চতুষ্পাঠী – ২

দুই

বিলু মাঝে মাঝেই ভাবত, এখনও ভাবে, এইমাত্র যেমন ভাবল ওর বাবার মৃত্যুর জন্য ও নিজেই দায়ী। বাবাকে খাইয়েছে ও বিষ সন্দেশ।

যে বাড়িতে বিলুরা থাকে, সেই বাড়িটা অন্তত দেড়শো বছরের পুরনো খোপে খোপে গোলা পায়রারা থাকে, গলা ফুলিয়ে বকম বকম করে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। আঠাশটা সিঁড়ি। প্রথম দশটা সিঁড়ির পর একটা বাঁক, তারপর সিঁড়ি, আবার দশটা। সিঁড়ির বাঁকগুলোতে সিঁড়িটা কিছুটা চওড়া হয়, ওখানে কয়লার ড্রাম রাখা নিয়ে শিখার মায়ের সঙ্গে বিলুর মায়ের কী ঝগড়া। বেশ করেছি রাখব। আমরা বিনা ভাড়ায় থাকি নাকি, আমরা সবাই ভাড়া দি। জানা আছে জানা আছে তিন মাসের ভাড়া কার বাকি…এই রকম কথাবার্তা হয় ঝগড়া হলে। এখন সিঁড়ির দুটো বাঁকে দুটো কয়লার ড্রাম। বিলুদের আর শিখাদের। শিখাদের সঙ্গে কথা বন্ধ ছিল অনেকদিন। শিখার বাবা গান জানেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে পারেন। শাড়ি পরা মেয়েরা এসে গান শিখে যায়। ওরা খবর কাগজ রাখে। যখন ঝগড়া ছিল না তখন বিলু ওদের ঘরে গিয়ে মাঝে মাঝে খবর কাগজ পড়ে আসত; নেহরুর পর কে? পাকিস্তান হইতে পুনরায় উদ্বাস্তু আগমন। নেতাজি জীবিত আছেন। ফুল আপনার ভাগ্য বলিয়া দিবে। শিখার বাবা খুব নেতাজি ভক্ত ছিলেন। বলতেন শৌলমারীর সাধুই নেতাজি। নেতাজি যখন আত্মপ্রকাশ করবেন তখন জওহরলাল গদি ছেড়ে পালাবে। শিখার বাবা নেতাজির জন্মদিনে বারান্দায় নেতাজির ছবি একটা চেয়ারে বসিয়ে মালা দিতেন, ধূপ জ্বালাতেন আর বেলা বারোটা নাগাদ শাঁখ বাজাতেন। গাঁদা ফুলের ঝিরিঝিরি পাপড়ি দিয়ে লিখতেন জয়তু নেতাজি। তেইশে জানুয়ারির দুপুরে শাঁখ বাজানো হলে শিখার বাবা ছাত্রীদের নিয়ে গাইতেন—কতকাল আর কতকাল বল মা…ভারতের বীর ছেলে/নেতাজীকে বিদায় দিলে/মা গো বল কবে শীতল হবে…। মরুতীর্থ হিংলাজের ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ গানটির সুরে গাইতেন শিখার বাবা। শিখা আর বিজুও গাইত। ঐ গানটারই এক জায়গায় ছিল—চীনের এই আক্রমণে/দেশমাতার ব্যথা মনে/তুমি এসে ভারতের কালিমা ঘুচাও।

শিখার বাবা খুব সুখী লোক ছিলেন। অফিসে যাবার সময় শিখার মা দুগ্‌গা দুগ্‌গা বলে একটা পান গুঁজে দিতেন হাতে। তখন শিখার বাবা পানটা মুখে দেবার আগে এমন করে হাসতেন যেন টাইম কলে জল এল। একদিন সিঁড়ির বাঁকটায়, যেখানে কয়লার ড্রাম ঐখানে চুমু খেতে দেখেছিল বিলু, বিলুর হাতে তখন ঘুড়ি। মুখপোড়া ঘুড়ি। বিলু দ্রুত উঠে গিয়েছিল উপরে। শিখার মায়ের চাপা গলায় বিলু ‘মুখপোড়া’ কথাটা শুনেছিল। ওটা ঘুড়িকে বলেছিল না বিলুকেই, এখনো জানে না বিলু। একদিন মনে হচ্ছে, সেই অফিসে যাবার সময়, শিখার বাবা বলেছিল, ‘যাই’, শিখার মা বলল—যাই বলতে নেই, ‘আসি’। শিখার বাবা তখন কি সুন্দর গেয়ে উঠল, সখী যাই যাই বলো না। বিলু তখন কলঘরে একা।

শিখারা খুব সুখী। ওদের বাবাও খুব সুখী। এখানে ওরা দুটো ঘর নিয়ে থাকে। ওখানে ওদের একটা দেশ আছে। দেশ থেকে পেয়ারা আসে, আমসত্ত্ব, জয়নগরের মোয়া। ছুটিতে ওরা দেশে যায়। জয়নগর মজিলপুর। বিলুদের কোনো দেশের বাড়ি নেই। বিলুর ঠাকুরদা দেশ ছেড়ে চলে এসেছিল। শিখাদের দেশ আছে। দেশের বাড়ি। শিখার বাবার গলায় গান ছিল। শিখার বাবা গান গাইত, শিখা বিজুরাও ওদের বাবার কাছে গান শিখত। ‘ওরে আর দেরি নয় ধরগো তোরা’, ‘আগুনের পরশমণি’, তারপর, ‘এই মণিহার আমার নাহি সাজে’—এইসব। বিলুর দিদি স্বপ্নাও কয়েকটা গান শিখে নিয়েছিল। স্বপ্না যদি গাইত, শিখা বলত, লজ্জা করে না আমাদের গান গাইছিস…স্বপ্নাও ওর দাদুকে নালিশ করলে অনঙ্গমোহন বলতেন রবিবাবুর গান গাও ক্যান? ডি এল রায় গাইবা, হেমচন্দ্র-নবীন সেন গাইবা। আর বিলুর মা বলত—রবীন্দ্রনাথ কারোর বাপের নাকি? রবীন্দ্রনাথ সবার।

বিলুর বাবার এমন কোনো জুতো ছিল না, যা পরে হাঁটলে মসমস শব্দ হয়। শিখার বাবার ছিল পাম্পসু জুতো, মোকাসিন জুতো। বিলুর বাবার ছিল নিরীহ চটি।

একবার বিলুর বাবা একজোড়া চটি নিয়ে এসে বললেন দেখ, দেখ, কেমন অদ্ভুত এক চটি। সর্বদা কেমন গদির উপর দিয়া হাঁটতাছি। বিলু পরে নাম জেনেছিল হাওয়াই চটি। আর যে প্যাকেটে চটিটা এনেছিল বিলুর বাবা, সেই প্যাকেটটাও ছিল অদ্ভুত। পাতলা ফিনফিনে, কাগজও নয়, আবার কাপড়ও নয়। ভিতরে জিনিস রাখলে কি সুন্দর দেখা যায়, আবার জলও ঢোকে না। বিলু নিতে চেয়েছিল ওটা, ওর বাবা দেয়নি। ওর বাবা টিফিনের বাক্স ওটা দিয়ে মুড়ে নিয়ে যাবে।

বিলুর বাবা জগদীশ সকাল আটটার সময় বেরিয়ে যেত বাড়ি থেকে, সন্ধ্যের সময় ফিরত। আবার বেরিয়ে রাত ন’টার আগে ফিরত না। এটা ছিল টিউশনি আর আগেরটা চাকরি। মাঝখানে এসে কিছু খেয়ে যেত বিলুর বাবা। চিঁড়ে খেত। চিঁড়ে ভেজা, চিনি বা আখের গুড় দিয়ে। দৈবাৎ নারকোল। অর্ধেক নারকোলের দাম চার আনা। চার আনায় দুটো বড় বড় সন্দেশ হয়। বিলুর বাবা কোনো রকমে চিঁড়ে-গুড় খেয়েই টিউশনিতে চলে যেত।

শিখার বাবা অফিস থেকে ফিরে সন্দেশ খেতেন দুটো। রুটি কিংবা পরোটা আলুভাজা। ফটিকের দোকান থেকে কাঁসার বাটি করে সাদা ফকফকে ডালডা ঘি কিনে নিত শিখা। আর বিরামের সন্দেশ। শিখাদের দেশ ছিল। দেশের জমির ধান ছিল। ঝুলবারান্দার দড়িতে ঝুলত শিখা আর বিজুর বাহারি জামা, জাহাজ ছাপ জামা, পাখি ছাপ জামা, ট্রিংকলের ডেক্রনের। বিলুর দিদি স্বপ্নার রঙ ওঠা জামার পাশে হিল হিল করত শিখার জামা—এবার পুজোয় আমায় একটা ভাল জামা দেবে তো, ট্রিংকলের জামা? স্বপ্না এরকম কথা বললে ওর বাবা স্বপ্নার মাথায় হাত দিয়ে বলত, হ্যাঁ দেবো দেবো। এই হ্যাঁ দেবো দেবো-র উচ্চারণ ভঙ্গি ও স্বরক্ষেপণের মধ্যে বিলু ওর বাবার অসহায় ভাবটা বুঝতে পারত। মিথ্যে বলার মধ্যে যে একটা অপরাধবোধ থাকে, সেটা বেশ স্পষ্ট ছিল। রেডিওর ব্যাপারেও এটা বুঝেছে বিলু।

শিখার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হলেও বৃহস্পতিবার নাগাদ আবার কথাবার্তা শুরু দিতে চেষ্টা করত বিলুর মা। কারণটা শুক্রবারের রেডিওর নাটক। সবার গলা চিনতে পারে বিলুর মা। প্রমোদ গাঙ্গুলি, প্রেমাংশু বসু, মঞ্জু দে, মেনকা দেবী, পাহাড়ী সান্যাল-সব্বাইয়ের। সমস্ত কাজপত্র গুছিয়ে রাত আটটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে শিখাদের ঘরে গুটি গুটি হাজির হয়ে যেত বিলুর মা। যদি সে রকম অবস্থা সৃষ্টি করতে অক্ষম হত বিলুর মা, বারান্দায় শিখাদের ঘরের পাশটাতে গিয়ে বসত। শিখার মা একদিন রেডিওর ভল্যুম কমিয়ে দিয়েছিল। সে দিন রাত্রে বিলুর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বিলুর মা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, বলছিল—পারবে না, পারবে না একটা রেডিও কিনে দিতে! শাড়ি নয়, গয়না নয়, একটা রেডিও। দীর্ঘশ্বাস সমেত হ্যাঁ, দেবো দেবো, শুনেছিল বিলু বাবার মুখে। খবর কাগজে পুজোর আগে আগে পৃষ্ঠাজুড়ে বাটার জুতোর ছবি বের হয় আর রেডিওর ছবি। ছবির পাশে দাম। টেলিরাড সোনেটা ২৭০ টাকা, মারফি প্রিমিয়াম ২৮০ টাকা। নেতাজি এলেই দেশের সব কিছু ভাল হয়ে যাবে। নেতাজি এলে রেডিওর দামও কমে যাবে? ইশ্।…যেন নেতাজি আসেন, তাড়াতাড়ি এসে যান। বিলু সিরিয়াসলি ভাবত।

একদিন রাত্রে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বিলুর। বিলুর মা বলছিল—দরকার নাই। ওগো দরকার নাই, রেডিওর দরকার নাই আমার। তুমি তোমার শরীলটা আগে দেখ। বিলু চোখ খুলে তাকিয়েছিল তখন। হলদেটে ম্যাদামারা একটা কম পাওয়ারের বাল্‌বের আলোয় দেখেছিল মায়ের আঁচল ঝুলে পড়েছে। একটা পাখা দিয়ে বাতাস করছে বাবার মাথায়। মেঝেতে পড়ে আছে বমি। বিলু হুড়মুড় করে উঠে পড়ে। বিলুর বাবা আবার উদ্গার তোলে। শব্দ করে বমি করে আবার। স্বপ্না তখনো ঘুমোচ্ছে। শুলেই ঘুম স্বপ্নার, কোনো হুঁশ নেই।

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে।

জগদীশ, ও জগদীশ। বমি করছিস? বমির শব্দ শুনি…অনঙ্গমোহন দরজায় টোকা দেন। বৌমা, ও বৌমা, দরজাটা খোলো।

অঞ্জলি বলে, ঢং। বুড়ার ঢং।

জগদীশ বলে, দরজাটা খুলে দাও।

বুড়া করবোটা কী?

খোলো বলতাছি। খুইল্যা দাও।

অঞ্জলি ঘোমটাটা লাগিয়ে নেয় এবং গজগজ করতে থাকে, সারাদিন কেবল গবৌ গাবৌ আর অং বং চং। পণ্ডিতি। এদিকে মানুষটা শ্যাষ হইয়া গেল। তার উপরে একটা আত্মীয় জুটাইছেন। খিল খুলতে গেলে যতটা জোরে শব্দ হওয়া উচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি জোরে খিল খোলার শব্দ হল। অনঙ্গমোহন ঘরে ঢুকে ছড়ানো বমির দিকে চেয়ে থাকেন। তারপর বলেন বায়ু। বায়ু চড়া। পিত্ত প্রবল।

হবে না? এতগুলোর ভাতের জোগাড় করতে হয় না?

অনঙ্গমোহন অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে থাকেন।

জানেন, আরও একটা টিউশনি নিছে? আজ বাড়ি আসারও সময় হয় নাই, খালি প্যাটে গ্যাস হয় না?

বিকালে সামান্য কিছু হলেও আহার করা উচিত। এক মুষ্ঠি চিড়া দিয়া…

থাক। হইছে।

জগদীশ কটমট করে তার স্ত্রীর দিকে তাকায়। অঞ্জলি আরও বেশি উত্তেজিত হয় তখন। বলে এর মধ্যে আবার অসীমরে জুটাইছেন উনি। কাণ্ডজ্ঞানটা কী?

অনঙ্গমোহন বলেন, মুখরা হয়ো না বৌমা

মুখ বুইজ্যা তো এতদিন ছিলাম। আর তো পারা যায় না। দ্যাখেন না মানুষটার কী অবস্থা, চোখের পাতা কি খাইছেন?

অনঙ্গমোহন একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালেন। বলেন ঝনঝনায়তে। বলেই চলে যান তাঁর বারান্দার মাদুরে। বিড়বিড় করে বলেন—শান্ত পাত্রী। পাত্রী খুবই শান্ত। এই নমুনা। ঝনঝনায়তে। ‘ঝনঝনায়তে’ কথাটা প্রায়ই বলেন অনঙ্গমোহন, এটা একটা তাঁর প্রিয় অলঙ্কার। এর মানেটা বিলু জানে। একটা সংস্কৃত শ্লোক আছে, যেটা বিলু জানে না, তার মানেটা হল—অতসী ফুল বড় চমৎকার, সোনার মতো রঙ। ভাবলাম এত সুন্দর ফুল যখন, না জানি কত ভাল ফল হবে। এই ভেবে গাছে জল ঢাললাম, যত্ন করলাম। তারপর যখন ফল হল, দেখি কেবলই ঝনঝন করে। আর কিছু নয়।

অনঙ্গমোহন বারান্দায় ঘুমোন। অনঙ্গমোহন আর অসীম। অসীম হল বোবাঠাকুরের ছেলে। অনঙ্গমোহনের শ্যালকপুত্র। অনঙ্গমোহনের টোলে অসীম পড়ে। অসীম বিলুর কাকা হয় সম্পর্কে, যদিও বয়সে বছর দুইয়ের মাত্র বড়।

হাতমুখ ধুয়ে জগদীশ শুয়ে পড়ে। দুটো বিছানা হয় ঘরে। একটা তক্তপোশের উপরে আর একটা তলায়। তক্তপোশে বিলু আর বাবা শোয়। মেঝেতে, স্বপ্না আর অঞ্জলি।

জবুথুবু বিলুকে অঞ্জলি বলে, তুই আজ তোর দিদির পাশে শো। তোর বাবার শরীল খারাপ।

ঘুম জড়ানো চোখে ওর বাবার দিকে একবার তাকাল বিলু। লজ্জা করল তাকাতে। ধুতে গিয়ে হাত ফসকে পড়ে যাওয়া কাচের গেলাসের টুকরোগুলোর দিকে যেরকম অপরাধীর মতো তাকিয়ে থাকেন মা, ওরকম তাকাল বিলু। বিলুর মনে হল বাবার কষ্টের জন্য ও নিজেও দায়ী। ও কেন ঝপঝপ করে এতটা লম্বা হয়ে যাচ্ছে, কেন এত খিদে পায় বিলুর। কী করবে বিলু?

বিলু গুটি গুটি মশারির ভেতরে শুতে যায়। গামছার মশারি, গামছা সেলাই করে তৈরি হয়েছে এই মশারি। অনঙ্গমোহন মাঝে মাঝেই গামছা পান। যদিও যজমানি করেন না অনঙ্গমোহন, তবু মাঝে মাঝে কেউ বিপদে পড়ে ডেকে নিলে যেতে হয়। কিন্তু ব্রাহ্মণ ভোজন, পণ্ডিত নিমন্ত্রণ, গীতাপাঠ এইসব ব্যাপারে অনঙ্গমোহন খুশি মনেই যান। গীতাপাঠ করলে একটি গীতা দান করার নিয়ম তো আছেই, একটি রেকাবিতে গীতা রেখে তারপর একটা আচ্ছাদন দেওয়া হয়, প্রায়শ সেটা একটা ছোটমোট গামছা। পণ্ডিত নিমন্ত্রণে ভোজন দক্ষিণার সঙ্গে গামছাও পাওয়া যায় অনেক সময়। এই সমস্ত ‘গামছা সংগ্রহ’ সেলাই করে মশারি বানিয়েছে অঞ্জলি। ঐ মশারিটা দেখলেই বিলুর ‘হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর’ কবিতাটা মনে পড়ে গোবিন্দবাবু বাংলার স্যার কবিতাটা পড়াতে গিয়ে প্রথমেই বলেন—ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি। বিভেদের মধ্যে ঐক্য। ওই কবিতাটার মধ্যে আছে না, নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান। মশারিতে লাল গামছা আছে, হলুদ গামছা আছে, লাল হলুদের ডোরা আছে, লাল সবুজের ডোরা আছে, পাতলা আছে, খাপি আছে, সব নিয়ে এই মশারি, হাওয়া ঢোকে না। হাওয়া ঢোকে না তাই এই মশারি মায়ের আর স্বপ্নার। কারণ ওরা মেয়েছেলে। আর যে মশারি আসল মশারি, ফুটো ফুটো মশারি, হাওয়া ঢোকে, সেটায় বিলু শোয়, বিলুর বাবা শোয়। কারণ ওরা ব্যাটাছেলে।

স্বপ্না ঘুমিয়ে আছে। কী গভীর ঘুম ওর। স্বপ্নার বালিশের তলায় গোঁজা ছিল ওর ব্রেসিয়ার। বালিশ সরে যেতে বেরিয়ে পড়েছে। উঃ দিদি, তুই বডিজ পরিস?

ইশ্, কত রকমের খরচ বাবার। বিলু জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। জানালার সামনেই বটগাছ। চাঁদের আলো পাতার গায়ে পড়েছে, লাল লাল বটফলের গায়ে পড়েছে। দিদির শরীরের সান্নিধ্য থেকে সরে মশারির গায়ে গায়ে লেগে শুয়ে পড়ে। বালিশ নেই, ভাঁজ করা কাঁথা। মা এইখানে শোয়। মায়ের বালিশ নেই। মশারির প্রায় গায়ে গায়ে লেগে শুয়ে থাকে বিলু। মশারির পাশেই জানালা। লাল গামছার ভিতর দিয়ে চাঁদের আলো পাওয়া বটফুল রহস্যময় দেখায়। আর একবার ওয়াক্ তোলে বিলুর বাবা। বিলুর মনে হয় ওরও কিছু করার ছিল।

যে বাড়িটায় বিলুরা থাকে সেটা দোতলা। এক তলায় একটা কালির কল। কালির বড়ি তৈরি হয়। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। মেশিনের ওপরের ফাঁদল দিয়ে একটা গুঁড়ো গুঁড়ো জিনিস ছেড়ে দেয় আর মেশিনের মুখ দিয়ে টপটপ করে পড়ে কালির বড়ি। ঐ কালির বড়ি জলে গুলে দিলে দোয়াতের কালি তৈরি হয়। নিবের কলমে ঐ কালি দিয়ে লেখা যায়। অনঙ্গমোহন এখনো নিবের কলমে লেখেন। কালির কারখানার মালিক বনমালী সাহা অত্যন্ত ভাল মানুষ। অনঙ্গমোহনকে বলে রেখেছেন—পণ্ডিতমশাই, আপনার দরকার হলে কালির বড়ি চেয়ে নিয়ে যাবেন। অনঙ্গমোহন এই কালিই ব্যবহার করেন। পি এম বাগচীর চেয়েও ভাল কালি। গরম জল দিয়ে খুব সুন্দর কালি তৈরি হয়।

তবে যত ভালই হোক না কেন, অনঙ্গমোহনের পিতার তৈরি কালির কাছে কিছুই নয়। অনঙ্গমোহনের পিতারও ছিল চতুষ্পাঠী। কাব্য ব্যাকরণ ছাড়াও স্মৃতিতীর্থ ছিলেন তিনি আর নানারকম ক্রিয়াকর্মের বিধান দিতে হত। নিজেই তৈরি করতেন সেই কালি।

ভুষা ত্রিফলা, বকুলের ছালা
ছাগ দুগ্ধে করি মেলা
তাহাতে হরিতকী ঘষি,
ছিঁড়ে পত্র, না উঠে মসী।

এখানে, কালির কলে কালি তৈরি হয় এক অদ্ভুত নিয়মে। লম্বা ত্রিপল বিছিয়ে সাদা সাদা একটা পাউডার ফেলা হয়। ঠিক ময়দার মতো দেখতে। এটার নাম ডেক্সট্রিন। এটা নাকি আলু থেকে তৈরি হয়। শুকনো আলুর গুঁড়ো। একটা ড্রামে রঙ গোলা হয়। কালো রঙ, লাল রঙ, নীল রঙ, সবুজ রঙ। ঐ সাদা রঙগুলো, রঙ গোলা জল দিয়ে মাখা হয়। মেখে মেখে দলা করা হয়, ঠিক ময়দা মাখার মতো। এবার ঐ রঙিন মণ্ড শুকোতে দেওয়া হয় ছাদে। শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে যায়। তারপর ঐ কড়কড়ে শক্ত দলাগুলো মুগুর দিয়ে পেটানো হয়। পিটিয়ে ছোট ছোট খণ্ড করা হয়। ঐ খণ্ডগুলো একটা মেশিনে দিয়ে দিলে মিহি গুঁড়ো হয়ে যায়। এবার কালি তৈরির আসল মেশিনের উপরে খাড়া করা ফাঁদলের মধ্যে ঐ গুঁড়ো ফেলে দিলে মেশিনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে কালির বড়ি। ব্ল্যাক নাইট কালি, কিং কালি, মাধুরী কালি…মাধুরী কালি হল লাল, বড় বড়। মাধুরী কালি যে কৌটোয় ভরা হয়, সেই কৌটোয় একটা মেয়েমানুষের ছবি, মেয়েটির হাতে একটা কালির বড়ি, বড়িটা ছুঁয়ে রেখেছে ঠোঁটে। কারখানার হেড কারিগর অনিল ব্যাপারটা খোলসা করে দিয়েছিল অনঙ্গমোহনকে। এটা লিপিস্টিক দাদু, লিপিস্টিক। সস্তার লিপিস্টিক। জল লাগিয়ে ঠোঁটে ঘষে দিলেই লাল। বিহারে যায়, উড়িষ্যা যায়। তাই আমরা লাল কালির বড়িতে গোলাপের সেন্ট মেশাই, শুঁকে দেখুন…।

বিলু মাঝে মাঝে একা একা থাকলে কালির কলে মেশিনের খেলা দেখে। একটা মোটর ঘুরছে, তার সঙ্গে বেল্ট লাগানো, চারটে মেশিন চলছে তাতে। গুঁড়োগুলো ডাইসের মধ্যে পড়ছে। ডাইসের ওপর, একটা ভারী লোহার চাপ পড়ছে। এই যে যন্ত্রের শব্দগুলো, তার মধ্যেও একটা তাল, ছন্দ আছে, আর মেশিনের মুখ দিয়ে টুপুর টুপুর কালির বড়ি বেরুচ্ছে। একটা ড্রামে পড়ছে। বিলু একদিন একমুঠো কালির বড়ি সাট্ করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।

ঝুলনে তো পুতুল সাজায়, রাধাকৃষ্ণ দোলে। কালো রঙের রাস্তা হয়, সবুজ মাঠ হয়। রঙ করা কাঠের গুঁড়ো বিক্রি করে ন্যাড়াদা, ঝুলনের আগে আগে। বিশ্বকর্মা পুজোর আগে আগে যেমন সুতো আর ঘুড়ি, কালীপুজোর আগে আগে বাজি। রথের সময় পাঁপড়-ভাজা।

তখন পাঁপড়-ভাজা বিক্রি করছিল ন্যাড়াদা। বিলু গুটি গুটি ন্যাড়াদার কাছে আসে। ন্যাড়াদা বলে কি রে, পাঁপড় খাবি? বিলু বলে উঁহু।

তবে?

এমনি।

পাঁপড় ভাজা দেখচিস?

হুঁ।

কোনো কাজই ইয়ে নয়। ডিগনিটি অব লেবার এসে পড়েছিস?—পড়িসনি তো, পড়বি। ভেরি ইম্পোর্টান্ট। পি কে দে সরকারের বইতে আছে। আমি তো সব করি। আই কম ফেল, তাতে কী হয়েছে। বাঁচার জন্য স্ট্রাগেল করছি।

তখন বিলুর পকেটে হাত। হাতে একমুঠো কালির বড়ি।

বিলু বলল—ন্যাড়াদা, আমিও স্ট্রাগেল করছি। বাঁচার জন্য।

তা তো করতেই হবে। তোরা তো বাঙাল, সব ছেড়েটেড়ে এধারে এসেছিস, একে চাকরি নেই। তাতে আবার তোরা ভাগ বসাচ্ছিস। বিধান রায় তো স্টেটবাসে সব বাঙালদেরই চাকরি করে দিলেন। ফুটপাতের হকারদের দ্যাখ এইট্টি পার্সেন্ট বাঙাল। আমিও তাই ভাবলুম বাঙালরা যদি এরকম ফাইট করতে পারে আমরাও পারব না কেন। স্ট্রাগেল ছাড়া উপায় নেই। যখন যা ডিমান্ড তাই বিকিরি করছি।

আমিও একটা জিনিস বিক্রি করব ন্যাড়াদা। কিনবে? তোমার দরকার হবে ন্যাড়াদা, সামনে ঝুলন। পকেট থেকে মুঠোটা বার করে বিলু। লজ্জামুঠি খুলে যায়। ন্যাড়াদা সোজা তাকায় বিলুর চোখের দিকে।

ঝাড়ামাল?

বিলুর মুখ নিচু।

দিয়ে যা। কিং বড়ি খুব ভাল। ক’টা আছে?

একমুঠো।

ক’টা? গুনে ফ্যাল।

বিলু গুনছিল। হরি সাহার বাড়ির রেলিং, নিমগাছ, নিমগাছের ডালে বসা কাক, ল্যাম্পপোস্ট, পোস্টের বাল্ব সবাই গুনগুনিয়ে দুয়ো দিচ্ছে। বিলু বলল, তেইশটা।

টুয়েনটি থ্রি ইন্টু থ্রি ইজিকাল্ট সিক্সটি নাইন। তোমাকে ষাট পয়সা দিচ্ছি। হাত পেতে পয়সা নেবার সময় বিলু দেখল ওর বাঁ হাতের চেটো সবুজ হয়ে গেছে। হাত ঘেমে ছিল বুঝি?

কিছু লাল আর কালো দিয়ে যাস পরে।

বিলু ঘাড় নাড়তে পারছিল না, যে ঘাড় নাড়ায় সম্মতি প্রকাশ করা যায়।

আরে লজ্জা কী? স্ট্রাগেল, স্ট্রাগেল।

.

প্রেশার খুব কম।

জগদীশ আর জি কর হাসপাতালের আউটডোর থেকে ফিরে এসে বলল। আর কী বলল ডাক্তার। অঞ্জলির ব্যস্ত প্রশ্ন।

—মাছ, মাংস, ডিম, সন্দেশ…

-আর?

—পেট খালি রাখা চলবে না। মাঝে মাঝে বিস্কুট।

—ওষুধ?

—না।

—যাক।

ওষুধ লাগবে না জেনে অঞ্জলি ‘যাক’ শব্দ করে নিশ্চিন্ত হল দেখে জগদীশ হাসল। বলল, মাছ-মাংসের দাম কি টনিকের চেয়ে কম? বিলু দেখল, বাবার হাতের প্রেসক্রিপশনের কাগজটা ক্রমশ দলিত হচ্ছে বাবার মুঠোর মধ্যে। পিষ্ট হচ্ছে। একটা গোলা পাকিয়ে গেল ক্রমশ।

.

দু’আনা দামের দুটো সন্দেশ কিনল বিলু। সন্দেশ কিনে ঘরে ফিরছে। শালপাতায় কাঠি ফুঁড়ে একটা ঠোঙা আর একটা শালপাতার কাঠি ফুঁড়িয়ে ঠোঙাটা ঢাকা দেওয়া আছে। বিলুর বাঁ হাত ঠোঙার ওপরে, আর ডান হাতটা তলায়। খুব সাবধানে নিয়ে যাচ্ছে বিলু। দামী জিনিস নিয়ে যাচ্ছে বিলু। ভাল করে নিয়ে যাচ্ছে, চারদিক তাকাতে তাকাতে। আকাশে তাকাল। চিল আছে কি না দেখল। বিরামের দোকান থেকে জিলিপি আনছিল সেদিন, একটা চিল ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছিল। এখন আকাশে চিল নেই, মেঘ। কালচে মেঘ। বৃষ্টি আসবে। শিখা যাচ্ছে বিরামের দোকানে ওর বাবার জন্য সন্দেশ আনতে। বিলু বাঁ হাতটা সরিয়ে নিল, যেন ঠোঙাটার পরিপূর্ণ অবয়ব দেখা যায়। দেখ শিখা দেখ, আমিও বাবার জন্য সন্দেশ নিয়ে যাচ্ছি। জগদীশ, জগদীশ কাঁচকলা ভাতে দিস এবার? দ্যাখ, বিলু মানে বিপ্লব ভট্টাচার্য ওর বাবার জন্য সন্দেশ নিয়ে যাচ্ছে।

সামনেই সুরকির মিল। ঝুড়ি ঝুড়ি ইটের টুকরো ফেলে দিচ্ছে একটা বিরাট জাঁতার মধ্যে। কী প্রচণ্ড শব্দ! ইটের টুকরোগুলো ক্রমশ কেমন গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। গুঁড়ো হতে কী আনন্দ হয়। জাঁতার মধ্যে ইটের টুকরোগুলোর কেন যে এত উচ্ছ্বাস। কাঁপছে, নাচছে, লম্ফ দিচ্ছে।

বিলু একবার ঠোঙাটার গন্ধ শোঁকে। শালপাতার গন্ধ পায়। শালপাতার গন্ধের মধ্যে একটা কি যে ভাল ব্যাপার আছে ঠিক বোঝানো যায় না। শালপাতায় লেগে থাকা কচুরির ছোলার ডাল জিভ দিয়ে চেটে পরিষ্কার করার সময় বিলু দেখেছে ঐ ছোলার ডালের অবশেষ শালপাতার সঙ্গে মিশে গিয়ে কি অদ্ভুত ব্যান্ডপার্টির সুর তৈরি করে। আলুকাবলির পরেও শালপাতা চেটেছে বিলু, কিংবা ফুচকার খাট্টাখানি খাবার সময়েও। এখন শালপাতা সমেত সন্দেশটার গন্ধ পেতে চেষ্টা করল।

বিলুর দাদু সন্দেশ আনেন বছরে দুবার তো বটেই, দারুণ সন্দেশ। দাদু ক’দিন আগে থাকতেই বলতে থাকেন—অমুক দিন জ্যোতিষ সম্রাটের বাড়ি পণ্ডিত নিমন্তন্ন। অনঙ্গমোহন ধুতি-ঢাকা পিতলের রেকাবি ও একবাক্স সন্দেশ নিয়ে হাসতে হাসতে ঢুকে বলেন—অনন্ত জ্যোতিভূষণের তুলনা হয় না। তার পিতার বাৎসরিক শ্রাদ্ধে কোনো কৃপণতা নেই। কে করে আজকালকার দিনে? বৌমা—সন্দেশ।

গন্ধ পেতে চেষ্টা করে বিলু। ঘ্রাণ নেয়। বিলু তারপর কাঠিটা খোলে। আচ্ছাদনী শালপাতাটা সামান্য ফাঁক করে। দ্যাখে একজোড়া সন্দেশ কেমন আদরের দুলালী হয়ে বসে আছে এবং তখনই দ্যাখে সন্দেশের গায়ে মণি-মাণিক্যের মতো লেগে রয়েছে গোলাপী আভার কিশমিশ। টুসটুসে কিশমিশ। বিলু ভাবল খাই? কিশমিশ দুটো খাই? পাতাটার ঢাকনা সরিয়ে যেই না কিশমিশ খুঁটতে গেল বিলু, ওমনি কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে নেমে এল একটা চিল। ছোঁ মারল বটে, কিন্তু পাতার ঠোঙাটা ছিনতাই করতে পারল না। সন্দেশদুটো রাস্তায় পড়ে গেল। এক পলক তাকিয়ে দেখল ঐ আহত যমজ সন্দেশদের। তারপর পিছনে তাকাল। শিখা-টিখা নেই রাস্তায়। দ্রুত তুলে নিল তারপর। খুব ভাল ছেলে হয়ে বিলু বাড়িতে ঢোকে। কলঘরটা একতলায়, ঠিক সিঁড়িটা পাশেই। কলঘর বন্ধ করে দিল বিলু। অল্প আলোয় সন্দেশ দুটোকে ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগল বিলু। সামান্য ধুলো লেগে আছে মনে হল। জামাটা দিয়ে মুছে নিল। একটা সন্দেশ মাঝখান দিয়ে ফেটে গেছে। দু হাত দিয়ে জোড়া লাগাল। এবারে কী করবে বিলু? রাস্তায় পড়ে যাওয়া সন্দেশ কি ওর বাবাকে দেবে? নাকি নিজে খেয়ে নেবে অথবা ফেলে দেবে? আবার ভাল করে পরখ করল সন্দেশ দুটোকে। ধুলোবালি দেখতে পেল না তেমন। ধুলোবালি না থাক জীবাণু তো আছে, জীবাণু তো আর চোখে দেখা যায় না। কিন্তু জীবাণু যে কেবলমাত্র রাস্তার ধুলোতেই থাকবে তা তো নয়, কালবৈশাখী ঝড়ে জানালা দিয়ে আসা যে ধুলো সেটা কি রাস্তার ধুলো নয়? গঙ্গার জলে তো জীবাণু ভর্তি। দাদু আর বাবা যে সন্ধ্যা-আহ্নিক করার সময় গঙ্গার জল আচমন করে তাতে বুঝি জীবাণু যায় না? আর ধুলো-বালি তো সবসময় উড়ছে। দোকানের মুড়িতে, গুড়ে, কিসে নয়? সব কিছুতেই ধুলো পড়ছে। আর বিকেল বেলা যখন বটগাছের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে রোদ্দুরের ফোকাস আলো ঘরের ভেতরে এসে পড়ে, তখন বিলু দেখেছে গুঁড়ি, গুঁড়ি, গুঁড়ি বিন্দুর চেয়েও ছোট কত সূক্ষ্ম ধুলো-বালি উড়ছে। কিছু হবে না, এই সন্দেশ বাবা খেলে কিচ্ছু হবে না। খাল-ব্রিজের তলায় থাকা ভিখিরিরা তো নর্দমার থেকেও খুঁটে খায়, কই ওদের কি কিচ্ছু হচ্ছে?

সন্দেশ দুটো ঠোঙায় বসিয়ে কাঠি গেঁথে নিয়ে ওর মায়ের কাছে যায় বিলু। মা তখন কুলোয় খৈ নিয়ে ধান বাছছিলেন। অনঙ্গমোহন রাত্রে দুধ-খৈ খান। মায়ের কপাল কুঁচকে ছিল, বিরক্তির রেখা। বিলু ওর মায়ের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে কিছুটা সংকোচে বলল, মা বাবার জন্য সন্দেশ এনেছি দুটো। বিলুর মায়ের কপালের কুঞ্চন মসৃণ হয়ে গেল হঠাৎ। এবারে বিস্ময়। তাই নাকি?

এবার ক’দিন আনব।

পয়সা?

কুড়িয়ে পেয়েছি।

জগদীশের ধুম জ্বর। সঙ্গে পিঠের ব্যথা। হোমিওপ্যাথি বই খুলে লক্ষণ মিলিয়ে ওষুধ খেল জগদীশ। কমল না। অঞ্জলি বলল প্রকাশবাবুকে ডাকি? প্রকাশবাবু এম-বি। চার টাকা ভিজিট নেন। জগদীশ বলল আর একটা দিন দেখি। অঞ্জলি তবু ডাক্তার ডাকল। প্রকাশবাবু বড় রসিক লোক। হা হা করে হাসেন। জগদীশকে দেখে আজ খুব একটা মজার কথা বললেন না, বললেন, মনে হচ্ছে কিড্‌নিতেই ব্যথা। পেচ্ছাপ পরীক্ষা করাও, রক্ত পরীক্ষা করাও।

দুদিন পর হাত-পা ফুলে গেল। বুকে কফ ঘড়ঘড় করে। অঞ্জলি লক্ষ্মীর ঘট ভেঙে ফেলেছে। প্রকাশবাবুর কোনো ওষুধই কাজে আসছে না। প্রকাশবাবু বলেন, অমল রায়কে ডাকো। অমলবাবু বিলেত ফেরত। বত্রিশ টাকা ভিজিট নেন।

অনঙ্গমোহনকে অঞ্জলি বলে বাবা, আপনার কাছে কোনো টাকা-পয়সা আছে?

অনঙ্গমোহন খুবই অপ্রস্তুতে পড়েন। আর মাস দুয়েক পর হলে কিছু দিতে পারতেন। তাঁর টোলের জন্য সরকারি সাহায্য পান তিনি। ঐ টাকা আলাদা তহবিলে রাখেন না কখনো। ঐ টাকার আলাদা হিসেবও রাখেন না। জগদীশ যে টাকা এনে তাঁর হাতে দিত, তার মধ্যে মিলিয়ে দিতেন। এখন বৌমার টাকার সঙ্গে মিশিয়ে রাখেন। সরু তিরতিরে নদী যখন গাঙে পড়ে, নদী ভাবে ঐ বিশাল জলরাশির মধ্যে আমার দেওয়া জলও রয়েছে। এইভাবেই খলু সংসারে জড়িয়ে আছেন অনঙ্গমোহন।

ট্রাংক খুললেন অনঙ্গমোহন। যত্নে রাখা রিফিউজি সার্টিফিকেট, দেশের বাড়ির জমির পরচা, পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠীর অনুমোদনের চিঠি, বিদ্যোৎসাহদায়িনী সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত প্রশস্তিপত্র, বিসম্যাগ ট্যাবলেট, এসিনার কৌটো, ইলেকট্রিক লোশনের শিশি, মাধুরী কালির খালি কৌটো। ঐ-কৌটো খুলে পঞ্চম জর্জের আমলের টাকা চারটি ছাড়া সিকি আধুলি টাকা মিলে ছেচল্লিশ টাকা গুনলেন অনঙ্গমোহন। ছ’টি টাকা রেখে চল্লিশটি টাকা একটা রুমালে বাঁধলেন। অঞ্জলিকে বললেন, নাও বৌমা।

জগদীশের সর্বাঙ্গে ব্যথা। বমি। জ্বর। বুকে কফ। অমল রায় রিপোর্ট দেখলেন, সারা শরীরে স্টেথো চাপলেন। প্রকাশবাবুকে বললেন, মিসটেরিয়াস।

বিলু বুঝতে পারল ডাক্তারবাবুরা রোগটাই ধরতে পারছে না। একটা বিচ্ছিরি ধরনের জীবাণু ঢুকেছে শরীরে। অমল রায়ের ওষুধেও কাজ হচ্ছিল না। হাত-পা আরও ফুলে গেল। জগদীশ হাতের ইশারায় বিলুকে কাছে ডাকলেন, বিলুর হাতটা চেপে ধরলেন। অনেক কষ্টে বললেন, বিলু আমায় বাঁচা। আমায় বাঁচা। বিলুর চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। নিজেকে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করে ফেলতে ইচ্ছে করে। উঃ বাবা, কেন আমি রাস্তায় পড়ে যাওয়া সন্দেশ তুলে খাইয়েছিলাম। চোখের কোণায় জল টলটল করছে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ঐ জলের ফোঁটাকে টানছে। চোখের কোণা থেকে বিচ্যুত হলেই ঐ জল পড়বে বাবার বুকে। বিলু আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে—জল যেন চোখের কোণেই রয়ে যায়। নিউটন, নিউটন গো…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *