৩
১৯০০-১৯০১৷ আগের বছর যেসব জায়গায় কাজ করেছিলাম তার ঠিক দক্ষিণেই এবারও কাজ করতে গিয়েছিলাম৷ সেই দীর্ঘ পথ, কুড়ি-একুশ দিনের রাস্তা পার হয়ে পৌঁছলাম৷ এবার সেয়ানা হয়েছি, দশদিনের পথ হেঁটে এসে ঘোড়া কিনে নিয়েছিলাম৷
৩৫০-৪০০ বর্গমাইলের মধ্যে আর লোকজনের বসতি নেই, খালি পাহাড় আর জঙ্গল৷ পথঘাট নেই, আছে খালি বুনো মহিষ, বাঘ, ভাল্লুক— এইসব৷ বুনো মহিষের পথ ধরে আমরা পাহাড় ওঠা-নামা করি৷ খচচর চলে না তাই দূর গ্রাম থেকে কুলি সঙ্গে এনেছি, জঙ্গল কাটবে আবার মোটও বইবে৷ সারাদিন এক হাঁটু জলে, নালায়-নালায় চলে, ক্লান্ত হয়ে, বেলা চারটের সময় দুটি নালার দোমোহনায় অর্থাৎ সঙ্গমস্থলে এসে আড্ডা করলাম৷ আমি আর সেই বুড়ো সার্ভেয়ার, সঙ্গে সাত-আটজন হাজারিবাগের লোক আর চার-পাঁচটি শান৷ সেই গ্রামের প্রধানের ছেলে বন্দুক নিয়ে সঙ্গে এসেছে৷ জঙ্গল কেটে, তাঁবু খাটাতেই প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল৷
সকলে নানা কাজে ব্যস্ত, আমি আর বুড়ো রামশবদবাবু সবে প্রধানের ছেলেকে জিগগেস করেছি যে সেই বনে কী-কী শিকার পাওয়া যায়, এমন সময়ে নালার ওপারে পাহাড়ের উপরে একটা কী রকম কোঁকানো গোছের আওয়াজ হল, যেন কেউ খুব ব্যথা পেয়ে কোঁকাচ্ছে৷ শুনেই তো আমরা লাফিয়ে উঠেছি, আর প্রধানের ছেলে, ‘বাঘে হরিণ ধরেছে’ বলে বন্দুক হাতে সেইদিকে ছুটল৷
তার পিছন-পিছন আমি আর বুড়ো সার্ভেয়ার, আর তিন-চারজন লোকও দৌড়ে চললাম৷ একজনের হাতে একটা তলোয়ার ছিল, আমি সেটা হাতে তুলে নিয়ে, হাত বাড়িয়ে তলোয়ারটা ঘুরিয়ে, সকলকে সাবধান করে দিলাম, ‘তোমরা এর ভিতর এস না— যদি লোক খায়৷’
প্রধানের ছেলে আমাদের আর এগোতে মানা করেছিল, কাজেই আমরা নালার কিনারায় বসে রইলাম৷ এমন সময়ে সে ভারি ব্যস্ত হয়ে বন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের ডাকতে লাগল— এত ব্যস্ত যে তার মাথার পাগড়ি কোথায় যে ফেলে এসেছে সে হুঁশ ছিল না৷ অমনি আমরা চার-পাঁচজনে সেইদিকে ছুটে চললাম, আর তিন-চারজন অন্য দিক দিয়ে ঘুরে চলল৷ রামশবদবাবু সেখানেই বসে রইল, বুড়োমানুষ— আটান্ন বছর বয়স, সন্ধ্যার সময় আর কোথায় যাবে?
আমরা ছুটে পাহাড়ে চড়তে লাগলাম৷ সকলের আগে প্রধানের ছেলে, তার পিছনে আমি, আর আমার পিছনে তিন-চারজন লোক৷ খানিক উঠলাম, তারপর একটা নালা, তার ওপারে যাবার উপায় নেই একেবারে দেয়ালের মতো খাড়া৷ আমি প্রধানের ছেলের কোমর ধরে যেমনি তাকে ঠেলে উপরে তুলে দিতে গিয়েছি, অমনি ঠিক আমাদের মাথার উপরে একটা বাঁশঝাড়ের পিছন থেকে গুড়-গুড় করে একটা আওয়াজ হল৷ আমরা তো তাড়াতাড়ি পিছন হটে এলাম, কিন্তু সঙ্গের লোক কয়টি ছুটে পালাতে গিয়ে জড়াজড়ি করে নালার ভিতরে পড়ে গেল৷
জানোয়ারের দস্তুর এই যে তাকে দেখে যে পালাবে, সে তাকেই ধরবে৷ কাজেই তখন কী আর করি? তলোয়ার বাগিয়ে তাদের বললাম, ‘যদি পালাবি, তো কেটেই ফেলব৷’ বেচারারা সেখানেই দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল৷ দাঁড়িয়েছে তলোয়ারের ভয়ে, আর কাঁপছে বাঘের ভয়ে৷
এমন সময়ে, অন্য দিক দিয়ে যে তিন-চারজন লোক গিয়েছিল, তারা ‘‘পাকড়া! পাকড়া!’’ বলে চিৎকার করে উঠল৷ শুনে আমার যা ভয় হল, ভাবলাম বুঝি বা কাউকে বাঘে ধরেছে৷ আমরা প্রাণপণে সেইদিকে ছুটলাম৷ গিয়ে দেখি, বাঘে তাদের পাকড়ায়নি, তারা পাকড়িয়েছে হরিণ! পাকড়িয়েই বেচারার গলায় গোটা তলোয়ারের দুই-তিন কোপ মেরেছে, আবার তার উপর চড়ে বসেছে৷ প্রকাণ্ড হরিণ, সেটা তখনও মরেনি৷
আমি জিগগেস করলাম, ‘বাঘ কোথায়?’
তারা উত্তর দিল, ‘বাঘ আবার কীসের? চারটে বুনো কুকুর ছিল, আমাদের দেখেই পালিয়েছে৷’
এই কুকুরগুলোই আমাদের দেখে গুড়-গুড় করেছিল৷ বুনো কুকুর বড়ো নিষ্ঠুর জানোয়ার৷ সকলের আগে ওই জীবন্ত হরিণটার চোখ দুটি কামড়ে নিয়েছিল৷ বেচারা অন্ধ হয়ে আর গুঁতোতেও পারেনি, পালাতেও পারেনি, কাজেই তারা সুবিধা পেয়ে তার পিছন থেকে মাংস ছিঁড়ে খেতে আরম্ভ করেছিল৷ এমনি করে প্রায় দু-তিন সের মাংস খেয়ে ফেলেছিল৷
যারা ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে জড়াজড়ি করে নালায় পড়ে গিয়েছিল, এর পর সকলে মিলে তাদের কী রকম জ্বালাতন করত, সেটা আর কী বলব৷ এর অর্থ এ নয় যে অপর সকলেই খুব সাহসী পুরুষ৷ তারা সেখানে উপস্থিত থাকলে হয়তো তারা সকলেই ছুটে পালাত৷ এই কথার প্রমাণ আরও অনেকবার পেয়েছি৷
এই জঙ্গলেই অন্য এক পাহাড়ে বুড়ো সার্ভেয়ারের তাঁবু পড়েছে৷ বেণী এখন বাবুর রান্না করে, তাকে তাঁবুতে রেখে, সুচিৎ আর অন্য লোকজন সঙ্গে নিয়ে বুড়ো কাজে গিয়েছে৷ সমস্তদিন খেটে-খুটে, সন্ধ্যার সময় তাঁবুতে ফিরে আসছে, আর মনে-মনে জল্পনা করছে— তাঁবুতে এসেই ভাত তৈরি পাবে, আর হাত-পা ধুয়ে খেয়েই দিব্যি ঘুম দেবে!
তাঁবুতে পৌঁছেই দেখে বেণী তাঁবুতে নেই, রান্না করবে কে? এদিক-ওদিক চারদিক খুঁজে, তাদের বড়ো ভাবনা হল— বুঝি বেণীকে বাঘে নিয়ে গেছে! সঙ্গের শান কুলিরা কিন্তু সকল দিক ভালো করে দেখে বলল যে বাঘ ওখানে আসেনি, বাঘের কোনো চিহ্নই নেই৷
তখন সকলে চিৎকার করে বেণীকে ডাকতে লাগল৷ অনেক ডাকাডাকির পর, খানিক দূর থেকে ভাঙা গলায় উত্তর এল, ‘আমি এখানে৷’ সকলে আলো হাতে সেইদিকে ছুটল৷ সেদিকেও তাকে দেখতে না পেয়ে, আবার ডাকতে আরম্ভ করল৷ তখন গাছের উপর থেকে বেণী বলল, ‘আমি গাছে, নামতে পারছি না৷’
তার কথা শুনে শানরা তাড়াতাড়ি গাছে চড়ে দেখে বেণী তার পাগড়ি খুলে নিজেকে সেই পাগড়ি দিয়ে, গাছের ডালের সঙ্গে বেশ করে বেঁধে বসে রয়েছে৷ বাঁধন খুলে তাকে সেই গাছ থেকে নামিয়ে আনা হল৷ বেচারা অনেক কষ্টে গাছে উঠেছিল৷ গায়ের অনেক জায়গা ছিঁড়ে গিয়েছে, কাঁটার খোঁচা, আঁচড়ও নিতান্ত কম পায়নি৷ সকলে জিগগেস করল, ‘তোর এ দশা কী করে হল রে?’
বড়ো-বড়ো চোখ করে বেণী বলল, ‘বা-আ-ঘ এসেছিল৷ নালার ধারে এসে এমন গড়গড়িয়ে উঠল যে আমি ছুটে চলে এলাম, তাতেই গা ছড়ে গেছে আর কাঁটার খোঁচা লেগেছে৷ বাঘটা আবার ডাকতে-ডাকতে উপরে উঠে আসতে লাগল, কাজেই আমিও গাছে উঠে গেলাম৷ কী করে যে উঠলাম জানি না, আর কখখনো গাছে উঠিনি৷ উঠেই পাগড়ি খুলে ডালের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে বেঁধে নিয়েছিলাম, তারপর শীতে হাত-পা অবশ হয়ে গেছে, নামতে গিয়ে আর নামতে পারি না৷’
শানরা কিন্তু বলল, ‘বাঘ এসেছিল আর তার পায়ের দাগ নেই কোথাও, তা কি হতে পারে?’
বেণী ভারি চটে উঠল, ‘বেটাদের চোখ নেই তাই বলছে বাঘ আসেনি৷ রাত্রে এসে যখন ধরবে, তখন বুঝতে পারবে৷’
বলতে-বলতেই নিচে নালার ধারে গমগম করে একটা শব্দ হল৷ আর বেণীও অমনি লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ওই শোনো, বাঘ এসেছে কি না৷’
শুনে তো সকলে হেসে গড়াগড়ি, সেটা ছিল একটা হরিণ, বার্কিং ডিয়ার৷
আমাকে যখন বুড়ো সকল কথা বলল, আমি বেণীকে ডেকে জিগগেস করলাম, ‘বেণী, তুমি পশ্চিমের লোক হয়ে, একটা হরিণের ডাক শুনে অমন করলে?’
বেণী বলল, ‘হুজুর, দিনের বেলা ওটা বাঘই ছিল৷ রাত্রে আমার ভুল হয়েছিল৷ তখন মেজাজটা ঠিক ছিল না, তাই বুঝতে পারিনি৷’
সে যেমনই হোক, বেণীকে বাঘের কথা নিয়ে সকলে মিলে কী রকম খেপিয়েছিল, তা বোধহয় আমি বুঝিয়ে না দিলেও চলবে৷
.
আমার সঙ্গে শিবদয়াল নামে একজন খালাসি ছিল, সে নতুন লোক আর ছেলেমানুষ৷ এবার আমার কাজে অনেক উঁচু-উঁচু পাহাড় ছিল, বিশেষত একটা পাহাড়— চারদিক থেকে দেখা যায়, সকল পাহাড়ের উপর মাথা তুলে রয়েছে৷ সকলেই দেখে আর জিগগেস করে, ‘হুজুর, উয়ো কালা পাহাড় দেখ পড়তা হ্যায়, উয়ো ভি হমলোগকা কাম মে হ্যায়?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়৷ ওটাও আমাদের কাজের মধ্যে৷’
‘বাপ, কৈশা চড়েঙ্গে উসপর?’ ইত্যাদি টীকা-টিপ্পনী চলেছে কতদিন ধরে৷
তারপর সত্যি-সত্যিই ওই ‘কালা’ পাহাড় চড়বার দিন এল৷ খালাসি কুলি ইত্যাদি নিয়ে ভোরে কাজে বের হলাম, জঙ্গল কাটতে হবে৷ সঙ্গে দেখি শিবদয়াল নেই৷ ‘আরে শিবদয়াল কোথা?’
‘বহুৎ পেটমে দরদ হ্যায়, হুজুর৷ সিধা হোনে নেহি সকতা হুঁ৷’
তাকে তাঁবুতে রেখে গেলাম৷ সন্ধ্যার সময় যখন তাঁবুতে ফিরে এলাম, তখন আমার চাকর শশী বলল, ‘শিবদয়ালের না পেটে ব্যথা? আপনারা চলে যাবার পরই তো ও দিব্যি রান্না করে খেয়েছে৷ গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছে৷’
‘ডাক বেটাকে৷’ সে এলে তাকে জিগগেস করলাম, ‘কীরে, একি শুনছি?’
‘হুজুর, তোমরা চলে যাবার পর পেট ব্যথা কমে গেল, তখন দুটি চাল সিদ্ধ করে খেয়েছি৷’
বেটা বাঁদর!
কিছু জঙ্গল কাটা বাকি ছিল৷ পরের দিন সকালবেলা কুলিদের সঙ্গে শিবদয়ালকেও পাঠালাম এক রকম জোর করে৷ রাত্রে নাকি তার পেটের ব্যথা আবার বেড়েছিল৷
বিকেলে যখন তাঁবুতে ফিরল, ডেকে জিগগেস করলাম, ‘পেট ব্যথা কেমন?’
‘আরাম হো গয়া হুজুর৷’
অন্য খালাসিরা বলল, ‘হুজুর ওর পেট ব্যথা তো হয়নি৷ পাহাড় দেখে ভয় পেয়ে চড়াই বাঁচাবার জন্য পেট ব্যথার ভান করেছিল৷ আজ চড়তে-চড়তে বলছিল যে আমার খেয়াল ছিল চড়তে-চড়তে পায়ের হাড় ব্যথা হয়ে যাবে, এ তো দেখছি বেশ রাস্তা রয়েছে৷’
বোকা লোক, তার খেয়াল নেই যে অর্ধেকের বেশি রাস্তা আগের দিন ওই গ্রামে আসবার সময় চড়া হয়েছে৷ যে গ্রামে আমরা তাঁবু ফেলেছিলাম, সেটা পাহাড়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চড়াইয়ের উপরে৷ এর পর পাহাড় দেখে আর তার পেটে ব্যথা হয়নি৷
এ বছরের মতো, আমাদের জরিপের কাজ শেষ হয়েছে, সকলে মিলে দেশে ফিরতে আরম্ভ করেছি, সকলেরই ভারি ফুর্তি৷
পথের দুই পাশে ঘোর বন, তারই ভিতর দিয়ে ছোটো নদী এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে, সেই নদীর ধারে-ধারে রাস্তা৷ কখনো বা এপার, কখনো বা ওপার, এমনি করে আমরা চলেছি৷ একটা মোড় ফিরেই তো আমাদের চক্ষুস্থির— হাত ত্রিশেক সামনেই, একেবারে রাস্তার কিনারায়, প্রকাণ্ড দাঁতওয়ালা এক হাতি দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ বুনো হাতি নয়, তার সামনের দু-পায়ে শিকল জড়ানো৷ তবু তার চেহারাটা কেমন-কেমন বোধ হচ্ছিল, হাতিটার সঙ্গে লোকজন নেই৷ বেটা আমাকে আর বুড়ো সার্ভেয়ারকে দেখেই, আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে, দাঁত উঁচিয়ে দাঁড়াল৷
আমাদের সঙ্গে অনেকগুলি লোক, ঘাড়ে বোঝা নিয়ে আমাদের পিছন-পিছন আসছিল৷ তাদের মধ্যে সামনের লোকটি, মোড় ঘুরেই হাতি দেখে ‘আরে বাপরে!’ বলে পিছন ফিরে দে দৌড়৷ আর অমনি বোঝা সুদ্ধ তার পিছনের লোকটির সঙ্গে টক্কর খেল৷ আর টক্করের চোটে বোঝা সুদ্ধ দুজনেই রাস্তার মাঝখানে গড়াগড়ি দিল৷ ততক্ষণে আরও কয়েকজন এসে, মোড় ঘুরে, সামলাতে না পেরে তাদের ঘাড়ে পড়ল৷
একটুক্ষণ বাদে হাতিটা আস্তে-আস্তে নদীর ওপারে গিয়ে একটা বাঁশঝাড়ের পিছনে, আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ তা দেখে আমরাও নালার কিনারায় এলাম, কিন্তু নালা পার হতে আর কারও ভরসা হয় না৷ অনেক বলা-কওয়ার পর এক-একজন করে, কাঁপতে-কাঁপতে, আস্তে-আস্তে হাতিটার সামনাসামনি অবধি যায় আর কোনো প্রকারে হাতিটাকে পার হয়েই প্রাণপণে ছুট দেয়৷ তা দেখে বুড়ো সার্ভেয়ার চটে গিয়ে তাদের বড়োই গালি দেয়, কিন্তু তারপর যখন নিজের পালা এল,তখন অন্য সকলের মতো সেও হাতির সামনাসামনি এসেই চোখ-মুখ বুজে বোঁ করে দৌড় দিল৷ শেষে তাঁবুতে এসে যা হাসির ধুম!
মং কাংজি নামে একজন দোভাষী আমাদের সঙ্গে ছিল, সেই বেচারার উপরেই যত হাসির চোট পড়ল৷ বেচারার অপরাধের মধ্যে সে শান, তার দেশেরই হাতি, তবু সে কেন ভয় পাবে?
মং কাংজির একটু ভয় পাওয়ার অভ্যাস যে ছিল না, সেটা কিন্তু আমি বলতে পারি না৷ আরেকদিনও সে এমনি করে একটা হরিণের ভয়ে ছাতা-টাতা ফেলে চম্পট দিয়েছিল৷
এই হরিণটাকে তিন-চারটে বুনো কুকুরে তাড়িয়ে এনেছিল৷ প্রকাণ্ড সম্বর হরিণ, এই বড়ো তার ডালপালাওয়ালা শিং, যেন মাথায় বাঁশঝাড় গজিয়েছে৷ বেচারা ছুটে-ছুটে এমনি ক্লান্ত হয়েছিল যে আর ছুটতে পারছিল না৷ আমাদের দু-জন লোক তাকে তাড়া করল, সে পাহাড়ের নীচের দিকে, রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে পালাতে লাগল৷ ঠিক সেই পথে, ছাতা মাথায় মং কাংজি আসছিল৷ তারপর যে কী হল, তা আগেই বলেছি৷ সে ভালো করে চেয়েও দেখল না যে কী জানোয়ার আসছে— বাঘ, ভাল্লুক, না হরিণ৷ কাঁইমাই করে চিৎকার করতে-করতে এমন বিকট ভঙ্গিতে দৌড় দিল যে সকলে তা দেখে হেসেই আকুল৷ তখন মং কাংজির লজ্জা হল, সে জানত না যে সে একটা হরিণের ভয়ে এমন করে পালিয়েছিল৷
হরিণটা চলে যাবার একটু পরেই বুনো কুকুরগুলো এসে উপস্থিত হল৷ তারা মাটি শুঁকতে-শুঁকতে আসছিল, আর এমনই আশ্চর্য যে, যে-পথ দিয়ে হরিণটা গিয়েছিল, ঠিক সেই পথ ধরে তারাও চলছিল৷ হঠাৎ আমাদের গন্ধ বা আওয়াজ পেয়ে কুকুরগুলো থমকে দাঁড়াল৷ তারপর মাথা তুলে একটিবার আমাদের দেখতে পেয়ে, আর কি তারা সেখানে থাকে?
আরেকজন সাহসী লোক ছিল— আমির আহম্মদ৷ দেড়শো-দুশো লোক দল বেঁধে বনের পথে চলেছে, আমির আহম্মদ সকলের আগে— তার সাহস কিনা সকলের চেয়ে বেশি৷ জঙ্গলের পথ, জানোয়ারের ভয় সর্বত্রই আছে৷ আমির আহম্মদের চোখ খালি চারদিকে ঘুরছে— কোন পথ দিয়ে বাঘ এসে না তাকে সেলাম করে ফেলে৷ এমন সময় বনের ভিতর একটা কী যেন সড় সড় করে উঠল, লাল মতো একটা কী যেন দেখতে পাওয়া গেল! অমনি আর যায় কোথায়? আমির আহম্মদ প্রাণপণ ছুটতে লাগল, সঙ্গে-সঙ্গে হাত-পা ছুড়ে চেঁচিয়ে সকলকে বলতে লাগল, ‘পালাও, পালাও, শিগগির পালাও! বাঘ আসছে, কিছু আর রাখবে না৷’
সকলে তা শুনে বড়ো ব্যস্ত হল, কিন্তু যখন সেই জানোয়ারটা সত্যি-সত্যিই এল, তখন সবাই দেখল যে ওটা একটা লাল কুকুর৷ এর পর আমির আহম্মদের যা লাঞ্ছনা, সে আর কী বলব!
বনের ভিতর তাঁবু, বাঘের ভয় খুব, বিশেষত রাত্রে, তাই পাহারা রাখতে হয়৷ সে রাত্রে শিবদয়ালের পাহারা ছিল৷ সে তাঁবুর সামনে আগুনের ধুনির কাছে বসে রয়েছে আর ঘোড়া ও খচচরগুলোর উপর নজর রাখছে, পাছে সেগুলোকে বাঘে নিয়ে যায়৷ আগেই বলেছি শিবদয়াল নতুন লোক, এই প্রথম জরিপের কাজে এসেছে৷ বাঘের দেশ হাজারিবাগে তার বাড়ি বটে, কিন্তু বাঘ সে চোখেও দেখেনি, বাঘের ডাকও শোনেনি৷
সকলে ঘুমুচ্ছে৷ নালায় কোলা ব্যাঙ ডেকে উঠল৷ সে যে কী রকম জন্তু, সেকথাও শিবদয়াল জানে না৷ আমি ডেকে বললাম, ‘শিবদয়াল, সাবধান! ও কী ডাকছে শোনো৷’
অমনি সে ভারি ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিল, ‘হুজুর, জরুর শের হোগা৷’ বলেই সে সকলকে ডাকাডাকি করে তুলছে, ‘ওঠো, ওঠো, বাঘ এসেছে! ওই শোনো ডাকছে৷’
তা শুনে একজন খালাসি হাসতে-হাসতে বলল, ‘দূর বোকা! ওটা বুঝি বাঘ? ওটা কচ্ছপ ডাকছে৷’
শিবদয়াল অমনি ছুটে এসে আমাকে বলল, ‘হুজুর, ওটা বাঘ নয়, ওটা কচ্ছপ৷’
এই ঘটনার পরে ব্যাঙ ডাকলেই সকলে মিলে শিবদয়ালকে খেপাতো, ‘শিবদয়াল, তোর বাঘ ডাকছে৷’
নালায় হাতি দেখে মং কাংজি আর অন্যান্য অনেকে ভয় পেয়েছিল বলেছি, কিন্তু সকলের চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিল শঙ্কর খালাসি৷ তাঁবুতে পৌঁছে দেখি শঙ্কর আসেনি— সে আমার খাবার নিয়ে যেত৷ জিগগেস করলাম, ‘শঙ্কর কোথায়?’
‘অভি তক নহি পৌঁছা হুজুর৷’
‘গেল কোথায়?’
দোভাষী বলল, ‘ও হাতি দেখে রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ে উঠে গিয়েছিল, বোধহয় ঘুরে আসছে৷’
প্রায় আধ-ঘণ্টা পরে শঙ্কর এসে হাজির— বিপরীত দিক থেকে৷
‘কঁহা থা রে?’
‘হুজুর দুসরি রাস্তাসে আয়া হুঁ৷’
সকলে জ্বালাতন করতে লাগল, ‘হাতিকে অত ভয়, তাও আবার পোষা হাতি?’
‘হুজুর, ম্যয় আউর কোই জানওয়ারকো নহি ডরতা, লেকিন হাতি বড়া খারাব জানোয়ার হ্যায়৷’
একবার নাকি সে একটা পাগলা হাতিকে একটা লোককে পিষে মেরে ফেলতে দেখেছিল৷ সেই অবধি হাতি দেখলেই তার বড়ো ভয় হয়, সে হাতি জংলিই হোক আর পোষাই হোক৷
.
আমরা কাজ শেষ করে ফিরে চলেছি, তিনদিনের পথ এসেছি, দেখি আমার অপেক্ষায় দুজন চাপরাশি বসে রয়েছে৷
‘সার্ভেয়ার সাদিক হুসেনের কাজ এখনও প্রায় দু-মাসের বাকি৷ গিয়ে দেখো, ও কী করছে, আর সম্ভবপর হলে, কাজ শেষ করে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো’— বড়োসাহেব হুকুম পাঠিয়েছেন৷
সেই গ্রাম থেকে সাদিক হুসেনের কাজের জায়গা তিনদিনের পথ৷ রাস্তায় আর গ্রাম নেই, কাজেই তিনদিনের খোরাক জোগাড় করে চললাম৷ বুড়ো তো মহা খাপ্পা, বলল, ‘কেন বাবু অমন তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করলে? তাই তো এই দুর্ভোগ,’ ইত্যাদি৷
সাদিক হুসেনের কাছে পৌঁছে দেখলাম যে প্রায় আড়াইশো বর্গ মাইলে কাজ তখনও বাকি, এ বছর শেষ করা অসম্ভব৷
বড়োসাহেবকে যথাযথ রিপোর্ট পাঠিয়ে, কাজে লেগে গেলাম৷
দুটো পাহাড়ের কাজ শেষ করে, তৃতীয়টায় এসেছি৷ সমস্ত পাহাড়ে আগুন লেগেছে, চারদিক ধোঁয়ায় ঘেরা, তিন-চার মাইল দূরের পাহাড় পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় না৷ এ পাহাড়টায় জল নেই, তাই বাধ্য হয়ে চার মাইল দূরে, গ্রামে তাঁবু ফেলেছি৷ ভোরে, অন্ধকার থাকতেই কাজে বার হয়েছি৷ বেজায় খাড়া চড়াই, যখন পাহাড়ের কিনারার উপর পৌঁছলাম, তখন একেবারে হাঁপিয়ে পড়েছিলাম৷ দাঁড়িয়ে একটা চীর অর্থাৎ পাইন গাছে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রাম করতে লাগলাম৷ পাহাড়ের অপর দিকটা একেবারে দেয়াল বললেই চলে— এমন খাড়া৷ অনেক জায়গায় গাছপালা তো নেইই, এমনকী ঘাস পর্যন্ত নেই৷ একটা বড়ো পাথর পড়ে ছিল, আমি সেটাকে ধরে, ঠেলে, ওই খাড়া জায়গায় গড়িয়ে দিলাম৷ বাবা! সে এক হুলস্থূল ব্যাপার! হড়হড়, হড়হড়— সে পাথরটা পড়ছে তো পড়ছেই৷ দুটো ছোটো পাইনগাছ ছিল, ওই পাথরের ধাক্কায় একটা মট করে প্যাঁকাটির মতো ভেঙে গেল, আর অন্যটা একেবারে সমূলে উপড়ে, হুড়মুড় করে চলল তার সঙ্গে ওই অতল গর্তে৷
আমি তো তামাশা দেখছি, এদিকে পিছনে বুড়ো রামশবদ তো যায়-যায়৷ ওই দেখে তার মাথা ঘুরে গেছে— ‘চক্কর আয়া,’ আর ‘বাপ-বাপ!’ বলে সে একেবারে শুয়ে পড়েছে৷ অনেক হাওয়া করে তবে তাকে ঠান্ডা করি৷ তখন আমার মনে পড়ল, দেরাদুনে একদিন শ্রীযুক্ত নি-রও ঠিক এমনি অবস্থা হয়েছিল৷
এই বুড়ো আরও একদিন বড়ো বিপদে ফেলেছিল৷
সালউইন নদীর উপরে এক বিদঘুটে পাহাড়ে চড়তে হবে— নদী থেকে পাহাড়ের চুড়ো প্রায় ৫৫০০ ফুট উঁচু আর এমন খাড়া যে সেদিক থেকে চড়া যায় না৷ পাহাড়ের নীচের দিকটায় জঙ্গল আছে, কিন্তু চুড়োর কাছাকাছি শেষের পাঁচ-ছশো ফুট খালি ঘাস আর পাথর৷ আঠারো-উনিশ মাইল ঘুরে পাহাড়টার অন্য পিঠ বেয়ে উঠতে হবে৷ আমরা তো সমস্ত দিন চলে পাহাড়ের উল্টো পিঠে, জঙ্গলে তাঁবু ফেললাম৷ তার পরের দিনও ঘুরে-ঘুরে চড়তে-চড়তে প্রায় তিনটে বেজে গেল, তখনও চার-পাঁচশো ফুট বাকি৷ আমাদের মাথার উপরে দেয়ালের মতন খাড়া প্রেসিপিস, তাতে এক জায়গায় একটা ফাটল, আর সেই ফাটল দিয়ে ঝিরঝির করে জল পড়ছে, অতি পরিষ্কার আর সুস্বাদু জল৷ জলের কাছে অল্প একটু সমান জায়গা আছে৷ শানেরা ওইখানে পাহাড়ের দেবতাকে পুজো দিতে আসে, আর ওই সমান জায়গাটাতে আড্ডা করে৷ ওই সমান জায়গাটুকুর সামনে বড়ো-বড়ো গাছ আর উপর দিকটায় প্রকাণ্ড একটা পাথর ঝুঁকে আছে, ঠিক যেন ছাদের মতন৷ ঝরনার নীচের জমিটুকু ভেজা, তাতে প্রকাণ্ড বড়ো সব বাঘের পাঞ্জার ছাপ৷ বাঘও ওই ঝরনায় জল খেতে আসে৷ সঙ্গের শান কুলিরা বলল, ‘এখানে কোনো ভয় নেই৷ দেবতা থাকেন এখানে, বাঘ কিছু বলবে না৷’ আমরাও ওই সমান জায়গাটুকুতে আড্ডা করলাম৷
পরের দিন বাকিটুকু চড়তে আরম্ভ করলাম৷ সে এক ব্যাপার, প্রথমে কতকটা হাত ধরে-ধরে গাছে চড়বার মতো চড়তে হল পাহাড়ের স্যাডল অর্থাৎ, কাঁধটা পর্যন্ত, তারপর একটা গুহার মধ্যে ঢুকলাম৷ দেখলাম ওই গুহার মধ্যে অনেকগুলো নিশান টাঙানো আছে, বাতি জ্বালানো হয়েছিল তার চিহ্ন আর কয়েক আনা পয়সাও রয়েছে৷ শানেরা এখানেই পুজো দেয়৷
গুহার অন্যদিকটা খোলা, যেন প্রকাণ্ড একটা পাতকুয়ো৷ সেখানে একটা খুব মোটা গাছের ডাল দাঁড় করানো হয়েছে, তার গায়ে ধাপ কাটা৷ ওই গাছ বেয়ে উপরের ফুটো দিয়ে গুহার উপরে উঠলাম৷ সেখানে খালি ঘাস৷ একটু দাঁড়াবার জায়গা আছে, আর যত দূর দূরান্তর পর্যন্ত সব দেখা যাচ্ছে৷ সেখানে পৌঁছে তো চক্ষুস্থির! সামনে যে রাস্তা তাতে বুনো ছাগল বা বাঁদর ছাড়া অন্য জীব যাবে কী করে? পাহাড়ের কানা ঘেঁষে এক ফুট বা পনেরো ইঞ্চি চওড়া পথ, তাতেও আবার হাঁটু সমান উঁচু ঘাস৷ এক পাশে দেয়ালের মতো পাহাড়, তাও আবার ওই পথের দিকে ঝুঁকে রয়েছে, আর অন্যদিকে এক হাজার ফুটের মধ্যে আর আটকাবার মতো কিছু নেই! তার প্রায় ৪৫০০ ফুট নীচে সালউইন নদীর সবুজ জল৷ ওই তাকের মতো কানাটুকুর উপর দিয়ে প্রায় দেড় জরিপ অর্থাৎ বত্রিশ-তেত্রিশ গজ যেতে হবে৷
শানেরা তো বাঁদরের মতো চলে গেল৷ আমিও, ভগবানের নাম নিয়ে, সালউইন নদীর দিকে পিঠ করে, কাঁকড়ার মতো পাশের দিকে পা ফেলে, এক-পা এক-পা করে পার হলাম৷ ওপারে পৌঁছে, ফিরে দেখলাম সকলে পার হল কি না৷ টিন্ডেল আর দোভাষী বলল, ‘হুজুর, বুড়াবাবু নেহি আয়া৷ আনে নহি শকতা, সো গয়া— শির ঘুমতা, বদন কাঁপতা৷’
উপায়? শানদের ডাকলাম, দোভাষী দু-জনকে সঙ্গে দিলাম৷ তারা পাগড়ি দিয়ে বুড়োর কোমর বেঁধে, চারজনে সামনে-পিছনে টেনে ধরে, এক রকম ঝুলিয়ে বললেও চলে, তাকে ওইটুকু পার করে আনল৷ ভয়ে বুড়োর চোখ কপালে উঠেছে৷ কাজ শেষ হলে পর, আবার ঠিক অমনি ভাবে বুড়োকে ওইটুকু পার করা হল৷ এমন বিটকেল পাহাড় আমি কমই চড়েছি৷
সাদিক হুসেনের কাজ যতটা সম্ভব করলাম৷ বড়োসাহেবের হুকুম এল, ‘কাজ বন্ধ করে চলে এসো৷’ আমরা হেডকোয়ার্টারে ফিরে চলেছি৷ রাস্তায় দু-দিন গ্রাম পাব না, ক্যাম্প করতে হবে জঙ্গলে৷ শানরা বলল প্রথম দিন বিশেষ কোনো অসুবিধা হবে না, কিন্তু দ্বিতীয় দিনই মুশকিল৷
‘কেন?’
‘জলের কষ্ট৷’
‘জল কি কোথাও নেই?’
‘হ্যাঁ, এক জায়গায় এক পরিত্যক্ত ফুংগিচং-এ জল আছে, কিন্তু সেখানে বড্ড বাঘের ভয়৷ বাঘের উপদ্রবে, গ্রাম ছেড়ে লোকজন সব পালিয়ে গেছে৷ ফুংগিরা কিছুদিন ছিলেন, শেষটা তাঁরাও চলে গেছেন৷’
আমি বললাম, ‘চলো, ওই পরিত্যক্ত ফুংগিচং-এই আড্ডা করব৷ রাত্রে বড়ো-বড়ো ধুনি জ্বেলে, কড়া পাহারার বন্দোবস্ত করা যাবে৷’
দ্বিতীয় দিন ওই ফুংগিচং অর্থাৎ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আশ্রমে পৌঁছলাম৷ গ্রাম ছেড়ে লোকজন কোথায় চলে গেছে৷ আম-কাঁঠালের গাছে সব ফল ধরে রয়েছে৷ তিন-চারটে কুয়ো আছে, তাতে পরিষ্কার জল৷ ফুংগিদের আশ্রমের ঘর-দরজা, স্তূপ সব মজুদ রয়েছে৷ আমরা আশ্রমের সামনে খোলা ময়দানে তাঁবু ফেললাম৷ ধুনি জ্বালাবার জন্য অনেক কাঠের ব্যবস্থা করে, ডবল পাহারা বসালাম৷ রাত্রে কিন্তু কেউ স্বস্তিতে ঘুমুতে পারল না৷ এক-একবার একটু চোখ বন্ধ করি আর অমনি হৈ-হৈ চিৎকার৷
‘কী হল?’
‘বাঘ খচচর ধরতে এসেছে৷’
এমনি করে রাত কাটল৷ সকালে এক জায়গায় পায়ের দাগ দেখে মনে হল খুব বড়ো বাঘ ছিল না৷ তা ছোটোই হোক, আর বড়োই হোক, হতভাগা সমস্ত রাত আমাদের ঘুমুতে দেয়নি৷
আটদিন চলে আমাদের হেড ক্যাম্পে পৌঁছলাম৷ আমার সঙ্গে একটা ওইদেশী কুকুর জুটেছিল, আগের দিন রাত্রে সেই কুকুরটাকে বাঘে খেল৷
কুকুরটা কী রোগা যে ছিল তা আর কী বলব৷ গ্রামে তাকে কেউ খেতে দিত না, সেইজন্য বোধহয় আমাদের ক্যাম্পে জুটেছিল৷ দুটো ভাত তাকে দেওয়া হল, বেচারা সবে তাতে মুখ দিয়েছে, আর অমনি গ্রামের অন্য দুটো কুকুর তার উপর লাফিয়ে পড়ল৷ আমি তাদের ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে এটাকে খেতে দিলাম৷ ভোরে উঠে ডেরা ডান্ডা বেঁধে আমরা চলেছি, দেখি সেও আমাদের পিছন-পিছন আসছে৷ বেণী ব্রাহ্মণ, তার ভয় হল, যদি ‘চুলা’ নষ্ট করে, তাই তাড়া করল৷ আমি নিষেধ করে বললাম, ‘আনে দেও গরিব কো৷’ লাল রঙ, তাই নাম রাখা হল লালু৷ আমার তাঁবুর কানাতের পাশে সে শোবার জায়গা বেছে নিল, কেননা রোজ রাত্রে খাবার পর তাকে এক মুঠো ভাত দিতাম আমি৷ এমনি করে ছ’মাস আমাদের সঙ্গে ঘুরে বেশ মোটাসোটা হয়েছিল৷ দু-তিনটে নতুন ঘর ছিল সেখানে, তাতেই আশ্রয় নিয়েছি৷ লালু সেদিন রাত্রে ঘরের ভিতর শুয়েছে, দু-তিনবার ঠেলে তাকে ঘরের বাইরে রেখে এসেছি, কিন্তু আবার এসেছে৷ শেষটা নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বারান্দায়ই শুয়েছে৷ ভোরে উঠে ডাকাডাকি, লালু নেই! খচচরওয়ালারা বলল, ‘নিশ্চয় বাঘে নিয়েছে৷ চিতা বাঘ, কুকুরটা তাড়া করেছিল রাত্রে৷’
বেচারা বোধহয় বাঘের গন্ধ পেয়েছিল, আর সেইজন্যই ধমক সত্ত্বেও ঘরের ভিতর ঢুকে শুয়েছিল৷
রেলস্টেশনে পৌঁছতে আরও আঠারো-উনিশ দিন লেগেছিল৷ রেলস্টেশনে পৌঁছবার আগের দিন এক ফুংগির আশ্রমের উঠানে তাঁবু ফেলেছি, ম্যালেরিয়ায় ভুগছিলাম, জ্বর এসেছে৷ তাড়াতাড়ি তাঁবু খাটানো হল, আমি শুয়ে পড়লাম৷ মে মাস, বেজায় গরম৷ খালাসিরা তাঁবুর কানাত তুলে বেঁধে দিয়েছে— হাওয়া আসবার জন্য৷
.
একে তো পথ চলবার পরিশ্রম, তার উপর জ্বর, আমার একটু তন্দ্রা এসেছে৷ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল— ‘সাপ! সাপ!’ সবে মনে-মনে ভাবছি ডেকে জিগগেস করি ‘কোথায় সাপ!’ আর একটা পাঁচ-ছয় ফুট লম্বা প্রকাণ্ড ধামনসাপ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে তাঁবুতে ঢুকল, আর আমার বুকের উপর দিয়ে ডিঙিয়ে তাঁবুর অন্য পাশ দিয়ে বার হয়ে গেল৷ লোকজন সবাই ‘বাপরে! বাপরে!’ বলতে-বলতে পিছন-পিছন ছুটে তাঁবুতে ঢুকল, সঙ্গে রামশবদ আর সাদিক হুসেনও এল৷ আমি চুপ করে শুয়ে আছি দেখে নিশ্চিন্ত হল৷
পরের দিন সকালে আমি বললাম, ‘বুড়ো চলো, গোটেক ভিয়াডাক্ট দেখে যাব৷ এ বস্তি থেকে একজন গাইড সঙ্গে নাও৷’
গোটেক পুল দেখবার মতো জিনিস৷ মাঝখানে পাহাড়ী নদী, আর দু’পাশে খাড়া পাহাড়, এঁকে-বেঁকে রেল লাইন যতটা সম্ভব নেমেছে৷ দুটি সুড়ঙ্গও আছে, তারপর পুলের উপর দিয়ে পার হয়েছে৷ আধ-মাইলের উপর লম্বা পুল, সমস্তটা ইস্পাতের৷ পুলের উপর থেকে নদীর জল প্রায় ১৬৫ ফুট হবে৷ তখনও লাইন খোলা হয়নি, পুল তৈরি হচ্ছে মাত্র৷ খচচর, খালাসি প্রভৃতি রাস্তা ধরে রেল স্টেশনে গেল, আমি আর বুড়ো সার্ভেয়ার সোজা পথে পুল দেখতে গেলাম, সঙ্গে দোভাষী আর দুজন খালাসি৷
গোটেক-এ পৌঁছলাম৷ পুল প্রকাণ্ড, অনেক লোক তাতে কাজ করছে৷ স্লিপার ফেলা হয়েছে, কিন্তু তখনও রেল বসানো হয়নি, দুই কিনারা থেকে লাইন বসাতে আরম্ভ করেছে মাত্র৷ বুড়ো পুলের কাছে এসে এক নজর দেখে নিল, তারপরেই মুখ ফিরিয়ে খাদে নামতে আরম্ভ করল৷ ওই খাড়া পাহাড়ের গায়ে এক-একটা পাকডাণ্ডি অর্থাৎ সরু পায়ে-হাঁটা পথ আছে, বুড়ো আর খালাসিরা সেই পথে চলল; আমাকেও বার-বার তাদের সঙ্গে যেতে অনুরোধ করতে লাগল; বুড়ো বলতে লাগল, ‘জবরদস্তি মৎ করো বাবা৷’
আমি পুলের উপর দিয়েই চললাম৷ অতি সোজা কাজ, স্লিপার-এর উপর-উপর পা ফেলে চলে যাব৷ যতটুকু লাইন বসানো হয়েছিল ততটুকু তো নির্বিবাদে চলে গেলাম, কিন্তু তারপরই যত গোলমাল৷ স্লিপারগুলো ফেলা আছে বটে, কিন্তু তখনও পেরেক মারা হয়নি, কাজেই সেগুলো অতি সহজেই খটখট করে নড়ে৷ স্লিপার-এর মাঝের জায়গাটুকু তখনও খোলা রয়েছে, নীচের দিকে চোখ পড়লেই একেবারে ১৫০-১৬০ ফুট নিচে নদীর জল দেখা যায়, মাথায় যেন একটু-একটু গোল বাধে! এখন কী করি? অতগুলো লোক একদৃষ্টে দেখছে আমার অবস্থা কী হয়, আর আমি কিনা ফিরে গিয়ে হাসির ফোয়ারা তুলব? তা হবে না, এই পুলের উপর দিয়েই পার হব৷ এক-পা, এক-পা করে অগ্রসর হতে লাগলাম৷
মনে করেছিলাম বুড়োর অনেক আগে পার হব, কিন্তু যখন ওপারে পৌঁছলাম, দেখি বুড়ো আমার অপেক্ষায় বসে রয়েছে৷
জিগগেস করলাম, ‘কতক্ষণ?’
‘তা কুড়ি-পঁচিশ মিনিট৷’
ওপারে পৌঁছে আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল৷