ঊনিশ
অসীমকে দেখে সবাই বেশ খুশি। এক মাসে ওর বেশ গোঁফদাড়ি বেরিয়ে গেছে। ফুলপ্যান্ট পরা, একটা লাল রঙের গেঞ্জি, ভাদ্রের ঘামে গায়ে লেপ্টে রয়েছে। দু’কাঁধে দুটো ব্যাগ।
ব্যাগদুটো রাখল অসীম।
চাউল? অ্যাতডি? অনঙ্গমোহন প্রায় আঁতকে উঠেন। আমি চালের কাজ করি, অসীম বলল। অসীম চালের ব্যাগের গায়ে হাত বুলোেল। ব্যাগ যেন আদর বোঝে। ব্যাগ যেন হরিণশাবক।
বিলু বেশ উত্তেজিত হল। চালের কারবার করিস অসীমকাকু? হেভি পুলিস না? কর্ডনিং না কী যেন বলে? ও সব নেই?
—পুলিসের সঙ্গে ফিটিং থাকে। যেদিন এস্পেশাল হয়, সেদিন পালাই।
—এস্পেশাল মানে?
—উল্টোপাল্টা পুলিস।
—ভাল লাভ থাকে, নারে? বিলু জিজ্ঞাসা করে।
—লাভাংশের হাফ তো জগাদা নিয়ে নেয়।
অনঙ্গমোহন বলল—লাভাংশ নয় অসীম, লভ্যাংশ।
অসীম বলল—লাভাং হোক লভ্যাং হোক, টাকায় আট আনা জগাদার।
—তবু কীরকম থাকে? বিলু জিজ্ঞাসা করল।
—ডেলি—দশ টাকার মতো কাজ করি। আমার পাঁচ টাকা থাকে।
মন্দ কী। অঞ্জলি মুহূর্তের জন্য বিলুর দিকে তাকায়। কিন্তু অসীম তোর ইস্কুল? বিলু বলে।
—যাই না।
—আর যাবি না?
—কে জানে।
—ই বর্ণো যমসবর্ণে ন চ পরলোপ্য মনে আছে অসীম্যা? অনঙ্গমোহন বলেন।
অসীম হাসে।
—দ্বিবচনমনৌ?
—অসীম হাসে।
—অসীম্যা, বিদ্যাহীনা ন শোভন্তে নির্গন্ধা ইবকিংশুকাঃ।
—চাঁদপাড়া থেকে চাল এনে হাবড়া ফেলতে পারলেই কেজিতে পনের পয়সা লাভ।
—অবিদং জীবনং শূন্যং দিকশূন্যা চ অবান্ধবাঃ
—বিলু—এই দ্যাখ টেরিলিনের গেঞ্জি। আরও দুইটা জামা আছে।
—দূরতঃ শোভতে মুর্খো লম্বশাটপটাবৃতঃ
—বর্ডার থেকে আনতে পারলে আরও লাভ।
-তোর বাপ তোরে কিছু কয় না অসীম্যা?
—বাবায় পেট ভইরা খায়, জোরে জোরে ঢেকুর মারে।
অনঙ্গমোহন উঠে দাঁড়ান। অসীমের দিকে তীব্রদৃষ্টি হানেন। খড়মের খটাং খটাং শব্দে বাজে অভিমান। খাতাটা বের করেন। পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠী। কলমটা বাগিয়ে ধরেন যেন শাণিত ছুরিকা। অসীম চক্রবর্তীর নামের উপরে ঘসটাতে থাকেন। কলমের নিব বেঁকে যায়। অনঙ্গমোহনের চোখের কোনায় টলটল করতে থাকে জল। ফ্যাকাসে নামাবলী জল শুষে নেয়।
বিলু বলল, তুই আজ এদিকেই মাল নিয়ে এসেছিস?
অসীম বলল—হাবড়াতেই মহাজন ফিট আছে। কিন্তু আজ মহাজন বেলগাছিয়ায় মাল পাঠাচ্ছে, লরিতে বসে চলে এলাম। আমিও পারসোনাল কিছু মাল নিয়ে এলাম। শ্যামবাজারে ঝেড়ে দেব। হাবড়া থেকে শ্যামবাজারে কিলোয় পঁচিশ পয়সা পড়তো। দে, একটা বাসন দে বিলু, কিছুটা চাল দিয়ে যাই।
বিলু বলল—সে কী? এটা তোর বিজনেসের চাল না?
বিজনেসের বলেই তো দিচ্ছি। কত ভাত খেয়েছি এখানে।
অসীম তো জানেই চালের টিন কোথায় থাকে—অসীম চালের টিন খোলে। চাল ঢালে। ঝন ঝন করে তীব্র বেজে উঠল টিন। কারণ ঐ টিনে চাল ছিল না। ঐ ঝনঝন, ঐ শূন্যতার আর্তনাদে অনঙ্গমোহন বড় লজ্জা পান। অসীম সে সময় দেবদূতের মতো শূন্য পাত্রে চালই ভরে যায়। তারপর চালের ঢাকনা বন্ধ করে ঢাকনার উপর চাপড় মারার গর্বিত ঠং শব্দ।
অনঙ্গমোহনের তখন তীব্র বাসনা হয়েছিল বলার জন্য—এই চাউল তুই লইয়া যা অসীম। বলতে পারলেন না। বলতে পারতেন, যদি এই পরিমাণ চাল তিনি এক্ষুণি এনে দিতে পারতেন।
স্বপ্না ভালো আছে তো, ওর বিয়ের চিঠি পেয়েছিলাম—কিন্তু বিয়ের পরে পৌছেছিল চিঠি। ওর সঙ্গে একবার দেখা করে যাব।
শিখারা উঠে গেছে, না? অসীম জিজ্ঞাসা করল। বিলু বলল, দিন দশ। ওরা বাড়ি করেছে। অসীম আস্তে আস্তে বলল, রাস্তা থেকেই বুঝেছিলেম। কাপড় ঝুলছে না। জানালা বন্ধ…
দুপুরবেলা খেয়ে যেতে বলেছিল অঞ্জলি, অসীম খেল না কিছুতেই।
অনঙ্গমোহন সেই দক্ষিণের জানালার সামনে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়েছিলেন। অসীম মাথা নিচু করে ওখানে গেল। খুব আস্তে পায়ে হাত দিল।
অনঙ্গমোহন পা-টা সামান্য সরিয়ে নিলেন। অসীম তবু স্পর্শ করল পা। কোনো কথা বলল না।
দুপুরে খেতে বসে অনঙ্গমোহন থালাভরা ভাত পেলেন। অনঙ্গমোহন বললেন, এই ভাত আমি খামু না। অনঙ্গমোহনের দিকে তাকিয়ে অঞ্জলি পরিপূর্ণ হাসল। অনঙ্গমোহন যেন শিশু। যেন শিশুর বায়না। অঞ্জলি বলল, থাক। এই থালাটা বিলু নে। আমার আগের ভাত আছে। অন্য থালায় ভাত বাড়ল অঞ্জলি। বলল অসীম আসার আগেই তো ভাত রান্না হয়েছিল। পোয়াটাক চাল ছিল না? অসীম না এলে ওটাই আপনাদের দু’জনকে দিতাম। আপনি ওটাই খান। ওটা আপনারই কেনা। অনঙ্গমোহন মৌন থাকেন। মৌনং সম্মতি লক্ষণং। ভাত পাল্টে দিল অঞ্জলি। মোটা মোটা ভাত।
অনঙ্গমোহন মাঝে মাঝে বিলুর খাওয়া দেখছিলেন। আর বিলু অনঙ্গমোহনের। গত দু’সপ্তাহ বড় কষ্টে যাচ্ছিল। অঞ্জলি চাকরি করতে যায় না। কেন যে আবার ছেড়ে দিল, কেউ জানে না। ছেড়ে দিয়েছে না চাকরি চলে গেছে, সেটাও রহস্য। অনঙ্গমোহন চেটেপুটে খেলেন। তারপর গণ্ডুষ নিলেন।
ওঁ অমৃতাপিধানমসি স্বাহা। তারপর বললেন, বিলু অন্ন ভুক্ত হইয়া ত্রিধা বিভক্ত হয়। অন্নের স্থূলতম অংশ হয় পুরীষ। মধ্যম ভাগ মাংস আর সূক্ষ্ম অংশ মন। সুতরাং অন্ন না পাইলে মন ভাল থাকে না। এই মীমাংসা কার কও দেখি? মহর্ষি উদ্দালকের। উদ্দালক শ্বেতকেতুরে কইলেন, পঞ্চদশ দিন ভোজন কইরো না। কেবল জলপান কইরো, তারপর আমার কাছে আইসো, কথা আছে। শ্বেতকেতু তাই করল। পনের দিন পর শ্বেতকেতু পিতার নিকট গেল। উদ্দালক কইলেন হে সৌম্য, ঋক্ মন্ত্র কও। শ্বেতকেতু তো কিছুই মনে করতে পারে না। কেবল মাথা চুলকায়। উদ্দালক কইলেন, বৎস, ভোজন কর। ভোজন করার পর শ্বেতকেতু ঋমন্ত্র, সামমন্ত্র, যজুর্মন্ত্র ফড়ফড় কইরা কইয়া দিল। সুতরাং বিলু, আজ তো উত্তম ভোজন হইল, একটু ব্যাকরণটা পইড়ো…
একটা ছোটখাটো উদ্গার তুললেন অনঙ্গমোহন। স্বোপার্জিত অন্নের শেষ উদ্গার। সরকারি বৃত্তি, ওরফে ডিএ-র টাকা যা তুলেছিলেন স্বপ্নার বিবাহে শেষ। ললিতবাবুর দাক্ষিণ্যে একটা রেডিও অনুষ্ঠানে যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে চাল কেনা হয়েছিল। এবার কী করবেন অনঙ্গমোহন। বলে তো দিয়েছিলেন, ঐ চালের ভাত খাবেন না তিনি। ন স্খলতি খলু বাক্যং সজ্জনানাং কদাচিৎ। অনঙ্গমোহন বইয়ের তাকের কাছে দাঁড়ালেন।
প্রথমে তুলে নিলেন বিবাদ ভঙ্গার্ণব। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের স্মৃতি সঙ্কলন। স্মৃতিশাস্ত্রের কোনো দরকার নেই। তারপর চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কারের স্মৃতি সন্দর্ভ। কোটালীপাড়ার হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ স্বহস্তে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন নীলকমলকে—শঙ্কর সম্ভবম্ নাটক। তুলে নিলেন। কমলকৃষ্ণ বিদ্যালঙ্কারের টীকা সংবলিত ময়ূর ভট্টের সূর্যশতক তুলে নিলেন, ভরে নিলেন বাজারের থলিতে। চললেন কলেজ স্ট্রিটে। হাঁটতে লাগলেন ট্রামলাইন বরাবর।
আজ অনন্ত নাগের মাতার সম্বাৎসরিক শ্রাদ্ধতিথি। অনঙ্গমোহন নিমন্ত্রিত হননি। সমাজচ্যুত হলেন বোধহয়। নিজের নাতনিকে স্বহস্তে অব্রাহ্মণের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছেন। তারাদাস একটা প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিলেন। অনঙ্গমোহন তার উত্তরও দিয়েছিলেন। মিছিল যাচ্ছে—নুরুল আনন্দ অমর রহে। বাংলা বন্ধ সফল করুন। দেয়ালে দেয়ালে লেখা, বিকল্প সরকারই একমাত্র সমাধান। ওরা এলে চাল-ডালের দাম কমবে। সংস্কৃতরও হয়তো কদর হবে। হোক ওরা নাস্তিক। ভারতের দর্শন শাস্ত্রগুলির মধ্যে নাস্তিক দর্শন তো কম নেই। জৈন, বৌদ্ধ, চার্বাক তো আছেই, সংখ্য যোগ ন্যায় বৈশেষিকও-বা কম কী। এই দর্শন শাস্ত্র নিয়ে কী ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিলেন ললিতবাবু রেডিও স্টেশনে।
সুমিতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন অনঙ্গমোহন, ললিতবাবু তখন বেঁচেছিলেন। অনঙ্গমোহনকে দেখে ললিতবাবু বলেছিলেন, পণ্ডিতমশাই, চলুন আমার সঙ্গে, আমি রেডিও স্টেশনে যাচ্ছি রেকর্ডিং আছে। আপনাকে ওখানে আলাপ করিয়ে দিই, মাঝে মাঝে ওরা ডাকে। কিছু বলতে বলে, টাকা দেয়।
—রেডিও? ওখানে আমি বলব আর ধরাব্যাপী সেই কণ্ঠ…
—হ্যাঁ।
—ওখানে কি কোনো যন্ত্রের ভিতরে কথা বলতে হয়।
—যন্ত্র নয়, মাইক্রোফোন। ও কিছু নয়। চলুন না। সুমিতাও বলল—যান না পণ্ডিতমশাই, কোনো ব্যাপারই নয়। ললিতবাবু বললেন—আপনাদের মতো লোকেদেরকে বহু আগেই ডাকা উচিত ছিল ওদের। চলুন আজ আলাপ করিয়ে দিই। সংস্কৃতের যিনি অফিসার, বড় ভাল লোক।
খালি গা, হাঁটুর কাছে ধুতি, গায়ে চাদর, পায়ে টায়ারের চটি ঐ লোকটাকে দেখে দারোয়ান আটকে দিল। ললিতবাবু আমার লোক বলে উপরে নিয়ে গেলেন। সাদা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় অনঙ্গমোহন একবার ললিতবাবুর কানে কানে বলেছিলেন, বীরেন ভদ্রকে একবার দেখা যায়?
—আলাপ করবেন? আমার সঙ্গে তো বিলক্ষণ আড্ডা হয়। ললিত মিত্র বলেছিলেন।
না থাক। অনঙ্গমোহন বললেন।
আরে আসুন স্যার, আসুন, আসুন-ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ললিতমোহন বললেন—এই যে ইনি একজন পণ্ডিতমশাই। অনঙ্গমোহন কাব্যব্যাকরণতীর্থ। আমার বন্ধু এবং আত্মীয়। এঁকে প্রোগ্রাম দিতে হবে। ভদ্রলোক বললেন, শিওর শিওর। আপনি বলছেন, যেন নিশ্চয়ই দেব। আজই একটা করে দিন না।
আজই?
আজ্ঞে। বড্ড বিপদে পড়েছি। এইমাত্র ফণিভূষণ মিশ্রমশাই ফোন করে জানালেন যে, তিনি আসতে পারছেন না। অথচ কালই ব্রডকাস্ট। ভাবছিলাম, কী করব? ভালই হল…
—কী? সাবজেক্ট কী? ললিতমোহন জিজ্ঞাসা করলেন।
—ভারতীয় দর্শনে আত্মা উপলব্ধি।
—আত্মা উপলব্ধি? না আত্মোপলব্ধি?
—আত্তা উপলব্ধি। এই তো কার্বন কপি। এটিটিএ, ইউপিএ, এলএবি…
—ভুল আছে।
—আপনারই সাজেশন এটা প্রফেসার মিত্র…
আরে, আমি তো আত্মোপলব্ধিই বলেছি…আপনারাই চিঠিতে ভুল লিখেছেন। ঐ জন্যই মিশ্ৰমশাই আসেননি।
একেই বলে ভাষার মারপ্যাচ। টাইপ করতে হয় ইংরিজিতে আবার বেতার জগতে ছাপা হয় বাংলায়। এই তো গত সপ্তাহে ‘বাবলা কাঁটা’কে লেখা হল ‘বাবলা কান্ত’। ইংরিজিতে ছিল কে এ এন টি এ। শাসন অধিকারীকে শ্মশান অধিকারী ছাপল ক’দিন আগে। ঐভাবেই এই স্যাংস্কৃট টকটা আত্মা উপলব্ধি ছাপা হয়ে গিয়েছে। ছাপা যখন হয়েই গেছে, এইটা ফাইনাল। এটাই করিয়ে দিন প্রফেসার মিত্র, নইলে ডেভিয়েশন হয়ে যাবে।
পোদ্দার সাহেব এবার অনঙ্গমোহনের দিকে তাকান। বললেন, আপনার নাম-ঠিকানা দিয়ে দিন। কার্ড করেনি। প্রফেসার মিত্র বলছেন যখন, আপনাকে মাঝে মাঝে প্রোগ্রাম দেব। আসলে আমি হলাম পলিটিক্যাল সায়েন্সের এম-এ, আমাকে স্যাংস্কৃট দেখতে হচ্ছে। আপনি বোধহয় পুজোটুজো করেন…
-ললিতমোহন তাড়াতাড়ি বলেছিলেন—না উনি পূজারী নন। উনিও অধ্যাপক। টোলের।
—ও আচ্ছা। আপনি তাহলে স্ক্রিপ্ট রেডি করুন, দশ মিনিটের চাংক। প্রফেসার মিত্র, ওঁকে বুঝিয়ে দিন, প্লিজ।
অনঙ্গমোহন বলেছিলেন, অন্য বিষয় হয় না? যেমন নিজন্ত, তিঙন্ত প্রকরণ, কিংবা কালিদাসস্য কাব্যে…।
—আরে হবে হবে, ললিতবাবু আছেন—সব হবে। এখন এটা করে দিন তো-ললিতবাবুর রেকর্ডিংটা করিয়ে নিচ্ছি, ততক্ষণে একটা স্ক্রিপ্ট করতে থাকুন। এই নিন কাগজ-কলম। ললিতমোহন চামড়ার ব্যাগ থেকে একটা গোটানো কাগজ বার করলেন। কাগজটা সমান করে ভদ্রলোকের কাছে দিলেন। তিনি সই করলেন। অনঙ্গমোহন দেখলেন—রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাবনা।
একবার দেখবেন নাকি পণ্ডিতমশাই! ললিতবাবু বললেন।
রবীন্দ্রনাথের আমি কী বুঝি? অনঙ্গমোহন আস্তে আস্তে বললেন।
ওরা ভিতরে গেলে অনঙ্গমোহন আত্মা নিয়ে বড় ফাঁপরে পড়েন। আত্মা কী? ভারতীয় দর্শনে আত্মার স্বরূপ কী? বৃহদারণ্যক উপনিষদে আছে, আত্মানং বিদ্ধি। আত্মাকে জান। কিন্তু অনঙ্গমোহন আত্মাকে জানেন না। আত্মা কি অন্নময়? না, প্রাণময় না—মনোনয় না নাকি আনন্দময়? আত্মা কি দ্রব্য? না অদ্রব্য? না চৈতন্য? নাকি আত্মাই ব্ৰহ্ম? আত্মা কি জ্ঞাতা না জ্ঞান? আত্মাই কি পুরুষ? প্রকৃতির বিপরীতে সৃষ্টির উৎস? নাকি আত্মাই নাই? ন স্বর্গো নাপবর্গো নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ। আত্মাকে পোড়ানো যায় না, জলে ভিজানো যায় না, নৈনং ছিন্দতি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। আত্মার ক্ষুধা নাই, তৃষ্ণা নাই, তবে কেন আত্মাকে পিণ্ড খাওয়াই? মৃতানাপি জন্তুনাং শ্রাদ্ধংচেতৃপ্তি কারণম/ গচ্ছাতামিহ, জন্তুনাং ব্যর্থং পাথেয় কারণম। ভারতীয় দর্শন যে বড় জটিল। ন্যায়ের সঙ্গে বেদান্তের গণ্ডগোল। বৈশেষিক আছে, যোগ আছে, মীমাংসা আছে, আত্মা সম্পর্কে সবাই ভিন্নমত। এছাড়া বৌদ্ধ আছে, জৈন আছে, চার্বাক আছে। কোন দর্শনের কথা লিখবেন অনঙ্গমোহন? সব তো জানাও নেই, পড়াও নেই, বইপত্রও নেই সামনে। অনঙ্গমোহনের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা হয়।
তবু তিনি শুরু করেন—দর্শন কথাটি আসিয়াছে দৃশ ধাতু হইতে। দৃশ ধাতুর বিশেষ অর্থ দেখা, সাধারণ অর্থ জানা। দৃশ ধাতুর উত্তর অনট্ প্রত্যয় করিয়া দর্শন শব্দটি সিদ্ধ হইয়াছে—অনট্ প্রত্যয় করণেও হয়, আবার ভাব বুঝাইতেও হয়। ব্যুৎপত্তি অনুসারে দর্শন কথাটির অন্য অর্থও হইতে পারে। অনট্ প্রত্যয়করণে না করিয়া যদি ভাবে করা হয়, তবে দৃশ ধাতুর অনপূর্বক যে দর্শন শব্দটি সিদ্ধ হইবে তাহার অর্থ দর্শনের ভাব। এইদিক হইতে দর্শন কথাটির অর্থ ‘উপলব্ধি’।
ললিতবাবু রেকর্ডিং শেষ করে ফিরে এলেন। বললেন—বাঃ পণ্ডিতমশাই। এই তো আপনি আপনার লাইনে এনে ফেলেছেন। শুধু ক্রিয়াপদগুলি চলিত করে নিন। অনঙ্গমোহন মৃদু হাসলেন। বললেন, বালকগণের সেই গরু রচনা মুখস্থের মতন। সেই ব্যাকরণ। আমার দ্বারা এইসব অসম্ভব। আমি পারুম না ললিতবাবু। ললিতবাবু বললেন, আরে কিচ্ছু ব্যাপার নয়। ন মিনিট তো। এবার আত্মার চৈতন্যগুণ, জীবাত্মা-পরমাত্মা ভেদ, কর্মফল, পুনর্জন্ম এইসব একটু একটু দিয়ে কয়েকটা মশলা ছড়িয়ে দিন। এই মশলাগুলি সংস্কৃত নিয়ে যে কোনো বক্তৃতায় লাগে। যেমন সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম, শূন্যস্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ, তত্ত্বমসি, সোহম, তমোসা মা জ্যোতির্গময় সৎ চিদানন্দ এইসব।
শেষ অবধি একটা খাড়া করেছিলেন অনঙ্গমোহন। মরালগ্রীবার মতো একটা যন্ত্রের সামনে মুখ রেখে ওটা পড়লেন। ঠাণ্ডা ঘরেও ঘেমে যাচ্ছিলেন চাদর জড়ানো অনঙ্গমোহন। সামনে কাচের দেওয়াল। ইন্দ্রপ্রস্থে ময়দানব এরূপ স্ফটিক নির্মিত পুরী নির্মাণ করেছিলেন। অনঙ্গমোহন দেখেন, কাচের দেয়ালের বাইরে প্রথম একজন, তারপর দু’জন, অতঃপর তিনজন দাঁড়িয়ে আছে, দেখছে লুপ্ত জীব।
জীবনে প্রথম চেক পেয়েছিলেন অনঙ্গমোহন। সেই চেক ভাঙানো কম ঝামেলা নয়। ললিতবাবুই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
রেডিওর ব্যাটারি ছিল না। নতুন ব্যাটারি কিনে এনেছিল বিলু। বিলু জেলেপাড়ার সবাইকে বলে রেখেছিল। বন্ধুদেরও বলেছিল। যেদিন বাজল—ঘরের মধ্যে বিলু ট্রানজিস্টারটার আওয়াজ ম্যাক্সিমাম করে দিল। অনঙ্গমোহনের ভীষণ লজ্জা করছিল। বিলু কি জানত, সেই মুহূর্তে বাংলার ঘরে ঘরে রেডিও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে?
রেডিও’র ভদ্রলোক বলেছিলেন, পরে যোগাযোগ করবেন। কিন্তু ললিতবাবুর অকস্মাৎ মৃত্যুর পর আর এইসব করা হয়নি।
গত সপ্তাহেই বৃন্দাবন বসাক লেনে গিয়েছিলেন অনঙ্গমোহন। সুমিতাই ছুটে এসে দরজা খুলে দিয়েছিল। ছুটে এসেছিল, অথচ উচ্ছ্বাস ছিল না। ওর মুখচ্ছবি কান্তিহীন আর পাংশু লাগছিল। খরাক্লিষ্ট লতা। বিরহজর্জরা বুঝি। দিন সাতেক হয় জাহাজ ছেড়েছে। ওর স্বামী চলে গেছে। সুমিতার ঐ পাংশু মুখ দেখে অনঙ্গমোহন বইপত্র খোলার কথাই বলেননি। আসলে ঐ মতলবেই গিয়েছিলেন অনঙ্গমোহন। ললিতবাবুর মৃত্যুর পর বইপত্র খোলাই হয়নি।
সুমিতা ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল। ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলেন অনঙ্গমোহন। ভিতরে ছোট ছোট টেবিল। ছোট ছোট চেয়ার। ব্ল্যাকবোর্ড। কোথায় গেল সেই পুরোন আমলের বড় গদিওলা চেয়ার? কোথায় সেই শ্বেতপাথরের টেবিল?
সুমিতা বলল-বসুন।
অনঙ্গমোহন ছোট একটা চেয়ারে বসেছিলেন।
সুমিতা মাথা নিচু করে খুব আস্তে আস্তে বলল, আমি অলক্ষ্মী।
একথা কেন? অনঙ্গমোহন বললেন।
—শাশুড়ী সবসময় বলছেন। বিয়ে হতে না হতেই আমি শ্বশুরকে খেয়েছি।
অনঙ্গমোহন বললেন, উনি না শিক্ষিত?
—হ্যাঁ। বিএ পাস।
অনঙ্গমোহন মাথা চুলকোতে থাকলেন। তারপর চেয়ার-টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এসব কী?
বাড়িতে ইস্কুল হচ্ছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। নাম টাইনি টট্স।
ইংরাজি ইস্কুল? বাড়িতে? অনঙ্গমোহন অবাক হলেন। সুমিতা বলল— আপনার জামাই বলল, বাবাও চলে গেলেন, আমারও জাহাজ ছাড়বে। আবার ছ’মাস পর ফিরব। তুমি কী নিয়ে থাকবে? একটা ইস্কুল কর। বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। পাশের বাড়ির জিজা আছে, লোরেটোর মেয়ে। বাড়িতেও স্পেস আছে। আমি বললাম, আমি যে ভাল ইংরিজি বলতে পারি না। তখন ও বলল, জিজার কাছ থেকে শিখে নিও। প্র্যাকটিস করলেই হবে। আপাতত বাংলা ক খ পড়াও, ছড়া শেখাও, জ্যাক অ্যান্ড জিল, হাম্পটি ডাম্পটি মুখস্থ করাও—। আমার শাশুড়িও বললেন, সেই ভাল। যাবার সময় টেবিল-চেয়ার অর্ডার দিয়ে গেল। আর বাইরের সাইনবোর্ড। জানুয়ারি থেকে ক্লাস শুরু হবে। অনঙ্গমোহন বলেছিলেন—তা হলে এই তোমার ইচ্ছা? সুমিতা বলেছিল—শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। অনঙ্গমোহন তখন ঐ ছোট চেয়ারটা থেকে উঠে দাঁড়ান। গুটি গুটি ব্ল্যাকবোর্ডটার কাছে হেঁটে যান। বোর্ডটার সামনে দাঁড়ান। কিছু যেন বলতে চান। ঠোঁট নড়ে। ঠোঁট কাঁপে। ঠিক সেই সময় চঞ্চলা হরিণ শাবকের মতোই একটি নবযৌবনা তন্বী, জুতোর খট খট শব্দ সহযোগে বৌদি-বৌদি হেঁকে ঘরে ঢোকে। বলে বৌদি, পোস্টার ছাপা হয়ে গেছে। ট্রাইকালার। ভে-এ-রি অ্যাট্রাকটিভ। অনঙ্গমোহন ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে থেকে সরে এসেছিলেন। যাবার সময় শুধু বলেছিলেন,
অগ্রহায়ণে পরীক্ষা কিন্তু। তুমিই ভরসা আমার।
হাঁটতে হাঁটতে কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছে গেলেন—অনঙ্গমোহন। গোলদিঘি। সংস্কৃত কলেজ।
গোলশ্রীদীর্ঘিকায়া বহুবিটপিতটে কোলিকাতা নগর্যাৎ নিঃসংখো বর্ততে সংস্কৃত পঠন গৃহাখ্য কুরংগ কৃশাংগ…
অনঙ্গমোহনের হাতে চটের থলে। তাতে বই। তাঁর প্রিয় বই।
প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনের রেলিঙে দাঁড়ালেন অনঙ্গমোহন। কলেজের সামনে জটলা। ছেলেমেয়েরা চিৎকার করছে আমাদের সংগ্রাম চলছে, চলবে। অধ্যক্ষ দূর হটো। এ লড়াই, বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে। অনঙ্গমোহন রেলিঙের সামনে দাঁড়ান। কত বই। অনঙ্গমোহনের হাতে চটের ব্যাগ। ব্যাগে বই। বইগুলো নড়েচড়ে ওঠে। অনঙ্গমোহন এবার বই বিক্রি করবেন। অনঙ্গমোহন হাতটা চালান করে দিলেন ব্যাগের ভিতরে। এক বইকে চেপে ধরলেন। বইটা ছটফট করে উঠল। ন দেবঃ সৃষ্টিনাশকঃ। এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে। একটি কমবয়সী ছেলে বক্তৃতা দিচ্ছে, মুখটা একটু বঙ্কিম। ভিয়েতনামের লড়াই আর আজকের কলেজ স্ট্রিটের এই লড়াই, দুটো পৃথক ঘটনা নয়। আমাদের সমবেত শক্তি বুলেট রুখে দেবে। ফিরিয়ে দেবে কাঁদানে গ্যাসের শেল। চটের থলের ভিতর অনঙ্গমোহনের লজ্জামুঠি। একটা বই ছটফটাচ্ছে। রেলিঙের সামনে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে বই দেখছে। কথা বলছে। জীমূতবাহন, বেণীসংসার এইসব দু’একটা কথা কানে এল অনঙ্গমোহনের। ওরা সংস্কৃত বই দেখছে। দাম জিজ্ঞাসা করছে। মলয়পবন বয়ে গেল অনঙ্গমোহনের শরীরে। মেয়েটি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল—আই হরপ্রসাদ, ঐ দেখ জীবনানন্দ বিদ্যাসাগরের টীকা। একটা বাহুবল্লবী টেনে নিল বইটা। নৈষধ চরিত। অনঙ্গমোহনের মুঠি আলগা হয়ে যায় চটের ভিতরে। বইটা পড়ে যায়। অনঙ্গমোহন হুমড়ি খেয়ে পড়েন মেয়েটির পাশে। মেয়েটি বই খোলে। অনঙ্গমোহন দেখেন তাঁরই হস্তাক্ষর। সেই বই, যে বইটি সুমিতাকে দিয়েছিলেন অনঙ্গমোহন। নৈষধচরিত। একটা বোম পড়ল। দোকানদার বলল, আবার গণ্ডগোল শুরু হল। বইটা নেবেন তো নিয়ে নিন। সব বন্ধ করে দেব। ছেলেটি বলল, তুই নিয়ে নে নারে সুমিতা, আমি তোর থেকে নিয়ে পড়ব। এই মেয়েটিরও নাম সুমিতা? অনঙ্গমোহন মেয়েটিকে দেখতে লাগলেন। চশমা পরা। নিবিড় চুল কাঁধ পর্যন্তই। যবনকন্যাদের মতো কুর্তা ও পাঞ্জাবি পরনে।
মেয়েটি কুড়ি টাকা নগদ দিয়ে বইটি কিনে নিল। ছেলেটিকে আস্তে আস্তে বলল, বেশ চিপে পেলাম, নারে?
ছেলেটির কিন্তু মলিন ধুতি এবং জামা। ছেলেটি কিছু বলে না।
অনঙ্গমোহন ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বুকটা টনটন করতে থাকে। মেয়েটির ব্যাগে ঢুকে গেল নৈষধচরিত। এই মেয়েটির নামও সুমিতা। অনঙ্গমোহনের বুকটা কীরকম টনটন করছে, চোখ দিয়ে হঠাৎ দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আনন্দে। সুমিতা শেষ হয়ে যায়নি। আরও অন্য সুমিতা আছে। সারস্বত সাধনা একটা প্রবাহ। সহজে মরে না। সংস্কৃত আছে। মরে নাই। মেয়েটি বলে, অলঙ্কার নিয়ে কাজ করতে গেলে নৈষধ পড়া উচিত। ছেলেটি কাল লাইব্রেরিতে আসিস বলে একটা বাসে উঠে যায়। মেয়েটি হাঁটতে থাকে। অনঙ্গমোহনের অনেক কথা বলার ছিল। মেয়েটিকে ডাকা দরকার। প্রথমেই নৈষধ সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণা নিরসন করা দরকার। তুমি অলঙ্কারশাস্ত্রে গবেষণা করবা। তোমার জাইন্যা রাখা উচিত, সংস্কৃত ভাষায় অনুপ্রাসের আধিক্য ভাষাকে কর্কশ করে। শ্রীহর্ষ অত্যন্ত অনুপ্রাসপ্রিয় ছিলেন, অত্যুক্তিপরায়ণ ছিলেন। নৈয়ায়িক মহাশয়রা যে হেতু অত্যুক্তিপ্রিয় সেহেতু তাঁরা সকল কাব্য অপেক্ষা প্রশংসা করেন। উদিতে কাব্যে ক্ব মাঘঃ ক্বচ ভারবিঃ, এই সব তাঁদেরই উক্তি। তৎসত্ত্বেও নৈষধচরিত একটি প্রধান কাব্য। নৈষধচরিত বিষয়ে এক কৌতুকাবহ প্রস্তাব আছে, শুন কই, শ্রীহর্ষ নৈষধচরিত রচনা কইরা তার মাতুলের কাছে গেলেন দেখাইতে। তাঁর নাম মম্মভট্ট, একজন প্রধান আলঙ্কারিক। মম্মভট্ট আদ্যোপান্ত পড়লেন, তারপর কইলেন, বাপুহে। যদি তুমি কিছুপূর্বে গ্রন্থখানি আইনতা, তবে আমার প্রভূত শ্রম লাঘব হইত। বহু গ্রন্থ পাঠ কইরা আমি আমার অলঙ্কার শাস্ত্রের ‘দোষ পরিচ্ছদ’ পর্বে আলঙ্কারিক দোষসমূহের উদাহরণ উদ্ধৃত করতে পারতাম।
মেয়েটি রাস্তা পার হচ্ছে। অনঙ্গমোহনও মেয়েটির পিছন পিছন যেতে লাগলেন। শুন বালিকা, অনেক কথা আছে, তোমাকে কইতে চাই। নৈষধচরিত এক অমূল্যগ্রন্থ, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। তবে অলঙ্কার শাস্ত্র এক বিশাল ব্যাপার। আমার আহৃত জ্ঞান সব দিয়া যামু তোমারে। আমার একটি টোল আছে। পূর্ণচন্দ্ৰ চতুষ্পাঠী। আসবা যদি তুমি, ও মাইয়া, শোনছ, যদি তুমি আমার টোলে আস, তোমারে আরও বই দিমু, আমার আরও বই আছে। শোনছ? যে বইখানা তোমার কালো ব্যাগের মধ্যে শুইয়া আছে, দেইখ্যো, পাশে পাশে আমার স্বহস্তের মন্তব্য লিখা আছে।
দূরে কোথাও শব্দ হল। মানুষজন চঞ্চল হয়ে উঠছে। মেয়েটি মানুষের আড়াল থেকে বেরিয়ে গাড়ির আড়ালে যায়, আবার গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে মানুষের আড়ালে।
ও মাইয়া, সংস্কৃত ভাষা হইল খনি। হীরার খনি। আবার জোরে শব্দ হল। মানুষেরা ছুটছে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাতাসে ঝাঁঝালো গন্ধ। মেয়েটি হারিয়ে গেল। অনঙ্গমোহন গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটিকে খুঁজতে লাগলেন। মেয়েটিকে আর পেলেন না। অথচ ওর সঙ্গে অনেক কথা ছিল।
একটা পুলিশের গাড়িতে বোমা পড়ল। কালো গাড়ি থেকে নেমে এল বন্দুক ওঁচানো পুলিশ। সমস্ত লোকজন ফাঁকা। অনঙ্গমোহন সামনে দাঁড়িয়ে, ওঁর দিকে তাক করা বন্দুক। একজন বলল, ভাগ হিঁয়াসে …
অনঙ্গমোহন একটা গলি পেয়ে যান সামনে। গলির ভিতরে ঢুকে যান। গলির ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে হাতিবাগানে আসেন। রাস্তায় হরিণঘাটার গুমটিঘর জ্বলছে। সমিধ। ওঁ অগ্নে তং শিখিনাবাসি। দমকলের ঘণ্টাধ্বনি। মানুষের চিৎকার। রাস্তায় রক্ত। অনঙ্গমোহন ছুটতে থাকেন। হাতে চটের ব্যাগ। ব্যাগে বই। ছুটতে থাকেন। একটি অঙ্গার প্রায় ট্রাম। বন্দুক ওঁচানো পুলিশ। ছুটতে থাকেন অনঙ্গমোহন। রাস্তায় লোকজন নেই। কালো গাড়ির গোঁ গোঁ শব্দ। দমকলের ঘণ্টা। বাড়ি ফিরলেন শেষ অব্দি। কান্নার আওয়াজ। স্বপ্নার, অঞ্জলির, বিলুর। ন্যাড়া মারা গেছে। পুলিশের গুলিতে। কারা যেন বাসে আগুন দিচ্ছিল। পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। চায়ের গ্লাসে চামচ নাড়াতে নাড়াতে ন্যাড়া পড়ে যায়। ন্যাড়া এখন পুলিশের কাছে। লাশ।