।। উনিশ।।
ফোন ছেড়ে দেবার পরই অতীশ ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল। এতক্ষণ ফোনে কি কথা হয়েছে বউরাণীর সঙ্গে তার একটা কথাও মনে করতে পারছে না। কেবল কোন সুদূরে একটা বড় কাঠের ঘোড়া দেখতে পাচ্ছে। সেই অতিকায় কাঠের ঘোড়া ক্রমে বড় হতে হতে আকাশ সমান উঁচু হয়ে গেছে। সেই ট্রয়ের ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে সামনে। শৈশবে এই কাঠের ঘোড়া পেলে, তার আর কিছু লাগত না। শিশু বয়স পার হলে কেউ তার কাঠের ঘোড়াটা কেড়ে নিল। তারপর কাঠের ঘোড়া না থাকলেও সে স্বপ্ন দেখত ঘোড়াটার। তার সপ্তম অথবা অষ্টম শ্রেণীতে আবার কাঠের ঘোড়াটা এসে গেল। ট্রয়ের ঘোড়া, হেলেন অফ ট্রয়। আশ্চর্য এক দেশ ট্রয় নগরী। রাজবধূর নাম হেলেন। কেমন স্বপ্নময় জগৎ। তরবারি, রথ, লোহার বর্ম, প্রায়ই মনে হত, সে সেই মহাযুদ্ধের এক সৈনিক। হেলেনকে আবার সে যেন উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনছে। সেই থেকে মাঝে মাঝে স্বপ্নেও দেখত কাঠের ঘোড়াটাকে। তখন তার জীবনের সুষমা বলতে সব কিছু সেই কাঠের ঘোড়া। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সে তাও হারিয়েছে —হিজিবিজি হয়ে গেছে সব। কি করে যে সব হয়ে যায়, কত সব গোলমেলে বিষয়—অথবা কখনও মনে হয়েছে বনি তার সেই হেলেন, তাকে কেউ তার জীবন থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। তারপর সব কেমন আবার হিজিবিজি, সে এক জগৎ ছেড়ে নতুন অন্য এক ট্রয় নগরীতে প্রবেশ করেছে। কি হবে জানে না।
তখনই মনে হল, ফ্যাক্টরির মধ্যে কিছু সোরগোল। সুপারভাইজার ছুটে আসছে। ধরাধরি করে কাউকে বাইরে এনে মাথায় জল ঢালছে। তার হুঁশ ফিরে আসে। সুপারভাইজার বলছে, স্যার মাধব বমি করছে।
অতীশ বলল, বমি করছে কেন?
তখন কর্মীদের বেশ একটা বড় জটলা, ওরা হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছে গেটের সামনে। সে বুঝতে পারছে না কি ব্যাপার। কোন দুর্ঘটনা হতে পারে। সেজন্য গন্ডগোল।
মনোরঞ্জন বলল, হাসপাতালে পাঠালে ভাল হয়।
—কি হয়েছে?
—রক্তবমি। কাশতে কাশতে হয়েছে।
—ওকে আগেই বললাম এক্সরে কর। খুক খুক কাশি, জ্বর ভাল না।
মনোরঞ্জন হাসল। ঠোঁটে বিদ্রূপ। অতীশ খেয়াল করেছে। সে বলল, এখানে এনে লাভ কি। আমি এর কি বুঝি! ই এস আই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।
আসলে সে ভয় পেয়ে গেছে। বাতাসে জীবাণুরা ঘোরাফেরা করে। নিশ্বাস নিতে পর্যন্ত ভয় করছিল তার।
কিছুটা বলির পাঁঠার মতো মাধবকে ধরে এনে ওর অফিসের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন সব কিছুর জন্য দায়ী অতীশ। এই যে রাজরোগ তার মূলে সে, শোষণের ক্ষেত্র তৈরি করছে সে. বীজ বপন করছে সে। এখন সে না সামলালে কে সামলাবে। সে বলল, কুম্ভবাবু তো নেই। ও আসুক। আপাতত তোমরা ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। বলে সে দশ টাকার একটা নোট ক্যাশ থেকে বার করে মনোরঞ্জনের হাতে দিল।
মনোরঞ্জন টাকা মেলে দেখল। চলবে কিনা, কারণ সর্বত্র জাল কারবার, কাজেই বিশ্বাস করা কঠিন, এবং যখন রিকশা করে নিয়ে চলে গেল, অতীশ কেমন কিছুটা হাল্কা বোধ করল। এতক্ষণে মনে হল, মাধবকে সে একটা কথা বলতে ভুলে গেছে। তারপরই ভাবল কথাটা কি, কথাটা কি হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, ছেলেবেলায় মাধবকে কেউ কাঠের ঘোড়া কিনে দিয়েছিল কি না! সে কাঠের ঘোড়া বগলে নিয়ে হেঁটে ছিল কিনা। তারপর কেউ সেই কাঠের ঘোড়া চুরি করে নিয়ে যায়! কিন্তু পরে মনে হল, এ-সব প্রশ্ন করলে তার মাথা খারাপ আছে ভাবতে পারে। অথবা বলতে পারে, স্যার ঘোড়া তো আপনারাই চুরি করেছেন।
কুম্ভ ফিরে এসে যেই শুনল, অমনি ফায়ার! দশটা টাকা দিলেন! একটা ব্যাড প্রিসিডেন্ট তৈরি
করলেন।
—তা ছাড়া কি করব!
—জানেন না, ই এস আই আছে। ই এস আই সব করবে।
—জানি।
—তাহলে আমরা খরচ করব কেন! পাবলিক মানি আপনি খুশিমত খরচ করতে পারেন না।
—এ সময়ে এতটা দেখলে হয় না।
কুম্ভ বলল, যা খুশি করুন। আপনার পাঁঠা লেজে কাটেন ঘাড়ে কাটেন কার কি দেখার আছে। দশটা টাকা জলে ফেললেন।
অতীশ কেমন একটু মাথা গরম করে ফেলল, আপনারা কি ভাবেন কুম্ভবাবু, এমন অসময়ে কিছু দিলে কোন ক্ষতি হয় না।
—জলে গেল আর কি! আগুনে পুড়িয়ে দিলেও যা এও তাই। আপনি ভাবছেন দশ টাকায় রোগ সেরে উঠবে!
—তা উঠবে না।
—তবে। দশ টাকায় যখন রোগ সারবে না, দশ টাকায় যখন বাঁচানো যাবে না তখন আপনার জেনে শুনে কোম্পানির টাকা নষ্ট করা ঠিক হয় নি।
আসলে কুম্ভ চায়, যে কোনও লেজ ধরে ওপরে বেয়ে ওঠা। যে কোন ভাবে। এই যে এখন অতীশবাবু তাকে না বলে টাকাটা দিল, দেবার হক অবশ্যই আছে তার, কিন্তু দিলেই সে ছেড়ে দেবে কেন? সেও জানে, কি করে কাকে সুতোয় নাতায় কব্জায় আনতে হয়। দোষ ধরার মতো আনন্দ কুম্ভ আর কিছুতেই উপভোগ করতে পারে না। আর এরেই বলে খেলা। এরেই বলে হাসিরাণী, তুমি তারে লক্ষ্মীর পট কিনে দেবে, আমি তারে পূজা করব। তুমি যা খুশি তাই করবে, আমি আন্ধার মতো সহ্য করব, এবং কত গুরুতর বে-আইনী কাজ, সেটা সমঝে দেবার জন্য বলল, দাদা আপনার এই একটাই দোষ। সব কিছু সংসারে নিজের ভাবেন।
অতীশের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কর্পোরেশনের লোকটাকে সে ফিরিয়ে দিয়েছিল, আড়াইশ টাকায় রফা, তার মধ্যে লোকটা তাকে খোলাখুলি বলেছিল, একশ টাকা পেয়ে থাকি, বাকিটা কর্পোরেশনের খাতায় জমা পড়ে। কত অবলীলায় লোকটা কথা বলতে পারল। মানুষের সামান্য সম্ভ্রম বোধ থাকলে এ-ভাবে কখনও কথা বলতে পারে না। আর যা হয়ে থাকে তার ভেতরে গোঁয়ার লোকটা তখন তেরিয়া হয়ে যায়। সে বলেছিল, এখন যান। পরে ভেবে দেখব। সে এইটুকু মাত্র বলেছিল, আর তাতেই মানে লেগেছে, চা না মিষ্টি না। চা মিষ্টি খাইয়ে টাকাটা যেখানে হাত জোড় করে দিতে হত, সেখানে এই নবীন লোকটি, নবীন না ভেবে, মাথায় গন্ডগোল আছে ভাবতে পারে, কারণ এ-কালে এমনভাবে কেউ কথা বলতে পারে সে বিশ্বাসই করে উঠতে পারেনি। পরে কুন্তবাবু ক্যাচটা মিস করতে চায়নি। প্রাণপণ দৌড়ে সেটা লুফে নিয়ে গেছে রাজার বাড়িতে। প্রথমে রাধিকাবাবু পরে কাবুল বাবু আরও পরে সনৎবাবু—পাবলিক মানি বলে কথা। পাবলিক মানি ড্রেনেজ হবে ভেবে কুম্ভবাবু বড়ই অস্থির হয়ে পড়েছিল। নতুন অ্যাসেসমেন্ট হলে দেড় দু হাজার সোজা কথা! তখন আবার আর এক দফা।
অতীশ গুম মেরে আছে আর কিছু চালান সই করে দিচ্ছে। কুম্ভ উঠছে না। সহজে উঠবে না। সে আবার এই দশ টাকার বিষয়টি নিয়ে সবার কান ভারি করবে। এই হয়েছে জ্বালা। এখন যেন কুম্ভ তার সামনে এক অতিকায় প্রতিপক্ষ। তারে যায় না ফেলা, দিনে দিনে ঘাড়ে চেপে বসছে। কিছুক্ষণ আগে বউরাণী ফোনে অনুরোধ করেছে টাকাটা দিয়ে দিতে। সে বুঝতে পারছে জল অনেক ‘দূর গড়িয়েছে। কিন্তু কুম্ভটা উঠছে না কেন। সে যেন এই লোকটার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও ভয় পাচ্ছে। পাছায় লাথি মেরে উঠিয়ে দিলে কেমন হয়। কুম্ভ বেশ আরাম করে তবু বসে থেকে কয়েকবার হাই তুলল। মুখের উপর তুড়ি মারল। কিছু লোক গেটে দাঁড়িয়েছিল, তাদের কুম্ভ ধমক দিল।—তোরা এখানে জটলা করছিস কেন! তারপর প্রিন্টারকে ডেকে বলল, জনার্দন ব্রাদার্স কমপ্লেন করেছে। স্যাম্পলটা নিয়ে আসুন।
অতীশ চোখ তুলে তাকাল না। শুধু একটা মাকড়সা দেখতে পেল। মাকড়সাটা জাল বুনে যাচ্ছে। সে আরোও মনোযোগী হয়ে পড়ল। যেন এক্ষুনি ক্যাশটা মিলিয়ে রাখা দরকার। চেকগুলো ব্যাংকে পাঠানো দরকার। গ্যাঞ্জেস কোম্পানির সেলট্যাক্স ডিক্লারেশনগুলো ঠিক আছে কিনা দেখা দরকার। কুম্ভ প্রিন্টিং দেখছে দেখুক। আসলে অতীশ বুঝতে পারে কুম্ভ কিছুই দেখছে না। ক্ষোভ জ্বালা থেকে তার এসব হচ্ছে। যদি কর্পোরেশনের লোকটাকে টাকা না দিয়ে থাকতে পারে তবে কুম্ভ আরও ভয়ঙ্কর ভাবে জেদি হয়ে উঠবে। সঙ্গে এই দশটা টাকার বিষয় মাথার ঘিলুতে লেপ্টে আছে তার।
প্রিন্টার মণিলাল, একটা সিট এনে দেখাল। সামনে কৌটার স্যাম্পল ধরে রাখল। কুম্ভ বলল, এক রং হল! বাফ কালার ঠিক আসছে মনে করেন!
প্রিন্টার বলল, ঠিকই ত আছে বাবু।
—ঠিকই আছে! কুম্ভ কপাল কুচকাল।
প্রিন্টার অতীশের দিকে সিটটা নিয়ে গেল।—স্যার দেখুন ত।
অতীশ সবই বোঝে। কিন্তু কি বলবে ভেবে পেল না। ঠিকই আছে। খুঁত ধরতে গেলে সহজেই ধরা যায়। নিখুঁত মাল এখানে আশা করা ঠিক না। এবং এখানে সব রঙই প্রিন্টারের ঘিলু থেকে বের হয়ে আসে। কাজ করতে করতে জেনেছে, কোন রঙের সঙ্গে কতটা অন্য রঙ মেশালে আর একটা রঙ ফুটে বের হবে। কোন নিক্তির মাপ নেই। মণিলালকে নিয়ে পড়ার অর্থ যে কোন ভাবেই কুম্ভ জেনেছে, প্রিন্টারটি তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। যেমন কাবুল রাজবাড়ির এজেন্ট, তেমনি কুম্ভ ও এখানে তার এজেন্ট রেখে দিয়েছে। ম্যানেজারের পক্ষে কে কি কথা বলে সহজেই তার কানে আসে। মণিলালটা কুম্ভর বিরুদ্ধে ঠিক কিছু বলেছে, এবং মণিলালকে নিয়ে পড়ার অর্থই হচ্ছে, কেউ পার পাবে না। সাঁড়াশি দিয়ে টেনে বক্র জিভ বের করে ফেলবে! কেন যে বোকার মতো বলতে যায়! সে বলল, ঠিকই ত আছে।
ঠিক যে নেই তা প্রমাণ করার জন্য কুম্ভ এবার উঠে দাঁড়াল। বলল, দাদা বাইরে আসুন। দেখবেন এ-আলোতে বুঝতে পারবেন না।
অতীশ বুঝল, কুম্ভ প্রমাণ করবেই। সে মণিলালকেই বলল, একটু দেখে শুনে কাজ করুন। কমপ্লেন হলে আমাদের সবার ক্ষতি। রুটি রোজগার সব ত এখানে। যান।
মণিলাল চলে গেলে কুম্ভ বলল, তবু মুখের ওপর বেয়াড়া তর্ক করে।
অতীশ ক্যাশবুক বন্ধ করে বলল, বোঝে না।
কুম্ভ সিগারেট ধরাল। বেশ দামী সিগারেট, তিন আঙুলে চারটা সোনার আংটি। চার রকমের পাথর, গোমেদ, মুনস্টোন, পলা এবং নীলা। বছরখানেক ধরে সে নিজের গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান নিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে করতে কখন হাত দেখার চর্চা যে তার মাথায় ঢুকে গেছিল! হাত দেখা শিখছে, কিরোর বইও কিনে ফেলেছে। অবসর সময় সে এখন হস্তরেখা বিচার চর্চা করছে। যেন হস্তরেখায় তার অগাধ বিশ্বাস। এবং এই রেখা সম্পর্কিত বিষয়টি অধীত বিদ্যার মধ্যে পড়ে গেলে অনেক অনেক গূঢ় কাজ উদ্ধার করতে সমর্থ হবে। কুম্ভ বলেছিল, দাদা পৃথিবীটা বড় গোলমেলে। কিছু তুকতাক জেনে রাখা ভাল। শেষে বেশ খোস মেজাজে কুম্ভ বলল, কাল শোনলাম ভোজ খাচ্ছেন।
অতীশ ভাবল, আরে এ যে সত্যি অন্তযামী, সে তার বিস্ময় গোপন করতে পারল না। কুম্ভ টের পেয়ে বলল, ডুবে ডুবে জল খান মনে করেন সতীলক্ষ্মী টের পায় না।
অতীশ বলল, কাল অমল খেতে বলেছে।
—অমল! কুন্ত ভীষণ স্তম্ভিত গলায় বলল, অমল মানে!
—বউরাণী।
—দাদা, মাইরি আপনার হাতটা দিন দেখি।
অতীশ বলল, আপনি ত জানেন, আমি এ সবে বিশ্বাস করি না।
—দেখি না। এমন করছেন কেন! আপনি সত্যি পারেন। সত্যি দাদা, আপনার মতো লোক হয় না। বলেই উঠে এসে টুক করে প্রণাম সেরে বলল, পাবলিক মানি না ছাই। যা খুশি করুন। স্ক্র্যাপের টাকা আগের বড়বাবু খেত। আমি যখন চার্জে ছিলাম, কুমারবাহাদুর খেত। আপনি আসায় চক্ষুলজ্জায় বন্ধ আছে। তবে বন্ধ বেশিদিন থাকবে না। থাকতে পারে না। এখন সেটা কোম্পানি খাচ্ছে। খাওয়াটাই মোদ্দা কথা। কেউ খেলেই হল। না খেলে ঈশ্বরের বংশ নাশ বোঝলেন না, দিন হাতটা দেখি।
—কি ছেলেমানুষী করছেন!
—পার্ক স্ট্রীটের বাড়িতে যেতে বলেছে কেন বলুন ত!
—জানি না।
—ওটা লীলাক্ষেত্র। বউরাণী লীলা করেন ওখানে।
এ-সময়ে অতীশের মাথায় আক্রোশ চেপে যায়। কার ওপর আক্রোশ সে বুঝতে পারে না। বউরাণী, আর্চি বনি না নির্মলা। তখনই কুম্ভের সোনা বাঁধানো সামনের দাঁতটা ঝিলিক মেরে উঠল। ঠিক সেই লীলাক্ষেত্রে কুম্ভ যেন দাঁত বের করে হাসছে।
অতীশ কেমন ভয় পেয়ে গেল। কুম্ভ আর্চি পাশাপাশি দুটো মু·, জ্বলছে নিভছে। জোনাকি পোকার মতো উড়ে যাচ্ছে, খপ করে ধরতে চাইল একটাকে। পিষে মারতে চাইল। অথচ হাত ফাঁকা। খালি মুঠো। আকাশ নিবিড় অন্ধকার এবং বুঝতে পারছে আজ গিয়ে আবার না সেই প্রেত্মাতার ভয়ে পড়ে যায়। তার মুখ কালো হয়ে গেল। সে আর কিছু না বলে উঠে পড়ল।
সে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। মিণ্টু টুটুল ঠিকঠাক বাসায় আছে ত! যা দুষ্টু হয়েছে, কখন বের হয়ে যায়, আর সেই পুকুর পাড়ে আমলকী বনে পরী খুঁজে বেড়ায়। পরীদের নেশায় পেয়েছে টুটুলকে। আসলে এই নেশাতেই মানুষ বুঝি বড় হয়। যেন সামনে সব সময় অলৌকিক কিছু আছে, কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য। যেমন মনে হয় তার সে বাসায় ফিরেই কোনো সুখবর পেয়ে যাবে। কেউ তার জন্য নীল খামে সুন্দর চিঠি রেখে যাবে। চিঠিটা কার তার জানা নেই। তবু প্রত্যাশা সব সময়, সুদূর থেকে আসবে চিঠিটা। লেখা থাকবে, সবাই ভাল আছে, সবাই মঙ্গল মতো আছে, অথবা মনে হয়, কোনও চিঠি, কোনও প্রকাশক, পত্রিকা তার লেখা চেয়ে পাঠিয়েছে। অথবা কোনও চিঠি, নীল খামে চিঠি, সুন্দর হস্তাক্ষরে কেউ জানিয়েছে আপনার জন্য আমরা অপেক্ষা করে আছি।
অতীশ হেঁটে বাসায় ফিরছে। মনের মধ্যে একটা নীল পোকা হুল ফুটিয়ে বসে আছে। মাধবটার টিবি, নির্ঘাত টিবি, তার বাবা মা নেই। সে একাই থাকে, একাই খায়। দশ টাকা বড়ই অমূল্য ধন, কুম্ভবাবু এ-নিয়ে আরও বাড়াবাড়ি করত। করবে না যে তাও এখন বলা যায় না; কুন্তবাবু সব কিছু সময় বুঝে কোপ মারে। কোপটা দিন যায় ঝুলে থাকে, কোপটা দিন যায় ওঠে নামে, তারপর অমাবস্যা পূর্ণিমা দেখে নামিয়ে দেয়। এই দশটা টাকা সে পকেট থেকে দিয়ে দেবে শেষ পর্যন্ত ভাবল। একজন রুগ্ণ মানুষের জন্য কোম্পানির হয়ে তার এটাও করার উপায় নেই! সে কোন কোন পয়েন্টে আক্রমণ হবে তাও জানে। কুম্ভ করবে না। করবে সনৎবাবু। সনবাবুকে দিয়ে কুম্ভ সব করাবে। কাল কিংবা পরশু ক্যাশবুক যাবে। রোজকার একাউন্ট পাশ করার শেষ মানুষ তিনি। নামের আদ্যক্ষর বসিয়ে নিচে তারিখ দেবেন। তিনিই বলবেন, দশ টাকা! দশ টাকা বলতে গিয়ে সনৎবাবুর মুখ বিস্ময়ে লম্বা হয়ে যাবে।
তারপরই তার প্রশ্ন মিণ্টু টুটুল তোমাদের মা কি শুয়ে আছেন! আজও পেটের ব্যথাটা কি উঠেছে। মাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। তোমাদের মা বুঝি আর পেরে উঠছে না। তোমরা মাকে দেখ। এবং যেটা হয়, বাড়ি ফিরে কেমন এক বিষণ্ণতা, নির্মলার সে সুন্দর হাসিখুশী মুখ নেই। নিত্য অভাব। অতীশ একে অভাব মনে করে না, কিন্তু নির্মলা মনে করতে শুরু করেছে! বিশেষ করে বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এলে তার এটা হয়। নির্মলা নিজের পছন্দ মতো মানুষকে বিয়ে করেছে। বাপের বাড়িতে অভাবের কথা বলতে পারে না। ওরা বুঝতে পারেন, কিন্তু এগিয়ে আসতে সাহস পায় না। সেখানে অতীশের অহংকার দরজায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
সে হাঁটতে হাঁটতে বলল, কি করব নির্মলা, আমি ত সাঁতার কাটছি। তারপরেই বলল, ঠিক পাড়ে উঠে যাব। কিন্তু তারপরই চারপাশের মানুষজন, ফুটপাথে ভিখারি, সেই গাছটা, নিচে আঁস্তাকুড় থেকে তুলে আনা খাবার সব কেমন মাথার মধ্যে কিলবিল করে ওঠে। সে আর আগের মতো সাহসী থাকতে পারে না।
আগে থাকতেই সাবধান হওয়া ভাল। রাজবাড়ি ঢোকার মুখে একটা বড় স্টেশনারি দোকান তার চেনা। সে দুটো প্যাকেট কিনে ফেলল। এই ধূপকাঠির প্যাকেট দেখলে নির্মলা গুটিয়ে যায়। ব্যাগের মধ্যে সাবধানে রেখে দেওয়া দরকার। মিণ্টুর আবার ব্যাগ হাতড়াবার স্বভাব। বাপ কি আনল। সে তার শিশুদের জন্য টফি নিয়ে যেত, কিন্তু নির্মলা বায়োসায়েন্স পড়া মেয়ে। সে খুব অপছন্দ করে। দাঁত নষ্ট হয়, তুমি কেন যে আন। সুতরাং সে এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে নিল। কিছু নিতেই হয়, এবং বেলা পড়ে আসছে। বেশ লম্বা ছায়া হয়ে গেছে গাছের। গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ভয় পায়, যেন এক্ষুনি দারোয়ান বলবে; স্যার শিগগির বাড়ি যান, এবং যখন দেখল, না আর দশটা দিনের মতোই সেলাম ঠুকছে, খুব গম্ভীর হয়ে আছে, তখন বাসায় সব কিছু ঠিকঠাকই আছে। এবং যা আশা করে থাকে, মিণ্টু টুটুল রাস্তায় তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে। চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল, মিণ্টু টুটুল তোমরা কোথায়! এখনও দু’ হাত তুলে ছুটে আসছ না কেন? এবং তারপরই সেই শিশুরা, মাঠ থেকে দৌড়াতে শুরু করে, বাবা বাবা। আমার বাবা। মাথার মধ্যে যা কিছু অস্বস্তি সব কেমন জল হয়ে যায়। বাবা, বাবা আমার বাবা। অতীশ নিজের ভিতর থেকে বলে ওঠে, হাঁ, আমি তোমাদের বাবা। সংসারে আমি বাদে তোমাদের কেউ নেই। তার চোখে জল আসে।
টুটুল দু’হাত বাপের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাবাকে দেখেই সে আর হাঁটতে পারছে না। পায়ে জোর পাচ্ছে না মতো দাঁড়িয়ে আছে। অতীশ টুটুলকে বুকে তুলে নিতেই মিণ্টু বাবার পায়ে পায়ে দৌড়াতে থাকল। আর অজস্র কথা। সারাদিন টুটুল কি কি খারাপ কাজ করেছে হাজার ফিরিস্তি। যেতে যেতে বলল, জান বাবা, বউরাণী টুটুলকে দুষ্টুমী করতে বারণ করেছে। পুকুরপাড়ে টুটুল ঢিল ছুঁড়ছিল। বউরাণী, টুটুলকে বাড়ি দিয়ে গেছে। টুটুল, কিছুতেই বউরাণীর কোলে উঠবে না। সারাটা পুকুরপাড় ছুটে বেড়িয়েছে দু’জনে।
অতীশ বলল, তোমাকে নেয়নি?
—না বাবা। আমি দাঁড়িয়েছিলাম। বউরাণী আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেছিল। আমি ত বড় হয়ে গেছি।
—পুকুরপাড়ে ভাইকে নিয়ে যেও না। কত জল, জলের নিচে শেকল থাকে। ধরে নেয়। কত বলেছি তোমাদের।
—টুটুল না বাবা ভয় পায় না।
বাবার কোল থেকে টুটুল দিদির সব অভিযোগ শুনছে। সে কিছু বলছে না। সে শুধু হাত নাড়িয়ে বলল, এত বড় মাছ বাবা।
—ওটা মাছ না! শেকল। জলে ভেসে মানুষকে লোভে ফেলে দেয়।
—আমার কিছু করে না বাবা।
অতীশ মনে মনে ফের সেই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। নির্মলাকে বার বার বলেছে, দরজা বন্ধ করে রাখবে। দরজায় তালা মেরে রাখলেই হয়। বারবার বলেও এটা করাতে পারে নি। কিন্তু এত সবের পরে বউরাণী এসেছিল, এই চিন্তাটাই তাকে আবার ভাবনায় ফেলে দিয়েছে, কাল খেতে বলেছে অমল। নির্মলার শরীর কেমন থাকবে কে জানে। এখানে আসার পর সহসা নির্মলা সব উদ্যম কেমন হারিয়ে বসে আছে। নির্মলার আশা ছিল কলকাতায় সে কোন একটা ইস্কুলে চাকরি পেয়ে যাবে। দু’জনে কাজ করলে, সংসারের অভাবটা এত বড় হয়ে দেখা দেবে না। যত দিন যাচ্ছে, তত সে ভেবে নিয়েছে এখানে কিছুই হবার নয়। এছাড়া বাইরে গেলে, দু’সংসার। ছেলেমেয়েদেরই বা কার কাছে রাখবে। অতীশ নিজে খাক বা না খাক, কর্তব্যবোধে পঙ্গু। বাড়িতে মাস গেলে বেতনের একটা বড় অংশ পাঠাবেই। বোঝে না, মিণ্টু টুটুল বড় হচ্ছে। সংসারে কেউ কারো না। এই সব সাত- পাঁচ চিন্তায় শরীরে ঘুণ ধরে গেছে নির্মলার। অতীশ বাসায় ঢোকার আগে বলল, মা শুয়ে আছে?
মিণ্টু বলল, মা তোমার জন্য পুডিং বানাচ্ছে।
অতীশ বুঝল, নির্মলা আজ ভাল আছে। সে সারাদিন পর এই একটা আশাতেই বাড়ি ফেরে। নির্মলার বিষণ্ণতা কেটে যাক। মাঝে মাঝে আজকাল কথা কাটাকাটি হয়। তিক্ততা দেখা দেয়। অতীশ বুঝতে পারে, এই তিক্ততা তার অক্ষমতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে। বাড়িতে টাকা পাঠাবার সময় নির্মলার অভাব আরও বেড়ে যায়। কেমন অবুঝের মতো হয়ে ওঠে নির্মলা। শহরে আসার আগে এমন ছিল না। তখনই মনে হয়, সে কি ছিন্নমূল হয়ে যাচ্ছে। বাবা কি এই ভয়টাই করেছিলেন। বাবা চিঠিতে বার বার লিখছেন, তুমি ভাল নেই অতীশ। শেকড় আলগা হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ঘুরে যাও। ভাল লাগবে। নিজেই যেতাম। ঠাকুরের নিত্য পূজা কে করে। জমিতে চাষের সময়। কখনও লেখে জমিতে ফসল তোলার সময়, মার শরীর ভাল যাচ্ছে না। তোমরা সবাই সংসার থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছ।
দরজায় দেখল নির্মলা। বেশ খুশী। রুগ্ণ মুখে কোথায় যেন প্রাণের সাড়া। টুটুলকে বলল, ধেড়ে ছেলে, বাপের কোলে উঠে বসে আছে। নাম। বাবাকে কষ্ট দেয় না। টুটুল কি বোঝে কে জানে। সে নেমে পড়ল। মিণ্টু যাও, বাবার পাজামা পাঞ্জাবি বাথরুমে রেখে এস। তারপর অতীশ দেখল, নির্মলা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেমেয়েরা কেউ কাছে নেই। লম্বা বারান্দায় স্বামী-স্ত্রী। অতীশ নির্মলার চোখে আশ্চর্য সজীবতা লক্ষ্য করে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। কাছে গেল। ডাকল, নির্মলা।
—নির্মলা বলল, বউরাণী তোমার চেনা?
—হ্যাঁ।
—তোমার দেশের মেয়ে?
—হ্যাঁ।
—কৈ আগে বলনি ত!
—বলার কি আছে নিৰ্মলা।
—বউরাণী ত কত কথা বলে গেল!
—সবই নালিশ তো।
—তাছাড়া কি! বলল, তোমার মরণ হল না মেয়ে, এই হতচ্ছাড়ার সঙ্গে ঘর করছ!
—তাই বুঝি! সে নির্মলার দিকে তারপরও তাকিয়ে থাকল। বউরাণী যদি আরও কিছু বলে থাকে।
—তুমি নাকি দশটা কথা বললে একটা কথা বল।
—কি জানি, বুঝি না।
—আমাকে বার বার বলল, অতীশকে আমি এতটুকুন দেখেছি। মুখচোরা স্বভাব। দেখেশুনে রেখ। আমরা ছাদে খেলতাম, নদীর পাড়ে হেঁটে যেতাম। তারপর নির্মলা কি ভেবে বলল, এ সব তুমি ঘুণাক্ষরেও বলনি।
—বললে কি হত?
তোমাকে কত ভালবাসে। আজ ত দেখে গেল, বলল, বাসার এই ছিরি। লোক এলে বসতে দিতে পার না বৌমা। ওটা যে কবে মানুষ হবে!
অতীশের বুকটা গুরগুর করে উঠল। বউরাণী নির্মলাকে লোভে ফেলে দিতে চায়। অমল তুমি আর যাই কর করুণা দেখিও না। ওটা আমি সহ্য করতে পারি না। আমার মধ্যে স্বপ্নের এক মানুষ বড় হয়ে উঠছে। সেই শৈশব থেকে, আমি পৃথিবীর গ্রহনক্ষত্র গুণে গুণে বড় হয়েছি। অনেক বড় আর বিশাল সে ব্রহ্মান্ড। আমার মধ্যে এক সুন্দর বালিকার প্রেম রুপোর কৌটোয় ভরা আছে। আমি মানুষের সামান্য করুণার ভিখিরি না অমলা। তুমি নির্মলাকে আর যাই কর লোভে ফেলে দিও না। এমনিতেই ওর বাড়ির প্রাচুর্য তাকে কষ্ট দেয়। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়ালে তুমি দু’হাত তার ভরে দেবে যদি বুঝতে পারে তবে আমার আর দাঁড়াবার ঠাঁই থাকবে না। লক্ষ্মী মেয়ে, আর যাই কর, এত বড় সর্বনাশ কর না।
—খাবার কথা বলে যায়নি!
—বলেছে।
—তুমি যাচ্ছ ত?
—বারে যাব না। কী ভাল। বলল, আমাকে বউরাণী ডাকবে না! পিসি ডাকবে। ওর সম্পর্কে আমি পিসি হই।
তাহলে নির্মলা ওর ভাইপোর বৌ। সম্পর্কটা বেশ পাতিয়েছে। নির্মলার সরল বিশ্বাসে সে টোকা মারতে চাইল না। বলল, তা পিসি হয়।
—তুমি নাকি পিসি বলে ডাক না। কত বলেছে, সেই ছেলেবেলাতে তোমাকে কত বলেছে, পিসি বলে ডাকবি, তুমি ডাকতে না। নাম ধরে ডাকতে।
—তখন অত বুঝতাম না নির্মলা।
—এখনই বা কি বোঝ! নিজের ভালটা সবাই বোঝে, কুম্ভবাবু কত বলছে কি একটা রফা করলে তোমার টাকা খায় কে! তুমি কিছুতেই মাথা পাতছ না। বার বার আমাকে বলল, বৌদি দাদাকে বুঝিয়ে বলুন। কমিশনে সর্বত্র কাজ হয়। কমিশন তুমিই বা নেবে না কেন! এটা ত আর চুরি না।
কুম্ভর কথায় মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না। কতদিন পর নির্মলার মুখে হাসি দেখতে পেয়েছে। চোঁখ সজীব, যেন বসুন্ধরার মতো শস্য শ্যামলা হতে চায়। এমন সুসময় সে মাথা গরম করে হেলায় হারাতে পারে না। মানুষের নিজের মধ্যেই থাকে বিজবিজে ঘা। রেহাই নেই। ক্ষেত্র তৈরি থাকে, শুধু হামলে পড়া। সে কেমন নিস্তেজ গলায় বলল, তুমি কি বললে?
—বললাম বুঝিয়ে বলব। তবে জানেন ত, যা বোঝে, তার বাইরে যায় না। এমন কি বাবাও পারেন নি। বাবার এত ঈশ্বর বিশ্বাস তার ছেলে কি হয়েছে চোখের উপরই দেখছেন।
নির্মলা হাত থেকে ব্যাগটা নেবার সময় সে বলল, তাহলে কমিশন নিতে বলছ?
নির্মলা ঘরের দিকে যাচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে বলল, কুম্ভবাবু যদি নিতে পারে তুমি নেবে না কেন?
অতীশ পেছনে পেছনে হেঁটে যাচ্ছে। সে পায়ে জোর পাচ্ছে না। তার মিণ্টু টুটুল বড় হচ্ছে। সে দেখল, টুটুল দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে বাবাকে উঁকি দিয়ে দেখছে। বাবা এখন খাবে। বাবা কতক্ষণে বাথরুমে যাবে, সে আর না পেরে বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাথরুমের দিকে। এখন টুটুলের কাছে বাবার সঙ্গে খাওয়া বাদে আর কোনও সমস্যাই নেই। অতীশ সামান্য বিরক্ত গলায় টুটুলকে বলল, যাচ্ছি। সে এখনও নির্মলার পেছনে যেতে চাইছে। সে ফের বলল, কুম্ভবাবু যা পারে আমি তা পারি না নিৰ্মলা।
নির্মলার গলার ঝাঁঝ শোনা যাবে সে ভেবেছিল। কিন্তু সে এও জানে অফিস থেকে এলে নিৰ্মলা কোনও ঝাঁঝ রাখে না গলায়। যা কিছু অভিযোগ রাতের খাওয়া হয়ে গেলে। অতীশের মধ্যে কিছু ছেলেমানুষী রাগ আছে। খুব তিক্ত বোধ করলে, সে খেতে পারে না। মাথা গরম হয়ে গেলে সারাদিন সে না খেয়ে থাকে। এবং এটা নির্মলা জানে বলেই খাইয়ে-দাইয়ে আজকাল সব অভিযোগ তোলে। আর এও জেনে ফেলেছে নির্মলা, সে রাগ বেশিক্ষণ পুষে রাখতে পারে না।
নির্মলা বলল, হাত-মুখ ধুয়ে নাও। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?
অতীশ তক্তপোশে বসে আবার বলল, কুম্ভ কখন আসে?
—তুমি চলে গেলেই।
—আর কি বলে?
—কি বলবে, বলে দাদাকে বলবেন, এটা কলকাতা শহর। একটা মানুষও নেই যে ধান্দায় না ঘুরছে।
—ধান্দা! কিসের ধান্দা?
—সে তো জিজ্ঞেস করি নি। সে তো কাল থেকে পারুলের মাকে কাজে আসতেও বলে দিয়েছে।
—কত দিতে হবে?
—তাতো বলে নি। বলল দাদার সঙ্গে কথা হবে। তারপরই নির্মলা কেমন ঠান্ডা গলায় বলল, ভারি ভাল মানুষ।
অতীশ পা নিচে রেখে বালিশে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। সে অনেক দূর থেকে যেন আবার বলছে, কমিশন নিতে বলছ?
নির্মলা ও-ঘর থেকে শুনতে পায় নি। নির্মলা বলল, কিছু বলছ?
অতীশ উঠে বসল, বারান্দায় ছুটে গেল। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল, হ্যাঁ বলছি।
নির্মলা অতীশের চোখ দেখে কেমন অবাক। ঠান্ডা মেরে গেল। সেই চোখ লাল, গোল গোল কেমন স্থির হয়ে আছে। ধূপকাঠি জ্বেলে বসে থাকলে তার এমন হয় দেখেছে। নির্মলা হাতে প্লেট নিয়ে একেবারে হিম হয়ে গেল। যেন কেঁদে ফেলবে।
অতীশ বুঝল, এ-বাড়ির মধ্যে সেই প্রেতাত্মা ঠিকই আছে। কুয়াশার মতো সে হেঁটে বেড়ায়। পাতাবাহারের পাতায় তারপর জল হয়ে লেগে থাকে। অদৃশ্য সেই দুষ্ট আত্মার সঙ্গে সে পারবে কেন! শুধু বলল, কুম্ভবাবুর ঈশ্বর আছে নির্মলা। তার মাথার ওপরে ঈশ্বর আছেন। সে পারে। আমার কিছু নেই। আমি পারি না। আমি একেবারে একা।
নির্মলা বলল, তুমি একা কেন। আমরা কি তোমার কেউ না?
অতীশ এবার দুঃখে হেসে ফেলল। তারপর আর কিছু বলল না। বাথরুমে হাত-মুখ ধুল। প্লেটে পুডিং চা, তিনখানা গরম স্যাকা রুটি। একটা গোল টেবিলে রেখে গেছে নির্মলা। চা আসছে। মিণ্টু টুটুল, দু-পাশে দাঁড়িয়ে। অতীশ নিজে মুখে দেবার আগে তার দুই সন্তানের মুখে রুটি পুডিং দিল। এখন টুটুল খুব ভাল ছেলে! দু-হাত মাথায় ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে দেখছে, বাবার খাওয়া দেখছে। মিণ্টু বাবার গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কে কতটা আগে গিলে ফেলতে পারে এবং হাঁ করা মুখ দেখলেই বাবা টের পাবে, সে খেয়ে ফেলেছে। নির্মলা জানে বলেই ডাকছে, তোমরা এখানে এস। তোমাদের খাবার দিয়েছি। কেউ গ্রাহ্যি করছে না মার কথা। নির্মলা বুঝতে পারছে না, বাবার সঙ্গে খাওয়ার কি এত আরাম। মানুষটা তার দুই সন্তানকে আরও কাছে নিয়ে থাকতে চায়। যেন ভয়, সর্বত্র সেই যে বলে না, এক অজগর হেঁটে বেড়ায়, সে শুধু গ্রাস করে—সেই গ্রাস থেকে বাঁচবার জন্য তার নিরন্তর এক শঙ্কা। সে বলল, মিণ্টু তোমার টাস্ক করে ফেল। টুটুলকে সে এখন মুখে মুখে পড়ায়। বিদ্যারম্ভ না দিয়ে লেখাতে পারছে না। বাবা বার বার চিঠিতে লিখেছে, সোনা তুমি আর যাই কর বিদ্যারম্ভ না দিয়ে টুটুলের পড়াশোনা শুরু করবে না। নির্মলাও বাবার এ-সব বিশ্বাসের অংশীদার। এ সময়ে ওরা দুজনই তার প্রতিপক্ষ। সে তাই বলল, পিতামহের নাম কি টুটুল?
টুটুল ঠিক ঠিক বলল।
তোমার প্রপিতামহের নাম? বৃদ্ধ প্রপিতামহের নাম এই করে অতীশ তার বংশতালিকা সহ এক বিশাল পটভূমির কথা টুটুলকে বলে যাচ্ছিল। কারণ এটা হয়, সে যখন বুঝতে পারে, তার চারপাশে নিয়ত এক ভয়াবহ প্রেতাত্মা নাচছে তখন তার সম্বল সেই শৈশব এবং নদীর পাড় অথবা বালিয়াড়ি এবং শস্যক্ষেত্র। সেখানে সে বড় হয়েছিল, সেখানে সে সোনালী যব গমের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখেছিল। এ-সব কথা বংশ পরম্পরায় বলে যেতে পারলে পাপ খন্ডন হবে। তাহলে সে একদিন না একদিন সেই ভয়াবহ পাপ থেকে ঠিক মুক্তি পাবে।
নির্মলা ঠিক তখনই বলল, তোমার তো কেউ নেই? টুটুলকে কাদের কথা এত বলছ? তুমি না বলেছিলে একা, খুব একা!
অতীশ তখনও বলে যাচ্ছিল আমাদের ভারি সুন্দর একটা তরমুজ খেত ছিল। আমি যখন তোমার মত ছোট্ট ছিলাম, ঈশম দাদা আমাকে নিয়ে তরমুজের ওপর বসিয়ে রাখত। তখন দূর দিয়ে পাগল জ্যাঠামশাই হেঁটে যেতেন। একবার একটা হাতি এসেছিল। হাতির পিঠে আমি আর পাগল জ্যাঠামশাই। হাতির কথায় আসতেই টুটুল দু’হাতে বাবাকে গলায় জড়িয়ে ধরল, বাবা আমাকে হাতি কিনে দেবে? আমি হাতির পিঠে উঠে পরী ধরব।
এই হয় মানুষের। হাতি পরী রাজহাঁস ময়ূরপঙ্খী পক্ষীরাজ কত কিছু দরকার মানুষের। টুটুলেরও দরকার। তারও দরকার, তার বাপ ঠাকুরদা সবার দরকার ছিল, এই করে মানুষ বড় হয়ে ওঠে। এই সব ধরতে ধরতে মানুষ বড় হতে চায়। অথচ শূন্য খাঁ খাঁ প্রান্তরে হেঁটে যাওয়া শুধু, তারা বোঝে না। অতীশ টুটুলকে বলল, তোমাকে আর কি কি কিনে দিতে হবে?
—ঘোড়া দেবে। ঘোড়ায় চড়ব। গাড়ি দেবে, আমি আর দিদি গাড়ি চড়ব। মা সামনে। তুমি পেছনে বসবে। তারপর কু-উ-উ-উ-উ।
—আর?
—আর, আর? বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকল। যেন অথৈ জলে পড়ে গেছে টুটুল।
—বল, বল!
অনেক ভেবে এবং হাতড়ে শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেল টুটুল। বাবার পেটে মুখ লুকিয়ে চুপি চুপি বলল, একটা রাজার টুপি।