চতুষ্পাঠী – ১৩

তের

উদ্দালক বলিলেন হে পুত্র, শ্রবণ কর। মনের তত্ত্ব বুঝাইতেছি। দুগ্ধ মন্থনে দুগ্ধের সারাংশ উপরে ভাসমান হয়, তাহাই নবনী। আমরা যে অন্ন খাই, তাহারই সূক্ষ্ম সারাংশ উপরে উঠে এবং তদ্দারাই মন পুষ্ট হয়। এইরূপেই জলের সারাংশ দ্বারা বাক্য পুষ্ট হয়। হে বৎস, আমাদের মন অন্নময়, প্ৰাণ জলময়, বাক্য তেজোময়।

শ্বেতকেতু বলিলেন, ভগবন, বুঝিতে পারিলাম না। পুনর্বার বলুন। তখন ঋষি আদেশ করিলেন পুত্র, অদ্য হইতে পঞ্চদশ দিন উপবাস কর। কেবল জলপান করিও, কারণ জল প্রাণময়। শ্বেতকেতু তাহাই করিলেন। পঞ্চদশ দিবস গত হইল। শ্বেতকেতু শুষ্ক শীর্ণ হইলেন, বর্ণ কালিমাময় হইল। কিন্তু পিতা তাহাকে তত্ত্বজ্ঞান শিক্ষা দিবেন এই আনন্দে সমস্ত দুঃখ বিস্মৃত হইয়া রহিলেন। ষোড়শ দিবসে শ্বেতকেতু পিতার নিকট উপস্থিত হইলেন। কহিলেন, পিতঃ আমি আসিয়াছি। উদ্দালক আদেশ করিলেন, হ্যাঁ বৎস, ঋক যজুঃ সাম আবৃত্তি কর। শ্বেতকেতু পিতার আদেশ শুনিয়া সমস্ত স্মরণ করিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু এ কি বিস্মরণ। কিছুই বলিতে পারিলেন না। অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া শ্বেতকেতু কহিলেন, ভগবন, কিছুই তো মনে পড়িতেছে না। পুত্রের এই অবস্থা দেখিয়া ঋষি কহিলেন-বৎস, কাতর হইও না। যাও, ভোজন কর। ভেজনান্তে সবই স্মরণ হইল—শ্বেতকেতু চিন্তান্বিত হইলেন। মন কি জড়? মন কি জড় অন্নের অংশ দ্বারা রচিত হয়?…

—আর নেই। ছান্দোগ্য উপনিষদের বঙ্গানুবাদ। এখন ঠোঙা

কিছুটা খই খেয়েছিলেন অনঙ্গমোহন। শুকনো খই। গোপনে। ক্ষুধায় গোপন ক্ষুধায়। সন্তর্পণে ঠোঙাটির ভাঁজ খুললেন অনঙ্গমোহন। সাবধানে। ভাঁজ-বিনষ্ট ঠোঙাটিকে দেখলেন। ঠোঙার ভাঁজগুলি দেখলেন। মন দিয়ে দেখলেন। অন্ন মনোময়।

বাড়ি ফিরেই প্রথমে একটা পুরনো পঞ্জিকা হাতড়ে নিলেন। শক্ত করে ধরলেন, ছিঁড়ে ফেললেন বুধ রাজা, শনি মন্ত্রী, ছিঁড়ে ফেললেন রাশিফল। অতিবৃহৎ প্রকাণ্ড লাল মূলা ছিঁড়ে ফেললেন। ছিঁড়ে ফেললেন শুভদিনের নির্ঘণ্ট। অনঙ্গমোহন যেন বাজারের মুরগিওলা। পালক ছিঁড়বার মতো পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেললেন। এবার বের করে আনলেন কাব্যচন্দ্রহার ছিঁড়ছেন। শ্লেষ-যমক উৎপ্রেক্ষা ছিঁড়ছেন…একজন নররাক্ষস যেন। বিলু ঘরে ঢুকেই দেখতে পায় এ দৃশ্য। ঝাঁপিয়ে পড়ে, অনঙ্গমোহনের হাত থেকে কেড়ে নেয় কাব্য চন্দ্রহার। বলে এসব কী করছ, দাদু? অনঙ্গমোহন বলেন, এইসব বই-পুস্তক ছিন্ন কইরা ঠোঙা বানামু। বিলু দু’হাত বিস্তার করে। জলের তোড়ের সামনে পাহাড়ের মতো। বিলুর বাড়ানো হাতে প্রবল নিষেধ। এসব কী করছ দাদু? অনঙ্গমোহন ছর ছর করে কেঁদে ফেলেন। বিলুকে জড়িয়ে ধরেন। বিলুকে তখন ছত্রছায়া মনে হয়। বিলুর গায়ে লেপ্টে থাকেন। বিলু বলেছিল, ঠোঙা যদি বানাতেই হয়, বাইরে থেকে কাগজ নিয়ে আসব। এসব বই ছিঁড়ছ কেন দাদু। অঞ্জলিও কোমরে কাপড় গুঁজে নেয় তখন। একটা একটা করে ছেঁড়া পাতাগুলি কুড়িয়ে দেয়। স্বপ্না পৃষ্ঠা মিলিয়ে ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো ঠিক করে গুছিয়ে রাখে। অঞ্জলি বলে, পরে সেলাই করে দেব। অনঙ্গমোহনের তখন মনে হয় এই পৃথিবী খুব একটা খারাপ জায়গা নয়।

এবার পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠীতে ঠোঙা তৈরি হতে লাগল নিয়মিত। প্রথম দিকে ঠোঙাগুলোর সাইজ ঠিক ছিল না। বেঁকাতেড়া হয়ে যাচ্ছিল। কাটার মধ্যে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল, এ ব্যাপারে ঠিকমত ট্রেনিং দিল ন্যাড়া, ওরফে স্বপন সরকার। ন্যাড়া বলেছিল, জীবনে অনেকরকম করেছি। বাজি, পুতুল, ফুলুরি, পাঁপড়, ঠোঙা। তবে ঠোঙা হল জাপানি শিল্প। জাপানি শিল্প ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল ন্যাড়া। জাপানে নাকি ফ্যামিলির সবাই একসঙ্গে বসে ঘড়ি, রেডিওর পার্টস ফিটিং করে, ঠোঙাও সেরকম। একা হয় না। একজন কেটে দেবে, সেকেন্ডজন আঠা লাগাবে, থার্ডজন ভাঁজ করবে। এই ঠোঙা তৈরির কর্মশালা পরিবারের সবাইকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে, একসঙ্গে হেসে ওঠে, একসঙ্গে চিন্তা করে। স্বপ্না হয়তো বলল, জানো মা, একভাবে রান্না করা যায় তাতে তেল অনেক কম লাগে। রেডিওতে মহিলামহলে শুনেছি। প্রথমে তরকারি সাঁতলাতে হয় না। আগে সেদ্ধ করে নিয়ে পরে তেলে ফোড়ন-টোড়ন মশলাটশলা দিয়ে ঐ সেদ্ধ তরকারিটা ঢেলে দিতে হয়। অনঙ্গমোহন হয়তো বললেন—ঐ তরকারির প্রয়োজন কী। ডাইলের মধ্যে তরকারি দিয়া দাও, ব্যাস। তৈলের দরকার নাই। তৈল খাওয়া ভাল নয়। পিত্তচড়া হয়। স্বপ্না হয়তো বললো—মা, একটা নতুন খাবার খেলাম। আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে দার্জিলিং থেকে এনেছে। সাদা সাদা। চাউচাউ না কি বেশ নাম। লম্বা লম্বা কেঁচোর মতো দেখতে। অ্যা মা…অঞ্জলি মুখ বিকৃতি করে। অনঙ্গমোহনের বেশ লাগে।

চাকরিটা হারাবার পর, এখন অঞ্জলির মধ্যে যেন প্রাণ এসেছে— অনঙ্গমোহনের মনে হয়। আগে ছিল যেন কাষ্ঠপুত্তলি। হাসত না, রাগত না। এখন অঞ্জলির মুখের হাসি দেখতে পেলে অনঙ্গমোহন খুশি হন। ঠোঙা বানাতে বানাতে হয়তো বিলু বলল-এই ঠোঙাটার কী রাশি বলত মা? অঞ্জলি বলল—তোর দাদুকে জিজ্ঞাসা কর। বিলু বলল-বলতে পারলে না তো, এটা বিরাশি। এই দেখ না লেখা আছে পৃষ্ঠা বিরাশি।

অঞ্জলি বলে, এই ঠোঙারও একটা রাশি নক্ষত্র আছে, কন বাবা? এরও একটা ভাগ্য আছে। কে বলতে পারে, এটা কিসের ঠোঙা হইব? ডাইলের, বিস্কুটের না চানাচুরের। কেউ হয়তো ঠোঙাটারে যত্ন কইরা রাইখ্যা দিব। কখন কি কাজে লাগে এইসব চিন্তা কইরা। কেউ হয়তো ফালাইয়া দিল, কেউ ফুঁ দিয়া ফাটাইল। অঞ্জলি হাসছে। ওর হাসিকে অম্লান করে রাখতে সাধ যায় অনঙ্গমোহনের, অনঙ্গমোহন গল্প বলেন—সেই এক আছিল জামাই। নোয়া জামাই। জামাই তো বিয়া কইচ্ছে পণ্ডিতের মাইয়া। জামাই উচ্চবংশ। কিন্তু লেহাপড়া জানে না। মূর্খ। বিয়ার পর জামাই গেছে শ্বশুরালয়ে। জামাই জানে, শ্বশুরবাড়ি হইল পণ্ডিতবাড়ি। অনেক পুঁথি পুস্তক আছে। জামাই কইল কী, একখান বই নিয়া মুখের সামনে রাখছে।

শ্বশুর একটু পরে গিয়ে দ্যাখে, জামাই কাঁদতেছে। জামাইয়ের সামনে মহাভারতের স্ত্রীপর্ব খোলা—

সহস্র বীরের দেহ গড়াগড়ি যায়,
ঘরের রমণীবালা করে হায় হায়।

শ্বশুর ভাবল, আহারে, জামাইয়ের কী নরম মন, শ্বশুর জামাইয়ের পিঠে হাত দিয়া কয়—কাইন্দো না, কাইন্দো না, জন্মিলে মরিতে হয়। মরণের পর আবার জন্ম হয়। কাইন্দো না। বাসাংসি জীর্নানি যথা বিহায়—গীতার ঐ শ্লোকটি স্মরণ কর।

জামাই কইল, শ্বশুরমশয়, আমি আমার ছোটবেলার কথা স্মরণ করি। তখন বইতে কত বড় বড় অ দেখেছি, কত বড় বড় আ, এই অ্যাত বড় বড় ক খ আছিল—এখন অক্ষরগুলি খাইতে না পাইয়া কত ছোট ছোট হইয়া গেছে গিয়া। এই অক্ষরগুলির দুঃখে আমার চোখে জল আসে।

হো হো করে হেসে ওঠে অঞ্জলি, হেসে ওঠে সবাই, শীত-শেষের শীর্ণডালে যেমন হেসে ওঠে পলাশ মঞ্জরী।

ন্যাড়া মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে আসে। এই চা বিক্রেতার উৎসাহ দেখে অবাক হন অনঙ্গমোহন। হিতোপদেশের অনেকটাই শেষ করে এনেছে এই স্বপন সরকার। মানুষের উপর আস্থা জাগে। এই ছেলেটির জ্ঞানলাভের তৃষ্ণা আছে। আকাঙ্ক্ষা আছে। ছেলেটি একদিন বলেছে—পণ্ডিতমশাই, আপনাকে দেখে আমার ভুল ভেঙেছে। আগে জানতাম, নামাবলী জড়ানো টিকিওলা ব্রাহ্মণ মানেই অং বং করে দক্ষিণা চায়। আপনি আলাদা। আপনি অন্য একটা লড়াই করছেন। আপনাকে দেখে আমার শ্রদ্ধা হয়।

ঠোঙা তৈরির সময় আগে কর্মশালার দরজা বন্ধ রাখা হত। এখন খোলাই থাকে। অজিতবাবু উঁকি মারলেন। বললেন-কাল ওঁকে নিয়ে আসছি।

অঞ্জলি ঘোমটা উঠিয়ে দিয়ে বলল—তাই? ভাল কথা। দিদি ছাড়া বাড়িটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।

শিখার মা হাসপাতালে ছিল বেশ কিছুদিন। অঞ্জলি কয়েকদিন দেখে এসেছে। অনঙ্গমোহনও গেছেন। নাকের ভিতর দিয়ে নল, হাতের চামড়া কুঁকড়ে গেছে। মরাল গ্রীবায় কদাকার ক্ষত। অগ্নি কি নৃশংস। যেদিন প্রথম কথা বলতে পারল, অনঙ্গমোহন সামনে ছিলেন, জয়া বলেছিল, তা হলে বেঁচে গেলাম। ও হাসতে চেষ্টা করছিল। শিখার মা আসবে শুনে অঞ্জলি প্রকৃতই খুশি হল যেন। আঙুলের আঠা মাথার চুলে ঘসে নিয়ে বলল—ঘর-দুয়ার যা হইয়া রইছে।

বিক্রির ব্যাপারটা অসীম আর বিলু করে। ঠোঙার ব্যাগ হাতে অনঙ্গমোহনকে দোকানে দোকানে যেতে হয় না। আজ অনঙ্গমোহনের মনে হল, এটা অভিভাবকসুলভ কাজ নয়। প্রথমত ঠোঙা তৈরির কারণে ওদের লেখাপড়ার সময় অনেকটাই নষ্ট হচ্ছে, তার উপর বিক্রির জন্যও ওদের সময় ব্যয় হয়। অনঙ্গমোহন ভাবেন, সংস্কার বিসর্জন দিয়ে তাঁরও উচিত, রাস্তায় নেমে যাওয়া। কিন্তু পণ্ডিত অনঙ্গমোহন সেটা পারেন না। উনি জানেন, সামাজিক সম্মান অর্থনির্ভর। বিদ্বান সর্বত্র পূজাতে এখন ভুল। উত্তমা মানমিচ্ছন্তি ধনমিচ্ছন্তি অধমা—একটা মিছে কথা মনে হয়। আসলে এটা একটা সংস্কার। কুলগত সংস্কার। অনঙ্গমোহন কিছু ঠোঙা সরিয়ে রাখেন। ব্যাগে ভরে নেন।

জয় মা বলে বেরিয়ে পড়েন অনঙ্গমোহন। খগেনের দোকানের সামনে দাঁড়ান। খগেন মুড়ি-তেলেভাজা বিক্রি করে। খগেন বলল, কী খবর ঠাকুরমশাই? অনঙ্গমোহন বলেন, ভালই তো। তাঁর কাঁধের সাইড ব্যাগ চাদরে আড়াল করে বলেন, তুমি ভাল আছ তো? খগেন বলে আজ্ঞে, আপনার আশীর্বাদে। অনঙ্গমোহন বলেন, ব্যবসা কেমন চলছে। আজ্ঞে, আপনার আশীর্বাদে চলে যাচ্ছে। অনঙ্গমোহন চলে যান। ফটিকের দোকানের দিকে যান। অনঙ্গমোহন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেন—এই দোকান থেকে অন্তত পালাবেন না। মনে মনে সংলাপ স্থির করেন।

—কী ফটিক। কুশল তো? ত, শুন, দরকারি কথা আছে। আমার তো তৈল, গুড় আর শুকনা লঙ্কা বাবদ কিছু বাকি আছে, সেই পয়সাটা লও।

—দিন, দিয়ে দিন।

—পয়সায় দিমু না। কিছু ঠোঙা আছে। হিসাব কইরা কিছু ঠোঙা লইয়া লও।

—সে কী ঠাকুরমশাই! আপনি ঠোঙা বানাচ্ছেন?

—হ। দিবানিদ্রাটা বড় খারাপ। বায়ুচড়া হয়। দ্বিপ্রহরে করিটা কী? তাই, আলস্য না কইরা ঠোঙা বানাইলাম। ক্ষতি কী?

তা বেশ, তা বেশ, মাঝে মাঝে দিয়ে যাবেন।

ফটিকের দোকানের সামনে দাঁড়ালেন অনঙ্গমোহন। বহুদিন ধরে দেখছেন ফটিককে। ফটিক দত্ত। গন্ধবণিক তপ্তকাঞ্চনের মতো রঙ। কিছুদিন ধরে বেশ মোটা হয়ে চলেছে ফটিক। অনঙ্গমোহন শুরু করেন—

—কী ফটিক কুশল তো?

—আর কুশল। বেচাকেনা নেই…

—শুন ফটিক, দরকারি কথা আছে।

—কী বলুন।

—তোমার বাবার লগে আমার খুবই সদ্ভাব ছিল।

—হ্যাঁ, তা তো ছিল।

—তোমার বাবা খুবই পুণ্যবান লোক ছিলেন।

—কিছু নেবেন?

—না, কইতাছিলাম কি যে—আচ্ছা ধারবাকি এখন কত আছে?

—আর তো কিছু বাকি নেই, অ্যাডজাস্ট হয়ে গেছে, আপনার নাতি এসে কিছু ঠোঙা বিক্রি করে গেল—তা এখন ঠোঙা বিক্রি করছেন ঠাকুরমশাই? বামুন হয়ে ঠোঙা বেচতে হচ্ছে, ঘোর কলি পড়েছে। শাস্ত্রে নাকি লেখা আছে, কলিতে বামুনরা শূদ্রের কাজ করবে, মুনিঋষিরা যা বলেছে সব অক্ষরে অক্ষরে ফলছে। কলিতে মেয়েছেলে ঘরে থাকবে না, চোর-জোচ্চরদের শাসন করার কেউ থাকবে না, রাজা হবে চোর, বলুন ঠাকুরমশাই, সব মিলে যাচ্ছে কিনা…কলিতে আরও কি হবে শুনবেন…

অনঙ্গমোহনের ওখানে দাঁড়িয়ে ফটিকের মুখে শাস্ত্রকথা ভাল লাগছিল না। বিরামের দোকানে যান অনঙ্গমোহন। কোনো ভণিতা ছাড়াই সোজাসুজি বিরাম ঘোষকে বলে ফেলেন, কিছু ঠোঙা আছে, ঠোঙা। নেবা? বিরাম ঘোষ মুগের লাড্ডু পাকাচ্ছিল। মুখই তুলল না। লাড্ডু পাকাতে পাকাতেই বলল, আর ঠোঙা। শালার বিক্রি নেই মোটে। নুন কে চুন বানিয়ে দিয়েছে প্রফুল্ল সেন। বোঁদে বেচতে আর কটা ঠোঙা লাগে? জানেন না এখন মিষ্টান্ন নিয়ন্ত্রণ।

অনঙ্গমোহন এবার বাজারের দিকে যান। ব্যাগের থেকে বার করেন এক বান্ডিল ঠোঙা। হাতের মুঠিতে ধরে থাকেন। এইবার প্রকৃত ক্যানভাসার। চাঁদিপুর ঘাটের রাঙাজবা সিঁদুর বিক্রেতার মতো হাত উঁচু করে ধরেন অনঙ্গমোহন কাব্য ব্যাকরণ তীর্থ। বাজারের মুখে একজন ফলওয়ালা। আপেল, আঙুর, কমলালেবু, অনঙ্গমোহন বলেন, এই যে ভাল ঠোঙা, খুব ভাল ঠোঙা আছে। তারপরই ক্যানভাসারের কণ্ঠ ও ভঙ্গিমা রাখতে পারেন না আর। কোমল কণ্ঠে বলেন, নেবা? নেবা ভাই কটা ঠোঙা? ফলওয়ালা উঠে দাঁড়াল। দু’হাত জোড়া করল, নারায়ণের সামনে গরুড় যেমন। বলল, আরে, পণ্ডিতজি, আপ? ঠোঙা বেচছেন?

—কেন? আমাকে চেন নাকি?

—হ্যাঁ, তো, জরুর চিনি, আপনি তো রোজ সুবা সুবা গঙ্গামাই যান, আমি ভি যাই। কোতো স্তব করেন, পূজা ভি করেন—আমি আপনার কাছে কী করে ঠোঙা লিব? আপনি আট আনা এমনি নিয়ে যান। ব্রাহ্মণ মহাত্মাকে দান করা তো বহুত পুন্ কী কাজ।

অনঙ্গমোহন বলেন, না ভাই, দান চাই না, ঠোঙা কটা যদি দয়া কইরা নাও…

আরে ঠোঙা কেন বেচবেন, আপনি ব্রামভন আছেন না? পইসা জরুরত আছে তো হামি বেবস্থা করিয়ে দিব। সোকাল বেলা কটা মন্ত্র পড়িয়ে দিবেন, বহুত আদমি পইসা দিবে।

অনঙ্গমোহন ঠোঙা ঢুকিয়ে ফেলেন ব্যাগে। ভাবলেন, এভাবে হবে না। অন্যপাড়ায় যেতে হবে তাঁকে। তোরঙ্গ খুলে জামাটা বার করে নিতে হবে। পণ্ডিতের পক্ষে ঠোঙা বিক্রি করাও কঠিন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন অনঙ্গমোহন, এমন সময় সামনের একটা ওষুধের দোকান থেকে একজন ভদ্রলোককে বের হতে দেখলেন অনঙ্গমোহন। তার হাতে কাগজের ঠোঙা নয়। ঠোঙাটি এমন, ভিতরের বস্তু দেখা যায়। বিলুর উপনয়নে এরকম দু’একটা ঠোঙা দেখেছিলেন। পলিথিন ব্যাগ। ঠোঙার শত্রুকে দেখলেন অনঙ্গমোহন। অনঙ্গমোহন তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন। কলিতেও যদি ব্রহ্মতেজ থাকত, তবে ঐ দৃষ্টিতে জন্ম হয়ে যেত কলির পলিথিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *