।। আটত্রিশ।।
ওরা মুখোমুখি বসে আছে। জানালার ধারে। সিট পেতে অসুবিধা হয় নি। একটু আগেই চলে এসেছে। এত ভাল জায়গা পাবে দুজনের একজনও আশা করেনি। যাত্রা শুভই বলতে হবে।
ট্রেনটি মাঝখানে কোথাও থামে না।
কতকাল পর নির্মলা আবার ট্রেনে কোথাও যাচ্ছে। কোথাও বের হওয়া হয়ে ওঠে না। সে তার বালিকা বয়সে কত জায়গায় বাবার সঙ্গে গেছে। বাবার ছিল বদলির চাকরি। দু-বছর তিন বছরও এক জায়গায় তারা এক নাগাড়ে থাকতে পারে নি। ছুটিছাটায়ও বাবা তাদের নিয়ে বেড়াতে বের হয়ে পড়তেন। বাবা ছাড়া সে কিছু বুঝত না। ভাই বোনদের মধ্যে বাবার একটু বেশিই টান ছিল তার প্রতি। তার বায়নাক্কায় মা অস্থির হয়ে উঠত।—কী মেয়েরে বাবা, বলছে ঘোড়ায় চড়বে।
বাবা বলতেন ঠিক আছে, আমি এজমোলিকে বলব, ওর যখন শখ শিখতে, শিখুক না। সাইকেল বাবাই কিনে দিয়েছিলেন। লাল রঙের সাইকেল—পাহাড়ি এলাকাতেই তারা মানুষ হয়েছে। সে সব শহরের দিনগুলি স্বপ্নের মতো মনে হয়।
ট্রেন ছুটছিল।
এখন নির্মলা মাঠ ঘাট দেখছে। শস্যবিহীন মাঠ দেখছে। কোথাও সবুজ ঘাসের মাঠ, সব ফেলে ট্রেন গতি পেয়ে গেছে। একবার অতীশের দিকে চোখ তুলে তাকাল। অতীশও কি তার শৈশবের কথা ভাবছে? বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লে, কেমন এক মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়। কিন্তু মনটা সবসময় বাড়িতেই পড়ে রয়েছে। কিছুতেই এই ছুটে চলার আনন্দ নির্মলা উপভোগ করতে পারছে না। সেই সব শহর, শহরের উঁচু নিচু ঢালু পথ, সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ, লেপচাদের বস্তি পার হয়ে ঝাউয়ের বনে হারিয়ে যেতে গিয়ে কখন যে দেখতে পাচ্ছে, সেখানে আর এক অরণ্য সৃষ্টি হয়েছে। সেই অরণ্যে মাত্র তিনটি গাছ। অতীশ, টুটুল, মিণ্টু। গাছ তিনটের মধ্যে এমন ঘোর রহস্যময়তা থাকে, থাকতে পারে, কোনো গভীর জঙ্গলে ঢুকেও তার এটা মনে হয় নি। বাবার ছিল শিকারের শখ, বাবার সঙ্গে সেও গেছে। কোনো ডাকবাংলোয় তাকে বাবা রেখে যেতে পারত না। সে ঠিক বাবার পিছু নিত। মা বলত, তোমার গেছো মেয়ে—এর বিয়ে হবে না। হলেও পরদিন ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। ঘরে একদম থাকতে চায় না।
নির্মলা ফের অতীশকে দেখল।
সেও জানালা দিয়ে মাঠঘাট দেখছে।
এই শুনছ!
অতীশ চোখ তুলে তাকাল।
দ্যাখ দ্যাখ।
অতীশ ঠিক বুঝতে পারল না নির্মলা তাকে কী দেখাতে চায়। সিগনাল না পেয়ে ট্রেনটা থেমে গেছে। ঠিক নিচে পাকা রাস্তা, মানুষজন ঘর-বাড়ি, গঞ্জের মতো জায়গা। রাস্তায় কোনো দুরন্ত ছেলের পেছনে মা তাড়া করছে ধরবার জন্য। এমন দৃশ্য এত দুর্লভ কেন অতীশের বুঝতে কষ্ট হল না।
নির্মলা বলছে, কী সুন্দর বাচ্চাটা, না!
খুব সুন্দর।
এই হয়। ট্রেনে বের হয়ে স্বামী স্ত্রীতে প্রথম হনিমুন—কতরকম দুজনের মধ্যে কথাচ্ছলে উপভোগের ছবি ফুটে উঠেছে, খারাপ কি, আমি তো তোমাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাই নি, আমরা এই প্ৰথম দুজনে একা বের হব, তোমার কোয়ার্টার সে যত ছোটই হোক ডাকবাংলো ভেবে ফেলব। গাঁয়ে যখন যাচ্ছি—তখন বন-জঙ্গল থাকবেই। শুনেছি, কিছু দূরেই ময়ূরাক্ষীর ক্যানেল। বিকালে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হব। যেমন ছুটিছাটায় তোমার বাবা তোমাদের নিয়ে বের হয়ে পড়তেন, তোমরা যখন জন্মাও নি, তখন তোমার মাকে নিয়ে—আমরাও ভেবে ফেলব বেড়াতে বের হয়েছি। কদিন সব কিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করব, এমনও কথা দিয়েছিল অতীশ। নির্মলাকে বলেছিল, তুমিও টুটুল মিণ্টুর কথা তুলে মন খারাপ করে দেবে না কথা দাও। আসলে টুটুল মিণ্টুর কথা উঠলেই দুজনের মধ্যে টুপ করে দুঃখ ঝরে পড়তে থাকবে।
দুরম্ভ শিশুটি মায়ের কোলে বন্দী। নির্মলা চোখ ফেরাতে পারছে না।
সে ত বলতে পারছে না, মিণ্টু ঠিক বলে দিয়েছে, মা না চলে গেছে!
মিণ্টু সব বোঝে। মা কাজ নিয়ে গাঁয়ের স্কুলে গেছে, থাকবে, তার স্কুলের আণ্টির মতো মা আণ্টি, ছুটিছাটায় মা আসবে—মিণ্টুর এ-সব বুঝতে কষ্ট হয় না। কিন্তু টুটুলটা হাবা। মিণ্টু তাই বলবে। তুই হাবারে। মা চাকরি করতে গেছে। দেখবি বাবা ফিরে আসবে, মা সঙ্গে আসবে না।
এমনিতে বলবে না। বরং কান্নাকাটি করলে বলবে, কিরে কাঁদছিস কেন? বাবা মাকে নিয়ে বেড়াতে গেছে। কাঁদছিস কেন। কী বোকারে তুই!
কিন্তু কী নিয়ে যে দুজনের মধ্যে সহসা ঝগড়া বেধে যায় এই রহস্যটা নির্মলা জানে না। কে বেশি আদরের, কার প্রতি মনোযোগ বেশি শিশুরা যতটা বোঝে আর কেউ তত বোঝে না। খেতে বসে, পড়তে বসে, বিকেলে খেলতে বের হলে কখন যে দুজন এসেই নালিশ দেবে, মা দেখ টুটুল খামচে দিয়েছে। যত ক্ষোভ তার দিদিটার উপর। আবার এক দণ্ড দেখতে না পেলে, মা, দিদি কোথায় গেল। মা, দিদিকে আমি মারি নি। দিদি দিদি, আমি তোকে মারব না দিদি।
মিণ্টুও কখন যে ভাইটার উপর খেপে যাবে বোঝা মুশকিল। বার বার বুঝিয়েছে। তুমি বড় হয়েছ, তুমি ভাইকে দেখে রাখবে। ভাইকে বলবে, বাবা মাকে নিয়ে বেড়াতে গেছে। কি, মনে থাকবে তো?
তুমি মা আণ্টি, না?
হ্যাঁ তাই।
আমাকে নিয়ে যাবে? আমি দুষ্টুমি করব না। টুটুলটা দুষ্টুমি করে। ওকে নেব না।
এই শেখালাম! তুমি টুটুল দুজনেই বাড়ি থাকবে। তোমার হাসুকাকা বাড়ি থাকবে। তোমার বাবা ফিরে এলে হাসু দেশে চলে যাবে। কাকার কথা শুনবে। সুখিদির কথা শুনবে।
মিণ্টু অবোধ চোখে তাকিয়েছিল। বুঝেও যেন বুঝতে চাইত না। মা বাড়ি থাকবে না, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বলতে পারবে না, মা খিদে পেয়েছে, খেতে দাও, মা মা। বিকেলে ভাইবোন রাজবাড়ির মাঠে ঘুরে বেড়ায়, কিংবা লুকোচুরি খেলা, সঙ্গীদের নিয়ে ছোটাছুটি, টুটুল অবশ্য না বুঝে দৌড়ঝাঁপ করে, দিদি যা করবে, তাকেও তাই করতে হবে—সে এসেও ফিরে দেখবে বাড়ি ফাঁকা। সুখি হয়ত করিডরে মাদুর পেতে ঘুমোবে—কিংবা কুম্ভবাবুর বাড়ি, অথবা মেস-বাড়ি পার হয়ে বাবুর্চি পাড়ায় ঘুরতে যাবে। ওর এই একটু সময় অবসর। দরজায় তালা ঝুলিয়ে চলে যেতেও পারে বিকেলে। তবে সুখি অতীশকে যমের মতো ভয় পায়। অতীশ রাখতে রাজিই হয় নি, সেই কবে থেকে কুম্ভবাবু লেগেছিল, রাখুন, মেয়েটার হাত টানের স্বভাব নেই। কিছুটা হাবা আছে।
নির্মলার হঠাৎ মনে হল, সুখির বোধহয় বুদ্ধি বিবেচনা কম। কে জানে বাসা খালি রেখে যেতেও পারে। মিণ্টু টুটুল সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখবে, বাসায় তালা ঝুলছে। ছুটে চলে যাবে বাবুর্চি পাড়ায়। ডাকবে, সুখিদি, ঘরে আলো জ্বাল নি, সন্ধ্যা দাও নি। ঘরে তালা দিয়েছ কেন।
মিণ্টু ভয়ও দেখাতে পারে, মা আসুক বলে দেব।
কেন জানি মনে হল, বাড়ি ফিরে গেলেই অজস্র নালিশ দেবে ভাই বোন মিলে।
জান মা টুটুল না আবার ঘাটলার সিঁড়িতে গিয়ে বসে ছিল।
সিঁড়ির জলে ছোট বেলে, কুঁচো চিংড়ি। টলটলে জল—রাজবাড়ির বাইরের পুকুরটাই একটা বড় আতঙ্ক তার। অন্দরের পুকুরে কেউ ঢুকতে পারে না। চারপাশে পাঁচিল তোলা। প্রাসাদ সংলগ্ন পুকুর। বউরাণী মাঝে মাঝে সাঁতার কাটে। আর কেউ জলে নামে কি না জানে না। কুমারবাহাদুরও নামতে পারে।
নির্মলা বলল, একটা কাজ করবে?
অতীশ আবার তাকাল।
ট্রেন আবার গতি পেয়ে গেছে। ছুটছে।
নির্মলার চুল উড়ছিল।
নির্মলার গায়ে র্যাপার
নির্মলা লক্ষ্য করছে এদিক ওদিক সব পুরুষরা চুরি করে দেখছে। সে না তাকিয়েও এটা টের পায় বলেই কারো দ্বিকে চোখ তুলে তাকায় না। চোখ তুলে তাকালেই চোখে চোখ পড়ে যাবে। ট্রেনে বাসে এটা এক অস্বস্তি তার। অতীশকে মাঝে মাঝে কোথাও থেকে ফিরে নালিশ দিয়েছে, কী বেহায়ারে বাবা! একেবারে গিলে খাচ্ছিল।
অতীশ হেসে বলত, দেখাটা ভাল। স্বাস্থ্যের লক্ষণ।
তুমি মজা করছ!
মজা না।’ এটা শেষ হয়ে গেলে জীবনও শেষ।
জীবন শেষ মানে?
আকর্ষণ বোঝো। জীবনের প্রতি আকর্ষণের কথা বলছি। যত লোকে দেখবে তত তুমি দীর্ঘায়ু হবে।
কী জানি বাবা, এ আবার তোমার কেমনতর কথা বুঝি না। এতে কেউ দীর্ঘায়ু হয়। অস্বস্তি না!
আরে বুঝছ না, ফুল ফুটলেই তার অহংকার। বাসি হয়ে গেলে, শুকিয়ে গেলে ফুলের আর কি মূল্য থাকে বল! পুরুষ দেখবে বলেই তো তুমি নারী। ওরা যদি না তাকায়, তোমার ভাল লাগবে?
এমন রূঢ় সত্য অতীশ সহজেই বলতে পারে। তার মানুষটিও এতই সুপুরুষ যে, সে কোনোদিন, অন্য কোনো মোহে পড়ে যায় নি। দীর্ঘকায় কোনো বলিষ্ঠ যুবা, হাতে পায়ে কালো লোমে ভর্তি বন্য এবং হিংস্রও মনে হয়, শ্বাপদেরা হেঁটে বেড়ায় ভিতরে। ওর আকর্ষণ এত তীব্র এবং গভীর কিংবা সহবাসে মানুষটি যখন তাকে ক্লান্ত করে দেয়, কেমন গভীর মায়ায় ঘুম চলে আসে। সে তারই সঙ্গে যাচ্ছে। একা পাওয়ার মোহ কি সন্তান-সন্তুতির চেয়েও বড়। কোনো ডাকবাংলো ভেবে মানুষটা তার সঙ্গে থাকবে। সে ভুলেই গেছে ওটা স্কুল কোয়ার্টার। আরও সব দিদিমণিরা থাকে। কোথায় কী ফাঁক- ফোকর থাকবে—দিনের বেলায় অস্থির হয়ে উঠলে কিছু করার থাকবে না।
সহবাসের জন্য এত পাগল মানুষ হয় সে জানত না। ফাঁক পেলেই পাঁচ সাত বছর পরও কেমন ছেলেমানুষের মতো জড়িয়ে ধরবে, চুমু খাবে, তাকে উলঙ্গ করে দিতে চাইবে—তার তো সবসময় ভাল লাগে না—অতীশ কেমন অবুঝ। সময় অসময় বোঝে না!
এই ছাড়। টুটুল আসছে।
একেবারে নিরীহ গোবেচারা মানুষ তখন অতীশ। ছিটকে সরে যাবে। বলবে, কই টুটুল! টুটুল আসছে বলছ!
জানালা খোলা দেখছ না!
সবাই উঁকি দিয়ে আছে!
আবার উঠে এলেই বুঝতে পারে অধীর হয়ে পড়ছে। কিন্তু তার যে সব সময় ভাল লাগে না। যেন এর জন্য সময় দিতে হয়। যেন এর জন্য সবুজ ঘাসের উপত্যকায় হেঁটে যাবার দরকার হয়—নারীর এই ইচ্ছের কথা পুরুষরা বোধহয় সহজে টের পায় না। নিরাভরণ সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য চাই গোপন নির্জনতা। স্কুল কোয়ার্টারে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। অতীশ তাকিয়েই আছে। কিছু বলতে গিয়ে কেন থেমে গেল নির্মলা সে বুঝতে পারছে না। নির্মলা এত অন্যমনস্ক! কী ভাবছে! কোনো কষ্ট, কোনো দুশ্চিন্তা? না, দুশ্চিন্তা কিংবা কষ্ট হলে মুখ এত প্রসন্ন দেখাত না। নারীর এই প্রসন্নতা ভিতরের কোনো অধীরতা থেকে।
সেই অধীরতা কত মধুর নির্মলার মুখ দেখলে সে টের পায়। প্রসন্নতা কোনো দেবীর মতো অবিরাম মহিমা নিয়ে বিরাজ করছে। সহবাসের সময় নারীর মুখ এত অপরূপ হয়ে যায় যে তখন অতীশের কেমন আর এক ঘোর। উলঙ্গ নারী শুয়ে থাকে বুঝি প্রকৃতির হেতু হয়ে। প্রকৃতির অঙ্কুরোদগমের উষ্ণতা শরীরে। চোখ বুজে পড়ে থাকে। চোখ বুজে থাকে কেন। লজ্জায়—না অধিক আরাম অনুভব করার জন্য—যে কোনো এক অচৈতন্য জড় জগতের মতো সে স্থির, তিরতির করে শুধু টের পায় নির্মলার শরীর কাঁপে, তারপর ক্রমে শক্ত হয়ে যায়, পাগল হয়ে ওঠে, দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে তছনছ করে দিতে চায় আবাদের জমিটুকু। তারপর দুজনই কেমন অসাড়। জীবনের অন্য অস্তিত্ব টের পায় না।
কিছু বলবে?
বলছিলাম, তুমি এবার কিন্তু ভুলে যাবে না।
ভুলে যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন অতীশ বুঝতে পারছে না।
কী ভুলে যাব বলছ?
ওই যে ওদের সাঁতার শেখানো….. মানে, তুমি কিন্তু অফিস যেতে দেরি হলেও রোজ ওদের পুকুরে নিয়ে যাবে।
যাব বলেছি তো। কিন্তু যা বিচ্ছু ছেলে, সাঁতারের নাম শুনলেই দৌড়। কতবার চেষ্টা করেছি দেখেছ।
মিণ্টুকে নিয়ে নামবে। তবেই দেখবে টুটুলও নামবে। এটা অবশ্য ঠিক। মিণ্টুকে তার বাবা সাঁতার শেখাচ্ছে, বুক জলে নিয়ে গেছে, সে পাড়ে দাঁড়িয়ে তা বেশিক্ষণ দেখবে না। অবশ্য বছর খানেক আগে দিদির সঙ্গে এতটা প্রতিযোগিতা ছিল না। দিদিকে বুক জলে নিয়ে গেলেও, কোনো আগ্রহ সঞ্চার হত না টুটুলের মনে। এখন হতে পারে!
মিণ্টু হাত পা ছুঁড়তে শিখেছিল, টুটুল তাও না। মিণ্টু জলে ডুব দিয়ে স্নান করাও শিখেছিল। কারখানার নানা জটিলতায় সব দিন হয়ে উঠত না। কখনও খুব সকালে বের হয়ে পড়তে হত, কখনও অফিস থেকে ফিরতে অনেক রাত হত, সকালে বাজার করে মিণ্টুকে স্কুলে দিয়ে টুটুলকে পুকুরে নিয়ে যাবার সময় হত না। ছুটির দিনে সম্ভব।
ও নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
দুশ্চিন্তা কোথায় করলাম!
আসলে কেউ কথা রাখতে পারে না। দুজনেই ভেবেছিল—যে কটা দিন একসঙ্গে থাকা যায়, সেই নতুন দিনগুলির মতো সে আর নির্মলা। বাড়িতে অবশ্য বেশি ঘরও ছিল না। তার জন্য যে ঘরটা ওটাও একা তার ছিল না। লোকজন এলে তার ঘরেই বসত। বাড়িতে একটা মাত্র আলনা। আলনাটা তার ঘরে। সবার জামা কাপড় আলনায়। জানালায় অথবা দরজায় পাড়াগাঁয়ে পর্দাও ঝোলে না। হুটহাট কে কখন ঢুকবে—রাত না হলে নিবিড়ভাবে কাছে পাবার উপায় ছিল না। তারপর ক মাসের মধ্যে মিণ্টু পেটে এসে গেল। এতদিন যাও ছিল একার, তখন হয়ে গেল সকলের। প্রথম তিন চার মাস, কিছু খেতে পারত না। ওক তুলে সব ফেলে দিত। কেমন শ্রীহীন হয়ে গেছিল—অতীশকে দেখলে খেপে যেত। যেন আহাম্মকির জন্য দায়ী সে। এত তাড়াতাড়ি নির্মলা সন্তান চায় নি। সে বাড়িতে এসে সবার মন যুগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। এমন কি শহরে যে চাকরি নিয়ে এল, বাবার অমতে সে তাও করতে সাহস পায়নি। বাড়ির বৌ বাইরে যাবে কাজে, পাড়াগাঁয়ে কে কবে ভেবেছে। শহর খুব দূরেও ছিল না। ক্রোশখানেক গেলেই রেললাইন পার হলেই শহর। নির্মলার যেন তখন একটা কাজই ছিল, কোনো কারণে কেউ তার বিরুদ্ধে অপবাদ না দেয়। সে অপবাদের ভয়ে বাবার গৃহদেবতার বাসন মাজা থেকে ফুল তোলার কাজ বড় যত্নের সঙ্গে করত।
কিন্তু মিণ্টু পেটে আসার পরই অতীশ টের পেয়েছিল, নির্মলা যে জগৎ নিয়ে বড় হচ্ছিল, তা থেকে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। সে কেমন জেদি এবং একগুঁয়ে হয়ে যাচ্ছিল—অতীশকে সহ্য করতে পারত না।
সেই নির্মলা যাচ্ছে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে গাঁয়ে শিক্ষয়িত্রী হয়ে। কপালে আর কী দুর্ভোগ আছে সে জানে না। যেন নির্মলা তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, যার এত দায়, তার স্ত্রীর চাকরি না করেই বা উপায় কী! বাবার সংসার, বোনের বিয়ে, ভাইদের মানুষ করা সব তার উপর। কেন বাড়ির বড় পুত্রটির কোনো দায় নেই?
তাকে কি তোমার মা বাবা পেটে ধরে নি? কিছু লিখলেই তোমাকে পাল্টা লিখবে আমি কি তোকে পেটে ধরি নি? বড় হলি কী করে! বৌমাই সব!
বৌমা সব নয় যেমন ঠিক, তেমনি তারাও আর আগের মতো কেউ কাছের নয়। কাছের হলে তারও যে সংসার আছে দুই ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ আছে অন্তত সে কথা মা ভাবত। কেমন তিক্ততা ক্রমে বেড়ে উঠছে। অথচ সে তো দায়িত্বহীন হতে পারে না। ইচ্ছে করলেই বাবার সংসার ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। সেও যেন অপবাদের ভয়েই অস্থির। বিয়ের কবছরের মধ্যেই এত আলগা হয়ে গেল! বাড়ির মা বাবা ভাই বোনের কথা ভুলে গেল!
এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে কীভাবে মুক্তি তাও সে ভাল করে জানে না। কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল।
নির্মলা ঠিক টের পেয়ে গেছে সে ভাল নেই। বলল, কি, কথা বলছ না কেন?
কী বলব!
আমার জন্য ভাববে না। আমি ঠিক থাকতে পারব।
সে কী ভাবছে, আর নির্মলা কী ভেবে যে বলল, আমার জন্য ভাববে না!
অতীশ দেখল ট্রেন শক্তিগড় পার হয়ে চলে যাচ্ছে। উঠতে হয়। দেড় দু-ঘণ্টা হল বাড়ি ছেড়ে এসেছে। ওরা কী করছে কে জানে! টুটুলটা কান্নাকাটি করতে পারে। একমাত্র হাসু ছাড়া অবলম্বন নেই। হাসু ওদের কী ভাবে ভুলিয়ে রাখবে বুঝে উঠতে পারছে না। এত উদ্বেগ সে কখনও বোধ করে নি। কিছুতেই মন থেকে বাসার চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। তার তখনই কেন যেন মনে হল, ধূপবাতিদানটা বাসায় এতক্ষণে কোনো ভূমিকা নিয়ে ফেলেছে। সেই সব সামলাবে। তার এই বিশ্বাসের মূলে কী আছে জানে না, বার বার মনে হচ্ছে যেন ধূপবাতিদানটা শুধু পাথরের পরী নয়, জীবন্ত বিগ্রহ। তার শুভাশুভ সব নির্ভর করছে সেই কল্পিত দেবীর ইচ্ছের উপর। সেখানে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বিরাজ করছে। পাতাবাহারের গাছগুলোতে আর্চির প্রেতাত্মা আর পাথরের মূর্তির মধ্যে তার ঈশ্বর। সে বলতে চাইল ও গড, ফ্রম দ্য ডেপথ অফ ডেসপেয়ার আই ক্রাই ফর ইয়োর হেলপ। হিয়ার মি! আনসার! হেলপ মি!
কোথাও থেকে যেন তখন কে বলছে, ট্রেনের চাকায় সেই কল্পিত দেবী রূপ নিচ্ছে এক অমোঘ ভাষণে—সে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ব্লেসিংস অন অল হু রিভিয়ারস অ্যাণ্ড ট্রাস্ট দ্য গড —অন অল হু ওবে হিম।
তা হলে বাবার কথাই ঠিক! গাছ যেমন শেকড় ছাড়া বাঁচতে পারে না, মানুষও তেমনি ঈশ্বরবিহীন হয়ে পৃথিবীতে বসবাস করতে পারে না। সংসারে এত বেশি পোকামাকড়ের উপদ্রব যে তাকে কারো কাছে আশ্রয় চাইতেই হয়। কে তাকে দিয়ে এমন সব কথা বলাচ্ছে, কে তার হয়ে অভয় দিচ্ছে—বনি? সেই সাদা বোট, নিরুত্তাপ সমুদ্র, কখনও জ্যোৎস্না, কখনও রোদ, আবার ঝড়ে বোট ঢেউয়ের উপর সাদা কর্কের মতো লাফাচ্ছে—বনিই ছিল বোটে তার একমাত্র নারী, একমাত্র প্রেরণা বেঁচে থাকার, অসীম সমুদ্রে সে ডাঙার খোঁজে বোটে পাল তুলে দিয়েছে—সহসা সে চিৎকার করে উঠেছিল, আমি মানি না, আমি ঈশ্বর মানি না, আমি জানি আমি আছি বলে তুমি আছ, এই সমুদ্র, আকাশ নক্ষত্র সব সেই আমি—আমি ছাড়া তার সব অর্থহীন বনি, তুমি আমাকে সংশয়ে ফেলে দিও না। ছুঁড়ে ফেলে দেব সব। আমি শুনতে চাই না, ও লর্ড ফ্রম দ্য ডেপথস অফ ডেসপেয়ার আই ক্রাই ফর ইয়োর হেলপ!
বনির চোখ থেকে জল পড়ত!—ছোটবাবু তুমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছ, কী আজে বাজে বকছ! যেন বলতে চাইত, এই নিথর সমুদ্র পাথরের মতো নিষ্ঠুর। দেখছ না, তার খ্যাপামি! সে কেমন খেপে গিয়ে আমাদের তলিয়ে দিতে চাইছে। ঐ দেখ কে দাঁড়িয়ে।
কে?
দেখতে পাচ্ছ না?
না।
আর্চি! ওফ্ কী ভয়ঙ্কর চোখে তাকাচ্ছে! আমি সহ্য করতে পারছি না।
আমি সমুদ্র ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না বনি। অ্যাণ্ড দ্য স্কর্চিং সান। তুমি কোথায় কি দেখছ! কোথায় সে!
ছোটবাবু, আমরা প্রেতাত্মার প্রভাবে পড়ে যাচ্ছি। ঐ দেখ তারা সব সমুদ্রের অতল থেকে হাত তুলে আমাদের তলিয়ে দিতে চাইছে। আর্চি আর একা নয়—সে সহস্র হয়ে মৃত মানুষের দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ওফ্, কী পচা গন্ধ ছোটবাবু! তুমি তাকে অবিশ্বাস কর না। ব্লেস দ্য লর্ড হু ইজ আওয়ার ইমমেমরেবল রক। হি গিভস আস স্ট্রেনথ অ্যান্ড স্কিল ইন ব্যাটল। হি ইজ অলওয়েজ কাইন্ড অ্যান্ড লাভিং টু আস। হি ইজ আওয়ার ফরট্রেস-আওয়ার টাওয়ার অফ স্ট্রেনথ অ্যান্ড সেফটি। ছোটবাবু তুমি তাকে অবিশ্বাস কর না। আমি আমার জন্য ভাবি না, ছোটবাবু তাকে তুমি অবহেলা দেখালে সারাজীবন কষ্টের মধ্যে থাকবে, উদ্বেগের মধ্যে থাকবে। আমি বাঁচি মরি আসে যায় না, তুমি বেঁচে থাকলেই আমি বেঁচে আছি ভাবব।
এত ভাবতে তুমি আমার জন্য!
অতীশের ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি। নিজেই এখন যেন মজা করে হাসছে। তারপর বলতে চাইছে, উদ্বেগের মধ্যে থাকব কেন। তুমি তো ধূপবাতিদানটায় আশ্রয় নিয়ে আছ। তোমার ধর্ষণকারী আর্টি পাতাবাহারের গাছগুলিতে। আর খুনী ছোটবাবু এখন পরের স্টেশনে নামবে বলে বাংক থেকে তার স্ত্রীর লটবহর নামাচ্ছে। বাসায় ওরা আছে। সামলাবে।
সব দুর্যোগ থেকে আমি জানি তুমি আছ বলে রক্ষা পেয়ে যাব। আর্চির প্রেতাত্মা যতই প্রতিশোধপরায়ণ হোক—আমি জানি তুমি তাদের রক্ষা করবে। বার বার তাই করেছ। আর্চি নানা ছলনায় আমাকে প্রতারণা করতে চাইছে, প্রতিশোধের আশায় নির্মলার উপর ভর করেছিল, মানসিক অবসাদের শিকার—অসুখ বিসুখ রক্তপাত, জরায়ুতে ঘা সব তার কাজ। পারল? হাসপাতালে ছোটাছুটি। নির্মলার জীবন নিয়ে কম টানাহ্যাঁচড়া করে নি! আমি কুলুঙ্গির নীচে দাঁড়িয়ে তার প্রাণভিক্ষা চেয়েছি। সে নিরাময় হয়ে গেল। মিণ্টুকে জলে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিল, পারে নি—তুমি যখন আছ পারবে না। টুটুলের মাথা ফেটে রক্তপাত—অজ্ঞান হয়ে গেল, হাসপাতাল, ইনটেনসিভ কেয়ার – সেই ধস্তাধস্তি, পারল! আমি বুঝি না কে আছেন তোমার, কে সেই গড তোমার জানি না, শুধু জানি, ধূপবাতিদানটায় তুমি আশ্রয় নিয়ে আছ। ঈশ্বর বিশ্বাস করি না করি, তুমি আমার সঙ্গে আছ টের পাই। দ্য লর্ড ইজ ফেয়ার ইন এভরিথিং হি ডাজ—তোমার সেই অমোঘ বিশ্বাসই আমাকে সাহস যোগাচ্ছে—লেট এভরিথিং অ্যালাইভ, গিভ প্রেইজেস টু দ্য লর্ড! ইউ প্রেইজ হিম। আমি তাঁর প্রশংসা করি না করি কিছু আসে যায় না। তোমার গ্রেট হ্যালেলুজা আশা করি তাদের রক্ষা করবে। তোমার বাবার কথাই ঠিক। খুন যখন করেই ফেলেছ তখন ইউ স্যাল হ্যাভ টু সাফার। আজীবন তোমাকে পিঠে ক্রস বহন করে বেড়াতে হবে।
কী এত ভাব বলত!
নির্মলা তার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলল।
কিছু ভাবি না।
ওঠো।
এসে গেছি!
হ্যাঁ।
অতীশ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।
আমার ভয় টুটুল মিণ্টুর জন্য নয়, তোমার জন্য!
আমি আবার কী করলাম!
এত অন্যমনস্ক হয়ে যাও কেন বুঝি না। কী যে হয় তোমার!
অতীশ হাসল—ধর। গুণে দ্যাখ।
ট্রেন থেমে গেছে।
ওরা নেমে আর একবার লটবহর গুণে দেখল। না ঠিকই আছে এক দুই …. সাত। কোথাও কিছু খোয়া যায় নি।
এই কুলি!
কুলি লাগবে না।
এই শীতের সকালেও অতীশ ঘেমে যাচ্ছে। সে ভারি বেডিং আর সুটকেস দু-হাতে তুলে নেবার আগে দুটো ব্যাগ বগলে ঝুলিয়ে বলল, ও তিনটে হালকা আছে। তুমি নাও। কী, পারবে তো?
আমি পারব। তুমি পারবে কি না দ্যাখ। কতটা দূর?
বাইরে চলতো! তারপর দেখা যাবে কতদূর।
দুজনেই স্টেশন থেকে বের হয়ে এল। নির্মলা হাতঘড়ি দেখল। প্রায় এক দেড় ঘণ্টা পর বাস ছাড়বে। কিছু খেয়ে নিলে হয়। রিকশায়ালা বলল, সামনে এগিয়ে যান। কাছেই দোকান
কিছুটা হেঁটে দোকান বাজার চোখে পড়ল। মিষ্টির দোকান। টুল পাতা।
অতীশ বলল, মিহিদানা সীতাভোগ নিচ্ছি। চা খাবে? কলা পাউরুটি কোন ব্যাগে রেখেছ? নির্মলা বলল, আগে জিজ্ঞেস করে নিলে হত না? তারপর কী ভেবে পাশের কাউকে বলল, গুসকরার বাস কটায় ছাড়বে বলতে পারেন?
লোকটি এই সকালে চবর চবর করে পান চিবোচ্ছে। শাড়িতে থুতুর ছিটে আসতে পারে। লোকটির মুখ পানের রসে ভর্তি। হাঁ করে কথা বলছে। হাঁ করে নির্মলাকে দেখছে। এই লোকটার কি কোনো উদ্বেগ নেই? নাও থাকতে পারে। অন্তত তার মতো উদ্বেগে কেউ ভোগে না।
গুসকরার বাস নটা চল্লিশে। নটায় বাস আসবে।
জায়গা পাওয়া যাবে? অতীশ জানতে চাইল।
এখান থেকেই ছাড়বে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়বেন। পেয়ে যাবেন।
কতটা পথ?
তা অনেকটা।
অনেকটা কত? নির্মলা লোকটার কাছ থেকে সব জেনে নিতে চাইছে।
সে তো মেপে বলা যাবে না। দেড় দু-ঘণ্টা লাগে। সময়ের কোনো বালাই নেই। বাবুদের মর্জি। বাদুড়ঝোলা করে ছাড়বে। বাদুড়ঝোলা যত তাড়াতাড়ি হবে বাস তত তাড়াতাড়ি যাবে।
তার মানে?
তার মানে দেড় দু-ঘণ্টা হতে পারে, ঘণ্টা তিনেক হতে পারে। কোনো ঠিকঠাক নেই। বাস খুব কম।
অতীশ দেখছে, নির্মলা যেন বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। শনিবার শনিবার যাওয়া সম্ভব হবে কি হবে না ভেবেই হয় তো মুখটা কালো হয়ে গেছে। সে পুরুষ হলে এক রকম ছিল। সে যুবতী নারী, সে বলল, বিকেলের বাস গুসকরা থেকে কটায়?
চারটায় একটা, সাড়ে পাঁচটায় একটা।
আর বাস নেই?
লোকটি পানের পিক ফেলে আসার জন্য টুল থেকে উঠে গেল। তারপর মুখ হাল্কা করে এসে নির্মলার আরও গা ঘেঁষে দাঁড়াল। নির্মলা একটু সরে দাঁড়িয়ে অতীশকে ইশারায় পাশে ডাকল।
লোকটা কি তার মতো নির্মলার শরীরের গন্ধে পাগল হয়ে উঠছে। তার চেয়ে নির্মলার সঙ্গেই বেশি ভাব করার ইচ্ছে। কথা বলার ইচ্ছে। হাতফাতও দিতে পারে যেন। না দিলেও দেবার ইচ্ছে চোখে মুখে—সেই ভয়েই অতীশের সংলগ্ন হয়ে নির্মলা কথা বলছে বুঝি! নির্মলা টুলের উপর হাতের ভারি ব্যাগটা রেখে বলল, সাড়ে চারটার আগে কোনো বাস নেই?
আছে। দুপুর বারোটায়।
রোদ মুখে এসে পড়ছে বলে ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল নির্মলা। তোলা ঝাঁপের এক পাশে দাঁড়িয়ে র্যাপার খুলে ব্যাগে রাখল। আর কিছু যেন তার জানার নেই। কেমন জলে পড়ে গেছে মতো। নির্মলার চোখ মুখ কাতর দেখাচ্ছে।
বাসা থেকে বের হয়ে বুঝতে পারছে—এ-সত্যি যেন নির্মলার বনবাস। সংসার থেকে এত দূরে পড়ে থাকা কী কষ্টের ভেবে অতীশও দমে গেল। কখন না সে বলে বসে, দরকার নেই কাজের। লেখালেখি ঠিকঠাক করতে পারলে নির্মলার উপার্জনের টাকা সে নিজেই রোজগার করতে পারবে। কিন্তু অতীশের সাহস নেই বলার, নিশ্চিত উপার্জন ছেড়ে এমন অনিশ্চয়তায় কে পা দেয়! নিৰ্মলাই বা রাজি হবে কেন! প্রথম-প্রথম খারাপ লাগবে খুব। পরে সব সয়ে যাবে। নির্মলা যখন মন শক্ত করে থাকতে পারছে—সেই বা পারবে না কেন। সেই তো বলেছে, ঠিক পারব। সেই তো তাকে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে। কাজটা হাত ছাড়া হলে সংসারে আর এক রকমের অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে। বলতে পারে, তুমি চাও না আমি চাকরি করি। বাইরে একা ছেড়ে দিতে তুমি সাহস পাচ্ছ না। যদি আলগা হয়ে যাই। এমনকি সংশয়ের কথাও বলে ফেলতে পারে—তুমি আমাকে সন্দেহ কর।
নির্মলা বলল, নাও।
শালপাতার ঠোঙায় মিহিদানা, সীতাভোগ। বর্ধমানের সীতাভোগ মিহিদানার সুনাম খুব। নির্মলা ব্যাগ থেকে রুটি কলা বের করে বলল বসে খাও না! দাঁড়িয়ে আছ কেন?
সে কেন দাঁড়িয়ে আছে নিজেও জানে না। দাঁড়িয়ে আছে এটা যেন নির্মলাই মনে করিয়ে দিল। সারা রাস্তায় রিকশার প্যাঁক প্যাঁক, মানুষজন ঠাসাঠাসি, কে কখন বসে পড়বে টুলে, অন্তত অন্য কেউ টুলের ফাঁকা জায়গাটায় বসে পড়তে পারে ভেবেই বলা—যা একখানা মানুষ, বসতেও শেখে নি। সুযোগ নিতে শেখে নি। দিনকাল পালটাচ্ছে, মানুষজন দিন দিন সেয়ানা হয়ে উঠছে, যদি বুঝত। অতীশ না বসলে, আর কেউ বসে পড়বে। সকালের জলখাবার এই সময়টাতে সেরে নিতে না পারলে আর সময় পাওয়া যাবে না। তখনই অতীশ দেখল, নির্মলা দূরে কিছু দেখছে।
অতীশ কেমন হিম হয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে। ঠিক টুটুল আর মিণ্টুর বয়সী ভাই বোন গলা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে। হাত পাতছে। শালপাতা উড়ে যাচ্ছিল, ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল। তারপর ভাই বোন মিলে শালপাতাটা চাটছে।
যেখানে যারা দাঁড়িয়ে, যা কিছু খাচ্ছে—হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ভাই বোন।
যা ভাগ!
তবু ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। দিন বাবু, দিন না! একটু দিন। বাবু। এই বাবু দিন না।
ভাইটা, কারো পাঞ্জাবি ধরে টানতে গেলে, তাড়া খাচ্ছে। দৌড়ে পালাচ্ছে। আবার ছুটে এসে ফেলে দেওয়া শালপাতা চাটছে।
নির্মলা ডাকল, এই শোন।
ওরা নির্মলাকে দেখতে পায় নি। মিষ্টির দোকানগুলির চারপাশে ভিড়। সবাই বাসযাত্রী, অথবা ট্রেনযাত্রী। সকালে গরম কচুরি আর মিহিদানা কিংবা দুটো রসগোল্লা খেয়ে এনামেলের গ্লাসে জল খাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে, কেউ ট্রেন ধরবে, বাস ধরবে। আর তারা শালপাতার ওড়াউড়ি দেখছে—খিদের জ্বালা না থাকলে কেউ এভাবে শালপাতার ওড়াউড়ি এত বেশি লক্ষ করে না। নির্মলার দীর্ঘশ্বাস পড়ছে।
ভাইবোন কাছে এসে দাঁড়ালে বলল, তোর দিদি হয়!
না, টেপি।
তোর দিদি হয় না?
না। টেপি।
তোর নাম কী?
মসগুল।
মশগুল আবার নাম হয় নাকি?
তালিমারা ইজের পরনে। শতচ্ছিন্ন। প্যান্টের ফাঁকে সেই উলঙ্গ শিশু, মেয়েটা বসতে গেলে টের পেল, ফ্রকের নীচে তার কোনো প্যান্ট নেই। কেমন নিষ্ঠুর এক পৃথিবী যেন নির্মলাকে গ্রাস করছে।
কী খাবি?
কচুরি খাব। দিবেন মাসি?
এই ভাই। চারটা করে কচুরি দিন না।
অতীশ বুঝতে পারছে, নিরাপত্তা মানুষের কত দরকার। বুঝতে পারছে, বাইরে বের হয়ে নির্মলার কাতর মুখ ক্রমে শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
নির্মলা বলল, আর খাবি?
খাব।
কী খাবি? কচুরি খাব।
এই ভাই আরও চারটা করে দিন।
চার পাশের মানুষ জন নির্মলার কাণ্ডকারখানা দেখে হতবাক। মাথা খারাপ নাকি! এদের কখনও খাইয়ে পেট ভরানো যায়! আরে এরা কোন গ্রহের মানুষ। যেন এই যে দম্পতি দাঁড়িয়ে আছে, তারা শহুরে মানুষজন থেকে একেবারে আলাদা। সবাই নির্মলাকে দেখছে। অতীশের মনে হচ্ছিল বাড়াবাড়ি। কিন্তু পরক্ষণেই টের পায়, নির্মলা আজ যদি এদের খাওয়াতে না পারে, তবে সে আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে।
অতীশ কিছু বলতে পারল না। সে চুপচাপ আর দশজনের মতো নির্মলার বুদ্ধি বিবেচনা এমনই ভাবছে, আর দশজনের মতো মজা উপভোগ করতে পারছে না। সবাই যখন মজা ভেবে, বেশ পুলক বোধ করছে, তখন সে বিচলিত হয়ে বলছে, ও দিকটায় চল। আসলে সে এখন সরে পড়তে চাইছে। তার পৌরুষে ঘা—দগদগে ঘা, সে তার মিণ্টু টুটুলকে ফেলে স্ত্রীকে রেখে আসতে যাচ্ছে—কী কষ্টের যে এটা! নির্মলা পাগলের মতো শুধু খাইয়ে যাচ্ছে। যতবার বলছে, আর কী খাবি, এক কথা, কচুরি খাব।
শুধু কচুরি খাবি কেন, সীতাভোগ, মিহিদানা খা—না কেবল কচুরি চুরি করছে। কচুরির রস শালপাতয় লেগে থাকে না। মিহিদানা সীতাভোগ তারা রোজই খায়—শালপাতা চেটে যখন খায় তখন মিহিদানা সীতাভোগ খাচ্ছে ভাবে। কিন্তু কচুরির রস লেগে থাকে না। তারা কেউ কচুরি খেয়ে শালপাতা ফেলে দিলে ফিরেও তাকায় না।
সে এবার না পেরে বলল, বাস এসে গেছে বোধ হয়।
নির্মলা ওদের সঙ্গে কথা বলছে, কোথায় থাকিস?
এমন সহৃদয় মা মাসি তারা বোধ হয় ইহকালে দেখে নি। নির্মলা যা বলছে আগ্রহের সঙ্গে শুনছে—ঐ দিকে বলে আঙুল তুলে এমন ভাবে দেখাল, যেন, তাদের জন্য একটা দিকই আছে, অন্য কোনো আর দিক নেই। দিকটা পুব না পশ্চিম, উত্তর না দক্ষিণ বোঝার উপায় নেই। মাসির প্রতি তাদের আগ্রহ এত বেশি যে নানা আবদার, এই মাসি জল খাওয়াবি?
এই ভাই, এক গ্লাস জল দিন।
আমিও খাব মাসি। প্রায় যেন নির্মলাকে জড়িয়েই ধরবে ছেলেটা। এক মাথা চুল, কেবল চুলকাচ্ছে দু-হাতে! নোংরা, এবং শরীরে দুর্গন্ধ। নির্মলা সরে পর্যন্ত দাঁড়াল না।
বলল, দাঁড়া। দিচ্ছি।
অতীশ আর পারল না।—তাড়াতাড়ি না গেলে বাসে কিন্তু বসতে পারবে না।
নির্মলা বলল, যাচ্ছি।
অতীশ বেডিং সুটকেস এবং ভারি ব্যাগ দুটো নিয়ে রাস্তার এ পাশে এসে দাঁড়াল। নির্মলার জন্যে অপেক্ষা করা বিপজ্জনক। কারণ সে সরে না গেলে নির্মলার হুঁশ ফিরবে না। সে যেমন ঘোরে পড়ে গেলে, পচা টাকার গন্ধ পায়, চারুর সঙ্গে ট্রেনে সহবাসের দৃশ্য দেখে, কিংবা আরও দূরবর্তী গ্রহে সাদা বোট আর পরীর মতো এক অপ্সরা নারী দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পায়, যেমন আর্চির প্রেতাত্মা গভীর রাতে কুয়াশার মতো অবয়ব ধরে গড়াগড়ি শুরু করে দেয়—করিডর ধরে বের হয়ে গিয়ে পাতাবাহারের গাছপালায় ডালপালায় জল হয়ে লেগে থাকে, এও তেমনি এক ঘোর নির্মলার। মাতৃ স্নেহ। ঘোরের নাম মাতৃস্নেহ—এইসব অভিজ্ঞতার কথা লিখলেই তো গল্প হয়ে যায়। গল্পে টাকা আসে। তার ধারাবাহিক উপন্যাস ‘স্বপ্নের সিঁড়ি ধরে’ পাঠকদের মনে সাড়া ফেলে দিয়েছে। এই অভিজ্ঞতাও গল্পের উপাদান হতে পারে। কারণ অভিজ্ঞতা থেকে যে গল্পের জন্ম লাভ, তাতে জীবনকে যত গভীরভাবে ধরা যায়—বানানো গল্পে তা হয় না।
তারপরই মনে হল, মগজে রক্তপাত শুরু হলেই গল্প তৈরি হয়। সারাজীবন ধরে এই রক্তপাত ভাবতে গিয়ে সে অস্থির হয়ে উঠল। খুঁচিয়ে ঘা করবে, ঘা থেকে পুঁজ রক্ত পড়বে, যন্ত্রণা কত কষ্টদায়ক উপলব্ধি না করতে পারলে গল্প হবে কেন!
সে এখন শরীর ক্ষতবিক্ষত করছে, যেমন সে সেই জাহাজে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে কিংবা তারও আগে সেই গোপাট, অশ্বত্থ গাছ এবং সোনালি বালির নদীর রহস্যময়তায় ডুবে গেলে টের পায়, জীবনের এই সব মালমসলা তার উপন্যাসে ধরা দিলে, জীবনের কোনো গভীর ক্ষত থেকে ঝরা রক্তের গাছ কিংবা নদী আপন মহিমায় জন্মলাভ করবে! নির্মলা তার সেই নদী, মোহনার দিকে যাবার মুখে দু-পাড়ের গাছপালা পাখির নীড় ভেঙে নতুন খাত সৃষ্টি করবে। এক একটি খাত যেন কোনো জোনাকিপোকার জন্মলাভ। জংঘার সন্ধিস্থলে জোনাকি জ্বলছে। যত জ্বলবে তত পুরুষ প্রজ্বলিত হবে। পুরুষ পুড়ে মরবে। কিংবা কোন পুরুষই নারী ছাড়া হাত শক্ত করতে পারে না। শক্ত হাত ভেঙে দিয়ে সে প্লাস্টার লাগাবে। জোড়া লাগলে আবার ভেঙে দেবে। প্লাস্টার খুলে নড়বড়ে হাত যখন অসাড় হয়ে যাবে তখন সে পড়ে থাকবে কোনো নির্জন স্টেশনে।
কেন যে সে একটা নির্জন স্টেশন দেখতে পেল বুঝল না। কোনো গাছের নীচে সে শুয়ে আছে। মানুষজন ভিড় করছে তার চারপাশে। কার লাশ?
কেউ বলতে পারছে না কার লাশ।
এটা কি কোনো আগাম খবর কেউ পৌঁছে দিয়ে গেল তাকে। সে ক্ষত সৃষ্টি করতে করতে একসময় তবে লাশ হয়ে যাবে! নিখোঁজ হয়ে যাবে। গাছের ছায়ায় কোনো মৃতদেহ, কাক উড়ছে!
.
কী হল? ডাকছি, শুনতে পাচ্ছ না?
অঃ যাচ্ছি।
বাসে উঠে নির্মলা তার মালপত্তর গুণতে শুরু করেছে। নির্মলা জানে না এই মাত্র আর্চির প্রেতাত্মা তার গলা টিপে খুন করতে চেয়েছিল। সে অজ্ঞাত কোনো স্টেশনে লাশ হয়ে পড়ে আছে দেখেছে।
দু-ঘণ্টা একটানা বাসে বসে থেকে অতীশের পিঠ ধরে গেছিল। ভাতার বলগনা পার হয়ে রাস্তাটা গুসকরার দিকে গেছে। সোজা গেলে কাটোয়ার দিকে। মার্টিন রেলের ছোট দু-একটা স্টেশন আসার সময় চোখে পড়েছে। সে ট্রেনও দেখেছিল একটা। মাঠের মধ্যে ট্রেনটা কেন দাঁড়িয়ে আছে জানে না। কেউ কেউ নামল, উঠেও গেল। সে নির্মলাকে বলেছিল, আবার যখন আসব ছোট লাইনে আসব। বলগনায় নেমে গুসকরার বাস ধরব। খুব মজা হবে। আসলে অতীশ ছোট রেলে কোনোদিন চড়ে নি। টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে এলে এই ট্রেনে আসার আলাদা কোনো আনন্দ থাকতে পারে—যেন ট্রেনটা ওদের নিয়ে অন্য কোনো নিরুপম পৃথিবীতে ঢুকে যাবে এমনই মনে হয়েছিল তার। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। হাত দেখালেই গাড়ি থামে।
দুজনের কেউ বড় বেশি কথা বলে নি। দু-পাশে শুধু ন্যাড়া মাঠ, শীত চলে যাবার মুখে কোথাও যব গমের খেত—অথবা আলু তোলা হচ্ছে, চাষী মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে, দূরে দূরে গ্রামের ছায়া, গাছপালা চোখে পড়ছে। হেঁটে যাচ্ছে কেউ। নির্মলা জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে। ড্রাইভারের ঠিক পেছনে খাঁচার মত ঘর। ভাড়া বেশি। বাবুমশায়দের জন্য বেশি পয়সায় আলাদা ব্যবস্থা। মালপত্র বাসের ছাদে। শুধু নীল রঙের বটুয়া আর অ্যাটাচি ওদের সঙ্গে। কোনো মাল না খোয়া যায় এই এক দুর্ভাবনা। দু-ঘণ্টা বাসে বসে থাকার অপরিসীম একঘেয়ে কষ্টটাও পীড়া দিচ্ছিল অতীশকে। নির্মলাকে বার বার এভাবে যাওয়া আসা করতে হবে। সারা রাস্তায় কত রকমের দুর্ভোগ পোহাতে হবে কে জানে? রাস্তায় বাস বিকল হয়ে যেতে পারে, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, ট্রেন ছেড়ে দেবার মুখে দৌড়ে উঠতে গেলে যদি কিছু ঘটে যায়—বাড়ি ফেরার তাড়া, ট্রেন মিস করলে পরের ট্রেনে হাওড়ায় যেতে পারবে ঠিক, কিন্তু শেষ বাস ছেড়ে দেবে। তখন কোথায় থাকবে, কি খাবে নির্মলা, একা। যেন নির্বান্ধব নির্মলার সেই অসহায় অবস্থার কথা ভেবে তার ভিতর পীড়ন শুরু হয়ে গেছিল।
নির্মলা সব যেন টের পায়। সে চুপচাপ থাকলেই নির্মলা টের পায়, আবার শুরু হয়েছে। এত দুশ্চিন্তা থাকলে মানুষ বাঁচে! নির্মলা তার হুঁশ ফিরিয়ে আনার জন্যই যেন বলল, বোধহয় এসে গেছি। আমার ব্যাগটা দাও তো। ব্যাগটা অতীশ পাশে রেখে দিয়েছে। এটা খোয়া গেলে সব যাবে। ভিতরে নির্মলার নিয়োগপত্র টাকা-পয়সা সব। টাকা-পয়সা অবশ্য অতীশ কোনো সময়ই এক জায়গায় রাখে না। হিপ পকেটে কিছু টাকা রেখেছে। কিছু খুচরো নোট বুকপকেটে। নির্মলাকে তার বটুয়া এগিয়ে দিলে, খুলে কি দেখল! যেন মিলিয়ে নেওয়া সব ঠিক আছে কিনা। চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ে নিল। চিরুনিটা তাকে দিলে বুঝল, তারও চুল এলোমেলো হাওয়ায় ঠিক নেই! সে নিজের চুল আঁচড়াবার সময়ই কনডাক্টরের হাঁক শুনতে পেল, গোরস্থান, গোরস্থান।
বাসে উঠে আগেই জেনে নিয়েছিল তারা গোরস্থান স্টপে নামলে স্কুল বাড়ি সামনে। স্কুলের দিদিমণি বলে মনেও রেখেছে, নতুন জায়গা, না বলে দিলে তারা চিনে নামতে পারবে না। খাঁচার ভেতরে যে দু-পাঁচজন ভদ্রগোছের মানুষ ছিলেন, তাঁরা আগেই নেমে গেছেন। বলগনা পর্যন্ত বাসটা প্রায় বাদুড়ঝোলা ছিল, তারপরই ফাঁকা হতে শুরু করেছে। দেহাতী মানুষ, হাঁস মুরগি, চালের বস্তা, হাঁড়ি পাতিল বোঝাই হয়ে বাসটা রওনা দিয়েছিল। কিছু আদিবাসী মানুষজন ঝুড়ি বাঁক সমেত উঠেছিল। তারাও নেমে গেছে।
বাসটা থামলে, অতীশ নির্মলা নেমে গেল। বাসের হেলপার ছোকরা সিঁড়ি ধরে ছাদে উঠে গেছে, গুণে গুণে মাল নামিয়ে দিচ্ছে। মালের জন্য আলাদা ভাড়া, সব মিটিয়ে এবার অতীশ দেখতে পেল, যেমন আর দশটা বাস-স্টপের চেহারা হয়ে থাকে গাঁয়েগঞ্জে এও তেমনি। পাঁচ-সাতটা কুঁড়েঘর। মিষ্টি, মনিহারি চায়ের দোকান একপাশে, ও-পাশে বিশাল খোলা মাঠে প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের ছায়া।
গোরস্থান যখন তখন নিশ্চয়ই কোনো কবরখানা আশে-পাশে আছে। কিন্তু তার চিহ্নমাত্র নেই। স্কুলবাড়ি ওটা, না হেলথ সেন্টার তাও নির্মলা কিংবা অতীশ জানে না। ছেলেদের এবং মেয়েদের আলাদা স্কুল। কোনদিকে গেলে কি পাবে জেনে নেওয়া দরকার।
ওদের দেখে চারপাশের লোকজনের কৌতূহলের যেন শেষ নেই। হতেই পারে। হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছে নির্মলা, তার কালো প্যান্ট সাদা শার্ট এবং পায়ে সু। মার্জিত ভদ্রজন দেখলেই কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক।
নির্মলা রুমাল বের করে বলল, মুখটা মুছে নাও। নির্মলার সঙ্গে বের হলে সব সময় সতর্ক নজর। নিজের চেয়ে অতীশ কতটা বেশি সুপুরুষ, এই অহঙ্কার ভিতরে বোধহয় নাড়া দেয়।
একজন বুড়ো মত লোক এগিয়ে এল। কেমন গায়ে পড়া ভাব।—কার বাড়ি যাবেন।
এদিকে কোনো লোকালয় আছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল অতীশের। লোকালয় না থাকলে বাস স্টপ হয় না, এটাও সে জানে। কিন্তু চারপাশে এত নির্জনতা, যেন কোনো ঘুমন্তপুরীতে এসে তারা হাজির। কোনো কোলাহল নেই, নিঝুম। মানুষজন আছে তবে তারা সবাই যেন ভিন্ন গ্রহের
সে বলল, মেয়েদের স্কুলে যাব।
সোজা চলে যান। ডানদিকে ঐ যে দেখছেন হেলথ সেন্টার। পরেই পেয়ে যাবেন।
কাঁচা রাস্তা। গরুর গাড়ি গাছের ছায়ায়—ধান বোঝাই—সার সার সব গরুর গাড়ি জোয়াল নামানো। বড় ধামায় খড়, খোল, ভূষি মেখে জাবনা দিয়েছে। দূরের পথ পাড়ি দেবে, গাড়োয়ান এধার-ওধার কোথাও কোনো দোকানে খুরিতে বোধহয় চা খাচ্ছে।
অতীশের ধারণা ছিল, স্কুলের কেউ বাস স্টপে থাকবে। মালপত্র অনেক। সে ঠিক স্টেশনের মতই ভারি বিছানা এবং ব্যাগ হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকল। কিছু কুচোকাচা বাচ্চা, হাতে পাঁচন, কৌতূহলবশত সঙ্গ নিয়েছে। দুটো একটা ব্যাগও নিতে চেয়েছে। নির্মলা একটা ভারি ব্যাগ ওদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। অতীশকেও বলছে দাও না। কতটা দূর যখন জানি না। অতীশের গ্রাম সম্পর্কে অবশ্য অভিজ্ঞতা আছে, ওদের কাছে এক-দুক্রোশ কোনো দূরত্ব নয়। ঐ তো কাছে, এইসে গেছেন।
তবে এখানে দেখল, না কাছেই। স্কুলবাড়ির তিন দিকে পাঁচিল, সামনে গেট। ঘণ্টা পড়ার শব্দ পেল।
গেটে ঢোকার মুখে ছোট মত একটা ঘর। বারান্দা। সামনে পুকুর। পাড়ে গাছপালার ছায়া। একদিকে খোলা মাঠ। কিছু গরু ছাগল—ডান দিকে প্ল্যাটফরমের মত লম্বা বাড়ি, দরজা জানালা বন্ধ। কেউ মনে হল স্কুলবাড়ি থেকে ছুটে আসছে। বোধহয় খবর পেয়ে গেছে। হস্তদন্ত হয়ে যে মানুষটা এল, তার একটি কাঠের পা। সে এসেই বলল, কলকাতা থেইকে, আজ্ঞে আসুন। সে নিজেই কথা বলে চলছিল।—আপনি নতুন দিদিমণি। এইসে গেছেন তবে। তা বুলছিলাম, এইসে ঠিক যাবেন। কাল এইসে গেলে আজ্ঞে ভাল হত। টানাটানি কইরতে হত না। খবর দিলে কালা ছুইটে যেত।
লোকটা তবে দপ্তরি স্কুলের। নাম কালা। মধ্যবসয়ী মানুষ, গালে বাসি কাঁচাপাকা দাড়ি। হাত পা-লম্বা। রোগা, হাফশার্ট গায়ে। ক্ষারে কাঁচা ধুতি পরনে। খুব বেশি আজ্ঞে আপনি করছে। দু-একজন দিদিমণিও বের হয়ে এসেছে। পুকুরের ও-পাড়ে স্কুলবাড়ি। ক্লাস চলছে। বেশ সবুজ ঘাস মাঠে। একটা দিকে নতুন বাড়ি উঠছে, তার কাজকর্ম আপাতত বন্ধ। দূরে অতীশ দেখল বাঁশবন। কোনো ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে না। হয়ত বাঁশ বন পার হলে লোকালয় শুরু। কিন্তু এই মাঠে দাঁড়িয়ে কিছু বোঝার উপায় নেই।
কালা সেই লম্বা মত প্ল্যাটফরম বাড়িটায় এনে তুলল তাদের। খোপ খোপ পার্টিশন করা ঘর। দরজার তালা খুলে দিলে দেখল, একজনের মত থাকার ব্যবস্থা। দু-পাশে জানালা, দু-পাশেই বারান্দা। ভিতরের দিকের দরজা খুলে দিলে ডানদিকে ছোট এক চিলতে রান্নাঘর। কল বাথরুম খোলা আকাশের নিচে। রাতে বিরাতে দরকারে নির্মলাকে একাই বের হতে হবে। অতীশ আরও গম্ভীর হয়ে গেল।
নির্মলা বলল—আমি আসছি। তুমি বোস। বলে সে কালার সঙ্গে স্কুল অফিসের দিকে চলে গেল। এমন অজ পাড়াগাঁয়ের এত সুন্দর স্কুলবাড়ি দেখা যায় না। সরকারি ব্যাপার। উপজাতি উন্নয়নের খাতে সরকার যে টাকা খরচ করছে, স্কুলবাড়িটা দেখে তা বোঝা যায়। সে জানালা খুলে দিল। তক্তপোশ ঝেড়ে বিছানাটা তার উপর রাখল। দু-পাশের জানালা খুলে দিলে হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল ঠিক, কিন্তু খচ করে একটা কামড় টের পেল ভিতরে। আলো পাখা নেই।
স্কুল চলছে বলে দূর থেকে গুঞ্জন ভেসে আসছে। স্কুল না চললে খাঁ খাঁ করবে। প্ল্যাটফরমের মত লম্বা পার্টিশন করা ঘরে দিদিমণিরা থাকে। নির্মলার কোয়ার্টার রাস্তার ঠিক গায়ে। রাতে জানালা খুলে নির্মলার পক্ষে শোওয়া খুব নিরাপদ হবেও না। পাঁচিল তিনদিকে উঠেছে, একটা দিক ফাঁকা। মাঠের দিকটায় শরবন আছে, কেমন জায়গা, চোর-ছেঁচড়ের উৎপাত থাকতে পারে—তা-ছাড়া নির্মলার লাবণ্য একটু বেশি মাত্রায়। চোখ বড়, চিবুক ভারি, শরীরের গঠন ভারি সুন্দর। খুব পাতলা না ভারিও না—নির্মলা সুনিতম্বিনী এবং সুস্তনী। গাঁয়ে ঢোকার রাস্তার পাশে এই ঘরটা ফাঁকা, মানে, কারো ঘরটা পছন্দ নয়। যে যার মত নিরাপদ দিকটা বেছে নিয়েছে।
অতীশের কপাল ঘামছিল।
নির্মলা একা থাকবে।
একবার ভাবল আরও ত সবাই আছে। নির্মলাই বা পারবে না কেন?
নির্মলার মত কেউ কি পুত্রকন্যা শহরে রেখে এসেছে! জানালা বন্ধ করে শুলে হাওয়া বাতাস পাবে না। জানালা খুলে শুলে, কেউ এসে যদি জানালার অন্ধকারে দাঁড়ায় নির্মলা ত্রাসে পড়ে যাবে। আসলে অতীশ নিজেই ত্রাসের মধ্যে পড়ে গেছে। নির্মলা একবারও এখন পর্যন্ত কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করে নি। কেমন ভিতরে জেদ। তোমার মা বাবা ভাই বোনদের জন্য এত ভাবনা, আমার জন্য না ভাবলেও চলবে। তোমার দিকে তাকানো যায় না। তোমার স্বস্তির জন্যই চাকরিটা নেওয়া। অন্তত তোমার চাকরি যদি নাই থাকে, অতীশ ভাবল, যা অবস্থা কারখানার কবে লাটে উঠবে কে জানে, নির্মলার চাকরিটা স্থায়ী এবং ইচ্ছে করলে এখানে এসেও ওঠা যাবে।
সে আর বসে থাকল না। বিছানাটা খুলে ফেলল। পেছনের দিকের বারান্দায় বের হয়ে চারপাশটা দেখল। পাঁচিলের পরই হেলথ সেন্টার। পাঁচিল সংলগ্ন মাঠ পার হয়ে কিছু ঘরবাড়ি।
ঠিক এ-সময় ও-পাশের বারান্দায় কারা যেন উঠে এল। সে ভিতরের দিকের বারান্দায়। কারা ওখানে। দরজা ছোট। সে মাথা নিচু করে ঢুকল। এবং দেখল মেয়েরা ক্লাস পালিয়ে নতুন দিদিমণির চিড়িয়াটিকে দেখতে এসেছে। তার সংকোচ হচ্ছিল, আবার কেমন বিষাদ, এই মানুষ তার বউকে এমন নির্বান্ধব পুরীতে ফেলে রাখার জন্যে এসেছে। সংকোচ এবং দ্বিধায় সে গুটিয়ে যাচ্ছিল। রোগা শীর্ণকায় সব মেয়ে, দেখতে মোটেও ভাল না। গ্রাম জায়গায় মেয়েদের লাবণ্য ঠিক থাকে না। কেমন রুক্ষ চেহারা অথচ সরল চোখমুখ। সে বুঝতে পারল সংকোচ কাটিয়ে উঠতে না পারলে মেয়েগুলি আরও মজা পাবে। তার এখন বিস্তর কাজ। সর্বত্র ধুলো ময়লা জমা হয়ে আছে, নির্মলা কখন ফিরবে বুঝতে পারছে না। অন্তত, ঘর সাফ-সোফ করে চালে ডালে খিচুড়ির মত করে না নিতে পারলে খিদেয় কষ্ট পাবে। এতসব চিন্তা মাথায়। তবু সে বলল, কারণ এ-সময় স্বাভাবিক থাকা দরকার—সে দেশলাই বের করে একটা সিগারেট ধরাল।
তোমরা এ-স্কুলে পড়?
মেয়েগুলি মুচকি হেসে নিজেদের মধ্যে কি ফিসফাস কথা বলল। তার কথার জবাব দিল না।
ভিতরে এসে বোস না। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন!
কোনো সাড়া পেল না।
অগত্যা সে জানালার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে বলল, তোমার কি নাম?
মেয়েটি বলল, লতা ধর।
কোন ক্লাসে পড়?
সিক্সে পড়ি।
কোন গাঁয়ে থাক?
মসলাপোতা।
বা সুন্দর নাম।
তোমার নাম কি? সে পাশের মেয়েটিকেও একইভাবে একই প্রশ্ন করল। কিভাবে কথা বলা যেতে পারে সে তাও গুলিয়ে ফেলছিল। হঠাৎ কি মনে পড়ায় বলল, কেনাকাটা কোথায় কর।
মেয়েটি বলল, মোড়ে। আমার দাদার মুদির দোকান আছে।
যেন এর চেয়ে বড় বিস্ময়ের খবর মেয়েটির জানা নেই। অতীশ বলল, বা বেশ, তোমার দাদার মুদি দোকান আছে! বল কি!
মাছ টাছ পাওয়া যায়? বাজার বসে।
বাজার বসে না। হুই যে বটগাছটা আছে, ওখানে হাট বসে শনি মঙ্গলবার।
সব পাওয়া যায়?
হুঁ। কাচের চুড়ি কানের দুল সব পাওয়া যায়।
তোমাদের নতুন দিদিমণি কি করছে!
অফিসে বসে আছেন।
সে আসলে নির্মলার ফেরার অপেক্ষায় আছে। প্রথম দিন ক্লাস-টাশ নাও দিতে পারে। সেই কোন সকালে রওনা হয়েছে, চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ, তাড়াতাড়িই ছেড়ে দেবে মনে হয়। না দিলেও কিছু করার নেই, নির্মলা এখন তার শুধু স্ত্রী নয়, মিণ্টু টুটুলের মা নয়, এ-স্কুলের সে নতুন দিদিমণিও। তার সর্বস্ব বলতে নির্মলা টুটুল মিণ্টু। নির্মলার উপর যেন আগেকার অধিকার আর তার নেই। সে ইচ্ছে করলেই বলতে পারে না, যাও দিদিমণিকে ডেকে আন। বলতে পারে না, আমাদের দুজনেরই এখন স্নান খাওয়া দরকার। এত দেরি হলে ওর শরীর খারাপ হতে পারে। কেউ যেন ছিনিয়ে নিচ্ছে নির্মলাকে। অভিমানে সে গুম মেরে গেল। বিস্বাদ লাগছে। কিছু ভাল লাগছে না। একসময় চোখ তুলে দেখল, বারান্দায় কেউ নেই। সব কটা পালিয়েছে। সে নিজের মনেই হাসল। অধিকার সম্পর্কে এত সচেতন থাকলে উচিত ছিল এখানে না আসা। কিন্তু নিরুপায়। মান সম্ভ্রম সবসময় মানুষকে তাড়া করে। নিজের দুটি শিশুর কথা ভাবলে, তাদের ভবিষ্যৎ ভাবলে মান সম্ভ্রমের কথা মনে থাকে না। সে গা ঝাড়া দিয়ে হাতের কাজ সেরে ফেলতে থাকল। ফুলঝাড়ু এনেছে। ঘর পেছনের বারান্দা ঝাড়ু দিল, দেখা না যায় মত আড়ালে যতটা হাতের কাজ সারা যায়, সেরে ফেলল। এক বালতি জল তুলে রান্নাঘরে রাখল। স্টোভে তেল ভরে ফেলল। কেতলিতে জল ফুটিয়ে দুজনের মত দু- কাপ চা, চা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে গরম করে দেওয়া যাবে। তারপর কোন ব্যাগে কি আছে সে জানে। স্টোভে সসপেন বসিয়ে দিল। জল গরম হলে দুটো শুকনো লঙ্কা ছিঁড়ে দিল, হলুদের গুঁড়ো দিয়ে মুসুরির ডাল ফেলে দিল কিছুটা। ডালটা আধসেদ্ধ হলে চাল ছেড়ে দিতে হবে।
বার বার সে বারান্দায় বের হয়ে দেখছে নির্মলা ফিরছে কি না। এত দেরি কেন, সে কিছুটা যেন অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছে। টিফিনের ঘণ্টা পড়লে বোধহয় আসবে। যতবারই সে বের হচ্ছে দেখতে পাচ্ছে, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ছাত্রীরা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে এই কোয়ার্টারের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়ে গেলে ছুটে পালাচ্ছে।
সে ঘর বার হচ্ছে। চাল ছেড়ে দিয়েছে। বেগুন ভাজা করে নিলেই হবে। এক কেজি টিনের গণেশ তেল সঙ্গে এনেছে। দু-হপ্তা চলার মত চাল-ডাল, তবে আজই সে নির্মলাকে মাসের মত বাজার করে দিয়ে যাবে। কাজের লোক পাওয়া কঠিন হবে না। রান্নাবান্না করে দেবে—স্নানের জল তুলে দেবে এবং রাজার হাট করার জন্যও দরকার—এ-সব ভাবার সময়ই দেখল নির্মলা আসছে। সহসা মনটা এত প্রসন্ন হয়ে গেল, যেন সে আগের চেয়ে অনেক বেশি সাহসী হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে আরও দু-তিন জন দিদিমণি, সম্ভবত তাদেরও কৌতূহল হয়েছে, নতুন শিক্ষয়িত্রীর বরটি কেমন দেখতে—কিংবা সে যে সুপুরুষ, এটা বোধহয় চাউর হয়ে গেছে স্কুলে। দেখার বাসনা এজন্য হতে পারে।
এ-সময় কেন জানি মনে হল, সে না এলেই ভাল করত। হাসু নিয়ে এলে কারো এত কৌতূহল জন্মাত না। যেন, এই তবে সেই অপদার্থ লোক, নিজের স্ত্রীকে এতদূরে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। বার বার এই এক কাঁটা ফুটছে গলায়। কাঁটাটা কদিন থেকেই ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে। গলায় আঙুল দিয়ে কাঁটা বের করতে গিয়ে বুঝেছে, যতদিন যাবে, তত দগদগে ঘা করে ছাড়বে।’ সে কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল।
ওরা এসে ওকে হাতজোড় করে নমস্কার করল। সেও করল। কিছুটা যন্ত্রের মত। নির্মলারই বয়সী হতে পারে, বড়ও হতে পারে। সে কথা বলতে পারল না। নির্মলাই বলল, বসুন দিদি। তার দিকে তাকিয়ে বলল, এতসব করার কি দরকার ছিল বুঝি না। সারাটা দিনই ত আছে। আমি এসেই ত বসিয়ে দিতে পারতাম। তুমি আবার সব টানাটানি করতে গেলে কেন।—বসুন দিদি, চা করছি। আরে না না। চা করতে হবে না। অতীশের দিকে তাকিয়ে তাদের একজন বলল, কেমন লাগছে জায়গাটা?
সে বলল, ভাল। খোলামেলা জায়গা। হাওয়া বাতাস আছে। আপনারা এখানে কতদিন?
রমার পাঁচ বছর হয়ে গেল। আমি বছর তিনেক হল এসেছি। শনিবার চলে যাই। কাছেই বাড়ি। কাটোয়ায় আমার দাদারা থাকে।
সে বলল, কোনো উৎপাত নেই ত!
এমনিতে নেই। তবে জায়গাটা ভাল না। মুসলমানদের কবরখানা ছিল একসময়। দেশভাগের পর অনেকেই চলে গেছে। ক্যানেলের পাড় ধরে গেলে, এখনও কয়েক ঘর আছে। পাকা রাস্তা হয়ে যাওয়ায় জায়গাটার দাম বেড়ে গেছে।
তা হলে জায়গাটা একদা কোনো কবরভূমি ছিল। এই কবরভূমির গোটা এলাকা খাস থাকায় এবং পতিত পড়ে থাকায়, সরকার জায়গাটাকে কাজে লাগিয়েছে। মানুষের কবরভূমির উপর স্কুল বাড়ি, হেলথ সেন্টার। পাকা সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে ছেলেদের স্কুল। বাসে যাতায়াত সুবিধা বলে, দূর দূর গ্রাম থেকেও বাসে ছাত্র শিক্ষকরা আসে।
কে জানে এই ঘরের নিচেই কোনো যুবতী নারী শুয়ে আছে কি না। অতীশের এই এক জ্বালা। সামান্য সূত্র আবিষ্কার করলেই মাথার মধ্যে নানারকমের ধন্দ গজিয়ে ওঠে। নির্মলা রাতে একা থাকবে কি করে! যদি ভয় পায়। তবে ওর ঠাকুর দেবতার প্রতি পরম বিশ্বাস। সে কালীঘাটের একটা পটও নিয়ে এসেছে সঙ্গে। এই পট সে কোনও পবিত্র জায়গায় রেখে ফুল জল দেবে। সঙ্গে এনেছে একটি শিবলিঙ্গ। বাবা যে কি ফুসমন্তর কানে দিয়েছে, শুধু শিবের মাথায় রোজ একটি বিল্বপত্র দিলেই সংসার থেকে নাকি সব অশুভ প্রভাব দূর হয়ে যায়। নির্মলার দেব-দেবী নিয়ে সে একসময় কটাক্ষ করতে ছাড়ত না। কিন্তু সেই ধূপবাতিদানটা তাকে এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দেবার পর সে আর নির্মলার দেব-দেবী নিয়ে বিদ্রূপ করে না। কোথায় যে মানুষের কি অবলম্বন থাকে কে জানে!
গরম খিচুড়ি, বেগুন ভাজা—নির্মলা আসন পেতে বলেছে, এস। অতীশের স্নান সারা। নির্মলা কলপাড়ে স্নান সেরে নিয়েছে! কোনো আব্রু নেই। সে জানালায় বসে নির্মলার স্নানের দৃশ্য দেখার সময় উষ্ণ হয়ে উঠেছিল। পায়ের গোড়ালি, খালি ঊরু, এবং পুষ্ট স্তন তাকে লোভে ফেলে দিয়েছে। সে সারাক্ষণ নির্মলাকে কেবল দেখেছে। এই নিরিবিলি কোয়ার্টারে সে আর তার স্ত্রী। যেন প্রকৃতই দুজনের পৃথিবীতে আর কারো জায়গা নেই। নির্মলা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। চোখ মুখ সজীব। সারা পিঠে তার রেশমের মত চুল এবং সুগন্ধ তেলের ঘ্রাণ, কিংবা এও হতে পারে নির্মলা আজ সত্যি যেন পালিয়ে প্রেম করতে এসে ধরা পড়ে গেছে! সে লোভে পড়ে যাচ্ছিল। তর সইছিল না। দু- পাশের জানালা খোলা, কোথা থেকে কে কি দেখে ফেলবে এই ভয়। বড় আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে। অথচ পারছে না। এক কথা, কি হচ্ছে। হাত দিলে, কিংবা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে বলছে, ইস তোমার দেখছি মাথা খারাপ। দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করেছে। হাত ছাড়িয়ে নেবার সময় বলেছে, হবে। এখন না। তুমি এত অধীর কেন বুঝি না। খেয়ে নাও তো।
এক সঙ্গে খাব।
ঠিক আছে, বোস। আমারটাও নিচ্ছি।
নির্মলা সসপেন থেকে নিজের জন্য থালায় খিচুড়ি ঢালছে। এক দণ্ড বসে থাকছে না। এ-ঘর ও-ঘর করছে। আর অজস্র কথা বলে যাচ্ছে—জান, আমাদের জ্যোতিদা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তুমি জ্যোতির্ময়দা বলতে। বাঙাল কাকে বলে। জ্যোতিদা বিকেলে আসবে বলেছে। আমাকে দেখেই অবাক, বলল, তুমি নির্মলা না!
‘তুমি নির্মলা না’, এইসব শব্দমালায় অতীশ অতীতে ডুবে গেলে দেখতে পায়, শিক্ষক শিক্ষণ কলেজের কামিনী ফুল গাছটার নিচে নির্মলা দাঁড়িয়ে আছে। হলুদ পাড়ের শাড়ি, ভরাট সৌন্দর্য সারা গায়ে, যেন টগবগ করে ফুটছে। সে তখন মাথা নিচু করে হেঁটে যেত, দেখত নির্মলাকে দূর থেকে। কিছু বলতে পারত না।
সে খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। নির্মলা ঘর গোছাতে ব্যস্ত। কিছু ফুল তুলে আনল, ছোট্ট একটা টেবিল চেয়ার আছে, ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ঝকঝকে করে তুলল। যেন অতিথি এলে টের না পায় নির্মলার জীবনে কোনো দৈন্য আছে। অতীশের ঘুম এল না। জানালা দরজা বন্ধ করে দিলে, কে কি ভাববে, রুচিবোধের প্রশ্ন নির্মলাকে তাড়া করছে, যেন সুযোগ পেলেই অতীশ পাগলের মত তাকে তছনছ করে দেবে।
নির্মলা মাঝে মাঝে আড়াল থেকে দেখছে অতীশকে। এই এক খেলা আছে, যেন অতীশ একসময় সব ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে বলে থাবা চাটতে থাকবে এবং তার ভিতরও সংলগ্ন হবার বাসনা, সে শরীরের ভিতর আগুন নিয়ে ছটফট করছে। কিন্তু একজন দিদিমণির পক্ষে, স্কুল চলাকালীন, না সে ভাবতে পারছে না। বরং অন্যমনস্ক থাকতে চাইছে। কাজের মধ্যে লেগে থাকলে সে দুর্বল হয়ে পড়বে না। সে দুর্বল হয়ে পড়লে এমনিতেই কাণ্ডজ্ঞান কম মানুষটার, কি করে বসবে কে জানে। সে চায় চারপাশ থেকে সব নিঝুম হয়ে গেলে, অধীর আগ্রহে শরীরের লোমকূপে ঝড় উঠে গেলে তখন যা খুশি কর। বরং সে তখন বলবে, কি করছ, না আর একটু রাখবে। আমাকে জড়িয়ে থাক। সারারাত কেমন। সারারাত আমরা জড়িয়ে থাকব। ইস আবার শুরু করলে, জানি পারবে না। ধুস ভাল্লাগে!
নির্মলা দেখছে অতীশ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ছোট্ট তক্তপোশ। এজনে পাশাপাশি শোবার মত জায়গা হবে না। অথচ সে জানে স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে এই ছোট্ট তক্তপোশই যথেষ্ট। দুজনের মধ্যে কোন ফাঁকা জায়গা থাকলেই ভয়ের। সে অতীশকে জীবনে এই প্রথম এত একান্তে পেয়েছে। সব মেয়েরাই চায়, এবং কি কুক্ষণে যে মাঝে মাঝে টুটুলের মুখ ভেসে উঠছে, যেন মিণ্টু দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কোলে—কি করছে কে জানে, আর আশ্চর্য সন্তানের মুখ ভেসে উঠলে শরীরের সব উষ্ণতা নিমেষে জল হয়ে যায়। বাড়িতে দস্যি দুটো কি করছে কে জানে! মুখ বিমর্ষ হয়ে গেলে অতীশ টের পাবে, সে বাড়ির কথা ভাবছে। দুজনের মধ্যে কথা আছে, কেউ বাসার কথা তুলবে না। তুললেই যেন অতীশের বেড়ানোর আনন্দটা মাটি হয়ে যাবে। অতীশ আসতেই চাইছিল না।
বাবা এসে অতীশকে আর এক বিপাকে ফেলে দিয়ে গেছেন। টুটুলের হাতেখড়ির সময় কি দরকার ছিল বলার, নিজের পুত্রটিকে তিনি ত চেনেন, ভীতু, উৎকণ্ঠার শেষ নেই, তাকে কেন যে বলা, তোমার গ্রহ অবস্থান খারাপ। মৃত্যুযোগ আছে। গ্রহ দোষ খণ্ডনের জন্য তোমার পঞ্চতীর্থকাকাকে সঙ্গে এনেছি। পলা গোমেদ মুনস্টোন ধারণ করিয়ে মৃত্যুযোগ থেকে আত্মরক্ষার পথ বাতলে দিয়ে গেছেন—আর তখনই অতীশের সহসা যে কি হল, বলল, না আমিই যাব, নির্মলা আমাদের তো হনিমুন হয় নি, বিয়ের পরই সংসারে লেপ্টে গেলে, কোথাও আমরা দুজনে যায়নি—এবারে যখন সুযোগ এসে গেল জীবনের হনিমুনটা সেরে ফেলি।
অতীশকে অসহায়ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তার কষ্ট হচ্ছিল। সে নিজেও বোধহয় পারছিল না। যেন এটা নিগ্রহ। সে দরজা জানালা বন্ধ করে অতীশের পাশে শুয়ে বলল, তাড়াতাড়ি। কে এসে আবার ডাকবে।
অতীশ একেবারে দুষ্টু বালকের মত জড়িয়ে ধরল নির্মলাকে। সারামুখে শিশুর মত অবোধ আনন্দ। এবং এক অপার অবগাহন মানুষের মধ্যে থাকে, পবিত্র এই অবগাহনের সময় কোনো সুদূর এক ক্রিয়াকলাপ, মানুষের অভ্যন্তরে বিরাজ করতে থাকলে, প্রকৃতির ফুল ফোটে ফল হয়, বীজ উড়ে যায় আবার কোনো বৃষ্টিপাতের মধ্যে শস্যরোপণের পালা।
অবগাহনের সময় অতীশ টের পায় নারীর কী যে অপার মহিমা! দেবীর মত মুখ চোখ প্ৰসন্ন, কিংবা গভীরে থাকে ফুলের সৌরভ। কোনো অতল সমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে কিছুই মনে থাকে না, ঈশ্বর উপলব্ধির মত, নিরাকার কোনো ব্রহ্মস্বাদ এই অবগাহনে।
অতীশ উঠে পড়লে নির্মলা বলল, এই দাঁড়াও—ইস কি করছ, দরজা খুলছ কেন।
নির্মলার এই সুখটা সে জানে। অবগাহনের পর নির্মলা চোখ বুজে খানিকটা সময় পড়ে থাকতে ভালবাসে। সহবাসের ঘোর তার সহজে কাটতে চায় না। দরজা খোলার আগে অতীশ নিজেই নির্মলার শাড়ি হাঁটুর নিচে টেনে দিল। ঘোরের মধ্যে নির্মলা শুয়ে আছে। এখন আর তার হুঁশ নেই। ধীরে ধীরে যেন তার হুশ ফিরে আসে। তারপর উঠে বসে। শেষে রাথরুমের দিকে চলে যায়।
এখন যেন দুজনেই বড় হালকা, ফুরফুরে শরীর—পারলে পাখা মেলে উড়ে যেতেও পারে। শাড়ি সায়া ছেড়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে এল নির্মলা। সামনের বারান্দার দিকের দরজা খুলে দিল, জানালা খুলে দিল। অতীশকে পাঞ্জাবি বের করে দিয়ে বলল, পর। স্কুলের ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেছে। জ্যোতিদা এসে যাবেন।
নির্মলা খুব দ্রুত সব নোংরা সায়া শাড়ি ধুয়ে এনে বলল, দড়ি টানিয়ে দাও। সায়া শাড়ি থাকল। অতীশ দড়ি টানিয়ে নির্মলার সায়া শাড়ি মেলে দিল। আর নির্মলা চুল আঁচরে মুখে প্রসাধন, পাট ভাঙা লতাপাতা আঁকা শাড়ি পরে অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, পাউডার ঠিক আছে!
আসলে সে সব সময় এটা বলে থাকে। প্রসাধন ধরা পড়ে গেলে নারীর সৌন্দর্যের পক্ষে যেন খুবই অপমান। হালকা প্রসাধন সে পছন্দ করে।
অতীশ বলল, দাঁড়াও। বলে পাফ দিয়ে গালের একটা দিকের পাউডার সামান্য মেজে দিল। বলল, ঠিক আছে। এবং সে দেখতে পেল, গাছপালার পাশ দিয়ে সব ছাত্রীরা যাবার সময় তাদের কোয়ার্টারের দিকে তাকাচ্ছে। আর একটু পরেই পাশের বারান্দা থেকে হাঁক পেল, নির্মলা আমি জ্যোতিদা। তোমার কর্তা কি করছে!
নির্মলা দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলল, আসুন। তিনি ঘরেই আছে।
কি হে অপদার্থ, চিনতে পারছ?
খুবই। কিন্তু কিরণ ত কিছু বলল না। রাইটার্সে কথা হল, তুমি এখানে আছ, কিছুই বলে নি! কিরণ হয় ত ভুলে গেছে। যাক তুমি ভুলে যাও নি দেখছি। মেয়েটাকে ছিনতাই করে নিয়ে গেলে হিম্মত আছে। তোমার ত খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে।
অতীশ জানে জ্যোতিদা এরকমেরই। তাকে নিয়ে জ্যোতিদাদের একটা গর্ব ছিল। জাহাজে সারা পৃথিবী ঘোরা মানুষ তাদের সতীর্থ। আজকাল লিখছে-টিখছে।
তারপর জ্যোতিদা বললেন, ছেলেদের হোস্টেলে থাকি। একবার নির্মলাকে নিয়ে ঘুরে যেও। অনেকদিন হল আছি। জায়গাটা ছেড়ে যেতে পারছি না। কেমন মোহে জড়িয়ে পড়েছি। ব্যাচেলার মানুষকে ত কিছু একটা নিয়ে থাকতে হয়। কি বল!
তা ঠিক।
জ্যোতিদাই বেশি কথা বলছিল। অনেকদিন পর—তা আট ন’বছর বাদে মানুষটার সঙ্গে দেখা। তার চেয়ে পাঁচ-সাত বছরের বড় হবে। ভারি সৌম্য চেহারা। গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরতে ভালবাসে। চুল ব্যাকব্রাশ করা। কমনীয়তা আছে চোখে মুখে। নির্মলা খুব একা হয়ে যাবে ভেবেছিল, কিন্তু একজন পরিচিত মানুষ এই নির্বান্ধব জায়গায় খুবই বড় অবলম্বন।
জ্যেতিদা বলল, কোনো অসুবিধা হলে বলবে। আমরা আছি।
সবাই প্রায় বাইরের। তারপরই অতীশের দিকে তাকিয়ে সহসা প্রশ্ন করে বসল, তোমার নায়কের কাঁধে সব সময় একটা মৃতদেহ রেখে দিয়েছ কেন। সে মৃতদেহ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? একটা লাশ মানুষের কাঁধে থাকলে পচে যাবে না!
জ্যোতিদা তবে তার ‘স্বপ্নের সিঁড়ি ধরে’ ধারাবাহিক উপন্যাসটি পড়ছেন। সে কেন যে একটা পচা লাশ নায়কের কাঁধে ফেলে রেখেছে নিজেও জানে না। সে বলল, এসে গেছে।
এসে গেছে মানে।
ঐ লিখতে লিখতে কে কখন যে কি ভাবে এসে যায় আমি ঠিক বুঝি না। কেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
খুব খুব বিশ্বাসযোগ্য। অসাধারণ পরিবেশ তৈরি করেছ। গা কাঁটা দেয়। লাশটা সে ফেলতে পারছে না। ফেলে দিতে গেলে দেখছে লাশটা শরীরে সেঁটে গেছে। আমরা কি সবাই কোনো লাশ বহন করে থাকি! আমাদের অজ্ঞাতে কাঁধে একটা মৃতদেহ ঝুলছে! তুমি তাই বলতে চাও!
অতীশ নিজেও জানে না, কেন সে একটা মানুষের লাশ ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। আসলে কি সে নিজের বধ্যভূমি কিংবা কোনো বিবেকের তাড়না থেকে এই লাশ বহনকারী কোনো মানুষের ছবি দেখতে পায়! গভীর বিষাদ কি তাকে উন্মাদ করে দেয়! অথবা সেই ঝড়ের সমুদ্রে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড তাকে এখনও পাগলা ঘোড়ার মত ছুটিয়ে মারছে। আর্চির তাড়া থেকে তার বুঝি নিস্তার নেই। এবং তখনই দেখতে পেল, ঝড়ে টালমাটাল জাহাজ, বয়লার-চক বসে গেছে, স্টিম-পাইপে বিস্ফোরণ, ট্রান্সমিশন রুম উড়ে গেছে, সমুদ্র খ্যাপা ষাঁড়ের মত আছড়ে পড়ছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, আলো নেই, সে তার বিশাল থাবা মেলে লাশ গোপনে তুলে নিয়েছে ঘাড়ে। ঝড়ের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলে কেউ টের পাবে না। বনি আগেই দরজা খুলে ছুটে গেছে। ধর্ষণকারী আর্চির লাশ, তার ঘাড়ে। সেই মহাত্রাসের মধ্যে জাহাজীরা যখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত তখন সে বোট-ডেকে উঠে যাচ্ছিল।
লাশটা কি সে সমুদ্রে হারিয়া করে দিতে পেরেছিল! না লাশটা তার ঘাড়ে এখনও দোদুল্যমান। মাথা ঝুলে আছে, হাত পা ঝুলে আছে। অদৃশ্য সেই লাশ সে গোপনে বহন করে চলেছে।
কিরে চুপ করে আছিস কেন! আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস।
নির্মলা স্টোভে চা বসিয়ে দিয়েছে। দুই বন্ধুতে কি কথা হচ্ছে শুনতে পায় নি। ভিতরে এসে দেখল,
তার মানুষটার আবার সেই ঘোর লাগা চোখ। সে এই ঘোর টের পায় চোখ দেখলেই। নির্মলা বলল, এই শুনছ একটু মোড় থেকে ঘুরে এস না।
অতীশ চোখ তুলে তাকাল। কথা বলল না।
নির্মলা বলল, শোনো। বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বলল, মিষ্টি নিয়ে এস।
জ্যোতির্ময় শুনে বলল, কি হচ্ছে, দাঁড়াও। বলে সে ডাকল, কালা, কালা। কালা দৌড়ে এলে টাকা বের করে দিয়ে বলল, গরম সিঙাড়া আনবি। আর ‘মিষ্টি। বাবুর সঙ্গে কতকাল পর দেখা। নির্মলার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ওর লেখা পড়?
সব পড়া হয় না, কেন বলুন ত?
দারুণ। দারুণ।
অতীশ তার লেখার প্রশংসা শুনলে খুশি হয় না। কেবল তার মনে হয়, সে যা লিখতে চায় পারে না। সবাই না বুঝে প্রশংসা করে। এবং ভিতরে আছে এক দাহ, এই দাহ মানুষের মধ্যে নিরন্তর জ্বলছে। এক একজনের এক এক রকমের। যেন যাত্রা কোনো মহাকাল থেকে অন্য কোনো মহাকালে। সবাই রওনা হয়েছে, মাথায় বিস্তর বোঝা।
অতীশ বলল, বাদ দাও, কি সব ছাইপাঁশ লিখছি ও নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। কেমন আছ!
তারপর মিষ্টি চা দুজনে মিলে খেল। কলেজের গল্প, কে কোথায় আছে, জ্যোতির্ময়দা সব খবরই রাখে। এমন কি সে যে কলকাতায় চলে এসেছে সে খবরও রাখে।
তুই কি করছিস! কদিন আছিস!
রাজার এক লজঝড়ে কারখানার ম্যানেজার। কুমারদহ রাজবাটী, বুঝতে পারছ। প্রাসাদের অন্দরের দিকে থাকি। রাজার বিশ্বস্ত আমলা। ভাড়া দিতে হয় না।
আর কে আছে?
ছেলে মেয়ে টুটুল মিণ্টু।
ওরা ত ছোট। একা থাকতে পারবে?
অতীশ কেমন বিপাকে পড়ে গেল। এই একটাই প্রশ্ন সবার। ওরা থাকতে পারবে! সে কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। থাকতে পারবে বললে, মনে করতে পারে অবিবেচক। থাকতে পারবে না বললে, ভাববে, কি দরকার ছিল বউকে চাকরি করানোর! এমন অমানবিক আচরণের জন্য যেন সব দায় তার। তার অক্ষমতাই নির্মলাকে এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। সে কি ভেবে বলল, তোমরা গল্প কর। আমি একটু ঘুরে আসছি। অতীশ বের হয়ে যেতে চাইলে নির্মলা বাধা দিল। বলল, আমিও বের হব। একটু ঘুরে দেখি, জায়গাটা কেমন। নির্মলা জানে, বের হবার নামে কোথাও গিয়ে এখন লুকিয়ে বসে থাকবে। কোনো গাছের ছায়ায় কিংবা মাঠের উপর দিয়ে একা একা হেঁটে যাবে। কখন ফিরবে কেউ বলতে পারবে না। অবোধ বালকের মত নিজের উপরই অজস্র অভিমান, অকারণ ক্ষত- বিক্ষত হওয়ার মধ্যে কি যে সুখ থাকে মানুষটার সে বুঝতে পারে না। শিশুর মত আগলে রাখা দরকার। ভয় টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে নয়, ভয় তার অভিমানী মানুষটাকে নিয়ে
ওরা তিনজনই বের হল ঘুরতে। হাসপাতাল ক্যানেলের ধার জ্যোতিদার হোস্টেল হয়ে ফিরে আসতে রাত হয়ে গেল। সারাদিন খাটুনি গেছে। সকাল সকালই জানালা খোলা রেখে ওরা শুয়ে পড়ল। আর রাতে ঘুমের মধ্যে মনে হল, কেউ যেন ডাকছে। নির্মলা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ঘুমের ঘোরে দরজা ঠেলছে কেউ। ডাকছে, মা মা, দরজা খোল। আমি টুটুল। মা মা!
নির্মলা ধড়ফড় করে উঠে বসল। টেবিল ল্যাম্প জ্বালা। স্তিমিত আলোতে সারা ঘরে কেমন রহস্যময়তা ছড়িয়ে পড়েছে। বাইরে জ্যোৎস্না। এবং কীটপতঙ্গের আওয়াজ দ্রুত ধাবমান অশ্বের মত ছড়িয়ে পড়ছে প্রকৃতির মধ্যে। তার ঘাম হচ্ছিল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, টুটুল দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে নেই। সারাটা দিন, এক চিন্তা, ওরা কি করছে! শুয়ে এক চিন্তা, কান্নাকাটি করছে না তো! কি জানি, যদি সত্যি হয়, সে কিছুতেই নিজেকে অবিশ্বাস করতে পারছে না। যদি কিছু হয়ে গিয়ে থাকে, ভিতরে প্রচণ্ড হাহাকার। সে ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখল সব ফাঁকা। কেউ নেই। কেন এমন শুনল। এখনও কানে বাজছে, মা মা, আমি টুটুল। মা মা দরজা খোল। মা মা! তার শরীর কেমন অবশ হয়ে গেল। দাঁড়াতে পারল না। আমার টুটুল, আমার মিণ্টু—যদি কিছু হয়ে গিয়ে থাকে! তার শরীর কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
অতীশেরও মনে হল, কেউ দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেল। কে সে! দরজা খোলার শব্দ সে স্পষ্ট শুনেছে। উঠে দেখল নির্মলা ঘরে নেই। চারপাশে শুধু জ্যোৎস্না, দূরে শালবনের গভীরে শ্বাপদেরা বুঝি দৌড়ায়। সে চিৎকার করে ডাকতে যাচ্ছিল, নির্মলা, কিন্তু যদি বাথরুমে গিয়ে থাকে। বাইরে বের হতেই দেখল, নির্মলা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। সে ডাকল, এই এখানে কি করছ!
হুঁ। নির্মলা নিজের মধ্যে ফিরে এসেছে। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।
কি হয়েছে তোমার? কি হয়েছে! এত রাতে দরজা খুলে বাইরে বের হয়েছ কেন!
জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না। তুমি কাল সকালেই চলে যাও। আমার জন্য ভাববে না।
কি হয়েছে বলবে ত?
কিচ্ছু হয় নি। ওরা একা রয়েছে আমার বড় খারাপ লাগছে। তুমি ওদের কাছে থাকলে আমি শাস্তি পাব। কালই চলে যাও।
মানুষের বেঁচে থাকার হাজার রকমের বিড়ম্বনা। কেন নির্মলা দরজা খুলে বের হয়ে গেল, নতুন জায়গা, কেউ তাকে অনুসরণ করতে পারে, সে কে! সে কি সেই আর্চি অথবা জীবনের আতঙ্ক, যা সে বয়ে বেড়াচ্ছে! নির্মলা বয়ে বেড়াচ্ছে! সারাজীবন এই অশুভ অনুসরণ কি মানুষ মাত্রেই ভোগ করে! কেমন দুশ্চিন্তায় তার আর ঘুম আসছিল না। একজনের মত তক্তপোশে দুজনে শুয়ে আছে পাশ ফিরে। নির্মলাকে কিছু বললেই এক কথা, ঘুমাও তো। বলছি কিছু না।
কিছু না হলে কেউ দরজা খুলে এত রাতে একা বের হয়ে যায়! অজানা অচেনা জায়গা!
তুমি কি আমাকে ঘুমোতে দেবে না! সেই থেকে এক কথা। কত রাত হল! সকালে উঠতে হবে। সারাদিন দুচোখ মুহূর্তের জন্য এক করতে পারি নি।
না, বলতে হবে, কেন বের হয়ে গেছিলে!
নির্মলা এবার কেমন তরল গলায় বলল, কি সুন্দর জ্যোৎস্না! জানালায় চোখ পড়তেই কেমন লোভ হল একবার দেখি বের হয়ে। জান, জ্যোৎস্নার কোনো গোপন অভিসার আছে। গাছপালার মধ্যে হেঁটে বেড়ালে টের পাওয়া যায়।
তুমি কি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলে!
খারাপ কি। একবার ভাবলাম, তোমাকে ডাকি। দুজনে পুকুরের পাড় দিয়ে হাঁটি। কী মনোরম ভ্রমণ। কী মজা!
অতীশ বিশ্বাস করতে পারছে না। এতই যদি মনোরম ভ্রমণ, তবে সহসা আর্তগলায় বলা কেন, তুমি কালই চলে যেও। তুমি ওদের কাছে থাকলে আমি শান্তি পাব।
এবার অতীশ আর না বলে পারল না, তুমি কিছু গোপন করছ নিমু। তুমি এ-ভাবে আমাকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দিও না। প্লিজ সাত আট বছরে আমরা কেউ কাউকে বুঝি না, ভাবলে ভুল করবে। তুমি কি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছ? কেউ তোমাকে তাড়া করছে!
কী বাজে বকছ বল তো! কে তাড়া করবে! কার এত দায় পড়েছে তাড়া করার। তোমার কষ্ট হয় না, সকালে আবার উঠতে হবে। আমার ভাল লাগে না। বুঝি না ছাই কেন যে দরজা খুলে বারান্দায় বসেছিলাম, টুটুল মিণ্টুর কথা ভাবছিলাম! তুমি ওদের কাছে থাকলে আমি শান্তি পাব, মিছে কি বললাম বুঝি না বাপু!
অতীশ আর কোনো কথা বলল না। নির্মলার স্বভাব সে জানে। কোনো কারণেই সে তার মানুষটাকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিতে চায় না। যাই ঘটুক, খুব যে শুভ নয় সে এটা কেন জানি টের পাচ্ছে। মা-এর মন, কোনো দূরাগত বার্তা সে ঠিক পেয়ে যায়। অতীশ শত চেষ্টা করেও জানতে পারবে না, কেন দরজা খুলে বের হয়ে গেছিল। ছেলেবেলায় নিশি পাওয়ার কথা সে শুনেছে, ঘুমের ঘোরে হেঁটে মানুষ কোথাও দূরে চলে যায়—এ-সব যদি হয়! কিংবা টুটুল মিণ্টুর যদি কিছু হয়, সে পাশ ফিরে পড়ে থাকল। অযথা নির্মলাকে আর ঘাঁটাল না। নড়ল না পর্যন্ত। গলা খুসখুস করছে, খুব সম্ভাৰ্পণে গলা খাঁকারি দিল। এবং বুঝতে পারছে, নির্মলাও শুয়ে আছে মরার মতো। নড়ছে না। পাছে তার মানুষটার ঘুমের ব্যাঘাত হয়—দুজনেই চাইছে, দুজনের সুনিদ্রা হোক
দুজনই চাইছে, কারো দুশ্চিন্তা না থাক।
অথচ দুজনেই পড়ে আছে মড়ার মতো। কে নড়লে কার ঘুম ভাঙবে এই এক আশঙ্কা।
বাইরে সেই জ্যোৎস্না গাছপালায়। নিশুতি রাতের ঝিমঝিম এক অবিরত শব্দমালা ভেসে যাচ্ছে। যেন কূট খেলা চলেছে প্রকৃতির, ঋতুটি শীতের শেষ—জোর হাওয়া তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। দুজনের গায়ে মোটা চাদর। একটাই চাদর, দুজনে গায়ে দিয়েছে, নড়লে চাদরটাও নড়বে—এমন স্তব্ধতা বিরাজ করছে দুজনের মধ্যে।
অতীশের অনিদ্রার রোগ আছে, ঘুম না হলে শরীরের বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু নির্মলার ঘুম না হলে, মাথা ঘোরাবে, চোখ বসে যাবে। গা বমি বমি ভাব, ঘুম না হলে কতরকমের অদ্ভুত সব উপসর্গ দেখা দেয়। অতীশ মনে প্রাণে চাইছে, নির্মলার ঘুম আসুক। নির্মলার ঘুমের জন্যই যেন সে অপেক্ষা করে আছে—নিমু ঘুমলে নিশ্চিন্তি। ঘুমলে যেন বুঝতে পারবে, না কোনো দুঃস্বপ্ন কিংবা অশুভ খবর কেউ নির্মলাকে পৌঁছে দিয়ে যায় নি। জ্যোৎস্না উপভোগের জন্যই বারান্দায় গিয়ে বসেছিল। শীত বসন্তের মাঝামাঝি এই সময়টায় কি বকুল ফুল ফোটে! সে ঠিক মনে করতে পারছে না। নিমুর কোয়ার্টারের পাশে কোথাও কি কোনো বকুল গাছ আছে। সে কেন সহসা বকুল ফুলের ঘ্রাণ পেল! ফুলের ঘ্রাণ কোথা থেকে আসছে জানে না। অতীশ আশ্চর্য সুঘ্রাণে কেমন ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যেতে থাকল। মগজের সহস্র কোষে নানা দুশ্চিন্তার যে বুড়বুড়ি উঠেছিল তা কখন থিতিয়ে গেল! অতীশ ঘুমিয়ে পড়ল।
আর ঘুম ভাঙলে দেখল, নিমুর চান হয়ে গেছে। সে ভিজা চুলে, কালীর পটের সামনে ধূপবাতি জ্বালিয়ে প্রণাম করছে। বড় করে সিঁদুরের ফোঁটা কপালে, কোমরে পড়ে আছে রেশমের মতো চুলের গুচ্ছ। সকাল হয়ে গেছে কখন! এই মনোরম সকালের এক সরল স্নিগ্ধতা আছে। সে প্রায় তাজা যুবকের মতো উঠে বসল। নিমু তার দিকে তাকিয়ে। বলল, চা ফ্লাস্কে করে রেখেছি।
নিমুকে বড় পবিত্র লাগছে। সারা মুখে লাবণ্য, তবু কোথায় সে যেন সামান্য কীটদংশনের জ্বালা অনুভব করছে। অতীশ নিমুকে দেখতে দেখতে কেমন বিহ্বল হয়ে গেল। এই নারী একা হয়ে যাবে সে চলে গেলে। তার কষ্টটা আবার তিরতির করে বুক বেয়ে উঠছে।
সে চা নিয়ে বারান্দায় বের হয়ে দেখল নিমু সকালের জলখাবার করছে। সে বারান্দায় বের হয়ে কোথাও কোনো বকুল ফুলের গাছ দেখতে পেল না। নিমু যদি জানে। সে বলল, নির্মলা, এখানে কোথাও কি বকুল গাছ আছে?
কি করে বলব! সকালবেলায় তোমার বকুল গাছের দরকার পড়ে গেল! তাড়াতাড়ি চানটান করে নাও। সকালের বাস ধরে না গেলে দেরি হয়ে যাবে।
আজই যাব বলছ!
নির্মলা কি বলবে বুঝতে পারল না। নির্মলা খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। যাওয়া দরকার বলতে পারছে না। টুটুল রাতে এসে ডেকেছে। বার বার। সে স্পষ্ট শুনেছে। রাতে এক ফোঁটা ঘুম হয় নি ধরা পড়ে না যায় ভেবে স্নানটান সেরে হালকা প্রসাধনে, মুখের সব আতঙ্কের রেখা মুছে দেবার চেষ্টা করেছে। মানুষটা তাকে ফেলে যেতে চায় না। ভিতরে সে নিজেও ভাল নেই। এ-মুহূর্তে সে প্রায় কিছুটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। বলল, তুমি কী! ওরা একা আছে! ওদের জন্য তোমার চিন্তা হয় না!
আচ্ছা এখানে কোথাও কি কোনো বকুল গাছ নেই তুমি ঠিক জান!
কি করে জানব! সব কি দেখেছি! থাকতে পারে—এই সবিতা, পাশের কোয়ার্টারে সে উঁকি দিয়ে বলল, এখানে বকুল গাছ আছে নাকি রে?
সে দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলল, না নেই তো! কেন, বকুল গাছ দিয়ে কি হবে?
বকুল গাছ দিয়ে কি হয় নির্মলা জানবে কি করে। সে ফিরে এসে দেখল, সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অতীশ চা খাচ্ছে।
রান্নাঘরে ঢুকে যাবার আগে বলল, না কোনো বকুল গাছ নেই। আচ্ছা মানুষ! সকালবেলায় লোকে ঠাকুর দেবতার নাম করে, তিনি বকুল গাছ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি চানে যাবে না! বাসায় পৌঁছে কিন্তু চিঠি দেবে। আর শোনো, ওরা কেমন আছে জানাবে।
সে স্টোভ জ্বেলে বাদাম তেল ছেড়ে দিল।
এই শুনছ!
বল। অতীশ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
আমাদের বাড়িতে ফোন করে দিও।
আমি ফোনটোন করতে পারব না। তুমি যে বললে, ফিরে গিয়ে তোমার কাজের খবরটা দেবে। তুমি দিলে দোষের কি!
দোষের না। তবে আমি পারব না। তোমার বাবা খবরটা পেলেই গুম মেরে যাবেন। অপদার্থ ভাববেন। আমার পক্ষে সম্ভব না। তারপরই বলল, জান, এখানে ঠিক কোথাও বকুল গাছ আছে। জান, আমি টের পেয়েছি এখানে কোথাও বকুল ফুল ফুটে আছে।
টের পেয়েছ বেশ করেছ। এখন দয়া করে চানে যাও। বলেই সে দৌড়ে ঘরে ঢুকে তোয়ালেটা হাতে দিয়ে দিল।—কোন কথা শুনছি না। যাও বলছি। বলে হাত ধরে কলপাড়ে টেনে নিয়ে যেতে চাইল।
দু-দিন থাকব ভাবলাম। হনিমুন হয়ে গেল। এক রাতেই!
নির্মলা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাকে ছাড়া মানুষটা একদণ্ড থাকতে পারে না। পাগলের মতো ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। মাঝে ছুটি নিয়ে মাসখানেকের জন্য দেশে গেছিল। নির্মলা তার বাপের বাড়ি। একা কোথাও গেলে কেমন জলে পড়ে যায়। নির্মলা মুখ ফুটে সব বলতেও পারছে না। বললেই আতঙ্কে পড়ে যাবে। আর এই আতঙ্ক থেকেই মানুষটা কেমন ঘোরে পড়ে যায়। নতুন বিড়ম্বনা। সে শুধু বলল, লক্ষ্মী আমার। আজ সকালের বাসে যাও। আমি তো শনিবার যাচ্ছি। রোববার থেকে সোমবার ব্ল্যাক ডায়মণ্ড ধরব। জ্যোতিদাকে বলে গেলেই হবে। ফিরতে এক-আধ ঘণ্টা দেরি হলেও কিছু বলবেন না।
অতীশ কল থেকে জল পাম্প করছিল। ব্রাশ মুখে। শনিবার যাবে বলছে। কত তারিখ, কত দূরে শনিবার! সে জলের বালতি বার্থরুমে রেখে কী ভেবে বলল, শনিবার তাড়াহুড়ো করে যেতে হবে না।
কেন গেলে কি হবে!
কি হবে জানি না। তবে যাবে না। ট্রেন লেটফেট হলে বাড়ি ফিরবে কি করে!
সে ঠিক ফিরে যাব।
অতীশ গম্ভীর হয়ে গেল। নির্মলা কি জানে না, কি অরাজকতা চলছে। মানুষ দিন-দুপুরে খুন হচ্ছে। এই সেদিন লিলুয়ায় একটি মেয়ের লাশ পাওয়া গেল ট্রেনের ধারে। রোজই দুর্ঘটনার খবর, নকশাল উৎপাতের খবর, ধর্ষণের খবর কাগজের পাতায় এত থাকে যে সে ভাবতেই পারে না, কোন সাহসে নির্মলা এতটা দুঃসাহসী হয়ে উঠতে পারে।
সে ফের বলল, ফিরতে পারবে না বলছি।
নির্মলা কি ভেবে বলল, আচ্ছা যাব না। হল তো! মুখ গোমড়া করে থাকতে পারবে না বলছি। আর শোনো, পার তো টেলিগ্রাম করে দিও। তোমার অফিসের কাছেই পোস্ট অফিস। আসলে নির্মলা যে ভিতরে ঠিকঠাক নেই, জোরজার করে স্বাভাবিক থাকতে চাইছে অতীশকে বুঝতে দিচ্ছে না। যেন আর দশটা দিনের মতোই এই সকাল। অতীশের মৃত্যুযোগ আছে। টুটুলের কুষ্ঠি গণনায় শ্বশুরমশাই তাকে এ-সব জানিয়ে দিয়ে গেছেন। এই এক উচাটন চলছে। অথচ মানুষটা আজ এত স্বাভাবিক যে, সে বুঝতে পারল না কি কারণ। কাল তাকে যে-ভাবে বারান্দায় অসহায় নারীর মতো বসে থাকতে দেখেছে—তাতে ভয় পাবারই কথা। কেবলই মনে হয়েছে, সকাল হলে না আবার বলে, রাখ তোমার চাকরি। ফুটপাথে থাকব, তবু এ ভাবে ফেলে রেখে যেতে পারব না। যা হবার হবে। অজানা অচেনা জায়গায় রাতে এভাবে একা কেউ বের হয়!
নিজের জন্য যা হয় কিছু ফুটিয়ে নেওয়া যাবে। তাড়াতাড়ি রওনা করিয়ে দেওয়া দরকার। লুচি বেগুনভাজা দুটো মিষ্টি থালায় সাজিয়ে সে ভিতরে ঢুকে অবাক। বাবু শুয়ে শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে একটা কি বই পড়ছে। সঙ্গে সব বই রাখার স্বভাব। মাথাটা কেমন উত্তপ্ত হয়ে গেল। কি বে- আক্কেলে মানুষ! কিছু বলতেও পারছে না। থালা হাতে দিয়ে সে নিজেই অতীশের অ্যাটাচি খুলে ফেলল। গোছগাছ করে দিতে হবে। কিছু পড়ে থাকলেও ক্ষতি নেই। এমন কিছু দরকারি জিনিস নিয়েও আসে নি।
এ কি, তোমারটা কই?
আমি পরে খেয়ে নেব।
না একসঙ্গে খাব।
আচ্ছা তুমি কী! দেরি করছ কেন? এখন বই পড়ার সময়! বেলা হচ্ছে না! আটটায় বাস। আমাকে তোমরা একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না!
কী সুন্দর লাগছে তোমাকে।
আমার মাথা।
আজ থেকে গেলে কি হত বলত! আর একটা দিন থাকি। হাসু আছে, সুখী আছে। দুমবার, কুম্ভবাবুর স্ত্রী সবাই তো জানে, উকিলবাবু তো বললেন, যান কোনো চিন্তা করবেন না। রাজার বাড়ি, বাইরেও বের হতে পারবে না। গেটে সাদেক-আলি, দু-একদিন থেকে যাই। তারপর কি ভেবে বলল—আচ্ছা আমার এটা হয় কেন বল তো?
ডান-হাতে বই, বাঁ-হাতে থালা। বইটা রেখে কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, কাছে এস না।
না।
এস না। বকুল ফুলের ঘ্রাণ তোমার শরীরে। একটু শুঁকে দেখি না। মাঝে মাঝে আজকাল কার সুঘ্রাণে মজে যাই বুঝি না।
না, এখন না।
শুঁকে দেখব, তাতেও রাগ!
নির্মলা বুঝতে পারে, মানুষটার কি ইচ্ছে। সে প্রসন্ন থাকলে, ইহজগতে মানুষটা যেন আর কিছু চায় না। রাজ্যের দুশ্চিন্তা মুহূর্তে মাথা থেকে উবে যায়। জীবনের এই সুষমা মানুষটাকে পাগল করে দেয়। সময় অসময় নেই আবদার। সবসময় ভাল লাগে!
অথচ সে আজ রূঢ় আচরণও করতে পারছে না। বলতে পারছে না, আমার শরীর ভাল নেই। তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও। এই সামান্য কথাই লোকটার উত্তপ্ত মগজে এমন ঠাণ্ডা বরফ ঢেলে দেবে যে গুম মেরে যাবে। কথা বলবে না। চুপচাপ জানালায় সরে গিয়ে গাছপালা মাঠ দেখতে দেখতে দূরাতীত কোনো দৃশ্যের মধ্যে যেন ডুবে যায়। সে কি সেই নারী, নাম বনি বলেছে, বনি কে সে জানে না। শ্বশুরমশাই বার বার সতর্ক করে দিতেন, বৌমা তুমি ওর জাহাজের জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে যেও না। হিতে বিপরীত হবে। আমি দু-একবার করে ভুগেছি। তোমার ভোগান্তি হোক আমি চাই না।
সাত আট বছর হয়ে গেল, সে কোনো দিন জানতে চায় নি, জাহাজ তোমার নিখোঁজ হয়ে গেল, তুমি ফিরে এলে কি করে? কাগজের লোকও নাকি হেরে গেছে তোমার কাছে। তুমি কিছুই বলনি কাগজের লোক এলেই তুমি দেখা করতে চাইতে না।কথা বলতে না। তাদের অজস্র প্রশ্ন এক কান দিয়ে ঢুকেছে, আর এক কান দিয়ে বের হয়ে গেছে। অস্বাভাবিক আচরণও করেছ। একবার উৎক্ষিপ্ত হয়ে, কাগজের লোককে ঠেঙাতে পর্যন্ত গেছিলে। এ-সব সে শুনেছে, অলকার কাছে। হাসু ভানুর কাছে। দুই ভাই তখন সারাক্ষণ পালা করে পাহারা দিত এমনও শুনেছে।
সব কিছু খোলামেলা, দরজা জানালা সব। সকালের রোদ জানালায়। পাঁচিলের দিকের জানালাও খোলা। পাখ-পাখালি উড়ে এসেছে। সবিতার কাজের মেয়েটাও চলে আসবে যে কোনো সময়। সে যে কি করে! এমন আবদার, তার শরীরের জন্য এত টান, কিংবা কোনো ফুল ফোটার আকর্ষণ যেন, শিশিরপাত, আবার ঝলমলে রোদে পরিচ্ছন্ন আকাশ কিংবা সবুজ ঘাসের নরম সুষমা মানুষটাকে সে ক্রীতদাসের চেয়ে অধম করে রেখেছে। সে নিজেও কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছিল। কি করবে বুঝতে পারছে না। সে অসহায়ের মতো রান্নাঘরে ঢুকে বসে থাকল। আর দেখল অতীশের ছায়া দরজায় কাণ্ডজ্ঞানের বড় অভাব। সে উঠে দাঁড়াল। বলল, লক্ষ্মী, জামা কাপড় পালটে নাও। দেরি কর না। প্লিজ।
তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ!
তাড়িয়ে দিচ্ছি! আমি তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি! তোমাকে তাড়াতে না পারলে যে আমার সুখ নেই তুমি আমার কত বড় শত্রু, কেন কেন তুমি যাচ্ছ না। শরীর ছাড়া তুমি কিছু বোঝো না। টুটুলের যদি কিছু হয়, আমি তোমাকে ক্ষমা করব না! বলে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।
আরে! এই নিমু। তুমি এমন করছ কেন। কি হয়েছে!
কাল রাতে টুটুল এসে ডেকেছে, মা দরজা খোল। মা মা! দরজা খুলে দেখি কেউ নেই। ফাঁকা। আমি যে কী করব! অতীশের মুখটা কালো হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে ঢুকে গেল ঘরে। দ্রুত জামা প্যান্ট পরে বলল, আমি যাচ্ছি নিমু, সাবধানে থেকো। গিয়েই টেলিগ্রাম করে দেব। রাতে একা বের হবে না। কার মনে কী আছে কে জানে!
নির্মলা নিজেকে যেন কিছুটা ফিরে পেয়েছে। সে এটা কি করল! কেন বলতে গেল, টুটুল দরজায় এসে ডেকেছে, মা মা, দরজা খোল।
সে দেখল, পাগলের মতো বাস স্ট্যাণ্ডের দিকে অতীশ ছুটছে। একবার তার কোয়ার্টারের দিকে ফিরেও তাকায় নি। কেমন সম্বিত হারিয়ে ছুটছে।
নির্মলা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে আশ্চর্য শূন্যতা কুয়াশার মতো অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিছু যেন দেখছে না। কি সুন্দর রোদ, সবুজ নরম ঘাস মাঠে, ছাতিমের ছায়া, পাখিরা উড়ে যাচ্ছে, রাস্তায় গরুর গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছে তার শব্দ—এবং বিড়ালের চোখের মতো সতর্কতা প্রকৃতির—সে কিছুই দেখছে না। ভোরের নরম ঠাণ্ডা হাওয়ায় চুল উড়ছে ফুরফুর করে—দীর্ঘাঙ্গী যুবতীর চোখে জলের দাগ—তার প্রিয়জন কিছু মুখে না দিয়ে ছুটে গেছে। সে এত একা নিঃসঙ্গ—তার কেবল বুক ঠেলে কান্না উঠে আসছে। এমন কি ঘরের ভেতর চোখ ফেরাতে পারছে না। খাবারের থালার লুচি বেগুন ভাজা পড়ে আছে। কিছু মুখে না দিয়ে বের হয়ে গেল!
এখন সে কি করবে বুঝতে পারছে না। সব উদ্যম যেন নিঃশেষ। সে স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। কোনো রকমে তক্তপোশে এসে বসল। বসেই থাকল। জানালায় চোখ। বোধ হয় বাসে উঠে যে যাবার সে চলে গেছে। টাকা পয়সা সঙ্গে নিয়েছে তো!
সে আঁচল দিয়ে মুখ মুছল। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। তার ভিতরের কষ্টটা যাচ্ছে না। তার তো কিছু করারও নেই! ব্যস্ততারও কিছু নেই। সে শুয়ে পড়ল। ঘরের দরজা খোলা, রান্নাঘর খোলা, বেলা বাড়ছে, রোদ জানালা থেকে সরে যাচ্ছে কিছুই খেয়াল নেই যেন।
শুয়েও শাস্তি পেল না। ছটফট করছে। উঠে বসল ফের। থালাটা রান্না ঘরে নিয়ে গেল। কিছু আর করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এই খেয়ে স্কুলে চলে যাবে। একার জন্য জীবনে বুঝি কোনো ভাবনা থাকে না। একা হয়ে যাওয়া জীবনে কত বড় শাস্তি আজ সে প্রথম টের পেল।