বার
অনঙ্গমোহন বাজার থেকে ফিরে এসে দেখলেন, কেশব শাস্ত্রীমশাই বসে রয়েছেন।
পরিদর্শকরা তো এরকমভাবে হঠাৎই আসেন। সামনের মাদুরে অসীম এবং বিলু বসে আছে। কি জিজ্ঞাসা করেছে কে জানে? অনঙ্গমোহন লজ্জিত হয়ে বাজারের থলে সমেত হাতজোড় করে নমস্কার করলেন।
—আরে দেড়ঘণ্টা বসে আছি, অ্যাতক্ষণ কী বাজার করলেন, অ্যাঁ? বাজারে তো কোনো দ্রব্য স্পর্শ করা যায় না। গতকাল দেখি, কাঁচকলা তিরিশ পয়সা জোড়া। হেতু জানেন?
—না।
কালকের খবর কাগজে লিখেছে, কোনো এক ভোজনসভায় মন্ত্রীরা কাঁচকলার তিন পদ খেয়েছেন। কাঁচকলার সেদ্ধ, কাঁচকলার কালিয়া, আর কাঁচকলার কোপ্তা। হয়ে গেল তিরিশ পয়সা জোড়া। শুধু কাঁচকলা নয়, প্রতিটি জিনিসের দামই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বাজার করা এখন বিড়ম্বনা বিশেষ। আলু ষাট পয়সা। উচ্ছে এক টাকা। মাছে তো হাতই দেওয়া যায় না।
আজ অনঙ্গমোহনের এতটা দেরি প্রকৃতপক্ষে মাছেরই জন্য। ট্যাংরা মাছ উঠেছিল। পুজোর পর ট্যাংরা মাছের গায়ে লাবণ্য আসে। লাবণ্যসুষমাময় ট্যাংরা মাছগুলিকে জলকেলিরত দেখতে পেয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন অনঙ্গমোহন। দাম জিজ্ঞাসা করতে ভয় পেলেন। তবু জিজ্ঞাসা করলেন। জানলেন, চার টাকা। দেখলেন কয়েকটা মাছ তার মধ্যে পঞ্চত্ব পেয়েছে। অনঙ্গমোহন জিজ্ঞাসা করলেন, মরাগুলি? মরাগুলো তিন টাকা করেই দিন। মরা মাছগুলো বেছে রেখেছিলেন অনঙ্গমোহন। সদ্যমৃত মাছ। আর মাছ তো মেরেই খেতে হয়। অনঙ্গমোহন দেখেছিলেন, আরও বেশ কয়েকটি মাছ বেশ মুমূর্ষু। একটু অপেক্ষা করলেই মরছে এবং মরার সঙ্গে সঙ্গেই তিন টাকা কিলো হয়ে যাচ্ছে। মাছগুলো অনঙ্গমোহনের ইচ্ছায় মরছিল না। ওরা যতক্ষণ পারছিল, বেঁচে থাকছিল। মাছগুলি মরতে দেরি করছিল।
অনঙ্গমোহন কালান্তক যমের মতোই দাঁড়িয়েছিলেন ঐ মাছ বাজারের চাতালে। একটি করে মাছ মরছিল আর অনঙ্গমোহন সেই মৃতদেহটি ছিনিয়ে নিচ্ছিলেন। অনঙ্গমোহন মনে মনে মাছেদের মৃত্যুকামনা করছিলেন, কিন্তু মাছগুলো মরতে চাইছিল না। এইভাবেই দেরি হয়ে গেল অনঙ্গমোহনের।
কেশব শাস্ত্রী বললেন—খাতাপত্র দিন। চাকরি বাঁচাই।
অনঙ্গমোহন খাতাগুলি দিলেন।
—মোটে পাঁচটা স্টুডেন্ট। আরও বাড়ান। আরও তিন-চারটে নাম ঢুকিয়ে দিন।
—আর যে ছাত্র নাই আমার।
—ঢুকিয়ে রাখুন না, তাতে আপনারও সুবিধা হয়, আমারও হয়। নাম বলুন, আমিই লিখে রাখি।
—ঐ একটা নাম লিখতে হয় না? জীবন মজুমদার। সে কিছুদিন পড়ছিল।
-পড়েছিল কি পড়েনি এসব ভাবলে চলবে না। যে কোনো নাম ঢুকিয়ে দিন। মনে করুন, গজপতি তলাপাত্র। তারপর কয়েকদিন প্রেজেন্ট দেখিয়ে পরীক্ষার আগে আগে অ্যাবসেন্ট করিয়ে দিন। পরীক্ষা দিতে পারেনি। ছাত্র বেশি থাকলে টোলের মেনটেনেন্সের জন্য একটা এককালীন ভাতা পাবেন।
—এটা তো তঞ্চকতা হয়।
-তঞ্চকতা কী আবার! সরকারের টাকা সব্বাই লুটেপুটে নিচ্ছে, আর পণ্ডিত নিলেই দোষ? পণ্ডিতরা হল সবচেয়ে নেগলেকটেড কমিউনিটি। এরা আইন জানে না। আইনের ঘোরপ্যাচ জানে না। সুতরাং আমি যতক্ষণ পারি, যতটা পারি সাহায্য করি। আমি এ জন্য কোনো উৎকোচ গ্রহণ করি না। আরও দুটো নাম যোগ করে রাখবেন। আপনার ছাত্রীরা কোথায়?
—একটি তো হরি ঘোষ স্ট্রিটে থাকে। সেই উপাধি দিবে এবার। আর অন্যটি ইস্কুলে গেছে। আমার নাতনি।
-ও। নাতনিকেও টোলের ছাত্রী বানিয়ে দিয়েছেন, তাহলে আর এতক্ষণ নাটক করছিলেন কেন পণ্ডিতমশাই? আপনার অন্য দুটি ছাত্রের মধ্যে একটি হল আপনার নাতি অন্যটি শ্যালকপুত্র। সবই তো স্বজন। আরও দুটো নাম যোগ করুন।
-আপনার ধারণা ঠিক নয় শাস্ত্রীমশাই। আমার টোলে যারা আছে, তাঁরা প্রকৃতই ছাত্র। আর অসীম শ্যালকপুত্র হলেও ছাত্র। আবাসিক ছাত্র। গুরুকুলে যেমন হইত।
— কেশব শাস্ত্রী হাসলেন। তা বেশ। তা বেশ।
অনঙ্গমোহন অঞ্জলিকে চা করতে বলে অসীমকে আট আনা পয়সা দিয়ে পাঠালেন মিষ্টি আনতে। এখন ছানার তৈরি মিষ্টি পাওয়া যায় না। মিষ্টান্ন নিয়ন্ত্রণ আইন নামে একটা আইন তৈরি হয়েছে। সেই আইনের ফলে ছানার মিষ্টি তৈরি করা বেআইনি হয়ে গেছে। গজা, লাড্ডু, অমৃতি এইসব বিক্রি হয় এখন।
কেশব শাস্ত্রী বললেন—সবই সই করে দিলাম। লিখে দিলাম—অহো চতুষ্পাঠী মিমামবলোক্য নিতরাম আহ্লাদিতেহস্মি। বিহগানাং কুজনব ছাত্রানাং রবাঃ শ্রায়ন্তে। আরও লিখলাম—আচার্যশ্চ স্বয়ং তত্ত্বাবধান করোতি। আর কী লিখব বলুন। আমি কোনো উৎকোচ গ্রহণ করি না। বলতে পারেন, এটা একটা ব্রাহ্মণসেবা। ব্রাহ্মণসেবাই তো ধর্ম, না কি বলেন?
কী বলবেন অনঙ্গমোহন? সেবা যে ধৰ্ম এটা তো সর্বজনগ্রাহ্য কিন্তু কেবল ব্রাহ্মণ সেবাই যে ধর্ম, একথায় হ্যাঁ হ্যাঁ বলেন কী করে?
কেশব শাস্ত্রীমশাইয়ের বক্তৃতা থামে না। বলেন, সরকার তো পণ্ডিতদের সাহায্য দিচ্ছে। ভাল ছাত্রদের স্কলারশিপও দিচ্ছে। শুনেছি নাকি, রেডিওতে দিনে দুবার করে সংস্কৃতে খবর পড়া হবে। আরে কার জন্য খবর হবে, কে শুনবে খবর? জল শুকিয়ে গেলে আর সেতু বেঁধে লাভ কী? পয়োগতে কিং খলু সেতুবন্ধনে? এই যে রাষ্ট্রভাষা হিন্দি করে দিল, কেন? সংস্কৃতই তো করতে পারত।
অসীম চা নিয়ে এল, বিলু মিষ্টি। পাথরের গ্লাসে চা, পাথরবাটিতে মিষ্টি। অনঙ্গমোহন পুলকিত হলেন। অঞ্জলির বুদ্ধিমত্তা দেখে মাঝে মাঝে চমৎকৃত হন অনঙ্গমোহন। কেশব শাস্ত্রীমশাইও পুলকিত হলেন। চামৃত এসে গেছে? বেশ। আর মিষ্টি দেখেই বললেন, এ যে দেখি প্রফুল্লভোগ। রাঙা আলুর পাস্তুয়া না? বিলু বলল, হ্যাঁ স্যার। দোকানদার বলল, প্রফুল্লভোগ নিয়ে যাও, কাঁচকলা রাঙাআলু মিশিয়ে তৈরি।
কেশব শাস্ত্রী মশাইকে রাস্তায় নেমে এগিয়ে দিলেন অনঙ্গমোহন। নেতাজি সংঘের সামনে সাঁটা খবর কাগজে দেখলেন রাশিফল। প্রত্যাশিত ফল লাভ ও মনোবাঞ্ছা পূরণ। অর্থাগম। বেশ মিলে গেল। কে বলে রাশিফল মেলে না?
মনে বেশ সুখ ছিল অনঙ্গমোহনের। তাই খাওয়া-দাওয়ার পর জনৈক ধীরানন্দ রায়ের চিঠির প্রতিবাদে একটি প্রতিবাদপত্র লিখতে বসলেন। ধীরানন্দবাবু লিখছেন, বর্তমানে বাংলা ভাষার বানানের সংস্কার করা প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। বাংলা ভাষা একটি স্বাধীন ভাষা। সংস্কৃতের পুচ্ছধারী হইয়া চলিলে বাংলা ভাষার স্বাধীন বিকাশ সম্ভব হইবে না।
এই মুহূর্তে আমার কতগুলি প্রস্তাব আছে।
১। ঙ স্থলে ং ব্যবহার : যথা বাংলা।
২। বর্ণের পূর্বে যুক্ত ‘ঞ’র স্থলে ন এবং পর প্রযুক্ত ‘ঞ’র স্থলে গা ব্যবহার যথা অনজন, অগগ্যান।
৩। ঊ, ঋ, ৯, ঐ, ঔ, ঙ, ঞ, ণ, স, ষ, য, ক্ষ বর্ণগুলিকে বাদ দেওয়া।
৪। ঐ স্থলে ওই, উ স্থলে অউ, ক্ষ স্থলে কখ…
এ তো সম্পূর্ণ অরাজকতা আহ্বান করছেন ধীরানন্দবাবু। আর বসুমতীর মতো কাগজ এই চিঠি ছাপল কী করে?
অনঙ্গমোহন লিখতে শুরু করলেন—সম্পাদক সমীপেষু, গত সতেরই নভেম্বর ১৯৬৫ তারিখে জনৈক ধীরানন্দ রায়ের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত চিঠিখানি পড়িয়া যারপরনাই আশ্চার্যান্বিত হইলাম। সন্তানের মুখাবয়ব তাঁহার মাতার অনুরূপ হইবে তাহাতে আশ্চর্য কী? বরং না হওয়াই আশ্চর্যের। তদ্রূপ, সংস্কৃত ভাষা বাংলা ভাষার জননী। সুতরাং সংস্কৃতের অনুরূপ বর্ণমালাই থাকিবে। সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে স্বাবলম্বী হয় কিন্তু পূর্ণ বয়সের পূর্বেই যদি উচ্ছৃঙ্খল হয় তবে তাহা নিন্দনীয়। ধীরানন্দ রায় বাংলাভাষাকে উচ্ছৃঙ্খল হইবার কুপরামর্শ দিতেছেন….
শ্লথচরণে অঞ্জলি অসময়ে বাড়ি আসে। ঘরে ঢুকেই স্বপ্নাকে জড়িয়ে ধরে। তারপরই বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। হতচকিত ঘাবড়ে যাওয়া স্বপ্না ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারে না। কেবলই জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে মা?
অঞ্জলি কান্নাগলায় বলে—আমাদের কী হইবরে স্বপ্না…
বারান্দা পেরিয়ে দরজার চৌকাঠের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে পরিতোষ যশ। বিহ্বল অনঙ্গমোহন তার কাছে জিজ্ঞাসা নিয়ে দাঁড়ান।
সেই সময় অঞ্জলি বলে, আমার আর চাকরি নাইরে স্বপ্না…
পরিতোষ যশ ধীরে ধীরে বলল—লক আউট। আজ সকাল বেলা থেকে। শুনেই অঞ্জলি অজ্ঞান হয়ে গেছিল।
কারখানা বন্ধ হয়ে গেল কেন, হঠাৎ? অনঙ্গমোহন জিজ্ঞাসা করলেন।
হঠাৎ নয়। আরও আগেই হয়তো বন্ধ করে দিতে হত কিন্তু সরকারের ঐ আইনটা পেয়ে গিয়ে…
কী আইন?
মিষ্টান্ন নিয়ন্ত্রণ আইন। রসগোল্লা, সন্দেশ, যত সব ছানার মিষ্টি—সবই বেআইনি হয়ে গেল কিনা, আমাদের কোম্পানি তো টিন তৈরি করে। বড় বড় মিষ্টি কোম্পানিগুলো রসগোল্লার টিন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাতেই মালিক মওকা পেয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।
—আর খুলবে না?
—জানি না।
এই ‘জানি না’ কথাটা শুনেই অঞ্জলির কান্নার শব্দ বেড়ে গেল। তখন পরিতোষ যশ ঘরের ভিতরে ঢুকল।
চৌকিটার সামনে গেল। অঞ্জলির মাথায় হাত দিল। বলল—অ্যাই, চোখ মোছ, চোখ মোছ।
—কারখানা আর সত্যি সত্যি খুলবে না পরিতোষবাবু?
—আরে খুলবে খুলবে। ইউনিয়ন কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে নাকি? —যদি না খোলে?
—ধুর, অত চিন্তার কী?
গলার স্বর গাঢ় আর ঘন করে পরিতোষ যশ এবার বলল—আর আমি তো আছি। অনঙ্গমোহনের সারা শরীর ঝিনঝিন করে উঠল। অনঙ্গমোহন বলতে পারলেন না আরে তুমি কেন, আমিই তো আছি। আমি তো মৃত নয়। আমি, পণ্ডিত নীলকমল ভট্টাচার্যের পুত্র অনঙ্গমোহন। আমাকে অবলম্বন কর। একথা অনঙ্গমোহন বলতে পারেন না। কারণ, অনঙ্গমোহন সংস্কৃত ভাষা ছাড়া আর অন্য কোনো কিছু জানেন না। আর সংস্কৃত ভাষার কোনো বিনিময় মূল্য নেই। সংস্কৃতভাষা অনঙ্গমোহনের মতোই অসহায়। স্বপ্না, তোমার মাকে ওঠাও। একটু দুধ খেতে দাও।
দুধ! আড়চোখে স্বপ্না চাইল ওর দাদুর দিকে।
অনঙ্গমোহন লজ্জা পেলেন। একপো দুধ রাখা হয়। চায়ের জন্য সামান্য রেখে বাকিটা সকালে খেয়ে নিয়েছেন অনঙ্গমোহন। রোজই খান। সামান্য একটু দুধ না হলে চলে না। অনঙ্গমোহন বললেন, ঈশ্বর, আমারে মরণ দাও। মরণ।
আপনি কেন মরবেন! বরং আমার মরে যাওয়া উচিত। আপনি বেঁচে থাকুন। অনঙ্গমোহন জানেন, এটা ব্যাজস্তুতি। আপনি বেঁচে থাকুন এর অর্থ আপনি মরুন। কিন্তু মৃত্যু তো ইচ্ছাধীন নয়। অঞ্জলি বলল—আপনি আর আপনার অসীম থাকেন এখানে, বরং আমি আমার ছেলেমেয়ে দুইটারে লইয়া ভিখারি হইয়া যাই। অনঙ্গমোহন রিপু বশবর্তী হন। শরীরের ভিতরে বুজকুড়ি কাটে দ্বিতীয় রিপু ক্রোধ। চোখ থেকে বের হয় ব্রহ্ম তেজ। যেদিকে দৃষ্টি দেবেন সেই দিক ভস্ম হয়ে যাবে। পশ্চিমে দৃষ্টি দিলেন। ঐ স্থানে সাড়ে সাত টাকায় কেনা হলক কাঠের বইয়ের তাক। ঐখানে জ্বলতে লাগল কাব্য কামধেনু শতশ্লোকচন্দ্রিকা, মুগ্ধবোধম। পশ্চিমে দৃষ্টি হানলেন অনঙ্গমোহন, তক্তপোশের তলায় ধূলিধূসরিত কিরাতার্জনীয় পুড়ে যায়। হা ভারবি হা ভারবি। পুড়ে যায় ফ্যাকাশে মলাটে মোড়া বাসবদত্তা। ভস্ম হয়ে গেল জীবানন্দ বিদ্যাসাগর কৃত টীকা সম্বলিত নৈষধচরিত। ঐ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন যেন খাণ্ডব দহনে সর্বস্ব হারানো উদ্ভ্রান্ত কিরাতপুত্র। উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে থাকেন অনঙ্গমোহন। অকালবর্ষণ হয়ে গেছে একটু আগে। পিচপথ সিক্ত। আকাশে মেঘ। যাও মেঘ, তুমি নীলকমলের কাছে যাও, তারে কও, বাগবাজারের খালপাড়ে খাড়াইয়া খাড়াইয়া তোমার পুত অনঙ্গমোহন কান্দে। তারে কও, অনঙ্গমোহন আজ পরাজিত। তারে কও, তোমার শব্দবন্ধ মিথ্যা। মিথ্যা কলাপ পাণিনি। মনু সংহিতা মিথ্যা। মিথ্যা পরাশর। নৈষধের পদলালিতা মিথ্যা। মিথ্যা যমক অনুপ্রাস। সমাস কী কাজে লাগে? ব্যুৎপত্তি, সন্ধি? এরে দিয়া জুটে না পচা পুঁটি মাছ। টুলা পণ্ডিতের সন্তান না হইতাম যদি, জিলাপি বানাইতে পারতাম যদি, ফুলুরি, বেগুনি, যদি রিকশাচালক হইতাম, গলায় গামছা, সাংখ্য না পড়তাম যদি, যদি না পড়তাম জৈমিনি সংহিতা, পূর্ব মীমাংসা, ঘটের মধ্যে, তিন আনার ঘটের মধ্যে যদি আবাহন করতে পারতাম ঐরাবত সমেত ইন্দ্রদেব, যদি হ্রীং মন্ত্রে, প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম মৃন্ময় পুত্তলের, যদি হাতে সাজি আর ফুল লইয়া দোকানে দোকানে ফুল ছিটাইতে পারতাম, দোকান মালিকের কপালে পরাইয়া দিতে পারতাম যদি দশনয়ার চন্দন তিলক, টাকার ড্রয়ারে যদি ছিটাইতে পারতাম গঙ্গাজল, বিন্দু, কুট্টনী হইতাম যদি, যদি হইতাম বেশ্যার দালাল, উঃ, কলের মিস্ত্রি ও যদি হইতাম…
হে মেঘ, হে বাগবাজারের মেঘ আমার উপায় বল।
অনঙ্গমোহন একা একা হাঁটেন।
বেসন মাখছে তেলেভাজাওলা, লোহার কারখানায় ঘড় ঘড় শব্দে ফুটো হয়ে যাচ্ছে লোহা, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিস, পানের দোকানে খেলার রিলে হচ্ছে। পৃথিবীটা কী সুন্দর, সংস্কৃত ভাষা ছাড়াই চলে যাচ্ছে। নিজেকে অনাবশ্যক মনে হয়। আবর্জনা মনে হয়। রাস্তার লঘু আর বিক্ষিপ্ত বাতাসে উচ্ছিষ্ট শালপাতার ছ্যাঁচড়ানির মতো অনঙ্গমোহন হাঁটতে থাকেন।
হাঁটতে হাঁটতে পৌছে যান হরি ঘোষ স্ট্রিটে। অনঙ্গমোহনের টায়ার চটির মৃদু শব্দও চিনে গেছে সুমিতা। এগিয়ে এসে বলবে এসেছেন? আশায় ছিলাম আসবেন। মন বলছিল।
অনঙ্গমোহন বলবেন, বাঃ। বেশ আলঙ্কারিত বাক্য ব্যবহার করতাছ তো…বেশ।
এখন কালিদাসের কাব্যে শ্লেষ ও যমকের ব্যবহার দেব। এখানেই অনঙ্গমোহনের আশ্রয়। এখানেই আনন্দ। আঃ, আনন্দ। মহর্ষি ভৃগু। তুমি ঠিক কথা, রাইট কথাই বলেছিলে। আনন্দোব্রহ্ম। আনন্দই ব্রহ্ম।