চতুষ্পাঠী – ৪

চার

শ্মশানে জ্বলন্ত পাটকাঠি হাতে কামাখ্যা পুরোহিত বলছিলেন, আস বিলু, অগ্নি ধর। মুখাগ্নি করতে হবে। বৌমা, শোক সংবরণ কর। শব প্রদক্ষিণ কর। অঞ্জলি তার দু’বাহু দিয়ে বিপ্লব ও স্বপ্নাকে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছিল। ডুকরে কাঁদছিল। কেবলই বলছিল, তোদের কী হবে…

১৯৪৭ সালের আগে যারা জন্মেছে তাদের মধ্যে স্বপন নামের কোনো ব্যক্তি দেখা যায় না। স্বাধীনতার পর যে প্রজন্ম, তাদের বাপ-মা’রা তাদের আগামী প্রজন্মকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। এই কারণেই কি জগদীশ তার সন্তানদের নাম রেখেছিল স্বপ্না, বিপ্লব! জগদীশের ভাসা ভাসা চোখে কি প্রত্যাশা ছিল? কী স্বপ্ন? কী বিপ্লব?

জগদীশের চোখ তুলসীপাতায় ঢাকা। সাজানো চিতায় শুয়ে আছে জগদীশ। অনঙ্গমোহন স্থির। রবিবাবুর যেখানে দাহকার্য হয়েছিল সেখানে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। হে ভৈরব শক্তি দাও, ভক্ত পানে চাহ—রবিবাবুর গান মনে পড়ল অনঙ্গমোহনের। অনঙ্গমোহন কামাখ্যা পুরোহিতের ঐ আহ্বান আবার শুনলেন—আস, আসরে ভাই বিলু। অগ্নিশলাকা হাতে লও। অনঙ্গমোহন চোখ বুজে থাকেন। মনে মনে শংকরাচার্যের মোহমুদগর থেকে কিছু শ্লোক মনে করার চেষ্টা করতে থাকেন। কিছু মনে পড়ে না, বরং বাবা, আমি বাঁচুম, আমারে বাঁচান…জগদীশের ঐ ক্রন্দন কাতর আর্তি জপমালার মতো ফেরে। মৃত্যুর আগের দিনও বাঁচার তীব্র অভীপ্সা জানিয়েছিলেন জগদীশ। অনঙ্গমোহন পারেননি। পারেননি ছেলেকে বাঁচাতে। নিজের স্ত্রীকেও পারেননি। জগদীশ তবু ক’টা দিন সুযোগ দিয়েছিল। সুরবালা সেই সুযোগটুকুও দেননি। জীবন এরকমই। নলিনীদলমধ্যস্থিত জলের মতোই অনিত্য।

নলিনী দলগত জলমতি তরলং তজ্জীবন মতিশয় চপলং—এই তো মনে পড়ছে মোহমুদগরের শ্লোক। না ভোলেননি তো, ভুলতে কি পারেন? তো মনে এল কা তব কান্তা কস্তে পুত্ৰ…

দাদু আঠারো টাকা বাকি আছে কাঠের দাম, দিয়ে দিন। শ্মশানের লোকটা বলল। অনঙ্গমোহন পোড়ামাংস গন্ধমাখা বাতাসে ওঁর দীর্ঘ নিঃশ্বাস মিশিয়ে দিয়ে থলের মধ্যে হাত ঢোকালেন। হে চণ্ডাল, আমার প্রিয়পুত্রের প্রেতকার্যাদি সুসম্পন্ন করিয়া দেও। আমি যথাসর্বস্ব দিব। রাজা হরিশচন্দ্র নাটকের অনুবাদ করেছিলেন অনঙ্গমোহন তাঁর যৌবনে। পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠীর ছাত্ররা অভিনয় করেছিল দেওয়ানজী বাড়ির আঙিনায়। অনঙ্গমোহন তাঁর ছিটকাপড়ের থলের মধ্যে হাত ঢোকালেন। মধুর শিশি, ঘৃতের কৌটা, খবরের কাগজে মোড়া তিল, যব, চন্দনকাঠ ইত্যাদির ভিতর থেকে একটা রুমাল বের করলেন, রুমালের মধ্যে লাল সুতোয় লেখা পতি পরম গুরু। সুরবালা সুতোয় সুতোয় লিখেছিল। যত্নে রাখা রুমালে ছিল আরও কিছু টাকা।

বল, মন্ত্র বল…দহেয়ং সর্বগাত্রানি দিব্যানলোকান স গচ্ছতু। এইবার শবমুখে অগ্নিপ্রদান কর। মুখে আগুন দাও, মুখে আগুন দাও বিলু-অঞ্জলির তখন ধুলায় আঁচল হাওয়ায় দুহাত। হুতাশন লেগেছে শরীরে। অঞ্জলি আছাড়ি বিছাড়ি খায়। এরকম করবেন না বৌদি। উঠে দাঁড়ান। শক্ত হতে হবে।

অঞ্জলির কাঁধে হাত। পরপুরুষের। কার হাত চেনে না অঞ্জলি।

আমরা জগদীশদার অফিসেরই লোক। এত ভেঙে পড়ছেন কেন, আমরা তো আছি। আমার নাম শ্রী পরিতোষ যশ।

অঞ্জলি দুহাতে মুখ ঢাকে। সংসারটা ভাসাইয়া দিয়া গেল। বাচ্চা দুইটা নিয়ে কোথায় দাঁড়ামু।

তা আমরা কি ভাবছি না? পরিতোষ যশ বলল।

তারপর চিতার ছাইয়ে কানাকড়ি ছিটিয়ে জল ঢেলে স্নান সেরে ঘরে ফিরল বিলুরা। সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল শিখার মা। হাতে বঁটি, দা, কেরোসিন কুপি। লোহা ছুঁয়ে, আগুন ছুঁয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। শিখার মা জড়িয়ে ধরল হঠাৎ বিলুর মাকে। ওরা জড়াজড়ি করে অনেকক্ষণ কাঁদল। পরিতোষ যশ বিলুর কানের কাছে মুখ দিয়ে বলল-পরশু আসব।

বিলু ঐ লোকটার মুখের দিকে চাইল মাথা উঁচু করে। চাষীরা যেমন করে মেঘ দেখে। মেঘে বৃষ্টি হবে কি না দেখে। তখন দৈববাণীর মতো ভেসে এল—চিন্তা করো না-চিন্তা করো না, আমি আছি। বিলুর মাথার চুলে বিলি কেটে দেয় ঐ লোকটা।

—কোন ক্লাসে পড়?

—সিক্‌স।

—ইশ্‌শ।

পরিতোষ যশ এসেছিলেন কিছু ফলফলাদি নিয়ে। অনঙ্গমোহনকে প্ৰণাম করতে গেলে অনঙ্গমোহন পিছিয়ে গেলেন, প্রণাম গ্রহণ করলেন না। অশৌচ অবস্থায় প্রণাম গ্রহণ নিষেধ। বিলু একটা ধুতি পরে, আলুথালু বসে ছিল। হাতের চেটো শুকনো সর্দির কারণে চটচটে। গলায় বাথরুমের খারাপ হয়ে যাওয়া তালাটার চাবি ঝোলানো রয়েছে। কাঁধের কাছটা ভীষণ জ্বালা করছিল বিলুর। কারণ গতকাল রাত্রে নিজের গলাটা খামচে ধরেছিল। নিজেই।

পরিতোষ যশও মৃদু হাসলেন বিলুর দিকে তাকিয়ে

স্বপ্নার কী বুদ্ধি। ও তাড়াতাড়ি শিখাদের ঘর থেকে চেয়ারটা নিয়ে এল। যশবাবু চেয়ারে বসলেন না। চেয়ারের হাতলটা ধরলেন। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ। তারপর বললেন, এরকম কী করে হল।

বিলুর গলার কাছে আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত আটকে রইল। খড়খড়ে মেঝেতে কাটল নখের আঁচড়। ভীষণ খাটতে পারতেন জগদীশদা। চেহারা তো ভালই ছিল। এরকমটা হবে আমরা ভাবতেই পারিনি। আমি, আমিই। রাস্তায় পড়ে যাওয়া সন্দেশ আমিই দিয়েছি বাবাকে। বিলু কখনোই কাউকেই বলতে পারবে না একথা। ও খড়খড়ে মেঝেতে নখের আঁচড় কাটে। অনঙ্গমোহন তাঁর হাতটা ক্রেনের মতো কপালের দিকে নিয়ে যান। কপালের উপরে গিয়ে হাতটা স্থির থাকে। মুখে শুধু বলেন-বিধিলিপি। পরিতোষবাবু পকেট থেকে একটা প্যাকেট বার করলেন।

পঁচাশি আছে। ছোট কোম্পানি আমাদের। আমরা চাঁদা তুলে এটুকু জোগাড় করলুম। মালিককে বলেছি, কিছু আদায় করব। আপনাদের ক’দিনে কাজ?

দশ দিনে।

এর আগেই কিছু দিয়ে যাব।

অনঙ্গমোহন বললেন—তারপর?

পরিতোষবাবু কিছু না বুঝে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

—তারপর কী হইবে আমাদের?

পরিতোষ যশ মাথা নিচু করে।

আমি চাকরি করব, আমার হয় না চাকরি? বিলু হঠাৎ বলে ফেলল।

বিপ্লব না তোমার ভাল নাম?

হুঁ।

তুমি তো পড়াশোনায় খুব ভাল। জগদীশদা তোমার কথা খুব বলতেন। তুমি পড়।

কী করে পড়ব?

হঠাৎ গলার স্বর চড়ালেন অনঙ্গমোহন। এই কথা ক্যান?

ইস্কুলের মাইনে?

আমি কি মইর‍্যা গেছি নাকি? আর ইস্কুল ছাড়া পড়া যায় না নাকি। আমার চতুষ্পাঠী নাই? আমার চতুষ্পাঠীতে তিরিশজন ছাত্র পড়ত, এক কালে।

চতুষ্পাঠী? মানে—ইয়ে? টোল?—পরিতোষ যশ যেন অবাক হয়।

বিরামের দোকানের স্বপন আর ভজা দু’জনেই বিলুরই বয়সী। ওরাও তো চাকরি করছে। বিলু মনে মনে ভাবে। ওর বাবার কোম্পানির সঙ্গে কত বড় বড় সন্দেশ রসগোল্লার দোকানের যোগাযোগ। এই কোম্পানি টিনের কৌটো তৈরি করে। বড় বড় রসগোল্লার দোকানগুলো ঐ টিনে রসগোল্লা ভরে বাইরে চালান দেয়।

আপনি চাকরি করবেন-বৌদি? পরিতোষ যশ অঞ্জলিকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করে।

আচমকা এই প্রশ্নে কেমন হতভম্ব হয়ে যায় অঞ্জলি। অনঙ্গমোহনও দেশভাগে গান্ধীর নীরব সম্মতি। অর্থাৎ পার্টিশন ফাইনাল। ‘আপনে কোনদিকে থাকবেন পণ্ডিতমশায়?’ দত্তপাড়া স্কুলের হেডমাস্টারের আচমকা প্রশ্নে এইরকমই নীরব হয়ে গিয়েছিলেন অনঙ্গমোহন। অঞ্জলি কোনো উত্তর দিল না।

অনঙ্গমোহন বললেন, বৌমা করবে চাকরি?

মালিককে চাপ দিয়ে দেখতে পারি।

তখনই হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল অঞ্জলি।

বিলু মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মা চাকরি করবে? এই মা ড্রেস দিয়ে শাড়ি পরবে? জুতোর শব্দ হবে খটখট, কাঁধে ঝুলবে ব্যাগ?

অনঙ্গমোহন তাকিয়ে থাকেন বৌমার দিকে। সারদাচরণ ন্যায়ালংকারের পৌত্রী। বোয়ালিয়ার ন্যায়ালংকার বাড়ির কন্যা—এইটুকুই জেনেছিলেন অনঙ্গমোহন। আর কিছু নয়। জগদীশের বিবাহের জন্য সম্বন্ধ দেখা হচ্ছিল, অনঙ্গমোহনেরা তখন শেঠবাগানের কলোনিতে। বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত মানুষরা তখনও তাদের পরিচয়ের সঙ্গে বয়ে বেড়াত গ্রাম-নাম। যেমন চৌমুহনীর রসময় ঠাকুর, দত্তপাড়ার বরদা কাব্যতীর্থ, সেনাচাকার বৈকুণ্ঠ স্মৃতিতীর্থ কিংবা মাইজদিয়ার অনন্ত চক্রবর্তী। তাঁরা কেউ আছেন ধুবুলিয়া ক্যাম্পে, কেউ লেকের ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে, কেউ দমদম বা যাদবপুরের কলোনিতে। শেঠবাগানের কলোনিতে শ্রীরামপুরের অনঙ্গমোহন শুনলেন, বোয়ালিয়ার ন্যায়ালংকারের গৌরবর্ণ পৌত্রী আছে—ধুবুলিয়া ক্যাম্পে। ব্যস, এটুকুই। আশীর্বাদের দিন দেখেছিলেন পাত্রী যথার্থই গৌরবর্ণা। লাবণ্যময়ী, মুখের বামভাগে একটি ক্ষুদ্র জড়ল। শুভলক্ষণ। জিজ্ঞাসা করেছিলেন— ল্যাখাপড়া করতে পারছনি কিছু মা? মেয়েটি বলেছিল, সিক্‌ছে উঠছিলাম।

কোন ইস্কুলে পড়তা?

ক্যান? বঙ্গবালা!

ঠিকই তো। বোয়ালিয়ার বিখ্যাত নারী শিক্ষা নিকেতন। প্রতিবারই আট-দশ জন করে বালিকা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিত। অনঙ্গমোহন শিক্ষিতা পুত্রবধূ পেয়ে খুশিই হয়েছিলেন।

অঞ্জলি মাটির দিকে তাকিয়ে বলল—আমি কি পারব চাকরি করতে? লেখাপড়া যে জানি না…

—আমাদের টিনের ফ্যাক্টরি। তেমন লেখাপড়ার কী দরকার?

—তবে কি কাজ করবে বৌমা? নারী শ্রমিক?

—এভাবে নেবেন না। বাঁচতে তো হবে। লড়াই তো করতেই হবে। আপনি বৃদ্ধ, ওরা শিশু। তবে?

খুব ভাল লাগল ছেলেটিকে। ওর কথার মধ্যে কেমন সহানুভূতি। জিজ্ঞাসা করলেন আপনের নাম কী?

পরিতোষ। পরিতোষ যশ।

দ্যাশ?

বর্ধমান জেলা।

অনঙ্গমোহনদের আদি পুরুষ বর্ধমান থেকেই গিয়েছিলেন সন্দীপরাজের আমন্ত্রণে। অনঙ্গমোহনরা রাঢ়ী। কুলপঞ্জি থেকে জানা যায় মন্তেশ্বরের কাছে ছিল তাঁদের দেশ। অনঙ্গমোহন জিজ্ঞাসা করে, মন্তেশ্বরের নিকটেই কি আপনার গ্রাম?

না না, বেশ দূরে। আমার গ্রাম গলসীর কাছে।

জমি আছে?

আছে।

ধানের গোলা?

আছে।

গাই-বলদ?

আছে।

পিতামাতা?

আছে।

পরিবার?

দেশে।

অনঙ্গমোহন কেমন যেন কৃতজ্ঞতাপরবশ হন। নিজেরা হল উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষ। এ দেশীয়দের খালি জমি, বাগান, বাগানবাড়ি জবরদখল করছে। পুকুরটুকুর ছারখার করেছে। রাস্তাঘাট নোংরা করেছে। অথচ কত এ দেশীয় মানুষ কতভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অনঙ্গমোহনও পরিতোষের দিকে মনে মনে হাত বাড়ান। যেন লাউ গাছ, আঁকশি বাড়াচ্ছে।

পরিতোষই কথা বলে। জগদীশদা তো টাইপিস্ট ছিল। তা পনের বছরের চাকরি। মালিককে চেপে ধরে একটা কিছু করতেই হবে।

অঞ্জলি, মেঝের দিকে চোখ রেখে বলল—অফিসে উনার টাকাপয়সা কিছু নাই? পরিতোষ বলল—তা তো আছে। কিন্তু বোঝেনই তো, মাড়োয়ারি ফার্ম। ক’পয়সা মাইনে দেয়। প্রভিডেন্ড ফান্ডের নিয়মকানুন কিছুই তো মানত না মালিক। অল্প ক’বছর হল ওসব চালু হয়েছে। তবে কত পাওনাগণ্ডা আছে এখনো হিসাব হয়নি বৌদি। দাদার কাজ মিটে যাক, আপনি একদিন অফিসে আসুন।

অঞ্জলি বাইরের জানালার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। বটগাছে ফল হয়েছে। লাল লাল ফল।

বটের ফল বটের ফল,
গহিন গাঙে কত জল।
পতি কোলে বেউলা যায়
পদ্মবনে হায় হায়।

অনঙ্গমোহন মনঃস্থির করতে পারেন না। সংসারের আয় বলতে চতুষ্পাঠীর সরকারি বৃত্তি। চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের কাছ থেকে দক্ষিণা নেওয়া যায় না। চতুষ্পাঠীর শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অবৈতনিক। সরকারি বৃত্তি যা পেয়ে থাকেন তাতে নিজেরও ব্যয় নির্বাহ হয় না। স্কুলের চাকরি হবার কোনোই সম্ভাবনা নেই অনঙ্গমোহনের। মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরাজি জানাটা বড়ই আবশ্যিক। কিন্তু অনঙ্গমোহন ইংরাজি জানেন না। ইংরাজি শিক্ষা তিনি নেননি। পণ্ডিতের ঘরের সন্তান। তাঁর পিতার চতুষ্পাঠীতেই তাঁর শিক্ষা। অনঙ্গমোহনের পিতা মনে করতেন, সেই শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা মেকলে প্রবর্তিত ঐ ম্লেচ্ছ শিক্ষাব্যবস্থায় অনাবশ্যক পাশ্চাত্য অনুরাগ জন্মে। ইংরাজের হীন অনুকৃত কিছু কুষ্মাণ্ড তৈরি হয়। অনঙ্গমোহন যখন শিশু, প্রতিটি জেলায় ততদিনে ইংরাজি স্কুল তৈরি হয়ে গেছে। ঐ সমস্ত স্কুলে এফ এ পর্যন্ত সংস্কৃত অবশ্যপাঠ্য ছিল। কিন্তু ঐ সমস্ত স্কুলের ঘোর বিরোধী ছিলেন অনঙ্গমোহনের পিতা। ঐ সমস্ত স্কুল ছিল প্রতি জেলায় একটি বা দুটি। ব্যয়সাপেক্ষও ছিল। অন্যদিকে চতুষ্পাঠী ছিল গ্রামে গ্রামে। যেখানেই ২০-২৫টি ব্রাহ্মণ পরিবারের বাস, সেখানেই ছিল চতুষ্পাঠী।

অনঙ্গমোহনের পিতা নীলকমল বিদ্যালংকারের চতুষ্পাঠীটি প্রকৃত অর্থেই চতুষ্পাঠী ছিল। কাব্য, ব্যাকরণ, বেদ এবং দর্শন, চারটি শাখাই পড়ানো হত। সরকারি ‘তীর্থ’ উপাধি ছাড়াও সারস্বত সমাজের অধীনে যে পরীক্ষাগুলি হত তাতেও ছাত্র পাঠাতেন নীলকমল। শলাকা পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষাতেও কৃতকার্য হত তাঁর ছাত্ররা। হাতে লেখা বিভিন্ন পুঁথির মধ্যে একটি শলাকা চালিয়ে দিতেন পরীক্ষক। শলাকার সূচীমুখে যে পৃষ্ঠাটি বিদ্ধ হত তার উপর ভিত্তি করেই হত পরীক্ষা।

সন্দীপের রাজা দান করেছিলেন তিন দ্রোণ নিষ্কর জমি। পিতৃপক্ষে অর্থাৎ মহালয়ার আগে জমিদাররা পণ্ডিতদের বাৎসরিক বৃত্তির জন্য আহ্বান করতেন। শুধু হিন্দু জমিদাররাই নয়, মুসলমান জমিদাররাও এই বৃত্তি দিতেন। তা থেকেই সম্বাৎসরিক ব্যয় নির্বাহ হত। চাহিদাও ছিল খুব কম। মোটা বস্ত্র, সামান্য আহার। ডাল, ভাত আর একটা কিছু। ডাল বলতে খেসারির ডাল। আর তরকারি বলতে কলাগাছের থোড়। যার ডাকনাম ছিল আইল্যা।

‘আইল্যা ভাজা কইল্যার ডাইল’ কথাটা প্রবাদ প্রবচনের মতো ছিল। অর্থাৎ কলাইয়ের ডালের সঙ্গে আইল্যা অর্থাৎ কলার থোড়ের তরকারি।

অনঙ্গমোহনের পিতা নীলকমল বিদ্যালঙ্কার পূর্ববাংলার পণ্ডিতমহলে একটি বিশিষ্ট নাম ছিলেন। বিভিন্ন পঞ্জিকার অনুমোদক মণ্ডলীর মধ্যে তাঁর নাম থাকত। ঢাকার সারস্বত সমাজের সভ্য ছিলেন তিনি। পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলনের জনক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন নীলকমলের স্নেহভাজন। আবদুল রশিদ সাহেব, যিনি আসলে ছিলেন আবদুল রসিদ তর্কবাগীশ, দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভায় স্পিকার হয়েছিলেন, তিনিও নীলকমলের চতুষ্পাঠীতে পড়তে এসেছিলেন। বেদ পড়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু আবদুল রশিদ মুসলমান। মুসলমান বেদ পাঠ করতে পারে না। শূদ্রও পারে না। নীলকমল অনুমতি দেননি। তাই ন্যায় পড়েছিলেন তিনি। সাত মাইল দূর থেকে পড়তে আসতেন আবদুল রশিদ। কিছুদিন পরেই কিন্তু নীলকমল বুঝতে পেরেছিলেন, ন্যায়শাস্ত্রে আবদুল রশিদ অসাধারণ ব্যুৎপন্ন হবে। নীলকমল তাই একটি চিঠি লিখে জীবনানন্দ তর্কালংকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

নীলকমল মুখে মুখে শ্লোক রচনা করতে পারতেন। পিতৃপক্ষে যখন বিভিন্ন জমিদার-বাড়ি দান গ্রহণ করতে যেতেন, তখন মুখে মুখে জমিদার সম্পর্কীয় শ্লোক রচনা করে দিতেন। চট্টগ্রামের বিখ্যাত পণ্ডিত শ্রী রজনীকান্ত সাহিত্যাচার্য ছিলেন নীলকমলের শুভাকাঙ্ক্ষী বান্ধব। চট্টল সংস্কৃত কলেজ এবং ধর্মমণ্ডলী সভার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নীলকমল।

চট্টল সংস্কৃত কলেজ স্থাপনের জন্য রজনীকান্ত সাহিত্যাচার্য অত্যন্ত পরিশ্রম ও অর্থব্যয় করেছিলেন। তৎকালীন জেলাশাসক ম্যাকফার্সন সাহেবের পদোন্নতি হয় এবং কলকাতা চলে আসেন। এর পরিবর্তে জেলাশাসক হয়ে যিনি এসেছিলেন তিনি ঐ সংস্কৃত কলেজটিকে ইংরাজি বিদ্যালয়ে পরিণত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তখন নীলকমল বিদ্যালংকার কলিকাতাস্থ ম্যাকফার্সন সাহেবকে সংস্কৃত শ্লোকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন তা আবার তিনি চট্টল সংস্কৃত কলেজকে উপহার দিয়েছিলেন। ম্যাকফার্সন সাহেবের চেষ্টায় সে যাত্রায় সংস্কৃত কলেজটি রক্ষা পায়।

সুমধুর সংস্কৃত শ্লোকে লেখা ঐ শ্লোকটি বহুদিন পর্যন্ত অধ্যক্ষের ঘরে রাখা ছিল।

অস্মিন সংস্কৃত পাঠ পদম সরসি
তৎ স্থাপিতা যে সুধী
হংসাঃ কাল বশেন পক্ষরহিতাঃ
দূরংগতে তে ত্বয়ি।
তত্তীরে নিবসন্তি সংপ্ৰতি
পূনর্ব্যাধাস্তদুচ্ছিত্তয়ে
তেভ্যস্তান যদি পাসিপালক
তদা কীর্তি শ্চিরং স্থাসাতি।

এই সংস্কৃত বিদ্যায়তনটি যেন একটি সরোবর। তাতে আপনি যে অধ্যাপকদের নিযুক্ত করেছিলেন তারা যেন সব হংস। আপনি দূরে চলে যাওয়ায় তারা আজ নিরাশ্রয়। এখন সেই সরোবরের তীরে কয়েকজন ব্যাধ এসে বাসা বেঁধেছে। তারা সেই হংসগুলিকে ধ্বংস করতে উদ্যত। আপনি যদি তাদের রক্ষা করেন তাহলে আপনার কীর্তি অবিনশ্বর থাকবে।

নীলকমলের তুলনায় অনঙ্গমোহন কিছুই নন। তবু তো সংস্কৃতসেবী অধ্যাপক, তাঁর ঘরেও একটি চতুষ্পাঠী আছে। তাঁর ছাত্রাবাসে একটি ছাত্র আছে। অসীম। আচার্য-গৃহেই খায়, অবস্থান করে।

নিজের একমাত্র পুত্র জগদীশকে ইচ্ছামতো সংস্কৃত শিক্ষা দিতে পারেননি অনঙ্গমোহন। তাঁদের পার্শ্ববর্তী গ্রামেই ইংরাজি স্কুল প্রবর্তিত হল। দত্তপাড়া গ্রামের জমিদার বীরেশ্বর দত্ত জমি দিলেন। জমিতে খেলার মাঠ হল। চর্ম নির্মিত ফুটবল খেলতে লাগল ছেলেরা। জগদীশ বায়না তুলল—ওই ইস্কুলে ভর্তি হবে। ঐ ইস্কুলে কোঠাবাড়ি, ঐ ইস্কুলে ঢং ঢং শব্দ। ঐ ইস্কুলে টেবিলচেয়ার, ব্ল্যাকবোর্ড। আগে ইংরাজি ইস্কুলে পড়তে হলে আট মাইল হাঁটতে হত। এখন দুই মাইলের মধ্যে ইস্কুল হওয়াতে, ছেলেরা সব ঐ ইস্কুলে ভর্তি হল। কায়স্থবাড়ির ছেলেরা, বৈদ্যবাড়ির ছেলেরা তো আগেই দূরের ইস্কুলে পড়তে যেত। এবার ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলেরাও ভর্তি হল দত্তপাড়ার মিডল স্কুলে।

ইংরাজি ইস্কুলে না পড়লে ডেপুটি সাব-ডেপুটি হওয়া যায় না। এমনকি কেরানিও হওয়া সম্ভব না। অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি। হাইস্কুলের সংস্কৃত পণ্ডিতদেরও ইংরাজি জানা চাই। সংস্কৃত শিক্ষকরাও আর টোল চতুষ্পাঠীর পণ্ডিত নয়, ইংরাজি স্কুল-কলেজের আই এ, বি এ নিদেনপক্ষে ম্যাট্রিক ও তৎসহ সংস্কৃত উপাধি। সুতরাং জগদীশও ইংরাজি ইস্কুলে ভর্তি হল এবং গোপনে ঐ স্কুলে সেই বছরই প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালন করা হল। ২৬ জানুয়ারি, ১৯৩০।

জগদীশ ম্যাট্রিক পাস করতে পারেনি যদিও কাব্যতীর্থ হয়েছিল। জগদীশের কাব্যতীর্থ উপাধি পাবার দিন দশেক পরে নীলকমলের প্রয়াণ ঘটে। তাঁর প্রয়াণের আগেই তিনটি কাজ সেরে রেখেছিলেন নীলকমল। ম্লেচ্ছসংস্পর্শ দোষের কারণে একটি প্রায়শ্চিত্য, দত্তপাড়া ইস্কুলের হেডমাস্টারমশাইকে তার নাতির একটি চাকরির জন্য অনুরোধ এবং উপাধি প্রাপ্তির কারণে শ্রীনারায়ণকে এক সহস্র ও আটটি তুলীপত্র প্রদান। নীলকমলের কয়েকটি মুসলমান ছাত্র শুধুমাত্র ছিল, এই কারণেই যে প্ৰায়শ্চিত্ত করেছিলেন তা নয়। মূল কারণ, তাঁর একমাত্র পৌত্র জগদীশ ইংরাজি বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন করেছে, জাতি নির্বিশেষে এক পঙ্ক্তিতে উপবেশন করেছে, স্পর্শিত খাদ্যগ্রহণ করাও আশ্চর্য নয়। এই জগদীশের স্পর্শ করা খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন নীলকমল। এই জগদীশের সঙ্গে পক্তি ভোজনও করতে হয়েছে। জগদীশ আর সবিপ্র নেই। স্কুলের মাস্টারি তো বিদ্যাবিক্রয়। অতঃপর এই পতিত বিপ্র যদি বিদ্যা বিক্রয় করে তবে তার দোষের কিই-বা ইতরবিশেষ হবে?

—‘যুধিষ্ঠির কহিলেন পিতামহ, ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কেহ কেহ স্বকর্ম নিরত ও কেহ কেহ-বা কুকর্মপরায়ণ হইয়াছেন। আপনি তাহাদের বিষয় বিশেষভাবে কীর্তন করুন। ভীষ্ম কহিলেন, ধর্মরাজ, বিদ্বান, সুলক্ষণসম্পন্ন ও সর্বত্র সমদর্শী বিপ্রগণ ব্রহ্মতুল্য। ঋক, যজুঃ ও সামবেদে দীক্ষিত স্বকার্য নিরত ব্রাহ্মণগণ দেবতুল্য আর স্বকার্যবিহীন ব্রাহ্মণগণ চণ্ডালতুল্য।’ বিদ্যাদানের বিনিময়ে যে ব্রাহ্মণ টাকা পয়সা গ্রহণ করে সে ব্রাহ্মণ শূদ্রবৎ। স্কুল মাস্টারাঃ শূদ্রবৎ দ্বিজাঃ। আর জগদীশ, বিলাতি বাহুল্যের ক্রীড়নক, এই তার নিয়তি। জগদীশও বেতনভূক পণ্ডিত। অথচ এই স্কুলে পণ্ডিত পদ প্রাপ্তির জন্য সুপারিশপত্র লিখতে হয়েছে নীলকমলকে। এগুলি অন্যায়। তাই প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন মৃত্যুর আগে। যজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, যে ব্যক্তি পাপ করিয়া প্রায়শ্চিত্য না করে, সে ব্যক্তি ইহলোকের নিকট ঘৃণিত ও পরলোকে ঘোর নরকে পতিত হয়।

নীলকমলের মৃত্যুমুহূর্তে গীতা পাঠ করেছিলেন স্বয়ং অনঙ্গমোহন। নীলকমল মৃত্যুর আগে তাঁর রচিত পাণ্ডুলিপিগুলি দেখতে চেয়েছিলেন একবার। বিদ্যাশতকম, বচঃ পুষ্পাঞ্জলী এবং কবি নবীনচন্দ্র সেনের পরলোক গমনোপলক্ষে রচিত চট্টলাবিলাপম্। পাণ্ডুলিপিগুলি একবার স্পর্শ করেছিলেন। গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিল নীলকমলের। সে ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেল। নীলকমল সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেছিলেন। মৃত্যুর আগে কৃষ্ণনাম জপ করেছিলেন। কিন্তু মুমূর্ষু নীলকমলের ওষ্ঠকম্পনে অনঙ্গমোহনের মনে হচ্ছিল, তিনি বিড়বিড় করেছিলেন চতুষ্পাঠী, চতুষ্পাঠী…

জগদীশের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলপাঠ ছিল বলেই প্রকৃতপক্ষে অনঙ্গমোহনকে অনাহারে কালাতিপাত করতে হয়নি এই সত্য অস্বীকার করতে পারেন না অনঙ্গমোহন। জগদীশ দত্তপাড়া স্কুলে পণ্ডিতদের পদ পেয়েছিলেন নীলকমলের সুপারিশের ফলেই হয়তো। বেতন মাসে আঠার টাকা। দেশ ভাগের পর সরকারি চাকুরিয়াদের অপশন দেবার সুযোগ ছিল। দ্বিখণ্ডিত দেশের ভারত নামক অংশে তারা চাকরি পেয়েছিল। জগদীশের সে সুযোগ ছিল না। কারণ, সে সরকারি চাকুরিয়া ছিল না। নিরালম্ব নিরাশ্রয় অনঙ্গমোহন আশ্রয় পেয়েছিল কলকাতার বিখ্যাত জ্যোতিষী অনন্তনাথ জ্যোতিভূষণের বাড়িতে। তাঁর বাড়িতে সর্বদা দারোয়ান থাকত। তাঁর একটি অতিথিশালাও ছিল। অনন্তনাথ ছিলেন নীলকমলের ছাত্র। পরে শ্রীহট্টে জ্যোতিষ অধ্যয়ন করেন। তিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। ‘বল বল বল সবে’ গানটি শুনতে শুনতে তিনি এক দূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, অনঙ্গমোহনকে কথা প্রসঙ্গে একদিন জানিয়েছিলেন সে কথা। ‘বল বল বল সবে’ গানটির মধ্যে আছে—ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে, ধর্মে মহান হবে, কর্মে মহান হবে…ইত্যাদি। তারপরই আছে তেত্রিশ কোটি মেরা নহি কভু হীন। তখনই অনন্তনাথের মনে হল, তেত্রিশ কোটির মধ্যে অন্তত তিন কোটি বোকা লোক আছে। সুতরাং ভাবনা কী? কলকাতা গেলেন তিনি। তখন যুদ্ধের সময়। ‘জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করিবে।’ ‘চেম্বারলেন পদত্যাগ করিবেন।’ ‘ডানকার্কের পতন হইবে’ এইরকম কয়েকটা ভবিষ্যৎ-বাণী করেছিলেন তিনি। তারপরই পি এম বাগচীর পঞ্জিকায় বর্ষফল, রাষ্ট্রফলের লেখক। মহামান্য পঞ্চমজর্জের স্বাস্থ্য কিরূপ যাইবে, গান্ধীজির সম্ভাব্য বিপদ ও প্রতিকার এই ধরনের প্রবন্ধ লিখতে লাগলেন জ্যোতিষবার্তা পত্রিকায়। সেই অনন্তনাথের এক পরম ভক্ত ছিলেন নগেন মজুমদার। সেই নগেন মজুমদার একদিন এসে জানাল সুসংবাদ। জমি পাওয়া গেছে। শেঠবাগানে। কচুরিপানা ভরা ডোবার সাথে খুঁটি পুঁতে এলেন অনঙ্গমোহন। নগেন মজুমদার দাঁড়িয়ে রইল। বাস্তুহারা পরিষদের গোলচশমামতো একজনকে নগেন মজুমদার বলে দিল—এরা আমার লোক। মুলিবাঁশের বেড়া এবং খড়ের ছাউনি দিয়ে ঘর হল রাতারাতি। নগেনের কয়েকজন লোক গায়েগতরে খেটে দিল। নগেন বলত—কেন পাট্টিশনে ওরা রাজি হল পণ্ডিতমশাই জানেন? পশ্চাদ্দেশ শুড়শুড় করছিল ওদের কখন গদিতে বসবে। আরে মারামারি চলছিল তো কী হয়েছে। ক দিন চলত। পাট্টিশন হয়ে কি মারপিট বন্ধ হবে? চলবেই। দেখুন দিকি এখন কী অবস্থা। ডিম খাচ্ছে দারোগাবাবু, গভভ্যন্ত্রণা হাঁসের। বাজে কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, কিছু মনে করবেন না পণ্ডিতমশাই। নগেনের দেশ ছিল হাওড়া জেলায়। প্রকৃত ঘটি। ও একটা বাঙাল পরিবারের জন্য যা করেছে তা অবিস্মরণীয়। এই পর্যন্তই শেষ নয়। কালিকলের বনমালীবাবুর বাড়িতে এই নগেনই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শেঠবাগানের কলোনিতে দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগেই থাকত। আসলে ঐ জমি ছিল শোভাবাজারের শীলদের। উচ্ছেদের জন্য নানা প্রক্রিয়া ক্রমাগতই চলছিল। একবার কয়েকটি ঘরে আগুনও লাগানো হয়েছিল। জগদীশের তখন সদ্য বিবাহ হয়েছে। নগেন বলেছিল—আমনারা হলেন পণ্ডিত ফ্যামিলি। এসব জায়গায় আমনারা পারবেন না। অন্য জায়গায় দেখে দিচ্ছি। কিছু ভাড়া দিতে হবে।

ভাড়া দিয়ে থাকা সম্ভব হয়েছিল জগদীশের ইংরাজি জানার ফলেই। সামান্য হলেও সে ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত, সে কারণেই শিয়ালদহর নস্করদের মাছের গুদামের ম্যানেজারের চাকরি পেয়েছিল। নস্কররাও ছিল অনন্তনাথের ভক্ত। অনন্তনাথের কথা ফেলতে পারেনি নস্কররা। নামে ম্যানেজার হলেও বেতন ছিল যৎসামান্য। জগদীশ টাইপ শিখতে শুরু করে। তারপর ঐ টিন কোম্পানিতে চাকরি।

কোনো জাগতিক ঘটনাই মানুষের ইচ্ছানুযায়ী ঘটে না। জগদীশ্বরের ইচ্ছা-নির্ভর এই জগৎ। জগদীশ্বরের ইচ্ছা এই কথাটা ভাবতেই খবর কাগজের চন্দ্রযাত্রী দুই মানুষের ছবির কথা মনে পড়ল। কবে যেন হিমালয় শৃঙ্গ এভারেস্টে তেনজিং না কে যেন উঠে গিয়ে মানুষের পতাকা ধরিয়ে এসেছে। জগদীশ্বর কোথায় থাকেন? কোথায় দেবভূমি? আর দেবতা বৃত্তান্ত যদি নেহাত কবি-কল্পনাই হয়, কেবল ব্ৰহ্মই সত্য হয়, তবে ব্রহ্মের স্বরূপ কী? স্থানং ন মানং ন চ নাদ বিন্দু রূপং ন রেখা ন…শোনাও যায় না, দেখাও যায় না—নারীও নহেন, পুরুষও নহেন—লিঙ্গমূর্তি নহেন। ব্ৰহ্মাণ্ড বিষ্ণু ন চ—যিনি ব্রহ্মাও নন, বিষ্ণুও নন সেই ব্রহ্মকে নমস্কার। শঙ্করাচার্যের ব্রহ্ম তো এইরকম। রঙ নাই, রূপ নাই, ঘন নহেন, শূন্য নহেন, ব্যক্ত নহেন, অব্যক্ত নহেন, তিনি তবে কী? এ তো মহা গণ্ডগোলের ব্যাপার। তার আবার ইচ্ছা কী? কিছুই তো বোঝা যায় না। বরং ন স্বর্গো নাপবর্গ বোঝা যায়। চার্বাক বোঝা যায় তাহলে আমি এখন কী করি? কী তা করতাম, কী তা করতাম রে?

অনঙ্গমোহন ভাবেন জীবন বড় জটিল। জীবনক্রম পরিকল্পিত করা যায় না। তবে জীবনের ঘটনাগুলির মধ্যে কার্যকারণ যোগ কিছু আছে। আব্দুল করিম, যে ছিল নীলকমলের মেধাবী ছাত্র, সে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে ভোজন করতে পারত না। বেদ পড়তে অনুমতি দেওয়া হয়নি তাকে। মুসলমান চাষীরা কেউ তাঁদের দাওয়ায় উঠতে পারত না। অনঙ্গমোহনের বাস্তুচ্যুতির পিছনে ইতিহাসের বিধান ছিল। একেই বলা হয় বিধির বিধান। মুকুন্দদাসের গান ছিল—বিধির বিধান ভাঙবে তুমি এতই শক্তিমান, তুমি কি এমনি শক্তিমান। আজ বিধির বিধানে যদি তাঁর পুত্রবধূকে চাকরি করতেই হয়, তাতে আপত্তির তেমন কীই-বা আছে?

অনঙ্গ। অনঙ্গ। নিজের গুয়ে চন্দন লেপতাছ তুমি? তুমি কারে বুঝাও নিজে টিউশনি পার না? যজমানি পার না? পুত্রবধূরে বাজারে নামাইতে চাও ক্যান? চাকরি করা অর্থ কি নামা? অবনমন? এইটা ঠিক কথা নয়। আর আমার কীই-বা করণীয় ছিল? সংস্কৃত ছাড়া তো কিচ্ছুই জানি না আমি। আমি তো অসহায়, জালে পড়ে যাওয়া চিত্রগ্রীব। সংস্কৃতের কোনো বিক্রয়মূল্য নাই। যজন ও যাজনের সঙ্গে সংস্কৃতের যোগ নাই, ঐ সব কর্মপ্রচ্ছায়া মাত্ৰ। হীনকর্ম। ইস্কুলের শিক্ষকতা পাওয়া সম্ভবপর হয় নাই। ম্যাট্রিক পাস ছাড়া ইস্কুলের পণ্ডিতি হয় না।

জগদীশও ইস্কুলের চাকরির চেষ্টা করেছিল। দত্তপাড়া মিডল স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত ছিল। জগদীশ ঐ পর্যন্তই পড়েছিল। কাব্যতীর্থ হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলার স্কুলে কুত্রাপি চাকরি পায়নি। ম্যাট্রিক ছাড়া ‘পণ্ডিত স্যার’ হয় না। সংস্কৃত প্রশ্নপত্রে ইংরাজি থেকে সংস্কৃতে অনুবাদ করতে বলা হয়। অনঙ্গ, এই পৃথিবী বড় সুন্দর। এই পৃথিবীতে দাঙ্গা হয়, পার্টিশন হয়, মহামারী হয়, বন্যা হয়, ধর্ষণ হয়, তবু তো গঙ্গা কলকল, শীত ঋতুর পর খালধারের কৃষ্ণচূড়া শাখায় শির শির করে পাতা, ভগবদলীলায় জারিত জড়িত এই জগতে মরতে আসো নাই, মরতে আসো নাই রে…। জীবন, জীবন রে তুই না থাকিলে তবে সোহাগ করুম কারে। চপলা তটিনী মধ্যে পতিত নিশ্চল প্রস্তরখণ্ডই শৈবালাক্রান্ত হয়। কারণ সে নিশ্চল।

সুতরাং পরিবর্তনশীল জগতের যোগ্য হও। নচেৎ বাঁচব না। সংশয় ত্যাগ কর। ন সংশয়মনারুহ্য নরো ভদ্রানি পশ্যতি। সংশয়ং পুনরারুহ্য যদি জীবতি পশ্যতি। সংশয় অতিক্রম না কইরা কেউ মঙ্গল দেখতে পায় না। সংশয়ের মধ্যে বাঁইচ্যা থাকলেই সে মঙ্গলরে দেখতে পাবে। সুতরাং তুমি অন্নপূর্ণা হও, বৌমা, বৌমা গো।

অঞ্জলিকে নিয়ে ট্রামে উঠেছিলেন অনঙ্গমোহন। অঞ্জলির থানকাপড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি নীল রঙ। কালির কারখানার কালি তৈরির মশলার সূক্ষ্মরেণু বাতাসে ওড়ে। সাদাকাপড় জুড়ে সেই দাগ। বাতাসে কালিমা ওড়ে—অনঙ্গমোহন একবার ভাবলেন। অনঙ্গমোহন ট্রামের হলুদ টিকিটটা পাকাচ্ছিলেন। ফতুয়াটা গায়ে আছে এখন। জামা পরেন না তিনি। ধুতি এবং একটি চাদর, যাকে ভালো কথায় উত্তরীয় বলা হয়, এটাই তাঁর পোশাক। জগদীশ একটি ফতুয়া কিনে দিয়েছিল। অঞ্জলির অনুরোধে এটা গায়ে দিয়েছেন তিনি। ঈষৎ ঠাণ্ডা পড়েছে। দেয়ালের গায়ে রৌদ্রের শোভা। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনাম থেকে হাত ওঠাও। আমার নাম তোমার নাম—ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম কি কম্বোজ? কম্বোজেও সংস্কৃতচর্চা হত। গত সপ্তাহের বসুমতী কাগজে সুনীতিবাবুর প্রবন্ধ পড়েছেন অনঙ্গমোহন। রাস্তার দু’ধারের প্রাসাদ মধ্যবর্তী আকাশ মেঘমুক্ত, কী নীলবর্ণ। গত পরশুর শেষ রাত্রে পাশের ঘর থেকে বীরেন ভদ্রের ভাবগম্ভীর গলায় শুনেছেন—আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ীর আগমন বার্তা। অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোকে ও রসলোকে আনে নব ভাবমাধুরীর সঞ্জীবন। ব্যাকরণে ভুল আছে।

নবভাবমাধুরীর সঞ্জীবন কিন্তু মনে মনে টের পান অনঙ্গমোহন। বৌমার চাকরি হলে নির্বিঘ্নে চতুষ্পাঠী চালাতে পারবেন তিনি। সুমিতা বড়ই আদর্শ ছাত্রী। অসীম আছে, গুরুগৃহে আশ্রিত। জীবন আছে—হোমিওপ্যাথির ডাক্তার, বড়ই সংস্কৃতপ্রেমী। আরও কয়েকজন নিষ্ঠাবান ছাত্র সংগ্রহ করতে হবে।

অঞ্জলি অবগুণ্ঠন সরিয়ে পিছন দিকে তাকাচ্ছে বারবার। বিচলিতা যেন-বা। রাজাবাজার কি পার হয়ে গেল? কন্ডাকটার বললেন, দেরি আছে। মানিকতলার ব্রাহ্মণসভায় মাঝে মাঝে আসেন অনঙ্গমোহন আর যান সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদে। বৃত্তির জন্য তাগাদা দিতে হয়। বৃত্তির নাম হয়েছে ডিএ। ইন্সপেক্টর নলিনীকান্ত মিশ্রও বলেন ডিএ; ডিএ-র সংস্কৃত হল মহার্ঘভাতা। বেতন-এর সঙ্গে ডিএ সংযুক্ত হয়, এটাই নিয়ম। কিন্তু এখানে বেতন নেই। সরকারি ভাতার নাম ডিএ। সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে চল্লিশ টাকা মাসে। রাজাবাজার অঞ্চলে বিশেষ যাবার প্রয়োজন হয়নি অনঙ্গমোহনের। কন্ডাকটারকে পুনরায় বললেন অনঙ্গমোহন, রাজাবাজার অবগত করাবেন ভাই। হাতের ইশারায় লেডিজ সিটে বসা অঞ্জলিকে আশ্বস্ত করেন অনঙ্গমোহন। অঞ্জলি আজ বের হবার আগে নারায়ণ প্রণাম করেছে সাষ্টাঙ্গে। জগদীশের ছবিকেও প্রণাম করেছে। যেন পরীক্ষা।

রাজাবাজার নেমে ঠিকানাটা বার করলেন অনঙ্গমোহন। গোমাংসের দোকানের পাশ দিয়ে রাস্তা। লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে পৌঁছলেন আইডিয়াল টিনবক্স ম্যানুফ্যাকচার কোম্পানিতে। সাইনবোর্ডটা অঞ্জলিই পড়ল।

পরিতোষের খোঁজ করেই পেয়ে গেল। পরিতোষ বলল—সব কথা বলে রেখেছি। চলুন মালিকের ঘরে।

ক্রমাগত ঠন ঠন আওয়াজ। দেওয়ালের ধারে নানা সাইজের টিনের কৌটা। কোনো টিনের গায়ে রসগোল্লার ছবি। কোনোটায় কমলালেবুর। বাংলাতেও লেখা দেখতে পেল—পিউরিটি বার্লি। পরিতোষ বলল—ঐ টিনগুলোয় কে সি দাসের রসগোল্লা ভর্তি হয়, ঐ রসগোল্লা বাইরে চালান যায়, দিল্লি-বোম্বেতেও যায়। ঐগুলো গাঙ্গুরামের। রসগোল্লাই আমাদের বড় ক্লায়েন্ট।

কাঠের দরজার উপরের দিকটায় কাচ লাগানো। দরজাটি যেন বায়ুভূতে নিরাশ্রয়, ওটি সামান্য ফাঁক করে পরিতোষ তার গলামাত্র বাড়াল। বলল, জগদীশদা কা উইডো আয়া। ভিতর থেকে কথা এল-লিয়ে আসুন। অঞ্জলি ঘোমটা বাড়িয়ে দিল। আঁচল দিয়ে ঢাকা দিল শরীর। ওরা ভিতরে ঢুকল। মালিক বলল বসুন। অনঙ্গমোহনকে বলল—শুনলাম আপনি একজন পণ্ডিতজি আছেন। আপনার মতন কুছ কাম ইখানে নেই। জগদীশবাবুর লেড়কা ভি বহুত ছোট আছে। এখন কী আমি করতে পারি।

অনঙ্গমোহন নিশ্চুপ। টেবিলে কালো টেলিফোন, কিছু কাগজপত্র, আর একটা প্লেটে ভাঙা জিলিপি। কয়েকটা মাছি।

বলেন—কী আমি করতে পারি?

অনঙ্গমোহন পরিতোষের দিকে তাকায়। পরিতোষের চোখে তখন কারুকার্য। কৃষিক্ষেত্রে, যুদ্ধে ও রাজদরবারে যারা দীর্ঘসূত্রতা করে তারা মূঢ়।

আমার এই পরিবারটিরে রক্ষা করেন শেঠজি।

সংস্কৃত শ্রেষ্ঠী শব্দ থেকে আগত শেঠজি, হা হা করে হেসে উঠলেন। তাঁর কপালে শ্বেতচন্দনের তিলক, কণ্ঠে স্বর্ণহার, গালে মেচেতা। মুখে পান দিয়ে বললেন—হামার কী ক্ষ্যামোতা আছে রক্ষা কোরার? অ্যাঁ?

অনঙ্গ আবার পরিতোষের দিকে তাকায়। পরিতোষের চোখে কারুকার্য। অনঙ্গমোহন বলেন, আপনি ইচ্ছা করলেই—পারেন।

বলুন আমি কী ইচ্ছা করতে পারি? আপনি কী চান পণ্ডিতজি?

অনঙ্গমোহন বুঝতে পারেন কথাটা তার মুখ দিয়েই বার করতে চান শ্রেষ্ঠী। অনঙ্গমোহন মূষিক নিন্দিত কণ্ঠে বললেন—আমার এই বৌমার যদি একটা চাকরি…কফে ঘড়ঘড় করে উঠল গলা, কিছু টিন গড়িয়ে পড়ল হুড়মুড় করে। মাটিতে ঢাকা বিঁধে যাওয়া কর্ণের বিলাপের মতো বলল, আপনের দয়া হইলেই…।

আপনি কী কাজ করতে পারবেন ম্যাডাম? অঞ্জলিকে জিজ্ঞাসা করলেন শ্রেষ্ঠী।

জানি না। অঞ্জলির মাথায় ঝাঁকুনি।

প্রভুর সঙ্গে কথার মধ্যে এত ঝাঁঝ কেন মা? অনঙ্গমোহন মনে মনে বললেন।

শ্রেষ্ঠী বললেন—জগদীশ লোকটা খুব ভালো ছিল। ওর উপরে আমার থোড়াবহুত সিমপাথি আছে। আউর আপনি ভি পণ্ডিতজী আছেন। তো একটা কিছু আমাকে করতেই হবে। যশবাবু ভি বহুত রিকোয়েস্ট করেছে। দেখি কী কোরা যায়। আর এখন জগদীশের ডিউজ যা ছিল, সব দিয়ে দিব। একথা বলেই যশবাবুর দিকে তাকান। যশবাবুর ঘাড় ও শরীরে তখন কারুকার্য। যশবাবু দ্রুত একটা ফাইল নিয়ে এসে মালিকের সামনে ধরেন। মালিক তাঁর আঙুল জিভে ঠেকিয়ে ফাইলের পৃষ্ঠা ওল্টান। এবার অঞ্জলির দিকে ফাইলটা বাড়িয়ে বলেন—সিগনেচার লাগিয়ে দিন ম্যাডাম। পরিতোষ যশ তার কালো রাইটার কলমটা বাড়িয়ে দেয়। এইটিন হানড্রেড সেভেনটি ফাইভ। এই টাকাটা পাচ্ছেন। অঞ্জলি সই করে। শুভকার্যে হুলুধ্বনি বিধেয়। বাইরে টিনের শব্দ। টিনের উপরে টিন। টিনের ঝনঝন।

দেখি, কী কোরা যায়। আমি খোবর দিব, বুঝলেন।

অঞ্জলি মৃদু ঘাড় নাড়ল।

সাঁই সাঁই গাড়ির ফাঁকে ওরা দুজন। জেব্রা ক্রসিং-এর সামনে ওরা দুজন। রাস্তা পার হবার সময় অঞ্জলির হাত ধরলেন অনঙ্গমোহন। হাত আর্দ্র। ঘর্মাক্ত। অনঙ্গমোহনের ইচ্ছা হয়, এই বিধবা পুত্রবধূকে কিছু সুখাদ্য খাওয়ান। সামনের মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে কিছু নরম সন্দেশ কিনে দেন। একবার মিঠাই দোকান ও একবার অঞ্জলির মুখের দিকে তাকান অনঙ্গমোহন। কিছুতেই কথাটা বলতে পারেন না। অনঙ্গমোহন যেন সেই জমদগ্নি, ব্যাধ-কপোত কথার ব্যাধ।

কলিকাতা বড় কোলাহলপ্রবণ। বাসের হর্ন, ট্রাম, জঞ্জাল-লরির ঘড়ঘড়। কিছুই ভাল লাগে না। সমস্ত কলকাতা জুড়ে বড় টিন ঝনঝন ঝনৎকার। কলকাতার পায়ে বিড়ালের থাবার নৈঃশব্দ্য সংস্থাপন কইরা দিমু আমি… অনঙ্গমোহন ভাবলেন। বারো নম্বর ট্রাম আসে। সন্দেশ কেনার কথা আর বলা হল না।

কুলবধূ যে অন্তঃপুরেই থাকবেন এমন নিয়ম কৃত্রিম। পুরাকালে মৈত্রেয়ী, খনা, লীলাবতী, গার্গী এমন আরও কত কুলবধূ জ্ঞান ও মেধার চর্চা করেছেন, পণ্ডিত সভায় গিয়েছেন, কুলবধূদের অন্তঃপুরে আবদ্ধ রাখা যাবনিক পর্দাপ্রথারই প্রভাব। এবার পেটে হাত দেন অনঙ্গমোহন। রুমালটার অস্তিত্ব অনুভব করেন।

রুমালে আছে ওয়ান থাউস্যান্ড এইট হানড্রেড সেভেনটি ফাইভ। থাউস্যান্ড সহস্র হয়, হানড্রেড শত, ল্যাক লক্ষ, ক্রোড় কোটি কহ অবিরত। রুমালটায় সুতোয় সুতোয় লেখা আছে পতি পরম গুরু। সুরবালা করে দিয়েছিল এটা। সুরবালা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্না ছিলেন।

বিবাহের সময় সুরবালার অক্ষরজ্ঞান ছিল না। বিবাহের সময় সুরবালা ছিল মাত্র তের বৎসরের বালিকা। কুল আর ঢেউয়া গাছের তলায় ছিল বিচরণ। আহা ঢেউয়া। এদেশে এসে আর ঢেউয়া দেখতে পাননি অনঙ্গমোহন। স্বর্ণবর্ণের কোয়া। লবণে জারিত করে নিলে কী আশ্চর্য স্বাদ। সুরবালা দেখত, বাড়ির কত ছাত্র পড়ছে, মাদুরে ছড়ানো পুঁথি, কত বই। সুরবালা বুঝতে পারত না কোনটা ভট্টিকাব্য, কোনটা কলাপ, কোনটা রঘুবংশ। ও শুধু বইপত্রগুলির দিকে, বইয়ের কালো কালো অক্ষরগুলির দিকে নির্বাক তাকাত।

বামা জাগরণী সমিতি তৈরি হল দত্তপাড়ার জমিদার বাড়িতে। জমিদার বীরেশ্বর দত্ত স্বরাজ্য পার্টির মেম্বার। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তার বাড়িতে যাওয়া আসা করেন। বীরেশ্বর দত্ত, একদিন সদলবলে হাজির নীলকমলের বাড়িতে। নীলকমলের সাক্ষাৎপ্রার্থী স্বয়ং জমিদার। কী বৃত্তান্ত? না, সাহায্য চাই, সাহায্য। বীরেশ্বর দত্ত বললেন, আমরা বামা জাগরণী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছি।

-আপনারা বামা জাগরণ করাইয়া কী করবেন? ম্যাম বানাইবেন?

তা কেন? মেম তাড়ামু।

অর্থাৎ?

দেখেন পণ্ডিত মশয়, ব্রিটিশ তাড়াইতে গেলে তো শুধু গান্ধী, তিলক, চিত্তরঞ্জনবাবু দিয়া হইব না, প্রত্যেকেরেই চাই। মা-ভগ্নীগরেও সঙ্গে চাই। তার আগে চাই ল্যাখাপড়া। শিক্ষা। অন্তঃপুরে শিক্ষা প্রচার দরকার। ঠিক কি না কন।

নীলকমল বললেন—যথার্থ নয়।

কেন?

নীলকমল বললেন-আপনারা কেহই ন্যায়াধীশ নহেন, স্মার্ত নহেন। সুতরাং এ মীমাংসা আপনাদের সঙ্গে নয়।

—তবে কি আপনি স্ত্রী শিক্ষার বিপক্ষে?

—নটী, বারাঙ্গনাদি নারীদের শিক্ষার প্রয়োজন। কুলবধূদের নয়।

—তবে—খনা, লীলাবতী, মৈত্রী—

—সে যুগের কথা পৃথক।

বীরেশ্বরবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন—কাকা, আপনি একজন বিদ্যোৎসাহী ব্রাহ্মণপণ্ডিত। আপনি যদি স্ত্রী শিক্ষার ব্যবস্থা না দেন তবে ব্রাহ্মণদিগের বালিকারা কেউ ইস্কুলে আইব না। আমরা কতগুলি বালিকা পাঠশালা স্থাপন করুম। এই গ্রামেও একটা করুম। আপনার অনুমোদন ছাড়া…

আমার অনুমোদন নাই। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন নীলকমল।

কিন্তু নীলকমল জমিদার নয়। দত্তবাবুই জমিদার। তাই শেষ পর্যন্ত পাঠশালা হল। নলিনীকান্ত শূরের ভিতরের বাড়িতে রোজ দুপুরে বসত পাঠশালা। নলিনী শূরের পুত্রবধূ এন্ট্রান্স পাস। কলিকাতা-বনিতা, বেথুন কলেজের ছাত্রী। নলিনী শূরের পুত্র এম বি ডাক্তার, সদরে বসেন। আর ঐ পাঠশালার শিক্ষিকা হল ঐ নলিনীবাবুর ম্যাট্রিক পাস পুত্রবধূ। সে সেমিজ পরে, পায়ে জুতো পরে ঘটিহাতা জামা; বিলাতি বেগুনকে বলে টমেটো

নীলকমল সে সময়ে নলিনীকান্ত শূরের উদ্দেশ্যে একটি শ্লোক রচনা করেছিলেন—

শস্ত্র হরণে শূরাবহব; সন্তি মানবাঃ
শাস্ত্র হরণে শূর এক এব ভবান ভুবি।

অর্থাৎ অনেক বীর আছেন যাঁরা শস্ত্র হরণ করতে পারেন, কিন্তু শাস্ত্র হরণকারী একা তুমিই আছ হে শূর।

কায়স্থ বাড়ির, বৈদ্যবাড়ির মেয়ের কেউ কেউ ঐ স্কুলে যেতে লাগল। পুজোয় চণ্ডীমণ্ডপে দক্ষযজ্ঞ পালার আগে হল স্বদেশী গান।

লক্ষ্মী তোমরা সাবিত্রী তোমরা জননী তোমরা নারীগণ।

গৃহপতি সেবার সঙ্গে বিদ্যা করহ অনুশীলন…অশ্বিনী রায় গান গাইলেন।

মেয়েরা ভিতর বাড়িতে বসে বসে দেখল। চিকের ব্যবস্থা ছিল না। নীলকমলদের ভট্টবাটিতে চোদ্দঘর ব্রাহ্মণ। নীলকমলের জ্ঞাতি-ভাইদের কোনো কোনো সংসারের দু’একজন মেয়ে ঐ পাঠশালায় যাতায়াত করতে লাগল। নীলকমল একদিন অধ্যাপনারত অবস্থায় শুনলেন পার্শ্ববর্তী অঙ্গন থেকে ক্রীড়ারতা বালিকাদের গান—

পামকিন চালকুমড়া কুকুম্বার শশা।
ব্রিঞ্জল বার্তাকু হয়, প্লাউম্যান চাষা।

নীলকমল চিৎকার করে উঠেছিলেন। গোল কোরো না, লঘু বালিকারা।

সুরবালাও বালিকা। অনঙ্গমোহনের সঙ্গে সদ্য বিবাহ হয়েছে। সম্প্রতি রজস্বলা হয়েছে। সুরবালার ঐ পাঠশালায় পড়তে যাওয়া প্রশ্নাতীত। তবে প্রতিবেশী রোহিণী, চপলা, এদের সঙ্গে ওর বড় ভাব। তারাও জ্ঞাতি, স্বগোত্র। আসা-যাওয়া আছে, যদিও বয়সে সুরবালার চেয়ে কম। একদিন নীলকমল বললেন—অনঙ্গ, ওরা যেন এ বাড়িতে না আসে। বৌমারে জানাইয়া দিও। শূর বাড়িতে এখন আসুরিক কাজকর্ম। নামে পাঠশালা, আসলে ইংরাজি ইস্কুল।

একদিন দুপুরে শূরবাড়ি থেকে কুড়োবা কুড়োবা লিজ্যে, কাঠায় কুড়োবা কাঠায় লিজ্যের পরিবর্তে শোনা গেল—

ত্রিশদিনেতে হয় মাস সেপ্টেম্বর
সে রূপ এপ্রিল জুন আর নভেম্বর

এবং সবচেয়ে বড় কথা পার্শ্ববর্তিনীরা একদিন গাইল—

পামকিন চালকুমড়ো কুকুম্বার শশা
কাম-ইন ভিতরে আসা সিট-ডাউন বসা।

নীলকমল চোখ বড় বড় করে বললেন—পণ্ডিতঃ ধ্রুব ভাবতে, কইছিলাম না, ম্যাম তৈরি হইতাছে? ম্যামের কারখানা? কইছিলাম না?

অনঙ্গমোহন সুরবালাকে নিষেধ করে দিয়েছিলেন যেন ঐ বালিকাগুলি কেউ এ বাড়িতে না আসে। পিতার আজ্ঞাই শিরোধার্য। সুরবালা মৌন ছিল তখন। তারপর অনঙ্গমোহনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল, কিন্তু আমারও যে পড়তে ইচ্ছা করে। আপনেগর সারা বাড়িতে কত বই। বইয়ের মধ্যে কত অক্ষর। আর আমার কাছে ও-গুলানই কেবল কালো কালো দাগ। আমারে শিখাইবেন? অ আ ক খ?

অনঙ্গমোহন শেখাচ্ছিল। অ আ ক খ শেখাচ্ছিল। স্লেট পেনসিলে সুরবালাও অ আ ক খ অভ্যেস করছিল। নীলকমলের অনুমোদন ছিল এতে।

আস্তে আস্তে অ-কার যোগ, উ-কার যোগ শিখছিল সুরবালা। সুরবালা প্রায়ই ‘ম’ অক্ষরের পাশে ফুলদানির মতো আকার বসিয়ে দিত। আর তখনই অক্ষরটা জীবন্ত হয়ে উঠত। মাতৃহারা সুরবালা উচ্চারণ করত মা। তখন ঐ মা শব্দের উচ্চারণে ধূপ-দীপ জ্বলত। লক্ষ্য করত অনঙ্গমোহন, প অক্ষরের পাশে ত-য়ে হ্রস্বই যোগ করে মৃদু মৃদু হাসত সুরবালা। একা একা অক্ষর দিয়ে খেলা করত সুরবালা। ফ অক্ষরের তলায় নূপুরের মতো উকার যোগ করে দিত, তারপর ল। কখনো রাত্রে দীপালোকে স্লেটে র লিখে অনঙ্গমোহনের দিকে তাকিয়ে ভ্রূভঙ্গি করে বলতো, এবার কী লিখি? অনঙ্গমোহন লিখে দিত ত-য়ে হ্রস্বই।

একদিন রাত্রে শয্যায় শুয়ে অনঙ্গমোহনের রোমশ বুকে হস্তলেপন করছিল সুরবালা। চম্পাকলির ন্যায় কোমল আঙুল। একটা একটা রোম ধরছিল, মৃদুটান দিচ্ছিল এবং তখন-

তবলা বেহালা বাঁশি বীণা পাখোয়াজ/করতাল তানপুরা সেতার এস্রাজ
সানাই সারঙ্গ শঙ্খ কাশী ঢাক ঢোল/নাগারা টিকারা কাড়া জগঝম্প খোল…

আমারে বাল্যশিক্ষা কিন্যা দিবা? বাল্যশিক্ষা? কী সুন্দর ছবি। ঘোড়ার ছবি, হাতির ছবি, সুবোধ বালকের ছবি। অনঙ্গমোহন বলেছিল, দিমু।

একদিন নীলকমল চৌকির তলায় ইঁদুর মারার কল পাততে গিয়ে দেখলেন, ঘরের কোণায় কাগজ। কলম। কলমে বিলাতি পিরামিড নিব। কাগজে লেখা অজ-আম-ঈশ। দেখলেন পরপদ লয়কর কমলজ নয়ন। তারপর বললেন—অনঙ্গ এই ইস্কুইল্যা জ কে লিখছে? বৌমা না?

ইস্কুইল্যা ‘জ’ হল ছাপা বইয়ের ‘জ’। যা প্রচলিত হস্তলিখিত ‘জ’-এর মতন নয়। আলাদা ধরনের। অনঙ্গ মাথা নিচু করে বলেছিল, হ। নীলকমল শুধু বলেছিলেন—সব নোড়াই শালগ্রাম হইলে বাটনা বাটব কীসে?

কাগজপত্র বই কলম—সব কিছুই পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিল সুরবালা। সেই দিনই।

ট্রামের ঘড়ঘড়। অঞ্জলি বসে আছে অবগুষ্ঠানাবৃতা। সাদা শাড়িতে নীলবর্ণের ছিটে। ধাবমান ট্রাম। এই ট্রামে টিন কোম্পানিতে চাকরি করতে যাবে অঞ্জলি। সময় এরূপই ধাবমান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *