চতুষ্পাঠী – ১

এক

ব্রহ্মচারী
দণ্ডধারী
দণ্ড দিয়ে
কুত্তা মারি।

বাবলুদাই প্রথমে বলেছিল। তারপর বিজু, শিখা, অন্যান্য কাচ্চাবাচ্চাগুলি, এমন কি অসীমও। বিপ্লবের দিদি স্বপ্নাও মজা পেয়ে হাততালি দিল।

বিপ্লবের গেরুয়া বসন, মাথা ন্যাড়া, ন্যাড়া মাথা ঘোমটায় ঢাকা। ঘোমটাকে ভাল কথায় অবগুণ্ঠন বলে। আছে না…প্রসঙ্গ উল্লেখ করিয়া ব্যাখ্যা কর—দিক দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা…। ভেরি ইমপরটেন্ট। বিপ্লবের এখন অব্রাহ্মণের মুখদর্শন নিষেধ। তাই এই অবগুণ্ঠন।

.

বিপ্লবের পৈতে হল আজ। আচার্য ছিলেন তার দাদু শ্রীঅনঙ্গমোহন ভট্টাচার্য কাব্যব্যাকরণতীর্থ। তিনি উপবীত প্রদান করলেন। আর পুরোহিত হলেন— শ্রীকামাখ্যাচরণ চক্রবর্তী। এইমাত্র অনঙ্গমোহন ‘প্রজাপতি ঋষি পঙক্তিশ্ছন্দো দণ্ডাগ্নি দেবতে উপনয়নে মানবক দার্পণে বিনিয়োগ’ এই বাক্য বলে বিপ্লবের হাতে একটা বেলকাঠের লাঠি তুলে দিলেন। কামাখ্যাচরণ বললেন এই হইল তোমার ভিক্ষাদণ্ড

কুত্তা করে ঘেউ ঘেউ
ব্রহ্মচারী ছুঁস না কেউ।

এই, …এই ছ্যামড়াগুলাইন, কুষ্মাণ্ড সকল,—এইখানে চিক্কোই চ্যাঁচামিচি কইরো না। এই ঘরে ক্যান?—এইটা ব্রহ্মচারীর ঘর। যাও— ভাগো—। ওরা চলে গেল। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে বিপ্লব একবার ওদের দেখল। শিখাকে দেখল। শিখার মাথায় প্রজাপতি ক্লিপ, ফ্রকটায় ঝিকিমিকি। ডেক্রনের কাপড়। কি পাতলা। টেরিলিনও পাতলা। মেজমামা কখন আসবে? মেজমামা টেরিলিনের পিস দেবে বলেছিল।

বুঝলা, তুমি এখন ভিক্ষাব্রতী হইলা। ভিক্ষালব্ধ সবকিছু তোমার আচার্যকে প্রদান করবা। কামাখ্যাচরণ বললেন, নাও, এইবার ভিক্ষা। পুরুষের নিকট ভিক্ষা গ্রহণকালে কইবা, ওঁ ভবন ভিক্ষাং দেহি আর স্ত্রীলোকের নিকট ভিক্ষা গ্রহণকালে কইবা, ওঁ ভবতি ভিক্ষাং দেহি। অনঙ্গমোহন বিপ্লবের কানে কানে ফিসফিস করে বলে দিলেন—ভবৎ শব্দ পুংলিঙ্গের এক বচনে ভবান, সম্বোধনে ভবন…।

কামাখ্যাচরণ বললেন, প্রথমে মাতৃভিক্ষা। মায়ের কাছে ভিক্ষা চাও। মায়ের হাতের ভিক্ষা নিয়া ব্রহ্মচারী গুরুকুলে যাইত। এই ছিল প্রথা

অনঙ্গমোহন ‘বৌমা’ বলে হাঁক দিলেন। অঞ্জলির কাপড়ে হলুদের দাগ। ব্যস্ত হয়ে এল।—ডাকছেন বাবা?

সত্য ভিক্ষা দিয়ে যাও বৌমা

ও। হয়ে গেছে? অঞ্জলি উচ্ছল হয়। ছুটে যায়।

একটা ছোট্ট বাক্স নিয়ে আসে। একটা আংটি বার করে অঞ্জলি।

দেখি বিলু, তোর আঙুলটা দে তো—

ভবতি ভিক্ষাং দেহি।

অঞ্জলি বিলুর আঙুলে পরিয়ে দিল একটা আংটি।

খোদাই করে লেখা-বিপ্লব।

কামাখ্যা পুরোহিত বললেন, ভিক্ষা গ্রহণপূর্বক বল, ওঁ স্বস্তি।

বিলু বলে, ওঁ স্বস্তি মা…

অঞ্জলি তখন হুট করে কেঁদে ফেলে। আঁচল চাপা দেয় মুখে, ঘর থেকে বার হয়ে যায়। বিলু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না। কামাখ্যা পুরোহিতও আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ স্থির। তারপর বলেন, এবার অন্যদের কাছে ভিক্ষা চাও।

অনঙ্গমোহন তখন, তাঁর বান্ধব তারানাথ স্মৃতিতীর্থকে আহ্বান করেন। ‘আস, তারানাথ, অধিক দিন আর এইসব বজায় থাকব না।’ অঞ্জলি তখনই ছুটে আসে।

না, আগে ওর বাবার কাছে যাবে।

কামাখ্যাচরণ বলেন—ওর বাবা? বাবার কাছে যাবে। কী কথা কও বৌমা?

—ওর বাবার আশীর্বাদ নেবে সবার আগে।

—মন্ত্রবাক্যে আশীর্বাদের কথা তো নাই, ভিক্ষা, ভিক্ষার কথা আছে মা, কামাখ্যাচরণ বলেন।

অঞ্জলি বিলুর হাত ধরে। দেওয়ালের কাছটাতে নিয়ে যায়। ওখানে ওর বাবার ছবি। অল্প অল্প দাড়ি, রোগা রোগা কিন্তু চোখটা কী রকম ভাসা ভাসা। ওর সত্যিকারের বাবাকে এরকম কক্ষনো দেখেনি বিলু, এরকম ভাসা ভাসা চোখ কখনো দেখেনি, এরকম স্মিত হাসিও কখনো দেখেনি।

এ ছবি বিয়ের আগের ছবি, চাকরির দরখাস্ত করার সময়ে তুলেছিল বাবা। বাবার কোনো ছবি পাওয়া যাচ্ছিল না তখন। একটা খাম থেকে যে ছবিটা বার করেছিল মা, তাতে বাবা চেয়ারে বসে, কোঁচাটা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে, একপাশে একটা গোলমত টেবিল, টেবিলে ফুলদানি। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে মা, জামার হাতা ঘটির মতো ফুলে আছে কনুই-এর ওপরে। মায়ের মাথায় কিছুটা ঘোমটা। ঘোমটাকে ভাল কথায় অবগুণ্ঠন বলে। মায়ের মুখে কিছুটা হাসি। মায়ের শাড়ির আঁচলে বুটি বুটি, সেই আঁচল কিছুটা এলানো। তার মায়ের কপালে সিঁদুরটিপ। মায়ের একটা হাত হাতলের ওপর বাবার হাত কিছুটা ছুঁয়েছে। বাবার হাত চেয়ারের হাতলে বিছিয়ে রয়েছে। বাবার হাতের আঙুলে আংটি। ঐ জোড়া ছবি থেকে বাবাকে আলাদা করা যায় না। তাছাড়া লুটোনো আঁচলের ঐ ছবি কি শ্রাদ্ধবাসরে মানায়? শেষকালে অনেক খুঁজে খুঁজে একটা হলুদখামের ভেতরে একটা ক্ষয়া ছবি পেয়েছিল মা। ঐ ছবিটাই বড় করে বাঁধিয়ে এনেছিল বিপ্লব শ্রাদ্ধের আগে আগে।

দেয়ালে বাবার ছবি। মরে যাওয়া বাবা। বাবার চোখটা কী রকম ভাসা ভাসা। মুখে অল্প অল্প দাড়ি। তলায় লেখা স্টুডিও শতদল। বিপ্লব হাতজোড় করে। ভবন ভিক্ষাং দেহি এই মন্ত্রবাক্য এখানে চলবে না। মরে যাওয়া বাবা কী ভিক্ষা দেবে?

আশীর্বাদ ভিক্ষা চাও বিলু, বাবার কাছে আশীর্বাদ চাও। অঞ্জলি বিপ্লবের মাথায় হাত রাখে। সদ্য মুণ্ডন করা মাথাটা কী রকম শিরশির করে ওঠে।

আজ কী আশীর্বাদ চাইবে বিলু। পরীক্ষার আগে বাবার ছবিকে নমস্কার করার সময় বিলু মনে মনে বলে বাবা, যেন ভাল নম্বর পাই। অসীম যেন আমাকে বিট্ দিতে না পারে। পাঁচ দুই হাইটের নক-আউট ফুটবলের ফাইনালের দিন বাবার ছবিকে নমস্কার করে বলেছে, বাবা, দেখো যেন গোল বাঁচাতে পারি, কেউ যেন না বলতে পারে গোলকিপারের দোষে নেতাজি সঙ্ঘ হেরে গেল। আজ, এখন কী আশীর্বাদ চাইবে বিলু? বিলু কি বলবে আমার পৈতে হয়েছে, এখন এক বছর ডিম খেতে দেবে না। পেঁয়াজ খেতে দেবে না, আশীর্বাদ কর বাবা, আমার যেন লোভ না হয়, নাকি বলবে সন্ধে-আহ্নিকের মন্ত্রগুলো বড় কঠিন বাবা, আশীর্বাদ কর যেন মনে রাখতে পারি।

তারানাথ স্মৃতিতীর্থ তখন বললেন, ব্রহ্মচারী, মনে মনে বল হে পরলোকগত পিতঃ আশীর্বাদ কর যেন ঈশ্বরের চরণে মতি রাইখ্যা সদা সদবিপ্র থাকতে নি পারি।

বিলু ওসব কিছুই বলে না।

সদবিপ্র থাকার মহা ঝামেলা। ওর মাকে তো দেখছে, দাদুকে সদবি রাখতে গিয়ে কত ঝামেলা।

কও, হে পিতঃ, আজ আমি দ্বিজ হইলাম, তুমি তো দেখলা না, যেন স্বধর্মে আসীন থাকি। আজ আমি দ্বিজ হলাম দ্বিজ। পরীক্ষায় এসেছিল— ব্যাসবাক্যসহ সমাস লিখ। দ্বিজ। দুইবার জন্মে যে। বহুব্রীহি, বহুব্রীহি।

ব্রহ্মচারী, ব্রহ্মচারী, কও আশীর্বাদ কর পিতা, এই উপনয়নের মর্যাদা যেন রাখতে পারি। পিতাই পরম গুরু। পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমন্তপঃ।

তারানাথ স্মৃতিতীর্থ এই কথা বলতেই জোরে জোরে মাথা নাড়লেন বোবাঠাকুর। মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের হতে থাকে। বোবাঠাকুরের কি একটা নাম আছে। হরিদাস সম্ভবত। ইনি বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর টিকির কারণে। টিকিকে ভাল কথায় বলে শিখা। নোয়াখালীর দাঙ্গায় ওঁর শিখাটি কাটা গিয়েছিল। বোবাঠাকুর ঐ কর্তিত শিখাটি সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন একটা কৌটোর মধ্যে। পরে গান্ধীজি নোয়াখালী সফরে এলে অত্যাচারের চিহ্নস্বরূপ এই শিখাগ্রভাগটি দেখিয়েছিলেন। তখনও তাতে গ্রন্থি এবং শুষ্ক ফুল ছিল। ওটার ছবি উঠেছিল হিতবাদী পত্রিকায়। বোবাঠাকুর আর্থিক অনুদান পেয়েছিলেন। পরে হরিপদ ভারতী তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ঐ কৌটো নিয়ে হরেন মুখার্জির সঙ্গেও দেখা করেছিলেন বোবাঠাকুর। স্কুলের পণ্ডিতের চাকরি পেতে পারতেন যদি উনি বোবা না হতেন। অনঙ্গমোহনের শ্যালক হন বোবাঠাকুর। অনঙ্গমোহন বয়স্যসুলভ পরিহাসে বলেছিলেন—তোমার শিখাটা না নিয়া যদি আমারটা নিত, তবে স্কুলের চাকরি আমারই হইত। ইশ্বরে, এখন স্কুলের পণ্ডিতেও দেড়শো টাকা পায়।

বোবাঠাকুর তখন মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করেছিলেন। তাঁর গালের কষ বেয়ে লালা গড়াচ্ছিল।

পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম—বিলু হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে। বাবা, বাবা গো—ক্ষমা করে দিও গো বাবা…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *