।। তেইশ।।
শিউপূজন ওর খাটিয়াতে শুয়ে আছে।
ভাঙা চালের নিচে একটুকুন ছায়া। ঝিরঝিরে হাওয়া কলকাতায় বয়ে যাচ্ছে। কাকের উপদ্রব বাড়ছে। ওর চারপাশে আজকাল কাক উড়ছে খুব। শরীরে পচা গন্ধটা ভুরভুর করছে। সেই গন্ধে কাকেরা সব উড়ে আসে। ওর চালে খাটিয়ার পাশে কা কা করে ডাকে। ভয়ে সর্বক্ষণ সে তার ঘা ঢেকে রাখে। কখন কোন ধান্দাবাজ কাক ঠুকরে দেবে—ভয়টা সেখানেই। বাইরে কল, কল থেকে জল পড়ছে। ওর রক্ষিতা গত মাসে মারা গেছে। সেই থেকে সম্বল তুলসীদাসী রামায়ণ। মনে হাবিজাবি চিন্তার উদয় হলেই সুর করে রামায়ণ পড়তে বসে যায়। মেয়েমানুষ বাদে জীবন রুক্ষ মাঠের মত। একটা মাস মনে হয় গোটা একটা সাল। শরীরে এত পোকামাকড় আর কটু গন্ধ মানুষের থাকলে মানুষ বাঁচে কি করে! খুব দার্শনিক ভঙ্গীতে চোখের উপর হাত রেখে জীবনের হরকিসিম কিসসার কথা ভাবছিল।
তখনই দেখল, ম্যানেজারবাবু কারখানার অফিসঘরে ঢুকছেন। শিউপূজন সম্মান দেখানোর জন্যে উঠে বসল। বলল, রাম রাম বাবুজী।
অতীশ ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল শিউপূজনকে। বলল, রাম রাম। হাত পা ব্যান্ডেজ করা একটা রুগ্ন মানুষ তেজী ঘোড়ার মতো বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। সংসারে কেউ নেই। দেশে নেই, ঘরে নেই। অতীশ শুনেছে, কি করে লোকটা অনেক টাকার মালিক। দু-পাঁচশ টাকা সহসা কারখানার দরকার হলে শিউপূজনকে বললেই দিয়ে যায়। সে কারখানার একটা শেড সেই কবে থেকে দখল করে আছে। আগের ম্যানেজার ওকে থাকতে দিয়েছিল। ডাইসপত্রের নিপুণ কারিগর বলে, লোকটা কোম্পানির পক্ষে খুবই দরকারী। এখনও খুব জটিল কোনও ডাইসপত্রে কোনও গন্ডগোল দেখা দিলে শিউপূজনের ডাক পড়ে। এই একটা কাজে সে এখনও পৃথিবীর দরকারী মানুষ।
অতীশ ভাবল, আসলে শিউপূজন একটা ঘাটের মড়া।
কিন্তু লোকে এটা টের পাবে বলেই শিউপূজন জোরে জোরে হাঁটার চেষ্টা করে। সাবলীল থাকতে চায়। ভাড়া আদায়ের সময় গরম কথা বলে। দুনিয়ায় যতক্ষণ বাস ততক্ষণ নড়েচড়ে বেড়াতে হবে! সে মোদ্দা কথাটা বুঝেই ঘরে বেড়া দেয়, চালে টালি দেয়, বিছানা রোদে দেয়, দোকান থেকে ঝাল খাবার আনিয়ে হুসহাস খায়। পাতে মাছি বসলে রাগ করে। জলে ফিটকারি দিয়ে রাখে। সর্বোপরি গন্ধ দূর করবার জন্য ঘরে সব সময় আতর ছড়িয়ে দেয়।
অতীশের কেন জানি মনে হল পচন, এই হচ্ছে পচন যাকে বলে সারাটা কালই মানুষ বয়স বাড়ার সঙ্গে শরীরে পচন ধরাচ্ছে। শেষে সেই নদীর পাড় এবং অগ্নিকুন্ড। সে বসল তার চেয়ারে, ড্রয়ার খুলল, কি দেখল, নিজেও জানে না। অভ্যাসবশে সে কাজগুলি করে যায়। তার যেমন চেয়ারটায় বসলে হাই ওঠে, আজও উঠল, অবশ্য রাতে ঘুম হয়নি, শরীরে কেমন একটা জ্বর-জ্বর ভাব।
শিউপূজনের কথাবার্তা ধার্মিক মানুষের মতো। কথায় কথায় রামের বনবাস, সীতা হরণ, দুরাচারী রাবণের কথা বলে উদাহরণ দেবার মোক্ষম একটা প্রয়াস থাকে। পুণ্যের জয়, পাপের পরাজয় এই বোধটা লোকটার ভীষণ। রক্ষিতা সম্পর্কে সে কখনো চিন্তাশীল হয়নি। ভাড়া আদায় করা এবং কাক- পক্ষীকে খাওয়ানো তার ধর্মীয় কাজ। সে কালীঘাটে ফী হপ্তা রিকশা করে যায়। সেদিন একটা রিকশা দিনমান তার হেফাজতে থাকে।
কপালে লাল চন্দনের ফোঁটা পরে। গরম পড়লে মাথায় দেশী কায়দায় ফেটী বাঁধে, ফুল, বেলপাতাসহ একটা বড় ঠোঙা আনে মিষ্টির। সেটা সে ছোঁয় না। বস্তির কার্তিক মল্লিকের সেজ ব্যাটা তখন তার সঙ্গী। সেই এসে ঘরে ঘরে প্রসাদী ফুল, বেলপাতা বিলোয়। আর বাকি ছয়-দিন ঘর আর খাটিয়া। সন্ধ্যায় দেশোয়ালী মানুষ আসে। সে মোমবাতি জ্বালিয়ে সুর ধরে রামায়ণ পাঠ করে শোনায়
অতীশ একদিন এতো পুণ্যবান থাকার চেষ্টার বিষয়ে প্রশ্ন করলে যা বলেছিল তাতে বুঝেছে শিউপূজন এখন যা করছে সবই পরকালের জন্য। ইহকালে তার আর করার কিছু নেই এবং সে ভেবে ফেলেছে পরকাল তার খুবই উজ্জ্বল। সে পরকাল থেকে আবার পৃথিবীতে আসবে, নতুন মানুষ, শরীরে কোন রক্তপুঁজ নেই। ঘা নেই, ব্যথা-বেদনা নেই। সতেজ এবং সুশ্রী মানুষ। কোন এক অলৌকিক পৃথিবী থেকে সে তার সব জরা-ব্যাধি এমনকি মৃত্যুকেও জয় করে আসবে।
অতীশের মনে হলো, শিউপূজনের ভরসা আছে, তার কিছুই নেই। সে এ সময় খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। ঘরে কেউ নেই। ফোনটাও বাজছে না। ও ঘরে কুম্ভবাবু আসেন নি। সকালে কুম্ভবাবুর রাজবাড়িতে কি নাকি জরুরী কাজ আছে। সে বাসায় এসে বলে গেছে—অফিসে যেতে তার দেরি হবে। পাশের শেডে ঘটাং ঘটাং শব্দ। বোধহয় প্রিন্টিং মেশিনের প্লেট সেট করা হচ্ছে। বেলটিং তুলে দিচ্ছে কেউ এবং মোটর চালাবার আওয়াজে সে বুঝল কাজ পুরোদমে চলছে। সে কম কথার মানুষ। অর্ডারপত্র বেড়েছে। কুম্ভবাবুর আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও অর্ডারের অভাব ঘটেনি। কিন্তু সে বুঝতে পারে বাঘকে উপোসী রাখার মতোই সে আগুন নিয়ে খেলা করছে। মনের মধ্যে এই বিষয়টা সহসা খচ্ করে কামড় দিল। কুম্ভবাবুর উপরি রোজগার একদম বন্ধ বলা যাচ্ছে না। এখনও কিছু হচ্ছে। এই কিছু হওয়াটা বন্ধ করতে না পারলে অতীশ স্বস্তি পাচ্ছে না। এবং আরেকটা কাঁটা মাধব। সে জানে মাধব শুয়ে আছে পুরোনো বাড়ির রকে। রাস্তায় আসতে রকটা পড়ে। সে তার কারখানার কর্মীর এমন দুরবস্থা দেখবে না বলেই পট্টিবাজারটা ঘুরে আসে। রাজরোগে আক্রান্ত তার কারখানার কর্মী শুয়ে আছে রকে। দেখলে মনে হবে ম্যানেজার পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
এখনও কিছু অতীশ করে উঠতে পারে নি। কুম্ভবাবু বলেছে, ঘুষ দিলে পরদিনই বেড পাওয়া যাবে। না দিলে পাবেন না। কলকাতায় না এলে অসুখ বিসুখের জন্য ঘুষ দিতে হয় অতীশ জানত না। কিছুক্ষণ পরেই কুম্ভবাবু এল। এসেই দু’ হাত ছড়িয়ে টেবিলে বসল—দাদা সুখবর।
অতীশ জানে পৃথিবীতে আর তার সুখবর থাকতে পারে না। স্ত্রী অসুস্থ, টুটুলের জলের বাই, মিণ্টু বড় হচ্ছে, বাবা টাকার প্রত্যাশায় বসে থাকে, লেখার বিড়ম্বনা, মাথার মধ্যে আছে ঘায়ের মতো বিষণ্ণ এক পাপবোধ। সে ঘুষ দিয়েছে এবং তার যে সম্ভ্রমটুকু ছিল মনুষ্যত্বের, তাও এই কুম্ভবাবুরা হরণ করে নিল। সে কোনও সুখবরের প্রত্যাশা করে না। গেল রাতে আর্চি তাকে জ্বালিয়েছে। এই ক্লেশ থেকে আত্মরক্ষার কোন উপায় তার জানা নেই। শুধু একদিন টুটুলকে পিতা পিতামহের নাম বলার সময় কেন জানি মনে হয়েছিল এই বলার মধ্যে কোথাও তার পাপ খন্ডনের পরিত্রাণ থাকতে পারে। কুম্ভবাবু তার দিকে তাকিয়ে আছে এখনও। কুম্ভবাবু আশা করছে সে কিছু বলবে। অগত্যা কুন্তই ফের বলল—আপনার মাইনে বাড়ছে।
—বাড়ছে কেন?
কোথায় খুশি হবে, কোথায় সারা মুখে তৃপ্তি দেখা দেবে, তা না প্রশ্ন!
—রাজা খুব খুশি।
অতীশ বলল, ঘুষ দিলে রাজা খুশি থাকে জানতাম না।
—জানলে ঘুষ দিতেন না?
—না।
—আপনি সত্যি একটা আবাল মানুষ দাদা।
আবাল কথাটা তাকে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দিল।
সে বলল—আবাল মানে?
—ঐ নিজের কথা যে ভাবে না।
—আমি তো নিজের কথা ছাড়া আর কিছু ভাবি না কুন্তবাবু। সব সময় নিজেকে নিয়ে বিপন্ন
—কোথায় দাদা, মাইনে বাড়ছে, কত বাড়ছে, কবে থেকে বাড়ছে কিছুই বললেন না? শুধু বললেন, বাড়ছে কেন? এমন কথা কি কেউ বলে? আর কার বাড়ছে জিজ্ঞেস করলেন না? খুব গোপন দাদা, আমারও বাড়ছে।
—বা বেশ। খুশী আপনি?
—কি যে বলেন দাদা, খুশী হব না? এ কটা টাকায় চলে? কি মাগগি গন্ডার বাজার। রাজা মাইসে যাবার আগে অর্ডার করে গেছেন।
কে খবর দিল এ প্রশ্নটা অবান্তর। ঠিক রাধিকাবাবুর খবর। সব সময়ই রাধিকাবাবু রাজবাড়ির খবর আগে পায়। তারপর পায় রাধিকার ছেলে কুম্ভ। কুম্ভ সেইসব খবর বয়ে আনে কারখানায়। সব সময় অতীশকে ভয়ের মধ্যে রাখে। এখনও রাজার সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন হলেন তার বাবা রাধিকাবাবু। কুম্ভের পেছনে লাগতে গেলে সাপের ল্যাজে পা পড়বে। কথাবার্তায় কুম্ভ যেন অতীশকে এ বিষয়টাতে সজাগ রাখতে চেষ্টা করে।
অতীশ বললো—আজ একবার ই এস আই অফিসে যান, বেডের কি হলো দেখুন
—আপনি দাদা বেড বেড করে পাগল হয়ে গেলেন। এদিকে মাধব কি করেছে জানেন?
অতীশ বললো—কি করেছে?
—পয়সা রোজগারের ধান্দা। শালা মনুষ্য জাতটাই বেজন্মার বাচ্চা। অতীশ বুঝতে পারল না, ই এস আই-এর কথায় পয়সা রোজগারের ধান্দা এলো কোত্থেকে। সে নিজের ভয়ের কথা বললো না। রাস্তায় কালীবাড়ির সামনে পুরনো বাড়ির রোয়াকে মাধব বসে থাকে। ঝড় বৃষ্টি হলে পাশের শেডে গিয়ে বসে। নিমাই-এর বৌ খাবার দেয় দুপুরে। চাঁদা করে খাবারের পয়সা তোলা হচ্ছে। অতীশকেও দিতে হয়। কারখানার সব কর্মচারী এক দু টাকা করে দেয়। এবং ওষুধপথ্য যা আসছে তার কিছু নাকি চুরি করে মাধব বিক্রি করে দিচ্ছে। আরো যা খবর কুম্ভবাবু দিল তাতে সে তাজ্জব বনে গেল। বলল, বেড পেলেও ও হারামজাদাকে নিয়ে যেতে পারবেন না।
অতীশ কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে ভয়ে অন্য রাস্তা ধরে আসে কারখানায়। কারণ রাস্তার দু’পাশের মানুষগুলো দেখবে ঐ সিট মেটালের ম্যানেজার যায়। মাধব ওর কারখানায় কাজ করে বুকের ব্যামো বাধিয়ে বসেছে। অস্থানে কুস্থানে ফেলে রেখেছে এবং সব দায় যেন অতীশের—মানুষগুলো তাকে দেখে এমন ভাবতে পারে। এজন্য ভয়ে সে আজকাল ঘুরে আসে কারখানায়। সে দূর থেকেও দেখেছে, মাধব করুণস্বরে ডাকে, জোরে জোরে কাশে, যদি মানুষের দয়া হয়। সে হাত পেতে থাকে। পয়সা ভিক্ষা করে। এক দুদিন করতে করতে স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে এখন এবং শিব মন্দিরের পুণ্যার্থীরা পূণ্য অর্জনের জন্য দু পয়সা পাঁচ পয়সা দিয়ে যায়। একটা পুঁটুলি বানিয়ে ফেলেছে রেজগি পয়সার। এতসব খবর কুম্ভ এক নিশ্বাসে বলে গেল। অতীশ মাথা নীচু করে শুনল।
তারপর বলল—মাধব ইচ্ছে করে কারখানার অসম্মান করছে।
অতীশ ভেতরে ভেতরে রুক্ষ হয়ে উঠছিল। সে বলল—এটা ইজ্জতের প্রশ্ন কুম্ভবাবু। কুম্ভ বলল—ইজ্জতের কথা বলছেন কেন?
—মাধব সিট মেটালের কর্মী সবাই জানে। ওকে যেভাবেই হোক ওখান থেকে তুলে আনতে হবে।
—জানলে বয়ে গেল।
—সিট মেটালের একজন কর্মী রাস্তায় পড়ে থাকবে বলছেন কি!
—তাহলে কোথায় পড়ে থাকবে, কোথায় রাখবেন? কেউ ঘর দেবে না ওকে
—রাস্তা থেকে তুলে নিন। দেখি কি করা যায়।
—রাখবেন কোথায়?
অতীশ উঠে দাঁড়াল, বলল—আসুন।
সদর রাস্তায় সিট মেটালের একজন কর্মী ভিক্ষা করছে! অতীশের মাথাটা কেমন গরম হয়ে উঠল। অসহায় অবস্থানের চেয়েও মারাত্মক ভিক্ষাবৃত্তি। যেন সারাটা কারখানার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করছে মাধব। অতীশ লাফিয়ে পার হয়ে গেল দু’নম্বর গেট।
ডান দিক ধরে ঘুরে গেল। লেদ শপের পাশ দিয়ে ঘুরে বার্নিশ ঘরে ঢুকে ডাকল—এই শক্তি, এই পঞ্চা এদিকে আয়।
কাঠের কিছু বাক্স প্যাকেজের জন্য রাখা। অতীশ সব নিজেই ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিতে থাকল। কর্মীরা এই মানুষটাকে আর কিছু না করুক, বড় সমীহ করে। কোন দুষ্ট প্রভাবে না পড়লে তারা অতীশের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে না। এবং কেউ কেউ ছুটে এসে দু’হাতে সরিয়ে দিচ্ছে সব। কুম্ভের মনে হচ্ছিল পাগলামি। সে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। আসলে সে কোনো গোপন রন্ধ্রপথ খুঁজছে যদি কোনও মওকা পাওয়া যায়।—অতীশ নামক বেয়াড়া জেদী মানুষের হাত মুচড়ে দেবার। ফলে সে যেন তামাশা দেখার মত উপভোগ করছে। কোন প্রশ্ন করছে না।
অতীশ বলল—এই জায়গাটা খালি পড়ে থাকে। ওদিকের দরজা খুলে দিলে কারখানার সঙ্গে কোন যোগাযোগ থাকবে না। শিউপূজনের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করবে। আপনার কি মনে হয়?
কুম্ভ খুব গম্ভীর গলায় বলল, আচ্ছা হবে। অফিসে চলুন।
কুম্ভ জানে এখানে এই কর্মীদের সামনেই অতীশ কত বড় ইম্প্রাকটিক্যাল তা সে প্রমাণ করতে পারে। কিন্তু সদ্য মাইনে বেড়েছে এবং এত বড় অঙ্কের মাইনে রাজবাড়ির কনসার্নে কস্মিনকালে একধাক্কায় কারো বাড়েনি। এ বিষয়ে অতীশবাবুর পুণ্যফলই সব, সুতরাং এ সময়ে সে সবার সামনে মানুষটাকে নাকানি-চোবানি খাওয়াতে চায় না। কৃতজ্ঞতা বলে কথা। সে শুধু বলল আসুন, আসুন না আপনি!
কুম্ভ আরো জানে লেবার জাতটাই নেমকহারাম। যত দেবে, তত দাবি বাড়বে। ওদের সামনে সে বলতেও পারে না, আপনি কি ক্ষেপেছেন মশাই! কার জায়গা! আপনার না আমার? কোম্পানির জায়গা, আপনি দেবার কে? হ্যাঁ, হয় সবই হয়। বোর্ড মিটিং-এ রেজলিউশন নিন। প্রস্তাব পাস হলে আপনি থাকতে দিতে পারেন। কেউ জানল না, ডিরেকটররা সব বাইরে, রাজা গেছেন মাইন্সে, আর তখন কিনা কথা নেই, বার্তা নেই একটা রাস্তার লোককে ধরে আনছেন। জায়গা দিচ্ছেন। জায়গা দিলে মৌরুসীপাট্টা পেয়ে যাবে না? আর উঠবে? ব্যাড প্রিসিডেন্ট তৈরী হবে না! এ সবই বলতে পারত কুম্ভ। কিন্তু চতুর মানুষদের যা হয়, সে অত আবাল লোক নয়, লেবারদের সামনে বলে অপ্রিয় হবে। সে অফিসে এসে বলল—আনবেন না।
—আনলে কি হবে। এমনিতেই জায়গাটা খালি পড়ে থাকে, পুরনো লোহালক্কড় কাঠের বাক্স গাদা মেরে পড়ে থাকে। একটা মানুষকে সেখানে রাখলে কি হয়?
—অনেক কিছু হয়। মানুষের যে দাদা দুষ্টুবুদ্ধি আছে। লোহালক্কড়ের তা নেই। পড়ে থাকবে কোম্পানির কোন অনিষ্ট করবে না, এরা অনিষ্ট করবে। থাকতে দিলে, উঠতে চাইবে না, মামলা মোকদ্দমা করলেও তুলতে পারবেন না। সাধে কে কবে ঝাড়ের বাঁশ সেধে নেয় বলুন!
অতীশ বললো—আমাদের কারখানার কর্মী তাই বলে রাস্তায় বসে ভিক্ষে করবে?
—করুক না। কতো লোক তো করে। সরকারই পারে না, আর আপনি তো কোন্ ছার।
অতীশ বুঝতে পারল কুম্ভবাবুর ভীষণ আপত্তি। এই মানুষটা তার সব কাজের বিঘ্ন। সে কিছুটা পরাজয়ের গ্লানি বোধ করতেই ভেতরের সেই মানুষ, এক গোঁয়ার মানুষ উঁকি দিয়ে যায়। অতীশ বলে ওঠে, এখন তো নিয়ে আসি। রাজা এলে কথা বলে নেব। সে সুধীরকে ডেকে বলল—মনোরঞ্জনকে ডাক।
তারপর কুম্ভর দিকে তাকিয়ে বলল—আপনিও রাজার কাছে চলুন। হাসপাতালে বেড যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে, এখানে এনেই রাখি।
কুম্ভ খুব বেশি আর আপত্তি তুলল না। ধর্মের দিক থেকে সে ঠিক আছে। সে বার বার বারণ করেছে। যখন সওয়াল হবে রাজার কোর্টে তখন সে বলতে পারবে, বার বার বারণ করা সত্ত্বেও অতীশবাবু অধমের কথা কানে তুললেন না। তখন সে রাজার আদালতে একজন বিচক্ষণ মানুষ বলে প্রমাণিত হবে এবং যা যা বলে রেখেছিল, তাই যে প্রমাণিত হলো, সেটাও রাজা দেখতে পাবে। এখন তাড়াতাড়ি অতীশের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্যই সে বলল—আপনার ওপর কোনও কথা নেই। নিয়ে আসতে চান নিয়ে আসুন। কিন্তু দাদা তখন বলবেন না, কুম্ভবাবু সঙ্গে ছিল। আমি আপনার আদেশ শুধু পালন করছি।
অতীশ বুঝতে পারে, ভেতরে কূট বুদ্ধি কুম্ভবাবুর। সব সময় তাকে পরাজিত করে মজা দেখার বাসনা। কুম্ভ বলেই রেখেছে, সরকারই পারে না। সরকার পারে না কথার অর্থ, সরকার তার ইজ্জত রক্ষা করতে পারে না। একটা সরকারের অধীনে মানুষ রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি করে, পকেট মারে, ছিনতাই করে, রাস্তায় শোয় এসব বড়ই অস্বস্তিকর বিষয়। এত বড় সরকারের যখন চক্ষুলজ্জা নেই, তখন আপনার থেকে কি হবে?
অতীশ বুঝতে পারল, সে আর এক পা এগোতে পারবে না। কারখানার অতিরিক্ত ঘরটায় লোহা- লক্কড় পড়ে থাকবে, তবু একজন মানুষের ঠাঁই হবে না। আইন কার জন্য সে বুঝতে পারল না। লোহালক্কড়ের জন্য, না মানুষের জন্য।