি ব্রাহ্মণ, বেঁটে মানুষ, কিন্তু খুব মজবুত আর বাঁদরের মতো পাহাড়ে চড়ে৷ মিস্টার ফে— এসেছেন তার কাজ একজামিন করতে৷ সাহেব হলেন লম্বা-চওড়া মোটাসোটা মানুষ, ওজন প্রায় আড়াই, পৌনে-তিন মন হবে, বয়সও হয়েছে ঢের৷
সকালে উঠে খচচর বোঝাই করে জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিয়ে সাহেব কাজে বের হলেন৷ কিছু দূর গিয়েই নদী পার হবার পালা৷ প্রায় একশো পঁচিশ গজ চওড়া নদী, ঢের জল তাতে, আর ওইরকম একটি পোল৷
পোল দেখে তো সাহেবের চক্ষুস্থির!
‘রামশরণ, পার হব কী করে?’
‘কেন সায়েব ওই তো পোল রয়েছে?’
‘আরে, ওতে কি ভার সইবে?’
‘আলবৎ! বহুত মজবুত হ্যায়, হুজুর!’ বলে রামশরণ পোলের উপর গিয়ে উঠল, আর কিছু দূর গিয়ে, লাফিয়ে, নেচে কুঁদে, সাহেবকে দেখিয়ে দিল যে পোলটা সত্যি-সত্যিই মজবুত৷ রামশরণ পার হয়ে গেল৷ সাহেব দাঁড়িয়ে পরিণাম দেখলেন, তারপর তিনিও পোলের উপরে উঠলেন, আর পা টিপে-টিপে এগোতে লাগলেন৷ প্রায় মাঝামাঝি পৌঁছেছেন তখন পোলটা দুলতে আরম্ভ করল৷ সাহেব একটু থতোমতো খেয়ে লতার রেলিং চেপে ধরলেন৷ ওই তো রেলিং, সে অত ভার সইবে কেন? পোলও আরও দুলতে আরম্ভ করল, সাহেব নিজেকে সামলাতে গিয়ে বেশ একটু জোরে পা ফেলেছেন আর মড়-মড়-মড়াৎ— সাহেব একেবারে গলা-জলে!
লোকজন ছুটে গিয়ে তাঁকে তুলল৷ উঠেই তিনি সার্ভেয়ারের বাপান্ত করলেন৷ বেচারাকে শান স্টেটের ওই দারুণ শীতে সমস্তদিন ভিজে কাপড়ে থাকতে হল৷
.
বাঘ, নেকড়ে, বা শেয়াল মারবার জন্য অনেক রকম ফাঁদ দেখেছি যা জঙ্গলের লোকরা ব্যবহার করে৷ বর্মাই বল, আসামই বল, আর বাঙলাদেশই বল, সব জায়গাতেই এই সব ফাঁদের একটা আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে৷
জানোয়ারের চলতি রাস্তার (গেম ট্র্যাক-এর) ধারে, পাহাড়ের খুব ঢালু জায়গায়, গভীর গর্ত খুঁড়ে, তার মধ্যে ভীষণ ধারালো সব বল্লম পুঁতে রাখে৷ তার উপর বাঁশের কঞ্চি বা বাঁখারির চাল তৈরি করে, মাটি, ঘাস, লতাপাতা দিয়ে এমন করে ঢেকে রেখে দেয় যে কিছু বোঝাই যায় না৷ তারপর ওই মাচার উপর বেশ মোটাসোটা একটা কুকুর-ছানা বা শুয়োরছানা বেঁধে রেখে দেয়৷ বাঘ আপন মনে হেলে-দুলে ওই পথে চলতে গিয়ে দেখতে পায় সামনেই খাবার তৈরি! হাল্লুম! আর যাবে কোথায়, বল্লম বিঁধে প্রাণ হারায়!
আবার ঠিক ওই রকম করে রাস্তার মাঝে, মাটিতে গর্ত খুঁড়ে, ঢাকা দিয়ে, টোপ বেঁধে রেখে দেয়৷ মাচার নীচে বল্লমের বদলে থাকে কাদা৷ এর মধ্যে পড়লে বাঘ প্রাণে মরে না বটে কিন্তু কাদায় পড়ে নড়বার জো থাকে না, চেঁচিয়ে দেশ মাথায় করে৷
তারপর বেড়ার মধ্যে ফুটো করে তাতে পাকা বেতের ফাঁস ঝুলিয়ে রাখা হয়৷ ফাঁসটা একটা মজবুত বাঁশের ডগায় বেঁধে, জোর করে বাঁশটা নীচু করে আটকিয়ে রাখা হয়৷ বেড়ার ফুটোর সামনেই মোরগ বা অন্য কিছু টোপ কায়দা করে দড়ি দিয়ে ফাঁসের সঙ্গে জড়ানো থাকে৷ বাঘ বা শেয়াল খাবার লোভে, ফুটো দিয়ে ঢুকে যেমনি মোরগ ধরে টান দেয়, অমনি কল খুলে যায়, সঙ্গে-সঙ্গে জানোয়ারটারও হাতে, পায়ে বা গলায় ফাঁস লেগে সে শূন্যে ঝুলতে থাকে৷ তারপরে যা তামাশা!
আবার মাটিতে মজবুত খুঁটি পুঁতে খোঁয়াড় তৈরি করা হয়৷ তার মধ্যে একটা ছোটো কুঠুরিতে কুকুর বা ছাগল বেঁধে রাখে৷ খোঁয়াড়ের দরজা কল এঁটে খুলে রাখা হয়৷ বাঘ ভিতরে ঢুকে যেই টোপটি খেতে যায় অমনি হড়াৎ করে দরজা বন্ধ হয়ে যায়৷ তারপর মারো আর ধরো, যেমন ইচ্ছা৷
বাঘ চলবার রাস্তা বা তার মারা শিকারের উপর তীর বা বন্দুক পেতে রাখে৷ বাঘ এসে শিকার ধরে টানলেই, তীর বা বন্দুকের গুলিতে মারা যায়৷ তীরটা অবশ্য বিষাক্ত৷
মজবুত কাঠের মাচা তৈরি করে তার উপর ভারি-ভারি পাথর বা কাঠ চাপিয়ে রাখে৷ মাচার একটা দিক বেশ শক্ত করে মাটিতে আটকিয়ে দেয়৷ অন্য দিকটা তুলে ধরে দড়ি দিয়ে নীচের টোপের সঙ্গে কৌশল করে বেঁধে রাখে৷ বাঘ বা শেয়াল টোপ ধরে টানবামাত্র কল খুলে যায় আর ওই প্রকাণ্ড বোঝা তার ঘাড়ে পড়ে৷ এই ফাঁকে শেয়াল বা ছোটো বাঘ চাপা পড়ে৷
এরই আবার একটা রকমারি খাসিয়া পাহাড়ে পেয়েছিলাম৷ সেটাতে মাচা তৈরি করে ওজন চাপানো নয়, প্রকাণ্ড একটা পাথর চমৎকার ব্যালান্স করে রাখা, আর তার উপরে টোপ৷ লাফিয়ে ছাড়া ওই টোপ ধরা যায় না, আর লাফালেই পাথর উলটিয়ে গিয়ে জানোয়ারটা চাপা পড়ে প্রাণ হারায়৷ এই রকম একটা বাঘের ফাঁদে পড়ে আমার রাজপুত সার্ভেয়ার আরেকটু হলেই প্রাণ হারিয়েছিল৷
অমর সিং পাহাড়ের উপর কাজ করছিল৷ যে জায়গায় দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে ভালো দেখতে পাচ্ছিল না৷ তার পাঁচ-সাত ফুট নীচে একটা বেশ বড়ো পাথর ছিল৷ মনে করল হয়তো বা পাথরটার তলায় গেলে ভালো দেখতে পাবে৷ লোকজনদের বললে, ‘যন্ত্রপাতি নিয়ে তোমরা ঘুরে ওই পাথরটার নীচে নেমে যাও৷ আমি সোজা নামছি৷’
খালাসিরা ঘুরে নামতে আরম্ভ করল আর অমর সিং সোজা ওই পাথরটার উপর লাফিয়ে পড়ল৷ ওটা ছিল বাঘ মারা ফাঁদ৷ লাফিয়ে পড়বামাত্র পাথরটা উলটিয়ে গিয়ে তাকে চাপা দিল৷ তার অদৃষ্ট ভালো, ভগবানের কৃপায় এক পাশে পড়েছিল, শুধু একটা পা চাপা পড়েছিল, তার ফলে চলৎশক্তি রহিত হয়ে দশ-বারোদিন বিছানায় পড়েছিল৷
গৌহাটি-শিলং রাস্তার মাঝামাঝি নংপো৷ নংপো থেকে একটু দূরেই সরকারি রিজার্ভ ফরেস্ট৷ ওই জঙ্গলে সার্ভেয়ার নারায়ণ সিং কাজ করছিল৷ দুটো পাগলা হাতি, যাকে বলে ‘মস্ত’, ওই জঙ্গলে ছিল৷ যদিও আজ পর্যন্ত হাতি ওদের চোখে পড়েনি, তবুও ওরা খুব সাবধানে কাজ করত৷ একদিন কাজে বেরিয়েছে৷ পিছন থেকে চমকওয়ালা চমক দিলেই কাজ আরম্ভ করবে, সেইজন্য দাঁড়িয়ে আছে৷
সার্ভেয়ার আর তার সঙ্গের লোকরা ক্রমাগত চেঁচাচ্ছে, ‘আরে চমকাও রে, চমকাও৷’ কিন্তু চমক আর দেয় না৷ বিরক্ত হয়ে দু-জন খালাসি দেখতে গেল লোকটা কী করছে, চমক দেয় না কেন৷ তারা নীচে নেমে দেখে লোকটা সেখানে নেই৷ চেঁচিয়ে বাবুকে ডাকল৷ সার্ভেয়ারও দৌড়ে গেল৷ একটু দূরেই তার দাখানা পড়ে রয়েছে৷ কাছে গিয়ে দেখল রক্ত আর মগজ! আরও একটু দূরে দেখতে পেল একটা বাঁশঝাড়ের মধ্যে খালাসির চূর্ণ করা দেহটা বিঁধে রয়েছে৷ সব জায়গায় হাতির পায়ের দাগ৷
সকালের কুয়াশাতে তারা হাতির রাস্তায়-রাস্তায় কাজ করছিল৷ কোথায় যে পাশেই হতভাগা হাতি চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল সেটা কুয়াশার জন্য দেখতে পায়নি৷ আর সকলে চলে যাবার পর যখন চমকওয়ালা একলা সেখানে দাঁড়িয়েছিল, তখন হতভাগা হাতি নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে তাকে ধরেছিল আর সঙ্গে—সঙ্গেই আছাড় মেরে হাড় ভেঙে দেহটাকে ওই বাঁশঝাড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল৷
পরে ওই হাতিটাকে আসামের কমিশনার সাহেব মেরেছিলেন৷
এ-বছর আমার কাজ ছিল খাসিয়া আর গারো পাহাড়ের সীমানার কাছে৷ সেখানে একটা জায়গা ছিল একেবারে গ্রামশূন্য৷ ওই জায়গাটাতে মেলা শিকার ছিল৷ দু-জন সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে গিয়েছিলাম, তাদের খালাসিরা একমাস ধরে শুধু নুন লঙ্কা আর ভাত খাচ্ছে৷ আমাকে দেখে মুখ ভার করে অবস্থাটা জানাল৷ বিকেলে বন্দুক হাতে বেরোলাম আর আধ-ঘণ্টার মধ্যে দুটো হরিণ মারলাম, একটা প্রকাণ্ড সম্বর আর একটা বড়ো বার্কিং ডিয়ার৷ সম্বরটাকে আট-দশজন লোকও তুলে আনতে পারেনি৷ চামড়া ছাড়িয়ে, মাংস কেটে টুকরো-টুকরো করে আনতে হয়েছিল৷ লোকও ঢের ছিল, দুজন সার্ভেয়ার আর আমার খালাসিরা ছাড়াও চার-পাঁচজন খাসিয়া কুলি৷ মাংস ভাগ-বাটরা করে দেওয়া হল, প্রত্যেকেই অনেক মাংস পেল আর সকলেই মহা খুশি!
রাত্রে খালাসিরা মিলে অনেক রাত পর্যন্ত হল্লা করল৷ ভোরে শুনি আবার হল্লা৷ আমি উঠে হাত-মুখ ধুয়ে, কাপড়-চোপড় পরে চা খেতে বসেছি, কাজে বেরোতে হবে৷ আমার টিন্ডেল হাঁড়িপানা মুখ করে এসে নালিশ করল, ‘হুজুর, আমার মাংস চুরি করে খেয়ে ফেলেছে৷’
‘কে খেয়েছে?’
‘পাহারাওয়ালারা৷’
‘কাদের পাহারা ছিল?’
দু-জন খালাসির নাম করল৷ তাদের একজন আবার ওর নিজের শালা৷ তাদের দুজনকে ডেকে আনলাম৷
‘কী ব্যাপার? তোমরা মাংস খেয়ে ফেলেছ?’
‘হ্যাঁ হুজুর, মেলা মাংস খেয়েছি৷’
‘তোমাদের হিস্যার মাংস ফেলে ওরটা খেলে কেন?’
তখন হাত জোড় করে টিন্ডেলের শালা বলল, ‘হুজুর, ওটা ওর হিস্যার মাংস নয়৷ ওটা চুরির মাংস৷’
‘চুরির মাংস কেমন?’
‘হুজুর, কাল দুটো হরিণ মেরেছিলেন আর সকলকে বেঁটে নিতে বলেছিলেন৷ এদিকে টিন্ডেল ছোটো হরিণটার একটা পিছনের ঠ্যাং লুকিয়ে রেখে বাকি মাংস ভাগ করে দিয়েছিল, নিজেকে সুদ্ধ হিসেব করে৷ রাত্রে সবাই শুলে ওই ঠ্যাংটা বের করে, লম্বা-লম্বা ফালি করে কেটে আগুনের উপর টাঙিয়ে দিয়েছিল আর আমাকে পাহারায় বসিয়ে রেখেছিল, শুকোলে যেন তুলে রাখি, ওই মাংস সে দেশে নিয়ে যাবে৷ এটা কেন ভাগ করা হয়নি জিগগেস করাতে আমাকে ধমকে বললে, ‘‘চারসের-সাড়ে-চারসের মাংস পেয়েছিস, আবার কী চাস? চুপ করে থাক, আর যা বলছি তাই কর৷’’ আমরা কিন্তু ওই মাংস আগুনে পুড়িয়ে, নুন দিয়ে খেয়ে ফেলেছি৷’
‘আরে হতভাগা, রাংটা তো সাত-আটসের মাংস হবে, দুজনে খেলি কী করে?’
‘নহি হুজুর, বহুৎ আদমি মিলকর খায়া৷’
‘টিন্ডেল কো নহি দিয়া?’
মাথা নীচু করে উত্তর দিল, ‘নহি, হুজুর৷’
আমার এমন হাসি পেয়েছিল যে কী বলব৷ টিন্ডেলকে বললাম, ‘ওদের হিস্যা ওরা খেয়ে নিয়েছে তাতে নালিশ করবার কিছু নেই! আর তোমার হিস্যা তোমার শালা খেয়েছে, তাতে তোমার বলবার কী আছে? শালারা তো অমন খেয়েই থাকে!’