১১
(১৯০৮-১৯০৯ ত্রিপুরা রাজ্য৷ লুশাই হিলস) পরের বছর আবার ত্রিপুরা রাজ্যে ফিরে গেলাম, সঙ্গে আট-দশজন সার্ভেয়ার, জরিপের কাজ করতে হবে৷
আগের বছর বহু চেষ্টা করেও লংতরাই যাবার বন্দোবস্ত করে উঠতে পারিনি৷ এবার আমার একজন সার্ভেয়ার লংতারই গিয়েছিল৷ সঙ্গে খালি কয়েকজন হাজারিবাগের খালাসি নিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল৷ ও-দেশের কোনো লোকই যেতে রাজি হয়নি৷ এদের কিন্তু কোনো অনিষ্ট হয়নি৷ তারা একটা ফুকিগ্রামে তাঁবু ফেলেছিল, লংতরাই সে-গ্রামের পশ্চিমে৷ সার্ভেয়ারটি মুসলমান, সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমমুখী হয়ে নমাজ পড়ছে৷ ফুকিরা অবাক হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখল, তারপর বলল, ‘দেখেছ? এরাও লংতরাই মানে৷ দেখছ-না ওই বাবুও তার পুজো করছে৷’
ত্রিপুরার মহারাজার রাজ্যে ভারী-ভারী সব বন আছে৷ কোন অতীতকালে এসব জায়গায় মানুষের বসতি ছিল৷ বনের ভিতর বড়ো-বড়ো পুকুর পাওয়া যায়, উত্তর দক্ষিণে লম্বা, মনে হয় হিন্দুর পুকুর৷ কোনো-কোনো জায়গায় খেতে জল নিয়ে যাবার খাল আছে, তাকে নহর বলে৷ কিন্তু তাতে জল নেই, সে সব খেতও এখন নেই৷ এখন শুধু দশ-বারো ফুট উঁচু শরবন, আর নল, আর বেত, আর ঘোর জঙ্গল৷ কতকাল হল এসব গ্রাম লোপ পেয়েছে তার ঠিকানা নেই, ও-দেশের লোকরাও বোধহয় সঠিক বলতে পারে না৷ আজকাল আবার একটু-একটু আবাদ আরম্ভ হয়েছে, দু-চার-ছয় ঘর লোক মিলে জায়গায়-জায়গায় নতুন গ্রামের পত্তন করেছে৷
এদের বড়ো কষ্ট৷ বর্ষাকালে সব জ্বরে মরে তার উপর হাতি শুয়োর এসে ধান খেয়ে যায়, তৈরি ফসল, দিনের বেলা তারা ধান কাটে, আবার রাত জেগে পাহারা দেয়, নইলে হরিণ আর শুয়োর সব খেয়ে যাবে, কিছু রাখবে না৷
এদের মধ্যে একজন মুসলমান আমাকে অনেক আদর-যত্ন করে বলল, ‘হুজুর, দু-একটা শুয়োর মারতে পারলে বড়ো উপকার হয়৷’
তার কথায় আমি শুয়োর মারবার জন্য অনেক রাত পর্যন্ত ধানখেতে বন্দুক হাতে বসে রইলাম, কিন্তু সেদিন আর শুয়োর এল না৷ লাভের মধ্যে আমি সেখানকার বিষম হিমে একেবারে ভিজে গেলাম৷ তখন আমি বিরক্ত হয়ে তাঁবুতে এসে সবে একটু ঘুমিয়েছি, অমনি একজন লোক ‘হুজুর, হুজুর’ বলে ছুটে এল৷ ‘চল্লিশ-পঞ্চাশটা শুয়োর এসে খেতে নেমেছে, আসুন৷’ কিন্তু আর কে যায়?
একদিন ও-দেশের কয়েকজন ভদ্রলোক মিলে আমাকে শিকারে নিমন্ত্রণ করেছিলেন৷ হাতিতে চড়ে পাঁচ-ছয় মাইল যেতে হবে৷ সঙ্গে লোকজন বিস্তর চলেছে, তাদের ঘাড়ে এই বড়ো-বড়ো জাল৷ সেই জাল দিয়ে বনের একটা দিক ঘেরা হবে৷ দুটি-দুটি জালের মাঝখানে পনরো-কুড়ি ফুট করে ফাঁকা থাকবে, আর সেই সব ফাঁকের মধ্যে বন্দুক হাতে শিকারিরা দাঁড়াবে৷ বনের এক পাশে রাস্তা আর মাঠ, অন্য পাশে নদী৷ এক মাথায় তো শিকারি আর জালই রয়েছে, অন্য মাথায় গিয়ে সঙ্গের লোকজনরা সারি বেঁধে, শোরগোল করে ঢালঢোল পিটিয়ে, কেরাসিনের টিন বাজিয়ে জঙ্গল ভেঙে আসতে থাকবে৷ বনের ভিতর জানোয়ার যত সব আছে, তারা তখন বেগতিক বুঝে ওই সব জালের ফাঁক দিয়ে পালাবার জন্য ছুটে আসে৷ সেই সময় শিকারিরা তাদের মেরে থাকে৷
আমরা চার-পাঁচজন বন্দুকওয়ালা, আর একজন বুড়ো শিকারি— অনেক বাঘ শিকারের পাণ্ডা সে৷ কে কোথায় দাঁড়াবে, সে-ই সবই ঠিক করে দিল৷
আমরা দাঁড়িয়েছি, দু-চারজনকে আমাদের আশেপাশে গাছে চড়িয়ে দিয়ে বাকি লোকজন সব অন্যদিকে চলে গিয়েছে৷ যারা গাছে চড়েছে তাদের উপর কড়া হুকুম কোন দিক দিয়ে জানোয়ার পালায় তার খেয়াল রাখবে৷ বুড়ো শিকারি বলতে লাগল, ‘বড়ো শিয়াল— মানে বাঘ— বেরোবার খুবই সম্ভাবনা৷ এই জঙ্গলটুকুকে বাঘের আড্ডা বললেই চলে৷’
শুনেই তো বন্দুকধারীরা গাছে চড়বার পথ দেখতে লাগলেন, দু-জন তো বাঁদরের মতো উঠেই গেলেন, আর দু-জন সুবিধা না পেয়ে একটু-একটু খোলা জায়গায় গিয়ে একসঙ্গে দাঁড়ালেন৷
আমি মাটিতেই বসে রইলাম, মোটা মানুষ, গাছে ওঠা চলবে না৷ একটু পরে বুড়ো এসে আমাকে মাটিতে দেখে কী যেন চিন্তা করল, তারপর জিগগেস করল, ‘কর্তা বুঝি গাছে উঠবেন না?’
আমি বললাম, ‘না৷’
তাই শুনে সে বললে, ‘তবে আমি কর্তার কাছেই দাঁড়াব৷’
যে জায়গায় বসেছিলাম, বুড়োর সে জায়গা পছন্দ হল না, সে আমাকে একটা বাঁশঝাড়ের পিছনে দাঁড় করিয়ে দিল৷
বুড়ো বলল, ‘যদি হরিণ আসে সামনে থাকতেই মারবেন, কিন্তু যদি বড়ো শেয়াল বেরোয় তাহলে আমাদের ছাড়িয়ে চলে গেলে তবে মারবেন, পাঁজরার দিকে৷’
দু-জনে বসে আছি৷ ঢাক, ঢোল আর টিনের একটু-একটু আওয়াজ কানে আসছে, বনের ভিতর জানোয়ার নড়বার-চড়বার আওয়াজও একটু-একটু শুনতে পাচ্ছি৷ শুনেই তো আমি একেবারে বন্দুক তুলে তৈরি৷ রাম! রাম! বেরোল কিনা একটা শেয়াল! আমার এমন রাগ হল৷
এতক্ষণে লোকজনের চিৎকারও একটু-একটু শুনতে পাচ্ছিলাম৷ আবার বনের ভিতরে জানোয়ার নড়বার শব্দ, শুকনো পাতার উপর পায়ের আওয়াজ৷ এবার আওয়াজ হচ্ছিল সেই যে দু-জন ভদ্রলোক এক জায়গায় দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের সামনে৷ একটু আওয়াজ হয়েই তখুনি আবার চুপচাপ হয়ে গেল৷
বুড়ো আমাকে হুঁশিয়ার করে দিল জানোয়ার যাই হোক, ওদিক থেকে আমাদের দিকে আসছে৷ এতক্ষণে লোকজনের গোলমালও বেশ কাছেই এসেছে৷ ওই! আবার জানোয়ারের গড়র-গড়র শব্দ৷ একবার শব্দ হওয়া মাত্র আমি বন্দুকের দুই ঘোড়া তুলে রেডি! পরক্ষণেই হুড়মুড় করে সব ভেঙে-চুরে পাঁচটা হাতি বেরিয়ে এল, পোষা হাতি!
আমরা প্রাণপণে হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে, বাঁশ দিয়ে ঠেঙিয়ে হাতিগুলোকে ফেরাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু হতভাগারা কি তা গ্রাহ্য করে? একে তো হাতি, তায় আবার পোষা৷ হাঁউ-মাউ-কাঁউ তারা ঢের শুনেছে, ঠেঙাকে তারা হিসেবেই আনে না৷ জাল-টাল সমস্ত ছিঁড়ে তারা বেরিয়ে গেল৷ ও-দেশে হাতিগুলোকে বনে ছেড়ে দেয়, তারা ইচ্ছমতো চরে খায়৷ একদিন পর, কখনো বা দু-দিন পর মাহুতরা এসে দেখে যায়, নুন খাইয়ে যায়৷
সেদিন আর যে আমাদের শিকার জুটল না তা বলবার আগেই নিশ্চয় সবাই বুঝে নিয়েছ৷
এই হাতি বেরোবার আগে অন্য এক টুকরো জঙ্গল ঘেরা হয়েছিল৷ সেখানেও আমরা বন্দুকধারী সব জালের ফাঁকে-ফাঁকে দাঁড়িয়েছিলাম, কেউ একটা গাছ, কেউ বা একটা ঝোপ মাত্র আশ্রয় করে৷ ক্রমে ঢাক-ঢোলের আওয়াজ বেশ স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল৷ আমি আগে কখনো এই রকম শিকার করিনি, সেইজন্য বড়োই ব্যস্ত হয়ে রয়েছি, না জানি কখন কী বেরোয়!
যেন একটা খড়খড় শব্দ কানে পৌঁছল, বন্দুক তুলে খুব নিবিষ্ট মনে জঙ্গল পরীক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না৷ হঠাৎ ভরর শব্দ করে তিন-চারটে বনমোরগ আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল৷ আবার সব নিস্তব্ধ, খালি ঢাক-ঢোলের আওয়াজ৷ আবার ভরর শব্দ করে এক জোড়া মধুরা (কালো ফেজেন্ট) উড়ল, হাতে লম্বা লাঠি থাকলে মারতে পারতাম৷ অন্য শিকারিদের মাথার উপর দিয়েও এমনি মোরগ, মধুরা উড়ে গেছে৷ আর আমরা সবাই বড়ো শিকারের আশায় বসে আছি৷
এতক্ষণে লোকজনদের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম৷ হঠাৎ শুকনো পাতার উপর জানোয়ার চলবার শব্দ হল, তারপরই সড়াৎ করে আট-দশ ফুট সামনে ঝোপের মধ্যে একটা জানোয়ার লাফিয়ে পড়ল৷ আমার তো মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল৷ না জানি কী বেরোল! তারপরেই তাকিয়ে দেখি একটা শেয়াল! আমাকে দেখেই আবার সে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল৷
দু-তিন মিনিট পরে মনে হল একটা ছোটো ঝোপ একটু নড়ে উঠল, আবার দু-তিন মিনিট সাড়াশব্দ নেই৷ তারপর ধীরে-ধীরে লতাপাতা ফাঁক করে দুটো হরিণ বেরোল৷ একটা এক গুলিতেই শুয়ে পড়ল, অন্যটা বন্দুক ঘুরোবার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল৷
ওই একটিমাত্র হরিণ ছাড়া সেদিন আর অন্য শিকার জুটল না৷ শিকারিরা, জঙ্গল-ভাঙনেওয়ালারা বড়োই দুঃখিত, এখানে নাকি সর্বদা বড়ো-বড়ো শিকার মেলে!