।। তেত্রিশ।।
শীতের সকালে মাধা রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকে। গায়ে নোংরা ছেঁড়া কাঁথা। শীতটা শরীর থেকে যেতেই চায় না। পোকা-মাকড়ের মত আটকে থাকে। শীতকালে এই একটা সুবিধা, তার স্নানটান করতে হয় না। জীবনের সব কাজই তার কাছে এখন বাতিল ন্যাকড়ার মত। যতটা কম নড়ে চড়ে থাকা যায়। সারাদিন খুকখুক করে কাশি। রাতে কাশির উপদ্রব বাড়ে। ঘুম হয় না। সকালে আর এক উপদ্রব, বাঞ্ছা এসে বলে গেছে, হাসপাতালে যেতে হবে। আজই।
কথাটা শুনেই মাথাটা গরম হয়ে আছে মাধার। সে সাফ বলে দিয়েছে—যাবে না। এতদিন শুনে আসছে ই এস আই থেকে বেড পেলেই তাকে ঝুপড়ি ছাড়তে হবে। সে ত কবে থেকেই শুনে আসছিল কান দেয়নি। সিট মেটালের সে ওয়ার্কার। বস্তির মধ্যে তার থাকার জায়গা পর্যন্ত মেলেনি। সংসারে সে একা। ক্যানিং লাইনের ট্রেনে চেপে সেই যে শহরে ছুটে এসেছিল সংমায়ের তাড়া খেয়ে, আর ওদিকটায় ফিরে যায় নি! শহরে থেকে সে দেখেছে, ফুটপাথ বড় প্রিয় জায়গা। সেই প্রিয় জায়গা থেকেই সিট মেটালের হেলপার হয়ে গেছে। ঠিকানা সে বদলায় নি। এখন নাকি তাকে ঠিকানা বদল করতে হবে। সে রাজি না।
গোরাকে বলেছে, তোরা রুখে না দাঁড়ালে সব যাবে।
গোরা বলে গেছে, কোন শুয়োরের বাচ্চা আছে তোকে তোলে! কত ক্ষেমতা দেখব।
পারুলকে বলেছে, সকালে আসবে বাবুরা।
পারুলের এক কথা, তোর রাজরোগ। ও রোগের কোন ওষুধ নেই। খামোকা ঝুপড়ি ছাড়তে বললে রাজী হবি না।
পচারও এক কথা, হাঙ্গামা হুজ্জতি হবে বলে দিস। আমরা মরে যাইনি।
তা পচা, গোরা হাঙ্গামা হুজ্জুতি করতে ওস্তাদ। তার ঝুপড়ি ওদের একটা বড় ঠেক। পারুলকে নিয়ে তারা ফূর্তিফার্তা করে—কালীমার্কা আর কাঁচা ছোলা খায়—সে তখন গাছতলায় বসে এনামেলের বাটি বাজায়, দু-চার পয়সা বাবুরা দেয়। ই এস আইয়ের দৌলতে টনিক ক্যাপসুল পায়। সে দিনমান এনামেলের বাটি ঝাঁকিয়েও দু-পাঁচ টাকা সারাদিন কামায়। বড় কাশির উৎপাত। আর শরীর একেবারে কাকলাশ! চোখ জবা ফুলের মত লাল, গিরগিটির মত চামড়া শরীরের। পারুলের মাথায় খুশকি, উকুন, পাগলী গোছের—যখন যা মুখে আসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খিস্তিখাস্তা করে। তেল চিটচিটে শাড়ি পরে থাকে। দুর্গন্ধ শরীরে—সেটা তার না পারুলের এখন আর টের পায় না মাধা।
কিন্তু সকাল থেকে কি যে হুজ্জুতি শুরু হয়েছে। কারখানা থেকে ইউনিয়নের পাণ্ডা মনোরঞ্জন বলে গেছে, বাবুরা এলেই কাগজপত্র নিয়ে আসব। রেডি থাকবি।
—কোথায় যাব।
—শালো জান না কোথায় যাবে! যমের বাড়ি। ঝুপড়িতে পড়ে মরে থাকলে ইউনিয়নের দুর্নাম। সিট মেটালের দুর্নাম।
—খেতা পুড়ি দুর্নামের। একদম ঘেঁষবে না। আমার কোন অসুখ নেই। অ পারুল শোন কী কয়!
—আচে কী নাই ঠেলা খেলে বুঝবি।
—বললাম তো আমার কোন অসুখ নাই। বাড়াবাড়ি করলে হাঁক মারব। অ পারুল, ডাক গোরা, পচাকে।
—হাঁক মেরে করবিটা কী! ডাক না।
—দেখবে? অ পচারে, আমারে মেরে ফেলল রে। তখন পারুল ছুটে গেছে ডাকতে। অ পচারে… রে…।
কোথা থেকে পাঁচ সাতজন যন্ডামার্কা লোক এসে হাজির।
—কী হুজ্জুতি জুড়েছেন দাদা। ব্যারামি নাচারি লোকের সঙ্গে কচলা কচলি কেন করছেন দাদা! মনোরঞ্জন বস্তি এলাকার সবাইকে চেনে। সবকটা ওয়াগন ব্রেকার। জেল হাজত কোনও বিষয় নয়। থানার বড়বাবু তাদের মামা হয়। ভাগ্নেরা মনোরঞ্জনকে তড়পাবে বেশি কি?
কুম্ভবাবু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। অতীশবাবুকে বলছে, আপনি যান দাদা। আমরা দেখছি কী করা যায়। অতীশ কী ভেবে অফিসে ফের ফিরে গেছে। মনোরঞ্জন এসে বলল, হামারজাদা চিৎকার করে লোক জড় করছে। মহা ঝামেলা। হাসপাতালে যেতে চাইছে না। ঝুপড়ি ছাড়বে না বলছে।
কুম্ভবাবুর সাহস নেই একা যাবার। কারখানার বাঞ্ছা যাদব দারোয়ান সঙ্গে। মনোরঞ্জনকে একা পাঠিয়ে একবার পরখ করে দেখল, বিষয়টা কতটা গোলমেলে। থানা পুলিশের যদি সাহায্যের দরকার হয়। কী করবে ঠিক করতে পারছে না। ঝুপড়ির দখল ছাড়তে মাধা রাজি না।
এই ই এস আইয়ের বেড পাওয়া নিয়ে কী লড়ালড়িটা না তার গেছে! তার ম্যানেজার বাবুটি ত বেশি ঝামেলা দেখলে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকবেন। মর শালা তুমি!
–এই যাদব তুই যা একবার। বুঝিয়ে বল।
—আপনি সঙ্গে চলুন।
—মনোরঞ্জন! কুম্ভ আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, ছোঁড়াগুলো কারা? চলে গেছে, না আছে! প্রতাপের দুই বেটা, যাদবের ভাইপো একটা। বাকি তিন চারটেকে দেখেছি। খালপাড়ে ডেরা আছে। নাম জানি না।
—কী করবে তবে?
—আপনি বুঝিয়ে বলুনগে। যদি রাজি হয়!
সহসা কুম্ভর ভয় ধরে গেল কেমন—এ কী ফ্যাসাদ—বলে কিনা অসুখ নয়! দু-দুবার রক্ত বমি করেছে কারখানায়। ই এস আইয়ের ডাক্তার প্লেট তুলে বলেছে, টি বি—ভিতরে ঢুকতে দেবেন না। বস্তির যে খুপরিটায় থাকত, খবর পেয়ে তারাও মরিয়া, এক সকালে এসে কুম্ভ দেখেছিল মাধা তার পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে অফিসের রোয়াকে বসে আছে, আর খুকখুক করে কাশছে। বিড়ি টানছে নির্বিকার চিত্তে। মাধা সবাইকে যজাতে চায়। এক তাড়া লাগিয়েছিল, ভাগ বেটা—কিন্তু ভাগ বললেই সে শুনবে কেন, কারখানার কর্মী, উদাস চোখে বলেছিল, যাইটা কোথায়! বলে শেষে একটা পরিত্যক্ত ধ্বসে পড়া মন্দিরের বোয়াকে এসে উঠেছিল—তারপরত মৌরসিপাট্টা। ঝুপরি তুলে পারুলকে নিয়ে বলতে গেলে বোধহয় সুখেই ছিল।
সেই কুম্ভ এখন গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে, যদি ভাগ্নেরা থাকে, মাধা হাসপাতালে কিছুতেই যাবে না। ইউনিয়নের পান্ডাদের হাতে কাগজ পত্র দিয়ে পাঠাবে—গেলে যাবে, না গেলে শালো ঝুপড়িতে ঠান্ডায় পড়ে মরে থাকবে। কার কি করার আছে। কী ব্যাপার, আপনারা যান নি?
কুম্ভ দেখল দেরি দেখে ফের অতীশবাবু নিজেই চলে এসেছেন। সে পই পই করে বারণ করে এসেছে আপনি কারখানার ম্যানেজার, আপনার যাওয়া ঠিক হবে না! কারখানার ইজ্জতের কথা ভেবেই বলা, তা শুনল না! চলে এসেছে আবার! কাউকে বিশ্বাস করে না! দাঙ্গা হাঙ্গামা হতে পারে এমন ভয়ও দেখিয়ে এসেছে। আরে নিজের জীবনটা তো আগে। অফিসে ঢুকেই বুঝেছিল কুম্ভ, মাধাকে ঝুপড়ি থেকে তুলতে গেলে তার ফান্ডামেন্টাল রাইটে হাত দেওয়া হবে। মাধা তাড়া খেয়ে শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত একটা মন্দিরের রোয়াকে আশ্রয় নিয়েছিল—বেড পেলে তুলে নেওয়া যাবে। ব্যাটা যে এত ধূরন্দর সে জানবে কী করে! নেশা ভাঙের অভ্যাস আছে। গাঁজা খায় তাও জানত। উপার্জন, পয়সা কড়ি সব ওতেই উবে যেত। এখন মাধা নানা দিক থেকে গেরস্ত মানুষ; পারুল বলে একটা ফুটপাথের আধা-পাগলী তার ঘরে শোয় পর্যন্ত। এত সব খবর পাবার পরই সে ম্যানেজারবাবুর কাছে প্রটেকসানের কথা তুলেছিল। শুনল না। আপনারা না যান, আমি যাচ্ছি, বুঝিয়ে বললে মাধা বুঝবে। ওর ভালর জন্যই করেছি, খারাপ ত কিছু করছি না। ভয়ের কি আছে।
কুম্ভ বলল, যাওয়া ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না।
—কেন?
—মনোরঞ্জন তাড়া খেয়েছে!
—কারা তাড়া করল?
—ভাগ্নেরা।
অতীশ কেমন চোখ ছোট করে ফেলল। কুম্ভবাবুর উপর অনেক বিষয়েই তাকে নির্ভর করতে হয়। কুম্ভ তাকে খুশি করার জন্য নানাভাবে তোয়াজ করেও থাকে—তবে সম্পর্কটা একই বাড়িতে থাকে বলে দাদা ভাই পাতিয়ে নিয়েছে, কিন্তু কোনদিন রসিকতা করেনি। ভাগ্নেরা বলে রসিকতা করছে কুম্ভ! কপাল তার কুঁচকে গেল। কার জোর বেশি পরখ করা যাক, ভাগ্নে না মামার! ভয় পান ত আমিও না হয় আপনাদের সঙ্গে মামার ভূমিকায় নেমে পড়ি।
তুমি মামা সাজাতে চাও। কেন? যাও তবে। দেখ ভাগ্নেরা কী আদরযত্ন করে! তারপরই মনে হল,যা গোঁয়ার স্বভাবের মানুষ, তাতে মামা সেজে চলে যেতেই পারে। কিন্তু পরে রাজবাড়িতে কৈফিয়ত—কিছু হলে তার চাকরি নিয়ে টানাটানি। কুমার বাহাদুর বলবে, তুই তো জানিস অতীশকে, বউরাণী ডেকে পাঠাবে, তোরা কোথায় ছিলি, হ্যাঁ তোদের দিয়ে আর কারখানা চালানো যাবে না। অতীশকে সঙ্গে নিলি!
এমন ভাবতেই কুম্ভর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ভাগ বললে যাবে কোথায়! সেও তখন আর এক মাধা! সাত পাঁচ ভেবে বলল, আপনি যাবেন না। দেখছি কী করা যায়!
যাদবকে পাঠাল কুম্ভ। তুমি গিয়ে বল।
যাদবের সুপারিশেই হেলপারের কাজ দিয়েছিল মাধাকে। বস্তির অশ্বত্থ গাছের নিচে পড়ে থাকে, বিশ-বাইশ বয়সের তাগড়া ছোকরা, যাদবের বউকে দিদি বলে ডাকে, কারখানায় চলে এলে মাধা দিদির কাছে গিয়ে নাকি বসে থাকে, আদরযত্ন খায়। তা সোমত্ত বউ ঘরে একা থাকলে একটা আতঙ্ক যে থেকেই যায়। মাধার উৎপাত আর বউয়ের সায়া শাড়ি খুলতে গেলে এমন ভাব করত, যেন সে জোর করে ধরে এনে ধর্ষণ করছে। কাঁহাতক ভাল লাগে! কাজ হলে বাড়ির উৎপাত থেকে রক্ষা পাবে ভেবেই ধরেছিল কুম্ভবাবুকে।
—তোমার কে হয়?
—আমার শ্যালক।
—তা শ্যালক এসে কাঁধে চেপে বসেছে।
যাদব কারখানার পাঞ্চ মেশিন চালায়, ডাইসপত্রের কাজ ভাল বোঝে, ছোট্ট একটা কারখানার পক্ষে যাদবের মত সব কিসিমের কাজ জানা কর্মীর খুবই দরকার। কাজে মন দিতে পারছে না। কারখানার লোকসান। যখন তখন যাদব নাগা করছে, এ-সব ঝুট ঝামেলা যে মাধাকে কেন্দ্র করে বুঝতে অসুবিধা হয়নি কুম্ভবাবুর—প্রডাকসন ঠিক না হলে আগেকার ম্যানেজার তাকে ছেড়ে কথা কইত না, এমন বহুবিধ কারণে শ্যালকের চাকরি না দিয়ে পারে নি। পরে শুনেছিল মাধা যাদবের কেউ হয় না। মাধা কাজটা হতেই ফুটপাতে গিয়ে উঠেছিল। তখন আর একজন হেলপারের মাইনে কত! অতীশবাবু আসার পর এক লাফে তিনগুণ মাইনে বাড়তেই মাধা বস্তির একটা ঘরে আশ্রয় পেয়েছিল—কিন্তু যা হবার আগেই হয়ে গেছে। খুকখুক কাশি, জ্বর, তারপর মেশিনের উপরই রক্ত বমি।
কুম্ভ এবার বিশ্বনাথকে পাঠাল।
অতীশ বলল, আপনারা আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সবাই চলুন এক সঙ্গে! বিশ্বনাথকে একা পাঠিয়ে কী হবে!
কুম্ভ বলল, যাদবের শ্যালক, বিশ্বনাথের দেশের লোক। একে ওকে ধরে চেষ্টা হচ্ছে। বিশ্বনাথ এসে বলল, না স্যার যাবে না। হাতে লাঠি নিয়ে ঝুপড়ির দরজায় বসে আছে। বলছে,
কোন শালা আসে দেখব।
—একা? কুম্ভ প্রশ্ন করল।
—না একা না। ফুটপাথের পাগলীটা ঘরে বসে চিনেবাদাম নিজে খাচ্ছে, মাধাকে ছাড়িয়ে দুটো একটা দানা দিচ্ছে।
কুম্ভ বলল, ব্রেকফাস্ট সাড়ছে তবে
তারপর অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, ব্রেকফাস্টের সময় যাওয়া কি ঠিক হবে দাদা?
—হবে, চলুন।
এভাবে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকলে বস্তির লোকজনের কৌতূহল বাড়ে।
—স্যার আপনারা এখানে! কী ব্যাপার!
—ব্যাপার কিছু না। সব তো খুলেও বলা যায় না। কুম্ভ আর পারল না। যা আছে কপালে হবে। রাস্তায় লোকজন যাচ্ছে। সকালে এক কিসিমের লোক যায়—তারা গঙ্গা স্নানে। তারপর আর এক কিসিমের লোক যায়—তারা যায় তেলকলে কাজ করতে। রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত। কিন্তু তিন চারটা তেলকল এ জায়গাটায় আছে বলে গেরস্ত মানুষের ঘরবাড়ি কম। নেই বললেই চলে। শুধু মোড়ে যতীন সাহার টিন প্লেটের আড়ত। দোতলা বাড়ি। একতলার ছাদ কাঠের পাটাতনের, দোতলার ছাদ টিনের। এখানকার সব বাড়ি ঘরই এ-রকমের। রাজার বস্তি—বস্তির মধ্যে থেকেও কেউ কেউ যে মাসে লাখ লাখ টাকার কারবার করতে পারে যতীন সাহাকে না দেখলে বোঝা যায় না।
বাড়িতে তার চার পাঁচ পুত্রবধু, বিঘেখানেক জমি দখল করে আছে। ওরা দোতলার জানালায় দাঁড়ালে মাধার কান্ড কারখানা দেখতে পায়। যতীন সাহা আবার সিট মেটালে টিনপ্লেট সাপ্লাই করে। সেই সুবাদে অতীশের সঙ্গে ব্যবসার সম্পর্ক আছে। কোটার টিনে হয় না। কারখানা চালু রাখতে গেলে খোলাবাজারে টিন কিনতেই হয়। অতীশের তখনই যে কেন মনে হল, সাহাদের বউ মেয়েরা বড় রূপসী হয়। যতীন সাহার ছোট মেয়েটা একদিন তাকে দু চোখ ভরে চুরি করে দেখার সময় অতীশের কেন জানি মনে হয়েছিল, নারীর জঙ্ঘায় একই জোনাকি পোকা দপদপ করে জ্বলছে। সব নারীর জঙ্ঘায়। চারুর কথা মনে হল তার।
চারুকে নিয়ে বউরাণী খাপ্পা। চারুটা কে? চারু যে তাকে সব দিয়েছে।
নির্মলা অসুস্থ না থাকলে চারুর কথাটা বোধহয় মাথায় থাকত না। আজও অফিসে বের হবার সময়, নির্মলার হাতের কাজ অনেক এগিয়ে রেখে এসেছে। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর নির্মলা আজকাল ভারি কাজ ছাড়া প্রায় সবই করার চেষ্টা করে। অতীশের সকালে বড় তাড়া থাকে। বাজার, মিণ্টুকে স্কুলে দিয়ে আসা, বাথরুমের চৌবাচ্চায় জল ভরে রাখা, কিছু কাচাকাচি থাকলে তাও করতে হয়। সুখি ক’দিন থেকে জল বাটনা দেয়। কুম্ভবাবুই ঠিক করে দিয়েছে।
নির্মলা হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর মা এসেছিল প্রহ্লাদ কাকাকে নিয়ে। দু’দিনও থাকে নি। নির্মলা বাড়ির লোকজনের কথা উঠলে আজকাল খুবই তিক্ত ব্যবহার করে। ওর এক কথা,তোমার সঙ্গে বাড়ির শুধু টাকার সম্পর্ক।
অতীশ টের পেতে শুরু করেছে যেন সত্যি টাকার সম্পর্ক। তার এত বড় বিপদেও কেউ বাড়ি থেকে এসে থাকে নি। বাবার চিঠি পেয়েছিল শুধু–তোমার মাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছ। টুটুল মিণ্টু বাড়িতে একা থাকবে লিখেছ। কিন্তু তোমার মা যায় কী করে! অলকার পড়া আছে, হাসু ভানু স্কুলে যায়, গৃহদেবতার কাজ থেকে সব এক হাতে তোমার মা সামলায়। অলকাই যাবে কী করে! সামনে পরীক্ষা। দু-বার অকৃতকার্য হয়েছে, এবারে উঠে পড়ে লেগেছে—ওর কোন পাত্রের সন্ধান পেলে কি না জানাবে।
চিঠি লিখেছিল কাউকে পাঠাবার জন্য আর উত্তর এসেছে পাত্রের সন্ধান দেবার জন্য।
বাবার চিঠি সেখানেই শেষ নয়। বাড়িতে কালসাপ ফণা তুলে আছে। আমার রাতে ঘুম হয় না। ইষ্টদেবতার স্মরণই সম্বল। অলকার কী ব্যবস্থা করছ জানাবে। শহরে গিয়ে যে শেকড় আলগা হয়ে যাচ্ছে, তোমার নিস্পৃহ স্বভাব থেকে তা টের পাচ্ছি।
অতীশ তখন দেখল বিশ্বনাথও ফিরে আসছে। এটা অতীশের পছন্দ হচ্ছে না। কুম্ভবাবুর এত সব রোয়াব গেল কোথায়! আসার সময় শ্রীনাথকে খুঁজেছে। শ্রীনাথ থাকলে কিছুটা সুবিধা হবে অতীশ জানে। কিন্তু বেটা বস্তির কার ঘরে বসে চা খাচ্ছে কে জানে! তাকে খুঁজে বার করাই কঠিন।
অতীশ নিজেই হাঁটা দিল, আমি যাচ্ছি। বুঝিয়ে বলতে পারলে ঠিক যাবে।
কুম্ভ প্রমাদ গুনল। বলল, আমরা সবাই যাচ্ছি। আপনি বরং যতীন সাহার গদিতে গিয়ে বসুন। দরকার পড়লে খবর দেব।
যতীন সাহার গদি থেকে ঝুপড়িটা দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল যতীন সাহা গেলেই এত বেশি আপ্যায়ন শুরু করবে যে সহজে উঠতে দেবে না। চা মিষ্টি সিগারেট সাজিয়ে রাখবে। তাকে বেশ সমীহ করে কথা বলে। বাবার বয়সী মানুষটা তাকে দেখলেই উঠে দাঁড়ায়। হাত জোড় করে থাকে। ব্যবসার রীতি এইটাই বোধহয়। একটা কারণে যতীন সাহার অবশ্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার কথা। খোলাবাজার থেকে টিন তুললে আগেকার ম্যানেজার তার কাছ থেকে কমিশন নিত। বাজারে এটাই রেওয়াজ। কমিশন বাবদ তার প্রাপ্য টাকা লোক মারফত খামে ভরে পাঠালে, অতীশ ফোন করে বলেছিল আর কখনও পাঠাবেন না। এবার থেকে কমিশন বাদ দিয়ে টিনের দর ধরবেন। খামে যে টাকাটা গুনে দিয়েছিলেন ওটা ফের গুনে নেবেন। আপনার মত ধার্মিক মানুষের কাছে এটা আমি আশা করিনি।
যতীন সাহার কথাবার্তায় ঈশ্বর ঈশ্বর ভাব আছে। মাথার উপরে গণেশের ছবি। গলায় কণ্ঠি। সে গেলেই জাহাজের খবর নেবে—আপনি জাহাজে সারা পৃথিবী ঘুরেছেন! কী সৌভাগ্য, আপনাকে দেখলেও পূণ্য।
—ঘুরেছি। দেখে এবার পুণ্য সঞ্চয় করুন। মহাপ্রভুতে যখন হল না!
—কী করে গেলেন! কী সাহস!
—জাহাজী হয়ে। ওতে সাহসের কী আছে!
–সমুদ্রে খুব ঢেউ…. না?
—তা আছে।
যতীন সাহার ঐ এক স্বভাব। কথার শুরু সব সময় জাহাজ দিয়ে। অতীশ প্রথম আলাপেই টের পেয়েছিল, যতীন সাহা তার নাড়ি-নক্ষত্রের সব খবর আগেই নিয়ে নিয়েছে। সে এক সময় নাবিক ছিল, সে খবরও। তার লেখালেখির বাই আছে। দুটো উপন্যাস সিনেমা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায়, ছোট মেয়েটা তার খবর রাখে সব চেয়ে বেশি। সে গেলেই ও-পাশের দরজার আড়াল থেকে উঁকি মেরে তাকে দেখে। তখনই তার কেবল মনে হয়, নির্মলা কবে যে নিরাময় হবে! মানুষের শরীরে কী যে থাকে! তার লেখায় নারী মহিমার কথা একটু বেশি মাত্রাতেই থাকে। নারী মাত্রেই দেবী, এবং এমন সব জটিলতা সৃষ্টি করে তোলে নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে যে মনে হবে নারী হল ভাসমান নৌকা। পুরুষ তার উপর পাল খাটিয়ে বসে আছে।
অতীশ গদিতে ঢুকতেই যতীন সাহা উঠে বসল। সাদা ফরাসে বড় বড় তাকিয়া—তাতে ঠেস দিয়ে বসে থাকে। পাশের টেবিলে একজন বাবু খটাখট টাইপ করে যাচ্ছে কপির পর কপি—তার ক্লিয়ারিং এজেন্ট, তার প্রিন্সিপাল, ইমপোর্ট লাইসেন্সের সব কপি। টিন প্লেটের গুদামে কুলিদের চিৎকার চেঁচামেচি। নির্বিকার চিত্তে একের পর এক টাইপবাবু সব সামলায়। দুটো ফোনে অনবরত কথাবার্তা চলে—ভাও কেতনা, ডেমারেজ খাচ্ছে মাল, জাহাজ ভিড়ছে, আনলোডিং কবে হচ্ছে, তার লোক কবে যাবে, ট্রাক বোঝাই হয়ে কার ঘরে মাল পৌঁছে দেবে, এ সব নিয়ে সব সময় ব্যস্ত মানুষটা। সে গেলেই সব কেমন ঠান্ডা মেরে যায়। টাইপবাবু পর্যন্ত কাজ বন্দ করে দেয়। হাত ধরে অতীশকে টেনে গদিতে বসায়, তারপর একটা তাকিয়া পাশে ঠেলে দিয়ে বলে, আরাম করুন। সাহাবাবু তার মত দশ বিশ জন লোক পোযে, অথচ তার কী খাতির! সে ভেবে অবাক হয়ে যায়, মানুষটা এই ঘরে বসে কোথায় দারুচিনি পাওয়া যায়, কোথায় জায়ফল পাওয়া যায়, তার দর ভাও পর্যন্ত খবর রাখে। দুটো ফোন পৃথিবীর সব খবর এই গদিতে পৌঁছে দেয়! সেই সাহাবাবু আজ অন্য কথা বলল, মাধাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন শুনেছি।
—আর বলবেন না, যেতে চাইছে না।
গদিতে ধূপকাঠি জ্বলছে। সুঘ্রাণ পাচ্ছিল অতীশ। লোকটা কী জানে, তার জাহাজ বিকল হয়ে গেছিল সমুদ্রে। সে কী জানে বনিকে নিয়ে জাহাজ থেকে বোটে ভেসে পড়েছিল, লোকটার কথাবার্তা শুনলে অতীশের এমনই মনে হয়। না হলে রাজবাড়ির সব খবর লোকটা আগেই পায় কী করে। বউরাণীর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক সে খবরও রাখে। এই এক বিঘা জমি রাজার কাছ থেকে টেনেনসি রাইটে নেওয়া। রাজাকে ধরে যদি বেনামে কিছু করিয়ে নেওয়া যায়। অর্থাৎ একেবারে খাস তালুক বানাবার ফন্দি! মাঝে মাঝে সে পচা টাকার গন্ধ পায়, এ খবরও রাখতে পারে সাহাবাবু। তা না হলে সে গেলেই সুগন্ধী ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিতে বলে কেন! এইসব রহস্য টের পায় বলেই পারতপক্ষে অতীশ খুব দরকার না পড়লে সাহাবাবুর গদিতে যায় না। আর ওর ছোট মেয়েটা কলেজে পড়ে। সে গেলেই টের পায় মেয়েটা চঞ্চল হয়ে পড়েছে—সিঁড়ি ধরে দৌড়ে দোতলায় উঠছে, নেমে যাচ্ছে, ওঠানামার মধ্যে তার শরীর স্পষ্ট হয়ে উঠে। সুন্দরী মেয়েরা চঞ্চল হয়ে উঠলে সে কেমন ভিতরে ভিতরে নিজেও চঞ্চল হয়ে পড়ে। চুরি করে দেখার প্রলোভন জাগে। চারুকে নিয়ে সে যে একটা বিভ্রমে পড়ে গেছে তাও কী সাহাবাবু জানে। জানতেও পারে।
তখনই সাহাবাবু ডাকলেন, ওরে কে আছিস?
এই কে আছিসই যথেষ্ট। চা এবং মিষ্টি পর্ব শুরু হবে। অতীশ বলল, কিছু খাব না। এক গ্লাস জল দিতে বলুন!
—কী যে বলেন, সে হয়! আপনি এসেছেন, কী সৌভাগ্য আমার। কুম্ভবাবু তো বলে, আপনি মানুষ না দেবতা।
অতীশ এসব শুনে অভ্যস্ত। আসলে সে এও জানে কুম্ভবাবু তাকে দেবতা বলে না, বলে অপদেবতা। কারখানার ঘাড়ে অপদেবতা ভর করেছে। লাটে উঠল বলে। দু-নম্বরী মাল না হলে বন্ধ করে দেয়! কারখানার লক্ষ্মীকে তাড়িয়ে দেয়!
সাহাবাবু এ খবরটাও রাখে। সহসা সাহাবাবু বলল, অতীশবাবু একটা কথা বলি।
—বলুন।
—দোয নেবেন না বলুন। দোষ করলে নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন বলুন।
—ক্ষমা করে দেবার কথা উঠছে কেন!
—না, অভয় দেন তো বলি।
লোকটা বলে কী! সে তো সামান্য মানুষ। সাহাবাবুর নিজেরও একটা কেনেস্তারার কারখানা আছে। বড় ছেলে তার ওটা দেখে। তার ম্যানেজারকে গাড়ি দেওয়া হয়। সে তাও পায় না। তার ম্যানেজার অতীশের মত প্যান্ট শার্ট পরে না। ধুতি পাঞ্জাবি পরে। বয়স্ক মানুষ, তার নিজের কলকাতায় ফ্ল্যাট পর্যন্ত আছে। অথচ অতীশের কাছে এমনভাবে কাতর গলায় অভয় ভিক্ষা করছে যে লোকটাকে মাধার চেয়ে এক ইঞ্চি বড় মাপের মানুষ মনে হচ্ছে না।
সে বলল, বলুন না।
—না আপনি যে বলেন না, লাভ ডাজ ব্রিং এবাউট জাস্টিস অ্যাট লাস্ট ইফ ইউ ওনলি ওয়েট! অতীশের মনে হল এক ঝলক বিদ্যুৎ তার মধ্যে কে ঢুকিয়ে দিচ্ছে! সাহাবাবু এটা জানলেন কী করে! এ তো সেই বনি বলত। সে কী কোনো ঘোরে পড়ে অফিসে এ কথা উচ্চারণ করেছে। তার কেমন মাথাটা ঘুরতে থাকল। নিজেকে সামলে বলল, আমি একথা বলি কে বলেছে আপনাকে। বনি, নির্বান্ধব সমুদ্র, মরীচিকা এসব যে সে ছাড়া কেউ জানে না!
—কুম্ভবাবুই যেন বলল!
—কবে বলল!
—এই তো ক’দিন আগে মনে হচ্ছে। বড়ই জব্বর কথা। – আমি কুম্ভবাবুকে বলেছি?
—না, কুম্ভবাবুকে নয়। তবে আপনি কাউকে বলেছেন! কথাটা শোনার পর মনে হয়েছে সত্যি আপনি দেবতা। আমিও বিশ্বাস করি। আমার এই যে ব্যবসাপ্রীতি এও এক অতীব ভালবাসা থেকে। আর কিছু বুঝি না কোথাও যাই না, কেবল লেনদেন করতে ভালবাসি। সল্ট লেকে ছেলেদের নামে নামে জমি কিনে দিয়েছি, বাড়ি উঠছে, ছেলেরা মেয়েরা সবাই ভাল থাকুক এই চাই। উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসে ব্যবসাটাকে এমন ভালবেসে ফেললাম, যে আমি যা চাই হাতের কাছে পেয়ে যাই। আপনার কথা ক’দিন থেকে বড় মোহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আপনার মত মানুষই এমন কথা বলতে পারে। এমন কথা কেন জানি আমার মনে হয় আর কেউ বলতে পারে না।
এসব শোনার পর অতীশের দৃঢ় ধারণা হল, চারুকে সে ঘোরেই দেখেছে। ঘোরে পড়েই মনে হয়েছে, রাতের নির্জন ট্রেনের কামরায় চারু উলঙ্গ, সে সহবাস করছে। ঘোরে পড়ে গেলেই এসব হয়। চারুর কথা নির্মলার কানে তুলে দিলেই সর্বনাশ। কুম্ভ, বউদি বউদি করে। যেন কত আপনজন। নির্মলা সরল সহজ স্বভাবের মেয়ে। বিশ্বাস করতেই পারে। কোনদিন আবার অফিসে এসে দেখবে, কেউ নেই—সব খাঁ খাঁ করছে। কেবল সিঁড়ি ধরে এক রহস্যময়ী নারী উঠছে নামছে। তার আঁচল উড়ছে, তার চুল উড়ছে হাওয়ায়। বলছে, এই আসুন না। উপরে চলুন, আমার ঘরে বসবেন। বড় সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছি আপনি আসবেন বলে। রহস্যময়ী নারী বোঝে, পুরুষ, কোনো মন্দিরে ঢুকে বসে থাকতে ভালবাসে। আমরা নারীরা শরীরটাকে পবিত্র করে রাখি, মন্দিরে কেউ এসে একটু বসবে বলে। দেখুন হাত, ফুলের গন্ধ পাবেন, দেখুন না স্তন, ফলের গন্ধ পাবেন। নাভিমূলে মুখ রাখুন, চন্দনের গন্ধ পাবেন। অতীশ ভাবতে ভাবতে ভিতরে কেঁপে উঠল। কী ভাবছে সব!
আর তখনই বিশ্বনাথ, মনোরঞ্জন ছুটে এসে বলল, শিগগির আসুন, স্যার। দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে মনে হচ্ছে।
অতীশ চোখ তুলে দেখল, বেশ লোকের ভিড় হয়ে গেছে মাধার ঝুপড়ির চার পাশে। হৈ-হল্লা হচ্ছে।
সে ছুটে বের হয়ে গেল।
সাহাবাবু বলল, কোথায় যাচ্ছেন। এরা মানুষ না। এরা শহরটাকে হেগে মুতে নষ্ট করছে, পারলে এখন আমাদের মাথায় হাগে মোতে। কিছু বলার নেই। যে যার খুশি মত ফুটপাথ দখল করছে।
অতীশ ততক্ষণে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেছে।
কে যেন বলল, এই তো শালা শুয়োরের বাচ্চা ম্যানেজার এসেছে। মার শালাকে!
অতীশ ভ্রুক্ষেপ করল না।
—মার শালাকে। মাধাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায়। মাধাকে ঝুপড়ি থেকে হঠাতে চায়। মাধাকে মেরে ফেলার উপক্রম করছে। মার। মার! মেরে পাট বানিয়ে দে।
অতীশ কেমন আবার ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে—সেই তারবার্তা কে যেন পৌঁছে দিচ্ছে মাথায়—লাভ ডাজ ব্রিং এবাউট জাস্টিস অ্যাট লাস্ট…..।
–এই মাধা!
—হুজুর।
—ওঠ বলছি।
—কোথায় যাব, স্যার?
—যাবি আমার সঙ্গে।
—এরা আমাকে যেতে দেবে না বলেছে।
—কারা?
মাটি ফুঁড়ে সেই হাঙ্গামাকারীরা দৃশ্যমান হতে থাকল। হাতে লোহার রড। পাইপ গান। আজ তারা বিপ্লব শুরু করবে বলে হাজির। মাধাকে দিয়েই বিপ্লব শুরু করতে চায়। মাধার ঝুপড়ি বেদখল হয়ে গেলে কে দেখবে! অন্যায় অবিচার চলেছে—মাধার যাও আশ্রয় ছিল, তাও আজ ভেঙে চুরমার করে দিতে এসেছে নিমকহারাম ম্যানেজার। মার শালাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে এক অতিকায় বিস্ফোরণ।
অতীশ অবিচল। নড়ছে না। ডাকছে, এই মাধা, বের হয়ে আয়।
পচা, গোরা ছুটে এসে সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। মাধা যাবে না।
—যাবে।
পচা, গোরা পেটো ফাটিয়ে ভয়ের উদ্রেক করতে চেয়েছে। কারখানার সবকটা লেজ তুলে পালিয়েছে। রাস্তার মোড়ে জটলা।
কেউ এগোতে সাহস পাচ্ছে না। আর লোকটার ভ্রূক্ষেপ নেই!
অতীশের মাথার উপর লোহার রড উঠে আসছে।
সেই তার বার্তা—লাভ ডাজ ব্রিং এবাউট……
সে স্থির অবিচল। নড়ছে না। কে যেন ভিতরে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে।
সে ডাকল মাধব, তুই মরে যাবি। তোর ভালর জন্য বলছি বের হয়ে আয় ঝুপড়ি থেকে। কী করেছিস, হাত মুখ ফুলে গেছে। এক ফোঁটা রক্ত নেই শরীরে। তোর জন্য বেড পাওয়া গেছে। সেখানে গেলে তুই ওষুধ পাবি, পথ্য পাবি, যে ক’দিন বেশি বেঁচে থাকা যায়! মানুষ, মানুষের জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারে না। আয় লক্ষ্মী ছেলে। পারুল তুমি দেখ ওর ঝুপড়িটা।
মাধা বের হয়ে এল। হাঁটতে থাকল। ভেবে পেল না মানুষটা এত জোর পায় কী করে! অতীশ আগে, মাধা তার পিছনে। দু’জনেই হাঁটছে আরোগ্য লাভের জন্য। রাস্তা ফাঁকা। কেউ নেই।
—হ্যালো রাজবাড়ি।
—হ্যাঁ কে বলছেন!—প্রাইভেট অফিস!—হ্যাঁ কে বলছেন!
—তুমি সুরেন!
—আজ্ঞে।
—বাবাকে দাও।
—অ, কুম্ভদা!
—আরে কুম্ভদা, কুম্ভদা পরে করবে। শিগগির দাও।
কুম্ভ ফোনের মুখ চেপে, বলছে এই তোরা সব দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন। ভিতরে ঢুকে যা! দরজা জানালা বন্ধ করে দে। এরা বোমাবাজি এখানেও এসে শুরু করতে পারে। সুধীর, এই ব্যাটা শুয়োরটা যে যায় কোথায়! জানালা বন্ধ কর।
—কুম্ভ!
—হ্যাঁ বাবা, সর্বনাশ। অতীশবাবুকে ঘিরে ফেলেছে।
—কারা ঘিরে ফেলেছে!
—বস্তির লোকেরা!
—কী দায় পড়েছে! রাজার বস্তি, রাজার লোককে ঘিরে ফেলতে পারে!
দায় না, আপনি কী বুঝছেন না, কারখানায় চাকরি হচ্ছে না ওদের লোকদের, বদলা নিচ্ছে। এটা অজুহাত।
—কিসের বদলা!
—আমাদের মাধা।
—তোমার মাথা! স্পষ্ট করে বল!
—মাধার বেড পাওয়া গেছে বলেছি না। সেই নিয়েই ক্রাইসিস। ভিতরে খবর দিন। কুমার বাহাদুরকে বলুন।
–কুমারবাহাদুরকে বলে কী হবে! থানায় খবর দে। ওকে ঘিরে রেখেছে, আর তোরা কি করছিস! শ্রীনাথ কী করছে!
কুম্ভ এবারে আর এক গোলমালে পড়ে গেল! বউরাণী বলবে তোরা কোথায় ছিলি! ওকে ঘিরে রেখেছে, তোরা কী করছিলি!
—আমরা কী করব! বললাম, শিগগির দাদা পালান, আমরা পালালাম, তিনি পালালেন না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন।
—ও দাঁড়িয়ে থাকল, আর তোরা পালালি!
কুম্ভ অবাক। কোথায় বাবা তার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে! আসলে কুম্ভ জানে বউরাণী কিংবা কুমার- বাহাদুরকে বললে এক কথা, কুম্ভ কোথায় ছিল, কারখানার এতগুলি লেবার, প্রিন্টার, লেদম্যান সবাই থাকতে অতীশবাবুকে ঘিরে রাখে এমন সাহস হয় কোথা থেকে! এক ঝলকে সব ভেবে কুম্ভ বলল, থানায় ফোন করে দিন শিগির।
—কেন, তুই করতে পারলি না।
সে করতে পারত। থানায় ফোন না করে রাজবাড়িতে ফোন কেন যে করতে গেল! পালিয়ে নিজে প্রাণে বেঁচেছে—ওর সঙ্গে যারা গেছিল তারাও, কিন্তু আসল লোকটাকেই তারা ঘিরে রেখেছে। ঠিক ঘিরে রেখেছে, কে যেন তখন বলল, মাথায় রড তুলে বাড়ি মারতে ছুটে গেছে স্যার! তবে কী এখানে এখন অতীশবাবুর লাশ পড়ে আছে!
চার পাশের বস্তির সব দরজা জানালা বন্ধ। খালপাড়ের দিকে কিছু লোকের ভিড়, তারা তামাশা দেখছিল, ট্রামরাস্তার মোড়েও জটলা। মারদাঙ্গা শুরু হলে যা হয়, দরজা জানালা সব পটাপট বন্ধ হয়ে যায়। যে যার ঝাঁকা মুটে নিয়ে দৌড়ায়। সহসা সারা রাস্তা খাঁ খাঁ করতে থাকে। কুম্ভ কী করবে বুঝতে পারছে না। সেও কারখানার গেট বন্ধ করে বলছে, লোহার রড-টড হাতের কাছে যা পাচ্ছ তুলে নাও। আমি থানায় ফোন করে দিচ্ছি।
আর তখনই জানালায় উঁকি দিয়ে যাদব চিৎকার করে উঠল, আসছে। আসছে।
কেউ বলল, বড়বাবু আসছে।
অতীশকে বয়স্করা বড়বাবু বলে, ছেলে ছোকরারা স্যার বলে, আর একদল আছে যারা ম্যানেজারবাবু বলে। আসছে আসছে বলায়, প্রথমে কুম্ভ ভেবেছিল, পুলিশের গাড়ি বড় রাস্তায় এসে গেছে। অতীশবাবু ফিরে আসতে পারেন, এটা কুম্ভ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না। বড়বাবু বলায় ভেবেছে, ও সি নিজে আসছেন। তার বুক ধড়ফড় করছে। কাঁপছে হাত পা। নিমেষে অঞ্চলটায় লঙ্কাকান্ড ঘটে গেল! শুয়োরের বাচ্চা মাধার এত রোয়াব! এবারে এসে পড়ায় সে বলল গেট খুলে দে। আমি বের হচ্ছি। দেখি কার কত হিম্মত। তা লাশ পেলে ভালই হয়, অদ্ভুত কারখানার ঘাড়ের অপদেবতাটির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। যা জ্বালাচ্ছে।
অতীশবাবু লাশ হয়ে গেছে ভাবনায় কুম্ভর মন কেন জানি প্রসন্ন হয়ে গেল। সে ভাবল, এসব মানুষ বেশিদিন বাঁচে না। মাথা খারাপ লোক। না হলে এভাবে মাথায় রড তুলে মারতে আসলে পাগল না হলে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? যাই হোক এখন কী করা! অকুস্থলে একবার যেতে হবে পুলিসের সঙ্গে ফোনে যদি কাবুলকে পাওয়া যেত, বেটা শ্রীনাথ বস্তিতে ঘুরে বেড়ায়, রাজবাড়ির পাইক, ট্যাক্স আদায় করার সঙ্গে মেয়েছেলের সম্পর্ক আছে বস্তিতে –বেটা নির্ঘাত সেখানটায় পড়ে আছে। এসব বিষয়ে হাঙ্গামা হুজ্জোতির শেষ থাকে না।—কেন অতীশ গেল, তোরা কী করছিলি—বার বার এই একটা প্রশ্নের কামড়ে পাগলা কুকুর হয়ে গেছে—এখন পুলিশ যখন এসেই গেছে—বিষয়টাকে কী ভাবে সাজালে, সে ধোওয়া তুলসীপাতা সেজে থাকতে পারবে সেই চিন্তায় অস্থির।
আর তখনই দেখল গেটের বাইরে সবাই বের হয়ে গেছে। সেও বের হয়ে গিয়ে যা দেখল একেবারে হতভম্ব। অতীশবাবু আসছেন। যেন এই বস্তিতে কিছুই হয়নি। কিছু দরজা জানালা খুলে গেছে। অনেকে বেরও হয়ে এসেছে! কলে জল এসেছে বলে একটি যুবতী নারী সতর্ক চোখে বাইরে বের হয়ে এল—আর সেও অবাক হয়ে দেখছে।
এই লোকটাকে নিয়েই তো ঝামেলা। লোকটাকে দেখলে, যুবতীরা চোখ ফেরাতে পারে না। কিন্তু জল না নিলে কখন আবার কোন দিকে পেটো পড়তে থাকবে কে জানে—বস্তিতে বাস করে যুবতীটি বুঝেছে, দরকারে জলও নিতে হয়, দরকারে দরজা জানালা বন্ধ করে বসেও থাকতে হয়। এখন সময় বড় খারাপ যাচ্ছে। পুলিস নিজেই তটস্থ। প্রকাশ্য দিবালোকে তিন চারজন যুবক পুলিসের পিস্তল কেড়ে নিচ্ছে। পুলিসের গলা কেটে দিয়ে চলে যাচ্ছে। মুহূর্তে রাস্তা সুনসান করে দিতে পারে। তখন মনে হয়, কিছু কাক ছাড়া শহরটায় মানুষজনের বাস নেই। এখানে সেখানে গাড়ি থেমে থাকে। খালি ট্রাম, খালি বাস। যেদিকে পারছে ছুটছে; যাবেন না, বোমা পড়ছে, যাবেন না।—’
অতীশের পিছু পিছু মাধা। গায়ে ছেঁড়া সোয়েটার। মাথায় গরম টুপি, গলায় মাফলার। লুঙ্গি পরে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আসছে। শীতের ঠান্ডায় গোড়ালি এত ফেটে যায় যে পা ফেলতে পারে না। ক্যাম্বিসের জুতো—একটাও তার নিজের নয়, কেউ না কেউ দয়া দেখিয়ে দিয়ে গেছে। কেবল লুঙ্গি দেয় না বলে, সেটা পাছার দিকে ফাটা। ছেঁড়া লুঙ্গির ফাঁকে পাছা দেখা যাচ্ছে। এটা মাধা ইচ্ছে করেই দেখাচ্ছে কিনা কে জানে!
সব ঠান্ডা। বস্তির লোকজন আবার দরজা জানালা খুলতে থাকল। উঁকি দিয়ে দেখল। অনেকে বের হয়ে দেখছে, কারখানার ম্যানেজার একটা নোংরা পুঁটুলি হাতে নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে, পেছনে মাধা। ম্যানেজারের উপর কম বেশি সব এলাকার মানুষদেরই যেমন আক্রোশ থাকে—এই এলাকায়ও তা আছে। পোকা মাকড়ের মত মানুষ বাড়ছে। ঘরে ঘরে বেকার, কেউ কাজ পায় না কারখানায়। সব বাইরের লোক। রোষ আছে তাদের। কারখানার লোকদের সঙ্গে কালীতলায় দাঙ্গা শুরু হয়েছে শুনে তারা মজাই পাচ্ছিল। সেটা যে এত সহজে থেমে যাবে, বস্তির লোকজন ভাবতে পারেনি।
দারোয়ান ছুটে গিয়ে অতীশের হাত থেকে নোংরা পুঁটুলিটা কেড়েই নিল।
কুম্ভ দেখছিল আর ক্ষেপে যাচ্ছিল! তুই কারখানার ম্যানেজার, আর তুই হাতে নোংরা পুঁটুলি নিয়ে হাঁটছিস। ইস্ বউরাণীর কানে কথাটা উঠলে যে কী হবে! এটা হাতে কেন! মাধাকে দেখে পাছাটায় একটা লাথি কযাতে ইচ্ছে হচ্ছে।
কারখানার লোকেরা সবাই বাইরে।
অতীশ বলল, কী ব্যাপার, তোমরা সব কাজ ফেলে বাইরে কেন! ভিতরে যাও।
সঙ্গে সঙ্গে সব ভিতরে।
কুম্ভ, হরিচরণ, প্রিন্টার, সুপারভাইজার আর দারোয়ান শুধু রোয়াকে দাঁড়িয়ে।
অতীশ যেন কিছুই হয়নি এমন চোখে মুখে দেখল সবাইকে।
কুম্ভ কথা বলছে না। কারণ ফোনে রাজবাড়িতে যা খবর দিয়েছে, তাতে সবাই ছুটে এল বলে! এসে দেখবে কোনো গন্ডগোল নেই। খামকা সবাইকে তটস্থ করে তোলা। রাধিকাবাবু নিজেই ছুটে আসতে পারেন। পুত্রের ফোন পেয়ে কুমারবাহাদুরকে জানালে তিনিই তাকে পাঠাতে পারেন, কাবুলও আসতে পারে। গাড়ী করে সবাই ছুটে এল বলে। তার আগেই ফোনে জানিয়ে দেওয়া ভাল–কুম্ভ তখনই অতীশবাবুকে দেখতে পেয়ে মাথার এত সব জট নিমেষে খুলে ফেলে বলল, হ্যালো, রাজবাড়ি?
—রাজবাড়ি।
—প্রাইভেট অফিস!
—হ্যাঁ
—কে সুরেন?
—কুম্ভদা!
—বাবাকে বল, কিছু হয়নি। অতীশবাবু চলে এসেছেন।
–ধরুন দিচ্ছি। বাবুকে আপনি নিজেই বলুন।
—আমি কুম্ভ।
—বল।
—কিছুই হয়নি।
—এই যে বললি, অতীশকে ঘিরে ফেলেছে।
—না ঘিরে ফেলেনি। অতীশবাবু ফিরে এয়েছেন। কোনো ঝামেলা হয়নি!
—কুমারবাহাদুর তো বললেন, ওরা কেন যে ঝুট ঝামেলায় জড়ায় বুঝি না! ঝামেলা হলে, থানা পুলিসের কাজ। আমরা কী করব! কুম্ভকে থানায় ফোন করতে বলুন।
কুম্ভ খুব হাল্কা হয়ে গেল। কুমারবাহাদুর ঝামেলায় জড়াবেন কেন! রাজবাড়ি থেকে লোকজন পাঠালে, কুমারবাহাদুর নিজে জড়িয়ে যেতে পারেন—যা দিনকাল, এখন টাকা না খসালে কোথাও কোনো কাজ হয় না। তোমরা কারখানা চালাও, তোমরাই লড়বে। বস্তির মাতব্বরদের হাতে রাখতে জানলে, গন্ডগোল হয়, হতে পারে! আসলে যে যত ট্যাক্টফুল তার উন্নতি তত চড় চড় করে উপরে ওঠে।
সে সহসা বাইরে বের হয়ে মাধার উপর হম্বিতম্বি শুরু করে দিল। এই হারামজাদা কী ভেবেছিস তুই? হ্যাঁ এলি কেন? সুড়সুড় করে চলে এলি। তোর ইয়ার দোস্তরা কোথায়? অতীশ ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে, যেন ছুঁলে রোগের জীবাণু তার গায়েও ছড়িয়ে পড়বে—কুম্ভ সট করে দূরে সরে গিয়ে পথ করে দিল অতীশকে।
অতীশ একটা কথাও বলছে না।
সে ভিতরে ঢুকে পাশের বাথরুমে চলে গেল। আগেকার ম্যানেজার খুবই শৌখিন লোক ছিলেন। দিন রাত কারখানায় পড়ে থাকতেন। কারখানায় পড়ে থাকলে হাগা মোতার কাজ থাকে। চান টান করতে হয়। তারই বাহারি বাথরুম। রাজা অমত করেন নি। রাজার কারখানা আছে এটাই বিলাস- রাজার শুধু জমিদারিই নেই, কারখানাও আছে। এই বিলাস থেকেই আগেকার ম্যানেজার বুঝেছিলেন, কারখানার লাভ অলাভে রাজার কিছু আসে যায় না। এস্টেট থেকে যে কিছু সাহায্য করতে হয় না এই ঢের। বুড়ো ম্যানেজার সেই সুযোগে অফিসের পাশে নিজের একটা শৌখিন বাথ বানিয়ে নিয়েছিলেন।
অতীশ এখন সেখানে হাত ধুচ্ছে। কী নোংরা, দুর্গন্ধ! সে মুখ হাত ধুয়ে চেয়ারে বসল না, দাঁড়িয়েই বেল টিপল।
সুধীর এলে বলল, কুম্ভবাবুকে ডাক।
কুম্ভ বাইরে থেকেই শুনতে পাচ্ছে সব। সে নড়ছে না। কারণ সে বিশ্বাসই করতে পারে না, কীভাবে এত বড় একটা হামলার মোকাবেলা করে এসে মানুষটা এত নির্বিকার থাকতে পারে! কাউকে দোষারোপ পর্যন্ত করল না। বলল না, এই কী, তোরা সব আমাকে একা রেখে পালালি। তোরা কী রে। তোরা পারলি আমাকে ফেলে আসতে!
কুম্ভ চড়া গলায় মাধাকে হম্বিতম্বি শুরু করেছে, সাপের পাঁচ পা দেখেছিস! ভেবেছিলি, তোর স্যাঙ্গাতরা রক্ষা করবে। পুলিস দিয়ে তোকে ঝুপড়িছাড়া না করাতাম তো আমার নাম কুম্ভ না। বেটা, তোর ভালোর জন্য হাসপাতালের বেড যোগাড় করলাম, তুই আমাদের মাথা নেবার জন্য উসকে দিলি।
মাধার এক কথা, আমি কী করব বাবু!
—কী করবি! মরবি, এলি কেন?
—স্যার যে বলল, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।
—স্যার বলল, তোকে বেঁচে থাকতে হবে!
—তাই তো বলল। বিশ্বাস না হয় স্যারকে জিজ্ঞেস করুন! বেঁচে থাকতে বললে মরি কী করে? গোরা, পচারাও বলল, তা স্যার ঠিক বলেছেন, বেঁচে থাকতে হবে। ওকে আপনি নিয়ে যান। বলল, আমরা জানেন তো স্যার চোখ রাঙানিকে একদম বরদাস্ত করি না! শালারা বাপের লাট পেয়েছে, গাড়ি চড়ে মাগি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ফূর্তিফার্তা করলে দোষের নয়। যত দোষ আমাদের!
—কে মাগি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, শুয়োর কোথাকার! নিজে করছিস, এখন সবাইকে মজাতে চাস! কে মাগি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বল!
—ওরা তাই বলে।
—ওরা কারা!
—পচা, গোরা, গৌর সবাই বলে। বাবুরা সব লুটেপুটে খায় বলে। দেখলেই ঠেঙাতে বলেছে।
—কাকে?
—বাবুদের। আর এর জন্যই তো বলল, বেঁচে থাকা দরকার।
—অতীশবাবুর সামনে বলেছে!
মাধা এক হাত জিব বের করে বলল, না। অরা তা পারে বলতে! পচা লোহার রড তুলেছিল মারবে বলে।
—আর তুই দেখছিলি!
পচা মারতে পারল না। ওর হাত থেকে রড খসে গেল! পায়ের কাছে বসে পড়ল। ওই দেখে সব পালাতে থাকল। গুরুর গুরু আছে ভবে বলেই মাধা গান জুড়ে দিল।
বিষয়টা কেমন জটিল হয়ে যাচ্ছে কুম্ভর কাছে। –আরে ধুস, বার বার বেল বাজছে, সুধীর ছুটে আসছে, স্যার ডাকছেন।
—যাচ্ছি, তেনার কী, কিছু হলেই কুম্ভর ডাক পড়বে।
আসলে যেন অতীশ শুনতে না পায় এমন করে বলা—যেন দারোয়ান, হরিহর, প্রিন্টার, সুপারভাইজার বোঝে, কুম্ভবাবুই আসলে সব। নৈবেদ্যের মাথায় বাতাসার মত অতীশবাবুকে বসিয়ে রাখা শুধু। হামলাবাজরা যে ভেগেছে, তার ফোনের খবর পেয়েই। থানায় ফোন গেছে, গাড়িতে পুলিস ফোর্স আসছে—এসব খবর না পেলে শালারা কখনও হটে যায়! সে এ সবই এতক্ষণ ধরে বোঝাবার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে মাধার কাছে এসে হাঁকছে, ওঠ শুয়োর, এই মনোরঞ্জন, নিয়ে যাও। ট্যাক্সি ডেকে কাগজপত্র তুলে নিয়ে যাও। আমি যাচ্ছি না।
আবার সুধীর!
এবারে কুম্ভ বেশ জোরগলায় বলল, আজ্ঞে যাই।
তারপর ভিতরে ঢুকেই আর এক রূপ! –দাদা আপনি নিজের কথা ভাবলেন না! ওর জামাকাপড় বিছানা সব আপনি হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে এলেন!
—মাধা যে বলল, সে কিছু ফেলে যাবে না। তাই নিয়ে এলাম।
—ও ফেলে যাবে না বলল, আর আপনি ওগুলো নিয়ে এলেন! মাধা অসুখের ডিপো একটা জানেন। সারা গায়ে বীজাণু থিকথিক করছে। রোয়াকে রেখেছেন, ডেটল, ফিনাইল ঢেলে সাফ করতে হবে। কে ধরবে ওগুলো!
—মাধা যে বলল, ওতে ওর সব আছে। একটা কিছু খোয়া গেলে আমাদের নামে মামলা ঠুকে দেবে।
কুম্ভর মাথা ফের গরম হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে। আসলে রড তুলে মাথায় মারার সময় দাঙ্গাবাজ পচা কী টের পেয়েছে, লোকটা আসলে পাগল, কিংবা চোখে অস্বাভাবিক কিছু এমন টের পেয়েছে যা দেখলে অন্তরাত্মা কেঁপে যায়! ধুস্ যত সব বাজে চিন্তা—সে এখন নিজেকে সামাল দেবার জন্য গাওনা গেয়ে রাখছে, পরে কোনো কৈফিয়ত যদি দিতে হয়। সে বলল ভাগ্যিস থানায় ফোন করে দিলাম। ফোর্স সঙ্গে সঙ্গে হাজির। ঐ দেখেই শালারা ভেগেছে।
অতীশ জানে না, তখন কী কী ঘটেছিল। অতীশের মনে হচ্ছিল এখন এটাও আর এক ঘোরে পড়ে করা। যখন চারপাশ থেকে তাকে সবাই ঘিরে ধরেছে, তখন সে এক আশ্চর্য মজা অনুভব করেছিল। ওরা তাকে খুন করতে চায়। খুন বিষয়টাই মজার! আর্চির মত খুনের সময় কী কী কষ্ট ভোগ করতে হয় এ-বেলা যেন সে এটা টের পাবে। এটা তার নিয়তি। সে অনেকবার নিজে দমবন্ধ করে দেখেছে, কেমন হাঁসফাঁস করতে হয়। আর্চির বুকের উপর বসে, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে খুন করেছে—সে আর্চির চেয়ে অনেক বেশি মজবুত, লম্বা এবং জাহাজে কয়লা মেরে হাতে পায়ের পেশিতে তার দানবের মত শক্তি। খুন করবার সময় বোধহয় ভেতরের শক্তি আরও বেশি প্রবল হয়ে ওঠে—দুর্বল হয়ে যায় প্রতিপক্ষ। ভয়েই মরে যায় অর্ধেক বাকিটা খুনীর কাজ।
সে ঠিক বুঝতে পারল না, পুলিস এসেছিল কি না। তার মনে আছে সে তখন একটা কথাই বলেছে, তোমরা আমাকে মারছ কেন! মাধার বেঁচে থাকা দরকার। আর কি বলেছিল, ঠিক মনে করতে পারছে না—আর তখনই কী মনে পড়ায় বলল, কুম্ভবাবু কবে বলেছি, লাভ ডাজ ব্রিং অ্যাবাউট জাস্টিস অ্যাট লাস্ট, ইফ ইউ ওনলি ওয়েট।
—আমি একথা বলেছি কে বলল!
—সাহাবাবু।
—ওকে বলতে যাব কেন!
হামলা শুরু হবার আগে অতীশ ভাগ্যিস সাহাবাবুর গদিতে গিয়ে বসেছিল- —না হলে মাধাকে নিয়ে আসা যেত না। সে গদিতে বসেই লক্ষ্য করছিল কালীতলায় মানুষের জটলা বাড়ছে। কুন্তবাবু, ইউনিয়নের পান্ডা মনোরঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে, বোধহয় কিছুতেই মাধাকে রাজি করাতে পারছে না। কারখানা থেকে মাধার নির্বাসন ঘটেছে, তা টি বি রুগীকে কে রাখে! বস্তি থেকেও। ধরা পড়ে গিয়ে মাধার উপর অকারণ সব মানুষ বিরূপ, তার ঝুপড়ি সম্বল, সে হাসপাতালে বেড পাওয়ার পরও যেতে রাজি নাই হতে পারে, ঝুপড়ি ছেড়ে গেলে মাধার শেষ আশ্রয় যাবে—এ-সবই সাহাবাবুর গদিতে বসে অতীশ ভাবছিল—কুম্ভই চায়নি কারখানার খোদ ম্যানেজার একটা তুচ্ছ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ুক, এ-সব কারণে অ্যাসিট্যান্ট কুম্ভর উপর কিছুটা কৃতজ্ঞতা বোধও আছে, কিন্তু থানা থেকে ফোর্স পাঠিয়েছে! সে কেমন বোকার মত, আবার বলল, সাহাবাবু কিন্তু বললেন আপনি বলেছেন। কবে আপনাকে আমি এ-সব কথা বলেছি! বলুন!
কুম্ভ নিরতিশয় বিপন্ন বোধ করছে।
নাটকের শেষ দৃশ্যে কুম্ভ দেখছে, মাধা নেই, তার ঝুপড়ি নেই, হাসপাতালে নিয়ে যাবার দৃশ্যও নেই—একেবারে অন্য দৃশ্য, লাভ ডাজ ব্রিং অ্যাবাউট জাস্টিস…….যদি বলেই থাকি তবে দোষের কী! কবে যেন কথাটা কুম্ভ শুনেছে, অতীশবাবু নিজেই কী বলেছেন! কোনো দু-নম্বরী কারবার থেকে কুম্ভকে মুক্ত করার সময় কী কথাটা বলেছিলেন, না পচা টাকার গন্ধ পাবার সময়, পচা টাকার গন্ধ পায় লোকটা। কুম্ভর হা হা করে হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে। এমন সিরিয়াস অভিযোগ শুনে সে হাসতেও পারছে না! কুম্ভ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলল, আপনি নিশ্চই বলেছেন, আপনি না বললে জানব কি করে? কথাটা তো খারাপ নয়। ভারী সুন্দর কথা! আপনি নিশ্চয় এ-সব বিশ্বাস করেন। আপনার মত মানুষই এমন কথা বললে শোভা পায়। ওতে আপনার ক্ষোভ হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। যদি বলেই থাকি, খারাপ কি করেছি!
অতীশ তাকিয়ে আছে।
কুম্ভ এমন ঠান্ডা চোখ দেখলে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু এ মুহূর্তে সে বিশ্বাসই করতে পারছে না অকারণ একটা অভিযোগ এনে তাকে দুর্বল করে দেবে! আসল অভিযোগ তো পালালেন কেন। আমাকে একা ফেলে আপনারা পালালেন কেন। আপনারা এত ভীরু দুর্বল! মাধা অসুস্থ। তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। চোখ রাঙালে যাবে কেন।
সে সব অভিযোগ অতীশবাবু তুলছেনই না। কুম্ভ এবারে পাল্টা অভিযোগ তুলল, আপনি ওর নোংরা পুঁটুলিটা যে আনলেন, কার কাছে ওগুলো গচ্ছিত রাখবেন।
অতীশ আসলে তলিয়ে যাচ্ছিল। সে জাহাজের নাবিক ছিল এ-রকম খবর কম বেশি সবাই রাখে। গভীর সমুদ্রে ঝড়ে পড়ে অচল হয়ে পড়ায় জাহাজ ছাড়তে হয়েছিল, সে খবরও অনেকে রাখে। নাবিকদের অনেকে নিখোঁজ হয়ে গেছিল, পত্রপত্রিকায় সে খবর সে সময় প্রকাশ হয়েছিল। কাপ্তান স্যালি হিগিনস, সে, কাপ্তানের একমাত্র তরুণী কন্যা বনি এবং সারেঙ জাহাজ ছেড়ে পালায় নি, এমন খবর দেশে ফেরার পর কোনো কাগজে প্রকাশ হয়েছে বলে সে জানে না। অচল জাহাজেই তারা কিছুদিন বসবাসের পর খাবার এবং জল ফুরিয়ে গেলে কাপ্তান তাকে এবং বনিকে বোটে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তা-ছাড়া বোটে সে এবং বনি, অজ্ঞাত এক সমুদ্রে তারা ভাসমান, ক্রস, বাইবেল, মাসখানেকের মত খাবার এবং জল, একটা পাখি, লেডি অ্যালবাট্রস—এই তিনজন মাত্র জানে লাভ ডাজ ব্রিং অ্যাবাউট জাস্টিস ইফ ইউ ওনলি ওয়েট অ্যাট লাস্ট। আর কেউ জানে না। দেশে ফিরে সে তার সেই অজ্ঞাতবাসের কথা কাউকে বলেনি। বাবা তার বিষণ্ণতা লক্ষ্য করলে মাঝে মাঝে বলতেন, তোমার কী হয়েছে! যখন নির্মলার সঙ্গে শিক্ষক শিক্ষণ কলেজে আলাপ, সেও প্রশ্ন করেছে, তুমি এত চুপচাপ থাক কেন! তুমি এত বিষণ্ণ কেন! নির্মলাও বিয়ের পর মাঝে মাঝে কেমন জলে পড়ে গেলে বলত কেন তুমি ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাক! সে নির্মলাকে কিছুই প্রকাশ করতে পারেনি।
প্রকাশ করতে পারলে সে হাল্কা বোধ করত।
প্রকাশ করতে পারলে বোধ হয় আর্চির প্রেতাত্মা তাকে তাড়া করতে সাহস পেত না।
কিন্তু সেই অজ্ঞাতবাসের জন্য তার আচরণই দায়ী। যেমন সে ভেবে থাকে, আর্চিকে খুন না করলে, জাহাজের বয়লার চক বসে যেত না। প্রপেলার স্যাফট দুমড়েমুচড়ে যেত না। স্টিয়ারিং এঞ্জিনে ধস নামত না। এমনকি ট্রান্সমিশান রুমও ঝড়ে উড়ে যেত না। ঝড়ের মধ্যে সে খুন করেছিল আর্চিকে। খুন না করলে বনিকে সে ধর্ষণ থেকে রক্ষা করতে পারত না। শুধু কী ধর্ষণ, দীর্ঘ সমুদ্র সফরে বালকের ছদ্মবেশে কাপ্তানের তরুণী কন্যা জাহাজে যুবতী হয়ে উঠেছে, সে আর আর্চি বাদে কেউ তা টের পায়নি। দুই প্রতিপক্ষ। আর্চি তাকে দিনের পর দিন স্টোক-হোল্ডে নামিয়ে নির্যাতন করেছে। আর্চি তার ওপরওয়ালা। আর্চি অকারণে তাকে ঝড়ের রাতে বিলজে নামিয়ে বরফ ঠান্ডা জলে কাজ করতে বলেছে। জাহাজের তলায় জলের বিশাল ট্যাঙ্ক, ট্যাঙ্কের ফাঁকফোকরে ঢুকে যাওয়া, তলা সাফ করা কিংবা উষ্ণ সমুদ্রে, বয়লারের নিচ থেকে ছাই তুলে আনা—এমন সব দুরহ কাজ দিত যে, মাঝে মাঝে তার প্রাণ- সংশয় দেখা দিত। খুনের পেছনে প্রতিশোধ নেবার আকাঙ্খা কাজ করেছে সে এত দীর্ঘকাল পরে তাও টের পায়।
অজ্ঞাতবাসের কথা বলতে গেলে, শুরুই করতে হবে, সে জাহাজের মেজ-মিস্ত্রি আর্চিকে খুন করেছিল!
বাবা শুনলেই আঁৎকে উঠবেন, তুমি খুনী।
নির্মলা বিশ্বাসই করতে পারবে না, সে খুন করতে পারে। টুটুল মিণ্টু শুনলে বলবে, বাবা তুমি মানুষও মেরেছ!
সে বলতেই পারে না, লাভ ডাজ ব্রিং অ্যাবাউট জাস্টিস ইফ ওনলি ওয়েট অ্যাট লাস্ট।
পালে হাওয়া না থাকলে, নিথর সমুদ্রে মরীচিকা দেখে ভেঙে পড়লে বনি তাকে এসব বলে প্রেরণা দিত। সে এসব কথা কুম্ভবাবুকে বলতে যাবে কেন! চারুর কথা উঠতেই কুম্ভ বলেছিল, চারু কে? চারু পিয়ারিলালের ভাইঝি—তাও কুম্ভ অস্বীকার করেছে। এমন মানুষকে সে কেন বনির সেই সব কথা বলতে যাবে! কুম্ভ এমনও বলেছে, আপনি দাদা ঘোরে পড়ে যান। টের পান না। ঘোরে পড়ে চারুকে দেখেছেন।
অতীশ ভয়ে চারুর নাম পর্যন্ত এখন উচ্চারণ করে না। বউরাণী পর্যন্ত তাকে ধিক্কার দিয়েছে, তুই কীরে চারু চারু করে সবার মাথা খাচ্ছিস!
চারুর কথা সত্যি তবে কেউ জানে না।
আসলে এই হল অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক। পাপবোধ একটা লোককে নিরন্তর তাড়া করলে শেষে বোধ হয় মানুষ পাগল হয়ে যায়। এই যে এখন মাধাকে নিয়ে আসতে পারল সেই এক পাপবোধের যন্ত্রণা থেকে। মৃত্যু অকিঞ্চিৎকর, বেঁচে থাকা অনেক বড় ব্যাপার। মাধাকে নির্ভয়ে আজ সে-কথা বলতে পেরেছে। পেটো পড়েছে, লোহার রড নিয়ে তাড়া করেছে সব দেখেও সে বিচলিত বোধ করেনি। কত দীর্ঘকাল পর বনির এক একটা কথা তার মাগজের মধ্যে ভেসে আসছে, আর অবলীলায় এমন কাজ করে ফেলছে, যা পাগলের কান্ড ছাড়া কিছু না। কারণ সে কারখানায় ঢোকার মুখেই যেন কথাটা শুনেছিল, পাগল না হলে এমন হল্লার মধ্যে কেউ এত স্থির অবিচল থাকতে পারে!
কুম্ভ দেখছিল, কী গভীর ঠান্ডা চোখ অতীশবাবুর। সে জানে এই ঠান্ডা চোখই বাবুটির মাথায় এক সময় ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকার নির্দেশ দেবে। যেন অতীশবাবুকে কিছুটা সজাগ করে দেবার জন্য বলল, আপনার ঘেন্না-পেত্তা নেই। কফ থুথু কী না লেগে রয়েছে! বেটার রক্তবমি পর্যন্ত। ওগুলো পুড়িয়ে না দিলে, ব্যাধি সংক্রামক কত বোঝেন না! মাধা কিছুই ফেলে আসতে না পারে, অসুখে ভুগে ভুগে ব্যাটা পাগলা কুকুর হয়ে গেছে,—কাকে কামড়াবে ঠিক নেই—কিন্তু আপনি তো আর পাগলা কুকুর নন, যে কামড়াবার জন্য যত রাজ্যের অসুখ নিয়ে কারখানায় হাজির হবেন!
অতীশ বলল, তাহলে আমি বলেছি বলছেন!
—কী বলেছেন!
—এই যে বললাম, লাভ ডাজ ব্রিং…….
শুয়োরের বাচ্চা ভবি ভুলবার নয়। কুম্ভ মনে মনে অতীশ সম্পর্কে বিরক্ত হয়ে গেলে এ ছাড়া অন্য কোন জন্তুর সঙ্গে লোকটাকে তুলনা করতে পারে না। পাছা চুলকে তার ধা করে ফেলেছে, তার ছ্যাঁচড়া স্বভাব যে এত অধিক, এই লোকটার জন্য, বউরাণী কুমারবাহাদুর পর্যন্ত তা টের পেয়ে গেছে!
কুম্ভ বলল, না আমি এমন কথা কাউকে বলি নি।
—না বললে সাহাবাবু জানলেন কী করে!
—তার আমি কী জানি!
আচ্চা ফ্যাসাদ। এমন উজবুক লোকের পাল্লায় পড়তে হবে কুম্ভ যেন দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি। আর কুম্ভ এও জানে—লোকটা গোঁয়ার, সহজে ছেড়ে দেবে না।
সে বুঝিয়ে বলল, দাদা এখন মাধাকে নিয়ে ভাবুন। তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। কিছু টাকা পয়সা দিন, ইউনিয়নের পান্ডাদের দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তাই তো। এ সময় এমন একটা বেয়াড়া তক্ক জুড়ে দিলে লোকের আর দোষ কী—অতীশ দাঁড়িয়েই টেবিলের নিচের দিকের একটা দেরাজ খুলে বলল, কত দিতে হবে?
—ট্যাক্সি-ভাড়াটা দিয়ে ছেড়ে দেন।
—আপনি যাবেন না?
—আমি কী করতে যাব। কাগজ পত্র নিয়ে দেখালেই হবে।
অতীশ টাকা বের করে বলল, আমি বাসায় যাচ্ছি।….কাকে যে বললাম লাভ ডাজ ব্রিং অ্যাবাউট। টাকা গুনতে গুনতে কুম্ভ চোখ ট্যারচা করে বাবুটিকে দেখছে। আর এক কামড়। শালা মানুষের কত রকমের কামড় থাকেরে বাবা, লাভ ডাজ ব্রিং ছাঁইপাশ কী সব বলছে—সে এমন কথা কাউকে বলেই নি!
অতীশ বেরিয়ে যাচ্ছিল।
কুম্ভ বলল, একটু দাঁড়ান। বলে সে ইউনিয়নের পান্ডাদের ডেকে অতীশের সামনেই টাকাটা দিল তাদের হাতে। কাগজ পত্রের ফাইল দিয়ে দিল। বলল, শিগগির চলে যাও।
আর তখনই দেখল মাধা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে সবাইকে প্রণাম করছে। বলছে, আপনারা সবাই প্রার্থনা করুন, আমি যেন ভালো হয়ে উঠি।
কুম্ভ বলল, হয়েছে যা। আমরা সব সময় তোর জন্য প্রার্থনা করব। যা তো। উঠে গিয়ে বস, মাথা ঠেকাতে হবে না। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, এখন মানে মানে রওনা হয়ে যাও।
অতীশ ভিতরের দিকে। এত ভেতরে ঢোকার হুকুম মাধার নেই। মাধা দূর থেকেই গড় হয়ে বলল, যাই স্যার। আমার জিনিসগুলি থাকল। কাউকে দেবেন না স্যার। পারুল চাইলেও না।
কুম্ভ আর পারল না!—ওতে কি আছে তোর! লাখ টাকার মাল রেখে যাচ্ছিস মনে হয়!
—ওই আমার লাখ টাকা বাবু।
কথা বাড়ালে বাড়বে। কুম্ভ বলল, ঠিক আছে, রেখে দেব। কারণ কুম্ভর ধারণা বেটা আর ফিরছে না। হাত পা যখন ফুলে গেছে তখন শমন বলতে গেলে ধরিয়েই দেওয়া হয়েছে। যে বেটার আর ফেরার কথা না, তাকে কথা দিতে কোনো অসুবিধাও থাকে না। কুম্ভ দারোয়ানকে ডেকে বলল, মাধা চলে গেলে সব তুলে রাখবে। ওর একটা জিনিস যেন এদিক ওদিক না হয়।
ট্যাক্সি এলে মাধা উঠে যাবার আগে দুটো শেডের গেটে দাঁড়াল। কারখানার সব কর্মীরা গেটের মুখে জড় হয়েছে। সে সটান রাস্তায় শুয়ে পড়ল। সাষ্ঠাঙ্গে প্রণিপাত জানাল কারখানাকে। সে অশ্রু বিসর্জন করল। এই কারখানা তার অন্ন দিত। এই কারখানার দৌলতে রাস্তায় পড়ে থাকল না। তার আর থাকার ভাবনা নেই, হাগা মোতার ভাবনা নেই, জামা কাপড়ের ভাবনা নেই। হাসপাতাল থেকেই সব পাবে। ভাগ্যিস সৎমায়ের তাড়া খেয়ে এই শহরে এসে জুটেছিল, যাদবের বউয়ের সঙ্গে ফস্টিনষ্টি করে এমন জল ঘোলা করে তুলেছিল যে, শেষ পর্যন্ত কারখানার গেট-পাস পেয়ে গেল।
বস্তির মানুষজনও বের হয়ে এসেছে। মাধাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বস্তিতে এটা খুবই বড় খবর একটা। বস্তি বলেই হরেকরকম মজা সব সময় একটা না একটা লেগে থাকে। কাচ্চাবাচ্চা, জোয়ান মরদ যুবতী এবং প্রৌঢ়ারা সবাই মাধাকে চেনে, চেনে বলেই ট্যাক্সিটা যতক্ষণ দেখা গেল সবাই দেখল। মাধা আজ সবাইকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল।
ট্যাক্সিটা চোখের অন্তরাল হতেই কুম্ভ বলল, দাদা ওগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছি।
—ওগুলো মানে?
—মাধার পোঁটলাপুঁটলি।
অতীশ টের পায়, সর্বত্র সংক্রামক ব্যাধি থিকথিক করছে—মাধার শেষ সম্বল পুড়িয়ে দিলেই যদি নিষ্কৃতি পাওয়া যেত—তবু সে কেন যে প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারল না, ওগুলো পুড়িয়ে আর কতটা কাজ হবে।
অতীশ তবু বলল, খুলে দেখা দরকার, যদি টাকা পয়সা কিছু থাকে। আনার সময় বেশ ভারী লাগছিল।
কুম্ভ মাধার সম্পত্তির এদিকটা একেবারেই ভাবেনি। সে খবরের কাগজে রোজ চমক প্রদ খবরের আশায় থাকে। পৃথিবীতে কিছু ঘটুক। তা না হলে কাগজ পড়ে সুখ পায় না। দাঙ্গা ধর্ষণের খবর তার খুব প্রিয়। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা আরও প্রিয়। সব সময় সে ইস্টবেঙ্গলকে শত্রুপক্ষ ভেবে থাকে। বাঙালরা এসে দেশটাকে ছুন্নছাড়া করে দিল। শালা মুখ্যমন্ত্রী থেকে অধিকাংশ মন্ত্রী বাঙাল, কোত্থেকে উড়ে এসে সব জুড়ে বসেছে। এইসব চমক প্রদ খবরের মধ্যে একবার একটা খবর তাকে ভারি উচাটনে ফেলে দিয়েছিল—ফুটপাথে ভিখারির লাশ। পোঁটলাপুঁটুলি থেকে নগদে আর নোটে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা পাওয়া গেছে।
কুম্ভ পাগল অথবা ভিখিরির ঝুপড়ি ফুটপাথে দেখলেই ভাবে কোনো গুপ্তধন ঠিক আছে। একবার একটা খবরে সে খুবই ঘাবড়ে গেছিল, ঝুপড়ি থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকার হেরোইন উদ্ধার। বস্তুটি কী সে জানে না। পরে শুনে অবাক হয়েছে। সাদা গুঁড়োর মতো এক প্রকারের মাদক, যা জ্বালিয়ে ধোঁয়া নিলে, বেশ দিনমান তুরীয় এক আনন্দ উপভোগ করা যায়। এ-সব খবর তার যে মাথায় ছিল না তা নয়, তবু সে ভাবতে পারেনি মাধার মতো একটা ঘাটের মড়ার পোঁটলা পুঁটলিতে গুপ্তধন থাকতে পারে।
কুম্ভ কিছুটা হতবাকই হয়ে গেছে শুনে।
থাকতেই পারে। সে আর বলতে পারল না, পুড়িয়ে দিই। কিন্তু ওতে হাত দেওয়া মানে কেউটে সাপের গর্তে হাত বাড়ানো। বাতাসে তারা ভেসে বেড়ায়। তার হাসি, চারুহাসিনী, সুহাসিনীও বলা যায়, রাতের বেলা সেই চারুহাসিনীকে সাপ্টে ধরলে টের পায় বেঁচে থাকার কী মজা। এ হেন দোদুল্য- মান অবস্থায় ঝুলতে থাকলে সেও না আর এক অতীশবাবু হয়ে যায়। কি যে করে!
তা হাসি তার চারুহাসিনী—না হলে কাবুল শালা এত মজে। রাজবাড়িতে ততক্ষণে খবর হয়ে গেছে, না লাশ পড়েনি। অতীশবাবু অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছেন। ঘরে ঘরে খবর, বাবুর্চিপাড়া, মেসবাড়ি এখন সর্বত্র এক কথা। অতীশবাবুর কিছু হয় নি। হাসিও মেসবাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে—কী খবর, কী হল, লোকজন দেখলেই মুখ মাগীর চুলবুল করবে। হাসি তার সতীসাধ্বী স্ত্রী, অথচ মাগী কথাটা এ-সময় কেন যে মনে এল! হাসির সতীপনা নানাভাবে গোলমালে ফেলে দেয় তাকে। সতীপনা কথাটাও মনে এল তার হাসি কাবুলকে ডেকেও জিজ্ঞেস করতে পারে—সিট মেটালে গন্ডগোল, অতীশবাবুকে ঘিরে ফেলেছে কারা, যেন অতীশবাবুর জন্য দুর্ভাবনার শেষ নেই! নবীন সন্ন্যাসীর মতো শুয়োরের বাচ্চার চোখমুখ না হলে হাসিকে লক্ষ্মীর পট কিনে দেবে বলতে সাহস পায়! হাসি তার নিজের মানুষের জন্য বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনায় থাকে না—কুম্ভর এটাই বড় কামড়। যেন সে যা মানুষ, তাতে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে হাসি বিশ্বাস করে না।
কিন্তু বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিলেও চলে না।
কুম্ভ এখন তার মাথার প্যাঁচ ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে দিল।
অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছে অধম ছিল বলে।
—কী-ভাবে সেটা?
কুম্ভ থানায় ফোন না করলে অক্ষত অবস্থায় আর ফিরে আসতে হত না। পুলিশ ঘিরে ফেলেছে টের পেয়েই সব পালিয়েছে। পুলিশ এলে দাঙ্গাবাজরা সট করে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে আজকের ঘটনা তার সাক্ষী। রাজবাড়ি ফিরে দশ কাহন করে বলতে না পারলে বউরাণী, কুমারবাহাদূর সহ সবার কাছে বেইজ্জতের একশেষ। অতীশকে ফেলে সে পালায় নি। অতীশকে উদ্ধার করার জন্যই কারখানায় ছুটে এসেছিল—পুলিশকে খবর দিয়েছিল। নিজের জান বাঁচানোর জন্য সে সট করে গা ঢাকা দেয়নি, অতীশবাবুকে রক্ষার জন্যই সে কারখানায় ছুটে এসেছে। ফোন করেছে। সে না থাকলে আজ লাশ নিয়ে রাজবাড়ি ফিরতে হত।
এবং এই সব দুরভিসন্ধিমূলক প্ররোচনা মাথার মধ্যে তার অহরহ কাজ করে। তার বাড়াভাতে ছাই দিয়ে লোকটা সিট মেটালে মাথা হয়ে বসে আছে। শকুনের মতো চোখ। শকুনের মতো ঘ্রাণ শক্তি। যেখানে দু পয়সা তার হয়, সেখানেই উড়ে এসে জুড়ে বসে।
অতীশ বলল, আমি যাচ্ছি।
কুম্ভর কপাল কুঁচকে গেল। গেলেই হল! মাধার পোঁটলা পুঁটলির দায় কে নেবে?
অতীশ দাঁড়িয়ে আছে। বসতে পারছে না—কারণ, ওর মনে হচ্ছিল সত্যি শরীরে বীজাণু থিকথিক করছে। হাত ডেটল দিয়ে ধুয়েও তৃপ্তি পাচ্ছে না। বাসায় ফিরে ভাল করে চান করবে। বিকেলে আজ লিখতে বসবে। তার আজ কেন জানি মনে হয়েছে, সে মাধাকে ফুটপাথ থেকে উদ্ধার করতে পেরে আর্চির প্রেতাত্মার অশুভ প্রভাব খানিকটা লঘু করতে পেরেছে। তার আজ দিনটা ভাল যাবে।
কুম্ভ চুলে চিরুনি চালাবার সময় বলল, দাদা এগুলির কোন সদ্গতি করে যান।
—লোহা লক্কড়ের ঘরটায় ফেলে রাখুন না। তা-ছাড়া রাখার জায়গা কোথায়?
—ওখানে রাখতে দেবে না।
—কারা দেবে না?
–ইউনিয়নের পান্ডারা। আনহেলদি, আনহাইজিনিক বোঝেন না! ওরা রাজি হবে কেন!—তবে কি করবেন?
—আমি কি বলব দাদা! আপনি যা অর্ডার করবেন—অতীশ পড়ে গেল ফ্যাসাদে। দেখুন না কি আছে।
–কে ধরবে ওগুলো? কুম্ভর ঠোঁট ঘৃণায় বেঁকে গেছে।
অতীশের মাথায় আসছে না, কী করা যায় পোঁটলা-পুঁটলিগুলি নিয়ে। তার নিজের কেমন নোংরা ঘাঁটতে সাহস হচ্ছে না। তার টুটুল মিণ্টু আছে। নির্মলা আছে। তার বাপ মা ভাই বোন আছে। সবার জন্য তার বেঁচে থাকা দরকার। কেবল সে তার বেয়ারা সুধীরকে ডেকে বলতে পারে, দেখতো খুলে কী আছে। কিন্তু সে নিজে যা করতে পারছে না, সুধীরকে দিয়ে সে কাজ কী করে করায়। সুধীর বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। যেন পোঁটলা-পুঁটলিতে সংক্রামক ব্যাধির পোকা বিজবিজ করছে। হাত দিলেই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে তারা উঠে এসে সুধীরের বুকের মধ্যে বাসা বানিয়ে ফেলবে। সে নিজেকে যজাতে যেমন ভয় পায়, অপরকেও। কারণ এতে তার আচরণ অধার্মিক হতে পারে। অধার্মিক আচরণকে সে জীবনে সব সময় ভয় পেয়ে আসছে।
সেদিন মিণ্টু রাজবাড়ির পুকুরের গভীর জলে ডুবে গিয়েও বেঁচে গেছে—মনে হয়েছে, সেই দূরবর্তী নীহারিকা থেকে কেউ যেন তাকে সতর্ক করে দেয়। লোভে পড়ে, অধার্মিক আচরণ সে যে না করে ফেলে তা নয়, তবে বার বার রক্ষা পেয়ে যায়, ঠিক কোনো মুহূর্তে তাকে কেউ সজাগ করে দেয়—ছোটবাবু এ তুমি কি করছ! বউরাণীর ফোন পেয়ে সে সেদিন এত বেশি কুহকে পড়ে গেছিল, যে, তার মগজে ঘন্টা বাজলেও তাতে সে সাড়া দেয়নি। বউরাণীর পরিপুষ্ট যৌবন এবং শৈশব থেকে এক গভীর পিচ্ছিল অন্ধকার জগৎ তাকে কুহকে ফেলে দেবার চেষ্টা করে আসছে। সে নিজেকে বার বার তার হাত থেকে নিস্তার লাভের জন্য যাবতীয় বিধিনিষেধের বেড়া চারপাশে তুলে রেখেছিল। সেদিন বউরাণীর শরীর সম্ভোগের সুযোগ তাকে এত কাতর করে রেখেছিল যে, টেরই পাইনি—কোন গভীর নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে জ্যোৎস্নায় সে বনিকে নিয়ে বোটে ভেসে গেছিল। সব অমঙ্গল থেকে যেন এখন সেই তাকে রক্ষা করে আসছে। আর্চির অশুভ প্রভাব তাকে অধার্মিক করে তোলার চেষ্টা করলেই, বনির আর্ত গলা শুনতে পায়—লাভ ডাজ ব্রিং অ্যাবাউট জাস্টিস—ইফ ইউ ওনলি ওয়েট অ্যাট লাস্ট।
সে ওয়েট করছে।
নির্মলা জীবনে একদিন না একদিন অবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। নির্মলা সহবাসে ভয় পাবে না। কাছে গেলেই বলবে না, না না আমি পারব না। তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও!
নির্মলার জরায়ুর অসুখের পর থেকেই এটা সে টের পায়। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর তাকে আর কাছে ঘেঁষতেই দিতে চায় না। নির্মলার ধারণা, সে আর ভাল হবে না। নিরাময় হবে না। কিংবা তার এও ধারণা হতে পারে, সে নিরাময় হয়েছে ঠিক, তবে আবার সহবাসে রাজি হতে পারছে না। যেন উপগত হলেই নির্মলা ফের অসুস্থ হয়ে পড়বে।
সে কতদিন রাত জেগে কাটিয়েছে।
নির্মলা এখন স্বাভাবিক, তার শরীর রুগ্ন নয়। বরং মুখে চোখে লাবণ্য ইদানীং উপচে পড়ছে। নিৰ্মলা এখন এত বেশি সেবাপরায়ণ অথচ রাত যত বাড়ে তত সে কেমন বিবর্ণ হয়ে যায়।
টুটুল মিণ্টু ঘুমিয়ে থাকে।
রাজবাড়ির সদরে ঘন্টা বাজে।
সে তার টেবিলে বসে লেখালেখি করে রাতে।
রোজই আশা, নির্মলা তার বিছানায় আসবে।
অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে, যেমন সেদিন বউরাণীর নির্দেশ মতো বের হবার মুখেই কেউ ফোন করে বলল, তুমি যাবে না।
এখন সে মনে করতে পারে না। সে কে!
রাজবাড়ির অফিস থেকে রাধিকাবাবু – রাধিকাবাবুর গলাই মনে হয়েছিল—অতীশ তোমার মেয়ে জলে ডুবে গেছে। তারপরও আবার দীর্ঘ এক কাঁপুনির মধ্যে শুনতে পেয়েছে, ভয় নেই। তোমার মিণ্টু ভাল আছে। সে রাজবাড়িতে ঢোকার মুখেই নতুন বাড়ির রাস্তায় দেখেছিল মিণ্টু বাবাকে দেখে দৌড়ে আসছে। কে যে রক্ষা করল—কার অশুভ প্রভাব মিণ্টুকে জলে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল, কার শুভ প্রভাবে মিণ্টু প্রায় অলৌকিক উপায়ে যেন বেঁচে গেছে। কেউ তো তখন ঘাটলায় থাকার কথা না। অধীর না কে যেন দেবদারু গাছের পাশ থেকে দেখছিল, একটা জলপরী সবুজ শ্যাওলায় সাঁতার কাঁটছে। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলেছে।
অতীশ বলতেও পারছে না, পোঁটলা-পুঁটলি সব তবে ফেলে দিন। খাল পাড়ে নিয়ে যান রিকশা ডেকে। কিন্তু এতে যে অবিশ্বাসের কাজ হবে। মাধা বিশ্বাস করে তার সম্বল অতীশের কাছে গচ্ছিত রেখে চলে গেছে। কী মনে হল কে জানে, সে বলল, দাঁড়ান দেখছি কী আছে ওতে।
কুম্ভ আর পারল না, আপনি কি পাগল হলেন দাদা!
কুম্ভের সেই এক ভয় বউরাণীর কানে কথাটা উঠবে। এমনিতেই তার উপর খাপ্পা, কারণে অকারণে তাকে দায়ী করতে পারলে যেন আর কিছু চায় না। কারখানার এত লোক থাকতে অতীশকে নোংরা ঘাটালি! তারপরই মনে হল যদি গুপ্তধন সত্যি থাকে—বলা যায় না, মাধার ডেরায় রাতের বেলা বেওয়ারিশ নারী পুরুষের ভিড় থাকত। কার কি আছে কে বলতে পারে! কুম্ভ বলতে গেলে লোভেই পড়ে গেল। সে বলল, রিকশায় তুলে ফেলে দিয়ে আসছি। তারপরই মনে হল, এ নিয়ে ইউনিয়ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। দু-একজনকে ডেকে পরামর্শ করলে হয়। অবশ্য সে যে খুব একটা তোয়াক্কা করে তা না—তবু হাত পা ধুয়ে সাফ থাকা ভাল।
এখন অতীশবাবু চলে গেলেই মঙ্গল। অতীশবাবু থাকলে ঠিক টের পাবে তার আসল মতলবটা কী। কী করে যে টের পায়! না হলে পিয়ারিলালের দু-নম্বরী মাল সাপ্লাই করে সে যে পয়সা কামাচ্ছে, কাজে যোগ দিতে না দিতে টের পায় কি করে লোকটা!
কুম্ভ বলল, আপনি যান। দেখছি কোথায় রাখা যায়। দারোয়ানদের একজন কুম্ভর খুব অনুগত। সে তাকে দিয়েই কাজটা করাবে ঠিক করল। অতীশ চলে গেলে, সে সুধীরকে ডেকে বলল, এগুলো তোল। শিউপূজনের ঘরটার পাশে রেখে দে। ওর ঘরের পাশে রেখে দিলে সে গাঁইগুঁই করতে পারবে না। বস্তির খালি জমিটাতে শিউপূজন ঠেলা রাখে। ওটাতে কারখানার বিল্ডিং উঠলে হাতছাড়া হবে—মামলা মোকদ্দমা রাজার সঙ্গে চালিয়ে যাবার ক্ষমতা তার কম।
এখন সম্বল মাত্র কুম্ভবাবু। জমিটার দখল সে ছাড়তে রাজি আছে। বেইমানি জানে না। আগেকার ম্যানেজার তাকে জমিতে ঠেলা রাখার অনুমতি দিয়েছিল বলেই সে এই শহর ছেড়ে যেতে পারেনি। ঠেলা ভাড়া খাটিয়ে পয়সা। কারখানার পুরনো আমলের মিস্ত্রি। জটিল কাজকর্মে তার সাহায্য দরকার পড়ে। এই একটা খুঁটির জোরেই তার কদর। কুম্ভবাবু বলেছে, সে তার বাবাকে বলে কিছু টাকা পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে। টোপ ফেলে রেখেছে, কুম্ভ কাকে কী টোপ দিতে হয় ভালই জানে। সাত কাঠার উপর জমি। জমিটার দখল নিতে পারলে কুম্ভ জানে, সে রাজার আরও কাছের মানুষ হয়ে যাবে। সে ছাড়া কারখানা যে অচল রাজার বুঝতে কষ্ট হবে না। কুম্ভ এ কারণে মাধার পোঁটলা-পুঁটলি শিউপূজনের ঘরের এক কোণায় ফেলে রাখলেও কিছু বলতে সাহস পাবে না।
সে ইউনিয়নের পান্ডা মনোরঞ্জনকে তার বাসনার কথা জানাল। শত হলেও মাধা কারখানার কর্মী। তার সম্বল গচ্ছিত রেখে গেলে তা পাহারা দেবার দায়িত্ব নিতে হয়। বিবেচক মানুষ কত কুন্ত—এটাই যেন সে এখন কারখানার কর্মীদের কাছে জাহির করতে চায়।
তখন অতীশ রাজবাড়ির সদর দরজায় ঢুকে দেখল, বেশ এধার ওধার জটলা। সাদেক সেলাম ঠুকছে। রাজবাড়ির অফিসার অতীশ। সেলাম ঠুকলে আজকাল তার অভ্যাস—কপালে হাত ঠেকানো। এটা এমন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে যে অতীশ ঢোকার মুখেই মাথায় হাত ঠেকায়। সেলাম ঠুকল কী ঠুকল না তাও সে লক্ষ্য করে না। তার মন মেজাজ প্রসন্ন। মেসবাড়ির দোতলার বারান্দায় মানসদা উবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেলিংয়ে ভর করে। অতীশকে দেখেই হাত তুলে দিল। বলল, সাবাস নবীন সন্ন্যাসী। এই মানুষটা অতীশকে নবীন সন্ন্যাসী বলে যেন ভেতরের শুভবোধকে আরও তীব্র করে তোলে।
সে দেখল, মানসদাও বেশ প্রসন্ন আজ। ঘরের মধ্যে মানুষটা বন্দী অবস্থায় থাকে। রাজবাড়ির অন্দর থেকে তার খাবার আসার সময় হয়ে গেছে। সেই আশাতেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। মানসদার সঙ্গে সে দাঁড়িয়ে যে দুটো কথা বলবে সেই অবকাশও কম। লোকজন ছুটে আসছে—কী হয়েছিল জানার আগ্রহ। সে শুধু বলছে, না না কিছুই হয়নি।
—তোমাকে কারা ঘিরে ধরেছিল?
—ঘিরে ধরবে কেন!
—মাথায় রড তুলেছিল।
—ও কিছু না।
আসলে অতীশ নিজের মধ্যে ভয়ঙ্কর এক মানুষকে আজ আবিষ্কার করে ফেলেছে। নির্যাতন কতটা শরীর সইতে পারে তারই পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখল, আততায়ীরা কেমন ভয় পেয়ে পালিয়েছে। ভিতরের এই জোরটার কথা তার যেন এতদিন জানা ছিল না। প্রায় নিজেকে আবিষ্কারের শামিল। সে কিছুটা জোরে হেঁটে গেল। মেসবাড়ি পার হয়ে যাবার সময় দেখল, হাসি দরজায় দাঁড়িয়ে।
—দাদা আপনার লাগেনি তো?
—লাগবে কেন!
—কে যে বলল রড তুলে মেরেছে।
অতীশ বুঝতে পারল, রাজবাড়িতে বেশ ভাল করেই গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। নির্মলা তার জন্য অস্থির হয়ে থাকবে। তার নিরাপত্তা নিয়ে নির্মলার এমনিতেই একটা ভয় আছে। বাসে ট্রামে ফেরার সময় মানুষটার যদি কিছু ঘটে যায়। যা অন্যমনষ্ক। এখন যত দ্রুত সম্ভব নতুন বাড়ি পার হয়ে বাগানের রাস্তাটায় ঢুকে পড়া
সে দেখল, জানালায় টুটুল মিণ্টু নির্মলা—তারই জন্য অপেক্ষা করছে। এই ফেরা কী যে আশ্চর্য জীবনের খবর বয়ে আনে! যেন এরা আছে বলেই তার এই ফেরা সার্থক।
অতীশকে দেখেই টুটুল মিণ্টু যা করে থাকে—দৌড়ে আসে। এবং তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটুল মিণ্টু লাফিয়ে নেমে আসছে সিঁড়ি ধরে।
সে সরে দাঁড়াল। বলল ওহো, না না, আ কী হচ্ছে, আমাকে ছোঁবে না।
টুটুল মিণ্টু কী বুঝল কে জানে। বাবা বুঝি তাদের ভালবাসে না। টুটুলের ঠোঁট কেঁপে গেল। বড় অভিমানী ছেলে।
অতীশ হেসে দিল। বলল, জামা-কাপড় নোংরা। তোরা কীরে! স্নান করে কোলে নেব। লক্ষ্মী ছেলে।
সে মিণ্টু টুটুলকে কিছুটা এড়িয়েই যেন সিঁড়িতে উঠে গেল। করিডর ধরে যাবার সময় শুধু নির্মলাকে বলল, আমার পাজামা বের করে দাও।
নির্মলা দরজায় ছুটে গেছিল। সে ফেরায় কতটা হাল্কা হয়ে গেছে—এই ছুটে যাওয়ার মধ্যে অতীশ অনুভব করেছে, নির্মলাকেও সে যেন এড়িয়ে গেছে। ছোঁয়াছুঁয়ির ভয় অথবা কিছুটা শুচিবাইগ্রস্ত রমণীর মতো বড় বড় পা ফেলে বাথরুমে ঢুকে যাওয়ার কারণ নির্মলা ঠিক বুঝতে পারছে না। অসময়ে স্নান। এটা আবার মানুষটার নতুন একটা উপসর্গ কী না, কে জানে! সে যে ভারি উচাটনে ছিল, কারখানায় গন্ডগোল লেগেই থাকে—আজ আবার কী নতুন গন্ডগোল শুরু হয়েছে, হাসি ছুটে এসে একবার বলেছিল, দিদি বস্তির লোকেরা কারখানা ঘিরে ফেলেছে।
আবার ছুটে এসে বলেছিল, না, দাদাকে ঘিরে রেখেছে কারা।
কুম্ভবাবুর বাবা রাজবাড়ির অফিসে আছে। অফিসের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে কারখানার সঙ্গে। হাসি সঙ্গে সঙ্গে সব খবর পায়। দাদাকে ঘিরে রেখেছে কারা শুনেই মূৰ্চ্ছা যাবার উপক্রম হয়েছিল নির্মলার। সে আর দেরি করতে পারেনি। টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে কুম্ভবাবুর বাসায় ছুটে গেছে। হাসি সান্ত্বনা দিয়েছে, তার কর্তা যখন সেখানে আছে কোনো ভয় নেই। দিদি কাঁদছেন কেন! আর তখনই খবর এসেছে রাজবাড়ির অফিস থেকে, অতীশ মাধাকে নিয়ে কারখানায় ফিরে আসতে পেরেছে।
মাধাকে নিয়ে কারখানার জল ঘোলা করার চেষ্টা করছে কারা এমন খবর অবশ্য নির্মলা রাখত। কারখানায় নিরাপদে ফিরে এসেছে জেনে, নির্মলা হাল্কা হয়ে গেছিল। বড় রকমের কোনো ঝামেলা তবে হয় নি। সে মিণ্টু টুটুলকে নিয়ে ফিরে এসেছে, আর করিডরের জানালায় দাঁড়িয়ে শুধু প্রত্যাশা কেউ আবার নতুন খবর দিয়ে যাবে। সে তার নাওয়া-খাওয়ার কথা পর্যন্ত ভুলে গেছিল। অতীশ সশরীরে হাজির হতেই তার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। অসময়ে সাধারণত তার মানুষটা বাড়ি ফেরে না। ফিরে আসায় নির্মলা বুঝেছে তার কিছু হয়নি সশরীরে হাজির হয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে। না হলে নির্মলা দুশ্চিন্তায় থাকবে সারাটা দিন। খাবে-দাবে না। মিণ্টু টুটুল মা মা করবে। বাবার কী হয়েছে বলবে। মিণ্টু সব বোঝে। টুটুল ঠিক না বুঝলেও মার বিষাদ তাকে দুঃখী করে রাখবে। সংসারে প্রসন্নতা কত দরকার মানুষটা বুঝতে পেরেই চলে এসেছে। কিন্তু কোনো কথা না বলে, সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল গা বাঁচিয়ে—এটা কেন!
নির্মলা তবু ছুটে ছুটে কাজ করছে।
অতীশ বাথরুম থেকেই টের পাচ্ছিল, নির্মলার মানসিক অবসাদ যেন আর সেভাবে নেই। বাসায় ঢোকার মুখেই নির্মলার চোখ মুখ একেবারে স্বাভাবিক যুবতীর মতো।
—এই শুনছ।
—বল।
—তোমার পাজামা।
দরজা সামান্য ফাঁক করে পাজামা টেনে নিল। সম্পূর্ণ নিরাবরণ অতীশ।
–সার্ফ দাও।
নির্মলা বলল, রেখে দাও! আমি ধুয়ে দেব।
—দাওনা বলছি।
অতীশ চায় না, এই নোংরা জামা প্যান্ট আর কেউ ধরুক! কাচাকাচি করুক।
নির্মলা দরজার কাছে এসে বলল, সার্ফ।
অতীশ দরজা ফাঁক করে হাত বাড়িয়ে সার্ফ নিল।—ডেটল আছে?
—আছে।
—শিগগির দাও।
আগেই জল ঢেলেছে শরীরে। ঠান্ডা লাগছে অতীশের।
নির্মলা ডেটল দিলে আবার দরজা ফাঁক করে হাত বাড়িয়ে নেবার সময় দরজাটা হাওয়ায় বেশি খুলে গেল। নির্মলা অতীশের এত লাবণ্য শরীরে যেন আর কখনও প্রত্যক্ষ করে নি। সে কেমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে অতীশের দিকে তাকিয়ে থাকল।
নির্মলার চোখে মুখে উষ্ণতার আভাস। অতীশ কেমন লজ্জায় গুটিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। এত লজ্জা তার! সেই এক দীর্ঘ সফরে এমন সঙ্কোচ এবং লজ্জা সে প্রথম অনুভব করেছিল। অতীশের কেন যে আবার সেই দূরবর্তী তারবার্তা মাথায় ভেসে আসছে—লাভ ডাজ ব্রিং অ্যাবাউট জাস্টিস ইফ ইউ ওনলি ওয়েট অ্যাট লাস্ট। তবে কী আজ মাধাকে উদ্ধার করে আনার মধ্যে অদৃষ্ট কোনো ভালবাসাকে সম্মান জানিয়েছে।
কী জানি কে জানে!
মনটা আজ অতীশেরও বড় বেশি অভিভূত।
সেই কবে থেকে চারুকে খুঁজছে। অথচ চারু বলে কেউ নেই। নির্মলার অসহিষ্ণুতা তাকে কী তবে ঘোরে ফেলে দিয়েছিল। নির্মলা তার স্ত্রী, দিন যায় মাস যায়, এমন কী এবারে বছর বুঝি গড়িয়ে যাবে ভেবেছিল, তার সঙ্গে সহবাসের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নির্মলার থাকে না। জটিল মানসিক রোগ হতে পারে। মাঝে মাঝে মনে হত, নির্মলাকে কোনো মনোবিদের কাছে নিয়ে যাবে। আবার ভয়ও কম না, যেমন নির্মলা ভাবতে পারে তবে কী তার মাথার গন্ডগোল আছে। হিতে বিপরীত হতে কতক্ষণ!
সে জামা সার্ফে ভাল করে কেচে দিল।
সে জামা প্যান্ট ডেটল জলে চুবিয়ে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দিল। ভাল করে ডেটল জলে স্নান করে সাবান মাখল গায়ে। শরীরের সর্বত্র ফেনা। মাথায় সাদা ফেনা—যেন সে এখন কোনো ডিটারজেন পাউডারের বিজ্ঞাপনের ছবি।
স্নান সেরেও তার মনে হল, কেমন অপবিত্র শরীর। সে সবাইকে ছুঁতে ভয় পাচ্ছে। এ-বড় কঠিন অসুখ, যদিও এখন আর ভয়াবহ বলে অসুখটাকে ধরা হয় না, অধিকাংশ রোগীই বেঁচে যায়—এসব রোগের চিকিৎসা জলভাত হয়ে গেছে, তবু ভিতরের খিঁচটা থেকেই গেল। সে স্বাভাবিক হতে পারছে না।
আর তখনই নির্মলা বলল বাবার চিঠি এসেছে।
চিঠি! বাবার!
হ্যাঁ লিখেছেন, টুটুলের হাতে খড়ি দিতে আসছেন। সঙ্গে পঞ্চতীর্থ কাকাকে নিয়ে আসবেন।
এত সব সুখবর কখনও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে জীবনে সে যেন এর আগে টের পায় নি। বাবা তো বলেন, সব কর্মফল। জীবনের সব কর্মই কখনও পাপতাপের, কখনও মুক্তির স্বাদ বহন করে থাকে—অথবা এও হতে পারে তার মাথার মধ্যে যদি সত্যি কোনো গন্ডগোল থেকে থাকে, তবে এইসব খবর বেঁচে থাকার জন্য জীবনে অধীর আগ্রহ তৈরি করবে একদিন।
টুটুলের হাতেখড়ি।
অতীশ বের হয়ে মাথাটা ভাল করে তোয়ালে দিয়ে ঘষছে।
টুটুলের হাতেখড়ি!
ঘাড়ে গলায় অতীশ তোয়ালে দিয়ে জল শুষে নিচ্ছে। শীত করছিল। নির্মলা হাতে গেঞ্জি এবং পাঞ্জাবি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
অতীশ বলল, দাও তো চিঠিটা।
বাবার চিঠি পড়ার খুব একটা আগ্রহ থাকে না তার। কারণ চিঠিতে বাবার শুধু অভিযোগ, চিঠিতে বাবা লিখবেন, অলকার পাত্র খোঁজা নিয়ে দেখছি তোমার কোনো দায় নেই। সবাই যদি একে একে পাখা মেলে উড়ে যাও তবে সংসারের এই দুটি প্রাণীর কি হবে! দুটি প্রাণী বলতে বাবা নিজে এবং সঙ্গে মার কথা উল্লেখ করেন। কতদিন পর যেন বাবা তার এবং তার পুত্রের শুভাশুভের কথা ভেবে নিজে চলে আসছেন। চিঠিতে নিশ্চয়ই কোনো অভিযোগ নেই।
বাবা কলকাতাকে বড় ভয় পান। এত মানুষজন, গাড়ি ঘোড়া, মানুষের এত নিঃশ্বাস প্রশ্বাস একই জায়গায় কুন্ডুলি পাকিয়ে থাকলে শরীর কখনও সুস্থ থাকতে পারে বিশ্বাস করতে পারেন না। অতীশ রাজার কারখানায় কাজ নিয়ে আসার পর দু তিন বছর কেটে গেল, বাবা একবারও আসেননি। এমন কী তিনি বাড়ির অন্যদেরও পাঠাতে যেন সাহস পান না। কলকাতায় এসে সে এবং সন্তানেরা এখনও বেঁচে আছে এটাই বোধ হয় বাবার কাছে পরম বিস্ময়ের। তিনি এলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন নির্ঘাত এবং কে জানে কিছু ঘটেও যেতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকেই বোধ হয় তিনি এতদিন আসতে সাহস পাননি। গাছপালা ঘরবাড়ি ছেড়ে আসতে বাবার শঙ্কা বোধ হয়।
সেই বাবা টুটুলের মঙ্গলার্থে বলতে গেলে জীবন বাজি রেখেই আসছেন।
কারণ তিনি বুঝেছেন, তাঁর পুত্রটি ধর্মবিমুখ। কবে না আবার হাতেখড়ি না দিয়েই পুত্রের পড়াশোনা শুরু করে দেয়। জীবন শুরুর মুখে এসব অনাচার তিনি পুত্রের জন্য সহ্য করতে পারলেও, পৌত্রের ক্ষেত্রে সহ্য করবেন না। পূর্বপুরুষের পিন্ডদানের একমাত্র অধিকার এখন টুটুলের উপর বর্তে আছে। হাসু ভানু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এখন ক্লাব-টালাব করছে। মাঝে মাঝে বাবার চিঠিতে তাদের চাকরির কথা লেখা থাকে—তুমি চেষ্টা না করলে কে করবে। ওদের স্থিতিলাভের দরকার।
সব বাবাই এটা চায়।
এক বয়সে বাবা মা ভাই বোন, এক বয়সে স্ত্রী পুত্র কন্যা, আর এক বয়সে ঝাড়া হাত পা হতে গিয়ে আরও জটিল গাড্ডায় জড়িয়ে পড়া। মানুষ যতদিন বাঁচে, ততদিন তার এক জটিলতা থেকে অন্য জটিলতায় গমন। এই যেমন সে সাত আট বছর আগে জানতই না নির্মলা বলে এক যুবতী তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। বনি ছাড়া তার জন্য আর কেউ কখনও অপেক্ষা করতে পারে বিশ্বাস হত না। এখন দেখছে, নারী মাত্রেই প্রেমিকা, না হলে কোথাকার কে এক চারু তাকে এ-ভাবে বিভ্রমে ফেলে চলে যেতে পারে! ছ সাত মাস হয়ে গেল, সে খোঁজাখুঁজি করে বুঝেছে মাথার দোষ, আসলে চারু বলে কোনো যুবতীর সঙ্গে তার কখনও কোনো ট্রেনে দেখা হয়নি। কোনো নীল জোৎস্নায় গভীর ফসলের ভেতর দিয়ে তারা ট্রেন যাত্রা করেনি। এতে আর কী এসে যায় জীবনে! এমনই কোনো স্বপ্নের ট্রেনে সবাই চড়ে বসবে বলে বসে আছে। আর এইসব ভাবনাই চারু নামক এক রমণীর বিভ্রমে ফেলে দিয়েছে!
বাবা জানেন–এই টুটুল তাঁর আপাতত একমাত্র উত্তর পুরুষ। তাঁর বংশগৌরব। মিণ্টুর বেলায় হাতেখড়ি হয়নি—এতে বাবার কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু টুটুলের যদি হাতেখড়ি না হয়, বাবার জীবনে বড় আক্ষেপ থেকে যাবে। বাবা তবে আসছেন।
সব মানুষই সব সময় একা, এক সময় সংসার, এক সময় ঘরবাড়ি, শেষে এই বংশগৌরব। বংশের ধারাবাহিকতা এ-ভাবেই মানুষ রক্ষা করে যায়। টুটুলের হাতেখড়ি না দিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিলে দেবীর কোপে পড়ে যাবার সম্ভাবনা। অমানুষ হলে কে কাকে রক্ষা করে! অথচ হাসু ভানুর ক্ষেত্রে তিনি কোনো বিপাকে পড়েছেন এমন মনে হয় না। তাঁর ধারণা, তিনি তার কর্তব্য করছেন—কর্মফলে হয়নি। কর্তব্যে অবহেলা তাঁর ছিল না। এই আপ্তবাক্যের তাড়না থেকেই তিনি আসছেন। তিনি কর্ম করার অধিকারী তার ফলে অধিকারী নন।
অতীশ তক্তপোশে বসলে নির্মলা চিঠিটা বের করে দিল।
সেই এক সম্বোধন,
পরম কল্যাণবরেষু,
আশা করি, তুমি বউমা কুশলে আছ। অনেকদিন তোমার চিঠি পাইনি। চিঠি না পেলে আমরা দুশ্চিন্তায় থাকি এটা তোমার বোঝা উচিত। শ্রীপঞ্চমীর আগের দিন আমরা আসছি। আমি এবং তোমার পঞ্চতীর্থ কাকা। সকাল ৭/২৮/৫৯ সেকেণ্ড গতে ১০/৪৫/২২ সেকেন্ডের মধ্যে শ্রীপঞ্চমীর অনুষ্ঠান ও হাতেখড়ি
এইটুকু লেখার পর বাবা পূজার উপকরণের একটি ফর্দ জুড়ে দিয়েছেন। কালোপাথরের থালা, চকখড়ি, সঙ্গে পূজার বিবিধ উপকরণের তালিকা। যেমন অবশ্যের তালিকায় আছে পলাশ ফুল। মাটির দোয়াত, কাঁচা দুধ, শরের কলম।
অতীশ বাড়িতে থাকার সময় বাবার যজন, যাজন পছন্দ করত না। বাড়িতে বৈশাখ মাসে বারের মঙ্গলচন্ডী, জ্যৈষ্ঠে যষ্ঠী পূজা, শ্রাবণে মনসা, আশ্বিনে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা থেকে ক্ষেত্রপাল, বাস্তুপূজা—হেন পার্বণ নেই করেন না। বাড়ির ঠাকুরঘরে শালগ্রামশিলা, লক্ষ্মী জনার্দনের পেতলের মূর্তি। সকালে বাগান থেকে ফুল তোলা, জবা ফুলের গাছই কত রকমের, যে ফুলে যে ঠাকুর তুষ্ট, ফলে বাগানে নানা ফুলের বাহার।
তালিকাটি খুবই দীর্ঘ। নির্মলা বছর চার-পাঁচ বাড়িতেই ছিল। সে বাবার ঠাকুরের কাজকর্ম যত্নের সঙ্গে করত। অতীশের ঈশ্বর বিশ্বাসের খামতি নির্মলা অনেকটা পুষিয়ে দিয়েছিল। নির্মলার পূণ্যফল তাকেও স্বস্তি এনে দেবে এমন ভেবে থাকেন।
তবে কলকাতায় এলে মানুষ কিছুটা ধর্মবিমুখ হয়ে পড়ে। এটা বাবার বিশ্বাস। শহরের জাঁকজমক এবং বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় মানুষ নিরন্তর ছুটছে। অতীশও তাই। না হলে সপ্তাহে না হোক মাসেও অন্তত পরিবারের মঙ্গল জানিয়ে চিঠি দিতে পারে। সে তাও দেয় না। আগে নির্মলা নিয়ম করে চিঠিপত্র লিখত। জরায়ুর অসুখের পর থেকে ওর কী ধারণা হয়েছে কে জানে—মানসিকভাবে বাড়ির মানুষজনের উপর তার ক্ষোভ জন্মেছে। সে আর চিঠি লেখে না। অন্তত হাসপাতালে থাকার সময় সে ভেবেছিল বাড়ি থেকে কেউ এসে থাকবে। তার মানুষটা বাবা, মা ভাই বোনের জন্য এত উদ্বেগ ভোগ করে—সময় মতো বাবার মাসোহারা না পাঠাতে পারলে অস্বস্তির মধ্যে থাকে এটা বাড়ির সবাই জানে। অথচ এত বড় বিপদের সময় বাড়ি থেকে মা একবার এসে হাসপাতালে একদিন গেছে এবং পরদিনই আবার ট্রেনে তুলে দিতে হয়েছে। সংসার কে দেখে! আর কেউ আসেনি, থাকেও নি। অথচ চিঠিতে সময়মতো টাকা যেন অতীশ পাঠায় তার তাগাদা দিতে বাবা ভুল করতেন না।
নির্মলার ক্ষোভের কারণ অতীশ বোঝে। সে অফিস চলে গেলে মিণ্টু টুটুল বাসাবাড়িতে একা। কেউ দেখার নেই। বড় জেঠিমা কিছুদিন ছিলেন। তাঁকেও বড়দা এসে নিয়ে গেল। এখন একান্ন নয় যে জোর করে রাখবে। নির্মলা হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে বুঝেছিল তার মানুষটা কত অসহায়। সকালে ওঠা, বাজার করা, রান্না করা, মিণ্টুকে ইস্কুলে দিয়ে আসা। নির্মলার ওষুধ-পথ্য সব জোগাড় করে টেবিলে সাজিয়ে রাখা থেকে টুটুলকে চান করানো খাওয়ানো এক হাতে। নির্মলা তার মানুষটার উপর এত চাপ পড়েছে ভেবেও কখনও ভেঙে পড়ত। সেই এক কথা বলত, তোমার সঙ্গে বাড়ির শুধু টাকার সম্পর্ক।
অতীশ বলত, এটা বলছ কেন। আমার মা বাবার কষ্ট ঠিকই হয়! কী করবেন। ওখানেও তো তাঁদের সংসার আছে।
নির্মলার এক কথা, অলকা এসে থাকতে পারে না!
অতীশ বলত, ওর স্কুল কামাই হবে। পড়াশোনার ক্ষতি হবে এটা বুঝছ না কেন!
—পড়াশোনা না ছাই। কেবল তো ফেল করছে।
অতীশ এণ্ড দেখেছে, কেউ নিজের স্বাধীনতা হারাতে চায় না। এখানে মা এসে থাকেন না, কারণ মার ধারণা এটা তাঁর নিজের সংসার নয়; পুত্রের সংসার। অলকা এসে থাকে না—কারণ ওর ধারণা দাদার বাড়িতে সে আছে। নিজের বাড়িতে নয়। পক্ষকালের মধ্যেই যেন মনে হয় অলকা বড় একঘেয়েমিতে ভুগছে। সারাদিন বাসায় আটক থাকতে হয়!
এই শহরে এসে তাঁরা জীবনকে যেন উপভোগ করতে পারে না। প্রবাস জীবনে হাঁপিয়ে ওঠে। অতীশ ওদের আচরণে এটা লক্ষ্য করার পরই কাউকে আর বাড়ি থেকে আসার কথা লেখে না। আসলে তারও ভিতরে বাড়ির প্রতি কেমন একটা অভিমান ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। আগে সে নির্মলা কিংবা টুটুল মিণ্টুদের সামান্য অসুখ বিসুখেই ঘাবড়ে যেত। বাবাকে চিঠি দিত—বাবার চিঠি এলে সাহস পেত। বাবা লিখতেন, শরীর থাকলে তার কষ্টভোগ থাকবেই। জীব মাত্রেই এটা ভোগ করতে হয়। জন্মের সঙ্গেই সে এটা বহন করে। তুমি অযথা দুশ্চিন্তা করবে না। প্রাণ তার নিজের সঞ্জীবনী শক্তিতে বাঁচে, বড় হয়। তার শ্রীবৃদ্ধি হয়। কষ্টভোগও থাকে। সব নিয়েই জীবন।
তখনই মিণ্টু লাফাতে লাফাতে এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল—বাবা টুটুল আমাকে মারছে!
—টুটুল
টুটুল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসছে না।
—তুমি দিদিকে মারছ!
—না বাবা দিদি আমাকে মারছে।
টুটুলের কোঁকড়ান চুল। এখন সে দৌড়াতে পারে। ধরতে গেলেই মার কাছে ছুটবে। মার পাশে বসে থাকবে। নির্মলা রান্নাঘরে খাচ্ছে বোধহয়। চিঠিটা ধরিয়ে দিয়েই সে বাথরুমে চলে গিয়েছিল। অতীশ বিছানায় শুয়ে বাবার ফর্দ দেখছে। পূজার এতটুকু বিঘ্ন হয় বাবা চান না। কলা, কদমা, বাতাসা, কলাপাতা থেকে আরম্ভ করে তিল তুলসী হরিতকী কিছুই ফর্দে বাদ দেন নি। এমনকি নৈবেদ্য কটা হবে তারও উল্লেখ করেছেন। পঞ্চদেবতার পাঁচটা। লক্ষ্মী সরস্বতীর দুটো নৈবেদ্য, চক্ষুদানের জন্য কাজল, অর্থাৎ পঞ্চতীর্থ কাকা সঙ্গে আসছেন—তিনি যেন টের না পান, বাবার মেজ পুত্রটির পরিবার পূজা আর্চার বিষয়ে অনভিজ্ঞ। অনভিজ্ঞ ধরা পড়লে বাবার কলঙ্ক।—তাহলে এই আপনার পুত্র, পুত্রবধূ শহরে এসে ম্লেচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। নিজের কর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ। এ-কারণেই বোধহয় এতবড় ফর্দ পাঠিয়ে কোনও ত্রুটি যাতে না থাকে তার চেষ্টা করেছেন। আর শেষে লিখেছেন, এখন তোমার গ্রহ সমাবেশ খারাপ। দুষ্টগ্রহের কোপে পড়ে গেছ। গ্রহ-শান্তি দরকার।
অতীশ বালিশে ভর দিয়ে বলল, এই টুটুল আয়, জানিস আমার বাবা আসছে।
টুটুল এখানে এসে তার ঠাকুরদার কথা ভুলে গেছে। সে বলল, তোমার বাবা আছে?
—বারে থাকবে না!
—তোমার সত্যি বাবা আছে?
তা টুটুল বলতেই পারে। সে বিশ্বাসই করে না, বাবার একজন বাবা থাকতে পারে। সে কেমন ঘাবড়ে গেছে কথাটাতে। তার পাকা পাকা কথা। তাদের বাবার বাবা থাকবে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। অতীশ কেমন ছেলে মানুষের মত বলল, সত্যি আমারও বাবা আছে। বাবা আসবে। তোমার হাতেখড়ি হবে।
মিণ্টু বলল, হাতেখড়ি কী বাবা!
—পড়াশোনা আরম্ভ করার আগে হাতেখড়ি দিতে হয়।
—হাতেখড়ি না দিলে কী হয় বাবা?
মিণ্টু লতাপাতা আঁকা ফ্রক গায়ে বাবার খাটের কাছে দু’হাত গালে রেখে তক্তপোশে ভর করে আছে। চোখ বড় বড়। ‘হাতেখড়ি’ কথাটা সে বোধহয় শোনেই নি। আবার শুনতেও পারে। টুটুলের জন্য একবার ‘খুশির পড়া’ নামে একটা বই কিনে এনেছিল নির্মলা। সে তখন বলেছে, পড়াও কিন্তু হাতেখড়ি না হলে লিখতে পারবে না। নির্মলাদের বাপের বাড়িতে এ সব নেই। তবু ওর দাদা দিদিরা কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার।
হাতেখড়ি না দিলে কী হয় সে জানে না। আসলে সংস্কার। অতীশ নিজের বিদ্যারম্ভের দিনটির কথা মনে করতে পারল। বাবা মেজ জ্যাঠামশাই বাড়ি এলেন। সঙ্গে দশাসই এক গৌরবর্ণ মানুষ। গায়ে সিল্কের চাদর, পাটভাঙ্গা ধুতি। গায়ে জামা নেই। খড়ম পায়ে দশ ক্রোশ রাস্তা হেঁটে যেতে পারেন। চুল সব সাদা। লম্বা টিকিতে জবা ফুল বাঁধা। সারা কপালে শ্বেত-চন্দনের প্রলেপ।
বিশাল অনুষ্ঠান। তার বিদ্যারম্ভ একভাবে হয়েছিল, তালপাতায় সেই উজ্জ্বল গৌরবর্ণ মানুষটি অ আ ক খ লিখে দিয়ে গেলেন। পূজাআর্চা, ভোজন কত কিছু তার বিদ্যারম্ভ উপলক্ষে। আসলে একজন মানুষের যাত্রা শুরু। শুভ দিনক্ষণ দেখে দেবদেবীর প্রসন্নতা লাভ না করতে পারলে, পদে পদে বিঘ্ন। বাবা জ্যাঠারা সবরকমের বিঘ্ন থেকে ত্রাণের জন্য এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। কালো পাথরের থালার উল্টোপিঠে সূর্যকান্ত পন্ডিত তাকে কোলে বসিয়ে প্রথম অ আ ক খ চকখড়ি দিয়ে লিখিয়ে ছিলেন। তারপর সরস্বতীর স্তব পাঠ করালেন। বড় হয়ে বুঝেছে, স্তব পাঠ করে বিদ্যারম্ভ শুরু। বিদ্যার দেবীকে প্রসন্ন করার জন্য কত কিছুর আয়োজন।
তার পুত্রের ক্ষেত্রে বাবা চান এমন অনুষ্ঠান হোক্। সদ্-ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে হবে কিনা চিঠিতে লেখেননি। এখানে আসার পর বোঝা যাবে বাবার আর কী ফরমাস তাকে পালন করতে হবে।
টাকার দরকার।
সে বলতে পারবে না, এত টাকা আমি পাব কোথায়! আপনাদের একরকমের দিন গেছে, আমাদের অন্যরকম।
হাতেখড়ি না দিলেই বা কী হয়। কিছুই হয় না আবার কেন যে মনে হয়, কিছু হয়—নিজের বেলায় না হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু পুত্রের বেলায় হবে না, তা অতীশ ভাবতে পারে না। কোনও কারণে টুটুলের পড়াশোনা না হলে মনটা খচ্খচ্ করবে। আসলে আশ্চর্য এক পবিত্র খবর যেন বাবা তাকে দীর্ঘদিন পর দিয়েছেন।
তার মনে হল, সে বাবার কর্তব্য ঠিক পালন করছে না।
যেমন শৈশবে, বাড়িতে বাবা কিংবা জ্যাঠামশাই কর্মস্থল থেকে ফিরে এলে বলতেন, এদিকে আয়। সে মেজদা বড়দা কাছাকাছি বয়সের। তিনজনকেই পাশে বসিয়ে মুখস্থ করাতেন।
তারা বলে যেত।
বাবার নাম?
চন্দ্রনাথ ভৌমিক।
এ-ভাবে পিতামহের নাম থেকে অতি অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহের নাম তাদের বলে যেত হত।
অতীশ টুটুলের দিকে তাকিয়ে আছে। সে দরজার কাছ থেকে নড়ছে না। ছোট্ট সরল শিশু যত আক্রোশ দিদিটার উপর। দিদির খবরদারি তার একদম পছন্দ নয়। দিদি প্যান্ট পরাতে গেলে, কিছুতেই পরবে না। শার্ট গায়ে দিতে গেলে দৌড়ে পালাবে—সেই দিদিটা বাবার এত কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে—আর তাকে বাবা ডাকছে না, ক্ষোভ হতে পারে, অতীশ ডাকতেই, টুটুল বাবার বুকের উপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
অতীশ বলল, তোমার বাবার নাম বল তো?
—অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক।
—তোমার পিতামহের নাম?
টুটুল বলল, বাবা, পিতামহ কি?
বাবার বাবাকে পিতামহ বলে। তোমার পিতামহের নাম চন্দ্রনাথ ভৌমিক। কি মনে থাকবে?
—হ্যাঁ, থাকবে।
—বল পিতামহের নাম কি?
টুটুল দৌড়ে পালাল।
—এই শোন। কোথায় গেলি! অতীশ উঠে দরজা পার হয়ে দেখল করিডরে টুটুল নেই। দরজা খোলা নেই তো! এই দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেই, অন্দরমহলের বিশাল এলাকা, কলকাতা শহরে এমন ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। এত গাছপালা যে, টুটুল যদি ইচ্ছে করে বাবাকে ভয় দেখাবে, তবে তাকে সে সারাদিনেও খুঁজে পাবে না। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বিঘার ওপর এই প্রাসাদবাড়ি, বাগান, পুকুর, গ্যারেজ, গোয়ালঘর, বাবুর্চিপাড়া, বাবুপাড়া, মেসবাড়ি, অতিথিভবন, ধোপাখানা কী নেই বাড়িটাতে। দরজা দিয়ে বের হয়ে যদি অন্দরে বউরাণীর মহলে চলে যায় তবে আর এক বিড়ম্বনা। সে করিডর দিয়ে দৌড়ে যাবার সময়েই নির্মলা বলল, তুমি ওকে বকেছ।
—কাকে?
নির্মলা আসনে বসে খাচ্ছিল। তার পিছনে এমন ঘাপটি মেরে বসে আছে যে, টুটুলকে দেখাই যায় না।
সে বলল, টুটুলটা ছুটে ওদিকে কোথায় গেল! এত করে বলি সদর বন্ধ রাখবে। কোথায় খুঁজি! আমি বকব কেন!
নির্মলার চোখে ভারি তৃপ্তির হাসি। এই হাসিটুকু দেখার জন্য অতীশ যেন সারাজীবন প্রতীক্ষা করে আছে। তার টুটুলের কথা মনে থাকল না। নির্মলাকে জড়িয়ে পাশে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। যেন ওই নারী আবাদের ক্ষেত্র। এবং সে বীজ বহন করে। অতীশ নিজে বীজ বপনকারী মাত্র। সে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে নির্মলা বলল, আমার পেছনে লুকিয়ে বসে আছে। এই কি হয়েছে তোর?
—কী পাজি দেখেছ!
–কী করেছে?
বললাম, তোমার পিতামহের নাম কি বল তো? শুনেই দৌড়।
নির্মলা বুঝতে পারল না, হঠাৎ টুটুলকে তার ঠাকুরদার নাম মুখস্থ করাচ্ছে কেন। বলল, কেন
ও জানে না?
—জিজ্ঞেস করে দেখ! জানে কিনা!
নির্মলা এঁটোকাঁটা বাসনে তুলে কলপাড়ে রেখে দেবার জন্য উঠে দাঁড়ালে টুটুলকে দেখা গেল। সে চোখ বুজে ঘাপটি মেরে আছে। মা যে তার উঠে দাঁড়িয়েছে টের পায় নি। অতীশ দৌড়ে গিয়ে টুটুলকে বুকে তুলে নিল।
নির্মলার দিকে তাকিয়ে অতীশ বলল, ও বাবার কথা ভুলে গেছে। জান ও বিশ্বাসই করে না আমার বাবা থাকতে পারে।
টুটুল বুকের উপর দাপাদাপি করছে। সে নেমে যেতে চাইছে।
আর তখনই মিণ্টু দরজায় এসে বলল, আমি বলব বাবা?
—কী বলবি?
—ঠাকুরদার নাম।
মিণ্টু বলতেই পারে।
অতীশ বলল, বল তো?
সঙ্গে সঙ্গে টুটুল চিৎকার করে উঠল, না না আমি বলব।
মিণ্টু সঙ্গে সঙ্গে বলে দিল, চন্দ্রনাথ ভৌমিক।
আর টুটুলের সহসা কি ক্ষোভ জন্মাল কে জানে। কেউ বোধহয় জীবনে হারতে রাজি থাকে না। দিদির কাছে হেরে যাবে সে সহ্য করবে কেন। জোরজার করে বাবার কোল থেকে নেমেই মিণ্টুর চুল খামচে ধরল।
—বাবা আমাকে মারছে।
—টুটুল কী হচ্ছে। শোন। আঃ দিদির লাগে না! দিদিকে একদন্ড না দেখলে তো ভেউ ভেউ করে কাঁদিস। মারলে দিদি তোর রাগ করবে না!
ঠিক আছে, এই মিণ্টু তুই বলবি না। বল তোমার পিতামহের নাম কী?
—চন্দ্রনাথ ভৌমিক। বলেই টুটুল বাবার কোমরে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলল। সে যে পারে, সে যে দিদির মত সব বলতে পারে এটা জানার পর তার বোধহয় লজ্জা হয়েছে। এ-লজ্জার কী হেতু থাকতে পারে অতীশ ভেবে পেল না। বাবার বাবা থাকে এই স্বীকারোক্তিতে কী কোনও কারণে শিশুর মধ্যে গভীর কোনও আনন্দের প্রকাশ ফুটে ওঠে অথবা শিশু কি বোঝে এই বলার মধ্যে তার বড় কৃতিত্ব আছে, সে জানে, সে বলতে পারে পিতামহের নাম
অতীশ বুঝতে পারল, মিণ্টুই এখন তার সম্বল, সে টুটুলকে সরাসরি না বলে মিণ্টুকেই বলবে—এতে টুটুলের শেখার আগ্রহ বাড়বে, দিদি পারে সে পারবে না, তাহলে যে বাবা মার কাছে তার গুরুত্ব কমে যাবে। এতটুকু শিশুর এত বুদ্ধিতে অতীশ জীবনধারার কোনও আশ্চর্য চমক আবিষ্কার করে ক্ষণিকের জন্য আবার পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। এরা তার আত্মজ। আসলে এরাই তার জীবনে বেঁচে থাকার আগ্রহ।
বাসাবাড়িতে এরাই তার অস্তিত্ব। এরা ভাল থাকলে সে ভাল থাকবে। সে দুজনকেই নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, মিণ্টু এখানে বোস। টুটুল এখানে।
অতীশ ঠিক মাঝখানে।
সে তক্তপোশে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে বলল, তোমার প্রপিতামহের নাম মহেন্দ্রনাথ ভৌমিক। বল। হ্যাঁ বল। মহেন্দ্রনাথ ভৌমিক। বৃদ্ধ প্রপিতামহের নাম দেবেন্দ্রনাথ ভৌমিক। বল। মনে রাখবে। আমি বলে যাচ্ছি। জান, আমার বাবা কাকারা জীবনের শুরুতেই চেয়েছিলেন, আমরা যেন আমাদের পূর্বপুরুষদের ভুলে না যাই।
টুটুল মিণ্টু ভারি বিস্ময়ের সঙ্গে বাবার অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করছে। ঠাকুরদার চিঠিটা পড়ে বাবা তাদের যেন কেমন হয়ে গেল।
—কী মনে থাকবে তো? আমার অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহের নাম সুরেন্দ্রনাথ ভৌমিক, রাঢ়ি শ্রেণী, বন্দ্যোঘটি গাই মনে রাখবে। বাবা আসছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলে সব ঠিক ঠিক বলবে। না বলতে পারলে তিনি খুব দুঃখ পাবেন।
টুটুল মিণ্টুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে তার শৈশবে চলে গেছে টের পেল না। নিজেও কেমন শিশুর মত, বলল, জান আমাদের বাড়ির সামনে বিশাল একটা পুকুর ছিল। পুকুরের পাড়ে অর্জুন গাছ ছিল। আমার বড় জ্যাঠামশাই পাগল ছিলেন। কতদিন সকালে তাঁর সঙ্গে হাত ধরে আমি বের হয়ে গেছি।
—একবার জান, হাতিতে চড়ে পাগল জ্যাঠামশাইর সঙ্গে সেই কোথায় কতদূরে চলে গেছিলাম। জসীম এসেছিল হাতিটা নিয়ে। শীতে গ্রীষ্মে বাবুদের হাতি নিয়ে সে বের হয়ে পড়ত। সে ছিল মস্ত বড় মাহুত।
—মাহুত বোঝা?
—মাহুত হাতির পিঠে বসলে হাতি খুব বাধ্য হয়ে যায়, সে যা বলে তাই শোনে। হাতি নিয়ে সে বের হয়ে পড়ত। গাঁয়ের লোকেরা ভাবত, হাতিটা এলে জমিতে ফসল ফলবে, অজন্মা হবে না, মড়ক লাগবে না। হাতির প্রতি সরল বিশ্বাসে বাড়ি বাড়ি উৎসবের আমেজ আসত। চাল কলা ধান দূর্বা দিয়ে গেরস্থরা হাতিটাকে বরণ করত।
—আমার বাবা, মেজ জ্যাঠামশাই জমিদার বাড়িতে কাজ করতেন। জমিদারের হাতি। আমাদের পুকুরের পাড়ে হাতিটা বাঁধা থাকত। সেই হাতি নিয়ে আমার পাগল জ্যাঠামশাই একদিন হাওয়া। সোনালী বালির নদীর চর পার হয়ে আমরা চলে গেছিলাম, কত গাছপালা, পাখি, বিশাল বনভূমি—এ সব তোমরা দেখতে পেলে না। আমার কষ্ট হয় জান। আমরা কীভাবে বড় হয়েছি, আর তোমরা একটা বাসাবাড়িতে বড় হচ্ছ—জীবনে সেই অমল আনন্দ থেকে তোমরা বঞ্চিত। শৈশবের কথা বলতে বলতে আবেগে তার চোখে জল এসে গেল।
মিণ্টু বলল, বাবা তুমি কাঁদছ?
—কাঁদছি?
—হ্যাঁ, তুমি কাঁদছ।
—যা! বলে তাড়াতাড়ি অতীশ নিজের গোপন দুঃখকে আড়াল দেবার জন্য চোখ মুছতেই নির্মলা কলপাড় থেকে হাজির। হেসে বলছে, কী ব্যাপার এত শান্তশিষ্ট তোরা!
মিণ্টু হতবাক হয়ে গেছে। সে স্পষ্ট দেখেছে, বাবার ঠোঁট বেঁকে গেছিল। চোখে জল। বাবাকে সে দেখেছে, চুপচাপ, কথাবার্তা খুব বলে না। বাসায় যতক্ষণ থাকে, সংসারের দরকারী কথা ছাড়া একটা কথা নেই মুখে। মার শরীর ভেঙে পড়ার পর বাবার চোখ মুখ দেখলে টের পেত, কেমন জলে পড়ে গেছে যেন। সব বিষয়ে ভারি সতর্ক। যেন কেউ বাবার সব হরণ করে নেবে এমন একটা ভয়। রাতে শোবার আগে দরজা সব বন্ধ আছে কিনা, জানালায় দামী কোনও জিনিস পড়ে থাকছে কিনা সব দিকে লক্ষ্য। আর বাবা সবাই শুয়ে পড়লে নিজের টেবিল চেয়ারে বসে চুপচাপ কী লেখে। বাবা কখন ঘুমোতে যায়, সে টের পায় না, বাবা কত সকালে ওঠে তাও সে জানে না। যেন বাবা সবাইকে জাগিয়ে দেবার জন্য রাত জেগে বসে থাকে। সেই বাবা শিশুর মত কেঁদে ফেলায় মিণ্টু কেমন ঘাবড়ে গেছে।
সে মার হাত ধরে বলল, মা শোনো!
–কী শুনব!
—এস না!
—কোথায় যাব?
—এসই না। সে নির্মলার হাত ধরে টানতে থাকল।
নির্মলা বলল, তোরা আজ ঘুমাবি না! বাবা আসায় তোদের দেখছি পাখা গজিয়েছে।
—বলছি শোন।
আসলে এ-সময় ভাই বোন দুপুরে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমায়। মিণ্টুর স্কুল ছুটি। বড়দিনের বন্ধ। দুপুরে না ঘুমালে সাঁঝ না লাগতেই ঢুলতে থাকে। বড় ঘুমকাতুরে। দুপুরে ঘুমালে রাতে নির্মলা তাকে পড়াতে পারে। ছুটির দিনে আজ না ঘুমিয়ে বাবার সঙ্গে জমে গেছে।
তখনও হাত ধরে টানছে মিণ্টু। –এস না মা
মিণ্টু নির্মলাকে পাশের ঘরে নিয়ে দেখল, বাবাকে দেখা যায় কিনা। দরজার আড়ালে টেনে নিয়ে গেল নির্মলাকে। তারপর ফিসফিস গলায় কী বলল, যার একবর্ণ নির্মলা বুঝতে পারছে না। খুব গোপন কথা—বাধ্য হয়ে নির্মলা হাঁটু গেড়ে বসলে, কানে কানে বলল, জান মা, বাবা না কাঁদছিল।
—যা!
—হ্যাঁ। বাবা একবার নাকি হাতিতে চড়ে কোথায় চলে গিয়েছিল। বাবার জ্যাঠামশাই জান পাগল ছিল!
নির্মলা এ সব খবর রাখে। অতীশের বড় জ্যাঠামশাই পাগল ছিলেন, অতীশের ঠাকুরদার মৃত্যুর পরই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। আজ পর্যন্ত তাঁর কোনও খবর নেই। বিশ বাইশ বছর হয়ে গেছে, বড় জেঠিমা রোজই ভাবেন মানুষটা তাঁর ফিরে আসবেন। অতীশ তখন খুব ছোট। দেশভাগ হয়ে যাওয়ায়, বাড়িঘর জমিজমা সব বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। নিখোঁজ মানুষটা ফিরে আর আসেন না। অতীশ তার পাগল জ্যাঠামশাইর জন্য একটা গাছে লিখে এসেছিল, জ্যাঠামশাই আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি। ইতি সোনা।
আরও কত সব খবর, মানুষটা তাকে দিত। জ্যাঠামশাই তার ভারি সুপুরুষ ছিলেন। দীর্ঘকায় মেধাবী এবং কিটসের কবিতা অনর্গল আবৃত্তি করে যেতেন। অতীশ আর্চির প্রেতাত্মার ভয়ে যখন ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকে তখন নির্মলারও কেন যে মনে হয় এক সকালে দেখতে পাবে মানুষটা তার আর ঘরে নেই। নিখোঁজ হয়ে গেছে। এ-সব ভাবলে নির্মলা রাতে ঘুমাতে পারে না। সেই মানুষটার চোখে জল। কেন?
কী এত কষ্ট?
সে কেমন আরও মায়ায় জড়িয়ে যায়।
আজ প্রথম মনে হল, সেও মানুষটাকে কম নির্যাতন করছে না। ছ-সাত মাসের মত তারা দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। জরায়ু বাদ দেবার পরই নির্মলা তলপেটে কেমন একটা ব্যথায় কষ্ট পায়। এই অসুখটার জন্য সে অতীশকেই দায়ী ভেবে থাকে। বাপের বাড়ির সবাইর এই ধারণা আরও তার মধ্যে বদ্ধমূল করে দিয়েছে—অবিবেচক, শরীর বাদে কিছু বোঝে না। মা বাবা ভাই বোনই সব। নিজের কীভাবে চলবে সেটা অতীশ ভাবে না। বাবার মাসোহারা পাঠিয়ে দাও, পরে দেখব। লেখালেখির পয়সা যখন আছে, হয়ে যাবে। হয়ে যায় ঠিক, তবে নির্মলা টের পায় তার জন্য তাকে কতটা কৃচ্ছ্রতা স্বীকার, করতে হয়। সেই জ্বালাবোধ থেকেও হতে পারে রাতে অতীশ কাছে এলেই এক কথা, আমার শরীর ভাল নেই—পারব না। মানুষটা তখন কিছু বলে না। মুখ ব্যাজার করে উঠে চলে যায়। নির্মলা নিজের বিছানায় শুয়েও টের পায় অতীশ বাথরুমে ঢুকে স্নান করছে। শরীর গরম হয়ে গেলে, অতীশের বোধহয় এছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকে না।
আর তখনই মনে হয় অতীশ ভারি বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেছে। নির্মলার ভিতর অনুতাপ জেগে উঠলে বলবে, কী করব বল, আমার ভাল লাগে না।
অতীশ পায়চারি করবে, অথবা লেখার টেবিলে বসে বলবে, তোমার কোনও দোষ নেই। তেমাকে আমি দায়ী করছি না। এই আমার নিয়তি। এই আমার সাফারিংস।
টুটুল মিণ্টু ঘুমিয়ে থাকে। ওরা টের পায় না বাবা মার মধ্যে গভীর রাতে কথা কাটাকাটি চলছে। একজন ঠান্ডা মেরে গেছে অন্যজন উত্তেজনায় স্থির থাকতে পারছে না। অধীর হয়ে পড়ছে।
নির্মলা পাশ ফিরে শুয়ে আছে।
অতীশ বলছে, নিয়তি।
নিয়তি কী শেষ পর্যন্ত মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়! নির্মলার সঙ্গে তার প্রেম, প্রেম কী, না শরীর, নির্মলা এভাবে জোরজার করে তার সঙ্গে বাড়ি চলে না গেলে, সে শেষ পর্যন্ত কী করত বুঝতে পারে না।
মাঝে মাঝে গভীর রাতে টেবিলে লিখতে বসলে অতীশের এসব মনে হয়। আর মনে হলেই সেই দূরবর্তী নীহারিকা থেকে কে হেঁকে ওঠে লাভ ডাজ ব্রিং অ্যাবাউট জাস্টিস ইফ ইউ ওনলি ওয়েট অ্যাট লাস্ট। সে বাথরুমে স্নান সেরে বাসাবাড়ির খোলা বারান্দায় একটা চেয়ারে তখন চুপচাপ বসে থাকত। দূরের নক্ষত্রমালা দেখতে দেখতে কখন তার শরীর জুড়িয়ে যেত। দেখতে পেত সেখানে, এক অবারিত আকাশ, নীল সমুদ্র, একটা সাদা রঙের বোট। কবেকার কথা—অথচ মনে হয় এই মাত্র যেন সে সেই বোট ছেড়ে উঠে এসেছে ডাঙায়।
নির্মলা পাশের ঘর থেকেই উঁকি দিয়ে দেখল অতীশকে। আজ সকালের দিকে কারখানায় বড় রকমের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল। অথচ এখন দেখলে কে বলবে, মানুষটা তার প্রাণ সংশয় করে কারখানার একজন কর্মীকে ঝুপড়ি থেকে তুলে এনেছে। যেন জীবনে এটা কোনো ঘটনাই নয়। ফিরে এসে একবারও বলেনি, কী সাংঘাতিক ব্যাপার জান? সবাই ঘিরে ধরেছে, বোমা ফেলেছে, হাতে লোহার রড, সোডার বোতল—মারদাঙ্গা—সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার। তা হলে কি মানুষটা তার মৃত্যুভয় জয় করে ফেলেছে! নিজের জন্য ভাবে না! অথচ সেই মানুষটাই কী কারণে চোখের জল ফেলতে পারে বুঝতে পারল না। যে মানুষ মৃত্যুভয় জয় করতে পারে সে তো সাংসারিক শোকতাপ সহজেই অবহেলা করতে হয় কী ভাবে জেনে গেছে।
নির্মলা আজ মানুষটার জন্য বড় মায়া বোধ করছে। অতীশ টুটুলকে কোলে নিয়ে বসে আছে। যেন এ জন্যই অসময়ে ফিরে এসেছে বাড়ি। আর কোথাও বের হবে না। টুটুল মিণ্টু নির্মলা কাছে থাকলে সে কী নিরাময় হয়ে যায়।
অতীশকে তখন হাজার রকমের প্রশ্ন করছে টুটুল। চঞ্চল বালক, যা কিছু শোনে, দেখে সব তাতেই তার অনন্ত বিস্ময়। বাবা বাসায় ফিরে এলে বিস্ময়, বাবা বাসা থেকে বের হয়ে গেলে বিস্ময়, পাখি প্রজাতি দেখলে বিস্ময়, পাগল হরিশকে দেখলে বিস্ময়। রাস্তার বাস ট্রাম, রাজবাড়ির পুকুর, পুকুরের পাড়ে দেবদারু গাছ, কদম ফুলের গাছ, জঙ্গলের মতো হয়ে আছে কিছুটা জায়গা—যেন এমন জায়গাতেই রাতের জ্যোৎস্নায় পরীরা নেমে আসে—রাক্ষস খোক্কস, অথবা মানুষ কেন পাখির মতো উড়ে যেতে পারে না—এমন সব প্রশ্ন বাবাকে তার অজস্রবার। দুমবার সিং পাতাবাহারের গাছগুলির পাশে এসে দাঁড়ালেও তার বিস্ময়ের শেষ নেই। সেই খবর দিয়ে গেছে, রাজবাড়ির ছাদে পরীরা নামে। ছাদের কার্নিশে পাথরের মূর্তি সব, পাখা মেলা, তাকে দুমবার সিং বলেছে দিনের বেলায় ওরা পাথর হয়ে থাকে—রাত হলেই তারা প্রাণ পায়। উড়ে বেড়ায় কিংবা সেই জঙ্গলের মধ্যে নেমে খেলা করে। দুমবার বলে গেছে ওকে একটা বাচ্চা পরী ধরে দেবে।
—কুয়াশা হলে বাচ্চা পরীদের পাখা ভিজে যায়।
টুটুল জানালায় দাঁড়িয়ে এত আগ্রহ নিয়ে শোনে যে, পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় সত্য ঘটনা আর হয় না।
তখন পরীরা উড়তে পারে না। পাখা ভিজে গেলে ভারি হয়ে যায়, সকালের রোদে শুকিয়ে নিতে না পারলে উড়তে পারে না। দুমবার সব শিশুদেরই নাকি একটা করে বাচ্চা পরী ধরে দিয়েছে, টুটুলকেও দেবে।
দেখা হলেই টুটুলের এক কথা, দুমবার দাদা আমার পরী?
—খুঁজছি।—কোথায়?
—পুকুরের পাড়ে।
—পাচ্ছ না?
ঠিক পেয়ে যাব খোকনবাবু।
নির্মলার মনে হয়, এই যে ফাঁক পেলেই সদর খুলে টুটুল বের হয়ে যায়, ঘরে থাকতে চায় না, পুকুরপাড়ে একা একা হেঁটে বেড়ায়, শুধু সেই বাচ্চা পরীটাকে সে ধরে আনবে বলে। এ বয়সে সবার জীবনেই একটা বাচ্চা পরী লাগে। তারপর বাচ্চা পরীরাই নারী হয়ে যায়, নির্মলা হয়ে যায়।
সে কতদিন টুটুলকে বলেছে, পরীরা তোমার মতো দুষ্টু ছেলেকে ভালোবাসে না। টুটুল তখন শান্ত হয়ে মার কথা শোনে!
—পরীরা চায় না, ওদের তুমি খুঁজে বেড়াও। বাচ্চা পরী ধরে আনলে ওদের মা বাবার কষ্ট হবে না!
টুটুল বড় বড় চোখে মাকে দেখে তখন। তারপর মার কাছে গিয়ে আবদার করে, আমাকে তবে কোলে নাও। নির্মলা টুটুলকে কোলে নিয়ে বলবে, পুকুরপাড়ে আর একা যাবে না বল?
—গেলে কি হবে মা?
—পরীরা যদি তোমাকে তুলে নিয়ে যায়—তখন আমরা তোমাকে কোথায় পাব?
টুটুলের তখন মুখ ভয়ে শুকনো। সে মার চুলে মুখ লুকিয়ে বলে, আমি আর যাব না মা। কোথাও যাব না।
এখন সেই টুটুল বলছে, বাবা আমাকে হাতি দেখাবে না?
অতীশ সব কথাই একবাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছে। যা বলছে সব।
—দেখাব।
—বাবা তুমি আমি হাতির পিঠে চড়ে চলে যাব।
—কোথায়?
—সেই যে বললে সোনালী বালির নদীর চর পার হয়ে—আমরা সেখানে যাব।
অতীশ বলল, জান সেই চরে একটা বিশাল তরমুজের খেত ছিল। কতদিন ঈশম দাদা আমাকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে তরমুজের জমিতে চলে গেছে।
তরমুজ টুটুল দেখেছে, খেয়েছে। কিন্তু কোথায়, কেমন লতাপাতার মধ্যে ডুবে থাকে সেই নদীর চর অথবা বালিয়াড়ি—এক স্বপ্নময় জগৎ যেন পার হয়ে অতীশ আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। নিজে সারাজীবন বড় বেশি ভালবাসার কাঙাল। অথচ তার মধ্যে এক পাপবোধ নিরন্তর আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। অফিসে গেলেই মনে হয় টুটুলটা না আবার একা একা বের হয়ে যায়। কত সতর্ক থাকে সে। কেবল নিরম্ভর এক ভয় এরা একদিন সবাই তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। টুটুলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, মিণ্টুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—এমন এক আতঙ্কে সব সময় সে অস্থির হয়ে থাকে। বাসায় ফিরে ডাকবে, টুটুল কোথায় রে। মিণ্টু। কিংবা রাজবাড়ির সদরে ঢোকার মুখে তার চোখ সর্বত্র এই দুই শিশুকেই খুঁজে বেড়ায়। সে যখন দেখতে পায় তারা তাকে দেখে দৌড়ে আসছে, তখন এত হাল্কা বোধ করে যে, মনে হয় জীবনে এর চেয়ে বেশি কিছু চায়নি।
নির্মলা আড়ালে দাঁড়িয়ে আজ অতীশকে দেখছে। কতদিন পর এই চুরি করে দেখার মধ্যে প্রাণের ভিতর এক অতীব মায়া টের পাচ্ছে।
সে বোঝে কলকাতায় এসে মানুষটা বড় বেশি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে। যেন যে কোনো দিন, রাজবাড়ির অফিস থেকে তাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হবে, অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক বাড়তি লোক। কারখানা চালাবার মতো হিম্মত তার নেই।
তা হলে কী শেষে ফুটপাথ!
না বাড়ি।
কিন্তু বাড়ি ফিরে গেলে তারা খাবে কি! সবাই তো এই মানুষটার মুখাপেক্ষী। অতীশ মরে গেলেও বাড়ি ফিরবে না। তার টুটুল মিণ্টুকে বড় করা আছে। ওখানে গেলে পড়াশুনাই হবে না। এই শহরে সুযোগ সুবিধা কত। আজ ভাবল নির্মলা খবরটা দেবে। কয়েকদিন থেকেই ভেবেছিল, ওকে বলা দরকার। কিন্তু বলতে পারছে না। টুটুল মিণ্টুকে ছেড়ে থাকতে হবে ভয়েই সে বলতে পারছে না, জান সুবোধদার সঙ্গে দেখা।
—সুবোধদা!
—আমাদের বি.টি. কলেজের প্রিন্সিপাল।
—অ! হ্যাঁ হ্যাঁ! তোমাকে চিনতে পারল! কোথায় দেখা!
—বৈঠকখানা বাজারে। মির্জাপুর স্ট্রীটে থাকেন। রিটায়ার করেছেন। বার বার বলেছেন, একদিন তোমাকে নিয়ে যেতে। দেখেই বললেন, তুমি নির্মলা না! কী চেহারা হয়েছে তোমার!
নির্মলা মনে মনে এমন অজস্রবার ভেবেছে বলবে। সে বললে অতীশ কি বলবে, তাও ভেবেছে। কিন্তু সাহসে কুলায়নি। এই সংসারে সেও ইচ্ছে করলে যে উপার্জন করতে পারে, শহরে না হোক গাঁয়ে গেলে সে একটা শিক্ষকতার কাজ পেয়ে যাবে, এটা সে যেন অনেক আগেই জানত। অতীশ কম চেষ্টা করেনি শহরে, কিংবা কুমারবাহাদুরকেও অনুরোধ করেছিল, যদি কোনো মেয়েদের স্কুলে হয়। তার বাংলায় অনার্স আছে—কিন্তু হয়নি। হয় না। কারণ সব ক্ষেত্রেই একজন দক্ষ লোকের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। অথবা প্রভাব না থাকলে শুধু এলেমের জোরে এ বাজারে চাকরি হয় না।
নির্মলা এবার অতীশের সামনে এসে দাঁড়াল।
আসলে কী আজ মানুষটা বাড়ি ফিরে ঘাবড়ে গেছে। সকালের দিকে যেভাবে প্রাণ সংশয় করে এত বড় একটা দায় ঝোঁকের মাথায় ঘাড়ে তুলে নিয়েছিল, এখন ফিরে এসে কি ভেবেছে, এটা তার করা উচিত হয়নি। কিংবা ক্রমেই নিরাপত্তা বোধের অভাব প্রকট হয়ে উঠছে তার!
তার কিছু হলে, টুটুল মিণ্টুর কী হবে ভেবে কী চোখে জল এসে গেছিল!
নির্মলা বলল, কী ভাবছ এত বলত!
অতীশ এবার নির্মলাকে দেখল। এত সতেজ দেখাচ্ছে যে, সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না, নির্মলা বড় অসুখ থেকে ভুগে উঠেছে। তাকে দেখলে জীবনের কোন উত্তাপের প্রকাশ ছিল না এতদিন। সে বাসায় ফিরে এলে যতটা সম্ভব তাকে বিশ্রাম দেবার চেষ্টা ছাড়া নির্মলার অন্য কিছু করণীয় আছে মনে হত না। কতদিন হয়ে গেছে, সে আর নির্মলাকে সহবাসের ব্যাপারে ঘাঁটায় না। নিজের মধ্যেই টের পায়, নির্মলার সেই তিক্ত কথাবার্তা।
—শরীর ছাড়া তুমি কিছু বোঝ না।
রাতে ঘুম না এলে সে নির্মলার কাছে যাবার সময়ই মনে পড়ত কথাটা। সে ফিরে আসত। নির্মলা টের পেত না, একজন মানুষ তার স্ত্রীর পাশে শোবে বলে উঠে এসেছিল, আবার কী ভেবে ফিরে গেছে। অতীশ ভাবত সে নিজেই যেন আর্চির প্রেতাত্মা। জাহাজে বনির কেবিনের পাশে ঘুর ঘুর করত আর্চি। সে যে শরীরের প্রলোভনে নির্মলার পাশে শোবার জন্য পাগল হয়ে থাকে, সেই দীর্ঘ সমুদ্র সফরে আর্চিরও তাই হত। আর্চি স্থির থাকতে পারত না। বালিকা পুরুষের ছদ্মবেশে নারী হয়ে উঠছে, স্থির থাকে কী করে! মনে হত আর্চির সঙ্গে তার কোনো তফাত নেই। আর তখনই সে টের পেত নির্মলা ঠিক টের পেয়েছে। নির্মলা ভয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছে। স্কাইলাইট দিয়ে রাজবাড়ির বিশাল পাঁচিলে যে উজ্জ্বল আলো জ্বলতে থাকত তার রেশ ঘরে এসে আবছা জ্যোৎস্নার মতো ছায়া সৃষ্টি করত। মশারির নিচে নির্মলা, দীর্ঘাঙ্গী যুবতীর এই অসহায় শোওয়া দেখে ভাবত সে আর আর্চি একই দুষ্টগ্রহ থেকে সৃষ্ট। সেও একই প্রেতাত্মা হয়ে গভীর রাতে গোপনে পায়চারি করছে এই বাসাবাড়িতে।
নির্মলা গায়ে একটা হাল্কা র্যাপার জড়িয়ে নিয়েছে। অন্যদিন এ সময় সে সদর দরজায় তালা দিয়ে টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে লেপের নীচে শুয়ে থাকে। ওরা বোঝে মার শরীর ভাল না। মিণ্টু তো এখন অনেক কাজে নির্মলাকে সাহায্যও করে থাকে। মার কাছে এটা ওটা এগিয়ে দিতে পারলে কাজে সাহায্য হয় মিণ্টু এটা বুঝতে শিখেছে। মার খুব বাধ্যের। মার দু’পাশে শুয়ে এ সময় তাদের দিবানিদ্রার অভ্যাস।
আজ অন্যরকম।
অন্যরকম—কারণ মানুষটা তাদের ফিরে এসেছে। এ সময় কখনও ফেরে না। আজ ফিরে এসেছে। সারা সকাল কী যে আতঙ্কে কেটেছে, এখনও ভাবলে, শরীর হিম হয়ে যায়।
এখন একই তক্তপোশে স্ত্রী সন্তান সব নিয়ে অতীশের একটা ভিন্ন গ্রহ।
নির্মলা বলল, তোমার ঠান্ডা লাগছে না?
—না।
অতীশের হাত তুলে নিজের হাতে নিতেই নির্মলার মধ্যে রক্ত আবার উষ্ণ হতে শুরু করেছে। অতীশের হাত সত্যি ঠান্ডা।
এ যে কতকাল পর। সে ভিতরে অতীশকে একা পাবার আকাঙ্ক্ষায় বলল, চাদরটা দিচ্ছি, গায়ে দাও। হাত পা তোমার ঠান্ডা কেন?
অতীশের কোলে টুটুল। সে নামছে না। মিণ্টু বাবার পিঠে পিঠ দিয়ে বেতাল পড়ছে। আফ্রিকার জঙ্গল, দুর্ধর্ষ বুম বুম উপজাতির হীরের মুকুট, করোটির সিংহাসন—বেতাল ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে, চোখে মুখোশ পরা। কেমন গা শিরশির করছে পড়তে পড়তে। বাবার পিঠে পিঠ দিয়ে হাঁটুর নিচে ফ্ৰক টেনে সুদূরের জঙ্গলে সিংহ, বাঘ, কুমীর, জিরাফের সঙ্গে সেও যেন গভীর বনে ঢুকে যাচ্ছে। অধীর আগ্রহে সে পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছে, বেতাল তারই মতো একটা মেয়েকে উদ্ধারের জন্য নদী, বন, জঙ্গল, পাহাড় উপত্যকা পার হয়ে ছুটছে। টুটুল টের পায়নি। দিদিটা ছবির বই গোপনে পড়ছে। টের পেলে এত মজা, মজা থাকত না। সেও উঁচু হয়ে বসত দিদির পাশে। এটা কিরে দিদি, সিংহটা হাঁ করে আছে কেন? জলে এগুলো কী ভেসে বেড়াচ্ছে? পড়ার আনন্দটাই মাটি করে দিত। এত কথা বলতে পারে! এখন, বাবাকে জ্বালাচ্ছে।
নির্মলা বলল, তোরা বাবাকে একটু ঘুমোতে দিবি না। ও ঘরে গিয়ে শোও না। অতীশের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল।
অতীশের দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই। কিন্তু নির্মলার চোখে চোখ পড়ে যেতেই সে নিজেও ভিতরে আজ উষ্ণ হয়ে উঠছে। নির্মলার ভিতর যে মেঘের আভাস ছিল এতদিন, তা কেমন উড়ে গেছে। লক্ষ্য করে দেখল, অনেকদিন পর নির্মলা বড় করে সিঁদুরের টিপ পরেছে। মুখে হাল্কা প্রসাধনও করেছে। বিয়ের পর সে কত রাতে দেখেছে, সাঁঝ হলেই গা ধোওয়া, পাট ভাঙা শাড়ি পরা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রসাধন করা, খোঁপায় রজনীগন্ধার ফুল, কেমন এক নীল লণ্ঠন জ্বালিয়ে অপেক্ষায় থাকা। আজ ক’মাস ধরে নির্মলা প্রসাধন করে না। বেঁচে থাকাটা বিড়ম্বনার সামিল। চোখে মুখে তিক্ততার আভাস। অথচ অতীশ দেখছে সংসারে বিন্দুমাত্র তার উপেক্ষা নেই। একমাত্র রাত হলেই সে অতীশকে কেমন এড়িয়ে যেত। কথাবার্তা যতটুকু দরকার, সংসারের প্রয়োজনে অতীশের যতটুকু দরকার তার সঙ্গে—অতীশের সঙ্গে আর কোনো যেন সম্পর্কের কথা মনে থাকত না। মনে করিয়ে দিলে মুখ চোখে তিক্ততা ভেসে উঠত।
সেই নারী আজ একেবারে অন্যরকম।
সে আজ নিজের জীবন বিপন্ন করে মাধাকে ঝুপড়ি থেকে তুলে এনেছে। সেই পুণ্যফলে কী আজ নির্মলার মধ্যে ভালবাসার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছে।
নির্মলা টুটুলকে বলছে, তোরা ঘুমাবি না! কীরে! আয়। শুবি।
নির্মলা টুটুল মিণ্টুকে জোর করে ঘুম পাড়াতে চাইছে।
টুটুল বিন্দুমাত্র টলছে না।
মিণ্টু বলছে, আমার ঘুম পাচ্ছে না মা।
অতীশ বলল, যাও। মার কথা শুনতে হয়।
টুটুল বলল, বাবা আমাকে রেলগাড়ি কিনে দেবে না?
দেব। মার কথা শুনলে দেব।
একসঙ্গে দু’জনেই বুঝি এখন বুঝে ফেলেছে বড় অসহায় তারা। কিন্তু এই বাসাবাড়িতে দিন দুপুরে নির্মলাকে একা পাবার উপায় নেই।
অতীশ বলল, আমার পাশে বোস।
নির্মলা এবার টুটুলকে জোর করে কোল থেকে তুলে নিয়ে বলল, বাবার খুব আদর খাওয়া হচ্ছে!
টুটুল বাবার কোল থেকে কিছুতেই নামবে না।
অতীশের শরীর কেমন যেন এক অমোঘ আকর্ষণে ভেতরে ভেতরে পাগল করে দিচ্ছে নির্মলাকে।
সে বলল, টুটুল মিণ্টু এস।
গলায় বেশ ধমকের সুর।
—এস ঘুমাবে। বাবাকে একটু শুতে দাও।
—আমরা বাবার সঙ্গে শোব।
—অতীশ আর কি করে। যদি ওরা দু’পাশে শুয়ে বাবার পাশে ঘুমিয়ে পড়ে তবে নির্মলাকে পাওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে।
নির্মলা বলল, তোমরা, বাবার পাশে শোবে আর আমি ভেসে এসেছি!
নির্মলা একটা বড় লেপ এনে বলল, আমরা আজ সবাই তোদের বাবার সঙ্গে শোব। কেমন!
—না না! মিণ্টু উঠে বসল। তুমি ওধারে গিয়ে শোও না মা। বাবা আমাদের।
নির্মলা বলল, ইস তোদের একার!
টুটুল বলল, বাবা তুমি মার সঙ্গে কথা বলবে না কেমন! মা কেবল তোমাকে বকে।
—আমাকে বকে তোমার মা? অতীশ শুয়ে পড়ল কথাটা বলতে বলতে। লেপ টেনে গা ঢাকা দিল।
নির্মলা বলল, কী মিথ্যুক। কখন বকলাম!
—বারে বকো না, কেবল বলবে, তোমার বাবা যা একখানা মানুষ! সংসারে অচল। বাবা তুমি অচল!
নির্মলা কিছুতেই তার মানুষটার পাশে শুতে পারছে না। এত অধীর হয়ে পড়েছে, কেন এমন হয়! হঠাৎ আজ তার কী হয়েছে! সকালের আতঙ্ক থেকে মানুষটার অমঙ্গল আশঙ্কার ভিতরে তার যে ক্ষোভ ছিল, সব কি নিরাময় হয়ে যাওয়ায় আবার উরাট জমিতে বৃষ্টিপাত ঘটছে! উর্বরা হয়ে উঠছে তার আবাদের ক্ষেত্রটি!
কিন্তু সে কী করবে! দু’পাশে মিণ্টু টুটুল। তার বিরুদ্ধে বাবার কাছে নালিশ। বাবার পাশ থেকে তারা নড়বে না। বাবাকে তারা কিছুতেই ছাড়বে না।
—তুমি বল না বাবা অচল!
—বলি বেশ করি।
অতীশ মজা পাচ্ছে। এত সুন্দর বিকেল কতকাল পর তার জীবনে যেন এসেছে। বালিকার মতো মা মেয়েতে ঝগড়া করছে! মিণ্টু জরির সাদা এক গায়ে দিলে সত্যি একেবারে জলপরী। সবুজ বনভূমির মতো লাবণ্য শরীরে। দেখলেই বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করে। অথবা ভাইবোন মিলে যখন রাজবাড়ির মাঠে কিংবা বাগানে খেলা করে বেড়ায়, কিংবা বাবাকে সদর গেটে ঢুকতে দেখলে দৌড়ে আসে—অতীশের তখন কী যে হয়—যেন এই;ই শিশুকে বড় করে তোলার মধ্যে তার জীবনের সব কৃতিত্ব ধরা পড়ে গেছে। ঠিকঠাক বড় করে তুলতে পারলে বাবা হিসাবে তার অহঙ্কারের সীমা থাকবে না। ভাই বোন, তারই মতো গায়ের রঙ পেয়েছে। মিণ্টুর চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা। নির্মলা বড় যত্ন করে চুল আঁচড়ে দেয়। পাউডার মাখিয়ে দেয়। ওর ফ্রক প্যান্টি, জুতো সব সময় তকতকে ঝকঝকে মাথায় লাল রঙের রিবন বেঁধে মিণ্টু কত দেখতে সুন্দর এমন এক প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়ে গেছে নির্মলার মধ্যে। এত করে মিণ্টুর জন্য, সেই এখন বাবার পাশে মাকে কিছুতেই শুতে দিচ্ছে না। কেবল বলছে, তুমি তোমার ঘরে যাও না মা। বাবা আমাদের গল্প বলবে।
টুটুলের এক কথা, বাবা আমাকে কবে রেলগাড়ি কিনে দেবে? বল না।
টুটুল উঠে বসেছে। সে বাবার কাছে থেকে কথা আদায় না করে যেন ছাড়বে না।
নির্মলা বলল, দেখত টুটুল রান্নাঘরে কেক আছে।
সঙ্গে সঙ্গে টুটুল লাফিয়ে নামল নিচে।
—কোথায় মা?
—মিটসেফে আছে।
মিণ্টু উঠে বসল। বলল, বাবা তুমি কেক এনেছ?
অতীশ জানে সে কেক আনেনি। তবে নির্মলা আনতে পারে। আজকাল কেউ এলে বাসায়, নির্মলা চানাচুর বিস্কুট কিংবা কেক আনিয়ে দেয়। সে এনে রাখতেই পারে। গোপনে রেখে দেবার স্বভাবও আছে। কারণ যা দুটো বিচ্ছু, কোনো খাবারই ঘরে রাখা যায় না। এমন কি ঘরে কিছু না থাকলে, মিটসেফের মাথা থেকে চিনির কৌটো টেনে নামিয়ে মুঠো মুঠো চিনি গিলবে। তারপর মুখ মুছে ঘর থেকে বের হয়ে আসবে। নির্মলা আসলে টুটুলকে লেলিয়ে দিয়ে তার পাশ থেকে মিণ্টুকে তুলে দিতে চাইছে। কিংবা এও হতে পারে শরীরের অধীরতা এত সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে যে, সে নিজের সন্তানের মঙ্গল অমঙ্গলের কথা পর্যন্ত ভুলে গেছে।
টুটুল দৌড়ে এসে বলছে, কোথায় মা?
—মাঝের তাকে আছে।
মিণ্টু দৌড়ে নেমে গেল। টুটুল নাগাল পাবে না। আর সঙ্গে সঙ্গে নির্মলা অতীশের লেপের ভিতর নিজেকে আড়াল করে ফেলল।
কে আগে সেই গুপ্ত জিনিসটি খুঁজে বের করতে পারবে তার তাড়া। সবাই এখন যে যার গুপ্ত রহস্য সন্ধানে পাগল হয়ে উঠেছে। মিণ্টু ঘর থেকে টুল টেনে নেবার সময় দেখল বাবার পাশে মা শুয়ে আছে। টুটুল খুঁজে পেলে সবটা একাই সাবাড় করবে। মিণ্টু বলল, মা কোথায় রেখেছ?
—দেখ না খুঁজে, পাবে। যা না ও ঘরে।
—এই শোনো!
–কী?
—তুমি আজ কিন্তু বের হবে না।
—ঠিক আছে বের হব না।
—আমরা সবাই মিলে বেড়াতে বের হব।
—ঠিক আছে।
—এই শোনো! আমাকে জড়িয়ে শোও না
—ওরা বুঝতে পারবে নির্মলা।
—পাশ ফিরে শুচ্ছি। আঃ কী করছ! লেপটা টানছ কেন। পা বের হয়ে যাচ্ছে!
মিণ্টু কেক পেয়ে গেছে। আর পেয়েই দৌড়ে চলে এসেছে বাবা মার কাছে। মা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। বাবাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না যেন। বাবা লেপের তলায় হারিয়ে গেছে।
নির্মলা আর পারছে না। সব ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু মিণ্টু কী কিছু বোঝে! মিণ্টু তো একেবারে তক্তপোশের কাছে। নির্মলা কেমন নির্লজ্জ হয়ে উঠছে।
মিণ্টু ডাকল, বাবা।
অতীশ লেপের তলা থেকে সামান্য মুখ বার করে বলল, আমাকে দিবি না? সে হাত বাড়াল। এবং দু’জনেই এভাবে লুকোচুরি খেলার মতো দুই সন্তানের সঙ্গে যেন কিছুই হচ্ছে না, যৌন আস্বাদে আপ্লুত হবার মুখেই শুনল, টুটুল কোথা থেকে পড়ে গেছে। শুধু একটাই চিৎকার, মা!
নির্মলা আর পারে! সে দ্রুত লেপ সরিয়ে উঠে বসল। শাড়ি শায়া সামলে দৌড়ে গেল। অতীশ কেমন স্থির চোখে শুয়ে আছে। সব অধীরতা এভাবে সন্তানের আর্ত চিৎকারে ঠান্ডা মেরে যেতে পারে একদন্ড আগেও অনুমান করতে পারেনি।
সে শুয়ে থেকেই চিৎকার শুনছে নির্মলার—শিগগির এসো, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
অতীশ কোনরকমে বেশবাস ঠিক করে নেমে গেল। সে গিয়ে দেখছে, নির্মলার কোলে টুটুল। টুল থেকে পড়ে গেছে। মাথা থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। সে দেখছে টুটুল বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কী করবে ঠিক করতে পারছে না।
অতীশ দরজা খুলে টুটুলকে কাঁধে ফেলে এখন রাস্তার দিকে ছুটছে। রাজবাড়ির এই শীতের বিকেলে টুটুলকে বুকে নিয়ে ছুটতে দেখেই কুম্ভবাবু, রাধিকাবাবু, এবং সব মানুষজন ছুটে এসেছে, শিগগির ট্যাক্সি ডাক।
–কী হয়েছে!
–অতীশ কেবল বলছে জানি না।
বউরাণীর খাস বেয়ারা ছুটে এসেছে, কী হয়েছে?
—জানি না, জানি না। আমি কিছু জানি না।
নির্মলা শুধু বলল, পড়ে গেছে টুল থেকে। নির্মলা এ সময় বেশ যেন শক্ত। নিয়তি মানুষের, মানুষ নিজেই এই নিয়তি তৈরী করে নিজের জন্য, তার থেকে রেহাই পাবার কোনও উপায় নেই।
অতীশ টের পায় সেই প্রেতাত্মা আর্চি আজ সত্যি আবার প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে। সে তার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হতে না হতেই প্রেতাত্মার অশুভ প্রভাবে টুটুল পড়ে গেছে। এতো টুটুল নয়, যেন সে নিজে! ট্যাক্সির ভিতর সে আর নির্মলা! দু’জনের কোলে টুটুল নিথর।
কুম্ভবাবু দুমবার সিং সামনে।
হাসপাতাল।
ইমারজেন্সি ওয়ার্ড।
টুটুল যেন ঘুমিয়ে আছে।
সংজ্ঞা নেই।
নির্মলা উপুড় হয়ে পড়েছে, টুটুলের মুখের উপর, আমার বাবা। টুটুল আমার বাবা, টুটুল টুটুল! বাবা আমি এটা কী করতে গেলাম! টুটুল টুটুল বলে হাউহাউ করে কান্নায় নির্মলা টুটুলের বুকের উপর আছড়ে পড়ল।
এখন অতীশ কী করবে ঠিক করতে পারছে না। হাসপাতালে বসে থাকবে না বাসায় ফিরবে।
সে বলল, আমি কী করব? আমি এখন কী করব?
নির্মলা টুটুলের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। স্থির অবিচল—কোনও কথা বলছে না। ডেকেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কুম্ভ বুঝিয়েছে, নির্মলার মেজদির বান্ধবী বুঝিয়েছে, তবু সে নড়েনি।
অতীশের যেন আর দাঁড়াবারও ক্ষমতা নেই। বিকেল থেকে পাগলের মত ছোটাছুটি করছে। মেজদিকে ফোনে পায় নি। বার বার রিং বেজে গেছে। কেউ ধরে নি। এমন অসময়ে ফোন অথচ কেউ ধরছে না! ফোন খারাপ থাকতে পারে। নির্মলা হাসপাতালে থাকার সময় মেজদির বান্ধবী অনেক করেছে, আবার টুটুলকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে কে জানত! সে, কুম্ভ ইমারজেন্সিতে টুটুলকে ধরাধরি করে নামাবার সময় নির্মলা সহসা উধাও হয়ে গেছিল। কোথায় গেল! তার তখন কিছু ভাববারও সময় ছিল না।
দুজন হাউসস্টাফ ছুটে এসে বলেছিল, ওদিকে না, এদিকে।
ওরা ঘাড় গলার রক্ত মুছে, টুটুলের মাথায় ব্যান্ডেজ করার সময় নির্মলা হাজির।
এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, সুরুচিদি আসছে। হাসপাতালে কেউ একজন নিজের লোক থাকলে সাহস অনেক বেড়ে যায়।
নির্মলা ঠোঁট চেপে রুদ্ধ আবেগ সংবরণ করছিল শুধু। কথা বলতে পারছিল না। টুটুল হাত পা ছড়িয়ে যেন ঘুমাচ্ছে।
অতীশ বলেছিল, ভাল হয়ে যাবে। আসলে অতীশ বলতে চেয়েছিল, আমার এমন হবে জানতাম।
সুরুচিদি খুব সাহস দিচ্ছিলেন প্রথম থেকেই। ও কিছু হয় নি ঠিক হয়ে যাবে। মণিকাকে খবর দিয়ে দিও। আমি আছি।
সুরুচিদি হাউসস্টাফশিফ শেষ করেই হাতপাতালে কাজ পেয়ে গেছেন। ক’মাস আগে নির্মলার মেজদি মণিকা এবং সুরচিদি মিলে ওকে এই হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল। নির্মলার হিসটেরেকটমি করতে হয়েছে। সে সময় অতীশ প্রায়দিন টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে হাসপাতালে আসত নির্মলাকে দেখতে। আজ আবার টুটুলকে সেই একই জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। চারপাশে রোগীর আর্ত চিৎকার, ব্লাড সেলাইন সব চলছে। সারা ঘরে রোগী থিকথিক করছে। করিডরে পর্যন্ত জায়গা নেই। সুরুচিদি না এলে টুটুলকে এত সহজে ভর্তি করেও নেওয়া হত না। তিনি কী করণীয় সব বুঝতে পারছেন। দুবার তিনি আড়ালে রেসিডেন্ট সার্জেনের ঘরেও ঘুরে এসেছেন।
তারপরই একটা খাতায় সই করতে হল অতীশকে। প্রথম ঠিকানা, পরে ফোন নম্বর।
টুটুলকে স্ট্রেচারে করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সুরুচিদি এবার আর টুটুলের সঙ্গে গেল না। কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তিনি হয়ত জানেন/ অতীশ শুধু একবার বলেছিল, কোথায় নিয়ে গেল ওকে?
সুরুচিদির মুখ গম্ভীর। কেবল বললেন, আপনারা বাসায় যান। নির্মলা তুমি যাও। ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখ। আমরা যথাসাধ্য করব। বেশ রাত হয়েছে।
আসলে এই ফুটফুটে শিশুটির জন্য সুরুচিদিরও কোথায় যেন মমতা জন্মে গেছে। ছোট্ট শিশুদের এমনিতেই মানুষ ভালবাসতে চায়। টুটুল মার সঙ্গে দেখা করার সময় কতদিন সুরচি মাসির কোয়ার্টারে গেছে মেজদির সঙ্গে। টুটুলের সেই দৌরাত্ম্য এখন মনে করতে পেরে সুরুচিদিও কেমন ভাল নেই। স্নেহ মমতা সবই মেয়েদের মধ্যে একটু বোধহয় বেশি। এই যুবতীও কেমন কী এক গভীর আশঙ্কায় কাতর।
কুম্ভ বলল, আপনার কী মনে হয়—কোথায় লেগেছে। ভেতরে হেমারেজ হচ্ছে না তো!
অতীশ শুধু বলছে, ও ভাল হবে তো সুরুচিদি?
সুরুচিদির সঙ্গে আরও কেউ কেউ হাসপাতালের ডাক্তার নার্স দাঁড়িয়ে আছে। টুটুল মণিকার যে বোনপো, নির্মলার বোন এসব শুধু বলছিল। অতীশ বুঝতে পারছে, এরা সবাই মণিকাদিকে চেনে। সে জানত মণিকাদি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। সেই সুবাদে ডাক্তার নার্সরা মণিকাদির প্রতি কোথাও কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে যেন নির্মলাকে ঘিরে রেখেছে। যে বেডে এতক্ষণ টুটুল শুয়ে ছিল, নির্মলা তার পাশেই দাঁড়িয়ে।
কিছু বললেই এক কথা, কোথায় নিয়ে গেল ওকে! আমাকে দেখতে দেবে না! ও কোথায় আছে?
সুরুচিদি বলল, এস।
অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা নিচে অপেক্ষা করুন, ওকে দেখিয়ে নিয়ে আসছি।
ওরা লিফটে উপরে উঠে যাচ্ছে। নির্মলা কেমন অসাড়। কাঁদতে পর্যন্ত পারছে না। বুকের মধ্যে কেউ যেন কেবল হাতুড়ি পেটাচ্ছে। হাত-পা অসাড়। ঘোরের মধ্যে নির্মলা বুঝি হেঁটে যাচ্ছে। যেন এই যাত্রা তার অবিরাম, সে আর কোনদিনই নদীর পাড় দেখতে পাবে না। সামনে মনে হচ্ছিল সব ঝাপসা—এক বিভীষিকাময় অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ আলোর মধ্যে সে দেখল বিশাল কাচের ঘরে সাদা চাদরে ঢাকা বেড। কেউ নেই, সব কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। কাচের পাশ থেকেই সুরুচিদি বলল, ওদিকের তিন নম্বর বেডে টুটুল আছে। সেলাইন ব্লাড দেওয়া হচ্ছে।
মাথার ওদিকটায় ছোট স্ক্রিনের মধ্যে আঁকাবাঁকা সোনালি রেখা ফুটে উঠছে। সব রোগীর মাথার কাছেই ছোট ছোট স্ক্রিন। আঁকা বাঁকা রেখাগুলি বেঁচে থাকার লক্ষণ। মুছে গেলেই নিঃশেষ। খালি মাঠের মত কিংবা নক্ষত্র খসে পড়ার মত শুধু শূন্যতা।
ওদিকের দেয়ালে বড় একটা স্ক্রিন—সেখানেও সব জীবনের রেখা ভেসে যাচ্ছে। মৃত্যু মানুষের বড় কাছাকাছি বসবাস করে। অথবা সে আছে ছায়ার মত নিত্যসঙ্গী। এই বড় কাচের ঘরটার পাশে এসে নির্মলার শরীর কেমন কাঁপতে থাকল। টুটুলের মুখ দেখা যাচ্ছে না। ওর কোঁকড়ান চুল শুধু দেখা যাচ্ছে। আজ সকালেও টুটুল বউরাণীর বাগান থেকে মার জন্য ফুল তুলে এনেছিল, আজ দুপুরেও দিদির সঙ্গে মারামারি করেছে, আজ বিকেলেও কেক খাবার জন্য ছোটাছুটি করেছে—সেই টুটুল এখন কাচের ঘরে শুয়ে।
নির্মলা কাচের মধ্যে যেন পারলে সারা মুখ ঠেসে দিয়ে দেখতে চাইছে। ওর পা দুটো দেখা যাচ্ছে। কী সুন্দর ছোট পা দুটো। নির্মলা সহসা কেমন চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল, আমার টুটুলের যদি কিছু হয়, আমি কী করব দিদি।
সুরুচিদি ডাকলেন, এস
নির্মলা কাঁদছে না। সে পাথর। সে হেঁটে যাচ্ছে। সুরুচিদিকে কিছু যেন বলারও নেই। শুধু অনুসরণ। সে বুঝতে পেরেছে, শেষ চেষ্টা চলছে।
সে নিচে এলে একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসতে বলা হল। একবার তাকাল অতীশের দিকে। তারপরই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
অতীশ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন তার কিছু হয়নি। টুটুল তার কেউ না। সে ভাসমান সমুদ্রের ছবি এবং নিঃসঙ্গতা টের পাচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে, এক অতিকায় অ্যালবাট্রস পাখি ডাঙার সন্ধানে বের হয়ে পড়েছে। বনি শুয়ে আছে, ঠোঁটে কস। গলা শুকনো। শরীর নিথর। কত সব স্মৃতি! কখনও ঝোড়ো বাতাসে, পাগলের মত অজস্র ঢেউয়ের মাথা ভেঙে তার বোট এগিয়ে চলেছে। পালে হাওয়া লেগেছে—যেন আজ হোক কাল হোক ডাঙা তারা পাবেই। দিশেহারা সে কখনও হয় নি। অথবা কখনও ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি। তারাবাতির মত নীল জলে ফুটে উঠেছে অজস্র নক্ষত্র। বনি ছইয়ের নিচে প্রসাধনে ব্যস্ত। ছোট্ট দুটো বাংক। দুজনে পা ছড়িয়ে কোন রকমে শুতে পারে। বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত, পৃথিবীর আকাশ একই রকম। দু’জন তরুণ তরুণী মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সহবাসে লিপ্ত হচ্ছে।
জলের নিচে পারপয়েজ মাছ খেলা করে বেড়াচ্ছে।
জলের নিচে র্যামোরা মাছ হাঙ্গরের পেটে জোঁকের মত আটকে আছে।
গভীর জলের নিচে দেখা যায় তাদের বিশাল শরীর। ভয় করে না। দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে। এবং কেন যে মনে হয় প্রাণই হল প্রাণের উৎস। যত বীভৎসই হোক সেই সব হাঙ্গরের বিশাল হাঁ, সমুদ্রের হাহাকারের মত ভয়ঙ্কর নয়। ওরা মাছ দেখলে সাহস পেত, ওরা দূরের দিগন্তে সূর্যাস্তের সোনালি রঙ দেখলে সাহস পেত, আকাশের নক্ষত্রমালা দেখলে সাহস পেত। সবচেয়ে বেশি নিৰ্ভয় হতে পারত্ব অ্যালবাট্রস পাখিটা সারাদিন পর উড়ে এসে বোটের মাথায় বসলে। দুজনেই তখন কথা শুরু করে দিত।
আমরা আর ডাঙা পাব না? বনি এমন প্রশ্ন করত।
অ্যালবাট্রস পাখির নীল চোখ দুটো কেমন অসহায় দেখাত তখন। যেন অতীশকে বলত, ছোটবাবু তুমি আমার ম্যান-অ্যালবাট্রসকে সলিল সমাধি দিয়েছ, আমি এ খবর রাখি। আমার মনে হয় সে আছে তোমাদের মধ্যে। তোমরা আছ বলে, আমি তার অস্তিত্ব টের পাই। আমি উড়ছি। সমুদ্রের অনন্ত হাহাকারের মধ্যে উড়ে যাচ্ছি। কোনো ডাঙার খোঁজ আজ হোক কাল হোক ঠিক পেয়ে যাব। তোমরা ভেঙে পড়বে না।
আসলে অতীশ নিজেই লেডি অ্যালবাট্রসের হয়ে তার কথা ভাবত।
সে বলত, জান আমাদের ডাঙায় ফিরতেই হবে। জান বনি কিছু খেতে চাইছে না। বনি চায়, আমি বাঁচি। আমি চাই, বনিকে ডাঙায় পৌঁছে দিই। পারবে না? হে অ্যালবাট্রস, আমাদের প্রিয় এলবা, বল পারবে না? সাহস দাও। আমাদের সাহস দাও। তুমি ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।
পাখিটা শুধু ওদের দেখছে।
কি পারব না?
পাখিটা অসহায় চোখে যেন দেখছে।
কি বলছি শুনতে পাচ্ছ?
না না। শুনতে পাচ্ছি না।
বনি, কিছু বলছে না কেন এলবা? মুখ গোমড়া করে রেখেছে। আজ সারাদিন সমুদ্রের অতলে ডুব সাঁতার দিয়েও একটা মাছ পাই নি—এ কোন সমুদ্রে এনে ফেলল সে! একটা মাছ নেই। কোনও জলজপ্রাণী নেই। এ কোন সমুদ্র! আর্চি আমাদের শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে এল! এলবা তুমিও কী আর্চির অশুভ প্রভাবে পড়ে গেছ! এখন আর আমরা কম্পাসের কাঁটা দেখছি না। তুমি যেদিকে উড়ে যাচ্ছ, বোটের মুখ সেদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছি। কী ঘাড় কাত কর। বল, হ্যাঁ, তুমি সেই অশুভ প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করেছ। দুরাত্মা আর্চি আমাদের অজানা সমুদ্রে নিয়ে এসে তামাশা দেখছে।
আর তারপরই মনে হল, এই হাসপাতাল, এই রক্তপাত শিশুর সবই আর্চির অশুভ প্রভাব থেকে। সেই নিরন্তর হাহাকার সমুদ্রের মতো। সে হাত তুলে চিৎকার করে উঠতে চাইল, না, না, বনি, আমি বিশ্বাস করি না, কথা বল, বনি বনি বনি! প্লিজ কথা বল, আমি যে একা। আমার যে কেউ থাকল না। অনেকদিন পর পাগলের মতো চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সুরুচিদি বলল, কিছু হলে ফোনে জানিয়ে দেব। ভাববে না। সব কিছুর জন্য মানুষকে প্রস্তুত থাকতে হয়। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিলে অতীশ দেখল নির্মলা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। রাজবাড়ির গেটে অনেকে তাদের ফেরার অপেক্ষায় আছে।
এক প্রশ্ন, টুটুল কেমন আছে!
অতীশ শুধু বলল, ভাল আছে!
নির্মলা চোখ বুজেই আছে। মেস বাড়ির ঠিক দরজার সামনে দেখল হাসি দাঁড়িয়ে আছে। মিণ্টুকে কোলে নিয়ে বউরাণী দাঁড়িয়ে আছে।
বউরাণী বলল, ভর্তি করে দিয়ে এলি?
—হ্যাঁ।
—কেমন আছে?
—ভাল।
কারণ অতীশের আর কোনও কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে দরজা খুলে ডাকল, নিমু আমরা বাসায় এসে গেছি।
নির্মলা চোখ মেলে তাকাল। কিছু বলল না। বউরাণী, হাসি এবং রাজবাড়ির সবাই দেখল বড় ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে নির্মলাকে। নাড়ি ছিঁড়ে গেলে মানুষের এমন হয়।
ওরা কুম্ভকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গেল—কেমন আছে।
—খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে। অপারেশন হতে পারে। অতীশ বউরাণীকে ডেকে শুধু বলল, অমলা, ফোন এলে খবর দিও। খারাপ কিছু হলে জানাবে।
প্রাইভেট অফিসে রাতে দুমবার শোয়। ঠিক ফোনের কাছটায় একটা ক্যাম্পখাট বিছিয়ে সে শুয়ে থাকে। গভীর রাতে কিংবা সকাল পর্যন্ত ফোন তুলে তারই কথা বলার নিয়ম।
দুমবার আজ সারারাত জেগে থাকবে।
টুটুলের সঙ্গে তার ভারি ভাব। একা মানুষ। বয়েস হয়ে গেলে শিশুরাই তার সঙ্গী। টুটুল দেখলেই বলত, দুমবার দাদা, আমায় পরী ধরে দিলে না।
দুমবারের চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে।
কোথায় কীভাবে কে যে নাড়ি ধরে টান মারে কেউ কখনও তা টের পায় না। খোকনবাবুর জন্য তার এতটা টান যেন জীবনেও বোধ করে নি।
অতীশ সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে।
বউরাণী বলল, মিণ্টু যা। তোর মার কাছে যা। নির্মলা মিণ্টুকে কোলে নাও। সেই কখন থেকে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
এতক্ষণে মনে হল টুটুলকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময়, মিণ্টুর কথা একবারও মনে হয় নি। সে কোথায় কার কাছে আছে মনে ছিল না। টুটুল এতক্ষণ জীবনের সর্বস্ব গ্রাস করেছিল।
—নিৰ্মলা!
—নির্মলা সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে।
—নিৰ্মলা!
বউরাণী ছুটে গেল। মিণ্টুকে ওর বুকে দিয়ে বলল, ধর।
নির্মলা মিণ্টুকে বুকে তুলে নিতে গিয়েই ভেঙে পড়ল।
হাসি বলল, দিদি কী করছেন! এতে টুটুলের অমঙ্গল হবে।
বউরাণীর কোনো সন্তান নেই। সন্তানের জন্য কী গভীর উদ্বেগ ভোগ করতে হয় আজ যেন সে প্রথম টের পেল। এই উদ্বেগ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বড় দরকার। মানুষকে আলগা হতে দেয় না। নিঃসঙ্গ হতে দেয় না। মানুষ এরই মধ্যে বেঁচে থাকে বলে, জ্যোৎস্নার মত নিবিড় স্নেহ অনুভব করা যায়।
বউরাণী আজ কেন যে গোপনে কেঁদে ফেলল! শিশুরাই মানুষের জন্য এক গভীর অরণ্য সৃষ্টি করে রাখে। তারা সেখানে বাঁচে, বড় হয়, হেঁটে যায়—আবার এক শিশু আসে পৃথিবীতে কোনও বানভাসি প্লাবনের মত সে দামাল, সে নিষ্ঠুর, সে স্নেহ মায়া মমতা সব।
অতীশ দরজা বন্ধ করে দিল।
নির্মলা কোনরকমে বিছানার কাছে এসে মিণ্টুকে শুইয়ে দিল। ঘুমে কাতর। তার ছোট ভাইটাকে কোথায় রেখে এসেছে, সকাল হলেই দুজনকে অভিযুক্ত করবে।
—আমার ভাই কোথায়? কার কাছে রেখে এলে? কী হয়েছে! আমার ভাই কোথায় বল! কিছু বলছ না কেন! অতীশ টের পায়, এ আর এক বিপজ্জনক খেলা শুরু জীবনের—। এতটা সে সামাল দেবে কী করে! নির্মলা এবং মিণ্টুর উদ্বেগ যে তাকে পাগল করে তুলবে।
মিণ্টুর মশারী টাঙিয়ে দেবার সময় বলল, নিমু কিছু মুখে দাও।
আর তখনই দরজায় ঠকঠক শব্দ।
কোনও খবর।
হৃৎপিন্ড উপচে রক্ত ছলাৎ করে অতীশকে নাড়া দিয়ে গেল।
দরজা খুলে দেখল, কুম্ভ, হাসি, রাধিকাবাবু।
অতীশ দেখল তারা উঠে আসছে।
সে বলল, আপনারা বলুন। চুপ করে আছেন কেন!
হাসি বলল, খাবেন আমাদের বাড়িতে। দিদি কোথায়?
ভয় উদ্বেগ নিমেষে জল হয়ে গেল। সে কেমন কিছুটা হাল্কা বোধ করছে। এত মায়া টুটুলের জন্য তবে সে হৃৎপিন্ডে পুষে রেখেছে। দরজায় খুটখুট শব্দ উঠলেও ভয় পায়। কে কি খবর নিয়ে আসবে!
সে বলল, খেতে ইচ্ছে করছে না।
রাধিকাবাবু বললেন, পাগলামি করবে না। এস। মানুষেরই বিপদ আপদ থাকে। এ সময় যে যত অবিচল থাকতে পারে নিয়তি তার কাছে তত জব্দ। ওঠো। খাবে। বউমা, ও বউমা—এভাবে না খেয়ে থাকলে চলবে কেন? বউমার বাপের বাড়ি ফোন করেছ?
—লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। অতীশ বলল।
—সকালে দুমবারকে চিঠি দিয়ে পাঠিয়ে দেব। এস তোমরা।
নির্মলাকে কিছুতেই ওঠান গেল না। কোনও কথা বলছে না। যেন সহসা নির্বাক হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় জীবনেও আর সে কথা বলবে না। কেবল মিণ্টু তার ভরসা। অতীশ বলল, সত্যি খেতে ইচ্ছে করছে না। বমি পাচ্ছে।
ওরা আর জোরজার না করে চলে গেল।
কুম্ভ যাবার সময় বলল, দরজা বন্ধ করে দেন। এই কুম্ভকে এখানে আসার পর থেকে কেমন অবিশ্বাস করে আসছে। আজ কুম্ভ যা করেছে-আসলে তার কেন জানি আজ মনে হল, হোয়াট ইজ রাইট, সে বোধহয় ঠিক জানে না। কুম্ভর এই একটা গুণ অতীশকে মাঝে মাঝে সত্যি ভারি বিব্রত করে। যে কুম্ভ ঠগ, ধাপ্পাবাজ, দু-নম্বরী মাল দিয়ে পয়সা কামাবার তালে থাকে, সেই কুম্ভ যেন আজ অন্য মানুষ। তার কেন জানি মনে হয় মানুষ দোষে গুণে। গুণেরই প্রশংসা করা উচিত। কুম্ভ চলে গেলে সে ভারি অসহায় বোধ করতে লাগল।
দরজা বন্ধ করে এসে দেখল নির্মলা মিণ্টুর পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। নির্মলা ঘুমায় নি। ঘুম আসবে না সে জানে। কুলুঙ্গিতে আছে তার শেষ আশ্রয়। সেই ধূপবাতিদান, পাথরের ছোট্ট নারীমূর্তি, মাথায় মুকুট এবং কয়েকটা ফোকর। এই বাতিদানটা হাতে নিতেই সেবারে সে কেমন বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে গেছিল। ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলে হয়। পাথরের নারীমূর্তি থেকে এক দূরাতীত আত্মা যেন তার সঙ্গে কথা বলে। সে শুনতে পায় সেই কন্ঠস্বর। বনি তাকে সাহস দিচ্ছে।
বাতিদানটা হাতে নিয়ে ঠিক বনির মত প্রতিধ্বনি করল, আই উইল প্রেইজ দ্য লর্ড নো মেটার হোয়াট হেপেনস।
বনির তারবার্তা ভেসে আসছে।
এই তারবার্তা থেকে সে সাহস সঞ্চয় করে। টেবিলের উপর সে বাতিদানটা রেখে তাকিয়ে থাকল। পলক ফেলছে না। জন্মমৃত্যু কালের যাত্রা রূপক মাত্র ভাবল। যেখানে বেঁচে থাকা এক অদৃষ্ট শক্তির ইচ্ছে। যেখানে মানুষের বেঁচে থাকা কোনও এক অলৌকিক জলযানের মতই শুধু আশ্চর্যভ্রমণ। যে ভ্রমণ ক্ষণকালের আবার চিরকালের। তার পরবর্তী বন্দর কী সে জানে না, সে ভেসে চলেছে। অতীশের মনে হয় এ এক যেন মানুষের নিরবধি ভ্রমণ—মানুষের, প্রেমের, ঈশ্বর এবং শয়তানের। জন্ম থেকেই শুরু, এ জন্মেই তা শেষ।
বনি বোটে অসহায় বোধ করলে যেমন ঈশ্বরের বন্দনা করত, আজ অতীশও বনির মত ঈশ্বরের বন্দনা করছে। সে জানে না সত্যি ঈশ্বর বলে কেউ আছেন কিনা, সে সেভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসীও নয়, তার মনে হয় এক মহাজাগতিক শক্তি তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে। কোনও দেব-দেবী কিংবা স্বর্গ-নরক সে বোঝে না। মানুষের মৃত্যুই শেষ। এই জীবনই তার ইহকাল পরকাল—তবু আজ সে বড় নিরাশ্রয় —টুটুলের জন্য সেই অজ্ঞাত শক্তির কাছে মাথা হেঁট করে প্রায় বনির কথাগুলিই বলে যেতে লাগল—ইয়োর স্টেডফাস্ট লাভ, ও লর্ড ইজ অ্যাজ গ্রেট অ্যাজ অল দ্য হেভেনস। ইয়োর ফেইথফুলনেস রিচেস বিয়ন্ড দ্য ক্লাউডস। ইয়োর জাস্টিস ইজ অ্যাজ সলিড অ্যাজ গড’স মাউন্টেন। ইয়োর ডিসিশানস আর অ্যাজ ফুল অফ উইজডম অ্যাজ দ্য ওসেনস আর উইথ ওয়াটার।
অতীশ আবার কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সে সব ভুলে যাচ্ছে। ইহকাল পরকাল জন্মমৃত্যু টুটুল মিণ্টু সব। তার একটাই যেন কাজ আর্চির প্রেতাত্মার প্রভাব থেকে বনিকে রক্ষা করা। বনিকে না টুটুলকে!
সে বিড়বিড় করে বকছে, ও গড মাই স্ট্রেনদ, আই উইল সিঙ ইয়োর প্রেইজেস ফর ইউ অ্যাজ মাই প্লেস অফ সেফটি।
যেন সেই দূরাতীত কোনও অস্তিত্ব তাকে দিয়ে আজ শপথ করিয়ে নিচ্ছে। সে তার পুত্রের মঙ্গলার্থে যে কোন অবিশ্বাসের কাছে মাথা নত করতে পারে। এমন কী সব কীটপতঙ্গ, ধূলিকণা, ঝড়, পাখি, গাছপালা সবার কাছে। মাথা নত করে সে পুত্রের জীবন ভিক্ষায় পাগল হয়ে উঠছে।
সে উঠে দাঁড়াল। সেই ধূপবাতিদান, যার মারফত সে দূরাতীত কন্ঠস্বর শুনতে পায়, এক রাতে সে ঘোরের মধ্যে দেখেছিল মূর্তিটা বনির অবয়ব ধারণ করছে, তাকে আজ হাতে তুলে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলবে বলে চিৎকার করে উঠল, টুটুলের কিছু হলে আমি তোমাকে খুন করব। আই শ্যাল কিল ইউ। ইউ নো মি ভেরি ওয়েল।
আর তখনই নির্মলা বিছানা থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসেছে। তার শাড়ি সায়া পর্যন্ত ঠিক নেই। সে ছুটে এসে বলছে, তুমি কী বলছ! কার সঙ্গে কথা বলছ!
অতীশ আর পারল না। বলল, আমি খুন করেছি। আমার নিস্তার নেই, আমাকে পিঠে ক্রস বহন করতেই হবে।
—তুমি খুন করেছ!
—হ্যাঁ। আর্চিকে। আর্চিকে আমি খুন করেছি।
—কোথায়, কবে!
—জাহাজে। সে বড় নিষ্ঠুর হত্যা নির্মলা। তুমি বুঝবে না। কেন আমি খুন করেছিলাম। কেন কেন কেন খুন করতে গেলাম! আমি আর্চির চেয়ে এক বিন্দু মহৎ নই। আমি অমানুষ। আমার পাপের শেষ নেই। বলতে বলতে সে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে।
—তুমি কী পাগল হয়ে যাচ্ছ!
—আমি জানি না। আমি জানি না।
—না তুমি কখনও খুন করতে পার না। তোমার মাথার ঠিক নেই। এস। বলে হাত ধরে শিশুর মত বিছানার পাশে নিয়ে গিয়ে বলল, শোও। তুমি এমন করলে আমরা যাব কোথায়!
অতীশের মধ্যে আবার স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে। সে কেমন বোকার মত বলল, আমি চিৎকার করছিলাম! কখন!
—না তুমি কিচ্ছু কর নি। কপালে যা আছে হবে। তুমি আমাদের সব। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। কেউ নেই।
আর তখনই দরজায় খুটখুট শব্দ।
—কে? কে?
অতীশ দৌড়ে গেল।
—বাবু ফোন।
—ফোন!
আর সঙ্গে সঙ্গে অতীশ বলল, সব শেষ। আমি কি করব! দুহাত তুলে সে ঘরের ভিতর ছুটে গেল। বাতিদানটা হাতে তুলে আছাড় মেরে ভাঙতে গেল।
নির্মলা অসহায়। আর্ত চিৎকার। সে পাগলের মত অতীশকে ঝাঁকাতে থাকল। ফোন, কার ফোন! কোথা থেকে! তুমি দাঁড়িয়ে কেন! অতীশের মনে হল, সব শেষ। তবু মানুষকে শেষ খবরের জন্যও অপেক্ষা করতে হয়। শেষ খবর মানুষের জন্য কী থাকে কেউ জানে না। বাতিদানটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর সে দরজা খুলে সোজা অন্দরমহলের ভিতর দিয়ে ছুটে গেল। ফোন ধরে বলল, কে? কে আপনি? আপনি কি সেই ঈশ্বর!
—আমি সুরুচিদি। ঈশ্বর নই। টুটুলের জ্ঞান ফিরেছে। ক্রাইসিস কেটে গেছে। তুমি অতীশ বলছ তো?
অতীশের যেন বিন্দুমাত্র আর ক্ষমতা নেই নড়বার। শুধু বলল, হ্যাঁ, আমি অতীশ।
এত উত্তেজনা, অধীরতার পর এমন শুভ বার্তা মানুষের জন্য অপেক্ষা করতে পারে সে জানত না। তার হাত থেকে রিসিভারটা খসে পড়ে গেল।
দুমবার বলল, কে ফোন করেছিল?
সে বলল, সেই দূরাতীত রহস্য দুমবার। তুমি ঠিক বুঝবে না। সে আবার ছুটতে থাকল। ঘরে ঢুকে দেখছে নির্মলা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ স্থির। বাতিদান কুলুঙ্গিতে তুলে রেখেছে নিৰ্মলা।
তার কোনও আজ কান্ডজ্ঞান নেই। সে নির্মলাকে বুকের কাছে টেনে আনল। পাগলের মত জড়িয়ে ধরে বলল, টুটুলের জ্ঞান ফিরেছে। ক্রাইসিস কেটে গেছে। সুরুচিদি ফোনে জানিয়েছে। সে নির্মলাকে বুকের মধ্যে সাপটে ধরে এসব বলার সময়ই মনে হল নির্মলাও সাপটে ধরেছে। কতকাল পর সেই স্নেহ, মায়া, মমতা ভালবাসা যেন আবার ফিরে পেয়েছে উভয়ে। গাছপালায় ঝড় উঠে গেছে। ডালে পাতায় পৃথিবীতে বেঁচে থাকায় আশ্চর্য সুষমা