চতুষ্পাঠী – ২০

কুড়ি

আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতিময়ীর আগমন বার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি। বাজল…বাজল তোমার আলোর বেণী, মাতল যে ভুবন। বিলুর হাতে বালতি, ব্যাগে পোস্টার। পুজো আসছে।

ব্যাট করছেন চাঁদু বোরদে, বল করছেন গ্রিফিথ্। গুডলেংথ বল, সপাটে ঘুরিয়েছেন, ক্যাচ…না, ধরতে পারেনি সরদেশাই, বলটা ড্রপ খেয়ে নর্দমায় পড়েছে। আ-বে বোরদে খেলা ছোড়দে। আজ হরতাল। ওরা খেলছে, খেলুক। হরতাল ওদের।

লেড়কা লেড়কি, শ্রেঃ কিশোর মমতাজ। তার উপর সুন্দর করে ঋতুবন্ধের পোস্টার মারে বিলু। ‘নারায়ণ দৈবশক্তি ঔষধালয়’-এর উপর সুন্দর করে ঋতুবন্ধের পোস্টার মারে। ন্যায্য দরে খাদ্য দাও নইলে গদি ছেড়ে দাও…এটা থাক, এটা থাক। একটা ল্যাম্পপোস্ট পোস্টারে ভরিয়ে দেয়। ঋতু বন্ধ? দুশ্চিন্তা কী? অনায়াসে আরোগ্য। দি আইডিয়াল ক্লিনিক। নারীমঙ্গল ক্লিনিকের উপর ভাল করে পোস্টার মারে বিলু।

ম্যানেজারবাবু বলে দিয়েছেন, যেখানেই নারীমঙ্গল ক্লিনিক দেখবে ভাই, সেটা মেরে দেবে। মেরে দেওয়ার মানে হল ঠিক তার উপর আইডিয়াল ক্লিনিকের পোস্টার সাঁটা। নারীমঙ্গল আর আইডিয়াল ক্লিনিক হল ইস্টবেঙ্গল- মোহনবাগান। শত্রু। এরা একই কাজ করে। ঋতুবন্ধে উপশম। একই রাস্তায় দুটো। বিলু একটা মোটা থামের নারীমঙ্গল ঢেকে দিতে থাকে আইডিয়াল ক্লিনিক দিয়ে। ক্রিমিনাশিনী, গুপ্তরোগের চিকিৎসা, খাদ্য আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় সফল করুন। পোস্টার…কত পোস্টার।

টাইনি টটস। দি আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুল ফর চিলড্রেন। অ্যাডমিশন গোয়িং অন। কনট্যাক্ট মিস জিজা রায়/মিসেস সুমিতা মিত্ৰা।

কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায় বিলু। পোস্টারটাকে দেখে। তারপর দ্রুত ঢেকে দেয়। টাইনি টটস-এর গায়ে আইডিয়াল ক্লিনিক সেঁটে দিতে থাকে। ঠাস ঠাস শব্দ। ক্রমাগত ঋতু বন্ধ? ঋতু বন্ধ? ঋতু বন্ধ? ঋতু বন্ধ?…

বসন্তায় নমস্তুভ্যং গ্রীষ্মায়চ নমোনমঃ বর্ষাভ্যশ্চ শরৎসংজ্ঞ ঋতবে চ নমঃ সদা, ইহা ঋতু বন্দনার মন্ত্র। ঋতু শব্দের অন্য অর্থ রজঃ।

অমরকোষ পড়াচ্ছিলেন অনঙ্গমোহন। অমরকোষ হল শব্দার্থতত্ত্বের বই। মাত্র এক বছর আগেও বিলু এত বোকা ছিল যে, জিজ্ঞাসা করেছিল রজ কী দাদু? অনঙ্গমোহন তখন আস্তে আস্তে বলে দিয়েছিলেন, ঐ গোপন কথা। বিলুর কান লাল হয়ে গিয়েছিল। মাথা ঝনঝন করছিল। বিলু তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছিল, ওর মা কেন মাঝে মাঝে অনঙ্গমোহনের জন্য ভাত রান্না করে না, তখন কেন স্বপ্না আলাদা করে দাদুর জন্য ভাত ফুটিয়ে রাখে। কেন মা-মেয়ে গোপনে কথা বলে মাঝে মাঝে। কেন সামান্য ছেঁড়া কাপড়ের জন্য ওদের গোপন যত্ন ও যন্ত্রণা?

ইশ, মায়েদের এত কষ্ট…বিলু ভেবেছিল। এখন এই এক-দেড় বছরে বিলু কত বড় হয়ে গেছে, কত বুড়ো হয়ে গেছে বিলু। এখন বিলু অনেক জানে, পৃথিবীর অনেক কিছু। এইসব আইডিয়াল ক্লিনিকের নারীমঙ্গল ক্লিনিকের সব কিছু জেনে গেছে বিলু।

এই হদিসটা ন্যাড়াদাই দিয়েছিল বিলুকে। বিলু একদিন বলেছিল, ন্যাড়াদা, মায়ের হোটেলে খেতে আর ভাল লাগে না, তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নাও না, যা হোক কিছু দিও। ন্যাড়াদা বলেছিল, সিরিয়াসলি? বিলু বলছিল, সত্যি সত্যি। ন্যাড়াদা তখন বলেছিল, ভেরি গুড। এই তো বড় হচ্ছিস তুই। গুড সাইন।

ন্যাড়াদা বলেছিল, দ্যাখ বিলু। পৃথিবীতে বাঁচাটা হল একটা স্ট্রাগল। কিন্তু প্রশ্ন হল, কীভাবে বেঁচে থাকব। ভালভাবে, মানে সৎভাবে বেঁচে থাকার কোনো জবাব নেই। কিন্তু ঐ ভাল থাকতে পারাটাও কিন্তু কম স্ট্রাগল নয়। যেমন ধর, তুই কালির বড়ি ঝাড়তিস, আমিও ঝাড়া মাল কিনেছি, কিন্তু দ্যাখ, আমরা হাত ধুয়ে নিয়েছি। তুই তো এরপর আর মেশিন পার্টস ঝাড়তে যাসনি। আমিও তো চিৎপুর ইয়ার্ডের ওয়াগান ঝাড়া মাল কিনতে পারতাম। বলিরাম যেমন কিনেছে। নেপালবাবুর গঙ্গামাটি গুঁড়ো কিনে সিমেন্টে পাইল করতে পারতাম, কমিশনে ঐ সিমেন্ট ঝাড়তে পারতাম, করিনি, চায়ের দোকান দিয়ে দিব্যি আছি। এখন তুই যদি সৎভাবে কিছু আর্নিং করতে চাস তো সিনেমার টিকিটের কাজ করতে পারিস। তবে ওতে অনেক হাঙ্গামা। বহুত হিস্যার ব্যাপার আছে। বরং তোকে এমন একটা কাজ দিই, যেখানে কোনো ঝুট-ঝামেলার ব্যাপার নেই। আমিও করেছি কিছুদিন। তোর প্রেস্টিজ-ফেস্টিজের ব্যাপার নেই তো? দ্যাখ কিন্তু।

তারপর একদিন আইডিয়াল ক্লিনিকে নিয়ে এসেছিল ন্যাড়াদা। বলেছিল, এদের কাজ যাই হোক, তোর কী? তুই তো কচ্ছিস না। কর্ম করে যাও, ফলের দিকে তাকিও না।

তা, বিলু মাঝে মাঝে এই কর্ম করছে। ছুটিছাটার দিন চলে আসে। শ হিসাবে কাজ। একটা দুপুর কাজ করলে দু’টাকা, আড়াই টাকা হয়ে যায়। ওরা যে কাজই করুক, ম্যানেজার বড় ভাল লোক। বিলু যেদিন আসে কাজ পায়। ম্যানেজারবাবু বলেছেন, ভদ্রলোকের ছেলেরা যে প্রেস্টিজ ফেস্টিজের ইয়ে না করে সবরকম কাজ করছে, তাতে মনে হয় বাঙালি আবার জাগবে। বলেছিল, বিলেত, আমেরিকায় নাকি কলেজি স্টুডেন্টরা পেলেট ধোয়। বিলু আজ হরতালের দিনে সকাল সকালই বেরিয়ে পড়েছে। বিলু নিজের পাড়ায় এটা করে না। বেপাড়ায় করে। বাড়ির কেউ জানে না। গোপন। আজ কিছু বেশি কাজ করতেই হবে বিলুকে। কাল মহালয়া। কাল থেকে চায়ের দোকান স্টার্ট।

ক’দিন আগে ওখানে একটা মিটিং হল। পটলার তেলেভাজা দোকানের সামনে। ওখানে ইট সাজিয়ে একটা বেদি করা হয়েছিল, বেদিতে চুন দিয়ে সাদা রঙ করা হয়েছিল। লেখা হয়েছিল, খাদ্য আন্দোলনের অমর শহিদ স্বপন সরকার লাল সেলাম। বক্তৃতা হল। স্বপ্নাকে যেতে বলেছিল বাবলুদা, ও যায়নি। বিলু গিয়েছিল। শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না। শহিদের রক্তঋণ শোধ করবই। এই খুনী সরকারকে সরিয়ে একটা বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এই হত্যাকাণ্ডের জবাব দিতে হবে। বিলু জুলজুল করে দেখছিল, তেলেভাজা দোকানটার পাশের ঐ ছোট লাল রোয়াক এবং দেয়ালটা। মিটিং শেষ হলে পটলা গুঁইকে বিলু বলেছিল, ওখানে চায়ের দোকান দেবে। পটলা বলেছিল, এমন জায়গা কি পড়ে থাকে। বুকড হয়ে গেছে। বিলু তখন সাদা রঙ করা ইটের বেদির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমার জামাইবাবু, এখানে শহিদ হল আর অন্য লোক বুক করে নিলেই হল? এখানে আমি বসব। তখন অমর শহিদ স্বপন সরকার যুগ যুগ জিও হচ্ছিল। তারই মধ্যে পটলা বলল—তোমার আগে বলা উচিত ছিল। তুমি তো জানতেই, আমি ন্যাড়াকে বসিয়েছিলাম। জায়গাটা ফাঁকা হবার পর অন্য একটা ছেলে কথা কয়ে গেছে, সে তো বাবলুরই লোক। শহিদের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ শেষ করে বিলু বাবলুদাকে বলল, ন্যাড়াদার ঐ জায়গাটায় আমিই বসব। আপনি ব্যবস্থা করে দিন। বাবলুদা বলেছিল, সে কী রে, তুই পারবি? বিলু বলেছিল—কেন পারব না, কী এমন কঠিন কাজ, আমার থেকে ছোট ছোট ছেলেরাও তো করছে।

তোর পড়াশুনো?—ইস্কুল? বিলু মাথা নিচু করেছিল।

এখন পড়াশুনো নিয়ে কিচ্ছু ভাবে না বিলু, ভাবতে পারে না, ট্রাপিজিয়াম, রম্বস, লম্ব, অতিভুজ, ক্ষেত্রফল, অশোক, বিক্রমাদিত্য, লোট, লুট, বিধিলিঙ—এই সবকিছু হারানো-পুরনো। সারা কাপড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি কালির বিন্দু মাখা মলিন কাপড়ে মোড়া দুই বিধবা, মা ও মেয়ে, বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না বিলু, দুটো গাছ, লতা গাছ, সর্বাঙ্গ থেকে বেরিয়েছে আঁকশি, হিল হিল করছে, কিছু আঁকড়ে ধরবে বলে, নিষ্ঠুর, ভয়ঙ্কর, অক্টোপাসের মতো। বিলু কিছুই বলতে পারছিল না তেমন, শুধু বলছিল, ওটা হলে খুব ভাল হত। আমাকেই দিন না ওটা বাবলুদা…

বাবলুদা বলেছিল—আমরা একটু কথা বলেনি, বাবলুদা তখন পটলা, আরও দু’চারজনের সঙ্গে গম্ভীর আলোচনা করল। তারপর বলল, ওখানে তুই-ই বোস বিলু, বেশি দেরি করিস না, জায়গা রাখা যাবে না।

বিলু একথা বলেছিল অঞ্জলিকে। অঞ্জলি শুনেই গলা চড়াল। কেন? তুই কেন? তোর ভবিষ্যৎ নাই। তুই সাইন্‌স পড়বি। আর কেউ না বসে আমিই বসুম। আমার প্রেস্টিজের দরকার নাই। প্রেস্টিজ ধুইয়া কি জল খামু?

একদিন রাত্রে কার স্পর্শে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বিলুর। বুঝল ওর মা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বিলুর গায়ে। বিলু বলল, এরকম কোর না মা। পরদিন অঞ্জলি ভীষণ গম্ভীর। কারুর সঙ্গেই কোনো কথা বলছিল না। একমনে ঠোঙা করছিল খালি। একবার বিলুকে ডাকল। বলল শোন, কথা আছে। কিন্তু কিছুই বলল না। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলল, না থাক। কোনো কথা নাই। একটু পর আবার বলল—বিলু, যশকাকুরে একটু খবর দিবি? একটি চিঠি দিয়ে বলল—এইটা ওনার হাতে দিস।

যশকাকুকে একদম ভাল লাগে না বিলুর। ওর মা যে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, তা কি যশকাকুর জন্যই? মালিক যখন বাড়িতে প্লাস্টিকের কারখানা করল, তখন টিনের কোম্পানির অধিকাংশকেই রাখেনি। মাকে তো ডেকে নিয়েছিল। মা কেন ছেড়ে দিল তবু?

বিলু রাস্তায় গিয়ে চিঠিটা খুলেছিল। লেখা যশদা, আমি হতভাগিনী। শেষ অব্দি ক্রমশ আপনাদের দোরে আবার যেতে হবে। মালিক রাজি হবে কি? একটু খোঁজ করবেন।

বিলু কাগজটা দিয়েছিল। যশকাকু কাগজটা পড়ে ঠোঁট উল্টোল। বলল, তোমার মায়ের কোনো কথারই ঠিক নেই। বলে গেল, আর জীবনে এমুখো হব না।

যশবাবু এসেছিল সন্ধ্যার সময়। অঞ্জলি বলল—স্বপ্না, বিলু, তোরা একটু বাইরে যা। নিচু গলায় কথা হচ্ছিল। বিলু আর স্বপ্না জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। কেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছিল না। বিলু শুনল, মায়ের গলা ক্রমশ উঁচু হয়ে যাচ্ছে। বলছে, আমার জন্য আলাদা নিয়ম কেন?

যশকাকু কী বলল, শোনা গেল না।

মা বলল, আমার আলাদা খাতির কেন?

যশকাকু বলল—এটা মালিকের ইচ্ছে। নইলে মালিক কেন?

তাহলে আমার কী কাজ করতে হইব? যশবাবু কী বলল, শোনা গেল না। আচমকা কান্নার আওয়াজ শুনল। মা কাঁদছে। আমি যাব না যশদা, আপনি চইলা যান। আমার সামনে থেকে চইলা যান অখনি।

যশবাবু নীরবে মোকাসিন গলিয়ে নিল পায়ে। অঞ্জলি সামনে এল। বলল, কিছু মনে করবেন না যশদা, আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন। আমারে ক্ষমা করবেন। মোকাসিনে শব্দ হয় না।

বিলু এরপর আস্তে আস্তে কেটলি, গেলাস, প্লেট, ছাঁকনি এইসব জোগাড় করেছে। কিচ্ছু বলেনি মা।

কাল মহালয়া। কাল থেকে দোকান স্টার্ট। কাল গঙ্গায় খুব ভিড় হবে। তর্পণ করতে আসবে শয়ে শয়ে লোক। ভাল বিক্রি হবে। কাল বাড়িতে চা করেছিল বিলু। অঞ্জলিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেমন হয়েছে মা? অঞ্জলি কিছুক্ষণ উদাস তাকিয়েছিল চায়ের কাপের দিকে।

বিলু পোস্টার মারা শেষ করে আইডিয়াল ক্লিনিকের দিকে যায়। দরজার গায়ে একটা লাল যোগ চিহ্ন, ডাক্তারদের গাড়িতে যেমন থাকে। দরজা খুললেই একটা ঘর। ওখানে একটা বেঞ্চি পাতা থাকে, একটা নোংরা চাদর পাতা টেবিল, ওটা ম্যানেজারের, আরেকটা ঘর, সামনে সবুজ পর্দা ফেলা, ভিতরে জ্ঞান ডাক্তার। জ্ঞান ডাক্তার আসলে ডাক্তারই নয়, বিলু তা জানে। জ্ঞান ডাক্তার একটা নাম। জ্ঞান ডাক্তারের সঙ্গে বিলুর কোনো দিন কথা হয়নি, শুধু সবুজপর্দার ভিতর থেকে জ্ঞান ডাক্তারের ভাঙা ভাঙা গলার কথা শুনেছে বিলু, আগে আসেননি কেন, এখন তো খরচা বেশি পড়ে যাবে। কিংবা কোনো ভয় নেই, কোনো ভয় নেই, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এইসব।

বিলু যোগ চিহ্ন লাগানো দরজাটা খুলল। ঠক করে আঠার বালতিটা রাখল মেঝের উপর। টেবিলে ম্যানেজার নেই। সবুজ পর্দার ওদিক থেকে ভেসে এল—কোনো অসুবিধা হবে না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ এবার একটু চাপা গলা—তাহলে ঐ কথাই রইল অ্যা। ছিটকে গেল ছাগমুণ্ড রক্তস্রোত, কাঁপছে ছিন্ন শরীর, সমস্ত বাস, লরি, ট্যাক্সি একসঙ্গে তীব্র হর্ন দিয়ে উঠল, বিদ্যুৎ চমকাল আকাশে, সাইরেন বাজল।

হ্যাঁ-হ্যাঁ-ঐ কথাই রইল।

তাহলে আসি? অ্যাঁ?

সবুজ পর্দার ফাঁক দিয়ে বিলু দেখল, কালো ফিতের চটি। নীল বুটির শাড়ি।

বিলু ছুটল। ভীষণ ছুটল। শোভাবাজার পেরিয়ে, বি কে পাল পেরিয়ে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে চলে যেতে চায় বিলু।

রাস্তার কল থেকে ঢক ঢক জল খেল বিলু। একটা ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও নৃসিংহ অবতার হল। মুখে সূচালো দাঁত, হাতে তীক্ষ্ণ নখ, যশবাবুর পেটে নখ বসিয়ে দিল বিলু।

আনমনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে বিলু। রাস্তার আলো জ্বলে উঠল, ওর ভাল লাগল না। বারো ঘণ্টার হরতাল শেষে গাড়িঘোড়া চলতে শুরু করেছে, ওর ভাল লাগল না। একটা দুটো দোকানপাট খুলছে, ওর ভাল লাগল না। মা ওখানে গেল কেন, কেন গেল মা?

আজ সকাল থেকেই মা কেমন গম্ভীর ছিল। স্টোভ, কেটলি আর গেলাস গুছিয়ে রেখেছিল বিলু, মা বলেছিল ওগুলো ঢাকা দিয়ে রাখ, ওগুলোর দিকে তাকাতে পারছি না।

স্বপ্নাও কেঁদেছিল সকালে। মা ওকে ছাদে নিয়ে গিয়েছিল। মা আজ ওখানে কেন গেল? কেন গেল মা?

একটু বেশি রাতেই বাড়িতে গেল বিলু। অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, এত রাত করলি যে?

বিলু বলল, বেশ করেছি। বিলু ওর মায়ের মুখের দিকে তাকায় না।

অঞ্জলি খেতে দিল, কোনোরকমে খেয়ে নিল বিলু। বারান্দায় অনঙ্গমোহনের পাশে শুয়ে পড়ল। অনঙ্গমোহন বললেন, বিলু আইলি?

বিলু কথা বলল না।

অনঙ্গমোহন বললেন, কাইল হইতে চায়ের দোকান?

হ্যাঁ।

আমিও যামু। আমিও কাল ভোরবেলায় গঙ্গার পাড়ে গিয়া দাঁড়ামু। পথ বেশ্যারা যেমন যৌবনলক্ষণ প্রদর্শন করে, সেরকমভাবে আমি আমার শিখাসূত্র ও নামাবলী প্রদর্শন কইরা দাঁড়ামু। যে আত্মা আগুনে পোড়ে না, ছিঁড়া যায় না। নৈনং ছিন্দতি নৈনং দহতি, ক্ষুধা পিপাসার ঊর্ধ্বে যে আত্মা, তারে আমি জল খাবামু, ন জায়তে ম্রিয়তে বা যে আত্মা, তারে লইয়া খেলা কইরা পয়সা নিমু। দক্ষিণা। বিষ্ণুদৈবতং ব্রাহ্মণায় দক্ষিণামহং দদে। কাল হইতে আমি যাজক। বুদ্ধি পৌরুষহীনানাং জীবিকা ধাতৃ নিৰ্মিতা…

অনঙ্গমোহন বিড়বিড় করেই চলেছেন। বিলু চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে ওঠে। ঘরে যায়, শব্দহীন মায়ের একটা হাত স্বপ্নার মাথার কাছে, স্বপ্না আর মা পাশাপাশি শুয়ে আছে দু’জন দু’জনকে ছুঁয়ে, দুই সখী। মায়ের একটা হাত স্বপ্নার মাথার উপরে মমতা বুলিয়ে দিচ্ছিল, যেন এইমাত্র থেমেছে। বাইরের রাস্তার আলো ঘরের ভিতরে এসে কিছুটা পড়েছে, পরিকল্পনাহীন; বটপাতার ছায়াও কিছুটা আচ্ছন্ন। মশারির পাশে বসে বিলু একা জেগে থেকে দেখে, মায়ের শরীরে আলো ও ছায়ার ছলনা। বিলু খামচে ধরে নিজের চুল। চোখ জাহাজের সার্চলাইট হতে চায়। মায়ের শরীরে ঘোরে ঐ ভূতগ্রস্ত জাহাজি আলো। ওখানে কেন গিয়েছিলে, কেন গিয়েছিলে মা গো!

ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে বিলু। অনঙ্গমোহন কী সব বিড়বিড় করেই চলেছেন। বিলু একা একা রান্নাঘরে যায়। উচ্ছিষ্ট বাসনগুলো টেনে নেয়। কলতলায় যায়, ছাই মাখে হাতে, প্রাণে বড় শান্তি হয়, বাসনে ছাই বুলোয়, প্রাণে বড় শান্তি হয়, বাসন ক’টা ধুয়ে রান্নাঘরে রেখে দেয় ফের।

অনঙ্গমোহন বকেই চলেছেন—কর্ণ বধ হইল, কর্ণ বধ। অর্জুন কয় হে কৃষ্ণ, কও দেখি, কর্ণের প্রকৃত হত্যাকারী কে? কৃষ্ণ কইলেন—ত্বয়া ময়া চ, কুন্ত্যাচ—তুমি, আমি, কুন্তী, ইন্দ্র, ধরণী, পরশুরাম, ছয়জনই দায়ী। কৰ্ণবধ আগে হইল না কেন, আমি কেন আগেই যাজক হইলাম না, বৌমা, বৌমাগো কত কষ্ট করছ…এতদিন…

এমন সময় একটা গভীর দীর্ঘশ্বাসের কাতর শব্দ শোনে বিলু। যেন মরুভূমি থেকে আসা হালকা হাওয়া। উঃ মাগো…

উঃ শব্দের বিসর্গ বিন্দু দুটি দু’ফোঁটা জল। বিসর্জন।

স্বপ্নার গলা শোনে বিলু।

মাগো…

উ।

আমি পারব না মা। পারুম না।

এখন ঘুমা।

ঘুমাতে পারি না মা।

পারবি।

পারুম না আমি…স্বপ্না ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমি ঐখানে যাব না মাগো, আমি যামু না। স্বপ্না গোঙায়।

অঞ্জলি চাপা স্বরে বলে—কোনো ভয় নাই তোর, কিচ্ছু হইব না। স্বপ্না কাঁদে। বলে, ও থাক। ও থাক মা। ও আমার থাক। ও থাক, প্লিজ মাগো…

.

আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক-মঞ্জির। বিলু কাপ, কেটলি, প্লেট, স্টোভ ব্যাগের মধ্যে ভরে নিল। হিমাচল দিলেন সিংহবাহন, বিষ্ণু দিলেন চক্র, পিনাকপাণি শংকর দিলেন শূল, যম দিলেন তাঁর দণ্ড…মাকে প্রণাম করল বিলু। দুগ্‌গা-দুগ্‌গা। জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিণী। বাবার ছবিকে নমস্কার করল বিলু। অনঙ্গমোহনের পায়ে হাত দেবার আগেই তিনি সরিয়ে নিলেন পা। অনঙ্গমোহন বললেন, আমিও তো যাইতেছি গঙ্গার ধারে, চল একসঙ্গে চল। যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা…। ওরা রাস্তায় নামে। ব্রাহ্ম মুহূর্ত। মৃদুমন্দ সমীরণ। এসেছে শরৎ হিমেল পরশ…। আমলকি বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরুদুরু, পেয়েছে খবর পাতা খসানোর…। হালকা বাতাস রাস্তার শালপাতা ছেঁচড়াচ্ছে।

পটলার দোকানে ধোঁয়া। আঁচ পড়েছে। পটলা বলল, বসছিস? ভাল দিন। মহালয়া। বেসন ফেটাচ্ছে পটলাদা।

বিলু স্টোভ বার করে। কাপ, কেটলি, গেলাশ, বয়াম, চামচ…লাল রকটা দোকান হয়ে যায় ক্রমশ। ন্যাড়াদার শহিদ বেদিতে এসে যায় কাক।

বিলু স্টোভে পাম্প দেয়। আগুন শোঁ শোঁ করে। কেটলিতে জল বসায়। জল গরম হয়। তাপ নিচ্ছে জল।

পাঁচশো সাঁইত্রিশ ক্যালোরি লীন তাপ প্রতি গ্রামে। জল স্ফুটনাংকে পৌঁছে যাচ্ছে ক্রমশ। জল ফোটে। জল টগবগ করে।

একটু পরেই বিলু দেখে, ঐ ফুটন্ত জলের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন অনঙ্গমোহন। নামাবলীর কোণা পাকাচ্ছেন হাতের আঙুলে।

বিলুরে বিলু, আমি পারলাম না। অনঙ্গমোহনের চোখে জল।

মন্ত্র পড়াইয়া দক্ষিণা চাওয়া আমার দ্বারা হইল না। আমি কুষ্মাণ্ড। আমি গর্ভস্রাব। আমি কিচ্ছু না। আমি বোঝা।

বিলু অনঙ্গমোহনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্বাক। স্টোভে আগুনের শোঁ শোঁ শব্দ।

তুই ঘরে যা বিলু, ঘরে যা। বীজগণিত কর। বস্তুবিদ্যা পড়। বিদ্যার কোনো বিকল্প নাইরে বিলু, অবিদ্যঃ জীবনং শূন্য। আমি বরং চায়ের দোকান করি। পারুম। এই কাম আমি নিশ্চয় পারুম। এই তো পারতাছি, দেখ…দেখ…স্টোভে পাম্প দিতে থাকেন অনঙ্গমোহন। আগুন বেড়ে ওঠে। শোঁ শোঁ শব্দ। অগ্নে…। অগ্নে ত্বং শিখিনামাসি। দু’হাত বাড়িয়ে আগুনের দিকে চেয়ে অনঙ্গমোহন বললেন—অগ্নে, ক্ষমস্ব। ওঁ অগ্নয়ে প্রজাপতিঋষিঃ অগ্নিদেবতা অগ্নৌ সমিধদানে বিনিয়োগঃ। হে অগ্নি, আমি আমার পাণিনি, কলাপ, আমার কালিদাস, দণ্ডী, ভর্তৃহরি, আমার টীকাটিপ্পনী, অলঙ্কার আমার অহংকার তোমাকে সমিধস্বরূপ দান করলাম।

রাস্তার লোকজন ঠিকঠাক গঙ্গার দিকেই যাচ্ছে, ব্যতিক্রমহীন। রিকশাওয়ালার নির্বিঘ্ন গতি, ঠুং ঠুং শব্দ। খবর কাগজওয়ালা, ভিখারি এবং প্রজাপতিঋষি কারুরই কোনো বিকার নেই। সর্বত্র অব্যয়ীভাব।

অগ্নে, হে অগ্নি, ওঁ ইদং চিত্তায় স্বাহা। আকুতঞ্চস্বাহা। ওঁ আহুতিশ্চ স্বাহা। ওঁ মনশ্চ স্বাহা। হে মাঘ, ভারবি, তোমরা দেখ। হে বাণভট্ট, তোমার চন্দ্রাপীড়ের আনন্দোচ্ছ্বাস দিয়া কিশমিশ শোভিত কেক মোড়াইয়া খরিদ্দার খুশি করুম তোমরা দেখ। হে দেবতাগণ, পুষ্পবৃষ্টি কর। মেঘদূতমের পৃষ্ঠায় প্যাকেট কইরা খরিদ্দাররে দিমু সুজি বিস্কুট।

আর আমার পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠীর খাতাগুলি ছিঁড়া ছিঁড়া আমি…

পটলাদা বলল, ভালই করেছিস বিলু, দাদুকে দিয়ে পুজোটা করিয়ে নিচ্ছিস।

অনঙ্গমোহন কেটলিতে চাপানো ফুটন্ত জলের দিকে তাকিয়ে বলতেই থাকেন—ওঁ শন্ন আপো ধন্বন্যাঃ শমনঃ সন্তু নৃপ্যাঃ হে জল, হে ফুটন্ত জল, হে চায়ের জল, আমাদের মঙ্গল কর। ওঁ আপো হি ষ্ঠা ময়োভুব স্তা ন ঊর্ধ্বে দধাতন…হে জল, চায়ের জল হে, আমাদের অন্নভোগের অধিকারী কর। রমণীয় ব্রহ্মের সঙ্গে সংযুক্ত কর। কারণ অন্নই ব্রহ্ম। আমারে বাঁচাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *