1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৪৫

।। পঁয়তাল্লিশ ॥

অতীশ দরজায় দাঁড়িয়ে ঠুক ঠুক করে কড়া নাড়ল। জানালায় টুটুল মিণ্টু কেউ দাঁড়িয়ে নেই। রাত বেশি হলে ঘুমিয়ে পড়ে। তার কাজ বেড়ে যায়। সুখি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। কড়া নাড়ার শব্দে টের পায় কে নাড়ছে। কড়া নাড়ার শব্দেই সুখি বুঝে ফেলে মানুষটির মেজাজ কেমন। ক্লান্ত, অবসন্ন, না তিনি প্রসন্ন মনে ফিরছেন।

মাঝে মাঝে খুব প্রসন্ন। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন, আদর করেন। আবার কেমন গুম মেরে যান। তখন তাকাতে পর্যন্ত ভয় হয় তার।

অতীশ ঢুকেই বলল, ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে?

—না। পড়ছে।

—এত সুমতি!

সে করিডর ধরে ঢুকে দেখল, মিণ্টু মন দিয়ে পড়ছে। টুটুল হাতের লেখা লিখছে। মা বাড়ি না থাকলে কেউ থাকে না, এটা সে হাড়ে হাড়ে টের পায়। বকাঝকা করে দুষ্টুমি করলে—কিংবা এই রাজবাড়ির বাগানে, কিংবা পুকুরে গেলেও ভয়। তবে স্কুল ছাড়া এরা বাড়ির বাইরে বের হতে পারে না। বিশাল এলাকা জুড়ে মাঠ, ফুলের বাগান, মালিপাড়া, বাবুর্চিপাড়া, মেসবাড়ি, বাবুদের কোয়ার্টার এবং আমলা কর্মচারী তাদের পরিবার, সব মিলে এই শিশু দুটির পক্ষে যথেষ্ট নিরাপত্তা আছে। একটাই আতঙ্ক পুকুরে যাবার নেশা টুটুল মিণ্টু দুজনেরই আছে। একবার মিণ্টু জলে ডুবেও গেছিল। অফিসে তাকে এই আতঙ্কটাই বেশি তাড়া করে। সুখির উপর ঠিক নির্ভর করা যায় না। সুখির পক্ষে এদের সামলানো দায়, বোঝে। কিন্তু সে নিরুপায়। মা সংসার ফেলে এখানে দু-পাঁচদিনের বেশি থাকেন না। এই সেদিন এসেছিলেন, চলেও গেছেন। বাবা টুটুলের বিদ্যারম্ভে এসে কিছুদিন থেকে গেছেন।

তাকে দেখে আজ টুটুল মিণ্টু পড়া ফেলে উঠে এল না। সে কিছুটা তাজ্জব। বলল, কিরে তোদের আজ কী হয়েছে!

টুটুল সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে নেমে গেল তক্তপোশ থেকে। বাবা, তুমি সোনাবাবু!

—আমি সোনাবাবু, কে বলল তোকে!

—মিণ্টুও বলল, তুমি সোনাবাবু। জানো আজ পাকিস্তানের পিসি এসেছিল।

সোনা খুশি হতে পারল না। পাকিস্তানের পিসিটা কে হতে পারে তার বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি। সে এসেই চেয়ারে বসে খানিক সময় বিশ্রাম নেয়। ব্যাগটা সুখি তাকে তুলে রাখে।

টুটুল মিণ্টু দু’পাশে দাঁড়িয়ে স্কুলের গল্প করে। কিংবা অজস্র নালিশ এর ওর নামে। কিন্তু আজ নালিশ নেই। সে সোনাবাবু, তবে সোনাবাবুর খোঁজে তিনি ঠিক হাজির। সে খুশি হতে পারছে না। বাড়ির ভিতর ঢুকে দেখে গেছে, সে কেমন ভাবে বেঁচে আছে। সেদিন তাকে এড়িয়ে যাবার জন্য ছল ছুতোর আশ্রয় নিয়েছিল। আসলে সংস্কার। মা, নির্মলা মেনে নাও নিতে পারে। করিডরের পাশে রান্নাঘর। ফতিমাকে মা চিনে ফেলতে পারেন এবং এমন সাত-পাঁচ চিন্তা ভাবনায় যখন অস্থির হয়ে উঠেছিল, না বলে পারেনি, আমাকে কফিহাউসে নামিয়ে দে। সে ফতিমাকে সঙ্গে করে বাড়ি আনতে সাহস পায়নি।

সুখি বলল, বাসায় কিছুতেই ঢুকল না। কত বললাম, ভিতরে এসে বসুন। বসল না।

অতীশ জুতোর স্ট্র্যাপ আলগা করছিল। সে সুখির দিকে তাকাল না। শুধু বলল, বাইরে থেকেই চলে গেছে!

—না সিঁড়িতে বসেছিল।

—সিঁড়িতে! আচমকা কোথায় যেন কেউ তাকে হৃদপিন্ডে ছুরিবিদ্ধ করে দিয়েছে। সিঁড়িতে বসেছিল!

তার নিজেরই কেমন খারাপ লাগছে ভাবতে। কেউ দেখলেই বা কী ভাববে! ফতিমা এখন আর আগের ফতিমা নেই। তার রুচিবোধ প্রখর। ওর বাড়িতে যা আছে, সে যেভাবে বেঁচে আছে, জীবনেও তার সেখানে যাবার সম্ভাবনা নেই। একজন ছিমছাম যুবতী নারী সিঁড়িতে বসে থাকলে, কপালে হলুদ টিপ, ঢাকাই জামদানি পরনে, চোখের ভ্রু প্লাক করা, এবং মুখের সেই আশ্চর্য সুষমা নারীকে কত পবিত্র করে তোলে ফতিমাকে না দেখলে সে টের পেত না।

সে ফিরে গেছে।

সে বাসায় ঢোকেনি।

—কিছু বলল? অতীশ জুতো জোড়া খুলে দিলে সুখি তুলে নিয়ে যাবার সময় থমকে গেল!

—না। কিছু বলেনি!

আমরা তো বুঝতে পারছিলাম না, সোনাবাবু কে?

টুটুল বাবার পিঠে মুখ লুকিয়ে বলল, জান বাবা, পিসি না আমাকে কোলে নিয়ে আদর করেছে। সোনাবাবু কে, এরা জানবে কী করে! ফতিমা টুটুলকে আদর করেনি, সোনাবাবুর ছেলেকে আদর করেছে। সে পর্ব তার ঘোরতর পর্ব। ফতিমা সহজে ছাড়বে না। অথচ জীবনের সেই পর্ব শেষ কবে—সে একসময় জাহাজের ছোটবাবু, এখন কারখানার অতীশ দীপঙ্কর। ফতিমা বাড়িতে ঢোকেনি, এটা একটা স্বস্তি। বাবা-মা, আত্মীয় স্বজনরা মেনে নাও নিতে পারেন। তারপর মনে হলো সে নিজেই কী পারছে! এই সংস্কার তাকে কিছুটা বিহ্বল করে রাখল। যেন ফতিমা টের পেয়ে গেছে বাবুর পছন্দ না, বাবু চায় না ফতিমা এসে তাকে আবার আর এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দিক। সুখি সব বলে দেয় তার কাকিমা বাড়ি এলে। সংসারের ভাল মন্দ খবর নিতে না পারলে নির্মলা অস্বস্তির মধ্যে থাকে। তাকে নিয়েও নির্মলার ভয়। এভাবে রাজবাড়িতে কোনো খবর না রেখে কেউ চলে যায়!

কান্ডজ্ঞানের এত অভাব!

ফতিমা বাসায় ঢুকলেও কান্ডজ্ঞানের অভাব ভাববে বেশি কি! তাই বলে বাড়ির নিয়ম-কানুন থাকবে না। নির্মলা বলতেই পারে। ফতিমা এলে, ঘরে এসে বসলে, রান্নাঘরে ঢুকলে সব অশুচি হয়ে যায় না! মনের দিক থেকে সেই বা সায় পাচ্ছে না কেন! মেয়েটা সেই শৈশবের টানে চলে এসেছে সে বুঝতে পারে। ভিতরে টান ধরে গেছে। সে রুষ্ট হবে বলে, ফতিমা বাসায় ঢোকে নি। সিঁড়িতে বসে ছিল। হঠাৎ তার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হলো, ফতিমা তুই এভাবে এসে আর আমাকে অপমান করিস না।

তারপরই মনে হলো, আসলে সে বাইরে বসে থেকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, কত অমানুষ সোনাবাবু।

অ আজার বালথাজার।

ঈশ্বর আপনার জন্ম দিয়ে আমরা ঠিক করিনি। আপনি না জন্মালেই পারতেন ঈশ্বর।

অতীশ এমন না ভেবে পারল না।

অ আজার বালথাজার।

ছবির সেই উলঙ্গ বালিকার নিতম্ব ভেসে উঠছে। বালিকাকে ধর্ষণ করে উধাও। তিন কিশোর যেন অজ্ঞাতে নিজের মধ্যে পশুর মতো গর্জে উঠেছিল। সঙ্গিনীর ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম দেয়নি! ছবিটার মাথামুন্ডু সে আজও বুঝতে পারছে না। ফরাসি ছবি—ছবিটা দেখতে না গেলে, ফতিমা তাকে হয়তো আর খুঁজেই পেত না। ছবিটার মতো সেও কি ফতিমাকে অপমান করে বারবার ধর্ষিতা এক নারীকে আবিষ্কার করতে চায়। সে বাথরুমে যাবার সময় বলল, কখন এসেছিল?

—এই সাঁজবেলায়।

—চিনে আসতে পারল!

—খোঁজাখুজি করেছে।

সুখি পাঞ্জাবি বের করে বাথরুমে রেখে আসার সময় বলল।

—আবার আসবে বলেছে?

সুখি বলল, না তা কিছু বলেনি।

অতীশ বাথরুমে হাতমুখ ধুয়ে পাজামা পাঞ্জাবি পরে বের হতেই দেখল টুটুল গম্ভীর হয়ে গেছে। মিণ্টুও

সে বোঝে বাড়িতে ফিরলে তারা চায় বাবা শুধু তাদের সঙ্গেই কথা বলবে। সুখিদিকে তারা সবসময় শত্রুপক্ষ ভেবে থাকে।

আবার আসবে না কেন? টুটুল মিণ্টু মানতে রাজী না। সুখিদি বলে দিল, না তা কিছু বলেনি! মিণ্টু বলল, পিসি আবার আসবে।

—কখন বলল? মিছে কথা বলছ কাকাকে? সুখি ফুঁসে উঠল।

টুটুল বলল, হ্যাঁ বলেছে। তারপরই কী ভেবে টুটুল বায়না করতে থাকল।

—আসবে না কেন বাবা?

প্রবোধ দেবার জন্য বলল অতীশ, আসবে। নিশ্চয় আসবে। তোমাদের টানে আসবে। আসতেই হবে।

সুখির দিকে তাকিয়ে মিণ্টু বলল, আসবে। নিশ্চই আসবে। টানে আসবে।

আসতেই হবে। সুখির দিকে তাকিয়ে টুটুল বলল, আসবে। পিসি আসবে।

টুটুলকে অতীশ বলল, তোকে কোলে নিয়ে খুব আদর করল! পিসিকে আবার আসতে বলতে পারলি না! আমি বাড়ি থাকি না, তোমার মা বাইরে, পিসিকে বলতে হয় আবার এস। তোরা তো এখন বড় হয়েছিস!

মিণ্টু শিশু নেই। সে বালিকা হয়ে গেছে। ক্লাস ফোরে পড়ে। ক্লাস ফোরে পড়লে মেয়েরা আর শিশু থাকে না। মিণ্টুও দেখেছে, অকারণ বায়না করলে বাবা ধমক দেবেন, মিণ্টু তুমি আর ছোট নেই। সব বোঝ। এটা বোঝ না।

টুটুল খেতে বসে বলল, বাবা পাকিস্তানের পিসি তোমার কে হয়!

—আমার!

বিষম খেল অতীশ। সে তাড়াতাড়ি গ্লাস তুলে নিল মুখে।

সহজেই সে বলতে পারত, তোমাদের পিসি হলে আমার কে হয় জান না! কিন্তু বলতে পারল না। সারা চোখে মুখে দ্বিধা দ্বন্দ্ব সত্যি ফতিমা তার কে হয় জানে না। এ দেশে আসার পর ফতিমার কথা সে তো ভুলেই গেছিল প্রায়। মাঝে মাঝে মনে পড়ত। দেশ ছেড়ে আসার আগে ফতিমার সঙ্গে তার অনেকদিন দেখা হয়নি। সামু চাচা ঢাকা শহরে তাকে নিয়ে চলে গেলেন। শহরের স্কুলে ফতিমা পড়ত। দেশ ছেড়ে আসার সময় বুকের ভিতরে তার একটা ব্যথা টনটন করত। সে যে অর্জুন গাছে নিঁখোজ পাগল জ্যাঠামশাইয়ের জন্য ঠিকানা লিখে রেখে এসেছিল, তা কতটা জ্যাঠামশাইয়ের জন্য, কতটা ফতিমা-মঞ্জুর জন্য তফাৎ বুঝতে এখনও অসুবিধা হয়।

সে জবাব এড়িয়ে গিয়ে বলল, অনেক রাত হয়েছে। তাড়াতাড়ি খাও। এ কি ভাত মেখে বসে থাকলে—খাচ্ছ না! খাইয়ে দেব!

টুটুল হাঁ করল।

ছেলেটার বায়নার শেষ নেই। পিসি তোমার কে হয় যদি না-ই বলতে পার, তবে ভাত খাইয়ে দাও।

ওদের দুর্ভাগ্য মা কাছে থাকে না। মনে মনে নানা কারণে অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেও সে বলতে পারল না, নিজে খেতে পার না, আমাকে খাইয়ে দিতে হবে! তবে খাবে! সবাই মিলে জ্বালালে আমি যাই কোথায়!

সে বুঝতে পারে এই ‘সবার’ কথাটা আসলে ফতিমার জেদী আচরণের প্রতি কিছুটা কটাক্ষের মতো। যেন এই যে তাদের মা, সংসারের সাশ্রয়ের জন্য মাস্টারি নিয়ে একটা মেয়েদের স্কুলে গাঁয়ে চলে গেল, তাও যেন তাকে শিক্ষা দেবার জন্য। সে ইচ্ছে করলে দু’হাতে উপার্জন করতে পারত কারখানার মাল বিক্রির ব্যাপারে একটা ক্ষতস্থান তৈরি হয়েছে, নির্মলা জানে, চোরাস্রোতে গা ভাসিয়ে তার সহকারী কুম্ভবাবু ফ্রিজ পর্যন্ত কিনে ফেলেছে। আর তার বাড়িতে দুটো তক্তপোশ। আর টেবিল চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। সে এত বড় অপদার্থ। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সহজেই দূরে সরে যেতে পারল।

ফতিমাও টের পেয়ে যেতে পারে, সে সত্যি অপদার্থ। আর তা প্রমাণের জন্য বাড়িঘরে সে আবার আসবেই। কতটা তার টানে কতটা তার জাত মারার জন্য, সে এ মুহূর্তে তা স্থির করতে পারছে না। দেশের বাড়িঘরের কথা ভেবেই আজ সিঁড়িতে বসেছিল। ঘরে ঢোকেনি। টুটুলকে কোলে নিয়ে বসে থেকেছে। আর হয়তো ভেবেছে, এ কেমনতর সংসার—মা হয়ে এমন দুটো ফুটফুটে বাচ্চা ফেলে দূরে কেউ থাকতে পারে। আসলে তার জীবনে বিড়ম্বনার কথা ফতিমা কিছুই জানে না। সেই তার বাবার একমাত্র উপার্জনশীল পুত্র, বড়দা বাবা-মার সঙ্গে প্রায় সম্পর্কহীন। তার কারখানার অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে। রাজার কারখানা। বউরাণী আছে বলেই সে তার চাকরিটা বজায় রাখতে পেরেছে। কালো টাকার পচা গন্ধ পায়। এক জীবনে সে জাহাজী ছিল, আর্চির প্রেতাত্মা তাকে অনুসরণ করছে। সে ভীত সন্ত্রস্ত। এই সেদিন সে যা করল—বোর্ড-মিটিং থেকে পালিয়ে প্রায় সোজা নির্মলার কাছে চলে গিয়েছিল কাউকে কিছু না বলে। নির্মলার আসার কথা, আসেনি, চিঠি দিয়ে জানায়নি। আসবে না। ইচ্ছে করলে একটা যে খবর দিতে পারে না বিশ্বাস করেনি। বাসায় ফেরার পথে ট্রেনে বাসে যদি দুর্ঘটনা ঘটে গিয়ে থাকে। আর্চির প্রেতাত্মা প্রতিশোধের নিমিত্ত নির্মলাকে ট্রেনের তলায় ফেলে যে ছিন্নভিন্ন করে দেয়নি, কে বলবে! এত সব সন্ত্রাস তাকে তাড়া করছিল বলে কেমন মোহাচ্ছন্নের মতো কারখানা থেকে বের হয়ে সোজা হাওড়া স্টেশনে চলে গিয়েছিল। তার মনেই ছিল না, বিকেলে বোর্ড-মিটিং, মনেই ছিলনা, সে না থাকলে টুটুল মিণ্টু একা, বাসায় কোনো খবর দেবার কথাও মাথায় আসেনি। সোজা সে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চড়ে বসেছিল। সে বাসায় না ফিরলে টুটুল মিণ্টু কান্নাকাটি করবে, রাজবাড়িতে শোরগোল পড়ে যাবে, বউরাণী অস্থির হয়ে পড়বে অতীশটার দেখছি সত্যি মাথা খারাপ! গেল কোথায়!

ফতিমা জানে না, সে নিরুপায় হয়ে গেলে দেবীর কাছে মাথা নোয়ায়। কাপ্তানের কিশোরী কন্যা বনি এখন তার দেবী। সে এসে একটা ধূপদানিতে ভর করেছে। সকলের অজ্ঞাতে গভীর রাতে কুলুঙ্গিতে রাখা ধূপদানির নিচে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে যে ভাল নেই নির্মলা সেই কবে টের পেয়ে গেছে। নির্মলা তার উপর বিশ্বাস হারিয়েছে বলে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। চাকরিটা হয়ে যাবার পর নির্মলারও আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। তার কিছু হলেও অন্তত ছেলেমেয়ে দুটো জলে ভেসে যাবে না।

মিণ্টু টুটুলকে বাথরুমে নিয়ে যেতে চাইছে। হাতমুখ ধুয়ে দেবে। সুখি এ নিয়ে বাড়াবাড়ি আর করে না। অতীশ কবে যেন না বলে পারেনি, তুইও দেখছি ছেলেমানুষ—মিণ্টু যখন পছন্দ করে না—মা বাড়ি থাকে না, বাবা সারাদিন বাইরে—ভাইটাকে সে চোখে চোখে রাখতে ভালবাসে। তোর কি দরকার—তা ছাড়া মিণ্টু তো করতে পারে। করতে দে। তুই কেন যে বলতে যাস, পারবে না মিণ্টু, আমি যাচ্ছি। তার ভাইয়ের উপর তোর খবরদারি সহ্য করবে কেন! অযথা দু’জনে তোরা এত জ্বালাস!

মিণ্টু টুটুলকে মুখ হাত ধুইয়ে তোয়ালে টেনে নিল। হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর মুখ মুছিয়ে দিতে গেলেই টুটুল এক দৌড়। অতীশ টের পেল, কোনো কারণে দিদির উপর খাপ্পা—কি কারণ সে জানে না। সুখি দু-ঘরে বিছানা করছে। তারপর সে খেয়ে চলে যাবে মালিপাড়ায়।

যাবার আগে সুখি করিডরে দাঁড়িয়ে বলবে, কাকা দরজা বন্ধ করে দিন। আমি যাচ্ছি। অথচ টুটুল কেন যে ছুটে গেল।

মিণ্টুও ছুটছে। কিন্তু ধরতে পারছে না।

—কী হলো তোর আবার! অতীশ বিরক্ত।

—দেখ বাবা, কিছুতেই মুখ মুছবে না।

—না মুছুক। তোমাকে পেছনে লেগে থাকতে হবে না। তোয়ালেটা দাও। বলে অতীশ ডাকল, টুটুল এদিকে এস! বললে না তো, পিসি আর কী বলে গেল!

আর দেখে কে! টুটুল বারান্দার অন্ধকার থেকে ছুটে এসে দু-হাটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে দিল। বলল, জান বাবা পিসি না, বলেছে—

এইটুকু বলেই সে থেমে গেল।

—কী কলেছে বলবি তো?

—পিসি না, বলেছে, লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে।

—তাই নাকি! আর তাই পড়ায় এত সুমতি।

—আচ্ছা! পিসিকে ঘরে টেনে আনতে পারলি না! সে নিজেই এমন কথা বলে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। আসলে একজন নারীর কিংবা পুরুষের ধর্মের বাইরে শক্ত অবলম্বন থাকলে এমন হয়। তখন অধিকারই বড়। পিসিকে ঘরে টেনে আনতে পারলে না বলার মহুর্তটিতে সে ফতিমার সোনাবাবু। পৃথিবীর সবাই যখন তার নাম ভুলে গেছে, তখনও এক নারী ডাকছে, সোনাবাবু, এই যে আমি। দেখতে পাচ্ছেন না। অর্জুন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি।

মিণ্টু বলল, পিসি এবার এলে কথা বলব না—ঠিক হবে না বাবা!

—ঠিক বলেছিস। একদম কথা বলবি না। আমরা কেউ কথা বলব না।

—বাবা আমি বলব? টুটুল বাবার মুখের দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

—না, তুমিও বলবে না! অতীশকে কেমন এখন একগুঁয়ে মনে হচ্ছে।

–কেন বলব না! পিসি কী করেছে? পিসি আমাকে কত ভালবাসে!

—তবু বলবে না। অতীশ আরও কঠিন হয়ে গেল।

—না বলব।

অতীশ আশ্চর্য হয়ে গেল। যে টুটুল তার মুখের উপর কথা বলতে সাহস পায় না, চোখের পাকে ডরায়, ঠোঁট ফুলিয়ে দু-হাতে চোখ ঢেকে কাঁদে—সেই শিশু কেমন একটু দূরে সরে গিয়ে বলল, না, বলব। এই বলার মধ্যে শিশুর ভিতরেও আশ্চর্য দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে। তেড়ে গেলেই সে যেন দরজা খুলে পিসির কাছে পালাবে।

আর তখনই সুখি এসে বলল, জানেন কাকা, কাঁসার গ্লাসে জল খেল না। কিছুতেই খেল না। কাচের গ্লাসে জল খেল। জলে ধুয়ে উপুড় করে রাখল।

—গ্লাসটা কোথায় রেখেছিস!

—বাইরে পড়ে আছে। ভুলে গেছি তুলতে।

—থাক। ওটা ওখানেই পড়ে থাক। ধরবি না। আসলে সে নিজের এই হঠকারি বিবেকের সঙ্গে পেরে উঠছে না। যেন আক্রোশ, তোদের জন্য, তোরা আমাদের দেশ থেকে তাড়িয়েছিস। আমাদের নির্বাসনে পাঠিয়ে মজা লুটছিস। বাচ্চা দুটোকে হাত করে ঘরে ঢোকার পাসপোর্ট চাইছিস। দ্যাখ মজা—অতীশ সত্যি মাথা গরম করে ফেলল।

আমার জাত মারবি ভাবছিস! সে যে নিজের মধ্যে নেই জানে না। থাকলে পারত না। তার নিজেকে নিয়ে ভাবনাও নেই। তার জাত এত পল্কা নয়। সে তো এক জীবনে জাহাজী ছিল। সারেং থেকে কোলবয় সবাই মুসলমান। তারা মাত্র চার-পাঁচজন হিন্দু জাহাজী। একসঙ্গে খানা—সে গো-মাংস খেয়েছে। সারেং সাব গ্যালিতে বিফ এলেই সতর্ক করে দিতেন তাকে। অভক্ষ্য ভক্ষণ করতে না হয় সেদিকে ছিল তার পুরোমাত্রায় নজর। তিনি তাকে সতর্ক করে দিতেন জাত যাবে বলে। তারও অস্বস্তি হতো—পরে অবশ্য সে এ সব অস্বস্তি কাটিয়ে উঠেছিল, মনু, ইদ্রিস, তার সামান্য অসুখে বিসুখে কিংবা সি-সিকনেসে ভুগলে অস্থির হয়ে উঠত। নোনা পানি খেলে সি-সিকনেস কমে—সে খেতে পারত না। আরও বেশি ওক উঠে আসত—আর তখন সারেং সাবের কি কাতর অনুরোধ—খা, খা ছোটবাবু, না খেলে বাঁচবি কী করে, ভাল হবি কী করে! জাহাজে কাজ করবি কী করে! তারপরও যখন পারত না, চিৎকার করে উঠতেন বুড়ো সারেং সাব—সাদা দাড়ি, সাদা চুল, পাঁচ ওক্ত নামাজ, ধর্মগ্রন্থ পাঠ অবসর সময়ে—শান্ত মেজাজ, অথচ তিনিও মেজাজ ঠিক রাখতে পারতেন না, কে বলেছিল, সফরে আসতে। তোর মা-বাবার কি আক্কেল বুঝি না—তোকে আসতে দিল! দিতে পারল। কী হাড্ডাহাড্ডি জাহাজে, তারা জানে না!

রুজি রোজগারের আশায় জাহাজ, জাহাজই সই। গোমাংস-খেতে হবে তাও সই। পেটে অন্ন নেই, জাত ধুয়ে জল খাবে! আসলে এ সব ভাবছে ঠিক, কিন্তু মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। তার এই মন্দ ভাগ্যের জন্য যেন দায়ী ফতিমারা। হাতের কাছে এত বড় সুযোগ সে কিছুতেই আজ ছাড়বে না।

সুখি বাবুর এই রুদ্রমূর্তি কেন বুঝতে পারছে না। কাকার ভেতরে কোনো দুরাত্মা ভর করে, সে এমন শুনেছিল—উড়ো কথা, কে এক প্রেতাত্মা কাকাকে নাকি তাড়া করছে—

সুখি ভাল বুঝছে না। আবার না কাকা কুলুঙ্গি থেকে বাতিদানটা হাতে তুলে নিয়ে যাত্রার ঢং- এ চেয়ে থাকেন। কাকা না আবার ঘোরে পড়ে যান। ঘোরে পড়ে গেলেই গোছা গোছা ধূপবাতি জ্বালিয়ে চোখ বুজে বসে থাকেন। কাকিমা থাকলে সামলে-সুমলে নিতে পারতেন। কিন্তু আজ কী হবে বুঝতে পারছে না। কাকা টর্চ বের করে বললেন, চল।

সুখি হতভম্ব।

টুটুল বলল, আমি যাব।

অতীশ চাতালে বের হয়ে বলল, তুলে নে। তুলসী গাছে টর্চ মেরে দেখাচ্ছেন কাকা।

এত রাতে তুলসী পাতা দিয়ে কী হবে বুঝতে পারছে না সুখি।

কাকা বললেন, জল নে।

গম্ভীর হয়ে আছে সবাই। টুটুল মিণ্টু বাবার মেজাজ বোঝে। মা এলে পিসিকে নিয়ে কথা উঠতে পারে। মিণ্টু বাবার পাশ থেকে নড়ছে না। যেন জানে, সে-ই বাবাকে কোনো অপঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে। সুখি গ্লাসে করে জল নিয়ে এল।

—চল।

কোথায় যেতে চায় তিল তুলসী নিয়ে, সুখি বুঝতে পারছে না!

সুখি দেখল কাকা করিডরের দিকে যাচ্ছেন। যেতে যেতে বলছেন, কোথায় গ্লাস রেখে গেছে। কোনখানে?

সুখি সদর খুলে সিঁড়িতে দেখাল—ঐ তো!

—দে আমাকে। বলে অতীশ তুলসী পাতা জল হাতে নিয়ে ছড়িয়ে দেবার সময় মনে হলো দূরে আবার কে যেন ডাকছে—

সোনা….বা….বু।

কে যেন ছুটছে!

সো…না…বা…বু।

কে যেন বলছে।

আমারে ছুঁইয়া দিলেন। কী ঠান্ডা!

হিমেল বাতাস বইছে। উত্তুরে বাতাসে ফতিমার চাদর উড়ছে।

ইস আমারে ছুঁইয়া দিলেন। কী হইব?

কী হইব আবার, আমার ছান করতে হইব!

ছান করতে হইব না। আমি কমু না। ফতিমা ফ্রকে মুখ ঢেকে বলল। তারপর সোনার শরীর ছুঁয়ে শপথ।

অতীশ দেখতে পাচ্ছে, সেই দূরাতীত কোনো কন্ঠস্বর আবার তাকে তাড়া করছে।

সত্যি কবি না?

না, সোনাবাবু, না।

আমাকে ছুঁয়ে বলছিস!

হ্যাঁ বাবু।

আর কি মজা তখন সেই বালকের। তার ভয় থাকে না। শীতের সাঁজবেলায় তাকে স্নান করতে হবে না। ফতিমা জানে, ফতিমা জানে সোনাবাবু সহজেই স্নান না করে অশুচি থাকতে রাজি আছে। কিন্তু নানী তো শুনলে ক্ষেপে যাবে—গুনা হবে বলবে। চোপা করবে, কর্তার বাড়িতে ঠাকুর দেবতা আছে—তুই ছুঁইয়া দিলি সোনাবাবুরে! ছান না করলে তর গুনা জানস!

কার গুনা!

ফতিমা তোর গুনা হবে।

কেন হবে নানী?

যার যা জাত বিচার মানতে হয়—বামুনের পোলারে তুই ছুঁইয়া দিয়া ঠিক করস নাই। ফতিমা গুনা হবে জেনেও শপথ করেছে, সে বলবে না। সে সেদিন বলেওনি। যা কিছু আগ্রহ তৈরি করত দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে। অথবা লটকন ফল দেবার সময় ফতিমা বলত, ধরেন। সোনা নিচে হাত পেতে রাখত। ফতিমা গুণে গুণে দিত। দ্রোণ ফুল তুলে একবার কী যে শখ হলো সোনাবাবুর, তার নাকে নথের মতো পরিয়ে দিয়েছিল। আর যায় কোথায়? বন জঙ্গলে বালক বালিকা, নাকে দ্ৰোণ ফুলের নথ, মঞ্জু ঘাপটি মেরে বসে থেকে বলেছিল, বলে দেব।

এই ‘বলে দেব’ কথার সঙ্গে ফতিমার মুখ এত মলিন হয়ে গেছিল, এত জোরে ছুটে পালিয়েছিল যে তারপর কতদিন দেখা হয়নি। এক সকালে পাগল জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে বের হয়ে দেখেছিল, ফতিমা বুনো ফুল তুলছে। তাকে দেখছে। কাছে এসে বলেছে, আপনেরে ছান করতে হয় নাই ত!

না।

মঞ্জু যদি বলে দেয়, সেই ভয়ে ফতিমা আর হিন্দু পাড়ার দিকে পা বাড়ায়নি। দ্রোণ ফুলের সুঘ্রাণ কত প্রিয় মঞ্জুও জানে। বলে দেবে না, হয় না।

ফতিমা বলেছিল, আমারে নেবেন!

সে একা না, বড়দা সঙ্গে। জ্যাঠামশাই দুপুরে ফেরেননি, বিকেলেও না। তারা বের হয়েছিল, ট্যাবার জঙ্গলে কিংবা তরমুজের জমিতে কিংবা কবিরাজ বাড়ির জঙ্গলে। কিংবা বকুলতলায় দুর্বো ঘাসে যদি বসে থাকেন, শুয়েও থাকতে পারেন। ফতিমা সঙ্গে গেলে ক্ষতির না। সে তো চায় সঙ্গে আসুক। কিন্তু সাঁজ লাগলে তখন কী হবে!

বলে আয় বাড়িতে। নানী না হইলে চিন্তা করব।

ফতিমা এক দৌড়ে গেছে, এক দৌড়ে ফিরে এসেছে।

তারপরই দুম করে কথা, মঞ্জু কয় নাই?

কি কইব! সোনা অবাক।

আপনে আমার নাকে নথ পরাইয়া দিছেন। দ্রোণ ফুল। কয় নাই।

মিছা কথা কইলেন। ফতিমা ফুঁসে উঠেছিল।

কয় নাই। মঞ্জু দ্রোণ ফুল তুলে নাক এগিয়ে দিয়ে বলেছে, পরিয়ে দাও বাবু। জানে বাঁচতে চাইলে পরিয়ে দাও। না হলে ফাঁস কইরা দিমু।

তা ঠিক—তাকে নিয়ে বাড়িতে মা জ্যোঠিমা ঠাকুমার অশান্তি ছিল। একদন্ড বাড়িতে মন টেকে না। জলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার শখ। আর ফতিমাও আছে। আহ্লাদে আটখানা বাবুটিকে দেখলে। সোনা একবার মারও খেয়েছে। কে এসে বলেছিল, সোনাকে দেখলাম কলাইর জমিতে বসে আছে। কলাই গাছ তুলে পোড়াচ্ছে। খাচ্ছে। ফতিমা রস, নন্দ, অবনী সঙ্গে।

বাড়িতে ফিরলেই ঠাকুমার চোপা—আইছেন তাইন। গু-মুত পাড়াইয়া আইছেন। অ ধনবৌ শুনছ। পোলায় তোমার কলাই পোড়াইছে ফতিমার লগে। পুকুরের জলে ডুবাইয়া আন। ঠাকুমার শুচিবাইতে মা ক্ষেপে গিয়েছিল। চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে চুবিয়েছিল পুকুরে। ফতিমাকে সে কোনদিন বলেনি মা তাকে পুকুরে চুবিয়েছে। অথচ কী করে জেনে ফেলেছিল! কী বিষাদ মুখে চোখে ফতিমার!

পরিয়ে দিয়েছিলেন?

দেব না! তুই তো ঠাকুরমাকে জানিস। বুড়ির চোপা শুরু হলে থামে না। যদি সত্যি বলে দেয়। নাকে দ্রোণ ফুল জুড়ে দিলাম।

ঠাকুমার কসুর কী কন। আমরা গরু খাই। আপনেরা খান না। পেঁয়াজ রসুন খাই। আপনেরা খান না। গরু আপনেগ ঠাকুর দেবতা না সোনাবাবু!

ফতিমা তখন যেন পাকা বুড়ি। তার নানীর কথাই হয়তো সে বলে, যার যা জাত ধর্ম। আমি ছুঁইয়া দিলে আপনের ত ছান করতেই হইব। হইব না কন! আপনেরে দিব মসজিদের বারান্দায় বসতে। আলেব বে তে ছে পড়তে দিব! দিব না। মোল্লাসাব হাজি সাব তখন মামলার কথা ভুইলা একলগে পানি খাইব জানেন

সোনা অত সব বুঝত না। গরু খাই বললে ফতিমাকে ছুঁতে সত্যি গা ঘিন ঘিন করত। ওক উঠে আসত।

সুখি দেখছিল। কথা বলছিল না। কাকা দরজা খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। সিঁড়ির ধাপে কাচের গ্লাস। উপুড় করা গ্লাসটায় জল লেগে নেই। শুকিয়ে গেছে। হাতের অঞ্জলিতে জল তিল তুলসী পাতা।

আমরা তো গরু খাই সোনাবাবু! আমারে ছুঁলে আপনার জাত যায় সোনাবাবু। আমার কি কসুর কন!

অতীশ চিৎকার করে বলতে চেয়েছিল, না না জাত যায় না। কিন্তু কেন যে যায়, এত অস্বস্তি কেন মনে—তার রাগ পড়ে আসছে।

টুটুল মিণ্টু বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

আর তখনই টুটুল বলল, এই দেখ না বাবা গ্লাসটা। পিসি জল খেয়েছে। এই তো গ্লাসটা!

টুটুল তার বাবাকে অন্যমনস্ক করে দেবার জন্যই যেন গ্লাসটা আবিষ্কার করে ফেলল। বাবা দরজায় এসে হাতে জল নিয়ে কেন যে দাঁড়িয়ে আছে জানে না। দিদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তাদের বাবা মাঝে মাঝে যে কেমন হয়ে যায়!

অতীশ জল ফেলে দিয়ে বলল, আমাকে দে। ভেঙে ফেলবি। টুটুলের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে নিল।

মিণ্টু বলল, আমাকে দাও রেখে দিচ্ছি। পিসি জল খেয়ে গেছে কি আনন্দের! বাবা হাতে জল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারপর জল ফেলে দিয়ে গ্লাস তুলে এনেছে। সুখি ভেবেছে, কোনো জাত বেজাতের ব্যাপার আছে, কাকা তিল তুলসী দিয়ে গ্লাস শোধন করে নেবেন। বোধহয় মেয়েটাকে কাকার একদম পছন্দ না। তবু এসে বসে থেকেছে বেহায়ার মতো। কিন্তু কাকা জল তো গ্লাসে ছিটোলেন না, পাশের নর্দমায় ফেলে দিলেন! তারপর গ্লাসটা টুটুল হাতে নিতেই প্রায় কেড়ে নেবার মতো কাকা বললেন, ভেঙে ফেলবে, আমাকে দাও। তা কাচের গ্লাস ভাঙতেই পারে। কাচের গ্লাসে জল খেলে দোষেরও না, তবু কাকা কেন এমন বিড়ম্বনা করলেন সে বুঝতে পারছে না। কাকিমা এলে বলতে হবে। কারণ কাকিমা এসেই তাকে সব জিজ্ঞেস করবেন। আজকের এই ঘটনা সবটা হুবহু না বলতে পারলে, সে একরকম বলছে, মিণ্টু একরকম টুটুল আর একরকম, কাকিমা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবেন। বলবেন, জানি না কিছু, যা খুশি করুক। আমি তো বাড়ির কেউ না।

কেমন অভিমান ফুটে ওঠে কথাবার্তায়। কাকা এমনিতেই কম কথা বলেন, তাকে নিয়ে অশান্তি হলে আরও গুম মেরে যান তিনি। সে বছর দুই আছে, জানে সব, ঘোরে পড়ে যান কাকা, কিসের ঘোর, কেন এই ঘোর সে জানে না। কাকিমাও কতটা কি জানেন, বোঝেন সে টের করতে পারে না। ছুটি পেলে একদন্ড মন টেকে না—কাকিমা সেই দুপুরে বের হয়ে রাত নটায় হাওড়ায় নামেন। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা হয়ে যায়। কাকা টুটুল মিণ্টু তিনজনই জানালায় দাঁড়িয়ে থাকেন। পাতাবাহারের গাছগুলি পার হয়ে নতুন বাড়ির রাস্তার দিকে চেয়ে থাকেন। বাস থেকে নেমে কাকিমা রিক্সা নেন। রিক্সাটার অন্দরমহলে ঢোকার সময় টুং টাং ঘন্টি বাজে। ঘন্টির শব্দ শুনলেই মিণ্টু দৌড়ে বের হয়ে যাবে। টুটুল যাবে। মা এসেছে, মা, আমার মা। সুখি কেন যে তখন চোখের জলে ভেসে যায়, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না।

সুখি দরজার আড়ালে বসে খাচ্ছে, কাকার সামনে খেতে তার লজ্জা। সে ভাত বেশি খায়। বেশি ভাত খাওয়া লজ্জার। তাছাড়া তারিয়ে তারিয়ে খাবার স্বভাব। দেরি হয় খেতে। মাঝে মাঝে কাকার গলা শুনতে পায়—আসলে তার খাওয়া হলে কাকার ছুটি। দরজা বন্ধ না করা পর্যন্ত চেয়ারে বসে একটার পর একটা সিগারেট খাবেন। শোবার দুটো ঘরই আলাদা। রান্নাঘর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। করিডরে পর পর তিনটে দরজা। প্রথম দরজা দিয়ে কয়লা ঘুঁটের ঘরে ঢোকা যায়। পরের দরজাটা রান্নাঘরের। শেষ দরজাটা শোবার ঘরে ঢোকার। পরে আরও একটা বড় হলঘর। কাকার বিছানা, কাকার দেবী, কাকার চেয়ার-টেবিল সব ঐ ঘরে। ঘরগুলি এত বড় আর খোলামেলা জোরে কথা না বললে, রান্নাঘর থেকে কিছু বোঝা যায় না।

আর তখনই মনে হলো, একটা লম্বা ছায়া পড়েছে তার উপর। সে আঁৎকে উঠল। রান্নাঘরে কাকা কখনও ঢোকেন না। সুদর্শন এই পুরুষটির বড় বড় চোখ তাকে মাঝে মাঝে কাতর করে রাখে। তার শরীর এবং মুখের অবয়বে নিরীহ গোবেচারা ভাব আছে। জাগিয়ে দিলে সেও কম পারে না। একটা আতঙ্ক তার ছিলই। এবং সে আশা করে থাকে কোনো একদিন ঠিক কিছু একটা হয়ে যাবে। সে মানুষটির প্রতি আকর্ষণে পড়ে যায়। স্বামী নেয় না। বাপের গলগ্রহ, এ-বাড়িতে নিজের মতো জায়গা করে নিয়েছে। সে থাকতে চেয়েছিল, রাতে শুতে চেয়েছিল—ঘর তো পড়েই আছে। একপাশে করিডরে কিংবা ঘুঁটে কয়লার ঘরে। বাড়িতে বেড়াল কুকুরও তো থাকে। কিন্তু কাকা রাজি হননি।

সে কী ভেবে যে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

অতীশ বলল, কোনো চিঠি আসেনি!

তার বুকে জল এল। সে থর থর করে কাঁপছিল। নিঝুম হয়ে আছে বাড়িটা। তার যুবতী বয়স, কাকার এই সহসা আবির্ভাব তাকে নিজের আগ্রহের মধ্যে কেমন এক গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেয়। সে লজ্জা পেয়ে শাড়িতে গা ঢেকে বলল, না কোনো চিঠি আসেনি।

রোজ বাসায় ফিরেই এক কথা। কোনো চিঠি এসেছে?

এলে সে এগিয়ে দেয়।

আজ পাকিস্তানের পিসিকে নিয়ে পড়তেই চিঠির কথা ভুলে গেছিলেন।

সুখি উঁচু করে খোপা বেঁধেছিল। সামান্য প্রসাধনও। কাকার কোনো দুর্বলতা প্রকাশ না হয়ে পড়ে আবার। সে না ডাকলে কাকা কখনই এদিকটায় আসেন না। কাকিমা থাকলে আসেন। তখন কেমন স্বাভাবিক। চিঠি আসেনি শুনে কাকা দমে গেলেন। একটা চিঠির প্রত্যাশা কত গভীর, কাকার বিমর্ষ মুখ না দেখলে আজ সে বুঝতে পারত না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *