চতুষ্পাঠী – ৬

ছয়

সাইরেন বেজে উঠল।

একটা মহড়া। বিমান আক্রমণ ঘটতে পারে। স্কুলের মাঠে, পার্কে, লম্বা লম্বা গর্ত খোঁড়া হয়েছে, এর নাম হল ট্রেঞ্চ। বোমা পড়লে এর ভিতরে ঢুকে যেতে হবে। এর ভিতরে ঢুকে সেদিন সিগারেট টেনেছিল অসীম। স্কুলের গেটের সামনে বালির বস্তা ডাঁই করা। গতকাল ব্ল্যাক-আউট হল। হেভি লাগল বিলুর। সারা কলকাতা অন্ধকার। কোনো বাড়িতে আলো নেই, রাস্তায় আলো নেই। ঘুটঘুটি কালোর মধ্যে দু-একটা গাড়ি চলছে। টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে। হেডলাইটের অর্ধেকটা কালো রঙ। দু’দিন আগে অমৃতসরের কাছে পাকিস্তান বোম ফেলে গেছে। ছাম্ব-এ এরোপ্লেনে এরোপ্লেনে লড়াই। কলকাতায় বোম পড়লে বেশ মজা হয়।

আজ ক’দিন ধরে সকালবেলা অনঙ্গমোহন বিলুকে খবর কাগজ কিনবার জন্য পয়সা দিচ্ছেন। আজ সেপ্টেম্বরের চার তারিখ। ঊনিশশো পঁয়ষট্টি সাল।

অনঙ্গমোহন আবার বললেন, বাপের ব্যাটা।

কে?

কে আবার, লালবাহাদুর শাস্ত্রী

অনঙ্গমোহন বললেন, যত মূর্খের দল।

কে?

যারা কয় সংস্কৃতে কিছু নাই।

কেন?

লালবাহাদুর তো সংস্কৃতজ্ঞ। ঐ সব বিএসসি, বিকম নয়। শাস্ত্রী। দেখ বিলু, শাস্ত্রীও বীর হয়। পণ্ডিতরাও বিক্রমশালী হয়।

পাকিস্তান সাবধান। সেনা গুটাও—নচেৎ উচিত শিক্ষা দিব। লালবাহাদুর শাস্ত্রী। এই এতদিনে একজন দেশনেতা পাইলাম। পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখলের অধিকার ভারতের আছে। লালবাহাদুর শাস্ত্রী।

এই জন্য পুরা দায়ী জওহরলাল। প্যাটেল আছিল ব্যাঘ্রশাবক। কাশ্মীরে যুদ্ধ কইরা হানাদার তাড়াইয়া দিতে ছিল, জওহরলাল চিৎকার পাড়ল, যুদ্ধ থামাও, যুদ্ধ থামাও।

এবার আমি যুদ্ধে চললাম। অঞ্জলি বলল। আজ মাছ আছে। দিদি স্কুল থেকে এসে যেন ভাত না খায়। ভাতে টান আজ। অঞ্জলির গা থেকে পাউডারের গন্ধ পেতেই অনঙ্গমোহন নাসিকা কুঞ্চন করলেন। বিধবা বৌ প্রসাধনও করছে?

অনঙ্গমোহন আবার কাগজের দিকে চোখ রাখেন। আকাশ যুদ্ধে দুইখানি পাক জেট বিমান ধ্বংস। টিথওয়াল, উরি প্রভৃতি জঙ্গলে ভারতীয় সৈন্যের অগ্রগতি। খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল।

সুমিতার গলা না? অনঙ্গমোহন খবরের কাগজ থেকে চোখ তুললেন। অজিতবাবু তো সকালে গান শেখান না। তবে সুমিতা আজ কেন ও-ঘরে? অনঙ্গমোহন কান খাড়া রাখেন।

তাহলে তোমার ব্ল্যাক-আউট ভালই লাগে বলছ, অ্যাঁ? অজিতবাবুর গলা শুনতে পান অনঙ্গমোহন। সুমিতা আবার হাসে।

বুঝলে সুমিতা, এ রকম ব্ল্যাক-আউট হতে থাকলে আর দশ মাস পরে দেশের পপুলেশন বেড়ে যাবে মনে হচ্ছে। অজিতবাবুর গলা, পাশের বারান্দায়। অজিতবাবু এখনো অফিসে যাননি তাহলে। অজিতবাবুর স্ত্রী-ও দু’দিন ধরে বাড়িতে নেই। তার ভ্রাতুষ্পুত্রের অন্নপ্রাশনে বারুইপুর গেছেন, অনঙ্গমোহনের কাছে বারবেলা জানতে এসেছিলেন উনি।

বোম পড়বে নাকি কলকাতায়? গুনে বলুন দেখি। সুমিতা এল। অনঙ্গমোহন সুমিতার দিকে চেয়ে একটু যেন কপাল কুঁচকোলেন। আজ সুমিতা যেন-বা কিছুটা উগ্রা। আলুলায়িত কুন্তল, বিলোল নেত্রা, লীলায়িত গাত্রভঙ্গ, চ্যুত বসনাঞ্চল, যেন ঈষৎ ন্যুব্জ। মন্দগতি।

অনঙ্গমোহন কপাল কুঁচকেই বললেন, আমি নক্ষত্রযাজক জ্যোতিষী না, আমি অধ্যাপক। কথার ঝাঁঝটা যেন সুমিতা বুঝতে পারল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল—না, না, এমনি বলছিলাম। শিখার বাবা উঁকি মারলেন ঘরে। বললেন, শোন সুমিতা। তা হলে ঐ কথাই রইল। যুদ্ধ চলছে। এখন দেশপ্রেমের গান। আর দেরি নয়, ধরগো তোরা হাতে হাতে খড়গ—নেক্সট ডে।

সুমিতা বলল—আজ তাহলে বেণীসংহার পড়া যাক।

অনঙ্গমোহন বললেন, থাক।

তা হলে মেঘদূতম্। আকাশটাও বেশ মেঘলা মেঘলা।

অনঙ্গমোহন বললেন, বৃথা বৃষ্টি সমুদ্রে চ বৃথা তৃপ্তেষু ভোজনং।

কেন এ কথা বলছেন পণ্ডিতমশাই? সুমিতা জিজ্ঞাসা করল।

অনঙ্গমোহন বললেন, মন এব মনুষ্যানাং কারণং বদ্ধমোক্ষয়োঃ। মানুষের বন্ধন বা মুক্তির কারণ হইল মন। তারপর অনঙ্গমোহন নিঃশব্দ, নিরুত্তাপ।

কী হল পণ্ডিতমশাই?

আইজ পড়ামু না। আস গিয়া। মন ভাল নাই।

সুমিতা সামান্যক্ষণ চুপ থেকে বলল, আপনার প্রহেলিকাটা বোধহয় হয়ে গেছে।

অনঙ্গমোহন মৃদু হাসলেন। বললেন, শুনি।

সুমিতা বলল—

কৃষ্ণমুখী।

ন মার্জারী।

দ্বি জিহ্বা ন চ সৰ্পিণী

যো জানতি সঃ পণ্ডিতঃ তাই তো?

অনঙ্গমোহন মাথা নাড়েন।

কলম। কলম। তাই না?

অনঙ্গমোহন হেসে ওঠেন। মনটা তরল হয়ে যায় অনঙ্গমোহনের।

—তা হলে আমিও পণ্ডিত। ঐ যে যো জানতি সঃ পণ্ডিতঃ।

—হ্যাঁ, তুমিও পণ্ডিত, দু’দিন পরে উপাধি পরীক্ষা পাস করবা। কাব্যতীর্থ হইবা…

কাব্যতীর্থ না হলে বুঝি পণ্ডিত হয় না? মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রাবৎ দেখলেও তো পণ্ডিত হয়।

—সে তো ঠিকই, পণ্ডিত তো কত রকমেই হয়। আত্মবৎ সর্বভূতেষু যঃ পশ্যতি। স পণ্ডিতঃ।

এবার আমি আপনাকে একটু আত্মবৎ দেখব পণ্ডিতমশাই। সামনে শীত আসছে। আপনার কষ্ট হয় খুব। সোয়েটারটা নিতেই হবে।

—ঐ সোয়েটারটা? যেটা গতবারে বানাইয়াছিলা?

হু।

সে তর্ক তো মীমাংসা হইয়াই গেছে গত বছরেই। ঐ সব পরুম না আমি। একটা চাদরই যথেষ্ট আমার।

কিন্তু এখন তো গরম-জামা, সোয়েটার এইসব পণ্ডিতরাই পরছে।

ওরা পণ্ডিত নয়। অং বং করলে পণ্ডিত হয় না। তবে একটা প্রস্তাব বলি শুন। এক মূর্খ জামাইয়ের সঙ্গে এক পণ্ডিত-কন্যার বিবাহ হইছে। দ্বিরাগমনে জামাই সপত্নীক শ্বশুরালয়ে আইতাছে। জামাই বড় ভীত। মনে শঙ্কা। না জানি শ্বশুর কী কইবে, আবার কী প্রশ্ন করবে, না জানি সর্বসমক্ষে অপমানিত হইবে, এইসব ভাবতে ভাবতে জামাই শ্বশুরবাড়ি ঢুকল। ঢুইক্যা শ্বশুররে নমস্কার কইরাই ভিতরের ঘরে চৌকির তলে লুকাইল। একটু পরে শাশুড়ি তো মুড়ি-নাডু লইয়া জামাই খোঁজে, জামাইরে তো কুত্রাপি পায় না। তখন ভাবল, বাইরে-টাইরে গেছে বোধহয়। কিন্তু পণ্ডিত-কন্যাটি তো দেইখ্যা ফালাইছিল, তার স্বামী কোন্ চৌকির তলে ফাঁদাইছে। কন্যাটি গোপনে চৌকির তলে ঢুইক্যা কইল—শুন প্রাণনাথ, বাইরে আস। সংস্কৃত ভাষা কঠিন কী। আমরা যে রকম কথা কই, তার মইধ্যে মাঝে মাঝে অনুস্বার বসাইয়া দিও। জামাইটি নিশ্চিন্ত হইয়া কইল—অনুস্বার দিলেই যদি সংস্কৃত হয়ে তবে কেন চৌকির তলে রয়েং। এই হইল জামাইয়ের মুখনিঃসৃত প্রথম সংস্কৃত শ্লোক। হংস মিথুনের হত্যা দুঃখে যে রকমভাবে বাল্মীকির মনে প্রথম শ্লোকটির উদয় হয়েছিল? সুমিতা বলল। তখন অনঙ্গমোহন হেসে উঠলেন এই সময় সুমিতা বলল দেখলেন আচার্যদেব, যুধিষ্ঠির কী রকম রাইট কথা বলেছিল। বক জিজ্ঞাসা করেছিল, সবচেয়ে দ্রুতগামী কী? যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, মন। কিছুক্ষণ আগেই আপনার মন খারাপ ছিল, আর এখন কেমন উৎফুল্ল।

অনঙ্গমোহন বললেন, মন বড় আশ্চর্য বস্তু। বস্তু নাকি অবস্তু কি জানি? নাকি সূক্ষ্ম জড়। পাণিনি ব্যাকরণে মন সম্পর্কিত এক কুটাভাস আছে।

নপুংসকামিতি জ্ঞাত্বা প্রিয়ায়ৈ প্রেষিতং মনঃ।
মনস্তু রমতে তত্র হতাঃ পাণিনীয়া বয়ম।

অর্থ বুঝলানি গো তুমি? মনকে ক্লীবলিঙ্গ জানিয়া স্ত্রীর নিকট পাঠাইলাম, অথচ দেখি মনটি স্ত্রীর সহিত রমণ করতাছে।

সুমিতা হাসি চাপল, হাসি চাপতে গিয়ে দেহে ঢেউ উঠল। অনঙ্গমোহন ছোট্ট এক টিপ নস্য গ্রহণ করলেন। নস্যগ্রহণের ভঙ্গিমাটাই বুঝিয়ে দেয় যে তাঁর এখন মেজাজ ভাল।

বিলু বলল—একটা গল্প বল দাদু।

অনঙ্গমোহন যেন সংবিত ফিরে পান।

বিলুর সামনে সন্ধিবৃত্তি আর অমরকোষ। পড়তেই এসেছিল বিলু, অনঙ্গমোহন তখন খবর কাগজ পড়ছিলেন। তারপরই সুমিতা এসে যাওয়ায় আর পড়ানোই হয়নি।

অনঙ্গমোহন তখন বলেন, সন্ধিবৃত্তি খোলো বিলু। কাইল কত পর্যন্ত পড়াইছিলাম? উষ্মানঃ শষসহাঃ। বিলু বলে, গল্প বলো না একটা।

অনঙ্গমোহন বলে, অসীম কোথায়?

বিলু বলে, জানি না।

ইস্কুলে যাবি না তোরা? বাজে কয়টা?

সুমিতা হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, দশটা। তবে আর গল্পের কা প্রশ্ন। বেলা হইয়া গেছে গিয়া। ইস্কুলে যাও তোমরা, ইংরাজি ইস্কুলে যাও, তবে একটা সূত্র দেখাইয়া দি, অধ্যয়নহীন দিনযাপন ঠিক নয়।

বিলু বলল, এগারোটায় তো ইস্কুল, সোয়া এগারোটায় গেলেও হয়। বল না গল্প একটা। সুমিতা তখন বলল—ঠিক আছে, আমি বলছি একটা মজার গল্প।

অনঙ্গমোহন হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন। গলা চড়িয়ে ডাকতে থাকেন অসীম-অসীম। অসীম বোধহয় কাছেই ছিল। হয়তো বারান্দার দক্ষিণের জানালায়। অসীম ধেয়ে এল। করতাছিলি কী? গর্ভস্রাব?

আমি তো অঙ্ক করছিলাম। এই যে এটা পারছি না। এটা অসীমের একটা প্রিয় কায়দা : অনঙ্গমোহন সংস্কৃত নিয়ে আক্রমণ করার আগেই অসীম অঙ্ক বা ইংরাজি নিয়ে আক্রমণ করে। অসীম বলে—খুব কঠিন অঙ্ক পিসামশায়। একটি পুকুরের তলার দৈর্ঘ্য ১০০ ফিট, প্রস্থ ৭০ ফিট, উপরের দৈর্ঘ্য ১৬০ ফিট, প্রস্থ ১৩০ ফিট…

এবার পুকুরটির কালি কত, এই তো, এই তো? অনঙ্গমোহন বললেন।

না কালি না, ক্ষেত্রফল।

যাহা কালি, তাহাই ক্ষেত্রফল।

আপনে এই অঙ্ক পারবেন পিসামশয়?

এ তো পুকুর কালির অঙ্ক। শুভঙ্করের আর্যা আছে।

অনঙ্গমোহন মনে করার চেষ্টা করেন-

পুকুর কালির কথা কহি শুন সবে
দৈর্ঘ্য প্রস্থ দুই দিকে যতেক মাপিবে
একদিকে কাঁচা আরদিকে পাকা হবে…

তারপর—আরও আছে, মনে পড়ে না।

নীলকমলের কাছে পড়ার আগে পাঠশালায় বেণীমাধব মাস্টারের কাছে পড়তেন অনঙ্গমোহন। এক কড়া পোয়া গণ্ডা দুই কড়া আধ গণ্ডা। তেরিজ, শুভঙ্করের কত রকম আর্যা—জমি বিঘা যত তল্কা হইবেক দর, তল্কা প্রতি ষোল গণ্ডা কাঠা প্রতি দর। কড়িষা, সোনাকষা, মোকর জমাবন্দির কত রকমের আর্যা, এমন আর্যা ছিল যাতে দইয়ের ভাঁড়ের আয়তন থেকে দইয়ের পরিমাণ বলে দেওয়া যেত। এর নাম ছিল দধিকষা। কায়স্থদের ছেলেরা মন দিয়ে এইসব আর্যা মুখস্থ করত। অনঙ্গমোহন শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, না। কিছুই মনে নাই। তারপর অনঙ্গমোহন বললেন, তবে কও সুমিতা, তুমি প্রস্তাব কইবা বলছিলা।

আসলে অনঙ্গমোহন অসীমকে পড়াশোনার জন্য ডাকেনি আদপেই। সুমিতার গল্পটার জন্য ডাকছিলেন। সুমিতা গল্প বলবে আর বিলু সেটা একা একা শুনে নেবে? সুমিতা গল্পটা বলার আগেই হাসতে লাগল।… সেই পণ্ডিতদের গল্প কিন্তু। একজন পণ্ডিত এক রাজবাড়িতে গেলেন। কাঁধে নিলেন ভাঙা খাটের ভাঙা পায়া, বেশ ভাল করে শালু দিয়ে মুড়িয়ে। রাজার ঘোষণা ছিল, যে রাজপণ্ডিতকে তর্কে পরাজিত করতে পারবে, তাকে প্রাইজ দেওয়া হবে। তা ঐ পণ্ডিতটি জানতেন, রাজপণ্ডিতটি হচ্ছে মূর্খ। আর দেশেও পণ্ডিত নেই, সুতরাং যস্মিন দেশে দ্রুম নাস্তি এড়ণ্ডাপি দ্রুমায়তে। ঐ পণ্ডিত রাজসভায় গেলে রাজা ঐ মোটা জিনিসটা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ওটা কী? পণ্ডিত বললেন—ইহা খট্টাঙ্গ পুরাণ। পুরাণের চতুষ্পাদ। রাজা তো ঘাড় নাড়লেন। এবার রাজার সভাপণ্ডিত এসে প্রথমেই বললেন, গব্য গূঢ়ং। তাই শুনে তো আগন্তুক পণ্ডিতটি চিৎকার করে বললেন, আগেই গব্য গূঢ়ং? প্রথমে গোবর ছড়াং অতঃপর পাতা বিছড়াং, তার পরে তো গব্য গূঢ়ং? অনঙ্গমোহন হাসলেন না। কপাল কুঞ্চন করলেন পুনরায়। মেয়েটি বড় বাচাল। কিন্তু বুদ্ধিমতী। দুই বছর পর একজন উপাধি পরীক্ষা দেবে তাঁর টোল থেকে, সুতরাং ওকে কিছুই না বলে সন্ধিবৃত্তি টেনে নিলেন। ঐ বইটি টানতেই অসীম গাত্রোত্থান করল। বলল, খাই গিয়া, ইস্কুলে যাব। বিলু বলল, আমিও যাব। অনঙ্গমোহন বললেন একটিমাত্র সূত্র। কয়েক পলের মধ্যেই হইয়া যাইব গিয়া। আজ বিসর্জনের সূত্র। অঃ ইতি বিসর্জনীয়ঃ। সংস্কৃত ভাষা, অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ। উচ্চারণের প্রকৃতি অনুযায়ী স্বরভেদ। পূর্বদিন ঘোষ, অঘোষ, আনুনাসিক, উষ্মবর্ণ ইত্যাদির সূত্র আলোচনা করছিলাম। আইজ বিসর্জনের সূত্র। অঃ ইতি বিসর্জনীয়ঃ। বক্ষের অবশিষ্ট শ্বাসবায়ু বিসর্জিত হয় অঃ এই উচ্চারণে।

উঃ! বেদনার এই অভিব্যক্তি মনে মনে ভাবে বিলু। বিসর্জন। ঠাকুরমা। বাবা।

অনঙ্গমোহন বলেন—অঃ শব্দের অ কার কেবলমাত্র উচ্চারণের জন্য। কেবল বিসর্জনীয় স্বতন্ত্র উচ্চারিত হয় না। সেহেতু অ কারের পর প্রযুক্ত হইল। ইতিঃ কুমারী স্তন যুগাকৃতির্ব্বর্ণো বিসর্জনীয় সংজ্ঞা ভবতি। কুমারীর দুইটি স্তনাগ্রভাগের ন্যায় বিন্দুরূপ বর্ণ দুইটিকে বিসর্জনীয় বলে। বোঝলা?

বিলুর কান লাল হয়ে যায়। স্তন? উরি বাবা। বাংলা ক্লাসের-বাপের আদর, মায়ের স্নেহ, প্রিয়ার হাসিমুখ বলার সময়েই গতকাল কান লাল হয়ে গিয়েছিল, তোতলাচ্ছিল বিলু। গোপেনবাবু স্যার বলেছিলেন, বেশ পেকেছিস দেখচি। ‘নারীর শোভা মমতা বক্ষ আবরণী’ এই বিজ্ঞাপনে কিছুটা স্তন দেখেছে, গোয়েন্দা রিপ-এর ডায়নার ছবিতে দেখেছে। কিন্তু স্তনাগ্রভাগ? বিসর্গ চিহ্নের মতো? বাথরুম থেকে স্নান সেরে দ্রুত উঠে আসা শিখার বুকে কি অস্পষ্ট বিসর্গচিহ্ন দেখেছিল বিলু?

অনঙ্গমোহন বললেন, সংস্কৃত টীকায় কদাচ অধিক ও অবান্তর কথা বলা হয় না। কেন কুমারী স্তনযুগের কথা বলা হইল? কী তার কারণ?

সুমিতার মাথা নিচু। বিলু চুপচাপ।

অনঙ্গ বলতে থাকলেন, কুমারী শব্দটি ব্যবহার না কইরা যদি কেবলমাত্র স্তনযুগাকৃতি বর্ণো লেখা হইত, তাইলে বৃদ্ধর স্তন দুইটাও বুঝাইতে পারত। তাইলে বিসর্গ অক্ষরের আকৃতির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হইত না। ফোঁটা দুইটা সমান সমান হইবে। একটা বড় কিংবা একটা ছোট নয়। ফোঁটা দুইটা তলায় তলায় হইবে, ঠিক একটার তলায় আরেকটা। একটা এই পাশে একটা ঐ পাশে নয়। বুড়িদের এই রকমই স্তন। সুতরাং শুধুমাত্র স্তনযুগাকৃতির্ব্বর্ণো খাটে না। কুমারী শব্দটা উল্লেখ কইরা দিতে হয়। বোঝলা?

মেশিনের মতো দ্রুত ঘাড় নাড়ে বিলু।

যাও।

স্বপ্না আসে স্কুল থেকে। সাদা পোশাক। বুকের সামনে ঝুলছে ঝালর। বিলু ওর দিকে তাকাতে পারে না।

বিসর্গ চিহ্নটা শুধুই কি স্তন? আর কিছু নয়? বিসর্গ মানে তো বিসর্জন। বুকে আটকে থাকা শ্বাস বাতাস নিঃশেষ বিসর্জন। বিসর্জনের মধ্যে দুঃখ থাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে, আর দুঃখের বিসর্গটা তো স্পষ্ট দু’ফোঁটা চোখের জল, বেদনার সব ভাষাতেই বিসর্জন।

স্কুলে যাবার সময় খালধারে, খালধারের পাশ দিয়ে রাস্তা, খালধারের পাশ দিয়ে মোটা পাইপে মাটি যাচ্ছে লবণহ্রদে। এই, এইখানেই ঠাকুরমার বিসর্জন।

.

বিলু তখন কত ছোট। সবে ভর্তি হয়েছে ক্লাস থ্রি-তে। বিলুর ঠাকুরমা বিলুকে কোলে নিত। বলত, মানিক আমার, কইলজা আমার। আগে গিয়ে বসত আর ঐ খালটার দিকে তাকিয়ে থাকত। বলত, দ্যাশে আমাগোর বাড়িতে সামনেই ঠিক এই রকম খাল আছিল। আমরা ঘরের কাছে নৌকায় উইঠ্যা বাপের বাড়ি নাইয়র যাইতাম, তোর দাদুর ছাত্ররা খালের জলে ছিপ ফালাইয়া জাল ফালাইয়া মাছ ধরত, আর জলের মধ্যে সাঁতার কাটত। আমার ছিল আঠারখান হাঁস। পুকুরে থাকত না অরা। দিন-রাইত থাকত খালের জলে…

আর এই খালের জন্যই বুড়ি মরল। খালের পাড় দিয়ে মোটা লোহার পাইপ সল্টলেক গেলে হবেটা কী, পাইপের ধারে কচুগাছের বড় হয়ে যাওয়া তো সল্টলেক আটকাতে পারছিল না। সুরবালা ছাত থেকে বোধহয় রোজ রোজ কচুগাছের পাতা মেলে ধরা দেখত। পাতার সবুজ দেখত আর ঐ মানকচুর ক্রমশ পুরুষ্টু হয়ে যাওয়া দেখত। উঃ, ‘ক্রমশ’ কথাটার মধ্যেও আবার সেই বিসর্জন। বুড়ির কি তখন তার দেশের উঠানের কোণার কচুগাছটার কথা মনে পড়ছিল, নাকি তার ছেলে জগদীশের একদিনের তরকারির খরচ বাঁচানোর প্রয়োজনের কথা ভেবেছিল। বুড়ি একদিন ভোরবেলা, খুব ভোরবেলা চুপি চুপি খালধারে নেমে গিয়েছিল। কচুটাকে তুলে নিয়েছিল।

বুড়ির মৃতদেহটা পড়েছিল জলের ধারে। কোমর পর্যন্ত জলের তলায় আর বাকিটা উপরে। একটা অপূর্ণ মানকচু মৃতদেহটার পাশে শুয়ে আছে।

সাপেই কি কেটেছিল সুরবালাকে? গঙ্গার মাটি পাইপে করে সল্টলেক গেলেও বিষাক্ত সাপ লুকিয়ে থাকতে পারে ঠিক পাইপেরই তলায়।

সুরবালা জলে নেমেছিল কেন? সদ্যতোলা কচুটার কাদামাটি ধুয়ে নিতে, মৃত্যুর আগে কচুটাকে সংসারের খাদ্যযোগ্য করে দেবে বলে? নাকি সর্পদংশনের জ্বালায় জলে নেমেছিল? জানা যায়নি।

সেই দেহটাকে মনে পড়ে বিলুর। ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া রঙ, বুকে আঁচল নেই, যে বুকের আশ্রয়ে আদরে আর আবদারে মুখ লুকোত বিলু, সেই আলুলায়িত আঁচলহারা দুই স্তন, বিসর্গচিহ্নের মতো স্পষ্টতই ঘন সংঘবদ্ধ নয়, বিসর্জন।

সুরবালার মৃত্যুর পরও পণ্ডিতি তর্ক কম হয়নি। তারাদাস স্মৃতিতীর্থ বললেন, আত্মঘাতিনী নয় তো? আত্মঘাতিনী হলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। অনঙ্গমোহন বলেছিলেন, আত্মহননের ইচ্ছা হলে কেউ মানকচু পরিষ্কার করতে জলে নামে না। তবে কি জলই মৃত্যুর কারণ? কামাখ্যা পুরোহিত বলেছিলেন, জল কেন? স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সর্পাঘাতই মৃত্যুর কারণ। তারাদাস বলেছিলেন—সর্পাঘাত অনুমান মাত্র। ধূম দেখলে অগ্নির অস্তিত্ব বোঝা যায়। কিন্তু সৰ্প দেখা যায় নাই। মৃত্যু সত্য, কিন্তু সর্প সত্য নাও হতে পারে। মৃত্যুর কারণ যে সর্পই তার প্রমাণ কী? প্রমাণাভাবে প্রায়শ্চিত্তই বিধেয়। ভিড়ের মধ্যে কে একজন বলেছিল—পক্ষাঘাতে কেন—হার্ট অ্যাটাক হতে পারে না বুঝি?

তারাদাস বলেছিলেন, ইংরাজি হতে যাহা হার্ট অ্যাটাক, তাহাই পক্ষাঘাত।

অনঙ্গমোহন বলেছিলেন, প্রায়শ্চিত্ত অর্থ তো কিছু অর্থদণ্ড। তারাদাস বলেছিলেন, তুমি স্ত্রী বিয়োগে উন্মাদ-প্ৰায় হইছ অনঙ্গভাই। তাই এরকম শাস্ত্র-বিরোধী কথা বল।

অনঙ্গমোহন রাগত স্বরে বললেন, আমি স্মৃতি বিশারদ নই। আমি অধ্যাপক। তোমরাই বল, আমার করণীয় কী? তারাদাস বললেন, এই মৃত্যু যে জলের ভিতরে হয় নাই—তার প্রমাণ কী? মৃত্যুর কারণ যদি জল হয়, তার জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা।

অনঙ্গমোহন বললেন, বড় ভ্যান ভ্যান করতাছ তোমরা। জলে ডুইব্যা মরলে কি জলের উপরে থাকত দেহ? চার্বাক ব্যাটা ঠিক কথা কইছে। বুদ্ধিহীনানাং জীবিকা হইল এইসব প্রেতকার্যাদি।

বাপরে। স্ত্রী বিয়োগে কম্যুনিস্ট হইয়া গেলা দেখি। মোছলমানেও প্রেতকার্য করে। তুমি যদি প্রেতকার্যাদি না করতে চাও না কর।

কী করতে হইব আমার, হেইডানি কইবা। কামাখ্যা পুরোহিত বললেন—যাই কও অনঙ্গভাই, এইটা অপঘাত মৃত্যু সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নাই। পক্ষাঘাতেই হোক, জলজনিত মৃত্যুই হোক, সর্পদংশনই হোক আর খালপাড়ের ডাঙায় পতনের কারণেই হোক, তিন দিন অশৌচ, আর প্রায়শ্চিত্ত। কারণ পক্ষিমৎস্যমৃগর্মে তু দংষ্ট্রিশৃঙ্গিনখৈহর্তা…তারপর কী যেন? বাকিটা তারাদাস বলে দিলেন।

কামাখ্যা বললেন, পক্ষী, মৎস্য, দংষ্ট্রা, শৃঙ্গী বা নখী দ্বারা হত, পতন, বজ্ৰ, অগ্নি, বিষ বা জল দ্বারা…

অনঙ্গমোহন বললেন, আমারে আর বাংলায় তর্জমা কইরা দিতে হইব না। সংস্কৃত জানি। প্রায়শ্চিত্ত করতে হইব, এইত কথা? কামাখ্যা বলেছিলেন, সবই মা কালীর ইচ্ছা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *