1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ২৬

।। ছাব্বিশ।।

চন্দ্রনাথ শেষরাতের দিকে ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন দেখলেন। কোথাও ঢাক ঢোল বাজছে। ধূপদীপের গন্ধ। মুন্ডমালা গলায় মহামায়া। তাঁর পায়ের কাছে চন্দ্রনাথ মৃগাসনে বসে। হোম হচ্ছে। প্রজ্বলিত হুতাশনে তিনি দেখলেন যজ্ঞের হবি জ্বলছে। তারপর দেখলেন, সেই হবি আর হবি নেই। মানুষের কাটামুন্ডু হয়ে গেছে। এবং অগ্নির মধ্যে সেই মুন্ডু বাপের সঙ্গে তর্ক করার জন্য পিটপিট করে তাকাচ্ছে। তিনি বললেন, এই হুতাশনে তোঁমার অবস্থান কেন?

কাটামুন্ডু বলল, এত যে মন্ত্রপাঠ করলেন, দেবী কি আপনার প্রতি প্রসন্না হয়েছেন?

তিনি বললেন, দেখ অতীশ, তোমাকে এ অবস্থায় আমি দেখব আশা করি নি।

কাটামুন্ডু হেসে বলল, বলিদান কখন হবে?

—এক্ষুনি।

—কটি ছাগ শিশু?

—তা দেখতে হবে। বহু পুণ্যার্থী এসেছে।

—তাদের বিশ্বাস বলিদান হলেই মুক্তি। জরা ব্যাধি মৃত্যু থাকবে না।

তিনি বুঝতে পারলেন, অতীশ তাঁর ঈশ্বরপ্রীতির প্রতি কটাক্ষ করছে। হুতাশনে থাকলে এমনই হবার কথা। তিনি একটা অতিকায় চিমটা দিয়ে যজ্ঞের প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে কাটামুন্ডুটি তুলে আনলেন। ঝলসে গেছে নাক মুখ। ফোসকা চামসে গন্ধ। তারপর গঙ্গাজল ছিটিয়ে ওম মন্ত্র উচ্চারণ করতেই দেখলেন, অতীশ দীপঙ্কর অথবা সোনা। সোনা মাঠ পার হয়ে ছুটে যাচ্ছে। সেই মোষ বলির দিনে যেমন অতীশ ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকত তেমনি, জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

তিনি তরমুজের জমি পার হয়ে ডাকলেন, সোনা।

কোথাও কেউ সাড়া দিচ্ছে না। চারপাশে বাস্তুপূজা হচ্ছে। মেষ বলি মোষ বলি হচ্ছে। আতপ চালে ডালে খিচুড়ি, পায়েসের গন্ধ। তিনি সব ফেলে ছুটছেন। অবোধ এই বালকটিকে এক্ষুনি ধরে আনা দরকার। তাঁর ঈশ্বরপ্রীতির প্রতি কটাক্ষ করার অর্থই হচ্ছে মহামায়ার প্রতি কটাক্ষ। তিনি বিরূপ হলে সংসার অসার অর্থহীন। কিন্তু ডেকে ডেকেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নিজে এবার গভীর বনের মধ্যে ঢুকে গেলেন। ঢুকে যেতেই বনটা কেমন অদৃশ্য হয়ে বড় এক দীঘি হয়ে গেল। দীঘির পাড়ে প্রাচীন সব মন্দির। মন্দিরের দরজা বন্ধ! কতকাল কেউ পূজা দেয় নি। তখনই দেখলেন সোনা পায়ে পায়ে হাঁটছে। মাথায় ঝুড়ি। বিশ্বপত্র, গাঁদাফুল চন্দনের গন্ধ মাথায় করে বাপের সঙ্গে পূজা দিতে যাচ্ছে। পিতাপুত্র মন্দিরের সামনে হাজির। দরজা খুলে গেল। মহারোষে মহামায়া তাকিয়ে আছেন। পূজা চাই। দীঘিতে দু’জনই স্নান সেরে উঠলে দেখলেন হাজার লক্ষ পুণ্যার্থী। তারা তাঁকে খুঁজছে। তিনি মহাপূজা সাঙ্গ না করেই ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছেন। করজোড়ে সেই পুণ্যার্থীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, পূজার প্রকৃষ্ট জায়গা দেবীর এই মন্দির। আপনারা দীঘির ঘাটে অবগাহন করুন। মেষ মোষ বলি প্রদত্ত যা আছে সব পবিত্র করে নিন। দীঘি তখন দীঘিও নেই। এক স্রোতস্বিনী নদী হয়ে গেছে। বিরাট বিশালকায় নদীর গর্ভে প্রকান্ড বালিচর। তাঁবু পড়েছে হাজার হাজার। তিনি প্রায় একজন কাপালিকের মতো ক্রমে আরও প্রবল হয়ে যাচ্ছিলেন। অতিকায় তার শরীর আকাশ ছুঁয়ে দিচ্ছে। যূপকাষ্ঠে বলি শুরু হয়ে গেছে। এবং বলির সময় উৎসর্গ করতে গিয়ে দেখলেন, যূপকাষ্ঠে অতীশ নামক এক বেয়াদপ ছোকরা গলা বাড়িয়ে আছে। মনের ভুল ভেবে, তিনি উচ্চারণ করলেন, একে ছেড়ে দাও, অপবিত্র পশু। বলিদানে বিঘ্ন ঘটতে পারে। পরে আর একটি। এ-ভাবে যতই যূপকাষ্টে বলি প্রদত্ত প্রাণীকুলকে নিয়ে আসছে ততই তিনি বিস্মিত। হাড়িকাঠে গলা দিয়ে সে আর পশু থাকে না। তাঁর জাতক হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারলেন, দেবীর এমনই ইচ্ছে। তিনি আর না পেরে আজ সেই মহাবলিদান সমাপন করলেন। অতীশ বলি প্রদত্ত এক জীব হয়ে গেল। অথচ পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সোনা। গলায় যজ্ঞোপবীত। মাথায় বিল্বপত্র। তিনি ফের ওম মন্ত্র উচ্চারণ করতেই সব সাফ হয়ে গেল এবং ঘুম ভেঙে গেল তাঁর!

ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসলেন চন্দ্রনাথ। গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে তাঁর। দুর্গা দুর্গা বলে তিনি প্রথম আর্তনাদ করে উঠলেন। শেষ রাতের স্বপ্ন। কোথাও সংসারে বড় অমঙ্গলের চিহ্ন প্রকট হয়ে উঠছে। বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি খড়ম পায়ে বের হতেই ধনবৌ দরজা খোলার শব্দ পেল। বয়স যত বাড়ছে, মানুষটার তত অস্বস্তি বাড়ছে। অতীশের চিঠি না পেলে এটা আরও বেশি হয়। ধনবৌ পাশের তক্তপোশ থেকে বলল, নিজেও ঘুমোও না, আমাদেরও ঘুমাতে দাও না।

আজ রাতে চন্দ্রনাথ এই নিয়ে তিনবার দরজা খুলেছেন। দরজা খুললেই শব্দ হয়। বয়স বাড়ার জন্য ধনবৌর ঘুম পাতলা। বার বার ঘুম ভেঙে গেলে কার না রাগ হয়। রোজই ভাবেন, দক্ষিণের ঘরে এবার থেকে একা শোবেন। শেষ পর্যন্ত আর হয় না। চোখে মুখে দুশ্চিন্তা, অতীশটা কেমন আছে, টুটুল মিণ্টু। বৌমার শরীর ভাল যাচ্ছে না। কারো, কিছু যদি বিপদ হয়ে থাকে।

ধনবৌর কথা গ্রাহ্য করলেন না চন্দ্রনাথ। উঠোনে নেমে প্রথমে আকাশ দেখলেন। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের আবছা অন্ধকার। গাছের ছায়া বাড়িটাকে আরও অস্পষ্ট আঁধারে ডুবিয়ে রেখেছে। কিছু জোনাকি পোকা উড়ছিল। সামনে ঠাকুরঘর। চন্দ্রনাথ দরজা খুলে প্রণিপাত হলেন। বললেন, ঠাকুর এমন দেখলাম কেন? অতীশের কি কিছু হয়েছে? বৌমার! আরও সব কথাবার্তা চলল গৃহদেবতার সঙ্গে। এবং মনে হল, এ-সময়ে গঙ্গাস্নানে যাওয়াই তাঁর প্রাথমিক কর্তব্য। নদী, ফুল ফল এবং বৃক্ষের সঙ্গে কথা বলা দরকার। তিনি বারান্দায় উঠে হাতে লাঠি নিলেন, লন্ঠন নিলেন। তাঁকে এখন বের হয়ে পড়তে হবে। রাস্তায় যেতে যেতে সব গাছপালা বৃক্ষকে আকাশকে এবং নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে স্রোতস্বিনীকে এই দুঃস্বপ্নের কথা বললে, স্বপ্নের কুফল দূরীভূত হবে।

ধনবৌ বিছানা থেকে উঠে পড়ল। বাইরে এসে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

—গঙ্গাস্নানে।

ধনবৌ ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে গেল।—সময় অসময় নেই!

—কুপিত হবে না। যেতে যেতে সকাল হয়ে যাবে।

ধনবৌ কাছে থাকলেই নানারকম অনুযোগ শুনতে হবে। তিনি তাড়াতাড়ি একটু তামাকু সেবন করে বের হয়ে গেলেন। বাড়ির আর কেউ জেগে নেই। কুকুর দুটো এখন চন্দ্রনাথের সঙ্গী। ধনবৌ নানারকম প্রশ্ন করবে ভয়েই তিনি যেন দ্রুত পালাচ্ছেন। কি জানি পাছে দুর্বল মুহূর্তে স্বপ্নের কথা ফাঁস করে দেন। তাহলে নির্ঘাত স্বপ্ন ফলে যাবে।

চন্দ্রনাথ রাস্তায় এসে আর একবার ব্যাগটা হাতড়ে দেখলেন। গামছা ধুতি সবই আছে। তিল তুলসী নিয়েছেন সঙ্গে। নাইজলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করবেন। সূর্যার্য্য দেবেন। পিতৃপুরুষের শুভাশুভই তাঁর জাতককে রক্ষা করবে। এমন বোধে তিনি প্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন। হাঁটছিলেন। বিশ্বচরাচর প্রায় নিস্তব্ধ। বড় রাস্তায় উঠে তিনি দেখলেন, কুকুর দুটো পেছনে তেমনি আসছে। তাদের সঙ্গেই কিছুক্ষণ আলাপ করা যেতে পারে। দুঃস্বপ্নের ভয় থেকে আপাতত তিনি অব্যাহতি পেতে চান। এমন একটা অদ্ভুত নৃশংস স্বপ্ন তিনি দেখলেনই বা কেন। পুত্রের ওপর কি অবিশ্বাস জন্মাচ্ছিল। আগে তো তিনি এমন ছিলেন না। যত বয়স বাড়ছে অল্পতেই ঘাবড়ে যান। নিরাপত্তাবোধে তিনি কি ইদানীং বিপর্যস্ত হচ্ছিলেন। পুত্রের অশুভ-কামনা করেছেন! তাঁর অন্তরাত্মা কেমন আর্তনাদ করে উঠল। বড় পুত্র সতীশের জন্য তাঁর দুর্ভাবনা হয় না কেন! সে কি সর্বতোভাবে আলগা হয়ে গেছে বলে। অধিকার রক্ষার আর এতটুকু সুযোগ নেই বলে! মেজটিরও কি তাই ইচ্ছে। দু-বছরের ওপর দেখা নেই। মাসান্তে টাকা পাঠিয়ে সে কি শুধু কর্তব্য পালন করে যাচ্ছে! নাড়ির টান তাহলে নেই! ভেতরে চন্দ্রনাথের টান ধরে গেল।

অনেককাল আগে তিনি এক দীর্ঘপথে পরিভ্রমণে বের হয়েছেন মনে হল। সেই জন্মকাল থেকে ইহকাল পার হয়ে পরকালের দিকে হাঁটা দিয়েছেন যেন। বয়স যত বাড়ছে ঈশ্বরভীতি তত বাড়ছে। একটুতেই মনে হয় তাঁর ঈশ্বর বুঝি ক্ষুব্ধ হলেন। সব কিছু ঠিকঠাক রেখে যেতে হলে তাঁর অপার করুণাই সম্বল। তিনি হাঁটছিলেন আর নক্ষত্রের শেষ আলোকিত রহস্যে উদ্ভাসিত হচ্ছিলেন। এই রাস্তায় এলেই দু’পাশে দিগন্ত প্রসারিত মাঠ পড়ে থাকে! গাছপালার ছায়ায় দু-এক ঘর সাঁওতাল পরিবারের বাস। রেল লাইন পার হলেই শহর আরম্ভ। জলের ট্যাঙ্ক পার হয়ে সদর জেলের পাঁচিল ঘেঁষে যেতে হয়। তারপর বাবলার ঘন বন। নদীর চড়া। এবং নেমে গেলে সেই পবিত্র জলধি। শত শত বর্ষের গ্লানি জননী জাহ্নবী বুকে শুষে নিচ্ছেন। তাঁর এখন জননী জাহ্নবীই অবলম্বন। সেখানে তিনি স্নান করলেন। কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গা বললেন। এহি সূর্য সংস্রাংশ তেজোরাশে জগৎপতে বললেন এবং বলে ডুব দেওয়ামাত্র কিছুটা হাল্কা হলেন। সেই দুশ্চিন্তার ভার তাঁর অনেকটা লাঘব হওয়াতেই তিনি কুকুর দুটোকে দেখতে পেলেন। পাড়ে তারা বসে আছে। এতক্ষণ এরা তাঁর পেছনে পেছনে এতদূর এসেছে ভুলেই গেছিলেন। শহরের মাথায় সূর্য উঠে গেছে। কিছুটা উঠে এলেই বিন্নির খৈ বাতাসা পাওয়া যায়। কিছু বিন্নির খৈ বাতাসা কিনে আজ তিনি কুকুর ভোজন করালেন। মনের মধ্যে মানুষের কৃত যে জটিল বিশ্বাস অবিশ্বাস থাকে! কুকুরের আহার হয়ে যাওয়ার পর তিনি সামান্য প্রসন্নবোধ করলেন। যেন কিছুই হয়নি। পুণ্যকর্মই মানুষকে সব পাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তাকে দীর্ঘজীবী করে। পুত্রের হয়ে আজ চন্দ্রনাথ প্রায়শ্চিত্ত করলেন ঈশ্বরের কাছে। কারণ কুকুর দুটো তাঁর কাছে আর জন্তুর শামিল নয়। যেন সাক্ষাৎ ধর্মরাজ তাঁর সামনে হাজির।

কুকুর দুটির নাম ধরে এবারে ডাকলেন। বললেন, এস। পায়ে পায়ে আবার তারা চন্দ্রনাথকে অনুসরণ করতে থাকল। পথে বড় বৃক্ষ দেখলেই তিনি থেমে যান। জল ঢালেন এবং স্বপ্নের আদ্যোপান্ত বলে যান। এই করে বাড়ি ফিরতে চন্দ্রনাথের বেশ বেলা হল। বাড়ি ফিরেই ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন, রান্নাঘরে কারো গলা পাওয়া যাচ্ছে। অতীশের গলা। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না। বাবার খড়মের শব্দ পেয়ে অতীশ বাইরে বের হয়ে আসতেই তিনি আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু একি চেহারা করেছে অতীশ! চোখের নিচে রাত জাগার দুশ্চিন্তা। কেমন রোগা হয়ে গেছে। এক নজর দেখেই বুঝলেন অতীশ ভাল নেই; স্কুলের চাকরি ছাড়ার আগে অতীশের ঠিক এমনই চেহারা হয়েছিল। অতীশ তাহলে সেই এক মানুষের দুর্গন্ধে অস্থির হয়ে পড়ছে! কিন্তু এই মুহূর্তে সামান্য কটি বাক্য তার সঙ্গে সমাপন করা বিধেয় ভাবলেন। বললেন, ভাল আছ?

অতীশ কিছু বলল না।

—বৌমা, দাদু দিদা?

—টুটুল মিণ্টু ভাল আছে।

—সবাইকে নিয়ে এলে না কেন?

—আসার ঠিক ছিল না।

—ওদের একা রেখে এলে!

—না একা না। নির্মলা বাপের বাড়ি আছে।

—ক’টার গাড়িতে এলে?

—রাতের গাড়িতে।

—রাস্তায় কোন বিঘ্ন ঘটেনি তো?

অতীশের ভেতর কে যেন একটা কামড় বসাল। বাবা সত্যি কি সব বুঝতে পারেন। ওর চোখে মুখে কি কোনও দুষ্কর্মের ছাপ ফুটে উঠেছে। কিন্তু সে তো অনেকদিন পর ট্রেনে আজ অঘোরে ঘুমিয়েছে। চারু বিছানা পেতে একবারে সতীসাধ্বী নারীর মতো বলেছে, এবারে ঘুমোন।

—ট্রেনে আমার ঘুম হয় না চারু।

চারু গম্ভীর গলায় বলেছিল, আজ হবে।

অতীশ হেসে বলেছিল, হবে না।

—শোন না। তারপর দেখি হয় কিনা। মানুষ না ঘুমালে বাঁচে?

—ঘুমাই না তোমাকে কে বলল?

—কে বলবে আবার, চোখ মুখ দেখলেই বুঝি। আপনার খুব ঘুমের দরকার। অতীশের তখন হাই উঠছিল। এবং আরও কি সব কথাবার্তা বলতে অতীশের চোখ জড়িয়ে আসছিল। ট্রেনটা অবলীলায় ছুটে যাচ্ছে। ঝমঝম শব্দ। কেমন এক শিশুর মতো কেউ যেন তার শরীরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। তার সত্যি কখন ঘুম এসে গিয়েছিল। কতদিন পর, কতরাত পর সে অঘোরে ঘুমিয়েছে ট্রেনে। জেগে উঠেছিল যখন, তখন আশ্চর্য, কামরায় কেউ নেই। চারু না। কেউ না। একটা ছোট্ট ইস্টিশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে। গাড়ি কোথাও খুব লেট করেছে। ঘুমের ঘোরে সে তাও টের পায় নি। সকাল হয়ে গেছে। চারপাশে সে চেয়ে দেখল সবুজ মাঠ, শস্যক্ষেত্র। ছোট্ট একটা ইস্টিশন। ইস্টিশনের পাশেই সেই ময়দার কল, সামনে রাস্তা, গাছপালার ভেতর দিয়ে রাস্তাটা আশ্রমের দিকে চলে গেছে। এ স্টেশনে সে আরও এসেছে। এখানে লোক কম নামে, কম ওঠে। কালো কোট গায়ে লোকও বেশি দৌড়ঝাঁপ করে না। স্টেশনটার নামও সে জানে। কিন্তু চারু কোথায়! পরের স্টেশনে চারু নেমে যাবে। তারপরের স্টেশনে তার নামার কথা। কিন্তু চারু আশ্চর্য এক ভোজবাজির মতো কোথায় অন্তর্ধান করল! প্রথমে বিশ্বাস হয় নি। সে নাম ধরে ডেকেছিল। চারুর কাছে সে ধরা পড়ে গেছে। বড় দুর্বল এবং ভীরু মানুষ সে। তার সবই দরকার। ভীরুতার জন্য তার কিছু হয় না। সাধু-সন্তের মতো মুখ নিয়ে চলাফেরা করে থাকে। আসলে সে আর্চি অথবা কুম্ভর মতোই পৃথিবীর একজন অনিষ্টকারী মানুষ। চারুর অনিষ্ট করেছে সে। বনির করেছে। নির্মলারও। সবার অনিষ্টের মূলে সে। সুতরাং তার মনে হয়েছিল, চারু তাকে আর মুখ দেখাতে চায় না। সে আগেই কোথাও নেমে গেছে। তারপর মনে হয়েছে, যদি এদিক ওদিকে থাকে। সে ডেকেছিল, চারু চারু! সাড়া নেই। বাথরুমে যদি থাকে, সে গিয়ে দেখল, ভিতর থেকে লক করা নয় বাথরুম। সব ফাঁকা। চারু তাকে একা ফেলে গেল, না কি, সে এক স্বপ্নের রেলগাড়িতে চড়ে বসেছিল!

তখনই বাবা বললেন, চিঠি দাও নি কেন? আস না কেন?

অতীশ বলতে পারত, আমি ভাল নেই বাবা। কিন্তু বাবা যদি বুঝে ফেলে, কিংবা যদি গন্ধটা পায়, সে চারু এবং নির্মলার প্রতি ভারি অবিশ্বাসের কাজ করছে, সে কিছুটা বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় বিচলিত বোধ করল। চন্দ্রনাথ কি ভাবলেন কে জানে, শুধু বললেন, ঠাকুর প্রণাম করেছ?

.

অতীশ যেমন এ সব করে না, আজও বাড়ি এসে তা করে নি। বাবা যেমন বার বার মনে করিয়ে দেন, এবং বাবার মন রক্ষার্থে যেমন দেব দ্বিজে ভক্তি রাখার চেষ্টা করে তেমনি আজও ভুল হয়ে গেছে মতো বলল, করছি।

—আগে করে এস।

অতীশ আর কি করে। বাধ্য ছেলের মতো চৌকাট ছুঁয়ে মাথা ঠেকাল। হাসু ভানু অলকা মজাটা দেখছে। মাও বের হয়ে এসেছে। বলল, নে কর। উদ্ধার হয়ে যাবি।

সবটাই খোঁটা। বাবার প্রতি মার খোঁটা। বাবা এদেশে আসার পরই বড় বেশি ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ হয়ে পড়েছিলেন। সেই শৈশবকাল থেকেই দেখে এসেছে, কি করে তিনি বহু দেশ ঘুরে শেষপর্যন্ত গৃহদেবতা গলায় ঝুলিয়ে ফিরেছিলেন। কি করে ঘরবাড়ি করার সময় দেশের মানুষদের ঠিকানা সংগ্ৰহ করে বেড়াতেন। খেরো খাতায় সব ঠিকানা সংগ্রহ করা থাকত। এবং এই করে তিনি তাঁর শিষ্যদের কাছ থেকে গৃহদেবতার নামে কিছু মাসোহারাও ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন অন্নসংস্থান করাই ছিল সংসারে পিতৃদেবের একমাত্র কাজ। অভাব অনটন ছিল প্রকট। বাবা কখনও কখনও উধাও হয়েও যেতেন। একবার একটা পঞ্জিকা নিবারণ দাস দিলে বাবা দিনরাত তাই নিয়ে পড়েছিলেন। তা কেনার সামর্থ্যও বাবার ছিল না। এবং যে দিয়েছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় বাবার চোখে জল এসে গিয়েছিল। মার তখনও বিরূপ কথাবার্তা—মার ধারণা মানুষটার আর একটু বুদ্ধি বিবেচনা থাকলে পরিবারে এত দুর্গতি থাকত না। এদেশে এসে যে বাবা নিরুপায় মানুষ হয়ে গেছিলেন, তাও মার কথাবার্তা থেকে বড় বেশি টের পাওয়া যেত। বাবার ঈশ্বর ঈশ্বর ভাব মা একদম সহ্য করতে পারত না। এই শেষ বয়সেও মার তা যায় নি। মা আজও বলল, নে কর, উদ্ধার হয়ে যাবি।

বাবা মার অহরহ কলহ তার ভাল লাগে না। বাবা তবু সয়ে যান। সময় সময় বলেন, আমার কাছে সবই সংকল্প পাঠ। মার তখন ভীষণ-অবস্থা। বাবার গায়ে এতটুকু হুল ফোটাতে পারছে না বলে মা কেমন নিরুপায় হয়ে পড়ে। তখন মার আরও খোঁটা দিয়ে কথা বলার প্রবৃত্তি বেড়ে যায়। এখনও এসব হবে ভেবে অতীশ হাসু ভানুকে ডাকল। একটু ঘুরে আসা যাক। অনেক দিন পর চাষের জমিতে তার হেঁটে যাবার ইচ্ছা হল। খালপাড় থেকে নেমে গেলেই বাবার এক লপ্তে কয়েক বিঘা জমি। এই জমির সঙ্গে বাবার মতো তারও বড় নাড়ির টান। শরৎ হেমন্তে অথবা বর্ষায় জমিতে বাবা কিছু না কিছু চাষ আবাদ করেই থাকেন। প্রহ্লাদকা সব দেখাশোনা করেন। সে এসেছে জানলে প্রহ্লাদকা যেখানেই থাক ছুটে আসত। যেতে যেতেই বলল, প্রহ্লাদকা কোথায় রে!

অতীশকে হাসু ভানু খুব সমীহ করে। কাকে প্রশ্ন করছে ওরা দু’জনের একজনও ধরতে পারল না। অতীশ বুঝতে পেরে বলল, প্রহ্লাদকাকে দেখছি না হাসু।

হাসু বলল, প্রহ্লাদকা কালীকে নিয়ে টিকটিকি পাড়া গেছে।

অতীশ বলল, কিছু হয়েছে কালীর?

হাসু কি বলবে ভেবে পেল না। কি করে বলবে ষাঁড় দেখাতে নিয়ে গেছে প্রহ্লাদকা। এই বয়সে এ সব খবর রাখা দাদার সামনে সমীচীন কি না বুঝতে পারছে না। জমির আলে অতীশ উঠে দাঁড়ালে বলল, কালী ক’দিন খুব হাম্বা হাম্বা করছিল।

অতীশ এখন কিছুই শুনছে না। এদিকের জমিতে বাবা আউস ধান বুনেছেন। সতেজ ধানের গাছ, মাঝে মাঝে তিল ফুলের গাছ। ধান ওঠার আগে তিল গাছে ফুল এসে যাবে। তিলের খুব দরকার এ পরিবারে! তিলের অম্বল বাবা খুব খেতে পছন্দ করেন। তিলের বড়াও বাবার খুব প্রিয়। অতীশের মনে হয়, বাবার জীবন বড় নিরুদ্বেগ। চাষ আবাদ, বাড়ির গৃহদেবতা, কিছু যজনযাজন আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর, সকাল হলে মানুষকে শুভ দিনক্ষণ বলে দেওয়া, বড়ই এক মুক্ত জীবন তাঁর। সে কেন বাবার মতো জীবন পেল না। তার কি উচ্চাশা আছে খুব! উচ্চাশা থাকলে মানুষের মধ্যে অহরহ দ্বন্দ্ব থাকে। অশান্তি থাকে। মনে হয় অন্ধকার কারাগারে কেউ তাকে যেন ছেড়ে দিয়েছে। সে পথ দেখতে পাচ্ছে না। সেই কারাগার কলকাতা নামক এক নগরী। আবার ফিরে যাবে ভাবতেই ভয় হয়। সেখানে কুম্ভবাবু শেঠজীরা তাকে খুঁচিয়ে মারার মতলবে আছে। সেখানেই আছে আবার তার প্রিয়জন নির্মলা টুটুল মিণ্টু। আছে অমলা। এই সবুজ শস্যক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তার কেমন জীবনে কোথাও বড় ভুল হয়ে গেছে এমন মনে হল। সে কোথাও আজীবন যেতে চেয়েছিল। সেটা কোথায় তার জানা নেই।

কটা দিন বাড়িতে বেশ হৈচৈ করে কাটাল অতীশ। সকাল হলেই মা মুড়ি দুধ পাটালি গুড় দেন খেতে এক থালা। সকাল হলেই বাবা বাজারে যান। কাচকি মাছ, বাতাশী মাছ, যা কলকাতায় পাওয়া যায় না, কলকাতায় বাঁচে কি করে মানুষ, কথায় কথায় বাবার এমন সব কথা, বাজার থেকে থলে হাতে বাবা ফিরে এলেই মা ডাকবে, অতীশ আয়! দেখে যা কি মাছ এনেছে তোর বাবা। কেমন এক শৈশবের অতীশ যেন। থালার তাজা মাছ কখনও লাফায়। মা এক হাতে সকাল থেকে সব কাজ করে যায়। স্বামী পুত্র কন্যার মুখে দুটো সুস্বাদু খাবার তুলে দিতে পারলে জীবনে তার আর কিছু লাগে না। খেতে বসলেই মা বলবে, কিরে কেমন লাগল। নুন বেশি হয়নি ত। চোখে তো আগের মতো আর ভাল দেখি না।

আসলে মার হাতের রান্না অতীশের কাছে অমৃত সমান।

অফুরন্ত লম্বা সময়, ছুটির সময়, কখনও পুরানো বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে দেখা, দেখা হলেই ফিসফিস করে বলা, এদিকে কোথাও দু’জনের ইস্কুলে চাকরি হয় না লীলাময়? আর ভাল লাগছে না। আসলে সে যে কলকাতায় ত্রিশঙ্কুর মতো জীবন যাপন করছে, তার শেকড় আল্গা হয়ে যাচ্ছে, অথবা সে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছে না এ-সব কথা বলার সময় বড় কাতর হয়ে পড়ে। কলকাতা মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে দেয়। সে একদিন খেতে বসে ডাকল, বাবা!

চন্দ্রনাথ পুত্রের দিকে তাকালেন। এই পুত্রটির জন্য তাঁর আলাদা গর্ব আছে। অবশ্য মনে মনে। মুখে তার কোন প্রকাশ নেই। শক্ত মজবুত চেহারা। লম্বা, গৌরবর্ণ। চন্দ্রনাথের গায়ের রঙ ফর্সা। এই পুত্রটি তার রঙ পেয়েছে। আদল পেয়েছে বড়দার। কিন্তু কি যে দুশ্চিন্তা এই পুত্রটির চোখে মুখে! খুব কম সময়েই হাসে। বিষণ্নতার এমন প্রতীক তাঁর এই পুত্রটি কেন হল! শেষে মনে হয়, ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলে এমনই হয়। স্বাধীন মানুষ হতে চাইলে এমনই হয়। তিনি বললেন, কিছু বলবে?

—বড় জ্যাঠামশাইর শ্রাদ্ধের জন্য সবাই নাকি উঠে পড়ে লেগেছেন?

চন্দ্রনাথ ডালের সঙ্গে গন্ধরাজ লেবুর রস মাখিয়ে নিচ্ছিলেন তখন। পুত্রের কথায় বুঝতে পারলেন, এই নিয়ে কোনও সংশয় অতীশের মনে দানা বাঁধছে। তিনি বললেন, আরো আগে করা উচিত ছিল?

অতীশ না বলে পারল না তিনি যে মারা গেছেন তার প্রমাণ তো নেই।

—শাস্ত্রে বিধি আছে।

—সেটা কি বিধি।

—বার বছর কোন মানুষ নিখোঁজ থাকলে, তাঁর দাহকার্য থেকে পারলৌকিক সব কাজ সেরে ফেলতে হয়।

—যদি তিনি ফিরে আসেন। জ্যাঠিমার চিঠি পড়ে আমার এমনই মনে হয়েছে, তিনি আবার ফিরে আসতে পারেন।

—আমার মনে হয় না।

—আপনি তো অনেক দূরের খবর চোখ বুঝলে টের পান। এ বিষয় কি কখনও ভেবে দেখেছেন।

—না।

—একবার ভেবে দেখুন না।

অতীশ তাঁকে ফ্যাসাদে ফেলতে চায়। আসলে এ বিষয়ে তাঁর আগ্রহের অভাব আছে কিছু। শাস্ত্রের বিপরীত চিন্তা করতে তাঁর ভয় হয়। যেন বিধিমতে কাজটা করে ফেললে সংসার থেকে সব রকমের অশুভ ঘটনা সরে যাবে। এমন কি অতীশ যে মানুষের দুর্গন্ধ পায় তাও দূরীভূত হতে পারে। তিনি বললেন, ফিরে এলেও করার কিছু নেই। ঈশ্বরের বিধির ওপর মানুষের বিধি হতে পারে না।

অতীশের খাওয়া প্রায় শেষ। সে খেতে বসে দ্রুত আহার করে থাকে। সব কিছুতেই মনে হয় তার বড় বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। যেন কোথাও তার যাওয়ার কথা। সময় হাতে বড় কম। তার চলা ফেরা, তার অস্বস্তি এবং চাঞ্চল্য দেখলে এমনই মনে হতে পারে। সে বাবার জবাব পেতেই বলল, কিছু না করলেই বা কি হয়?

চন্দ্রনাথ বলল, কিছুই হয় না। তবু মনের শান্তি বলে কথা। মানুষ তো নিজের আশ্রয়ের জন্য এই সব বিধি নিষেধ মেনে চলে।

অতীশ বলল, আসলে আপনারা মানুষের চেয়ে প্রেতাত্মাকে বেশি ভয় পান?

—কে বলেছে?

—জ্যাঠামশাই যদি নাই থাকেন, তবে তাঁর অশুভ প্রভাব সংসারে পড়বে কেন। আপনাদের ধারণা তিনি না থাক তাঁর প্রেতাত্মা আছে। সে ঘোরাফেরা করছে।

—করতেই পারে! তোমার সোনা জ্যাঠামশাই জানিয়েছেন, বড়দা নাকি জল খেতে চান। মাঝে মাঝেই স্বপ্নে তিনি বলছেন, আমাকে এ-ভাবে ফেলে রেখেছিস কেন, উদ্ধার কর। আমার বড় তেষ্টা।

—পারলৌকিক কাজ করলেই উদ্ধার পাবেন আপনারা?

—তাইত হয়। চন্দ্রনাথ টকের ডাল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন।

ধনবৌ বাপবেটার তর্ক শুনছিল। এই সব তর্কে ধনবৌ স্বামীর ঈশ্বর প্রীতির প্রতি বিদ্বেষ হেতু পুত্রের পক্ষ অবলম্বন করে থাকে। কিন্তু বড় ভাশুরঠাকুরের শ্রাদ্ধ হবে কি হবে না এই বিষয় নিয়ে এখন তর্ক চলছে। অতীশের এতটা নাস্তিকতা আজ কেন জানি ধনবৌরও ভাল লাগল না। সংসারের ভাল মন্দ এর সঙ্গে জড়িত। অতীশ কি সাহসে এমন কথা বলতে পারে ধনবৌ বুঝে উঠতে পারল না। ধনবৌ আর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে এসে বলল, তাই বলে মানুষটার কাজ হবে না!

অতীশ বলল, আমি যদি না ফিরতাম মা? আমি যদি আবার কোথাও চলে যাই? চন্দ্রনাথ কেমন আতঙ্কিত গলায় তখন বলে উঠলেন, এ-সব অলুক্ষণে কথা বলবে না। ফিরবে না কেন? আমি তো ঈশ্বরের কাছে তেমন কোনও পাপ করি নি। চলে যাবে কেন, তোমার সংসার নেই!

—তাহলে এটা পাপ থেকে হয়েছে বলছেন। জ্যাঠামশাইর পাগল হয়ে যাওয়া, নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া ঠাকুরদার পাপ কিংবা কর্মফলে হয়েছে!

চন্দ্রনাথ কি বলবেন ভেবে পেলেন না। তার যতদূর জানা আছে বাবা ছিলেন বড় পুণ্যবান মানুষ। শতবর্ষ পরমায়ু পার করে তিনি তাঁর জীর্ণবাস ত্যাগ করেছেন। তবু পুত্রের আচরণে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, আমরা যাই করি, গন্ডির বাইরে যেতে পারি না। গন্ডির বাইরে গেলেই সীতা হরণ হয়। সংসারে অপযশ হয়। তুমি তার চেষ্টা করছ। বৌমা টুটুল, মিণ্টুর দিকে তাকিয়ে আর গন্ডির বাইরে যেতে চেও না।

অতীশ ঘাবড়ে গেল। চারুর সঙ্গে সহবাস করেছে সে। এ-জন্য মানসিক পীড়ন বোধ করে নি। বরং ভেতরে যে হাহাকার ছিল এই সহবাসের ফলে তা লাঘব হয়েছে। তারপরই চারুর রহস্যময় অন্তর্ধান কিছুটা ওকে চিন্তামগ্ন করে তুলল। বাবা কি সব টের পান! তিনি কি জানেন, আর্টি নামে এক প্রেতাত্মা তাকে তাড়না করছে! একবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হল, অপযশটা কি বাবা। কিন্তু যদি বাবা বলেই দেন এক নারী তোমাকে প্রলোভনে ফেলে দিচ্ছে। একজন হবে কেন। অমলাও তো চায়। সে বলল, বাবা আপনি মেজবাবুকে তো চিনতেন?

—কোন মেজবাবু?

—মুড়াপাড়ার।

—অঃ হাঁ, তা কি হল?

—মেজবাবুর বড় মেয়ে অমলার কথা মনে আছে।

চন্দ্রনাথ কি স্মরণ করার চেষ্টা করলেন, সেই জমিদারবাড়ির প্রাসাদ, দীঘি, নদীর পাড় এবং ঝাউগাছের শনশন শব্দ—সব কিছুর মধ্যে এক বালিকার অবয়ব খুঁজে পেতে বললেন, ওরা তো দু-বোন ছিল।

—বড়জনের নাম অমলা।

—মনে পড়ছে।

—অমলা এখন কুমারদহের বউরাণী।

এই খবরে চন্দ্রনাথের বিশেষ কৌতূহল দেখা গেল। খাওয়া শেষ। শেষ পাতে পিতা-পুত্র অনেকদিন পর যেন স্মৃতির মধ্যে ডুব দিতে চাইলেন। কারণ মানুষ স্মৃতির ভেতরে নিজেকে বার বার খুঁজে পায়। চন্দ্রনাথ বললেন, মেজবাবু ধার্মিক মানুষ ছিলেন। বিয়ে সুখের হয়নি। বড় হুজুরের সঙ্গে মেজবাবুর বিয়ে নিয়ে বনাবনি ছিল না। তিনি কি বেঁচে আছেন?

—না।

—ওনার স্ত্রী তো আগেই গত হয়েছেন।

অতীশ বলল, অমলার মাকে দেখেছেন বাবা?

—দেখিনি। কলকাতা ছেড়ে তিনি কখনও মুড়াপাড়ায় আসেন নি। ছবি দেখেছি। ইংরেজ মহিলা। চোখে মুখে আশ্চর্য বিষণ্ণতা ছিল। আসলে তিনি যেন এ-দেশে কাউকে খুঁজতে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন, মেজবাবুর মধ্যে তা পাবেন। শুনেছি তা পাননি। বাড়ির ব্যালকনিতে বসে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে কেবল তাকিয়ে থাকতেন। মেজবাবু প্রশ্ন করলেই বলতেন কার যেন আসার কথা আছে বাবু। তার জন্য বসে থাকি।

—মাথায় গন্ডগোল ছিল? অতীশ চন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। তার যতদূর জানা আছে পাগল জ্যাঠামশাইও এমনি করেই পাগল হয়ে যান। তাঁরও মনে হত কোথাও নীলকণ্ঠ পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। হাতে তালি বাজালেই তারা নেমে আসবে।

চন্দ্রনাথ বললেন, মানুষের যে কি হয়! মেজবাবু বুঝতে পারতেন, তাঁর প্রতি সেই মহিলার কোনও আগ্রহ নেই। তবু তিনি সারাজীবন স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে গেছেন। শেষ দিকে শুনেছি আলাদা ঘরে থাকতেন। গীর্জা থেকে ফাদাররা আসতেন। বাইবেল পাঠ করে শোনাতেন। অমলার মার বিশ্বাস ছিল, যে আসবে কথা আছে সে আসবেই। এ জন্মে না হয় অন্য কোনও জন্মে মানুষটার জন্য তাঁর নিরন্তর অপেক্ষা ছিল।

—সেই মানুষটা কে বাবা?

—বোধহয় ঈশ্বর। আর এ-ভাবেই মানুষের ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে। আসলে নিজের জন্যই মানুষের সেই ঈশ্বর—যা আমরা খুঁজে মরি। সংসারে থেকেও মানুষের মনে হয়, সে কিছু হারিয়েছে। যতই ঐশ্বর্য থাকুক, যতই সুখ থাকুক, মানুষ সব সময় কিছু না কিছু হারায়। তার মনে হয়, সে যা পাবে বলে বসে আছে তা পেয়ে গেছে। পেয়ে গেলে মনে হয়, না ঠিক পাওয়া হল না। আরও কি যেন বাকি থেকে গেল। তার আশা রোজই কোনও না কোনও নীলখামে চিঠি আসবে, আসেও। কিন্তু সে চিঠিতে সব খবরই থাকে, আসল খবর বাদে। মানুষের এই প্রতীক্ষাই হচ্ছে ঈশ্বর প্রতীক্ষা। কখন কে যে পেয়েও যায়!

অতীশ বলল, বাবা এই নীলখামের চিঠির প্রত্যাশায় সবাই বসে থাকি যদি তবে এত কুকাজ করে কেন মানুষ?

—কুকাজ? সেটা আবার কি?

—আপনার ধর্মের বিষয়েই আসা যাক। ঈশ্বরকে আপনি বলেছেন, মনের মধ্যে ধরে রাখা যায়। মনই তাঁকে ধারণ করতে পারে। আপনি যদি তাই ভাবেন, তবে কোনও কুকাজ করেও তাঁকে পাওয়া যেতে পারে।

—ঈশ্বরের কাছে কুকাজ সুকাজ বলে কিছু নেই। সবই তাঁর পৃথিবীতে ঘটে। যা কিছু ঘটে তিনিই নিমিত্ত মাত্র।

—তাহলে বলছেন আমাদের রামলাল পিয়ারিলালরা যে ভেজাল তেল, ভেজাল গন্ধ সাবান চালাচ্ছে তাতে ঈশ্বর ক্ষুব্ধ হন না।

—সে নিজে ক্ষুব্ধ না হলে ঈশ্বর ক্ষুব্ধ হবেন কেন?

—তাহলে তেনার পৃথিবীতে সব কাজেরই এক রকমের ফলাফল। আপনারও যা হবে, তাদেরও তাই হবে।

—নিশ্চয়। এক চুল ফারাক নেই। জরা ব্যাধি মৃত্যু সবাইকে গ্রাস করে।

—তাহলে পরজন্ম বিষয়টা?

—এখানেই অতীশ মানুষ আটকে যায়। সে ভাবে এক-ভাবে না এক-ভাবে জালজুয়াচুরি করে ইহকালটা কেটে গেল। কিন্তু পরকাল। সেই ভেবে নিরস্ত হয়। বুঝতে পারে ভুল রাস্তায় সে গাড়ি চালিয়েছে। অনুশোচনা আসবেই। আসতে বাধ্য। তারই নাম পাপ। অনুশোচনাই পাপ, তার দাহ নিরন্তর।

সে একবার ভাবল বলবে, যার পরকালে বিশ্বাস নেই, ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই তার কি হবে? কিন্তু তা না বলে, অতীশ বাবার কথাবার্তার মধ্যে কিছুটা নিমগ্ন হবার চেষ্টা করল। বাবা ঠিক কি বলতে চান, বাবার ধর্মাধর্ম কতটা জীবনে গুরুত্ব পেতে পারে ভাবতে গিয়ে মনে হল, সরল বিশ্বাস ছাড়া মানুষের মুক্তি থাকতে পারে না। তার সেই সরল বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। দেশভাগ, পৃথিবী পরিভ্রমণ, আর্চির মতো দুরাত্মার নির্যাতন, স্যালি হিগিনসের ঈশ্বর এবং পাপ সম্পর্কিত সত্যাসত্য এবং সমুদ্রের সেই রুদ্ররোষ তাকে ঈশ্বর থেকে ক্রমে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ফতিমার চোখ জলে ভার, চোখ দুটো সে স্পষ্ট মনে করতে পারে। প্রায় বনির মতো জেদি এবং নিষ্পাপ ছিল সে। তাকে ছুঁয়ে দিলে সোনাকে স্নান করতে হত। তার এখন হাসি পায় ভাবলে। সে ভাবল, বাবাকে এবারে সেই নিষ্ঠুর প্রশ্নটি করবে কিনা। বলবে কিনা, বাবা দেশ ছেড়ে এসেছিলেন, অভক্ষ্য ভক্ষণ করতে হবে ভয়ে। গোমাংস কথাটা বাবা উচ্চারণ করেন না। এই শব্দ উচ্চারণে বাবার অপবিত্র হবার ভয় থাকে। হয়ত শোনামাত্র তিনি আবার গঙ্গাস্নানে ছুটবেন। ঠিক খাওয়ার পরই এ-কথা বলতে অতীশের বাধছিল। গলার কাছে এসেও কথাটা আটকে গেল। কথাটা অতীশের মনের মধ্যে গুরুগুরু করছে। সেই এক সমুদ্রযাত্রা। বাঙ্কারে অমানুষিক পরিশ্রম। তিন টনের ওপর কয়লা টানা, স্টকহোল্ড থেকে ছাই হাপিজ করা—বয়লার থেকে উত্তপ্ত কয়লার চাঙ টেনে বের করা এবং জলে নির্বাপিত করলে সারা স্টকহোলডে দম বন্ধ করা গ্যাসের মধ্যে তার ক্রীতদাসের ভূমিকা এবং ওয়াচ শেষে ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত অবসন্ন এক তরুণের সামনে আহারের থালা—ভাত আর গোস্ত। সেই অভক্ষ্য ভক্ষণ। ধর্মের নামে তার বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা হয়নি অভক্ষ্য ভক্ষণ করতে। প্রথমে সে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেছিল—এই পর্যন্ত। বলতে ইচ্ছে হল, সব জানলে বাবা আপনি আমার ফের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াই পছন্দ করতেন। তা-ছাড়া আপনার জাতক একজন সাদা কথায় খুনী। সে মানুষ খুন করেছে। তার মধ্যে সেই অনুশোচনা। মানুষ খুনের অনুশোচনা। মানুষ খুনের অনুশোচনাতেই তার এখন ভারি প্রেতাত্মার ভয়। মানুষেরা তার অমঙ্গল চাইলেই মনে হয় সব সেই দুরাত্মা আর্চির কাজ। সব মানুষের পাগল হয়ে যাওয়ার মধ্যেই বোধহয় দুরাত্মার ভূমিকা থাকে। সেই দুরাত্মা ঈশ্বর হতে পারেন, আবার আর্চির প্রেতাত্মাও হতে পারে। পাগল জ্যাঠামশাই সেই ঈশ্বরের বলি। দেশভাগ সেই ঈশ্বরের বলি। মানুষের ভূমিকার চেয়ে ঈশ্বরের ভূমিকা বড় হয়ে গেলে যে সর্বনাশ হয়, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ, দেশভাগ আর আমার সেই পাগল জ্যাঠামশাই। এর থেকে মানুষের পরিত্রাণ আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। প্রেতাত্মার হাত থেকে বাবা আমি নিষ্কৃতি পেতে চাইছি। ঈশ্বর এবং প্রেতাত্মা আমার কাছে সমান।

অতীশ মাথা গোঁজ করে বসে আছে। বাবা উঠে যাচ্ছিলেন। সে আবার প্রশ্ন করল, যার পরকালে বিশ্বাস নেই?

—পরকালে বিশ্বাস না থাকলে ফাঁকা মাঠ ধু-ধু বালিরাশি। কোন গাছই গজায় না যে ছায়া দেবে।

অতীশ তখনই দুম করে প্রশ্ন করে বসল, আচ্ছা বাবা, প্রেতাত্মা বড় না ঈশ্বর বড়।

বাবা বললেন, ঈশ্বরই প্রেতাত্মা, প্রেতাত্মাই ঈশ্বর। তোমার আরও জেনে রাখা দরকার যে-ঈশ্বর মানুষের অনিষ্ট করে তিনি প্রেতাত্মা। যে-ঈশ্বর মানুষের হিত করেন তিনি প্রকৃতপক্ষেই ঈশ্বর।

—তা হলে বলছেন, ঈশ্বর কখনও প্রেতাত্মা হয়ে যায়।

—ইতিহাসে অনেকবার হয়েছে শুনেছি।

—দেশভাগ প্রেতাত্মার কাজ?

—ঈশ্বর তখন প্রেতাত্মার রূপ পরিগ্রহ করেছিল বোধহয়। মানুষই ঈশ্বরকে তৈরি করেছে। মানুষই ভূতপ্রেতের স্রষ্টা। মানুষ নেই, ঈশ্বরও নেই। ভূত প্রেতও নেই

—তবে বিশ্বাস করেন মানুষের সুবিধার্থেই তাঁর সৃষ্টি।

—তা করব না কেন!

—তাহলে ওটা না থাকলে কিছু আসে যায় না। আত্মবিশ্বাসই বড় কথা।

তিনি এবার গম্ভীর গলায় বললেন, আসে যায়।

অতীশ এবার উঠে পড়ল। বলল, কি আসে যায়?

—তিনি আমাদের আশ্রয়। তিনি আছেন বলেই আমরা আছি।

—তাহলে বলছেন, ঈশ্বর থাকবে, প্রেতাত্মাও মানুষের জন্য থাকবে।

—ঈশ্বর থাকলে সেও থাকবে। তবে একজন মানুষকে আশ্রয় দেয়, অন্যজন শুধু তাড়া করে। এরপর বাবা কলপাড়ে চলে গেলেন হাত-মুখ ধুতে। বাবার কথাগুলি ভারি গোলমেলে। একটার সঙ্গে আর একটা বড়ই সঙ্গতিবিহীন। তবু বাবার মতো মানুষের পক্ষে সে বুঝতে পারে, ঈশ্বর দরকার। তারও দরকার। খুব দরকার। কিন্তু চারপাশে এত প্রেতাত্মার উপদ্রব থাকলে তার মহিমা বোধহয় টের পাওয়া যায় না। তারপরই মনের দুর্বলতা ভেবে সে হেসে ফেলল। এবং বিকেলেই গেল সেই শস্যক্ষেত্রে। আকাশ মেঘলা হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। ঝড় বৃষ্টি আসবে। মাঠে দাঁড়িয়ে ঝড় বৃষ্টিতে তাঁর মহিমা টের পাবার জন্য অতীশ কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল। তারপরই ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে সে যখন ফিরে এল, তার আরও হাসি পেল। এও এক পাগলামি। ঈশ্বর ঈশ্বর পাগলামি। আত্মপ্রত্যয়ের অভাব থেকেই মানুষের এই ক্ষ্যাপামি।

সেদিন সন্ধ্যার মুখে যজমান বাড়ি থেকে ফিরে শুনলেন, অতীশ শহরে গেছে। অতীশকে একটা কথা তাঁর বলা হয় নি। বাড়ি ফিরেই ভেবেছিলেন, বলবেন। কিন্তু কখন ফিরবে কে জানে! কথাটা না বললে ভারি দুশ্চিন্তা থেকে যাবে। চারপাশে বিপদসঙ্কুল বার্তা কানে আসছে। তা-ছাড়া খারাপ স্বপ্নটার অস্বস্তিও কাটছে না। বৈকালি দিতে গিয়ে মনে হল, অতীশ ফিরেছে। ভুলে যাবেন ভেবে ঠাকুরঘরে বসেই ডাকলেন, অতীশ এলি?

অতীশ বারান্দায় উঠেছিল সবে। বাবার ডাকে সে আর ঘরে না ঢুকে ঠাকুরঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রদীপ জ্বলছে। ধূপ জ্বলছে। এবং এই ঘরের কাছে এলেই আশ্চর্য এক সুঘ্রাণ পায়। ফলমূলের গন্ধ, চন্দনের গন্ধ, চরণামৃতের ঠাণ্ডা তুলসীপাতা তার একসময় বড় প্রিয় ছিল। কোথায় যেন এর মধ্যে সে এক পবিত্র বারিধি আছে টের পায়। আজও দরজার সামনে যেতে সব ঠিকঠাক নাকে এসে লাগল। বাবা মুখ না ফিরিয়েই টাট থেকে সামান্য চরণামৃত নিয়ে অতীশের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। যেন কথা বলার আগে পুত্রকে পবিত্র করে নেওয়া। তারপর মন্ত্রপাঠের মতোই বললেন, কলকাতায় থাকিস, রাস্তাঘাট দেখেশুনে চলিস ত?

বাবার এ সব কথায় সে বিস্মিত হল না। বলল, চলি।

—আমার কিন্তু মনে হয় না।

অতীশ বলল, কি করে জানলেন?

কলকাতায় যে এত বিপত্তি যাচ্ছে তার ত কোন খবরই রাখিস না!

অতীশের মনে হল সত্যি সে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে। আগে বাবাকে কলকাতার খবর দিত। ইদানীংকার চিঠিতে তা কিছুই থাকত না। যেন কলকাতাটাই এই রকমের। মিছিল, ছিনতাই, খুনখারাপি, বাস দুর্ঘটনা, যাত্রা নাটক, শোভাযাত্রা, পরেশনাথের মিছিল—এই সব নিয়েই কলকাতা। আঁস্তাকুড়, বস্তি, যুবতীদের বেলাল্লাপনা, হা-অন্ন মানুষ, কোটিপতি মানুষ, ট্রাম বাস, বড় বড় হাসপাতাল, নিত্য মহামারীর মতো মুখ হাঁ করে রেখেছে। দু-বছরের মধ্যে আগের মতো সব কিছু চোখে আর তত খারাপ ঠেকে না। আঁস্তাকুড়ে মানুষের আহার সংগ্রহ দেখলে প্রথম প্রথম আর্টি কি যে মাথার মধ্যে দাপাদাপি করত। এখন আর তা করে না। ঘুষ দেবার পর থেকে কিছুদিন আবার আর্চির ঘোরে পড়ে গেছিল। ট্রেনে চারুর সঙ্গে সহবাসের পর আর্চি এসে জ্বালাতন করে নি।

অতীশ উত্তর না দেওয়ায় বাবা ফের বললেন, তোমাকে একটা কথা বলা হয় নি। মনে রেখ কথাটা খুব দরকারী। এখানে কেউ এসে দেয়ালে লিখে দিয়ে যাচ্ছে, আগুনে ফু দিন। ক’দিন এই নিয়ে হৈচৈ গেছে খুব। যে লিখত সে ধরাও পড়েছিল। তোমার মা তাকে সেবাযত্ন করে খাইয়েছিল। সকালে প্রহ্লাদ জানাল নেই। কোথায় আবার ভেগে গেছে। এরা কারা তুমি জান?

সে বুঝতে না পেরে বলল, কি করে বলব?

—তুমি তো কলকাতায় থাক। অনেক খবর রাখার কথা।

—এখন ত কত রকমের আন্দোলন হচ্ছে। ক’বছর আগে চীন প্রশ্নে কম্যুনিস্টরা দু-ভাগ হয়ে গেল। অতীশ বলল।

—কেন হয়ে গেল?

—আদর্শের লড়াই! অতীশ বিরক্ত হয়ে বলল, ঠাকুরঘরে বসে থাকলে বুঝতে পারবেন না। চন্দ্রনাথ পুত্রের বিরূপ মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন না। ঠাণ্ডা মাথায় বললেন, সে বুঝতে না পারি—তোমাকে বাবা কিন্তু বলে দিচ্ছি, এ সবে থেক না। নিজে ঠিক থেক। নিজে ঠিক থাকলে আদর্শের কোন লড়াই থাকে না। কলকাতা যাবার আগে তোমার ভাই দুটোকেও বুঝিয়ে দিয়ে যেও। ওরা আমার কথা গ্রাহ্য করে না। নিবারণ দাস তোমার ভাইদের সম্পর্কে অভিযোগ করেছে। এটা নাকি বড়ই ছোঁয়াচে রোগ। প্লেগের চেয়েও ভয়াবহ। বাড়িতে মহামারী শুরু হোক আমি চাই না।

অতীশ বলল, বলে যাব।

—আর শোন, তারপর কি ভেবে পুত্রের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ভিতরে এসে বস। কথা আছে।

অতীশ বুঝতে পারল বাবা আরও কিছু তার সংশয়ের কথা বলবেন। অথবা মনে হল মার বিরুদ্ধে হয়ত অভিযোগ আছে বাবার। মার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে, কাছে গিয়ে শুনতে হয়। মার মধ্যে নাকি অভাব অনটনের বাই আছে। সব সময় অভিযোগ, এটা নেই, ওটা নেই। নিষ্কর্মা মানুষের হাতে পড়লে যা হয়। আপাত মনে হয় মার এ সব কথা বাবা আজীবন অগ্রাহ্য করেছেন। কিন্তু বাবার চোখের দিকে তাকালে সে বুঝতে পারে বাবা এতদূর যে হেঁটে এসেছেন, সে একমাত্র মাকে সুখী করার জন্য। এবং যখন রেষারেষি শুরু হয় দু’জনে তখন বাবার কি হতাশ চোখ মুখ। অতীশের তখন বাবার কষ্টটা ভিতরে বড় বাজে। সে দরজার কাছে গিয়ে বলল, বলুন না।

—ভিতরে আসতে এত ভয় কেন? এখানে আর যাই থাক ভূত নেই।

সে বলল, হাত পা ধোয়া হয়নি।

বাবা হেসে দিলেন।—তাহলে ঈশ্বর ভীতি আছে?

অতীশ চীৎকার করে বলতে চাইল, না নেই। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না।

চন্দ্রনাথ বললেন, ঈশ্বরের করুণা তোমার শরীরে আছে। তুমি নির্ভয়ে ভিতরে আসতে পার। তোমার পাপপুণ্য বোধ তীক্ষ্ণ। তাঁর মহিমা না থাকলে এটা হয় না। এটা যখন থাকবে না, তুমি পাপ-পুণ্যের ফারাক বুঝতে কষ্ট পাবে।

অতীশের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে মনে হল, তবে কি সে চারুর সঙ্গে সহবাস করার পর গন্ডার হয়ে গেছে। তাকে আর আর্চি তাড়া করছে না। আর্চি শেষ পর্যন্ত কাজ হাসিল করে উধাও। নির্মলার প্রতি অবিশ্বাসের কাজটা সেরে আর্চি প্রমাণ করতে চাইল, প্রেম ভালবাসা, স্ত্রীপুত্র সংসার সবই নিজের আত্মসুখের জন্য। এর বাইরে পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আত্মসুখের জন্যই আর্চি বনির প্রতি বিরূপ আচরণ করেছিল। আর্চি আর সে এক।

চন্দ্রনাথ পাশে ফুলতোলা আসন পেতে দিয়ে বললেন, বস।

অতীশ বসল।

চন্দ্রনাথ বললেন, তোমার শত্রুপক্ষ প্রবল।

অতীশ খুব ভাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে-ত বাবাকে তার বিপর্যস্ত জীবন সম্পর্কে কিছু লেখেনি। বাবা আবার ফিসফিস করে বললেন, বেঁচে থাকতে গেলে মানুষকে পাপ কাজ করতেই হয়। ঈশ্বর বল অবতার বল, কেউ পাপ কাজ করেননি, গলা উঁচু করে বলতে পারবেন না। যদি আমি তুমি ঈশ্বরের অংশ হয়ে থাকি, সেই পরমব্রহ্মের যদি আমরা ক্ষীণ অস্তিত্ব আমাদের মধ্যে আছে বিশ্বাস করি, তবে সব পাপ-পুণ্যের দায় ভাগও তাঁর। তাঁর ইচ্ছাই তুমি পূর্ণ করেছ। তোমার অন্য নারীতে গমন কিংবা অকাজ কুকাজের প্রলোভন যদি হয়ে থাকে তাও তাঁরই ইচ্ছে। সুতরাং মনঃকষ্টে ভুগবে না। তোমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যার জন্য তোমাকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। মানুষকে সুখে রাখার কাজটা ঘর থেকেই আরম্ভ করতে হয়। সবাই যদি তোমার মতো হয়, ঈশ্বরের সৃষ্টি তবে থাকে কি করে!

অতীশ খুবই বেয়াড়া জবাব দিল, অন্য নারীতে গমন বলছেন কেন?

—হয়। এই বয়সে সব হয়। নির্মলাকে সুস্থ করে তোল।

—হবে কেন?

—ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়। তুমি মনে কর সবটাই তোমার। আমি মনে করি সবটাই তাঁর? অতীশ বলল, যা আমার নয়, তার দায়ভাগ আমি নেব কেন?

—জন্মেছ বলে নিতে হবে।

অতীশ নিজেকে ঈশ্বরবিহীন প্রতিপন্ন করার জন্য বলল, অন্য নারীতে আমার গমন হয় নি।

চন্দ্রনাথ বিগ্রহের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। বললেন, গমন হলেও কোন দোষের না।

বাবা এ-সব কি বলছেন! এ একেবারে উল্টো কথা। আসলে বাবা বুঝি টের পেয়েছেন, অনুশোচনা মানুষকে পাগল করে দেয়। বাবা তাঁর পুত্রের মঙ্গলার্থে পৃথিবীটাকে এখন বিপরীত প্রান্ত থেকে দেখছেন, সে বলল, যা হয়নি তাই নিয়ে অযথা মাথা ঘামাচ্ছেন বাবা। সে আজ প্রথম বাবাকে ছলনা করল। বাবার অনুমান নির্ভর কথাবার্তা তাকে বড় বেশী পীড়া দিচ্ছিল। বাবার সঙ্গে ছলনা করা ছাড়া এ সময় হাতের সামনে অন্য কোনও উপায় খুঁজে পেল না অতীশ। চন্দ্রনাথ বললেন, তোমার মঙ্গল হোক। তারপর বিগ্রহের ফুল বেলপাতা কিছুটা তুলে নিলেন। অতীশ বুঝতে পারল বাবা এই ফুল বেলপাতা তার পকেটে এবং অ্যাটাচিতে ভরে দেবেন।

অতীশ বলল, উঠি বাবা।

চন্দ্রনাথের এক মাথা চুল দাড়ি প্রদীপ শিখায় কেমন এক অলৌকিক প্রবাহ তৈরি করছে। ধূপদীপের গন্ধ, চন্দনের গন্ধ, থালায় বৈকালির নকুলদানা, বাতাসা, ময়ুরের পালকের তৈরি বিগ্রহের রুপোর মুকুট সবই কেমন এক রহস্যময় জগৎ। অতীশ প্রবল আকর্ষণে বোধ হয় তলিয়ে যাচ্ছিল। সে জোর করে উঠতে পারছে না। হাতে পায়ে সে কেমন চলৎশক্তি হারিয়েছে। সে চিৎকার করে বলতে চাইল, বাবা আমি উঠতে পারছি না কেন, জোর পাচ্ছি না কেন?

চন্দ্রনাথ বললেন, পাবে। তারপরই ঘণ্টা নাড়তে আরম্ভ করে দিলেন। অতীশ বলে তাঁর কোনও জাতক অথবা স্ত্রী পুত্রপরিবার কেউ আছে এখন আর বাবার নিমগ্ন অবস্থা দেখলে বোঝা যায় না। অতীশের মনে হল বাবা যেন তাকে উৎসর্গ করে বলি দেবার নিমিত্ত এই বিগ্রহের সামনে এনে বসিয়ে রেখেছেন। ফুল বেলপাতা দিয়ে তাঁর শেষ অর্চনা শুরু। অতীশ প্রায় একলাফে চৌকাঠ পার হয়ে বের হয়ে গেল। বাবাকে সত্যি কোন কাপালিক পুরুষের মতো মনে হচ্ছিল তার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *