১৬
(১৯১৫৷ আসাম: ডিমাপুর, নাম্বর) বাইশ-তেইশ বছর জরিপের কাজে নানা প্রদেশে গিয়েছি, নানা জায়গায় ঘুরেছি, কত বন-জঙ্গল দেখেছি, কিন্তু আসামের নাম্বরের মতো জঙ্গল কোথাও দেখিনি৷ জঙ্গল যে এমন বিদঘুটে হতে পারে তা আমার ধারণাই ছিল না৷ অনেক জায়গাতেই বিশ্রী জঙ্গল আছে কিন্তু তার আগাগোড়া সমস্তটাই এক ধরনের নয়৷ কোথাও বা অল্প-বিস্তর বেত, কোথাও বা বড়ো-বড়ো গাছের বন, আবার কোথাও বা একটু-আধটু খোলা-খালা, কিন্তু নাম্বরে সব অন্য রকম— খালি বেত, আর বেত, আর বেত৷ যে জায়গায় বড়-বড় গাছ আছে, সেখানেও গাছের নীচে বেত, আর সকল গাছ জড়িয়ে উঠেছে বেত— ষাট-সত্তর ফুট লম্বা বেতও আছে৷ এক-এক জায়গায় এমন ঘন বেতও পেয়েছি যে সে বেত কেটে পথ করা যায় না, সুড়ঙ্গ তৈরি করতে হয়, তবে এগোনো যায়৷
মনে আছে এক জায়গায় একজন সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে গিয়েছিলাম, সঙ্গে দশ-বারোজন খালাসি ছিল৷ তারা সারাদিন প্রাণান্ত পরিশ্রম করে মাত্র কয়েক ফুট চওড়া আর ত্রিশ-বত্রিশ জরিপ লম্বা একটি সুড়ঙ্গ-পথ কাটতে সমর্থ হয়েছিল৷ শেষে হার মেনে চলে আসতে হয়৷
একে তো ওই রকম জঙ্গল, তার উপর আবার জানোয়ারে কিলবিল করছে৷ বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, শুয়োর, হাতি— কোনোটাই বাদ যায় না৷ আর জোঁক? তার কথা না বললেও চলে— এখনও গায়ে কাঁটা দেয় ওই জোঁকের কথা মনে পড়লে৷
সার্ভেয়ার ইন্দ্রসিং-এর কাজ দেখতে গিয়েছি৷ পথে একটা হরিণ মেরেছি৷ একটা নদীর ধারে আমার তাঁবু পড়েছে৷ সন্ধ্যার সময় সার্ভেয়ার এল৷ রাত্রে সে জায়গায়ই সে থাকবে, সকালে উঠে তার কাজ দেখতে দেখতে সার্ভেয়ার রণজিৎ সিং-এর ডেরায় যাব৷ তাদের দুজনের তাঁবু এক জায়গায়৷ ঘোর জঙ্গল, তাতে আবার অসংখ্য জানোয়ার, সেইজন্য সুবিধা হলেই দুজন সার্ভেয়ার এক জায়গায় তাঁবু খাটায়, তবুও তো বাইশজন লোক রাত্রে একসঙ্গে থাকবে৷
সকালে উঠেই সার্ভেয়ারের লোকেরা নালিশ করল, ‘হুজুর, আমরা শিকারের ভাগ পাইনি৷’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা, আজ যদি শিকার মেলে, সেটা তোমাদের হবে৷ আমার লোকের কোনো দাবি থাকবে না তার উপর৷’
লোকজনদের সোজা পথে রণজিৎ সিং-এর তাঁবুতে পাঠিয়ে দিলাম৷ বলে দিলাম সন্ধ্যার আগেই যেন দু-তিনজন লোককে লন্ঠন সঙ্গে দিয়ে, নদীর রাস্তায় পাঠিয়ে দেয়, অনেক কাজ— আমাদের হয়তো দেরি হতে পারে৷
বেশ চওড়া নদী, কিন্তু তাতে জল অতি সামান্য, বালিই বেশি৷ জলের স্রোত মাত্র ত্রিশ-বত্রিশ গজ চওড়া, বালির মধ্যে এঁকেবেঁকে চলেছে, কখনো বা এপার, কখনো বা ওপার ঘেঁষে৷ নদীটা প্রায় আড়াইশো গজ চওড়া হবে৷ জায়গায়-জায়গায় ছোটো-ছোটো দ্বীপ আছে, তাতে শুধু শরবন৷ নদীর কিনারাতেও কোথাও-কোথাও ত্রিশ-চল্লিশ গজ চওড়া শরবন৷
জঙ্গল কেটে লাইন তৈরি করে চলেছি, দেরি হচ্ছে, লোকজন হয়রান হয়ে পড়েছে৷ বারোটা-সাড়ে-বারোটার সময় একটা ছোটো নালার ধারে বসেছি, কিছু জলযোগ করব, লোকজনও জল খাবে, ‘খৈইনি’ খাবে৷ আমার খাওয়া প্রায় শেষ হয়েছে, এমন সময় এক খালাসি এসে বললে, ‘হুজুর, হরিণ৷’
খাওয়া ফেলে তাড়াতাড়ি বন্দুক হাতে ছুটলাম৷ একটা হরিণ ঝোপের মধ্যে ঘুমোচ্ছিল, আমাদের গোলমালে উঠে পালাচ্ছে৷ সেটাকে মেরে সার্ভেয়ারের লোকেদের বললাম, ‘এটা তোমাদের৷ বয়ে নিয়ে চল, কিন্তু খবরদার যেন গাফিলি না হয়, আমার লোকের ভাগ নেই এতে৷’
মহা খুশি হয়ে দু-জন খালাসি সেটাকে ঘাড়ে করে চলল৷
চারটের সময় আমরা একটা শুকনো নালায় পৌঁছুলাম, তখন সার্ভেয়ার বলল, ‘হুজুর, আজ এইখানে কাজ বন্ধ না করলে, তাঁবুতে পৌঁছতে পারব না৷ এই নালা ধরে নদীতে যেতে হবে— প্রায় এক মাইল রাস্তা, তারপর নদী-নদী যেতে হবে দু-আড়াই মাইল রাস্তা৷’
কাজ বন্ধ করে চললাম৷ বিশ্রী পথ— সার্ভেয়ারের কাটা লাইন, তাড়াতাড়ি চলা অসম্ভব৷ বড়ো নদীতে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য অস্ত গেছে, যদিও চারদিকে পরিষ্কার আলো, পাহাড়ের মাথায়-মাথায় একটু-একটু রোদের ছিটেফোঁটা ঝিকমিক করছে৷ বেশ চওড়া নদী, জলের স্রোত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ গজ চওড়া— একহাঁটু গভীর আর পরিষ্কার জল৷
নদীতে পৌঁছেই লোকজন একেবারে বালির উপর বসে পড়ল৷ বললে, ‘হুজুর থক গিয়া, পানি পিয়েঙ্গে৷’
আমরাও একটা পাথরের উপর বসলাম, পাঁচ-সাত মিনিট বিশ্রাম করলাম; লোকজনেরা হাত-মুখ ধুয়ে জল খেল৷ আমি ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছি, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এই অন্ধকার হল বলে, জলদি চলো৷’
সার্ভেয়ার বলল, ‘আর ভয় নেই৷ চওড়া নদী, এখুনি লোক এসে পড়বে লন্ঠন নিয়ে৷ ওদের চারটের সময় বেরোতে বলে দিয়েছি৷’
লোকজন উঠে দাঁড়াল আর চার-পাঁচজন মিলে ‘হু-উ-উ’ বলে জোরে চিৎকার করল— তাঁবু থেকে যাদের আসবার কথা, তারা কত দূর এল দেখবার জন্য৷ চিৎকারও করা আর পাশের আট-দশ ফুট উঁচু শরবন থেকে পাঁচ-সাতটা বুনো হাতি ফ্যাঁস-ফ্যাঁস শব্দ করে বের হয়ে এল, আর দৌড়ে জল পার হয়ে অন্য পারের জঙ্গলে ঢুকল৷
অত বড়ো-বড়ো পাঁচ-সাতটা জানোয়ার পনেরো-কুড়ি গজ মাত্র দূরে ওই খাগড়াটুকুর মধ্যে ছিল, কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি৷ লোকজন হঠাৎ অতগুলো হাতি দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল, তাদের সামলে নিয়ে চলতে আরম্ভ করলাম৷ ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ উপরে ঝলমল করছে আকাশভরা তারা, আর নীচে ঝকঝক করছে বালি, তার উপর দিয়ে আমরা চলেছি আর একটু পর-পরই জল পার হচ্ছি৷
পথ আর ফুরোয় না৷ সার্ভেয়ার বলল সবসুদ্ধ ষোলো-সতেরোবার জল পার হতে হবে৷ লন্ঠন নিয়ে লোক আসবার কোনো লক্ষণই নেই৷ আর দু-চার বার ‘হু-উ-উ’ বলে চিৎকার করা হয়েছে, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি৷ সকলে চটে লাল, সার্ভেয়ারের টিন্ডেল বলতে লাগল, ‘আচ্ছা, বেটাদের হরিণ খাওয়াব এখন! তাঁবুতে বসে আরাম করছে৷ অতবার করে বলে দিয়েছি চারটের সময় লন্ঠন নিয়ে আসবি তার নামও নেই৷’
এক-একবার জল পার হই আর লোকেরা বলাবলি করে, ‘আউর আট দফে, আউর সাত দফে’ ইত্যাদি৷ বালিতে পা আর চলে না, বালির উপর জায়গায়-জায়গায় পাথর, গাছের ডাল বা শেকড় পড়ে রয়েছে কাজেই চোখ নীচের দিকে রেখেই চলতে হয়, নয়তো হোঁচট খাবার আশঙ্কা৷ সাতটা বাজতে চলল, সকলেই পরিশ্রান্ত৷
‘আরে ফের আওয়াজ দেও৷’
‘হু-উ-উ৷’
এইবার উত্তর এল কিন্তু বহুদূর থেকে৷ সঙ্গের লোকেরা তাদের বাপান্ত করতে লাগল, ‘হতভাগারা তাঁবুতে বসে আওয়াজ দিচ্ছে!’ এমন সময়ে আবার নদীর মোড় ঘুরলাম আর দূরে আলো চোখে পড়ল৷ লোকেরা বলল, ‘ওই আসছে৷’
আমি ভালো করে দেখে বললাম, ‘ওটা লন্ঠনের আলো নয়, ধুনির আলো বলে মনে হচ্ছে৷’
তখন তো সকলে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল, ‘হতভাগারা আগুন পোয়াচ্ছে!’
ক্রমে সেটার আরও কাছে পৌঁছলাম, বেশ বুঝতে পারলাম যে একটা গাছ কিংবা বাঁশঝাড়ের গোড়া জ্বলছে আর দুটো লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ ক্রমে আরও কাছে গেলাম, আর একবার জল পার হলেই তাদের কাছে পৌঁছব৷
আগে-আগে দু-জন খালাসি হরিণ ঘাড়ে করে চলেছে, তাদের পিছনে আমি আর সার্ভেয়ার পাশাপাশি, আমাদের পিছনে বন্দুকওয়ালা, তার পিছনে অন্য লোকরা৷ আমাদের ডান দিকে জল, বাঁদিকে তিন-সাড়ে-তিন ফুট আন্দাজ উঁচু বালির পাড়, তার উপর সাত-আট ফুট পরিষ্কার বালি, তারপর কষায় আর শরবন৷ ওই বালির উপর একটা গাছের গোড়া বা পোড়াকাঠ পড়ে আছে৷ হরিণওয়ালা খালাসি দু-জন যখন ওই কাঠটার পাশ দিয়ে চলে গেল আমার মনে হল যেন কাঠটা একটু নড়ল৷
‘কাঠ নড়ল কী রকম?’ এই প্রশ্ন মনে ওঠা মাত্র আমি জোরে হাঁকলাম— ‘হ্যাইও৷’
আর চাই কি? ‘ফ্যাশ’ বলে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠে দাঁড়াল এই বড়ো এক বাঘ!
আমি আর ইন্দ্রসিং দাঁড়ালাম, হরিণওয়ালারাও ‘বাঘ! বাঘ!’ বলে দাঁড়াল, কিন্তু হতভাগা বন্দুকওয়ালা ‘বাপরে! বাঘুয়া!’ বলে তিন লাফে পিছনের লোকদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল! আমাদের হাতে লাঠি ছাড়া আর কিছু নেই, বাঘটা কিন্তু দুবার গলা শানিয়েই শরবনে ঢুকে পড়ল৷ হাতের ছড়ি দিয়ে ছুঁতে পারতাম এত কাছে ছিল৷
একেই বলে ‘রাখে হরি মারে কে?’
আগুনের সামনে যে লোক দু-জন ছিল তারা এতক্ষণ চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাচ্ছিল৷ আমরা জল পার হয়ে ওপারে গেলাম৷ তখন ওই খালাসি দু-জন বলতে লাগল, ‘হুজুর, এই হতভাগাই তো দুঘণ্টার উপর আমাদের আগলে রেখেছে৷ না এগোতে পারি, না তাঁবুতে ফিরে যেতে পারি৷ আমরা বেগতিক দেখে লন্ঠনের কেরাসিন ঢেলে এই বাঁশঝাড়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছি৷ আর ওই হতভাগা ওইখানে বসে পাহারা দিয়েছে, আগুনটা নিভলেই আমাদের ধরে খেত৷ আমরা যখন এখানে এসেছি, তখন ওটা এখানে জল খাচ্ছিল৷ আমাদের দেখে উঠে দাঁড়িয়েছে৷ আমরা ভয়ে তাঁবুমুখো হয়েছিলাম আর দৌড়ে ওটা জল পার হয়ে সামনে পথ আগলে দাঁড়িয়েছে৷ হুজুর এখন না এলে ঠিক আমাদের খেত, আগুন আর পনেরো-কুড়ি মিনিট পরেই নিভে যেত৷’
সত্যি কথা৷ আগুনটা তখন নিভু-নিভু হয়ে আসছিল৷ ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা তাঁবুতে পৌঁছলাম৷
এইজনই বলেছিলাম যে কোথাও বা শিকার মেলে— কিন্তু তখন একেবারে খালি হাত, নিরস্ত্র অবস্থা৷
পরের দিন সকালবেলা আমরা ওই রাস্তায় বাকি কাজটুকু শেষ করতে গিয়েছিলাম৷ যাবার সময় রাত্রের জানোয়ারটা কত বড়ো ছিল তা দেখতে পেলাম৷ যে জায়গায় জল খেয়েছিল আর যে জায়গায় হামা দিয়ে বসে ওই লোক দুটিকে পাহারা দিয়েছিল, দু জায়গাতেই পায়ের দাগ দেখলাম৷ আঙুল সুদ্ধ আমার পাঞ্জার প্রায় সমান এক-একটা! বেশ বড়ো বাঘ ছিল৷
দু-দিন ওই জায়গায় ছিলাম, তারপর ফিরবার পালা, পথ ওই নদী-নদী, যে জায়গায় প্রথম দিন হাতি বের হয়েছিল সেই পর্যন্ত৷ তারপর সার্ভেয়ারের কাটা লাইন ধরে-ধরে রিজার্ভ ফরেস্ট-এর সীমানা পর্যন্ত; সীমানার উপর বারো ফুট চাওড়া লাইন কাটা, ওই লাইন ধরে নীচুগারদ হয়ে ডিমাপুর যাব৷ নিচুগারদ থেকে ডিমাপুর পর্যন্ত পাকা রাস্তা৷
একটু ভোরে বের হয়েছি, যদি কোনো শিকার মেলে৷ আমার সঙ্গে ফুদনা নামে এক খালাসি৷ সাঁওতাল, বেশ হুঁশিয়ার লোক আর জঙ্গলে তার দৃষ্টিশক্তি বেশ সাফ৷ অনেকবার দেখেছি ঝোপের মধ্যে হরিণ বা শুয়োর নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমার চোখে পড়ল না, কিন্তু ফুদনা ঠিক ধরেছে৷ সে তার দেশে— হাজরিবাগের জঙ্গলে, শিকার করে থাকে আর তার সাহসও যথেষ্ট আছে, অনেকবার তার প্রমাণও পেয়েছি৷
নদী-নদী চলেছি, যে জায়গায় প্রথম দিন বাঘ দেখেছিলাম, সে জায়গাটা পার হয়ে প্রায় এক-দু মাইল পথ চলে গেছি৷ একটু-একটু রোদ উঠেছে, চারদিক তাকিয়ে দেখি আবার পথ চলি৷ সামনে বালির উপর একটা শুকনো গাছের ডাল পড়ে আছে, হলদে রঙের শুকনো পাতা তার, চার-পাঁচ ফুট দূরেই জঙ্গল৷ দু-চারবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার ওই শুকনো পাতা কটির দিকে চোখ গিয়েছে, ওরে বাবা, ওটা যে বাঘের বাচচা! আমাদের দিকে তার পিঠ, কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে৷
আমরা দাঁড়ালাম, বন্দুকটা ফুদনার ঘাড়ে, পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘বন্দুক৷’ ওই যে ফিসফিস করে কথা বলেছি, ওইটি তার কানে গিয়েছে৷ বাচচাটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এক নজরে আমাদের দেখে নিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে লাফ দিয়ে জঙ্গলে পড়ল৷ ‘মারো, মারো’ বলে ফুদনা আমার হাতে বন্দুক দিল বটে, কিন্তু মারবার সময় আর মিলল না৷ বন্দুক হাতে করে ধীরে-ধীরে এগোলাম, এক-এক পা ফেলি আর পাতা পরীক্ষা করে দেখি কোথাও তার মা বসে আছে কিনা৷ কিছুই দেখতে পেলাম না৷
জানোয়ার দেখলাম না বটে, কিন্তু পাঁচ-ছয় কদম সামনে গিয়েই পায়ের দাগ পেলাম৷ মা আর বাচচার দুজনের পায়ের দাগ পাশাপাশি, জল খেয়ে উঠে এসেছে৷ বাচচাটা যখন ওই জায়গায় শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছিল তখন তার মাও নিশ্চয়ই কাছেই কোথাও বসে আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল৷ গুলি চালালে আর রক্ষা ছিল না৷ বাচচার শোকে আমাদের আর পিছনের খালাসিদের সকলকে মুলোর মতো চিবিয়ে খেত৷ সৌভাগ্যের বিষয় হাতে বন্দুক ছিল না, হাতে বন্দুক থাকলে হয়তো বা বাচচাটাকে মেরে ফেলতাম৷ বাচচাটা একটা কুকুরের সমান উঁচু ছিল৷
সে জায়গা ছেড়ে চললাম৷ অন্য খালাসিরা এসে জুটেছিল, তাদের দশ-বারো মিনিট সেই জায়গায় অপেক্ষা করতে বলে আমরা এগিয়ে চললাম৷ ক্রমে নদী ছেড়ে সার্ভেয়ারের কাটা লাইন ধরে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম৷ অনেক জানোয়ারের পাঞ্জা দেখতে পাচ্ছিলাম, হরিণ, শুয়োর জল খেয়ে গেছে, তাদের পায়ের দাগ আছে৷
বন্দুক ঘাড়ে ধীরে-ধীরে চলতে লাগলাম, বেলা প্রায় সাড়ে-আটটা৷ শুনতে পেলাম একটু সামনে শুকনো পাতার উপর খুব খড়খড় শব্দ হচ্ছে৷ ‘কেয়া হ্যায় রে?’
ফুদনা বলল, ‘হুজুর, টেঙ্গা হোগা৷’
টেঙ্গা এক ধরনের পাখি, শালিখের মতো বড়ো, খয়েরি রঙ, বুক আর মাথার উপরদিকটা সাদাপানা, কুড়ি-বাইশটা একসঙ্গে থাকে, জঙ্গলে কোনো জানোয়ার দেখলে এরা সাধারণত বড়োই চ্চোমেচি করে সকলকে সাবধান করে দেয়৷ বললাম, ‘টেঙ্গা হ্যায় তো জমিন পর কেয়া করতা হ্যায়?’
‘শুখা পাত্তি পর লোটতা-পোটতা৷’
আমার মন ওই কৈফিয়তে প্রবোধ মানল না, টেঙ্গা মাটির উপর অমন লুটোপুটি খাবে কেন? বন্দুক ভরে এগোলাম কিন্তু খুব সাবধানে, একেবারে যেন হাঁটি-হাঁটি পা-পা! ক্রমে যে জায়গায় শব্দ হচ্ছিল সেই জায়গায় এলাম৷ আট-দশটা টেঙ্গা বসে আছে, কিন্তু গাছে, আর আমাদের দেখে কিচির-মিচির করতে লাগল৷
ফুদনা হেসে বলল, ‘ওই দেখো হুজুর৷’
বললাম, ‘তা বটে, কিন্তু কী দেখে তখন অমন করছিল?’
কোথাও কিছু নেই, আরও পাঁচ-সাত কদম আগে গেলাম, ‘ট্যাং’ শব্দ করে একটা প্রকাণ্ড হরিণী আমাদের সামনে দিয়ে দৌড়ে লাইন পার হয়ে গেল৷ টেঙ্গাগুলি আবার চেঁচামেচি করে উঠল৷
ফুদনা বলল, ‘ইসিকো দেখা থা হুজুর৷’
আমার বিশ্বাস হল না, শুধু এই? তবে মাটিতে হড়বড় কেন? আর কিছু দূর এগোলাম, কিছুই নেই৷ বন্দুকটা বড়ো ভারী, প্রায় আট পাউন্ড৷ কার্তুজ খুলে ব্যাগে রেখে, বন্দুকটা ফুদনার ঘাড়ে চাপালাম৷ লাঠি হাতে নিয়ে চলতে লাগলাম, কিন্তু তেমনি আস্তে-আস্তে পা টিপে৷ লাইনটা আঁকাবাঁকা, সামনেই মোড়, হঠাৎ মনে হল মোড়ের পাশে ঝোপের মধ্যে একটা কী নড়ল— চার-পাঁচ কদম দূরে হবে৷ দুজনেই দাঁড়িয়ে এক মনে দেখলাম, কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না; হয়তো কোনো ছোটো পাখি ছিল, এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফিয়ে গেল৷
আরও দু-চার পা চলে মোড়ের উপর এলাম, আর আকাশ-পাতাল ফাটিয়ে গর্জন করে, যেন একেবারে আমার পায়ের নীচে থেকে, প্রকাণ্ড বাঘ পিছনের দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল, সঙ্গে-সঙ্গে উল্টে সাত-আট ফুট দূরে লাফিয়ে পড়ল— ঠিক যেন ডিগবাজি খেল৷ আবার সেই ভীষণ গর্জন— আবার একলাফ, আবার গর্জন আবার লাফ৷ তিন লাফে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট চলে গেল আর সেইখানে দাঁড়িয়ে কী ভীষণ গর্জন!
আমি তো প্রথম গর্জন আর লাফের পরেই পিছনে হাত বাড়িয়ে ‘বন্দুক, বন্দুক’ বলে ডাকছি কিন্তু বন্দুক আর দেয় না৷
মুখ ফিরিয়ে দেখলাম বন্দুক দেবার শক্তি ফুদনার নেই৷ তার চোখ কপালে উঠেছে, হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে গেছে, সে ঠকঠক করে কাঁপছে৷ এক পা পিছনে হটে গিয়ে তার হাত থেকে বন্দুক নিলাম, বললাম, ‘ছররা দে৷’ বেচারা এমন ঘাবড়ে গিয়েছে যে কার্তুজের ব্যাগটা আর খুলতে পারে না৷ আমিই তাড়াতাড়ি এক মুঠা কার্তুজ বের করে নিলাম৷
তখনও বাঘের গর্জনে বন-জঙ্গল কাঁপছে, বন্দুকে ছিটা ভরে সেই বাঘের দিকে মুখ করে দুটো ফায়ার করলাম, বাঘটা আরও দুটো লাফ দিয়ে আবার গর্জে উঠল৷ আমি আরও দুবার বন্দুকের আওয়াজ করলাম৷ তখন মনে হল যেন বাঘটা দৌড়ে পালিয়ে গেল, গর্জন থেমে গেল৷ আমি কিন্তু আরও দুবার ফায়ার করলাম৷
লিখতে যত সময় লাগল তার সিকি ভাগের মধ্যে অত সব কাণ্ড হয়ে গেল৷ বাঘের গর্জন থেমে গেলে পর চারদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম, ব্যাপার কী, বাঘটা ওখানে শুয়ে কী করছিল? ফুদনা ততক্ষণে প্রকৃতিস্থ হয়েছে, তার চোখে পড়ল আগে— ‘হুজুর, ওই দেখো৷’ তাকিয়ে দেখলাম, আমার চার-পাঁচ ফুট সামনে প্রকাণ্ড এক সম্বরের মৃতদেহ পড়ে আছে, আশেপাশে আট-দশ ফুট জমি যেন একেবারে চষে ফেলেছে৷ সম্বরটার ঘাড় ভেঙে ফেলেছে, তার মুখ উপরদিকে আর সিং মাটিতে, গলায় চারটে ফুটো, আর তার থেকে রক্ত ঝরছে৷ পিছনের এক পায়ের হাঁটু ভাঙা, একখানা চোঙ্গা হাড় বেরিয়ে পড়েছে, সেটা একটা ছোটো গাছের সঙ্গে জড়ানো রয়েছে— ঠিক যেন ইচ্ছা করে বেঁধে রেখেছে৷ পিছনের রাঙের প্রায় দু সের মাংস উড়ে গেছে, সামনের একটা রাং থেকে প্রায় তিন পোয়া মাংস নেই৷ এইবার বুঝতে পারলাম যে এই দুয়ের লড়াইয়ের হড়বড়ি আমরা শুনতে পেয়েছিলাম৷ বাঘটা প্রথম যখন লাফিয়ে উঠেছিল, তখন ইচ্ছা করলে হাতের লাঠি দিয়ে তাকে ছুঁতে পারতাম৷
পাঁচ-সাতটা বন্দুকের আওয়াজ শুনে পিছনের খালাসিরা ধরে নিয়েছে যে বড়ো জবর শিকার পড়েছে, আর আধ মাইল দূর থেকে হল্লা করতে করতে এসে হাজির হয়েছে৷ পৌঁছে সব দেখে-শুনে তাদের চক্ষুস্থির৷ ফুদনাকে চেপে ধরল, ‘তুম ডর গিয়া থা?’
ফুদনা সোজা মানুষ, সে বলল, ‘হাঁ ভাইয়া, ডর গিয়া থা, মেরা খেয়াল হুয়া কেয়া হুজুরকো পকড় লিয়া৷’
শিকার যেই করুক, মাংস তো জুটেছে৷ খালাসিরা বলল, ‘আট-দশ মিনিট সময় দিন, আমরা মাংস নেব৷’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা৷ কিন্তু বাঘের খোরাক ছেড়ে নিয়ো, জখমি দিকটা নিয়ো না৷’
ওরা কুড়ুল দিয়ে দুখানা পা, একপাশের পাঁজর ও পাছা কেটে নিল৷ দু-জন খালাসির মাথাটাও নেবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমি বারণ করলাম৷ ভয় দেখালাম, ‘তাহলে বাঘ তাঁবুতে আসবে৷ কাছাড়ের পাহাড়ে বাঘ রাত্রে বাবুর ডেরায় এসেছিল, সমস্তটা শিকার তারা নিয়ে গিয়েছিল বলে৷’
হতভাগারা সহজে ছাড়তে চায়নি৷ ‘গুলি মেরে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব’ বলে ভয় দেখিয়ে তবে ছাড়িয়ে ছিলাম৷
মাংস নিয়ে চললাম আর দশ-বারো মিনিটে ফরেস্ট-এর সীমানার লাইনে গিয়ে পৌঁছলাম৷ লোকগুলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, বারো ফুট চওড়া লাইন, একেবারে পরিষ্কার, এবার সোজা হয়ে হাঁটতে পারবে৷ সীমানায় পৌঁছে খালাসিরা বলল, ‘বড্ড ভারী হয়েছে, জিনিসগুলো একটু গুছিয়ে বাঁধব৷’
বললাম, ‘আচ্ছা, বারোটা বাজে আমিও কিছু খেয়ে নিই৷’
খেতে বসে, যারা হরিণের মাথাটা আনতে চেয়েছিল, সেই খালাসি দু-জনকে ডাকলাম, বললাম, ‘যাও, গিয়ে হরিণের মাথাটা কেটে নিয়ে এসো, দশ টাকা বকশিশ দেব৷’
আমার টিন্ডেল শীতল লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ওরা নিয়ে এলে আমরা চাঁদা তুলে আরও দশ টাকা দেব৷’
তখন সবাই মিলে তাদের বলতে লাগল, ‘যা-না দেখি, কেমন মুরদ৷’
.
রির্জাভ ফরেস্ট-এর সীমানার উপর বারো ফুট চওড়া লাইন, জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাখা হয়, তাতে ঘাস গজায়৷ ওই পরিষ্কার করা লাইনের উপর সকাল সন্ধ্যায় অনেক শিকার পাওয়া যায়— মোরগ, হরিণ তো প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়৷
একদিন ভোরে আমি আর ফুদনা এমনি এক ফরেস্ট-এর সীমানা ধরে চলেছি৷ অন্য লোকেরা হাতির পিঠে মালপত্র বোঝাই করে আসছে৷ বেজায় কুয়াশায় চারদিক ঘেরা, দশ-পনরো ফুট দূরেও ভালো করে কিছুই দেখা যায় না৷ বন্দুকে দু-নম্বর ছিটা আর বাকশট ভরে নিয়েছি, মোরগ বা ছোটো হরিণ যা মিলবে মারব৷
হঠাৎ মনে হল যেন একটা ছোটো হরিণ (বার্কিং ডিয়ার) আমাদের বাঁদিক থেকে এসে, বারো-চোদ্দো ফুট সামনে লাইনটা পার হয়ে ডানদিকের জঙ্গলে ঢুকল৷ লালচে জানোয়ার চোখে পড়ল কিন্তু কুয়াশার জন্য আর কিছু ভালো করে দেখা গেল না৷ লাইনটার ডানদিকে আট-দশ ফুট দূরে একটু পরিষ্কার জায়গা ছিল— সেখানটায় বড়ো গাছই বেশি৷ ওই জায়গাটুকুতে বের হলেই মারব মনে করে, বন্দুক তুলে তৈরি হয়ে দাঁড়ালাম৷ এবার বের হলেই ঘোড়া টিপে দেব৷
বের হল বটে, কিন্তু এই বড়ো বাঘ! ফুদনা আমার কানে-কানে বলেছে ‘বাঘুয়া’— ওইটুকু তার কানে গেছে, আর তার ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে উঠল, একবার মুখ ফিরে আমাদের দেখল, তারপর যেমন চলছিল সেই তালেই চলে গেল, একটুও ব্যস্ত হল না৷ ঠিক যেন আমাদের সাবধান করে গেল— খবরদার, বুঝে-শুনে কাজ কোরো৷
.
এই নাম্বরে কাজ করবার সময় এক জায়গায় একটা মরা হাতি দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, দুটো বাঘ ওই হাতির মাংস খাচ্ছিল৷ কী করে হাতিটা মরল তা স্পষ্ট বুঝতে পারা গেল না৷ বাঘে মেরেছে বলে মনে হল না, কেননা হাতিটা প্রায় পূর্ণ বয়স্ক৷ অত বড়ো হাতি বাঘে মারতে পারবে না৷
বেতের মধ্যে হাতির রাস্তা, ওই রাস্তা ছাড়া যাবার পথ নেই, ঝড়ে একটা প্রকাণ্ড গাছ উপড়িয়ে ওই রাস্তার উপর ফেলেছে, রাস্তার উপর গাছের মূল কাণ্ডটা প্রায় চার-পাঁচ ফুট উঁচু হয়ে আছে৷ হাতিটার সামনের দু-পা গাছটার এক পাশে আর পিছনের দু-পা গাছের অন্য পাশে, গাছের কাণ্ডটা তার পেটের নীচে৷ দেখে শুনে মনে হল বোধহয় হাতিটা ওই গাছ ডিঙিয়ে যাবার চেষ্টায় ছিল৷ সামনের পা পার করে আটকিয়ে গিয়েছিল, পিছনের পা দুটি আর পার করতে পারেনি, ফিরেও আসতে পারেনি৷ কদিন না জানি ওই অবস্থায় থেকে তবে তার প্রাণ বের হয়েছিল৷
বাঘ দুটো সম্ভবত ওই রকম বেকায়দায় তাকে পেয়েছিল আর মরবার পর বা মরমর অবস্থায়ই খেতে আরম্ভ করেছিল৷ পেটের দিকটা খাচ্ছিল৷ কাজ করতে-করতে আমাদের লোকরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত, তাদের দেখে বাঘ দুটো পালিয়ে গেল৷ তারপর আরও দু-তিনবার তারা ওই রাস্তা দিয়ে গিয়েছে আর প্রত্যেকবারই বাঘ দুটোকে দেখতে পেয়েছে— আহারে ব্যস্ত! কী গন্ধ যে হয়েছিল ততদিনে তা বুঝতেই পারছ৷
.
এই যে ঘোর নাম্বর জঙ্গল, জানোয়ার কিলবিল করছে, আমাদের লোক চারমাস এই জঙ্গলে কাজ করেছে৷ কতদিন কত বিপদে পড়েছে, ম্যালোরিয়ায় ভুগেছে, দু-তিনজন ব্যারামে ভুগে প্রাণও হারিয়েছে, কিন্তু ভগবানের কৃপায় কেউই জানোয়ারের হাতে প্রাণ দেয়নি৷
দু-তিনবার সার্ভেয়াররা খবর পাঠিয়েছে, ‘কাজ করা যাচ্ছে না৷ খালাসিরা ভয়ে কাজে বের হতে চায় না, পালাবার জোগাড়ে আছে৷ রোজ তাঁবুতে বাঘ এসে হল্লা করে, শিগগির একটা কিছু ব্যবস্থা করো৷’
কারো তাঁবুতে শিকারি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে বন্দুক ঘাড়ে করে সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে কাজ করিয়েছে৷ আবার কোনো জায়গায় বা দু-জন সার্ভেয়ারকে এক কাজে নিয়োগ করতে হয়েছে, প্রত্যেকের সঙ্গে দশ-বারোজন লোক৷ তারা এক জায়গায় তাঁবু রাখে, একসঙ্গে কাজে বের হয়৷ বাঘের সাড়া পেলেই দুড়ুম-দাড়ুম বন্দুক ছুড়ে বাঘ তাড়ায় আর কাজ করে৷
এক জায়গায় তো মহা মুশকিল হল৷ খানিকটা জমিতে আর কোনো রকমেই জরিপ করা যায় না, সার্ভেয়ারের লোকের আওয়াজ পেলেই হাঁউ-হাঁউ করে বাঘ ছুটে আসে৷ দু-জন বাহাদুর লোককে সে জায়গাটুকু জরিপ করার জন্য পাঠানো হয়েছিল— একজান পাঠান, আগে পল্টনে ছিল; আরেকজন মাদ্রাজি মুসলমান, তার চার পুরুষ পল্টনে কাজ করেছে৷ দু-জন চার-পাঁচদিন একসঙ্গে কাজ করল৷ একজন কাজ করে আর অন্যজন বন্দুক ছুড়ে বাঘ তাড়ায়৷
এই মাদ্রাজি সার্ভেয়ারটি একদিন বড়ো বিপদে পড়েছিল৷ কাজ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, সঙ্গে-সঙ্গে আকাশ কালো হয়ে মেঘ উঠল৷ ঘন-ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে আরম্ভ করল আর বাজ পড়তে লাগল৷ সার্ভেয়ার কাজ বন্ধ করে খালাসিদের তাড়া দিল, ‘জলদি চলো, তুফান আতা হ্যায়, জঙ্গলমে রাস্তা ভুল যাওগে৷’
তাড়া দিয়েই সার্ভেয়ার রওয়ানা হয়ে গেল৷ বলে গেল আগুনের লাইন ধরে প্রায় এক মাইল যাবে তারপর সেই হাতির রাস্তা ধরে আড্ডায়৷ হাতির রাস্তা অনেক আছে কিন্তু একটা তাদের বিশেষ পরিচিত৷ সেটাকে তারা পরিষ্কার করে নিয়েছে, সর্বদা ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করে৷ আগুনের লাইন থেকে তাঁবু সিকি মাইল৷
সার্ভেয়ার তো চলে গেল, খালাসি বেচারাদের জিনিসপত্র বেঁধে নিয়ে যেতে চার-পাঁচ মিনিট দেরি হল৷ ‘এই ঝড় এল, এই ঝড় এল’— ভয়ে ছুটতে-ছুটতে তারা তাঁবুতে এল৷
‘বাবু কোথায়?’
আড্ডার লোকরা বলল, ‘বাবু তো আসেনি৷’
‘বাবু আসেনি? বাবু তো আমাদের আগে চলে এসেছে৷’
ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে আর তুমুল ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে৷ কত চিৎকার করে ডাকাডাকি করল, কিন্তু কোনো সাড়া পেল না৷
এদিকে সার্ভেয়ার তো লম্বা-লম্বা পা ফেলে চলেছে, যদি ঝড় আরম্ভ হবার আগে তাঁবুতে পৌঁছতে পারে৷ একটু অন্যমনস্ক হয়ে চলছে আর পথ ভুলে অন্য এক হাতির রাস্তা ধরে চলে গেছে৷ হঠাৎ কড়-কড়-কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল আর চারদিক ঝলসিয়ে বিদ্যুৎ চমকাল, তখন তার চৈতন্য হল৷ ‘এ কোথায় এলাম? এ রাস্তা তো নয়! আগুনের লাইন থেকে তাঁবু মাত্র সিকি মাইল— এ তো অনেক দূর এসেছি’ ইত্যাদি ভাবতে-ভাবতে ফিরতে আরম্ভ করল৷ ততক্ষণে তুমুল ঝড় আর মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে৷ পথ চোখে দেখা যায় না, বুঝতেই পারছে না কোনদিকে যাচ্ছে৷
তখন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগল, কী কর্তব্য৷ স্থির করল যে কোথাও বসে রাত কাটানোই যুক্তিসংগত, নয়তো এই অন্ধকারে ঝড়-বৃষ্টিতে প্রাণ হারাতে পারে, আর এতে খেয়াল হল যে ওই হাতির রাস্তার উপর বসে থাকা সমীচীন নয়, যত জানোয়ার এই পথ দিয়েই যাতায়াত করে৷ সার্ভেয়ারের হাতে একখানা ছোটো তলোয়ার ছিল, সে তা দিয়ে গাছে দাগ কাটতে আরম্ভ করল, আর ওই হাতির রাস্তা ছেড়ে কুড়ি-পঁচিশ ফুট জঙ্গলে ঢুকে একটা উইঢিপি পেল, তার উপরে একটা বড়ো গাছ৷ ওই গাছে পিঠ দিয়ে উইঢিপির উপর বসল, ওইখানেই রাত কাটাবে৷ তলোয়ারখানা সামনের দিকে বাগিয়ে ধরে রইল যদি কোনো জানোয়ার আসে, পিছনে প্রকাণ্ড গাছটার আড়াল৷
সমস্ত রাত যে তার কী ভাবে কেটেছিল তা বুঝতেই পার৷ ভিজে একেবারে চুপচুপে হয়ে গেছে, জোঁকও যে কত ধরেছে, তা বলা যায় না৷ এক-একবার পাশে ঝোপ-জঙ্গলে একটা কিছুর শব্দ হওয়া মাত্র তার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠছে, ঘুটঘুটে অন্ধকার, চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না৷ সৌভাগ্যের বিষয় ঝড়-বৃষ্টি সমস্ত রাতই ছিল, ঝড়ের দাপটে জানোয়ার বড়ো একটা বের হয়নি, সকলেই নিজেদের আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছিল৷
ভোর হলে বেচারা আধমরা অবস্থায় উঠে রাস্তায় এসে ফিরে চলল, অর্ধেক রাস্তা যেতে-না-যেতে তার লোকজনদের সঙ্গে দেখা হল তারা তাকে খুঁজতে বেরিয়েছে৷ বাবুকে দেখে লোকগুলির ধড়ে প্রাণ এল, তারা তার আশা ছেড়ে দিয়েছিল, বাবু হয়তো বা গাছ চাপা পড়েছে, নয়তো তাকে বাঘে খেয়েছে৷