বনের খবর – ২

১৮৯৯-১৯০০ ব্রহ্মদেশ, শান স্টেট৷ দেরাদুন থেকে কলকাতা, তারপর জাহাজে রেঙ্গুন৷ রেঙ্গুন থেকে আবার রেলপথে থাজি জংশন, মিকটিলা রোড৷ তারপর হাঁটা পথে শান স্টেট৷ থাজি থেকে দক্ষিণে শান স্টেটের প্রধান শহর, টাউংজি, দশদিনের পথ— ১১০ মাইল৷ টাউংজি থেকে আমাদের কর্মস্থান আরও বারো-তেরোদিনের পথ; প্রথমবার পদব্রজেই গিয়েছিলাম৷ যে কয়দিন বড়ো রাস্তা ধরে চলেছি, তাঁবু খাটাতেই হয়নি, বারো-চোদ্দো মাইল পর-পর গভর্নমেন্টের আড্ডা আছে৷ সেই আড্ডার বাংলোয় রাত কাটিয়েছি৷ বড়ো রাস্তা ছাড়লে পর তাঁবু আশ্রয় করতে হয়েছে৷ সে সময়ে শান স্টেটে রেল লাইন খোলা হয়নি, টাউংজি পর্যন্ত গোরুর গাড়ি চলত, তারপর খচচর বা বলদ সম্বল৷

আমার কাজের সাহায্যের জন্য আমার সঙ্গী রামশবদ নামে একজন বুড়ো সার্ভেয়ার গিয়েছিলেন— তাঁর দুই চাকরের কথা বলি৷

সার্ভেয়ারটি ব্রাহ্মণ, বাড়ি অযোধ্যায়৷ প্রায় ৩৫-৩৬ বছর সার্ভে ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছেন৷ চাকর দুটিও তাঁরই দেশের লোক— সুচিৎ আর বেণী, তারাও ব্রাহ্মণ৷ বেণী বুড়ো, বেঁটে, রোগা আর হিংসায় তার পেটটা ভরা৷ সুচিৎ তার বিপরীত, লম্বা, মোটা, ফরসা আর সাদাসিদে মানুষ৷ তারা দু-জনে মিলে ওই সার্ভেয়ারটির রান্নাবান্না, কাজকর্ম সব করে৷ সার্ভেয়ার তাদের দু-জনকেই খেতে দেয়, বেণীর কিন্তু তা সহ্য হয় না৷ সুচিৎ কেন বাবুর খাবে? আর যদি খাবেই, তবে অত খাবে কেন? সুচিতের শরীরটি যেমন, আহারটিও তেমনি, সে বেণীর ডবল খায়৷ কাজও করে সে বেণীর চেয়ে ঢের বেশি, কিন্তু তা হলে কী হয়? বাবু যে সুচিৎকে খেতে দেন, বেণী তা সইতে পারে না৷ সুচিৎ আবার যতটা খায়, সব সময় তা হজম করতে পারে না, সেজন্য কাজ করতে-করতে অনেক সময় তাকে ঘটি হাতে ছুটতে হয়৷ সেদিন সন্ধ্যাবেলা, বাবুর চায়ের জল করতে বসে তাকে তেমনি ঘটি হাতে ছুটতে হল৷

চারদিকে ঘোর জঙ্গল৷ বাঘের ভয় খুবই আছে, কাজেই সুচিৎ বেশিদূর যায়নি৷ অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দেখে, খচচরওয়ালারা খচচর সব ভালো করে বেঁধে চারদিকে ধুনি জ্বালাবার জোগাড় করছে৷ এমন সময় তাদের একজন দেখলে ওরে বাবারে! কী বড়ো বাঘ আসছে গুড়ি মেরে৷ এ ঝোপ থেকে ও ঝোপের আড়ালে, সেখান থেকে আর এক ঝোপের পিছনে— এমনি করে সুচিৎকে ঠিক ধরবার চেষ্টা৷

দেখেই তো সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘পালাও, পালাও! বাঘ এসেছে, ধরলে!’

এ কথা শোনামাত্র সুচিৎ যে কী প্রাণপণ ছুটেছিল, তা বুঝতেই পার৷ কোথায় রইল তার লোটা আর কোথায় রইল তার জল, সে দু-লাফে একেবারে তাঁবুর ভিতরে এসে হাজির৷ ভয়ে বেচারার প্রাণ শুকিয়ে গেছে, মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না৷ বাবুর চা সে-রাত্রে উনুনের উপরই রইল, বাঘকেও সুচিৎকে না খেয়ে ফিরে যেতে হল৷ তার অনেকক্ষণ পরে চার-পাঁচজনে মিলে, মশাল জ্বালিয়ে সুচিৎকে নদীতে স্নান করিয়ে আনল৷ সেই পৌষ মাসের শীতে বেচারা কী কষ্টই পেল, তা দেখে কিন্তু বেণীর মুখে হাসি ধরে না৷ তবে বেণীরও যে সকল দিন এমনি হেসে কেটেছিল তা নয়, সে গল্প পরে শুনবে৷

আগেই বলেছি, সুচিৎ যে বাবুর খায়, বেণীর তা সহ্য হয় না৷ ঝগড়াঝাঁটি লেগেই আছে৷ দিন-রাত খুঁটিনাটি নিয়ে এই ঝগড়ার চোটে বেচারা বুড়ো রামশবদের আর সহ্য হয় না, সেজন্য বিরক্ত হয়ে বেণীকে বলেছেন, ‘তোমরা দু-জনেই সরকারের চাকর৷ কাজ কর সরকার বাহাদুরের, খেতে দিই আমি, তাই নিয়ে ওর সঙ্গে ঝগড়া কেন? তোমার তো আর সে খায় না৷’ ইত্যাদি৷

চটে গিয়ে বেণী আর বুড়োর ভাত খায় না, নিজে আলাদা রেঁধে খায়৷ বুড়োর কোনো কাজও সে আর করে না, দিব্যি আরামে বসে থাকে৷ আগে ব্যবস্থা ছিল যে পালা করে তারা দু-জনে বুড়োর সব কাজ করে দেবে, আর আবশ্যকমতো বুড়োর সঙ্গে জঙ্গলে কাজ করতে যাবে৷ সুচিৎই কাজে যেত, বেণী রান্না করত, কখনো জঙ্গলের কাজে যেত না৷ বেণী ঝগড়া করে বসে-বসে দিন কাটায়, জঙ্গলেও যায় না, বুড়োর কাজও করে না৷ সুচিৎকে দুই কাজই করতে হয়৷

আমি দিন দুই দেখে একটু চাপ দিলাম, ‘বেণী, তুমি বাবুর কাজ না কর বেশ, সরকারের মাইনে যখন খাও, সরকারের কাজ তোমাকে করতে হবে৷ বসে থাকতে পাবে না৷ কাল থেকে তুমি বাবুর সঙ্গে কাজে যাবে৷ না গেলে, তোমার মাইনে কাটা যাবে৷ সুচিৎ যখন বাবুর রান্নাবান্না সব করে দেয়, তখন সুচিৎ আর কাজে যাবে না৷’

বেণীর জঙ্গলে গিয়ে অভ্যাস নেই, মহা ফাঁপরে পড়ে গেল৷ কিন্তু উপায় নেই, তাই যেতেই হল৷ কাজে বের হয়েছি, দেখেছি বেণীর পিঠে একটা বোঁচকা বাঁধা৷

‘ওটা কী রে?’

বুড়ো হেসে বলল, ‘আরে বাবুজি, উসমে উসকা জনমভরকা কামাই৷’

ব্যাপার কী? শুনলাম বেণীর যা কিছু পুঁজি আছে, সব ওই বোঁচকার মধ্যে— ৩৬০ টাকা৷ ভীষণ কৃপণ, কাকেও বিশ্বাস করে না৷ সেজন্য এই টাকা, দেশে তার আত্মীয়স্বজনদের কাছে রেখে আসে না, সর্বদাই সঙ্গে নিয়ে-নিয়ে ফেরে, তাঁবুতেও রেখে যাবে না, যদি কেউ চুরি করে৷ তিন-চারদিন বোঁচকা বেঁধেই কাজে গেল, তারপর একদিন বসে একটা লম্বা থলে সেলাই করে, তাতে টাকা ভরে কোমরে বাঁধল, আর তার উপর একটা কম্বল জড়িয়ে প্রকাণ্ড ভুঁড়ি বানাল৷ কিন্তু অমন করে আর কদিন চলবে? একে তো জঙ্গলের কাজে অনভ্যস্ত, তার উপর আগের মতো চর্ব্যচোষ্যও জোটে না, একবেলা দুটি শুকনো ভাত মাত্র খায়৷ কৃপণ, পয়সা খরচ করে দু-বেলা খাবে না৷ একটু জব্দ হয়ে পড়ল৷

সেদিন আমরা সালউইন নদী পার হয়েছি আর নদীর কিনারায় তাঁবু খাটিয়েছি৷ শানেরা নদীতে মাছ ধরছিল, বেচতে এল৷ বুড়ো অযোধ্যার ব্রাহ্মণ হলেও মাছ-মাংসের ভক্ত৷ আমি মাছ খাই না, বুড়োকে দেখিয়ে দিলাম৷ বুড়ো বলল, ‘নেব না৷’

‘কেন?’

‘সুচিৎ ভালো রাঁধতে পারে না, মিছিমিছি নষ্ট করব কেন?’

আমি বললাম, ‘মাছ রাখ, আমার লোক সুচিৎকে মাছ রান্না দেখিয়ে দেবে৷’

বুড়ো একটু ইতস্তত করে একটা মাছ কিনল৷

আমি একটু ঘুমিয়ে উঠেছি, স্নান করব৷ মাছ রান্নার গন্ধ পেয়ে দেখতে গেলাম আমার লোক সুচিৎকে দেখিয়ে দিচ্ছে কি না৷ গিয়ে দেখি বেণী রান্না করছে৷

‘কী বেণী, কী হল?’

‘আরে হুজুর, বাবু না হয় রাগ করে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আমি তো কদিন থেকে দেখছি যে বাবুর খাওয়া হয় না৷ ওটা তো রাঁধতে জানে না, তাই মাছটা রেঁধে দিচ্ছি৷’

বুড়ো আমাদের কথা শুনে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছিল, আর একটু-একটু হাসছিল৷

সন্ধ্যার সময় দেখি বুড়ো আর সুচিতের সঙ্গে বেণী ভাত ও মাছ খাচ্ছে৷ মাছের লোভটা হতভাগা ছাড়তে পারলে না!

.

সালউইন নদীর পারে একটা পাহাড়ের কাজ শেষ করে, অপর পারে অন্য পাহাড়ে যাব৷ সোজাসুজি রাস্তা থাকলে ওই পাহাড়ের উপরের গ্রামটি মাইল সাতেক মাত্র দূর, কিন্তু সোজা যাবার উপায় নেই৷ মাঝখানে সালউইন নদী, তার দু-পাশের পাহাড়গুলো একেবারে দেয়ালের মতো খাড়া, পার হবার সাধ্য নেই৷ কাজেই বাধ্য হয়ে চারদিনের পথ ঘুরে যেতে হল৷ দ্বিতীয় দিন সালউইন নদী পার হয়েছিলাম আর সেদিনই মাছের লোভে বেণীর রাগ উড়ে গিয়েছিল৷

ওই পাহাড়ের উপর মুসোদের গ্রাম৷ সেই দেশে শান ছাড়া মুসো, পালাউং, কুই প্রভৃতি অনেক জাতির লোক বাস করে৷ পাহাড়ের মাথায় মুসোদের গ্রাম৷ তারা অন্য জায়গায় বড়ো একটা যাতায়াত করে না, কাজেই তাদের পথঘাটের বিশেষ দরকার হয় না, নালায়-নালায়ই কাজ চালিয়ে নেয়৷ জিনিসপত্র যা প্রয়োজন, প্রায় সবই তাদের আছে৷ খেতের ধান, খেতের লঙ্কা, কুমড়োও খেতের, রাইও খেতের৷ এই রাইপাতা তাদের উত্তম তরকারি৷ শিকার করে আর সেই মাংস খায়— হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভাল্লুক থেকে আরম্ভ করে কাঠবিড়ালিটি অবধি বাদ দেয় না৷ কাজেই তাদের কোনো জিনিসেরই অভাব হয় না— খালি নুন ছাড়া৷ নুনের জন্যই মাঝে-মাঝে নীচে শানদের গ্রামে আসে, তাই নালার ভিতর দিয়ে একটু-একটু রাস্তা আছে৷

তুলোও তাদের নিজের খেতের, সেই তুলোর সুতো কেটে সে দেশের মেয়েরা কাপড় বোনে৷

হাতিয়ার— তীর, ধনুক, দা, কুড়ুল আর বর্শা— কদাচিৎ মান্ধাতার আমলের এক-আধটা বন্দুকও দেখা যায়৷ তীর-ধনুক তারা নিজেরাই তৈরি করে, দা, কুড়ুল ইত্যাদি শানদের গ্রাম থেকে কিনে আনে৷

এরা খুব শিকারি৷ জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, নানা রকম জানোয়ার শিকার করে, নানা রকম পাখি এনে পোষে৷ ভয় তাদের একেবারেই নেই৷ দু-তিনজন মিলে চার-পাঁচদিন ধরে ওই ভয়ংকর বনে শিকার খুঁজে বেড়ায়, একটুও ভয় পায় না৷

এদের গ্রামগুলি দূর থেকে বড়ো সুন্দর দেখায়৷ পাহাড়ের মাথায় উঁচু-উঁচু মাচার উপর সারি-সারি বাঁশের ঘর, দূর থেকে দেখতে বেশ৷ কিন্তু কাছে গেলে বমি আসে এমনি নোংরা৷ এই যাত্রায় এদের গ্রামে দু-তিন দিন ছিলাম৷ গ্রামের প্রধান একটা বড়ো সুন্দর পাখি পুষত৷ সাদা ধবধবে, মোরগের মতো লেজ, সাদার উপর কালো-কালো কারিকুরি, যেন তুলি দিয়ে আঁকা, ডানায়ও ঠিক তেমনি কারিকুরি৷ লেজের দুটি পালক খুব লম্বা, গলাটি ঘোর নীল আর চকচকে, মাথায় ঘোর নীল রঙের ঝুঁটি৷ আমার বড়ো লোভ হল, তাই প্রধানকে ডেকে আড়াই টাকায় সেটি কিনলাম, ভাবলাম কলকাতায় নিয়ে আসব৷ পাখিটা সারাদিন বনে-বনে ঘুরে বেড়ায়, রাত্রে ঘরে আসে৷ সকালে আমরা চলে আসব, প্রধান সকালে উঠে পাখিটাকে ধরে এনে দিল, একটা খাঁচায় পুরে তাকে নিয়ে এলাম৷ নিয়ে এলাম বটে, কিন্তু দু-দিন বাদেই বেচারা মরে গেল৷ হয়তো খাঁচায় বন্ধ রাখাতে তার মন ভেঙে গিয়ে থাকবে, অথবা পুরোনো মনিবের জন্য তার গভীর দুঃখ হয়েছিল, যে দু-দিন আমাদের কাছে ছিল, এক ফোঁটা জল স্পর্শ করেনি৷

শান স্টেটে একটা তামাশা দেখেছিলাম আর একটু আশ্চর্যও হয়েছিলাম৷ আমাদের সঙ্গে যে সমস্ত শান কুলিরা জঙ্গলে কাজ করতে যেত, তাদের প্রায়ই দু-তিনদিন জঙ্গলেই থাকতে হত, কিন্তু তারা অনেক সময়েই রাঁধবার জন্য কোনো হাঁড়ি বা কড়া, বা অন্য বাসন-কোসন নিয়ে যেত না, অথচ ভাত খেত৷ কী করে রান্না করে? একটা লম্বা কাঁচা বাঁশের চোঙার একটি বাদে সমস্ত গাঁটগুলিকে ফুটো করে, সেটাকে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে, তাতে আবশ্যক মতো চাল পুরে, জল ভরে, ঘাস-পাতা দিয়ে মুখটা বন্ধ করে একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দেয়৷ তিন-চার ঘণ্টা অমনি থাকে, তারপর ওই চোঙাটা ধুনির আগুনে ঝলসায়৷ চারদিকে বেশ ঝলসানো হলে চোঙাটা জায়গায়- জায়গায় পুড়ে যায়— সেটাকে ধুনি থেকে বার করে রেখে দেয়৷ ঠান্ডা হলে পর দা দিয়ে আস্তে-আস্তে বাঁশটাকে চিরে ফেলে আর তার ভিতর থেকে দিব্যি একটি ভাতের পাশ বালিশ বার হয়ে আসে৷ সেটা চাকা-চাকা করে কেটে সকলে ভাগ করে নেয়, আর নুন, লঙ্কা, শুকনো মাছ বা মাংস উপকরণ দিয়ে খায়৷ গরমের দিনে কখনো বা ঝিঁঝি পোকা ধরে, আগুনে পুড়িয়ে তার চাটনি করে খায়৷ ঝিঁঝি পোকা নাকি অতি উপাদেয়!

ওই বছর একটা বড়ো দুর্ঘটনা হয়েছিল আমার কাজ শেষ হবার ক-দিন আগেই৷ আমাদের উপরওয়ালা মিস্টার এস- লিখলেন: তোমার কাজ তো শেষ হল বলে, শেষ হলেই তোমার পাশে সাদিক হুসেন কাজ করছে, তাকে সাহায্য করে, তার কাজ শেষ করে দাও৷ সে বড্ড পিছিয়ে পড়েছে৷

আমার কাজ শেষ হতে আরও তিন-চারদিন লাগবে, আমি তখন থেকেই পাশে সাদিক হুসেনের কাজ করব বলে গ্রাম, রাস্তাঘাট ইত্যাদি সংবাদ সংগ্রহ করতে লাগলাম৷ প্রথমেই যে সংবাদ পেলাম তাতেই তো চক্ষুস্থির! ওই পাহাড়ে সার্ভেওয়ালারা নাকি একজন লোক মেরে ফেলেছে৷

দোভাষীকে ডেকে বললাম, ‘এই গুজব আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, কাল হাট আছে, তুমি হাটে খবর নাও৷’

ভোরে উঠে দোভাষী আর দু-জন খালাসিকে হাটে পাঠিয়ে দিলাম৷ আমার তাঁবু থেকে দু-তিন মাইল দূরে, অন্য গ্রামে হাট ছিল৷ বিকেলে দোভাষী এসে খবর দিল যে ওই গুজব মিথ্যা৷ কিন্তু ওই যে পাহাড় দেখা যাচ্ছে (আট-দশ মাইল দূরে একটা পাহাড় দেখিয়ে), ওই পাহাড়ে হুসেনবাবুর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অমুক গ্রামের প্রধান গাছ চাপা পড়ে মারা গিয়েছে৷ দোভাষী বিস্তারিত কোনো খবর আনতে পারেনি৷ তবে এইটুকু বলল, ‘ওই পাহাড়ে কোনো লোক যেতে চায় না, বলে ওখানে নিশ্চয় ভূত আছে৷’

তিন-চারদিন পরে যখন আমার কাজ শেষ হল, আমি আর বুড়ো সার্ভেয়ার রামশবদবাবু ওই পাহাড়ের নীচে গ্রমে তাঁবু ফেললাম৷ এই গ্রামের প্রধানই মারা পড়েছিল৷ গ্রামের লোক পাঠিয়ে তাদের বড়ো প্রধানকে খবর দিলাম যেন এসে আমার সঙ্গে দেখা করে৷

বর্মিরা গ্রামের প্রধানকে ফুঙ্গি বলে আর শানেরা বলে ‘পুকং’৷ দশ-বারোটা গ্রামের উপর একজন বড়ো সর্দার থাকে, তাকে বর্মিরা বলে ‘মিও থুজি’ আর শান স্টেটে বলে ‘হেং’৷

রাত আটটা-সাড়ে-আটটার সময় হেং এসে হাজির, তার সঙ্গে এসেছিল আরও তিন-চারটা গ্রামের প্রধান, আর একটি বারো-তেরো বছরের ছেলে, একটি ছয়-সাত বছরের মেয়ে ও একটি ত্রিশ-বত্রিশ বছরের স্ত্রীলোক— এরা ওই মৃত প্রধানের পুত্র, কন্যা ও স্ত্রী৷ গ্রামের লোকও কুড়ি-বাইশজন এসেছিল৷ তাদের কাছ থেকে সব খবর পেলাম৷

সার্ভেয়ারদের চার-পাঁচজন খালাসি আর গ্রামের দশ-বারোজন শান কুলি পাহাড়ের উপর জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করতে গিয়েছিল— দূরবিনের কাজ হবে৷ লোকজনদের হুকুম দিয়ে কাজ করাবে বলে প্রধান সঙ্গে গিয়েছিল৷ কোথায় কী কাটতে হবে, কোনদিক থেকে আরম্ভ করতে হবে, ইত্যাদি, সব তার লোকদের দেখিয়ে দিয়ে প্রধান পাহাড়ের মাথায় আট-দশ ফুট উঁচু একটা প্রকাণ্ড পাথরের উপর চড়ে বসল আর সকলকে হুকুম করতে লাগল এটা কাট, ওটা কাট ইত্যাদি৷ শান কুলিরা এ সব কাজে সিদ্ধহস্ত, তারা কায়দা মাফিক কেটে যাচ্ছে৷ এমন কায়দায় কাটছে যে প্রত্যেকটি গাছ কাটা হলে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ছে৷

খালাসি কয়জন হাজারিবাগের লোক, তাদের এ সব খেয়াল নেই, এ কায়দাও জানা নেই৷ তারা একটা গাছ উল্টো কেটেছে— মটমট করে গাছটা নীচের দিকে না ঝুঁকে উপরের দিকে ঝুঁকেছে, এই পড়ে আর কি! ‘ভাগো, ভাগো দরখত গিরতা হ্যায়!’ যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল৷ গাছটাকে তার দিকে ঝুঁকতে দেখে প্রধান ও-পাথরটার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে সামনের নালার মধ্যে আশ্রয় নিল৷ নালার দুই কিনারা খুব উঁচু, তার ভিতর গাছের ধাক্কা লাগবে না৷ দুর্ভাগ্য তার, গাছটা পড়ল ওই প্রকাণ্ড পাথরটার উপর৷ পাথরটা মাটিতে আলগোছে বসানো ছিল, অত বড়ো গাছের ধাক্কায় একেবারে সমূলে উপড়ে গিয়ে ওই নালার ভিতর গড়িয়ে পড়ে গেল৷ ‘হায়, হায়, হায়!’ চিৎকার করে সকলে ছুটে এসে দেখল মাত্র আধখানা শরীর পড়ে আছে, বাকি অর্ধেকটা একেবারে চুরমার হয়ে যেন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে৷

গ্রামে সংবাদ দিতে, গ্রামের লোকেরা ওই আধখানা দেহ সেই পাহাড়ের উপরেই কবর দিল, আর দেবতাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য সেখানে পুজো দিয়ে এল৷

ওরা আর ও-পাহাড়ে যায় না, ওখানে ভূত আছে৷ দু-তিনজন, যারা সে সময় ওখানে উপস্থিত ছিল, তারা সকলে ওই একই কথা বলল৷ আমি হেঁকে বলে বন্দোবস্ত করলাম যে সকালে দুজন পথ দেখিয়ে আমাকে পাহাড়ে নিয়ে যাবে, কিন্তু কোনো গাছ তারা কাটবে না৷ তাহলে আর রক্ষা নেই, নাট (ভূত) আবার কাকে শেষ করবে!

ওই ছেলেটিকে সঙ্গে করে তার মামা আর প্রধানের নিজের একজন লোক আমাদের সঙ্গে আমাদের হেডকোয়ার্টারে এসেছিল— প্রায় দশদিনের পথ৷ আমরা সকলে মিলে চাঁদা তুলে প্রায় ২৫০ টাকা তাকে দিয়েছিলাম৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *