॥ পঞ্চাশ ॥
ফতিমা ফিরে এসেছিল। ভুলে ব্যাগ ফেলে রেখে গেছে। আর তখনই দেখল দরজা খোলা। সুখি নেই। কেউ নেই। সে বুঝতে পারছে না, সুখি গেল কোথায়। ভিতরে ঢুকে তার শরীর কেঁপে উঠল। সে ডাকল সুখিদি। বাথরুমে সুখিদি স্নান করছে। আর ঘরের মধ্যে কে পড়ে আছে উপুড় হয়ে।
সে চিৎকার করে উঠল, সোনাবাবু! সোনাবাবু – সোনাবাবু কেমন করছেন!
তার প্রিয় সোনাবাবু তক্তপোশে মাথা রেখে পড়ে আছেন। শরীরের একাংশ ঝুলছে নিচে। সে তাড়াতাড়ি পা দুটো তক্তপোশে তুলে ডাকল, সোনাবাবু! সোনাবাবু!
কোনো সাড়া নেই।
সে অস্থির হয়ে উঠেছে। বিছানা পেতে কোনরকমে মাথাটা বালিশের উপর রাখার চেষ্টা করছে। ভারি। পারছে না। সে এবারে না পেরে চিৎকার করে উঠল, সুখিদি, শীগির এসো! শীগির। বাথরুমে জলের শব্দ এবং এক অরাজক নৈঃশব্দ তাকে তাড়া করছিল। বালিশ চাদর সব কেমন সোনাবাবুর পক্ষে বেমানান। বালিশে ওয়াড় আছে—সাবানে কাচা সস্তা চাদর বিছানো। তার বুক ভারি হয়ে আসছিল। সোনাবাবুদের সেই বৈভব থেকে এখানে—তার চোখ ফেটে জল আসছে। একদন্ডে কী হয়ে গেল! সোনাবাবু ভাল নেই। ভাল নেই। সে কিছুই জানে না। সে অস্থির হয়ে উঠছে। বুকের কাছে কান পেতে শুনল, নাকে হাত রেখে দেখল—নিঃশ্বাস পড়ছে। একেবারে স্বাভাবিক মুখ। সুখি ছুটে এসেছে। আসতেই বলল, ধরো। পায়ের দিকটা ধরো। প্যান্ট-শার্ট পরনে। সে জামার বোতাম আলগা করে দিল। দৌড়ে গেল বাথরুমে—জল এনে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিল। আর দেখছে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছেন সোনাবাবু। কিন্তু সাড়া নেই। ডাক্তার, ডাক্তার দরকার। কে আছে আর সোনাবাবুর, সে জানে না। সুখিদিকে বলল, সুখিদি, তুমি পাশে থাকো। আমি আসছি। ব্যাগ থেকে একটা চিরকুট বের করে দ্রুত লিখল, সাহেব, আমার বড় বিপদ। সোনাবাবু কেমন করছেন। শীগির সেলিম ডাক্তারকে নিয়ে চলে আসুন।
তারপর পাগলের মতো সে ছুটে বের হয়ে গেল। গহরকে চিঠি দিয়ে বলল, সোনাবাবু অসুস্থ কেউ নেই। একদন্ড দেরি করবে না। শীগগির চলে যাও। সাহেবের কাছে চলে যাও।
গহর দেখল, মেমসাবের মুখে বিষাদ। থমথম করছে মুখ। কী বিপদ সে জানে না। কিন্তু প্রিয়জনের কষ্ট মানুষকে কতটা কাতর করে এই পরী—হুরীর মুখখানি না দেখলে বোঝার উপায় থাকে না। গোটা রাজবাড়িতে খবরটা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। ফতিমা শিয়রে বসে কপালের ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছে—আর শুধু সময়ের অপেক্ষা। সে জানে আলম সাহেব ছাড়া এ-মুহূর্তে তার নিদারুণ বিপদের গুরুত্ব কেউ টের পাবে না। অপরিচিত লোকজন সব। দরজায় এসে দাঁড়াচ্ছে। সে কাউকে চেনে না। সে কে তারাও জানে না। এক অপরিচিতা নারী শিয়রে বসে আছে অতীশবাবুর।
কুম্ভবাবু, নধরবাবু, রাধিকাবাবু, কুম্ভবাবুর স্ত্রী হাসি আর রাজবাড়ির সব আমলারা ঘিরে আছে। হাসপাতালের কথা বলছে, ডাক্তারের কথা বলছে, তাকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। এই রাজবাড়ির অভ্যন্তরে এত মানুষজনের বাস আছে সে আগে টের পায় নি। জানালার ও-পাশে পাতাবাহারের গাছ। ওখানে মানুষজনের ভিড়। সে শুধু বলছে আপনারা ঘরে ঢুকবেন না। ভিড় করবেন না। প্লিজ। মুহূর্তের মধ্যে কারা যেন স্থির করে ফেলেছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। রাজবাড়ির গাড়ি হাজির। তবু তো সময় লেগে যায়। সে বলতেই পারছে না, ফুল স্পীডে পাখা চালিয়ে দিয়েছে। আনাড়ি সে, জানে না কী করলে সোনাবাবুর কষ্ট লাঘব হবে।
এরই মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কথাবার্তা শুনে সে জেনে ফেলেছে, কারা এসেছিল, সোনাবাবু কখন অফিসে আসে, কোন পথে আসে কখন যায়—তবে সেই অনুসরণকারীরা সোনাবাবুর ভেতরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাঁর জীবন জখম করতে চায়। একজন সুদর্শনা রমণী ঢুকতেই সবাই রাস্তা করে দিচ্ছে। তিনি এসে পায়ের সামনে দাঁড়ালেন। অতীশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং কাকে যেন নির্দেশ দিলেন কোনো নার্সিংহোমের সঙ্গে কথা বলতে।
প্রায় যখন তারা ঠিকই করে ফেলেছে, তুলে নিয়ে যাওয়া হবে সোনাবাবুকে, তখনই সহসা সে কেন যে উন্মাদের মতো বলতে থাকল, না না। উনি না এলে আমি ওঁকে তুলে নিতে দেব না।
কুম্ভবাবু স্তম্ভিত। বউরাণীর মুখের উপর কথা বলছে! কে এই নারী?
সুখিকে ইশারায় ডেকে বলল, কে তিনি!
সুখি বলল, টুটুলের পিসি হয়!
সুতরাং জোর খাটাবার যে অধিকার আছে যুবতীর, যে অনায়াসে বলতে পারে, না। না তো এ- ভাবে পড়ে থাকবে! কিন্তু অধিকারের প্রশ্ন। বৌদি বাসায় নেই। বৌদির বাপের বাড়ির ফোনের কী নাম্বার তাও তারা জানে না। তারা ঠিকই করতে পারছে না এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়।
বউরাণীও যেন জোর হারিয়ে ফেলছে।
আর তখনই স্যুট-কোটপরা দুজন পুরুষের আবির্ভাব। ফতিমার কাছে এটা এ-মুহূর্তে আবির্ভাবের শামিল।
—ফতিমার বুকে জল এসে গেছে।
—টুটুল মিণ্টুকে স্কুলে দিয়ে এসে দেখছি—সে আর বলতে পারছে না। তার স্তব্ধ চোখে-মুখে জল ফেটে বের হয়ে আসছে।
আলম সাব ঝুঁকে দাঁড়ালেন।
ফতিমা টিনের চেয়ার টেনে আনল। সেলিম নাড়ি দেখলেন। চোখ টেনে দেখলেন। প্রেসার নিলেন। স্টেথোস্কোপ বসালেন বুকে। পিঠে। সব স্বাভাবিক। তিনি বললেন, হাসপাতালে নেওয়া চলবে না। তিনি বললেন, একটু গরম জল। ফতিমা নিজের মধ্যে ছিল না। সে ছুটে গেল রান্নাঘরে। তোলা উনুন। একটা স্টোভ। সুখিকে বলতে পারত, কিন্তু সবাই কেমন উচাটনে পড়ে গেছে। কেবল সে ক্রমে স্থির এবং অবিচল থাকার চেষ্টা করছে। সে গরম জল করে নিয়ে গেলে দেখল, আরও একজন কে ছুটে আসছেন। তিনি যে এই রাজবাড়ির দন্ডমুন্ডের কর্তা, বুঝতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না। সেলিমকে বললেন, আরে আপনি!
শহরের সেরা একজন ডাক্তার রাজবাড়ির অন্দরে! এমন প্রভাবশালী মানুষ থাকতে পারে তিনি ছাড়া, যার একডাকে চলে আসতে পারে ডাক্তার সেলিম!
কুমার বাহাদুর বললেন, কী বুঝলেন?
মনে হচ্ছে, মানসিক অবসাদে হয়েছে। ভয়ের কিচ্ছু নেই। ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হতো। তাঁকে ডেকে দিন।
ফতিমা বলল, আমাকে বলুন। বৌদি এখানে নেই। কুম্ভবাবু লোকটিকে সে আগে দেখেছে। কুম্ভর কাছে গিয়ে সে বলল, আপনি বৌদির কাছে লোক পাঠিয়ে দিন।
কুম্ভ বলল, তিনি তো বর্ধমানের দিকে কোন গাঁয়ে আছেন। কোথায় তা জানিনা।
—সুখিদি, তুমি জানো!
সুখিও বিশেষ কিছু বলতে পারল না।
আশ্চর্য, এত নিঃসঙ্গ সোনাবাবু! তাঁর স্ত্রীর খবর কেউ রাখে না। এখানে আর কারা আছেন, যাঁদের খবর দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। দেখা গেল টুটুলের মামার বাড়ির খবরও কেউ রাখে না। বালিগঞ্জে টুটুলের মামার বাড়ি, এইটুকু খবর ছাড়া বিশেষ কিছু জানা গেল না।
সেলিম তাকালেন আলম সাবের দিকে। আলম সাব বললেন, কাছের বলতে আপনাদের মেমসাব ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই দেখছি।
তিনি বললেন, একটা কাজ করতে হবে। আচ্ছন্নভাব কেটে গেলে, প্রিয়জনের সান্নিধ্যই তাঁকে আরোগ্যলাভ করাবে। তিনি ভেঙে পড়েছেন। যা শুনলাম, তাতে তো মনে হয়, দীর্ঘদিন থেকেই তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছেন।
কুম্ভ বলল, একবার তো কাউকে না বলে না কয়ে বৌদির কাছে চলে গেছিলেন।
—কবে সেটা?
—তা পাঁচ-সাত মাস হবে। মাঝে মাঝে ঘোরে পড়ে যেতেন।
—কিসের ঘোর।
—তা জানি না। এমনিতে সব ঠিকঠাক থাকে। সরল সোজা মানুষ। কাজপাগলা মানুষ। মাঝে মাঝে তাঁর এক কথা, পচা টাকার গন্ধ। তখনই দেখছি, কী অফিসে, কী বাড়িতে গোছা গোছা ধূপবাতি জ্বালিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। ইদানীং কিছু ছোকরা অফিসে এসে খবর নিয়ে গেছে, তিনি কখন অফিসে যান। ফেরেন। কয়েক মাস আগে পাশের এক তেলকলের ম্যানেজার খুন হলেন। নকশাল প্রচারপত্র পড়েছিল খুনের জায়গায়।
অতীশ সোজা পড়ে আছে বিছানায়। ভীষ্মের শরশয্যা যেন। মনে হচ্ছে সব বুঝতে পারছে অথচ কথা বলতে পারছে না, চোখ মেলে তাকাচ্ছে না। কেবল নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া কোথাও বিন্দুমাত্র জীবনের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সেলিম বললেন, মেমসাব বড় ঝামেলায় পড়ে গেলেন। ঠিক আছে সাহেব। এটা থাকল—এই ওষুধগুলো দিতে হবে। বলে আলম সাবের হাতে প্রেসক্রিপশন তুলে দিলেন। তারপর ফতিমাকে ইশারায় বাইরের চাতালে ডেকে নিয়ে গেলেন সেলিম।
ফতিমা অতি কষ্টে বলল, কী বোঝলেন, খুলে বলুন। আমার কাছে কিছু লোকাবেন না।
সেলিম সব শুনেছেন রাস্তায়। আলম সাবই তাঁকে বলেছেন। এ তো আর শুধু তাঁর সোনাবাবু না। স্বপ্নের মানুষ। শৈশবের টুকরো টুকরো ছবিও আলম সাব হাসতে হাসতে সেলিমকে বলেছেন! জানেন তো আমার বেগমসাহেবা অবুঝ। কিন্তু এমন দরাজ দিলও কারো মধ্যে দেখিনি।
ফতিমাকে সেলিম বললেন, জ্ঞান ফিরলে, তাঁর প্রিয়জনকে দেখতে চাইবেন। বড় দরকার প্রিয়জনের সান্নিধ্য। আপনি পারবেন?
—পারব।
—তবে আর আশঙ্কার কিছু নেই। অতীশবাবুর স্ত্রী না আসা পর্যন্ত আপনার এখানে থাকা দরকার।
—থাকব।
আলম সাব সেলিমকে নিয়ে চলে যাবার মুখে ফতিমা ছুটে গেল। বলল, সাহেব, একটা কথা।
—বলেন।
—এদিকে আসুন।
আবার আলমকে চাতালে নিয়ে এসে ব্যাগ থেকে দুটো দশ টাকার নোট বের করে দিয়ে বলল, পীরের দরগায় সিন্নি দিয়েন সোনাবাবুর নামে। দোয়া মাঙবেন আল্লার কাছে। দু-একদিন আপনার অসুবিধা হবে। বৌদি এলেই আমার নিষ্কৃতি মিলবে।
আলম সাব বললেন, শেষে আপনার স্বপ্নের মানুষ, এখানে এসে উঠলেন! কিচ্ছু নেই!
ফতিমা একটা চাবি বের করল রিঙ থেকে। চাবিটা আলম সাবকে দিয়ে বলল, দুটো সাদা চাদর, বালিশের পাটভাঙা সাদা ওয়াড়, একটা পাশ-বালিশ পাঠিয়ে দেবেন। আর ফুলদানিটা। আপাতত গিয়েই এগুলো গহরভাইকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন মনে করে।
আর কিছু!
আর কিছু গোলাপ ফুল। সাদা লাল দুরকমের গোলাপ।