১৭
(১৯১৬-১৯১৮ (আসাম: ডিব্রুগড়: নাগা হিলস) তোমরা অনেকেই চিড়িয়াখানায় উল্লুক দেখেছ৷ আমি আসামের জঙ্গলে অসংখ্য উল্লুক দেখেছি, কতবার নিঃশব্দে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে তাদের কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করেছি৷ তাদের মজার সব কাজ দেখে আমার ভারি আমোদ হত৷ গাছের উপর উল্লুক এক জীব, আর মাটিতে একেবারে অন্য জানোয়ার, মাটিতে অমন আনাড়ি জানোয়ার বোধহয় নেই৷ যখন আপন মনে থাকে, দু হাত বাঁকিয়ে উপর দিকে তুলে, হেলে-দুলে এমন মজা করে চলে যে হাসি রাখা যায় না৷ তখন দেখতে পেলে তোমরা বলবে, ‘কী আনাড়ি অকর্মা জানোয়ার হাঁটতেও পারে না৷’
আবার ওই জানোয়ারটিকে গাছের উপরে দেখো, সে এক অদ্ভুত ব্যাপার! দলে-দলে গাছে বসে চিৎকার করতে থাকে, পালের গোদা উপরে বসে হাঁকে— ‘হুঁ-কু’, আর অমনি নীচের ডাল থেকে কুড়ি-পঁচিশটা জোয়ান একসঙ্গে সুর ভাঁজে, ‘হুঁকু, হু-উ-ক৷’ থামতে-না-থামতে সর্দারমশায় আবার হাঁকলেন, ‘হুঁ-কু’— অমনি আবার সুর উঠল ‘হুঁকু, হুঁকু, হুঁ-উ-কু’, মিনিটের পর মিনিট ওই রকম চলবে৷
একটু শব্দ করো বা গাছপালা কিছু নাড়ো, আর অমনি এ-গাছ থেকে ও-গাছ, ও-গাছ থেকে সে-গাছ এমনি করে লাফিয়ে দু-তিন মিনিটের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল৷ আর সে কী লাফ! কুড়ি-পঁচিশ-ত্রিশ ফুট অম্লানবদনে পার হয়ে যায়৷ পঁচিশ-ত্রিশ ফুট উপর থেকে লাফিয়ে ঝপাং করে ঢালুর নীচের গাছে পড়বে, হাত-পায়ের যা সামনে পাবে একটা-না-একটা ডাল ধরে দোল খাবে আর ওই দোলের সঙ্গে-সঙ্গে লাফিয়ে আরও পঁচিশ-ত্রিশ ফুট নীচে অন্য গাছে, আবার অন্য গাছে৷ দেখতে-না-দেখতে কোথায় চলে গেল৷ বন নিস্তব্ধ হয়ে গেল৷
লুশাই পাহাড়ে কাজ করবার সময় এর একটা বাচচা খুঁজেছিলাম৷ একটা বাচচা এনে দিতে পারলে গ্রামের লোকদের দশ টাকা বকশিশ দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছিলাম৷ লুশাইরা বলেছিল, ‘মাকে মেরে বাচচা ধরে দিতে পারি৷’ আমি অবশ্য রাজি হয়নি৷ পোষা জন্তু হিসেবে ওরা ভারি মজার হয়৷
বাচচার কথায় মনে পড়ল৷ একদিন কাজ করে তাঁবুতে ফিরে হাত-পা ধুয়ে চা খেতে বসেছি, শুনতে পেলাম যেন কেউ কাঁদছে৷ টিন্ডেলকে ডেকে জিগগেস করলাম, ‘কে কাঁদছে?’ আমার সন্দেহ হয়েছিল বুঝি বা আমার লোকেরা গ্রামের লোকদের উপর কোনোরকম অত্যাচার করেছে৷
টিন্ডেল বলল, ‘হুজুর, হল্লুমান রোতা হ্যায়৷’
‘হনুমান কাঁদছে, মানে?’
তখন শুনলাম হাতির মাহুতরা একটা হনুমানের বাচচা জঙ্গল থেকে ধরে এনেছে, তার মা বেচারা গাছে-গাছে লাফিয়ে, জঙ্গল থেকে তাদের পিছনে-পিছনে তাঁবু পর্যন্ত এসেছে আর সেই চারটে থেকে গাছে বসে কাঁদছে৷ পরে তার বাবাও এসেছে৷
তাঁবু গ্রাম থেকে একটু দূরে জঙ্গলের কিনারায়৷ তাঁবুতে আমার চাপরাশি রামাবতার ছিল, অযোধ্যার ব্রাহ্মণ, তাকে ডেকে জিগগেস করলাম, ‘তুমি হিন্দু, ব্রাহ্মণ, আর তোমার সামনে হনুমানের বাচচা ধরে এনেছে, আর তুমি কিছু বললে না?’
‘হুজুর, এই মাহুতরা জানোয়ার, আমার কথা শোনে না, কত বলেছি, কিছুতেই ছাড়ে না, বলে বহুৎ জঙ্গল থেকে ধরে এনেছে৷’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা, আমি হুকুম দিচ্ছি তুমি গিয়ে বাচচাটাকে ওই গাছের ডালে বসিয়ে দিয়ে এসো৷ দেখো তো ওর মা কেমন করে কাঁদছে! আমার দুঃখ হচ্ছে, আর তুমি রামের দেশের লোক, তোমার দরদ হচ্ছে না?’
হুকুম পেয়ে বুড়োর গোঁফ ফুলে উঠল, সে তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে মাহুতদের ডেরা থেকে ছানাটিকে নিয়ে এল, আর তাকে ওই গাছের নীচের ডালের উপর বসিয়ে চলে এল৷
তার মা উপরের ডালে বসে-বসে রামাবতারের কাজ লক্ষ্য করছিল, তার কান্না থেমে গিয়েছিল৷ বাচচাটিকে গাছের ডালে বসিয়ে দিয়ে চাপরাশি চলে এলে পর তার মা ধীরে-ধীরে নামতে আরম্ভ করল, দু-চার পা নামে আবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নেয়৷ শেষে যখন বাচচাটার কাছে পৌঁছল, প্রথম তাকে ভালো করে শুঁকে দেখল, তারপর তাকে বুকে তুলে নিল আর তড়াক-তড়াক করে লাফিয়ে উপরে উঠে গেল৷ সেখানে মা-বাবা দুজনে কত রকমে যে বাচচাটাকে আদর করল তার আর কী বলব! তারপর তাকে নিয়ে তারা লাফাতে-লাফাতে গভীর বনে চলে গেল৷
.
এ-বছর আমাকে নাগা পাহাড়ে যেতে হয়েছিল৷ যে জায়গায় আমার কাজ ছিল সেটা নাগা হিলস জেলার বাইরে, জংলি নাগাদের এলাকায়৷ সঙ্গে সিপাই-সান্ত্রী না নিয়ে এ এলাকায় প্রবেশ করবার হুকুম নেই৷ সাদিয়া থেকে দশজন সিপাই আমাদের সঙ্গে গিয়েছিল৷ আমরা মার্গারিটা থেকে নৌকোয় চড়ে বুড়িডিহিং নদী দিয়ে ওই নাগা সীমানা পর্যন্ত গিয়েছিলাম৷ বুড়িডিহিং নদী আর অন্য একটি নদীর দোমোহনায় তাঁবু ফেলা হয়েছিল৷ সাত-আটজন সিপাই সঙ্গে নিয়ে খালাসিরা পাঁচ-ছয়দিন আগেই চলে গিয়েছিল— জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করবার জন্য৷ আমরা চারদিন পরে এসে দোমোহনায় তাঁবু ফেলেছিলাম৷ প্রথম যেদিন সে জায়গায় পৌঁছলাম সেদিন রাত্রে বড়ো তামাশা হয়েছিল৷
ওই দোমোহনার অপর পারে ডিহিং রিজার্ভ ফরেস্ট৷ দু বছর আগে আমাদের আপিসের মিস্টার নি- ওই রিজার্ভ ফরেস্ট-এ কাজ করেছিলেন৷ তিনি আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে ওই রিজার্ভ ফরেস্ট-এ দুটো পাগলা হাতি আছে, মাফুন-এর ডেপুটি রেঞ্জারও বারবার সে কথা বলে দিয়েছিলেন৷
আমার সঙ্গে মিস্টার বা- নামে একজন নতুন অফিসার দূরবিনের কাজ শিখতে গিয়েছিলেন৷ যাতায়াতের কষ্ট, নৌকো ছোটো, সেজন্য আমরা একটিমাত্র তাঁবু নিয়ে গিয়েছি, দু-জনে একই তাঁবুতে থাকব৷ দু-পাশে দুখানা খাটিয়া, মাঝখানে একটি ছোটো টেবিল— লেখাপড়া, খাওয়া-দাওয়া সব ওই টেবিলেই সারতে হয়৷
পাগলা হাতির ভয়, রাত্রে বড়ো ধুনি জ্বালাবার বন্দোবস্ত করেছি, আর খালাসিদের ভালো করে পাহারা দেবার জন্য হুকুম দিয়েছি, যেন ধুনি নিভে না যায়৷ বুনো জানোয়ার আগুনকে বড়োই ভয় পায়৷
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে শুয়েছি৷ টেবিলটার উপর দু-জনের দুটো বন্দুক আর বালিশের নীচে কার্তুজ রেখেছি৷ সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি৷
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি তা বলতে পারি না, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল৷ মনে হচ্ছিল যেন একটা বড়ো জানোয়ার নড়ছে৷ কান পেতে শুনতে লাগলাম, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম একটা খুব বড়ো জানোয়ার ধীরে-ধীরে তাঁবুর দিকে আসছে৷ খসখস আওয়াজ মাঝে-মাঝে কানে আসছিল৷
খেতে বসে মিস্টার বা- বলেছিলেন যদি রাত্রে হাতি বা অন্য কোনো জানোয়ার আসে তাহলে তাঁকে যেন ডেকে তোলা হয়৷ আমি আস্তে-আস্তে বললাম, ‘বা- হাতি এসেছে, ওঠো৷’
‘কোথায় হাতি?’
‘ওই শোনো খসখস শব্দ—’
সে জায়গায় চারদিকে জঙ্গল, গাছের ডালপালার সঙ্গে জানোয়ারের শরীরের ঘষা লাগার শব্দ ওটা৷
মিস্টার বা- আর ওঠবার নাম করেন না, শুধু বলেন, ‘না, না, আপনি ভুল শুনেছেন, আমি তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না৷’
এমন সময় মট করে শুকনো ডাল ভাঙবার শব্দ হল, যেন জানোয়ারের পায়ের চাপে শুকনো ডাল ভাঙল৷ বললাম, ‘ওই শোনো৷ শিগগির ওঠো, এক্ষুনি বেরোলো বলে, উঠে দুটো ফায়ার করো৷’
বাইরে জ্যোৎস্না, যদিও আকাশে দু-চার টুকরো মেঘ ছিল৷
মিস্টার বা- নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে উঠলেন, তাঁবুর দরজা একটু ফাঁক করে বললেন, ‘কই, কিছু দেখছি না তো৷’
‘আরে বন্দুক ছোঁড়ো-না৷’
ওই তাঁবুর দরজার ফাঁক দিয়ে বন্দুকের নল বের করে দিয়ে গুড়ুম গুড়ুম দুবার ফায়ার করলেন, অমনি তাঁবুর খুব কাছ থেকে মড়-মড় শব্দে ডাল ভেঙে দে দৌড়— হাতি!
আমি বললাম, ‘শুনলে?’
মিস্টার বা- বললেন, ‘দেখতে তো পেলাম না কিছু৷’
তিনি কিন্তু তখনও তাঁবুর দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, এক পা-ও বাইরে যাননি৷
খালাসিরা সব ঘুমিয়ে পড়েছিল, ধুনিও নিভে গিয়েছিল৷ বন্দুকের আওয়াজ শুনে সকলেই উঠেছে৷ ‘ব্যাপার কী?’
‘হতভাগারা, এক্ষুনি যে হাতিতে মাড়িয়ে সকলকে চ্যাপ্টা করে দিত৷ পাহারাওয়ালারা গেল কোথায়?’
‘হুজুর, বহুৎ থক গিয়া থা নিঁদ আ গিয়া৷’
কী করা যায়, কথাটা অতি সত্যি৷ সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর ঘুমিয়ে পড়া স্বাভাবিক৷ যাক, ধুনি ঠিক করে, পাহারাওয়ালাদের ভয় দেখিয়ে, আবার শুয়ে পড়লাম আর তখুনি ঘুমিয়ে পড়লাম৷
আবার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল৷ আবার মনের ভিতর সেই ভাব হচ্ছিল যে জানোয়ার এসে আমাদের দেখছে৷ কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম, আবার সেই ভারী জানোয়ার চলবার আওয়াজ, আবার সেই খসখস শব্দ৷ জানোয়ারটা খুব সাবধানে পা টিপে-টিপে চলছে৷ মিস্টার বা- কে ডাকলাম, ‘ওঠো৷’
‘কেন?’
‘ওঠো, আবার হাতি এসেছে৷’
আর তাঁর সাড়া নেই, কত ডাকলাম, কোনো জবাব নেই৷ হাত বাড়িয়ে পা ধরে টানলাম, কিন্তু ভীষণ ঘুম! নড়লেনও না, ঠিক যেন কুম্ভকর্ণ ঘুমোচ্ছেন৷
বন্দুক তুলে নিয়ে, কার্তুজ ভরে ধীরে-ধীরে বাইরে এলাম৷ পাহারাওয়ালা ঘুমে অচৈতন্য, ধুনি আবার নিভে গেছে৷ ধুনির কাছেই যেন প্রকাণ্ড ছায়ার মতো কালো একটা কী দাঁড়িয়ে আছে, একেবারে জঙ্গলের কিনারায়৷ ধীরে-ধীরে ধুনির কাছে এলাম— সামনেই প্রকাণ্ড হাতি! নিশ্চল দাঁড়িয়ে খালাসিদের তিরপলটা লক্ষ্য করছে৷ খালাসিরা তাঁবু আনেনি, তিরপল খাটিয়ে শুয়েছে, হাতিটা আট-দশ ফুট দূরেও হবে না৷
হাতির শুঁড়ের নীচেই গুড়ুম-গুড়ুম শব্দে দুবার বন্দুকের আওয়াজ করে দিলাম, আর ক্যাঁ-ক্যাঁ শব্দে চিৎকার করে, লাট্টুর মতো ঘুরে একদৌড়ে একেবারে জঙ্গলে৷ আমি কিন্তু তার পিছন-পিছন আরও দুটো ফায়ার করেছিলাম৷
একে তো কানের কাছে বন্দুকের আওয়াজ, তার উপর আবার সঙ্গে সঙ্গে হাতির চিৎকার শুনে সব লোক চেঁচামেচি করে উঠল, মিস্টার বা-ও তখন ‘কী? কী?’ বলে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন৷ দু-জন সিপাই, তাদের তাঁবু একটু দূরে ছিল, তারাও ‘কেয়া হুয়া?’ বলতে-বলতে ছুটে এল৷ সকল কথা শুনে তারা বললে, ‘হ্যাঁ, এই বদমাস রোজ রাত্রে এখান দিয়েই নদী পার হয়৷
মিস্টার বা- দুঃখ করতে লাগলেন, ‘আমাকে ডাকলেন না কেন?’
ভালো! পা ধরে টেনে খাটিয়া থেকে প্রায় ফেলে দিয়েছিলাম, তবুও কিনা ভদ্রলোক বলেন— আমাকে ডাকলেন না?
তিনি বললেন, ‘আমি তো কিছুই টের পাইনি, কখন ডাকলেন, কখনই বা পা ধরে টানলেন৷’
হাতিটা সে রাত্রে আমাদের তাঁবুর দিকে আর আসেনি৷ এরপর আমরা দু-তিন রাত সেইখানে ছিলাম, কিন্তু ওদিক দিয়ে আর সে নদী পার হয়নি৷
মিস্টার বা-কে আমি অনেকদিন পর্যন্ত ওই হাতির কথা বলে তামাশা করেছি৷ নতুন লোকের প্রথম-প্রথম জঙ্গলে এসে ওইরকম হওয়াটা কিছু আশ্চর্যের কথা নয়৷
.
পচা হাতির গন্ধের কথা আগে এক জায়গায় বলেছি, সেটা শোনা কথা, আমার সার্ভেয়ারের অভিজ্ঞতা৷ এ সম্বন্ধে আমার যা অভিজ্ঞতা আছে, তা মনে হলে এখনও অন্নপ্রাশনের ভাত উল্টে আসে৷
দীঘাতরং বড়ো চা বাগিচা৷ ম্যানেজার সাহেব হাতির খেদার ঠিকা নিয়েছেন, সরকারি রিজার্ভ ফরেস্ট-এ তিনি হাতি ধরবেন৷ আমাদের সার্ভেয়াররা ওই রিজার্ভ ফরেস্ট-এ জরিপ করেছিল, তাদের গোলমালে সব হাতি পালিয়ে যাবে, ধরতে পারবেন না৷ সেইজন্য আমার সঙ্গে বন্দোবস্ত হল, যে জায়গায় তিনি খেদার জোগাড়যন্ত্র করেছিলেন, তার আশেপাশে পাঁচ-ছয় মাইলের মধ্যে মার্চ মাসের আগে আমাদের লোকজন প্রবেশ করবে না৷ মার্চের শেষ ভাগে আমি আমার সার্ভেয়ারের কাজ পরিদর্শন করতে গেলাম৷
সন্ধ্যার সময় সার্ভেয়ারের সঙ্গে পরামর্শ করছিলাম, সকালে উঠে কোনদিকে কাজ দেখতে যাব৷ আমি তার নকশার উপর একটা দিক দেখিয়ে বললাম, ‘এইদিক দিয়ে যাব আর ওইদিক দিয়ে সন্ধ্যার সময় ফিরব, তা সম্ভব?’
সার্ভেয়ার একটু চিন্তা করে বলল, ‘হাঁ, হো সকতা৷ লেকিন ইস জগগা পর থোড়া মুশকিল হ্যায়৷’
‘কেয়া মুশকিল?’
‘খেদা কো একঠো হাথি মর গয়া থা, থোড়া বদবো হ্যায়৷’
খেদাতে যে সব হাতি ধরেছিল তার মধ্যে একটাকে বেঁধে ‘কোট’-এর (স্টকেড—এর) ভিতর থেকে বের করে আনবার সময় টানা-হেঁচড়া ধস্তাধস্তিতে চোট পেয়েছিল, আর কদিন পর মরে গিয়েছিল৷ তার মৃতদেহটা ওই জায়গায় ফেলে গিয়েছিল, পচে দুর্গন্ধ হয়েছে৷
আমি বললাম ওইটুকু জায়গা বই তো নয়, নিশ্বাস বন্ধ করে দৌড়ে পার হয়ে যাব৷
কাজে বের হলাম, যাবার সময় বিশেষ কিছুই বুঝতে পারলাম না৷ বিকেলে তাঁবুতে ফিরে আসবার সময় হঠাৎ সাঁই-সাঁই শব্দে চল্লিশ-পঞ্চাশটা শকুন উড়ল, হাজার-হাজার মাছির ভনভন আওয়াজ কানে এল, একটা উৎকট দুর্গন্ধও নাকে এল— অমনি আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে দৌড়লাম৷ শকুনের ঝাঁক পার হলাম, মাছির ভনভনানি আর কানে আসছে না, এদিকে আবার দম আটকিয়ে মরবার উপক্রম, নিশ্চয়ই এতক্ষণে বিপদ কেটে গেছে৷ নিশ্বাস ফেললাম, প্রাণ বাঁচল বটে কিন্তু ওরে বাবা! কী বিটকেল দুর্গন্ধ! ওয়াক! ওয়াক! শুধু বমি!
যার নাকে এ গন্ধ ঢোকেনি সে লোক ধারণাই করতে পারবে না যে সে কেমন গন্ধ৷ প্রাণপণে দৌড়, আর ওয়াক! ওয়াক! আবার বমি আবার দৌড়৷ ফুসফুস ফেটে যাবার উপক্রম হয়েছে নিশ্বাস ফেল একটু, আর ওয়াক! ওয়াক!! ওয়াক!!!
বাবা! এ যেন একেবারে নাকের স্নায়ুতে-স্নায়ুতে, ফুসফুসের অলিগলিতে এই ভীষণ পচা গন্ধ ভরে দিয়েছে৷
সঙ্গের হাজারিবাগের খালাসি যারা ছিল তাদেরও প্রায় ওই অবস্থা৷
সার্ভেয়ার জাফর হুশেন ব্রহ্মপুত্র নদের কিনারায় কাজ করছিল৷ পূর্বোক্ত রিজার্ভ ফরেস্ট-এর অর্থাৎ গভর্নমেন্টের খাস জঙ্গলের সীমানা থেকে আরম্ভ করে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তার কাজ৷ জঙ্গল খারাপ তাতে আবার জানোয়ারের ভয় বেশি, কাজেই তিন-চারজন লোক তাকে বেশি দেওয়া হয়েছে৷ সার্ভেয়ার কাজে বের হয়ে গেছে, দুজন খালাসি আড্ডায় রয়েছে, রান্নাবান্না করবে জিনিসপত্র সামলাবে৷ জানোয়ারের ভয় আছে, বাঘ আছে, আড্ডায় একজন লোক রেখে যাওয়া নিরাপদ নয়৷ দু-একদিন বাঘ দেখেছে, ডাক তো রোজই শুনতে পায়৷
লম্বা একটা লতা-পাতার ঘর তৈরি করেছে, তার সামনের দিকটা খোলা, সেইদিকে ধুনি জ্বালানো হয়৷ একজন খালাসি ধুনি আর রান্নার কাঠ সংগ্রহ করছে, অন্য লোকটি নদীতে বাসন ধুতে গেছে— নদীটা ছোটো, মাত্র এক ফুট জল৷ হঠাৎ ছপছপ শব্দ এল তার কানে, মুখ তুলে দেখল এই বড়ো বাঘ নদী পার হচ্ছে, মাত্র পাঁচ-সাত চেন দূরে, (এক চেন বাইশ গজ)৷ সে চুপিচুপি উঠে, দৌড়ে আড্ডায় এল, এক নম্বর খালাসি তখন সবে এক বোঝা কাঠ মাথায় করে এনে দাঁড়িয়েছে৷ দু নম্বর খালাসি এসেই বলল, ‘জলদি ভাগ, শের আতা হ্যায়৷’
দু-জনে ছুটে গিয়ে গাছে উঠে পাতার আড়ালে আশ্রয় নিল৷ তারা গাছে চড়ে বসবার দু-তিন মিনিটের মধ্যেই হেলতে-দুলতে কর্তা এসে হাজির হলেন, সোজা ওই নদীর ঘাটে৷ কোথাও কেউ নেই৷ এইমাত্র নদীর অন্য পার থেকে ‘ভোজ’ দেখতে পেয়েছিল, এরই মধ্যে গেল কোথায়? ‘হিঁয়াও!’
দুই লাফে উপরে উঠে এল, বাসনগুলি শুঁকে দেখল, কাঠের বোঝাটা শুঁকল, আহা কী চমৎকার গন্ধ! কিন্তু, গেল কোথায়? ‘হিঁয়াও!’ ওই ঘরটার দিকে গেল, রান্নার জায়গার চারপাশ ঘুরে দেখল, বিছানাপত্র সব জড়ানো ছিল উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে সেগুলো দেখল, আবার শুঁকে দেখল৷ তাজা গন্ধ সর্বত্র, কিন্তু গেল কোথায়? আবার ‘হিঁয়াও!’ বুঝতেই পারছ, বেচারার জিভ দিয়ে কেমন জল পড়ছিল! খাদ্যের অমন সুগন্ধ, আগের মুহূর্তে আবার তা নিজের চোখে দেখেছে, আর কিনা ভোজনে বসতে-না-বসতেই কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল? এতে মনে দুঃখ তো হবারই কথা, কাজেই— ‘হিঁয়াও!’
বাঘটা অনেকক্ষণ সেই আড্ডায় বসেছিল, পায়চারি করেছিল, তারপর যখন বিকেলবেলা সার্ভেয়ার কাজ থেকে ফিরে আসছিল আর তার লোকজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল, তখন চলে গেল৷
সার্ভেয়ার আর তার লোকজনদের দেখেই ওই লোক দুটি গাছের উপর থেকে চেঁচিয়ে তাদের সাবধান করে দিলে যে আড্ডায় বাঘ বসে আছে, তারা তা শুনে চিৎকার আরম্ভ করল, তবে হতভাগা গেল৷
সার্ভেয়ার তাঁবুতে পৌঁছল তবে এরা গাছ থেকে নেমে এল৷
পরের দিন আমি সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে গিয়ে তার আড্ডায় ঘরের সামনে, উনুনের চারদিকে, বাঘের পাঞ্জা দেখেছিলাম৷ এই বাঘটা দু-জন লোক খেয়েছিল, কাঠুরেরা সার্ভেয়ারকে বিশেষ সাবধান করে দিয়েছিল৷
.