1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ২৮

।। আটাশ।।

অতীশবাবু বের হয়ে গেলে কুম্ভ কেমন বোকার মতো কিছুক্ষণ বসে থাকল। মগজ কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। অতীশবাবু চারুকে খুঁজছে।—চারু! চারুকে চাই। আচ্ছা লোকটা যে পাগল হয়ে যাচ্ছে, চারুকে দিয়েই সেটা শুরু করা যেতে পারে। কুম্ভ কেমন বিড়বিড় করে বকছিল।

হাসিরাণী ঘর থেকে বের হয়ে বলল, এ কি বসে থাকলে কেন! বাজারে যাবে না! কখন রান্না

করব! দাদাকে আবার খেতে বলেছ।

—দাদা! হুঁ।

হাসিরাণী যেন এই মানুষটাকে কিছুতেই বুঝতে পারে না। সকাল ভাল করে হতে না হতেই কাবুল জানালায় এসে ডেকে তুলেছিল কুম্ভকে—এই কুম্ভ শিগগির ওঠ। তোর ম্যানেজারবাবু এসে গেছে। সারারাত ধস্তাধস্তি চলেছে।

—ধস্তাধস্তি!

—তাই বাবু। বৌদিকে তখনই বলেছিলাম ও নেই, বাসা খালি, খালি বাসা রঙ করানো ঠিক হবে না। বাসাটাকে বৌদি ভদ্রস্থ করতে চেয়েছিল। নিজে পছন্দ করে সব কিনেছে। আর মধ্য রাতে বাড়ি থেকে ফিরে একেবারে পাগলামির চূড়ান্ত। বৌদির সোফা সেট, বাতিদান খাট সব টেনে নিয়ে গিয়ে দরজায় ঠেলে ফেলে দিয়েছে।

কুম্ভ শুনে মজা পাচ্ছিল। সে এমনই হোক চায়।

একজন বিশ্বাসী মানুষ চাই। কোম্পানি লুটেপুটে খাচ্ছে, মাথায় একজন বিশ্বাসী মানুষ বসিয়ে দাও। কুমারবাহাদুর শেষে এই হাফ ম্যাড লোকটাকে এনে হাজির করেছিলেন। দু-বছরে যা দেখাল! মাসখানেকের ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল। বৌকে বাপের বাড়ি রেখে গেছে—কেমন এক অপার্থিব ঘোরের মধ্যে থাকে লোকটা! এখন সেই কি না প্রশ্ন করে গেল, চারুকে চেনেন? পিয়ারীলালের ভাইঝি চারু। বউরাণীর পেয়ারের লোক এই অতীশবাবুটিকে চারু নামক এক বেশ্যা মাগি ধরিয়ে দিয়েছে জানতে পারলে যে কি হবে! মগজ ঘামছিল কুম্ভর। সে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

কুম্ভ বৌর তাড়া খেয়ে উঠে বসল। বাজারে সকালে না গেলে পছন্দ মতো জিনিস কেনা যায় না। সকালে উঠেই বলে এসেছিল, দাদা, কাল রাতে কিছু ঠিক খাওয়া হয় নি। কখন এলেন? ট্রেন লেট ছিল বুঝি? হাসি আপনার জন্য চা করছে।

আসলে কুম্ভ জানে এই অতীশবাবু নামক পদার্থটিকে হাতের কব্জায় না আনা পর্যন্ত কাজ হাসিল হচ্ছে না। কিন্তু এত বেয়াড়া লোক নিয়ে চলাও দায়। এই যে চা খাবার সময় বাবুটির অনুপস্থিতিতে কারখানার এত কাজের খবর দিল তার জন্য কোনও ধন্যবাদ নেই। কেমন ঘোরের মধ্যে থাকে সব সময়। হাসিরাণীকে কেবল দেখছিল।.

সে বের হয়ে দেখল, কোনদিকে গেল! প্রাসাদসংলগ্ন মেসবাড়ি, বাবুপাড়া, বাবুর্চিপাড়া, গোলা ঘর—আস্তাবলের দিকটায় এখন গ্যারেজ —সেখানে কুমারবাহাদুরের গাড়ি, বউরাণীর গাড়ি, প্রাইভেট সেক্রেটারির গাড়ি থাকে। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বিঘা জমি জুড়ে এই বাড়ির একটাই সদর রাস্তা। গেট দিয়ে ঢুকে রাস্তাটা প্রাসাদটাকে চক্রাকারে ঘিরে রেখেছে।

মাথায় এখন তার চারু। পিয়ারীলালের ভাইঝি বলে বাবুটির সঙ্গে একই গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। আসলে চারু যে পিয়ারীর রক্ষিতা, ঠিক রক্ষিতাও বলা যায় না, দরকারে তাকে বাবুদের কাছে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়ে থাকে—বলতে গেলে চারু পিয়ারির হয়ে ভাড়া খাটে কিন্তু এই একটা লোক এসেই কারখানার দু’নম্বরি মাল বানাবার ব্যবস্থা বানচাল করে দিয়ে, পিয়ারি এবং অনেককে পথে বসাবার তালে ছিল—সেটা আর হতে দিচ্ছে না। সব রকমের ফন্দি ফিকির যখন ব্যর্থ তখনই কুম্ভর এই নষ্টামি মাথায় পেরেক ফুটিয়ে দিয়েছিল—আরে তাইত!

—শেঠজি, কিছু করা যাচ্ছে না। ম্যানেজার রাজি না।

—রাজাকো বলিয়ে কিছু কোরে দিন। এতকালের ব্যওসা। পথে বসে যাব।

—দু-নম্বরী মাল হবে না।

—ম্যানেজার সাবকো বলিয়ে হামি সব করবে ওসকা লিয়ে।

—আরে শেঠজি বহুত বকর বকর করতা। দ্যাখতা হ্যায় ত আপ, কি চীজ আছে! সাধু পুরুষ।

—তব কেয়া হোগা?

—মরেগা।

—লেকিন ছ-মাহিনা হয়ে গেল, গদি বসে গেলে কেয়া হোবে?

—মুল্লুক মে চলে যাবে। লোটা লেকে আয়া, লোটা লেকে চলা যায়গা। কৈ দিককত নেই আছে।

—বাবু ঘর যায়গা।

তখনই কুম্ভ বুঝেছিল, হাসিরাণী বাবুর চোখে কাজল পরিয়ে দিয়েছে। আসলে জ্বালা ভেতরে। জোয়ান মানুষের বৌ অসুস্থ কুম্ভ টের পায়। উপোসী ছারপোকা। নরম গদিতে শুইয়ে দাও—ব্যস হয়ে গেল। সে আর পিয়ারি দু’জনে মিলে ফন্দিটা এঁটেছিল—দাও তুলে একই গাড়িতে।

—রাত দশটার ট্রেনে যাবে বাড়ি। বাবু একলা যাচ্ছে। চারুকে ভাইঝি বলে ফার্স্ট ক্লাসে তুলে দিয়ে এস। বাবুর জন্য একখানা টিকিট কেটে রাখ। যেন জানই না, হঠাৎ দেখা স্টেশনে, বাবু, ভাইঝি যাচ্ছে। বহরমপুর যাবে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন? কাশীমবাজার! ব্যস হয়ে গেল। টিকিট ধরিয়ে বলবে, কাজে ফেঁসে গেছ যেতে পারছ না—বাবুটির দয়া চাইবে। তুলে দাও, বাকিটার দায় চারুর। চারু পারবে।

—লেকিন এক বাত? কুম্ভ একটু থেমে কথাটা বলেছিল।

—কেয়া বাত?

—ফাঁস হো জায়গা তো তুমভি মরেগা, হামভি মরেগা।

—বহুত লীলা খেলা চলতা হ্যায়। লীলা খেলা সামজা

—লীলা!

—আরে লীলা বোঝতা নেহি। লীলা মানে প্রেম, মহব্বত, সামজা?

—প্রেম মহব্বত কিসকা সাথ?

—আর কিসকা সাথ, খোদ বউরাণীকা সাথ।

—বহু-রাণী! রাজাকা বহু!

—হাঁ হাঁ।

—আরে রাম রাম! বহুত খারাপ বাত! রাজাবাবু কুছ বলে না?

—ভেঁড়া আছে। ভেঁড়া সামজা?

—ভেঁড়া!

—আরে ম্যাড়া সামজা?

—ম্যাড়া!

—ও ভি নেহি সামজা? তুমকো কোন টিকিট দিয়া মুল্লুক ছোড়নেকো? ম্যাড়া নেই সামজা?

—টিকিট তো হাম খোদ কেটে লিয়েছি বাবু।

—ধুস্। উজবককা মাফিক বাত বোলতা হ্যায়। হাম বোলতা হ্যায় ম্যাড়া হলগে পাঁঠ টা। পাঁঠ টা সামজা?

—হাঁ হাঁ।

তব রাজা বহু-রাণীকা এক রাম-পাঁঠটা। পোযতা হ্যায়। বহু-রাণী রাজি হোনেসে সব ঠিক হ্যায়। কই গড়বড় হবে না। ফাঁস হয়ে যায়গা তো হাম মর যায়গা, তুম মর যায়গা।

—কাহে?

—কাহে তুম জানতা নেই। দু-সাল দেখতা হ্যায়, কেয়া চিজ সামজা নেহি হ্যায়। পচা টাকার গন্ধ পায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *