বনের খবর – ১৪

১৪

(১৯১২-১৯১৩ আসাম৷ কামরূপ) গৌহাটির পরপারে ফুরুয়া পাহাড়৷ পাহাড়ের পশ্চিমদিকে বেশ বড়ো গ্রাম, গ্রামের নামও ফুরুয়া৷ সেই গ্রামের কিনারায় সার্ভেয়ারের তাঁবু৷ আমি তার কাজ দেখতে গিয়েছি৷ নৌকোতে গিয়েছি, উজান বেয়ে যেতে বেশ দেরি হয়ে গেছে৷ তাঁবু খাটাতে প্রায় সন্ধ্যা৷

একজন লোককে জিগগেস করলাম, ‘এখানে শিকার পাওয়া যায়?’

সে বললে, ‘হ্যাঁ৷ ওই পাহাড়ের নীচে-নীচে রাস্তা ধরে গেলে, সকাল সন্ধ্যায় পাওয়া যায়, মুর্গি ইত্যাদি৷’

একজন খালাসিকে বললাম, ‘টোটার ব্যাগটা নিয়ে আমার সঙ্গে চল৷’

বন্দুক ঘাড়ে ফেলে তো দু-জনে বেরোলাম৷ ধীরে-ধীরে চলেছি, প্রায় একমাইল-দেড়মাইল রাস্তা গিয়েছি, কোথাও কিছু নেই৷ দু-চারটে বনমোরগ দেখেছিলাম, কিন্তু সাধ্য কি যে কাছে যাই৷ ওই গ্রামে দু-চারটে বন্দুক আছে, সেগুলোকে গ্রামের লোকরা ফটফট চালায়, কাজেই শিকার সব হুঁশিয়ার হয়ে গেছে, দেড়শো-দুশো গজ দূর থেকেই পালিয়ে যায়৷

পরিশ্রমই সার হল, নিরাশ মনে তাঁবুতে ফিরে আসছি এমন সময় চোখে পড়ল ত্রিশ-চল্লিশ গজ সামনে একটা শুকনো নালার উপর, নালার চকচকে সাদা বালির উপর দিয়ে একটা কালো জানোয়ার চলে গেল৷ নালাটা পাহাড় থেকে নেমেছে আর রাস্তা কেটে ধানখেতে পড়েছে৷ জানোয়ারটা যখন রাস্তা পার হয় তখন আমার চোখে পড়েছে৷ ওখানে বাঘ-শুয়োরও আছে, গ্রামের লোকরা সাবধান করে দিয়েছিল৷ বন্দুকে ছিটা ভরা ছিল, খালাসিটাকে কানে কানে বললাম, ‘গুলিওয়ালা টোটা দে৷’

‘আনিনি হুজুর৷’

‘কেন আনিসনি?’

‘টিন্ডেল বলল সাহেব চিড়িয়া মারবেন, গুলির দরকার নেই!’

হতভাগা! পকেটে একটা গুলিওয়ালা আর একটা বাকশটওয়ালা কার্তুজ ছিল, সে দুটো বন্দুকে পুরে নিলাম, আর ধীরে-ধীরে নিঃশব্দে চললাম৷ পায়ে রোপ-সোলের জুতো ছিল কোনো রকম আওয়াজ হচ্ছিল না৷ নালায় পৌঁছে খুব সাবধানে দেখতে লাগলাম কী ওটা৷ দেখি তিন-চার হাত সামনেই মাটি খুঁড়ছে প্রকাণ্ড এক শুয়োর, আমার দিকে তার পিছন৷

একবার ভাবলাম— যাক, মারব না, মাত্র ওই একটি তো গুলি, যদি এক গুলিতে না মরে! তারপরই মনে হল দূর ছাই, ওই তো তিন-চার হাত সামনে রয়েছে, মরবে না আবার কি! যেমন মনে হওয়া আর অমনি বন্দুক তুলে গুড়ুম করে ছেড়ে দিলাম৷

শুয়োরটা একেবারে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেল৷ আট-দশ সেকেন্ড পড়ে থেকে, উঠতে চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু আবার উলটে পড়ে গেল৷ আবার একটুক্ষণ ছটফট করে, আবার উঠতে চেষ্টা করল৷ বার তিনেক উঠে-পড়ে, আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল৷ খালাসিটা পালাবার চেষ্টায় ছিল, তাকে ধমক দিলাম— ‘পালালে তোকেই গুলি করব৷’

শুয়োরটার যা চেহারা, বাপ! তার গর্দানের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে, কটাস-কটাস করে দাঁত ঘষছে, এই বুঝি আমার দিকে তেড়ে আসে৷ মাত্র একটি বাকশট সম্বল আমার, বন্দুক ঘাড়ে তুলে প্রস্তুত তো হয়েই আছি, চার্জ করলে, যখন বন্দুকের নাকে পৌঁছবে, তখন ঘোড়া টিপব৷

শুয়োরটা কিন্তু চার্জ করল না৷ পাঁচ-ছয় সেকেন্ড ওই ভাবে কটাস-কটাস করে দাঁত ঘষে বিকট একটা হুঙ্কার দিয়ে পাশের শরবনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল৷ আমিও খালাসিটার হাত ধরে পিছু হেঁটে নালার ওপারে গিয়ে উঠলাম৷ উঠে তাকে বললাম, ‘আব ভাগো৷’

লোকটা কিন্তু ভাগল না, আমার সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁবুতে ফিরে এল৷

তাঁবুতে ফিরে টিন্ডেলকে তাড়া দিলাম গুলিওয়ালা টোটা দেয়নি কেন? আরও বললাম, ‘সকালে দু-জন লোক গিয়ে ওইখানটায় খুঁজে দেখ৷ ওটা নিশ্চয় মরেছে৷’

সকালে উঠে আমি কাজে গেলাম, বিকেলে ফিরে এসে জিগগেস করলাম, ‘কেয়া রে? মিলা?’

‘নহি হুজুর, কাঁহা ভাগ গিয়া৷’

পরদিন সকালে আমরা আবার ওই রাস্তায় যাচ্ছিলাম, সেই শুকনো নালার ধারে শরবন, নালা থেকে আট-দশ ফুট দূরেই ঢের শকুন৷

‘কেয়া হ্যায় রে?’

‘আরে হুজুর ওহি শুয়ার তো থা লেকিন সব খা গিয়া৷’

অনুসন্ধান করা হল, লোক দুটো কেন বলেছিল যে নেই, চলে গেছে৷ ধমক খেয়ে একজন স্বীকার করল যে তারা ভয়ে ওদিকে মাড়ায়ইনি৷

ফুরুয়ায় বড়ো বাঘের উৎপাত৷ গ্রাম থেকে তিন-চারটে গোরু ধরে নিয়ে গেছে৷ সার্ভেয়ার শামসের সিং বলল, ‘হুজুর, বন্দুক দাও৷’

আমি বললাম, ‘আমি তো তিন রাত কাটালাম, কই বাঘ বেরোল না, তার ডাকও শুনলাম না৷’

সে বলল ইতিপূর্বে তারা প্রায় রোজই বাঘের ডাক শুনেছে৷

আমি গৌহাটি ফিরে এলাম৷ সেইদিনই আমার চাপরাশি রামাবতার আর দু-জন খালাসিকে শামসের সিং-এর তাঁবুতে পাঠালাম, তার টাকার দরকার৷ পরদিন সকালে তারা ফিরে এল আর সার্ভেয়ারের লম্বা এক চিঠি নিয়ে এল৷ রাত্রে বাঘের ভয়ে তারা ঘুমোতে পারেনি শিগগির বন্দুক পাঠিয়ে দাও নইলে খালাসিরা ভয়ে কাজে বেরোবে না ইত্যাদি৷

রামাবতারকে ডেকে জিগগেস করলাম, ‘বুড়ো, ব্যাপার কী?’

সারারাত নাকি কেউ ঘুমোয়নি৷ তাঁবুর সামনে বসে বাঘ গর্জন করেছে৷

‘যেখানে আপনার তাঁবু ছিল সেইখানে দাঁড়িয়ে চার পায়ে মাটি খুঁড়েছে আর গর্জন করেছে৷ আমরা কত চিৎকার করেছি, গ্রাহ্যই করেনি৷’

যাই হোক, একটা বন্দুক পাঠিয়ে দেওয়া হল৷

.

বনে-জঙ্গলে ছোটো-বড়ো কত রকমের জানোয়ার, আর তাদের অস্ত্রই বা কত রকমের৷ শিং, নখ, দাঁত, ক্ষুর— এক-একজনের এক-একটা চলে! এক-একজনের আবার মুখ ও পা দুই-ই চলে৷ যেমন, বাঘের দাঁত ও নখ, মহিষের শিং ও ক্ষুর, শুয়োরের দাঁত ও ক্ষুর৷ বনে-জঙ্গলে কত রকমের জানোয়ারই দেখেছি, কিন্তু শুয়োরের মতো এমন অদ্ভুত মেজাজের জীব আর দেখলাম না৷ বাঘ বল, ভাল্লুক বল, হাতি, মহিষ, গণ্ডার সকলেই চলে অতি সাবধানে, অতি সন্তর্পণে, পাছে কেউ জানতে পারে৷ দশ-বিশ ফুট দূর দিয়ে বাঘ-ভাল্লুক নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, কিছু জানবার, কিছু বোঝাবার জো নেই৷ হাতিটা পর্যন্ত এক-এক সময়ে প্রায় ঘাড়ের উপর এসে না পড়লে আর বুঝতে পারা যায় না যে হাতি আসছে৷

এইরকম সন্তর্পণে চলা বুনো জানোয়ার মাত্রেরই স্বভাব, শুধু শুয়োর বাদে৷ শুয়োর যখন চলে সে যেন নোটিশ দিতে-দিতে আসে, ‘সাবধান, আমি আসছি!’ এদিক-ওদিক তাকানো নেই, টিপে-টিপে পা ফেলা নেই, খালি ঘোঁৎ-ঘোঁৎ ফোঁস-ফোঁস, পা দুলিয়ে বুক ফুলিয়ে চলা, আর ঝোপ-জঙ্গল ঘেঁটেঘুঁটে তোলপাড় করা৷ আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারি ওই আসছেন বরাহ-অবতার৷ এমন একরোখা গোঁয়ার জন্তু বুঝি আর নেই, তাই লোকে বলে শুয়োরের গোঁ৷

যেমন মেজাজ, তেমনি তেজ আর তেমনিই তার শক্তি৷ পালাবার পথ থাকলে প্রায় সব জন্তুই আগে সেইটে খোঁজে৷ কিন্তু শুয়োরের সে-সব জ্ঞান নেই৷ তোমাকে দেখে যদি দৈবাৎ তার পছন্দ না হয়, সে খামখা পঁচিশ হাত জঙ্গল পার হয়ে তোমাকে তাড়া করে আসবে৷ তার উপর তুমি যদি আগে থেকে খোঁচাখুঁচি করতে যাও, তাহলে তো আর কথাই নেই৷ খোঁচা খেয়ে হজম করবে এমন জন্তুই সে নয়! তাকে মেরে কেটে রক্তাক্ত করে ফেল, সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপও নেই৷ তুমি একাই হও, আর পঁচিশজন লোকই সঙ্গে আনো, সে তার তোয়াক্কা রাখে না৷ গায়ে আঁচড় পড়লে, তার মাথায় যেন খুন চাপে৷ যতক্ষণ তার শরীরে প্রাণ থাকে ও নড়বার-চড়বার শক্তি থাকে, ততক্ষণ ওই সর্বনেশে গোঁ সে ছাড়ে না৷ রাগ আছে, সাহস আছে, তার উপর শারীরিক ক্ষমতা আছে আর হাতিয়ারেরও অভাব নেই, এমন জন্তুকে কে না ভয় করে? আমাদের দেশে বলে: ‘বাঘ-শিকারির ভাত রেঁধো৷ শুয়োর-শিকারির রেঁধো না৷’ সে যে ফিরে আসবে তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই৷

ছোটো-বড়ো, রঙ-বেরঙের কত রকম শুয়োর৷ কোনোটা সাদা, কোনোটা কালো, কোনোটার কাদার মতো রঙ৷ কারো পিঠে লম্বা-লম্বা লোম, রাগলে, সেই লোম ফুলে ওঠে৷ কারো ঘাড়ে খাড়া-খাড়া চুল, আবার কারো বা সর্বাঙ্গ চুলে ঢাকা৷ কারো দুটি দাঁত, কারো চারটি, আবার কারো বা নাকের পাশে চামড়া ফুঁড়ে দাঁত বেরিয়েছে৷ এক-একটার মুখ ভরা আলুর মতো বড়ো গোল-গোল আঁচিল৷ কেউ থাকে দু-চার-ছয়জন মিলে, আর কোনোটা বড়ো-বড়ো দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়৷ কিন্তু মেজাজ প্রায় সকলেরই একরকম, একটু উনিশ-বিশ মাত্র৷

শুয়োর শিকারেরও নানান কায়দা৷ কোথাও হয়তো ঘোড়ায় চড়ে বল্লম দিয়ে শিকার করে, কোথাও বা জাল দিয়ে ঘিরে ফেলে, তাড়া করে সেই জালে ফেলে বর্শা দিয়ে মারে, আর যাদের সে সাহস নেই, তারা দূর থেকে বন্দুক চালায়৷

একদিন ভোরে কাজে বেরিয়েছি, সঙ্গে আট-দশজন লোক৷ চারদিকে লম্বা-লম্বা নলখাগড়ার বন, মাঝে-মাঝে দু-একটা খেতও আছে৷ হঠাৎ দেখি একটা সর্ষে-খেতের মাঝখানে কালো-কালো কী দেখা যাচ্ছে৷ প্রথমটা মনে করলাম হয়তো বাছুর হবে, কিন্তু একটু এগিয়ে দেখি প্রকাণ্ড দুই শুয়োর! প্রথমে আমাদের সঙ্গের কুকুরটা ঘেউ-ঘেউ করে তাড়া করতে গিয়েছিল, কিন্তু বড়ো শুয়োরটা ঘোঁৎ করে ফিরে দাঁড়াতেই সে লেজ গুটিয়ে কেঁউ-কেঁউ শব্দ করতে-করতে দে দৌড়! হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না৷ ভাবলাম সকলে চেঁচামেচি করে ওদের তাড়ানো যাক৷ তাতে কিন্তু হিতে বিপরীত হল, শুয়োরটা এমনি তাড়া করে এল যে আমরা যে-যেদিকে পারলাম দৌড়িয়ে একেবারে জঙ্গলের বাইরে৷

আরেকদিন কিন্তু আমাদেরই জয়লাভ হয়েছিল৷ সেদিন কাজ থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, তাঁবু দূরে, তাই তাড়াতাড়ি ফিরছিলাম৷ পথের মধ্যে একেবারে আট-দশটা শুয়োরের সামনে পড়ে গেলাম৷ আমরাও যেমন চমকে উঠলাম, শুয়োরগুলোও থমকে দাঁড়াল, আর ঘোঁৎ ঘোঁৎ! পালের গোদা পিছনে ছিলেন, তিনি তাড়াতাড়ি সঙ্গীদের ঠেলে, দু-চারটাকে উল্টে ফেলে দিয়ে একেবারে সামনে এসে হাজির! আর তাঁর যা চেহারা! ঘাড়ের লোম খাড়া, দুই চোখ লাল, আর প্রকাণ্ড দুই দাঁত বের করে সে এমন এক বিকট ভেংচি দিল যে আমি বেগতিক বুঝে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বন্দুক তুললাম৷ শুয়োরটাও তাড়া করল, সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলি তার কপালে!

বরাহ এক গুলিতেই চিতপটাং৷ সঙ্গের লোকরা তাকে তাঁবুতে এনে মহা ভোজের জোগাড় করল, আমার লাভ হল শুধু তার বড়ো-বড়ো দাঁত দুটি৷

আরেকবার একজন মুসলমান সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে গিয়েছি৷ সে বড়ো ভালো লোক৷ আমাকে অনুরোধ করল, ‘হুজুর, শুনেছি আপনি সকলকেই শিকার মেরে খাওয়ান, আমার কাছে তো কখনো মারেননি৷’

জিগগেস করলাম, ‘এখানে শিকার আছে?’

‘হাঁ হুজুর৷ গ্রামের লোকরা ধান কাটছে, তারা বলে যে রোজ রাত্রে হরিণ, মোষ, শুয়োর ইত্যাদি ধান খেতে আসে৷’

আমি বললাম, ‘আচ্ছা, সন্ধ্যার পর যাব৷ যদি তোমাদের কপালে থাকে তো শিকার মিলবে৷’

একদিন রাত দশটা-এগারোটা অবধি বসে থেকে-থেকে ফিরে এলাম, শিকার পেলাম না৷ সমস্তদিন পাহাড়-জঙ্গল ঘেঁটে তারপর রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত ধানখেতে বসে থাকা নেহাত আমোদের কথা নয়৷ কাজেই পরদিন আর যাবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু সেই যে বলেছিলাম ‘তোমাদের কপালে থাকে তো মিলবে’— কাজেই যেতে হল৷ খালাসিদের জন্যই বেশি ভাবনা৷ বেচারারা সমস্তদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে, আর খায় শুধু ভাত নুন লঙ্কা, কদাচিৎ একটু ডাল, কুমড়ো বা কচু মেলে৷

সন্ধ্যার পর দু-জন খালাসি সঙ্গে করে বেরোলাম, তাঁবুতে বলে গেলাম যে বন্দুকের আওয়াজ পেলেই লোক পাঠাবে৷

প্রায় সমস্ত ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে, শুধু তাঁবু থেকে সিকি-মাইল দূরে এক টুকরো বাকি আছে, তারও চার পাশের ধান কাটা হয়ে গেছে৷ জঙ্গলের কিনারায়-কিনারায় চললাম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না৷ চারদিক দেখে নেবার পর, ওই ধানটুকুর পাশে একটু ঘাস ছিল, দু-ফুট আড়াই-ফুট উঁচু, তার মধ্যে গুড়ি মেরে বসে রইলাম৷ জ্যোৎস্না উঠেছে, জঙ্গলের দিকে মুখ করে বসে আছি, কিন্তু কিছুই বেরোয় না৷

রাত নটা সাড়ে-নটা বাজল, মনে করলাম এখন তাঁবুতে ফিরে যাই, এমন সময় জানোয়ারের পায়ের শব্দ কানে এল৷ আমার পিছনদিকে একটা বিল ছিল, তাতে উঁচু শরবন৷ সেইদিক থেকে আওয়াজ আসছে, একটার বেশি জানোয়ারের৷ চুপ করে বসে আছি, নড়িও না, যেন কানে কোনো আওয়াজই পৌঁছয়নি৷

জানোয়ারগুলো বেশ চালাক৷ দশ-বারো পা আসে, আবার ছুটে পালিয়ে যায়, আবার দশ-বারো কদম এগোয় আবার পিছন ফিরে দৌড়োয়৷ আমরা যেন কিছুই শুনিনি, যেমন হামাগুড়ি দিয়ে বসে ছিলাম তেমনি রইলাম৷ তিন-চারবার ওইরকম করে বোধহয় জানোয়ারদের বিশ্বাস হল এখানে লোকজন কেউ নেই, আর একেবারে সোজা পাশ কাটিয়ে এসে আমাদের সামনে হাজির— শুয়োর! সকলের আগে একটা প্রকাণ্ড, তার পিছনে দুটো পাশাপাশি, তারও পিছনে কী আছে না আছে দেখতে পাচ্ছিলাম না৷ আমাদের উপর চোখ পড়তেই শুয়োরগুলো নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে লাগল৷ কোনটাকে মারি? সামনের বড়োটাকে? ওটা দূরে, এ-দুটো কাছে৷ পাঁচ-ছয় হাত মাত্র ব্যবধান৷

কাছের দুটোকে লক্ষ্য করে বন্দুক ছুঁড়লাম৷ একটা তো নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল, দু-একবার হাত-পা ছুঁড়ে ঠান্ডা৷ অন্যটা ক্যাঁ-ক্যাঁ শব্দ করতে করতে তিন ঠ্যাঙে দৌড়৷ অন্যগুলো যে কোনদিকে উড়ে গেল লক্ষ্য করতে পারলাম না৷ উঠে দাঁড়িয়ে একটাকেও আর দেখতে পেলাম না৷

বন্দুকের আওয়াজ শুনেই তো খালাসিরা হল্লা করে তাঁবু থেকে দৌড়ে এল৷ এসে দেখে শুয়োর৷ তখন একজন চিৎকার করে অন্যদের খবর দিল কী শিকার মিলেছে৷ বেচারা সার্ভেয়ার তো শুনেই তোবা-তোবা বলে তাঁবুর দরজা বন্ধ করে দিল৷ আর খালাসিরা মহানন্দে ভোজের আয়োজন করতে লাগল৷

একবার সার্ভেয়ারের তাঁবু অনেক দূরে, গ্রামের লোক বলল একদিনে পৌঁছনো যাবে না৷ মাঝে আর গ্রাম নেই, কাজেই বাধ্য হয়ে ভোরে বেরিয়েছি, যেমন করেই হোক সন্ধ্যার আগে পৌঁছতে হবে৷

সমস্তদিন চলতে-চলতে লোকজন সব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে৷ বেলা চারটে প্রায়, তখনও দু’মাইল রাস্তা বাকি৷ দোভাষী আমি আর একজন খালাসি একটা নালার কিনারায় বসেছি, অন্য খালাসি আর খাসিয়া কুলিরা পিছনে পড়েছে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছি৷ হঠাৎ আমার পিছনের জঙ্গলে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ৷ নিঃশব্দে উঠে, আমার বন্দুকটি হাতে নিয়ে, দোভাষী দেখতে চলল কী জানোয়ার৷ শুয়োর সন্দেহ নেই, ঘোঁৎ-ঘোঁৎ তার প্রমাণ৷ এক মিনিটের মধ্যে গুড়ুম শব্দ আর সঙ্গে-সঙ্গে শুয়োরের হুঙ্কার৷ ছুটে দেখতে গেলাম কী ব্যাপার৷ গিয়ে দেখি গুলি লেগে শুয়োরের কোমর ভেঙে গেছে, বেচারা চলৎশক্তিরহিত! তবুও তার হুঙ্কার কী! আর দোভাষীকে মারবার জন্য চেষ্টাই বা কত! ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে উঠেছে, লাল চোখ দিয়ে আগুন ছুটছে, কটাস-কটাস করে দাঁত পিষছে, আর শুধু সামনের পা দুখানা দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছে দোভাষীর দিকে এগোতে৷ পিছু হটবার নামও নেই! আরেক গুলিতে তার সব যন্ত্রণার অবসান করে দেওয়া হল৷

একদিন একটা মজা হয়েছিল৷ সমস্ত দিন সার্ভেয়ারের কাজ দেখেছি, বড়োই পরিশ্রান্ত৷ কাজ শেষ করে, ঘোড়ায় চড়ে তাঁবুতে চলেছি, আট-নয় মাইল পথ যেতে হবে৷ রাস্তা ভালো, জ্যোৎস্না রাত, ভাবনা নেই৷ দু-জন মাত্র লোক আমার সঙ্গে, আমার সহিস অলক আর একজন খালাসি৷

আমরা তো লম্বা পা ফেলে চলেছি, নদী পার হতে হবে, সন্ধ্যার আগে নদীর ধারে পৌঁছবার ইচ্ছা৷ প্রায় মাঝ-পথে একটা বড়ো বিল আছে৷ বিলের কাছে এসে দেখি মেলা হাঁস৷ বড়োই লোভ হল৷ লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামলাম৷ অন্য লোকটিকে ঘোড়া ধরতে বলে, আমি আর অলক হামাগুড়ি দিয়ে চললাম, মতলব সোলা গাছের ( যা দিয়ে টুপি তৈরি হয়) আড়ালে-আড়ালে চলে একেবারে বিলের কিনারায় পৌঁছব৷ তারপর মাত্র কুড়ি-ত্রিশ গজ বাকি থাকবে, দুমদাম দুটো কার্তুজ চালালে দু-চারটে হাঁস নিশ্চয় পাব৷

প্রায় কিনারায় পৌঁছে গেছি, সবেমাত্র মনে-মনে ভাবছি এইবার উঠে দেখি কোনদিকে বন্দুক চালাব৷ আর অমনি সোলাগাছের আড়াল থেকে ‘ক্রা-আ-আ’ বলে একটা সারস ডেকে উঠল৷ চার-পাঁচটা সারস ডাঙায় চরছিল, আর সেই সঙ্গে-সঙ্গে বিলের সমস্ত পাখি ভ-র-র শব্দে উড়ে গেল৷ ওই সারসটাও সঙ্গে সঙ্গে উড়ল৷

এমন রাগ হল হতভাগার উপর যে কী বলব৷ সারসটা যখন আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, গুড়ুম করে তার বুকে দুই নম্বর ছিটা ছেড়ে দিলাম৷ অমনি ঘুরপাক খেয়ে সারসটা জলে পড়ল৷ সমস্ত পাখিটা জলে ডুবে গেল, শুধু তার মাথাটা আর গলার খানিকটা উপরে রইল৷

অলক তাড়াতাড়ি গামছা পরে ওটাকে ধরে আনবার জন্য জলে নামল৷ আমি তাকে অনেকবার বললাম, ‘লাঠি নিয়ে যা, ওটা জ্যান্ত, কামড়াবে৷’ কিন্তু সে কিছুই গ্রাহ্য করল না৷ বলল, ‘নাহি হুজুর, গলেমে পকড় লেঙ্গে৷’

সেখানে তিন-চার ফুট জল হবে৷ অলক পাখিটার কাছে গিয়ে হাত বাড়াল তার গলাটা ধরবার জন্য, আর সারসটা তার প্রকাণ্ড ঠোঁট হাঁ করে এল তাকে কামড়াতে৷ অলক অমনি এক পা পিছনে হটে গেল৷ আবার পাখিটার অন্য পাশ দিয়ে হাত বাড়াল৷ পাখিটা মুখ ঘুরিয়ে আবার ওই প্রকাণ্ড হাঁ অলকের দিকে ফেরাল৷ কিছুতেই আর ধরতে পারে না৷ শেষটা নিরুপায় হয়ে সে ডুব দিয়ে সারসের পা ধরল৷ কিন্তু পা ধরে যেমন সে দাঁড়িয়েছে আর অমনি সারসটা তার প্রকাণ্ড দুই ডানা মেলে অলকের মুখে মাথায় ডানা দিয়ে তিন-চরটে ঝাপটা মারল, অলকও ‘বাপরে বাপ’ বলে তাকে ছেড়ে দিল৷ অমনি সারসটা বিদ্যুৎবগে আকাশে উড়ে গেল৷

আমি এতক্ষণ অলকের কাণ্ড দেখে হেসে আকুল হচ্ছিলাম, মারবার অবসর হল না৷ ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রায় সিকি-মাইল পথ বেচারা উড়ে গেল, তারপর হঠাৎ ডিগবাজি খেয়ে নল-খাগড়ার বনের মধ্যে পড়ে গেল, বোধ হল যেন মরে পড়ল! ওই ছিল তার শেষ চেষ্টা, ওই জঙ্গলের ভিতর তাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব৷

এদিকে সকলে মিলে অলককে কী রকম জ্বালাতন করেছিল, বুঝতেই পারছ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *