1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৫

।। পাঁচ।।

ফেরার পথে অতীশ বলল, ভাল ধূপকাঠি দরকার। ধূপকাঠি কিনব কুম্ভবাবু।

কারখানা থেকে গাড়ি বের হতেই অতীশ কথাটা বলল। দু-পাশের বস্তি তখনও শেষ হয়নি। কালীমাতা হোমিওপ্যাথ ডিসপেনসারির সামনে গাড়ি। রাস্তার কলে বালতির লাইন। পাশে বড় বড় ঝাঁকা। বেতের মোড়া লম্বা। ছোলা শসা পেঁয়াজ গুঁড়োলঙ্কায় সাজানো। রাস্তা জুড়ে বসে গেছে হকাররা। রাস্তা জুড়ে কুকুর মুরগি হাঁস। সিটমেটালের ম্যানেজার যাচ্ছেন। গাড়ি দেখে ওরা তাড়াতাড়ি ঝাঁকাগুলি সরিয়ে নিচ্ছে।

অতীশ দেখল, দাওয়ায় বসে এক বুড়ি নাতিনের উকুন বাছছে। বস্তির উলঙ্গ শিশুরা কোথা থেকে একটা আখ চুরি করে এনেছে—তাই নিয়ে হুটোপাটি। বেওয়ারিশ কুকুর এবং আবর্জনায় ভর্তি চারপাশ। থিকথিক করছে নোংরা জল। তার মধ্যে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ছাগল গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাড়ি চালাবার সময় খুব সতর্ক থাকা দরকার। কুম্ভকে এরা চেনে। কেউ কেউ সেলাম ঠুকে গেল।

কুম্ভ বলল, ভাল ধূপকাঠি আমারও দরকার। ড্রাইভারকে বলল, একটু ঘুরে যাবি। দোকান থেকে ধূপকাঠি কেনার সময় কুম্ভ বলল, আপনার পছন্দ হচ্ছে না?

—ভাল গন্ধ হবে ত!

—খুব সুন্দর গন্ধ। নিয়ে দেখুন না।

—চড়া গন্ধ দরকার।

—আমার কিন্তু চড়া গন্ধ অতীশবাবু একদম পছন্দ না।

অতীশ বলতে পারত, আমারও না। কিন্তু এ মুহূর্তে চড়া গন্ধ চাই। এই এক ল্যাটা জীবনে। সে এক ধূপকাঠি কিনতে কিনতেই ফেরার হয়ে যাবে এমন ভাবল। সে প্রায় হামলে তুলে নিল ডজনখানেক ধূপবাতির প্যাকেট।

কুম্ভ অতীশবাবুর কান্ড দেখে হাঁ হয়ে গেল। এত ধূপকাঠি দিয়ে কি হবে?

অতীশ কিছু বলল না। দাম মিটিয়ে বলল, চলুন।

কুম্ভ ভাবল বেশ লোক বটে। এসেই ধূপকাঠি কিনতে শুরু করেছে। সে তবু বলল, দেশে পাঠাবেন বুঝি?

অতীশ বলল, না।

—ধূপকাঠি বেশিদিন থাকলে নষ্ট হয়ে যায়।

অতীশ বলল, জানি।

কুম্ভ কেন জানি আর কিছু বলতে সাহস পেল না; পাঁচ সাত ঘণ্টা একসঙ্গে কাটিয়ে মনে হয়েছে মানুষটা কথা বলতে বলতে খুব অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কাজ বুঝে নেবার সময় না হলে কেউ বলতে পারে না, চলুন বস্তিটা ঘুরে দেখি। মানুষটা লেখালেখি করে। বস্তি দেখার তাই আগ্রহ। কিন্তু বস্তির কিছুটা ভিতরে গিয়েই বলল, থাক চলুন। পরে দেখা যাবে। এই বস্তির মধ্যে মাত্র একটা ন্যাড়া বেলগাছ এবং অশ্বত্থ গাছ দাঁড়িয়ে। আর কিছু নেই। ইলেকট্রিকের তার এদিক-ওদিক ঝুলে আছে। সব খুপরিগুলি আলকাতরায় অথবা পিচের টিনে মোড়া। ছোট ছোট দরজা। মানুষগুলি আরও ছোট, কাকলাশ। দেখে দেখে কুম্ভর অভ্যাস হয়ে গেছে। একটা লোক গামছা পরে শেডের নিচে বসে আছে। চা বানায় লোকটা। গালে বড় জড়ল। চুল সাদা। লোকটা দাওয়ায় ঘুমায়। লোকটার নাম হরকু সিং। নাম শুনেই অতীশবাবু কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল।

কুম্ভ বলেছিল, আপনি আলাপ করতে পারেন। যদি বলেন অফিসে ডাকিয়ে আনব। বস্তির কেচ্ছা কাহিনী জানে।

অতীশ বলেছিল, কেচ্ছা কাহিনী লেখার বিষয় হতে পারে না কুম্ভবাবু।

কুম্ভর তাই ধারণা। সে হিন্দী সিনেমাখোর। বৌ হাসিরাণী প্রায় পারলে এবেলা ওবেলা দেখতে চায়। কোনোও রববার ফাঁক গেলে কুম্ভ জানে বিছানায় বউ ঘেঁষতে দেবে না। ভয়ে সে আগেই সেজন্য টিকিট কেটে রাখে, এবং একটা সপ্তাহ বৌকে তবে বিছানায় উল্টে-পাল্টেনিরাপদে বেশ জুতসই দেখা যায়। হাসিরাণীর রং গৌরবর্ণ। মসৃণ ত্বকে কি সুষমা! রক্তে বিজবিজ করে থোকা থোকা পোকা। ভেতরে কামড়ায়। হিন্দী সিনেমা না দেখলে পোকারা ভেতরে কামড়াতে উদ্‌গ্রীব হয় না। কেমন নিরাসক্ত, ঠেলে ফেলে দেয় বুকের ওপর থেকে। কুম্ভ নিচে গিয়ে শুয়ে থাকে।

গাড়িটা যাচ্ছে। ট্রাম লাইনে দুটো ট্রাক দাঁড়িয়ে। সিনেমা ভাঙছে। হাউসের গায়ে সাই জোয়ান এক মদ্দ এবং পাশে লম্বা ঠ্যাংখালি করে যুবতী দাঁড়িয়ে। বড়ই কামের উদ্রেক করে। রাস্তায় ভিড়। মানুষজন বাসের জন্য মোড়ে মোড়ে জমা হয়ে আছে। কাদার মতোই থিকথিক করছে মানুষেরা।

অতীশ এইসব দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক থাকতে চাইছে। কারণ গন্ধটা নাক থেকে যাচ্ছে না। সে ধূপকাঠির প্যাকেটগুলি নাকের ডগায় এনে প্রায় উবু হয়ে বসল। কতক্ষণে গাড়িটা রাজবাড়িতে ঢুকবে। ঢুকলেই স্নান, এবং ঘরে ধূপবাতি জ্বেলে দেবে। গন্ধটা তবে নাকে ঝুলে থাকবে না। আর্চির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে।

গাড়িটা ওদের রাজবাড়ির সামনে নামিয়ে দিল। বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে হবে। প্রথম দিন বলে একটা গাড়ি পাওয়া গেছে। পরে অতীশকে ট্রামে বাসেই যেতে হবে। তার ট্রামে-বাসে ওঠার অভ্যাস একেবারে নেই। রাস্তাঘাটও ভাল চেনে না। সে নামার সময় বলল, কুম্ভবাবু অফিসে যাবার সময় কাল আমাকে ডেকে নেবেন।

কিন্তু রাজবাড়ি ঢোকার মুখেই দেখল ভেতরে যতদূর দেখা যায়—খালি। একটা লোক নেই। হঠ যা হঠ যা করে চিৎকার করছে একটা লোক। দু’পাশ থেকে লোকজন সরে যাচ্ছে। যদি কেউ সামনে পড়েও যায়, নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এবং হাতজোড় করা সবার।

সদরের সিপাই হাঁকল, খবরদার রাজার গাড়ি আতা হ্যায়।

অতীশ দেখল, সাদা রঙের একটা ক্যাডিলাক। ভেতরে রাজেনদা। পাশে মেমসাহেবের মতো ববকাটা চুলের এক যুবতী। চোখে নীল চশমা। ভারি সুন্দর দেখতে এক রহস্যময়ী নারী। চোখ উদাস মনে হল। চশমা খুলে অতীশকে চোখ তুলে দেখেছেও। অতীশেরও চোখে পড়ে গেছে। তারপরই সে কেমন বিমূঢ়। যুবতীকে কোথায় যেন দেখেছে, কতকালের যেন চেনা। কে এই যুবতী এমন মনে হল তার! চেনা। কিন্তু সে তো দীর্ঘদিন বিশেষ করে নিরুদ্দিষ্ট জীবন থেকে ফিরে আসার পর গাঁয়ে ছিল। মাঝে এক বছর একটা কো-এডুকেশন ট্রেনিং কলেজে বি টি পড়েছে। হোস্টেল জীবনের সে কিছু মেয়ের মুখ মনে করার চেষ্টা করল। সবিতা, আরতি, চন্দ্রা, জ্যোৎস্না, পূরবী এক এক করে তার সব সহপাঠিনীদের মুখ মনে করার চেষ্টা করল। না ওদের কেউ এমন দেখতে ছিল না। ওরা কেউ এত সুন্দর, এত লম্বা, এত মহিমময়ী ছিল না। শরীরে নীল রক্ত না থাকলে এমন নমনীয়তা চোখে মুখে কখনও আসে না।

সদরে সেও এক পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাজবাড়ির এই নিয়ম। রাজা বের হলে প্রাসাদের মানুষজনের রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা। হাত করজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা। সে যত বড় অফিসার হোক রেহাই নেই। অতীশ নতুন। জানে না সব কিছু। সে হাতে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কুম্ভবাবু বলল, এটা কি করলেন!

কি হল! তখনই বুঝল, তারও উচিত ছিল কুম্ভবাবুর মতো হাত তুলে কপালে ঠোকা। তারপর বলল, আমি ত জানি না। তারপরই ভেতরে কেমন এক দৈত্য মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ক্রীতদাসের ভূমিকা পালন করতে হবে ভেবেই মাথার ঘিলুতে জ্বর চলে আসে। সে ভেতরে ভেতরে কেমন ক্ষেপে যায়। শক্ত এবং অমার্জিত গলায় বলল, এটাই এ-বাড়ির নিয়ম বুঝি?

কুম্ভ বলল, আজ্ঞে তাই। তবে সব ঠিক হয়ে যাবে। থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে যাবে। আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রেতাত্মার ভয় থেকেও এই অবমাননার ভয় তীব্র তীক্ষ্ণ। সে আসলে বিভ্রমের মধ্যে পড়ে গেছে। যে গেল সে কে এমন মহামান্য? তার গাড়ি গেলেই করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা—ভাবা যায় না। বরং বিদ্রোহ করবে। বিপ্লব করবে এ-বাড়িতে এটা বিপ্লবেরই শামিল। গতকাল সে রাজার সঙ্গে জুতো পরে দেখা করেছে। বাড়িতে এই নিয়ে তোলপাড় গেছে। মানসদাও খবরটা পেয়ে গেছিলেন। একবার সকালে এসে বলে গেলেন, ওহে নবীন যুবক, তোমার ত ভারি আস্পর্ধা হে। রাজার ঘরে জুতো পরে ঢোকো। বেয়াদপ।

নবীন যুবক হাঁ করে তাকিয়েছিল।

মানসদা বলেছিলেন, বুটের তলায় যতক্ষণ থাকবে মনে রাখবে ভাল আছ। চুরি কর চামারি কর খুন কর সব মাফ। বের হতে চেয়েছ কি মরেছ।

অতীশ কি বলতে গেলে এক ধমক দিয়েছিল মানসদা।—দেখ নবীন যুবক, আমি তোমার আগে পৃথিবীতে এসেছি। অনেক দেখা। তুমি মনে করছ দেশ বিদেশ করেছ বলে সব বোঝ সব জান। মোসায়েব বলে একটা কথা আছে অভিধানে। সেটা একবার খুলে পড়ে দেখ। উপকারে লাগবে। তুমি কতটা কাজের তার চেয়ে বেশি দরকার কত বড় তুমি মোসায়েব। ইংরেজ আমল থেকে দেশে সেই এক ট্রাডিশন চলছে। ফক্কা ছক্কা বাইরে চলে, রাজার বাড়িতে চলে না। বলে তিনি তাঁর মুঠো আল্লা করে দেখালেন, কিছুই নেই। তবু কত জোর এই মুঠিতে। চেপে ধর, মনে হবে, বিশ্বসংসার তোমার তালুতে, আম্মা করে দাও, মনে হবে সাঁতার কাটছ।

সে ভাঙা শ্যাওলাধরা দোতলা বাড়িটার সামনে এসে সকালের কথাগুলি মনে করতে পারল। সৎ মানুষ চাই। সৎ জীবনের আশায় সে এখানে এসেছে। প্রথম সে নির্ভয় পেয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে সব ফাঁকা। সে বলল, আচ্ছা কুম্ভবাবু, রাজেনদার পাশে ভদ্রমহিলা কে? প্রায় বিদেশিনীর মত দেখতে।

—ওরে বাপ, আপনার সঙ্গে কথা বললেও দেখছি কেলেঙ্কারি হবে। বলতে হবে কে? তারপর খুব গলা নামিয়ে ফিস্ ফিস করে বলল, বৌরাণী। সব কব্জা করে ফেলেছে। কুক্ষিগত করেছে সব। এ-সব কথা আবার দু-কান করবেন না যেন। কুম্ভ পরে বলতে যাচ্ছিল, কাছা-আলগা লোক মশাই আপনি। ধরে ফেলেছি। তারপরই সতর্ক করে দিয়ে বলল, দু-কান করবেন না। করলে সোজা মশাই অস্বীকার করব। বাবা বলেছেন, আত্মরক্ষার জন্য সব করা চলে। বাবার কথা খুব মানি। দেখছি এতে আমার উপকারই হয়েছে। অনেক বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছি।

কুম্ভ বলল, আর কিছু বলবেন?

—আচ্ছা বৌরাণীর দেশ কোথায় ছিল জানেন?

—আপনার দেখছি ভারি ব্যামো আছে। ও দিয়ে কি হবে! আমাদের সাহস আছে জানার!

—বাঙালী মেয়েরা তো দেখতে এমন হয় না।

—কে বলেছে বাঙালী। তবে শুনেছি বাপ বাঙালী জমিদার ছিল। বাকিটা ঠিক জানি না। জানলেও বলব না। আপনি আমার ওপরওয়ালা, যদি জোর করে জানতে চান বলতে পারি। ধরা পড়লে বলব, চাকরি রক্ষার্থে বলেছি। তাহলেই দোষ খণ্ডন।

—না, জানতে চাই না। আর শুনুন, আমি কিন্তু রাতে মেসে খাব। আমার জন্য আর বাড়িতে ঝামেলা বাড়াবেন না।

কুম্ভ খুব মোলায়েম গলায় বলল, আপনাকে দাদার মতো দেখি বলেই এত জোর গলায় কথা বলি। বাবা বলেছেন, মানুষটা ভাল। সেই থেকে ভাল মানুষ আছেন। তবে কি জানেন, এ-বাড়িতে ভাল মানুষকেই আমাদের ভয়। আপনাকে কোন কথা বলতে ভয় করে।

অতীশ সিঁড়িতে উঠে যেতে যেতে বলল, আরে না, যত ভাল মানুষ আমাকে আপনারা ভাবছেন, আসলে আমি তত ভাল নই। শেষে নিজের কাছেই জবাবদিহি করার মতো বলল, কি ছোটবাবু ঠিক না! তুমি আড়ালে চলে যাচ্ছ কেন। সামনে এস। আমি ঠিক বলিনি!

অতীশ দেখতে পেল তার পাশে পাশে ছোটবাবু লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ছোটবাবু একটা ক্রস কাঁধে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে টুইন ডেকে উঠছে। পেছনে পেছনে বনি উঠে আসছে। পাশে সেই বুড়ো মানুষ—হাত তুলে দিগন্ত প্রসারিত সমুদ্র দেখিয়ে বলছেন, ইউ উইল কেরি দিস ক্রস।

অতীশ ছোটবাবুকে প্রশ্ন করল, সেটা মানুষের কতদিন।

ছোটবাবু বলে যাচ্ছে যেন, আজীবন অতীশ। আজীবন এই ক্রস বহন করে যেতে হয়।

অতীশ সাহস পেয়ে গেল। এই করে সে তার সাহস ফিরিয়ে আনে। সে তখন আবার স্বাভাবিক,

সাধারণ মানুষ। কেউ একজন পাশের ঘর থেকে বলল, ফিরলেন?

—এই ফিরলাম।

—তাস খেলবেন? পার্টনার পাচ্ছি না।

অতীশ হেসে বলল, খেলব। তবে শিখিয়ে নিতে হবে।

—ধুস। আপনি মশাই তবে কি!

অতীশ বুঝতে পারল, তাঁর সমবয়সী এই যুবকটি আজ অফিস কামাই করেছে। সে যখন বের হয়, তখন সিঁড়িতে দেখেছে শ্যামলা রঙের একটা মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এই যুবকের ঘরে ঢুকে গেল। কলেজে পড়ে-টড়ে বোধ হয়। হাতে বই খাতা। মেয়েটি এখন না থাকায় নিঃসঙ্গ বোধ করছে। তাকে তাস খেলতে বলছে। তাস খেলা জানে না বলে, উজবুক ভেবেছে। সে যুবকের নাম জানে না। আলাপ করে নাম জেনে নেবার মানসিকতাও তার গড়ে ওঠেনি। ফলে সে দেখেছে, মানুষের সঙ্গে কিছুতেই তার দূরত্ব ঘুচতে চায় না। সে যেখানেই গেছে নিঃসঙ্গ এবং একা হয়ে পড়েছে। এবারে সে ভাবল, এগুলো ভাল লক্ষণ না। এখানকার জীবনও যে তার কাছে সেই অনিশ্চিত সমুদ্র যাত্রার মতো। এখানেও সে চায় কোনো মৈত্রদা তার পাশে থাকুক। সারেঙসাব থাকুন। মাথার ওপর কেউ না কেউ বিশাল বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকুক জীবনভর। এখানে একমাত্র মানসদাই যেন কিছুটা বৃক্ষের মতো। কিন্তু গতকাল সে যা দেখেছে তারপর এই মানুষের ওপর কতটা নির্ভর করতে পারবে সে ঠিক বুঝতে পারছে না।

অতীশ গলা বাড়িয়ে বলল, আপনার নামটা জানা গেল না।

—জয়ন্ত চক্রবর্তী। জয়ন্তু বলে ডাকবেন। এখানে সবাই চক্রবর্তী বলে। এটা আমার ভাল লাগে না।

—রাজার অফিসেই আছেন?

—ওরে বাপ, মরে গেলেও না। আমার বাবা করতেন। আমরা কেউ করি না। বাবা আমার রাজার আতঙ্কেই অকালে মরে গেলেন। আসলে এদের মুশকিল কি জানেন, এরা ভাবে তাদের ছেড়ে গেলে আর কোথাও কেউ কাজ করতে পারবে না। বাপের মতো বেটারাও ভিক্ষা চাইতে আসবে।

অতসব কথা অতীশ শুনতে চায়নি। শুধু সামান্য অন্তরঙ্গ হবার জন্য দুটো একটা কথা বলা। ছেলেটি খুব খোলামেলা কথা বলছে। আরও বলত, কিন্তু হাত মুখ ধুয়ে এখন কিছু খাওয়া দরকার। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মেসবাড়িতে নটায় খাবার দেবে। এর আগে সামান্য কিছু খেয়ে না নিলে খিদেয় কষ্ট পাবে ভাবল। গাড়িবারান্দায় আলো জ্বলে উঠেছে। রাজপ্রাসাদে আলো, নতুন বাড়ির একটা দিকে আলো জ্বলছে। অন্য দিকটা অন্ধকার। নিচে সব অফিস ফেরত মানুষ যে যার ঘরে ঢুকে যাচ্ছে।

অতীশ বাথরুমে স্নান করে নিল। ঘরে এসে তোয়ালে মেলে দেবার সময় দেখল, জয়ন্ত বারান্দায় রেলিঙে ভর করে কি দেখছে। নাকে রুমাল চাপা এবং সেও একটা পচা গন্ধ পেল। নিচ থেকে খুপরি ঘরগুলোর বাচ্চাদেরও সোরগোল আসছে। সে বলল, কী বিশ্রী পচা গন্ধ!

—আরে বাইরে এসে দেখুন। মানুষের লাশ। কে গায়েব করে রেখেছিল।

এমন নিরাসক্ত গলায় জয়ম্ভ কথাটা বলল, যেন এটা কোনও ঘটনাই নয়। সে দৌড়ে বারান্দায় বের হয়ে গেল। দেখল তিন চাকার আবর্জনা টানার টিনের একটা গাড়িতে এ-বাড়ির জমাদার বস্তা ঢেকে কি নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে এক দঙ্গল লোক।

অতীশ মানুষগুলোর কৌতূহল দেখে বুঝল, জয়ন্ত ঠাট্টা করছে। এতটুকু গাড়িতে মানুষের লাশ যায় কি করে। কুকুর বেড়াল মরেছে। সে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ঘরে ফিরে এল।

জয়ন্ত ওখান থেকে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না! এ বাড়িতে আপনি আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভ্রূণ হত্যা হয়েছে। লক্ষণ ভাল না।

অতীশ বলল, তার মানে!

জয়ন্ত বলল, ভালবাসার দান এখন আঁস্তাকুড়ে। পচে ঢোল। অতীশ কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল। এই ঘটনার সঙ্গে তার আসায় একটা সম্পর্ক খুঁজছে জয়ন্ত। সে বলল, হত্যাকারী ধরা পড়েছে?

—না।

—প্রাইভেট অফিসে এই নিয়ে ঝামেলা গেল। আমার ডাক পড়েছিল।

—কেন?

—যদি জানি। যদি কোন ক্লু দিতে পারি। আসলে এটা তো আর রাজার বাড়ি নেই। চারপাশটা দেখুন বস্তির মতো। ঐ ঘেরাটা দিয়ে রাজা সতীত্ব বাঁচাচ্ছে। কতদিন চলে দেখা যাক। এখন বাড়িতে যত যুবতী মেয়ে আছে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করালেই সব ধরা যায়। ওতে কারো গরজ নেই। তখনই কুম্ভবাবু নিচে ছুটে আসছে। হস্তদন্ত হয়ে সিঁড়িতে উঠছে।

—দাদা শুনেছেন কান্ড?

—এই ত নিয়ে গেল।

—বলেন, এ-বাড়িতে কারো থাকতে ইচ্ছে করে। বাড়িটাকে রেন্ডিপাড়া করে ছাড়লি! অতীশ বলল, এতে উত্তেজিত হবার কি আছে!

—নেই বলছেন! তা হলে নেই। সে উঠে পড়ল। তারপর কেমন উত্তেজিত গলায় বলল, কোথায় ও-সব পয়দা হয় জানা আছে। হাত দিতে পারছি না। যখন দেব না রাজার বাড়ি উল্টে যাবে।

অতীশের কানে লাগছিল কথাগুলো। বলল, কুম্ভবাবু বসুন। চা আনান কাউকে বলে। কিছু খাবার। অতীশ টাকা বের করে দিল।

কুম্ভবাবু বেশ প্রফুল্ল হয়ে গেল। এ-বাড়ির সবার ওপর খবরদারি করার একটা হক আছে তার। সে রেলিং-এ ঝুঁকে ডাকল, দেখত, অফিসে কে আছে নকুল। কালীদা পঞ্চানন যেই থাকুক পাঠিয়ে দিবি। নতুন ম্যানেজারবাবুর চা মিষ্টি আনতে হবে।

চা মিষ্টি খাবার পর কুম্ভবাবু বলল, যাই দাদা, কাল মোহনবাগান ওয়াড়ি খেলা আছে। যাবেন নাকি! টিকিটের জন্য ভাববেন না। কাবুলবাবুকে ধরলেই হবে। রাজার মেম্বারশিপের কার্ড আছে। কাবুলবাবুর আছে। ওকে ধরলে দুটোই পাওয়া যাবে।

অতীশ দেখল, এই মানুষ কিছুক্ষণ আগে ভেবেছিল, সমাজ সংসার রসাতলে গেল, এই মানুষ সিঙারা মিষ্টি খেয়ে কাল খেলা দেখবে ভেবে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এই মানুষ তার অফিসে তার পরেই জায়গা দখল করে আছে। বছর চারেক হল কাজ করছে। কাজ বোঝে ভাল। আসলে অফিসে সে ওপরওয়ালা না এই কুম্ভবাবু পরে বোধ হয় টের পাওয়া যাবে। অতীশ এ-মুহূর্তে এই নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করা পছন্দ করছে না। এখন তার মনের মধ্যে সেই রহস্যময়ী নারী—কোথায় কখন, কবে কত দূরে কোন অতীতে, তবু এত পরিচিত, যেন কতকাল আগে সে শৈশবে এই মুখটা মনে মনে লালন করেছিল—অথচ মনে করতে পারছে না।

তখন কুম্ভবাবু বলল, আপনি খাবেন না শুনে বাবা খুব কষ্ট পেয়েছেন। মেসের খাওয়া আপনার সহ্য হবে!

—সে হয়ে যাবে।

—শুনছি ত আপনার কোয়ার্টার ঠিক হচ্ছে।

—আমার কোয়ার্টার!

—আরে দাদা আপনি খুব গুড বুকে আছেন। চালিয়ে যান। কোথায় যে আপনি সুতো টেনে রেখেছেন কে জানে। আমি একটা আলাদা কোয়ার্টার চাইলুম, কিছুতেই রাজাকে রাজি করানো গেল না। পাশের একটা বাড়তি ঘর দিয়ে দায় চুকিয়ে দিল।

অতীশ কিছুই শুনছে না। সে কি ভেবে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন থাকার পর বলল, আমি তো কোয়ার্টারের কথা বলিনি কুম্ভবাবু। কারটা আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছেন দেখুন!

কুম্ভবাবু বেঁটে গোলগাল চেহারার মানুষ। মাথায় ঘন চুল, রং ফর্সা। পাতলুন পরনে। জরির কাজ করা পাঞ্জাবি গায়ে। বাপের মতো সৌখিন। কেবল কানে এখনও আতর মাখানো তুলো গোঁজা নেই। বয়স বাড়লে হবে। অফিস থেকে ফিরে স্নান-টান সেরে এসেছে। গলায় ঘাড়ে পাউডার। বেশ সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল। সে এখন ঘরটা দেখছে। দোতলায় এটা এখন রাজার গেস্ট-হাউস। বাইরের কেউ এলে থাকে। কুম্ভ এ-ঘরটায় অনেকদিন আসেনি। অতীশ আসায় এ-ঘরটায় আবার আসার সুযোগ পেয়েছে। সে পায়ের ওপর পা রেখে বলল, এ শর্মা দাদা না জেনে কিছু বলে না।

এ-বাড়ির ওপর অতীশের কৃতজ্ঞতায় মনটা কেমন ভরে গেল। নির্মলা এলে সে এত ভয় পাবে না। নির্মলাও এখন তার কাছে বড় বৃক্ষের মতো। মিণ্টু টুটুল সে। আসার সময় মিণ্টু টুটুল ঘুমিয়েছিল। ফুটফুটে দুটো শিশু জানেই না তাদের বাবা একা পড়ে গিয়ে কত অসহায় বোধ করছে। ভয় পাচ্ছে। এবং যা হয়ে থাকে, তাকে একা পেলেই সেই প্রেতাত্মা গন্ধ ছড়ায়। অফিসে আজ প্রথম গন্ধটা পেয়েছিল। এবং যা করে থাকে, সে এক গাদা ধূপকাঠি কিনে এনেছে। ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখলে অতীশ দেখেছে গন্ধটা কেমন ক্রমে মরে আসে! সে নিজেই এভাবে আত্মরক্ষার উপায় বের করে নিয়েছে। প্রথম প্রথম সহসা কখনও এভাবে ঘরে ধূপকাঠি রাশি রশি জ্বালিয়ে দিলে নির্মলা বিস্মিত হয়ে বলত, করছ কি! একটা-দুটো জ্বালাও। এত জ্বালাচ্ছ কেন। লোকে তো পাগল বলবে।

অতীশ নির্মলার কথায় তখন ক্ষেপে যেত। গন্ধটা ছড়ালেই তার মাথা কেমন ঠিক থাকে না। চোখ লাল হয়ে যায়। কথা কম বলে। চুপচাপ বসে থাকে। কেউ কিছু বললেই, চিৎকার করে ওঠে। নির্মলা বুঝতে পারে না কেন এমন হয়, মাঝে মাঝে বিভ্রমে পড়ে গিয়ে কেঁদে ফেলে। আর তখনই অতীশের কি হয়ে যায়। সে নির্মলার প্রতি অহেতুক নিষ্ঠুর আচরণ করছে ভাবে। বলে তুমি ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন। মাঝে মাঝে আমার এটা হয়। কিসের গন্ধ পাই। খেতে পারি না। ধূপকাঠি জ্বেলে দিলে স্বস্তি পাই।

ধূপকাঠি জ্বেলে দিলেই সে আবার ভাল হয়ে যায়। মনের সব ধন্দ ঘুচে যায়। নাক টেনেও তখন আর কোনও গন্ধ পায় না। আজ অফিসে গন্ধটা পাবার পরই সে খুব বিচলিত বোধ করছিল। ফেরার পথে এক ডজন ধূপকাঠি কিনেছে। গাড়িতে প্রেতাত্মার গন্ধটা ভুরভুর করছিল। চোখ লাল হয়ে উঠছিল। পারলে গাড়িতেই যেন সে ধূপকাঠি জ্বালাত। কিন্তু এতে কুম্ভবাবু মাথায় গোলমাল আছে ভাবতে পারে। সেজন্য ধূপকাঠি নাকের কাছে নিয়ে বসে ছিল। আর কখন গন্ধটা নিজ থেকেই উবে গেল। এমন ত হয় না। কখন হল এটা। রাজার দেউড়িতে আসতেই সেই রহস্যময়ী নারী—সে কে? সে এখন রাজার ঘরণী—আগে কি ছিল, কোথায় ছিল, তখনই গন্ধটা বুঝি ভয়ে উড়ে গেছে।

কুম্ভবাবু বলল, কি ভাবছেন। গল্পের প্লট?

—না, না।

—বৌদিকে ফেলে এসে মন খারাপ?

অতীশ হাসল। বলল, তা বলতে পারেন। রমণীরা ভারি তুকতাক জানে, কোথাকার কে, অথচ দেখুন কেমন মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসে গেল। তাকে ফেলে এক-পা নড়া যায় না। কোথাও গেলেই মন কেমন করে।

—ভাববেন না। কোয়ার্টার পেয়ে যাচ্ছেন। শুনছি তো অন্দরের পাশেই আপনার কোয়ার্টার দেওয়া হবে।

অতীশের বুকটা ছাঁত করে উঠল। ওদিকটা ত খুব রেসট্রিকটেড জোন। নির্দিষ্ট কিছু আমলা যেতে পারে। বয়বাবুর্চিরা যেতে পারে। জমাদার, পুরনো পাইক বরকন্দাজ যেতে পারে—যারা গতকাল তার সঙ্গে দেখা করে গেছে তারাই রাজবাড়ির সব হালচাল বলে গেছে। ভুলেও ওদিকটা মাড়াবেন না। কৈফিয়ত তলব হবে। খাস খানসামার খুব লাগানো ভাঙানোর স্বভাব।

এ-বাড়ির কিছু কিছু গোপন খবর খুব সহজেই চাউর হয়ে যায়। কিছু কিছু গোপন খবর দু- একজনের কানে আসে আর অতি গোপন খবর কেউ জানতে পারে না। কুমার বাহাদুর বৌরাণী আর নির্দিষ্ট কিছু আমলা শুধু জানে। কুম্ভ কিছু কিছু গোপন খবর পায়। রাধিকাবাবু পুত্রদের কন্যাদের এই গোপন উৎসের মুখ খুলে দিয়ে প্রমাণ করেন, রাজার তিনি কত বিশ্বস্ত লোক। কুম্ভ বড় হয়ে এটা টের পেয়েছে। বাবার কাছ থেকেই সে জানে, কুমার বাহাদুর বলেছেন, অতীশকে ভাল দেখে একটা কোয়ার্টার দিন। ওর যাতে কোন অসুবিধা না হয় দেখুন।

বিকেলে বাসায় ফিরেই কুম্ভ সব শুনেছে। শুনেই সে ক্ষেপে গিয়েছিল। আসতে না আসতেই কোয়ার্টার। আমরা ভেসে এসেছি। তবে তার বাবা রাধিকাবাবু রাজার সুপার, সোজা কথা? সে ভাবতে গর্ব বোধ করে। সে বলল, বাবাই কুমার বাহাদুরের কাছে কথাটা তুললেন। অতীশের খুব অসুবিধা হচ্ছে। একা, থাকে কোথায়, খায় কি, কে দেখে? মেসে খেলে অজীর্ণ রোগে ভুগে মারা পড়বে ছেলেটা।

অতীশ শুনে যাচ্ছিল।

কুম্ভ বলল, বাবা আপনার খুব সুখ্যাতি করেছেন কুমারবাহাদুরের কাছে।

অতীশ বলল, আগেকার দিনের মানুষদেরই এই স্বভাব। খুঁটিয়ে দেখে না। ভাল লাগলেই ভাল বলে ফেলে। আমার বাবাকেও দেখেছি এরকমের।

কুম্ভ বলল, বাবাই কুমারবাহাদুরকে কোয়ার্টারের কথা বললেন। কিন্তু এরা একদম পিচাশ জানেন। থাকলেও দেবে না। কুমারবাহাদুর বলল, কোয়ার্টার কোথায়। ফাঁকা তো একটাও নেই। কিন্তু বাবার সঙ্গে পারবে কেন? বললেন, সোজাসুজি বললেন, দেখুন কুমারবাহাদুর কাজ ভাল চাইলে তাকে সুযোগ- সুবিধা দিতেই হবে। সারাদিন কাজের পর যদি নিজের পরিজন নিয়ে একটু থাকার জায়গা না পায় তো মন দিয়ে কাজ করবে কেন!

অতীশ এবার প্রশ্ন না করে পারল না, রাজেনদা কি বললেন?

—এরা কিছু বলতে চায় দাদা? এদের মুখ থেকে কথা খসিয়ে নিতে হয়। বাবা ঠিক খসিয়ে নিয়েছেন। নিধিবাবুর কোয়ার্টার ফাঁকা।

—নিধিবাবুটা কে?

—নিউবেঙ্গল টাইপ ফাউন্ড্রির ম্যানেজার। রিটায়ার করেছেন মাস দুই হল। কুমারবাহাদুরের বাবার আমলের লোক। ইদানীং চোখে দেখতে পেতেন না। আশির কাছাকাছি বয়েস। মহারাজার খুব বন্ধুলোক ছিলেন।

কুম্ভকে এখন অন্যরকম লাগছে। এরা তার ভাল চায়।

কুম্ভর বাবার প্রতি অতীশের মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। আসলে বাবার সঙ্গে আলাপ ছিল বলেই হয়ত তাকে খুব স্নেহ করছেন। সে রাতে খাবে না বলায়ও কষ্ট পেয়েছেন। আগেকার আমলের মানুষ বলেই এটা হয়। আজকাল মানুষের মধ্যে এসব গুণ একেবারেই নেই। অতীশের বলার ইচ্ছা হল, আপনার বাবার এ ঋণ শোধ করতে পারব না। কি বলে এখন সে যে কৃতজ্ঞতা জানাবে তার বাবাকে! কিন্তু তার আছে আশ্চর্য এক স্বভাব, সে কিছুতেই খুব বিগলিত হয়ে যেতে পারে না। বিন্দুমাত্র কাউকে তোষামোদও করতে পারে না। কখনই সে ভেতরের কথা প্রকাশ করতে পারে না। সংকোচে পড়ে যায়। সে তখন আবার চুপচাপ বসে থাকে।

কুম্ভ বলল, কোয়ার্টার পেলে খাওয়াবেন। কত বড় খবর। রাজার খুব নিজের লোক না হলে এখানে কোয়ার্টার মেলে না। আপনি আসতে না আসতেই তার নিজের লোক হয়ে গেলেন। ঈর্যা হয়।

তারপর কুম্ভ উঠে যাবার সময় বলল, কি খেলা দেখছেন ত?

অতীশ হেসে বলল, কাল থাক। আর একদিন যাওয়া যাবে।

কুম্ভ উঠে যাবার সময় ভাবল, বড়ই নীরস লোক। খেলাতে পর্যন্ত উৎসাহ নেই। কি ভাবে লোকটা সব সময়! এত আচ্ছন্ন থাকে কেন! কিছু একটা রহস্য আছে। জাহাজে কাজ করত। স্বভাব-চরিত্র ভাল থাকার কথা না। মেয়েমানুষ ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে বড় রকমের অসুখ বাধিয়েছে। শরীরে ঘা ফুটে বের হলে টের পাওয়া যাবে। এবং সে বের হবার মুখে যাতে ক্ষত ফুটে বের হয় সেই প্রার্থনাই করল ভগবানের কাছে। তারই কথা ছিল, শিট অ্যানড মেটাল প্রিন্টিং পাবলিক লিমিটেডের ম্যানেজার হবার। কিন্তু এত করেও রাজার বিশ্বাস অর্জন করতে পারল না। মনে মনে ভারি আফসোস। কোথা থেকে উটকো লোক রাজা যে ধরে আনল।

সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে কুম্ভর মাথা গরম হয়ে গেল; যত নামছে, তত গরম হচ্ছে মাথা—সে শেষ পর্যন্ত হেরে গেল। কি না করেছে সে, আগের ম্যানেজারের বাড়ির ছবি তুলে এনে দেখিয়েছে, দেখুন টাকা আপনার কোথায় যায়! কাস্টমারদের ধরে নিয়ে গিয়ে বলেছে, কি পারশেন্টেজে কাজ হয় দেখুন। যতটা ঘটেছিল তার চেয়ে বেশি বানিয়ে বানিয়ে সে প্রথম তার বাবা ওরফে রাধিকাবাবুর মারফত রাজার কান ভারি করেছে। বলেছে, এটা আপনার গোল্ড মাইন। নজর দিন। আপনার পূর্বপুরুষের স্বার্থ রক্ষা করুন। চার বছরে অক্লান্ত খেটে সে কোম্পানীর খুঁটিনাটি বিষয় রপ্ত করেছে। প্রিন্টিং থেকে ফেব্রিকেশনে, কোথাও এতটুকু খুঁত থাকলে ধরতে পারে, শোধরাতে পারে। একাউন্টস তার নখদর্পণে। সেলট্যাকস, ইনকামট্যাকস সে নিজে করতে পারে। ক্যাশ, লেজার, ব্যালেন্সশীট তার কাছে এখন জলভাত। এক আশাতেই সে এতদূর দৌড়ে গেছে। এখন কি না এই হারামজাদা ঘুঘু লোকটা তার বাড়াভাতে ছাই দিয়েছে। গত রাতে পৃথিবীতে সেও আর এক মানুষ যে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে। এসে গেছে শুনেই তার হৃৎপিণ্ডে কে যেন আগুন নিক্ষেপ করেছিল। সে স্থির থাকতে পারে নি! ছট-ফট করেছে সারারাত। সকালের দিকে ঘুম চোখে লেগে এসেছিল। ঘুম ভাঙলে দেখেছিল, হাসিরাণী ঘরে নেই। কাবলকে দেখার জন্য ঠিক জানালায় পালিয়ে গেছে। তাহলে বল বাবু আমি তোমাকে ক্ষমা করব কেন। তুমি যত ভালমানুষই হও, আমি তোমাকে নরকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করব। আমি তো মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *