১২
(১৯০৯-১৯১০) এবারও আমি ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট আর কাছাড়ে কাজ করতে গিয়েছিলাম৷ এই দু বছরে একটা বিষয়ে খুব অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সে হল জোঁকের৷ জোঁক যদি দেখতে চাও, তাহলে কাছাড়ের বনে একবারটি যাও৷ অনেক দেশে, অনেক জায়গায় ঘুরেছি, এমন জোঁক আর কোথাও দেখিনি৷ সে জোঁকই বা কত রকমের, কত রঙ-বেরঙের! ছোটো, বড়ো, মাঝারি৷ এক-একটা দু-ইঞ্চি আড়াই-ইঞ্চি লম্বাও আছে, সে যখন রক্ত খেয়ে পটলের মতো মোটা হয়, তখন তাকে দেখলে ভয়ে প্রাণ উড়ে যায়৷ কত রঙেরই বা জোঁকগুলো—মেটে, কটা, কালো, ফ্যাকাশে, সবুজ, ছাই৷ এক-একটার গায়ে আবার ডোরা-ডোরা, জলের ভিতর চোখে পড়লে হঠাৎ মনে হয় যেন প্রকাণ্ড শুঁয়ো পোকা!
দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে তো জোঁকের জ্বালায় ঘাসের উপর বা জঙ্গলের ভিতর চলবার জো নেই! আধ মাইল পার হতে-না-হতেই দুটি পা একেবারে জোঁকে বোঝাই হয়ে যায়, পনেরো-কুড়িটা করে একসঙ্গে এসে ধরে! যাদের খালি পা, তাদের অনেক সময়ই দা দিয়ে চেঁছে জোঁক ছাড়াতে হয়৷ এতেও যদি অব্যাহতি পাওয়া যেত তাহলে আর দুঃখ ছিল না৷ অনেক জায়গায় নীচে তো জোঁক রয়েছেই, তার উপর আবার গাছ থেকেও টুপটাপ করে মাথায় পড়ে৷
সার্ভেয়ার খালাসি পাঠিয়েছে ডাক আনবার জন্য৷ চিঠিপত্র আনবে আর সেইসঙ্গে চাল-ডালও কিছু কিনে আনবে৷ ইতিমধ্যে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ ফিরবার সময় খালাসিরা একটা জলার উপর দিয়ে পোল পার হয়ে আসছিল৷ দুখানা আড়াআড়ি বাঁশ, তার উপর লম্বালম্বি তিনখানা বাঁশ পাতা, এই হল পোল এবং এরই উপর দিয়ে পার হচ্ছে৷ এমন সময় নীচের দিকে চেয়ে দেখে মাছ! কই মাছ আর ল্যাটা মাছ! ইঞ্চি তিনেক বৃষ্টির জল জমেছে তারই মধ্যে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে৷
সে মাছের লোভ কি আর সামলানো যায়? খালাসি মাছ ধরবার জন্য লাফিয়ে জলে নামল৷ আর সে যাবে কোথায়! বেচারা আর উঠবার পথ পায় না এমনি জোঁকে ধরেছে তাকে! অনেক কষ্টে উপরে উঠে পা দুখানির দিকে চেয়ে তার চোখ দুটো কপালে উঠে গেল! পা দুটো যেন জোঁক দিয়েই তৈরি৷ ভাগ্যিস আরেকজন লোক সঙ্গে ছিল, সে দা দিয়ে চেঁছে জোঁক ছাড়াল, নইলে সেদিন মাছ খাওয়া ভালো করেই হয়েছিল আর কি!
আমার তো বাঘ-ভাল্লুকের অত ভয় করে না, জোঁককে যত করে৷ ভয় করবে না? এদের হাত এড়াবার জন্য কত ফন্দিই-না করি, কিন্তু এড়াবার জো আছে? কখন যে ধরে তাও বোঝবার উপায় নেই, বোঝবার আগেই সে যত খুশি রক্ত খেয়ে পেট ঢাক করে বসে আছে! মোজা, তার উপর বুট, তার উপর একেবারে পায়ের কবজি অবধি ইজের, তার উপর কবজি থেকে হাঁটু পর্যন্ত পট্টি জড়ানো, তবু তাকে ফাঁকি দেবার জো নেই৷ এতগুলো জিনিসের ভিতর দিয়েও বেমালুম ঢুকে যায়! এমন জানোয়ারকে ভয় করব না তো কাকে করব?
.
গ্রাম থেকে দেড়-দুদিনের পথ দূরে, ঘোর বনে সফদর-হুসেন সার্ভেয়ার কাজ করে, তার সঙ্গে ন-দশজন লোক৷ খালাসি বেচারিরা বনে থাকে, নুন লঙ্কা ভাত ছাড়া বড়ো একটা জোটে না৷ তাও দুদিনের পথ থেকে পনেরোদিনের মতো একসঙ্গে সব এনে রাখতে হয়৷ মাঝে-মাঝে নুনও ফুরিয়ে যায়, তখন শুধু ভাত খায়৷
আজ বড়ো ভারি শিকার জুটেছে৷ কাজ শেষ করে সার্ভেয়ার তাঁবুতে ফিরে আসছে, আর চোখের সামনেই শিকার, প্রকাণ্ড হরিণ! সেটাকে মারতে পর্যন্ত হবে না, ইতিপূর্বেই বাঘ সেটাকে মেরে নিয়ে খেতে বসেছে৷ অনেকক্ষণ আগে যে মেরেছে তাও না, বড়ো জোর ঘণ্টা দেড়েক হবে৷
সকলে মিলে চিৎকার করে বাঘটাকে তাড়াল৷ তারপর তারা মহা আনন্দে হরিণটাকে বয়ে নিয়ে চলল৷ বাঘ সামান্যই খেয়েছিল, সেদিকের খানিকটা মাংস কেটে ফেলে দেওয়া হল৷ কিন্তু অত বড়ো হরিণ কি সহজে বয়ে নেওয়া যায়? তায় আবার অনেকখানি পাহাড় চড়তে হবে, এদিকে সারাদিন খেটে সকলেই কাহিল হয়ে পড়েছে৷
তখন তারা বুদ্ধি খাটিয়ে উপস্থিত কাজ চালাবার মতো শুধু একটা রাং কেটে নিল, বাকি হরিণটা একটা গাছের উপর, মাটি থেকে দশ-বারো ফুট উঁচুতে দুটো ডালের মাঝখানে টাঙিয়ে রেখে গেল৷
সে রাত্রে তাদের আহারটি বেশ ভালো রকমই হয়েছিল, পরদিন সকালেও ওই মাংসতেই চলেছিল৷ সকালে কাজে যাবার সময়ে সার্ভেয়ার বলল, ‘দুদিনের চাল বেঁধে নিয়ে চলো, কাজ করতে-করতে অনেক দূর যেতে হবে, ফিরবার সুবিধা হবে না৷’
খালাসিদের মহা ফুর্তি! তারা শুধু চাল আর নুন লঙ্কা সঙ্গে নিল, মাংস তো পথেই টাঙানো আছে, তাই দিয়ে বেশ জমকালো রকমের ভোজ হবে৷
জিনিসপত্র ঘাড়ে করে হাসতে-হাসতে তারা গাছতলায় এল৷ কিন্তু হায়, হায়! মাংস তো নেই, একটুও নেই! আছে শুধু গাছের গায়ে বাঘের নখের আঁচড়! বাঘের মতো জন্তু, সে নিজের হাতের শিকার অত সহজে ছেড়ে দেবে, তা কখনো হতে পারে? নিশ্চয় চুপি-চুপি তাদের পিছন-পিছন এসে সব দেখেছিল৷ তারপর সুবিধা বুঝে, লাফ দিয়ে, থাবা মেরে হরিণ নামিয়ে নিয়ে গেছে৷ মাটিতে যে রক্ত পড়েছিল, তাও চেটে-চেটে খেয়ে যেতে ভোলেনি৷ এদিকে এ বেচারাদের যে কষ্ট সেই কষ্ট! আবার সেই নুন লঙ্কা দিয়ে ভাত খেতে হল৷
আরেকবার দু-জন সার্ভেয়ার কাছাড়ের বনে কাজ করতে গিয়েছিল৷ একই নালার ধারে তিন-চার মাইল উপরে নীচে তাদের ডেরা৷ ঘোর জঙ্গল, বুনো হাতির রাস্তা ছাড়া পথ নেই৷ চোদ্দো-পনেরো মাইল দূর থেকে চাল-ডাল ইত্যাদি এনে খেতে হয়৷ প্রত্যেকের সঙ্গে দশ-বারোজন করে হাজারিবাগের খালাসি ছিল৷ কাজকর্মও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, চার-পাঁচদিনের বেশি কাজ বাকি নেই৷ তারপর তারা অন্য জায়গায় যাবে৷
গোপাল সিং আর অমর সিং দু-জনেই রাজপুত৷ গোপাল সিং দিনের কাজ শেষ করে তাঁবুতে এসে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছে৷ তার চারকটাও তার সামনে বসে খাচ্ছে, মাঝখানে হাত দু-তিন জায়গা৷ দু-গ্রাস ভাতও মুখে দেয়নি, আর অমনি ‘হাল্লুম’ বলে এই বড়ো বাঘ দু-জনের মাঝখানে লাফিয়ে পড়েছে! বাঘ দেখেই তো তারা বন্দুকের গুলির মতো দু-দিকে ছিটকিয়ে পড়ল, তারপর বাপ রে বাপ, খাওয়া-দাওয়া কোথায় গেল, জিনিসপত্র ফেলে দে পিট্টান!
হাতির রাস্তা ধরে তারা প্রাণপণে ছুটতে লাগল৷ দু-তিন মাইল চলে দেখতে পেল অমর সিং তার কাজ শেষ করে তাঁবুতে ফিরে যাচ্ছে৷ অমর সিং ওদের দেখে মনে করল বুঝি কাজ শেষ হয়ে গেছে৷ তারপর যখন শুনল যে তারা বাঘের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন অমর সিং গোপাল সিংকে বুঝিয়ে বলল, ‘দেখো, কাজ থেকে পালিয়ে গেলে বড়ো বদনাম হবে৷ জঙ্গলের কাজ, জানোয়ার তো হামেশাই পাওয়া যায়৷ আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে, চলো, কাল থেকে আমরা দু-জনে মিলে তোমার কাজ করি৷ দু-তিনদিনেই শেষ হয়ে যাবে, তখন একসঙ্গে চলে যাব৷ আমাদের দু-জনের ডেরা এক জায়গায় থাকলে আমরা কুড়ি-বাইশজন লোক হব, তাহলে আর কোনো জানোয়ার আসবে না৷’
এই প্রস্তাবে গোপাল সিং রাজি হয়ে, অমর সিং-এর সঙ্গে তার তাঁবুতে গেল৷ সেখানেও ভাত তৈরি, দুই দলে মিলে তাই ভাগ করে খেতে বসল৷ একজন খালাসির খাওয়া শেষ হয়েছে, সে বেচারা ডেরার পাশে নালার জলে থালাখানা ধুতে গেছে৷ অমনি বাঘ এসে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়েছে! কারো মনে হয়নি যে সে ব্যাটা এই তিন-চার মাইল পথ চলে তাদের পিছন-পিছন এখানে এসে হাজির হবে৷ বাঘে ধরবামাত্র লোকটা চেঁচিয়ে উঠল আর সঙ্গে-সঙ্গে অপর সকলেও এমনি চিৎকার জুড়ে দিল যে আর কী বলব!
অমর সিং-এর টিন্ডেল অর্থাৎ সর্দার খালাসি নান্দা ছিল বড়ো বাহাদুর লোক৷ এর আগেও ব্রহ্মদেশে দু-একবার বাঘের সঙ্গে তার হাতাহাতি হয়েছে৷ সে তখনই ধুনি থেকে একটা জ্বলন্ত বাঁশ তুলে নিয়ে, ছুটে গিয়ে, ধাঁই করে বাঘের মাথায় এক ঘা বসিয়ে দিল৷ তার ফলে বাঘও সেই লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ নান্দাকে ধরে বসল৷
নান্দা কিন্তু ছাড়বার পাত্র নয়৷ তার বাঁ হাতটা বাঘের মুখে রইল আর ডান হাতের সেই বাঁশ দিয়ে সে বাঘের নাকমুখ বেশ করে থেঁতলিয়ে দিতে লাগল৷ বাঘ তখন বেগতিক বুঝে নান্দাকে ছেড়ে দিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল৷ তাই দেখে নান্দাও সেই লোকটাকে তুলে উপরে নিয়ে এল৷
বাঘ কিন্তু সেখান থেকে যায়নি, এপারে বসে রাগে গরগর করছে৷ সকলে ভয়ে তাঁবুর ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নিল, আর প্রাণপণে তাঁবুর দরজার সামনের ধুনিটা উস্কে দিতে লাগল৷ কিন্তু বাঘ কি তাতে ভয় পায়? তার মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সে অত সহজে ছাড়বে কেন? নালা ডিঙিয়ে এসে তাঁবুর চারদিকে ঘুরতে লাগল৷ এক-একবার ভীষণ রাগে তাঁবুতে থাবা মারতে লাগল, আর সে কি ভীষণ গর্জন!
এদিকে তাঁবুর ভিতরে সকলে প্রাণপণ চ্যাঁচাচ্ছে আর থালা, ঘটি, বাটি, কেরাসিনের টিন, যা কিছু ছিল তাই নিয়ে খুব করে পিটছে৷ এমনি করে অনেক রাতও হল আর বাঘও যেন চুপ করে গেল৷ এদিকে ধুনিটাও একটু নিবু-নিবু হয়ে এল৷ বাঘের সাড়াশব্দ নেই, হয়তো চলে গিয়ে থাকবে, এই মনে করে একজন খালাসি সাহসে বুক বেঁধে, ধুনিটাকে উস্কিয়ে দেবার জন্য বাইরে এল৷
আর যাবে কোথায়? হতভাগা বাঘ ধুনির পিছনেই লুকিয়ে বসেছিল, লাফিয়ে এসে তার ঘাড়ে পড়ল!
এখন এ বেচারাকে কে ছাড়াবে? আর কে ছাড়াবে? নান্দার হাত দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে, কিন্তু সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই, আবার ধুনি থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে কষে বাঘের মাথায় এক ঘা!
বাঘ নান্দাকে বেশ চিনেছিল, সেইজন্য এক ঘা খেয়েই আর দ্বিতীয় ঘায়ের জন্য অপেক্ষা করল না, তার বোধহয় মনে হল এবার লেজটি গুটিয়ে সরে পড়াই ভালো৷
তখন সে লোকটাকে তাঁবুতে এনে, সকলে মিলে চেঁচিয়ে আর থালা-ঘটি পিটে রাত কাটাল৷ সকালে উঠে জিনিসপত্র সেখানেই ফেলে, শুধু নকশাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চম্পট দিল৷
দুদিন পরে সেই আড্ডায় গিয়ে দেখা গেল যে বাঘটা রাগের চোটে তাঁবুটাকে কামড়িয়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলেছে৷ এক বস্তা চাল আর একটা তেপায়া ছিল, সেগুলোকেও চিবিয়ে আর কিছু রাখেনি৷
প্রথম যে লোকটাকে বাঘে ধরেছিল, সে তিনদিন পরে মারা গেল৷ নান্দা আর অন্য লোকটা তিন মাস হাসপাতালে ভুগে ভালো হয়ে গেল৷
বনের ভিতর জরিপের কাজ করতে হলে, সামনে আর পিছনে দু-জন লোক নিশান নিয়ে দাঁড়ায়, আর ওই নিশান দেখে-দেখে ৬৬ ফুট লম্বা জরিপের চেন দিয়ে মেপে যেতে হয়৷ অনেক সময় কিন্তু নিশানও দেখা যায় না, তখন একখানা ছোটো আয়না হাতে নিয়ে চমকাতে হয়৷ তার ঝিকমিক তিন-চার জরিপ দূর থেকে দেখা যায়৷ আয়না চমকাবার সময় সামনের লোকটি সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার করতে থাকে, তাতে ঠিক তার সোজাসুজি জরিপ দিয়ে মাপবার সুবিধা হয়৷
ফুটকিয়া নতুন লোক, সামনের চমকের কাজ তার হাতে৷ চমক দিয়েছে ঠিকই কিন্তু আওয়াজ আর দেয় না৷ ব্যাপার কী? সে পথে বাঘের ভয় আছে, গ্রামের লোকেরা আগেই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল৷ কাজেই আমার মনে একটু সন্দেহ হল, আমি লম্বা-লম্বা পা ফেলে দেখতে চললাম৷
একটু দূর গিয়েই দেখি কাদার উপর ফুটকিয়ার পায়ের দাগ আর তার পাশেই প্রকাণ্ড বাঘের পাঞ্জা৷ বাঘটা এইমাত্র গিয়েছে, তখনও চারদিক থেকে জল গড়িয়ে এসে পাঞ্জার দাগে জমা হচ্ছে! আমি খুব জোরে চিৎকার করে হাঁক দিলাম, ‘ফুটকিয়া!’ হাত কুড়ি-বাইশ সামনে থেকে ভাঙা গলায় আওয়াজ হল: ‘হুজুর!’ আর তার সঙ্গে-সঙ্গেই মনে হল কী একটা জানোয়ার জঙ্গলে গা ঢাকা দিল৷ দৌড়ে ফুটকিয়ার কাছে গেলাম৷ বেচারা রাস্তার মাঝখানে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে কথাটি নেই৷
‘কীরে, কী হয়েছে?’
বললে, ‘একটা কিছু আমার পিছনে-পিছনে আসছিল৷’
‘কোথায় গেল?’
‘এখানেই তো ছিল, হুজুর ডাকলেন আর জঙ্গলে ঢুকে পড়ল৷’
যেখানটায় ছিল বলে দেখিয়ে দিল সে জায়গাটা ফুটকিয়ার কাছ থেকে সাত-আট হাত দূরে হবে৷
‘কেমন জানোয়ার ছিল রে?’
‘তানি মটুকে তো থা— ’ বলে হাত দিয়ে মাটি থেকে ফুট দুই উঁচু দেখাল৷ ‘লাল আউর কালা ভি থা৷ এতনা বাড়া শির থা, আউর দুম হিলাতা থা৷’
‘আরে, শের থা রে?’
‘নহি হুজুর! শের হোতা তো হামকো খা ডালতা নহি?’
ভালো! যে প্রকাণ্ড পায়ের দাগ, আমার আর মিনিট খানেক দেরি হলেই খা ডালতা কিনা বুঝতে পারত৷ আসল কথা ফুটকিয়া কখনো বাঘ দেখেনি৷
.
গরমের দিনের রোদ হাতির সহ্য হয় না, সেইজন্য ভোরে জিনিসপত্র নিয়ে লোকজন চলে গেছে, আমি সার্ভেয়ারের সঙ্গে কাজে গিয়েছি৷ বেলা বারোটার পর কাজ বন্ধ করে ঘোড়ায় চড়ে তাঁবুতে চললাম৷ বারো মাইল যেতে হবে, পথে আবার পাহাড়ের চড়াই আছে৷ পাঁচ-ছয় মাইল মাত্র গিয়েছি, দেখলাম রাস্তার পাশে কয়েকটা বোঝা পড়ে আছে, সেগুলি দেখতে ঠিক আমাদের মালপত্রেরই মতো৷ আরও একটু চলে দেখি একটা গাছের ছায়ায় আরও মালপত্র আর সঙ্গে একটা খালাসি বসে রয়েছে৷
‘আরে, কেয়া হ্যায় রে?’
‘হুজুর, একটা হাতি ভেগেছে, তাই আমি জিনিসপত্র আগলাবার জন্য বসে আছি, টিন্ডেল আর লোকজনরা হাতির পিছন-পিছন দৌড়েছে৷’
‘হাথি কেঁউ ভাগা?’
‘হুজুর, হামলোগ যাতা রহা, পিছেসে ফটফটিয়া আয়া, আউর হাতি চিল্লাকর ভাগা! আসবাব ইধার-উধার ফেঁক দিয়া৷ মাহুত পিছু-পিছু দৌড়কর গিয়া আউর টিন্ডেল ভি গিয়া৷’
‘হাথি পর কৌন থা?’
‘হুজুর, টরকাটা থা৷ মাহুত বাত করতে-করতে পয়দল আতা থা৷’
এই ফটিফটিয়া অর্থাৎ মোটর-সাইকেল বড়ো বিষম জিনিস৷ হাতি বেচারা আসামের জঙ্গলে নিশ্চিন্ত মনে পথ চলেছে আর যদি বিনা নোটিশে পিছন থেকে ওই বিদঘুটে আওয়াজ করতে-করতে একটা কিম্ভূতকিমাকার জীব এসে পড়ে, তাহলে কার না প্রাণ আঁতকে ওঠে?
চা বাগানের সাহেবদের ফটফটিয়া আছে৷ এদের জ্বালায় কতবার যে নাকাল হতে হয়েছে সে আর কী বলব! রাস্তার মোড় ঘুরেছি অমনি ফটফট আওয়াজ করে এসে হাজির! ঘোড়াটা লাট্টুর মতো ঘুরে যেদিকে তার মন গেল দে দৌড়! সে কাঁটাই হোক, আর কাদাই হোক, আর যাই হোক! দুর্দশা দেখে কেউ একটু সহানুভূতিও প্রকাশ করে না, সবাই হেসে কুটোপাটি!
আমার সঙ্গের হাতি দুটোর মধ্যে একটা কানা ছিল, তাকে নিয়েই যত গণ্ডগোল হত৷ বেচারা এক চোখে কিছুই দেখতে পায় না, অন্য চোখটাও প্রায় অকর্মণ্য— ছানি পড়েছে, কাজেই পালানোই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায় ঠাউরিয়ে ছিল৷
এ বছর কাজ শেষ করে আমরা শিলং চলে গেলাম৷ আমাদের আপিস ব্যাঙ্গালোর থেকে শিলং-এ উঠে এল৷ এখন আমাদের আসামেই কাজ করতে হবে৷