॥ ছেচল্লিশ ॥
আলম সাবের অজু ফজরের নামাজ শেষ। তিনি ব্যালকনির সেন্টার টেবিলে রোজকার মতোই দেখলেন, বেগম সাহেবা কাগজগুলি রেখে গেছেন। গহর মাদুর বদনা তুলে নিচ্ছে। তাঁর কাগজ পড়া শেষ হলেই সকালের ব্রেকফাস্ট। বেগম সাহেবা এখন কিচেনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করছেন। বেটা কুদ্দুস হারামের হদ্দ। কামচোর মানুষ হলে যা হয়। ফতিমা হাত না লাগালে সব কিছুতেই বিশৃঙ্খলা। গহর, সাহেবের গাড়ির দেখভাল করে। সে চাবি নিয়ে নিচে নেমে গেছে। ফের উপরে উঠে এসে খবর দিয়ে গেল, গাড়ি বের করা যাবে না। শিয়ালদায় বোমাবাজি চলছে। ট্রাফিক পুলিশ খুন—রাইফেল ছিনতাই, রাস্তা বন্ধ। গাড়ি ধুয়ে মুছে গ্যারেজেই ঢুকিয়ে দিতে হবে।
আলম সাব কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললেন, ঠিক আছে তুলে রাখ।
আলম সাব জানেন, কলকাতা অগ্নিগর্ভ। বাসা থেকে বের হওয়া খুব নিরাপদ নয়। যখন তখন লাশ পড়ে যাচ্ছে—চারু মজুমদার, কানু সান্যালপন্থী নকশালরা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক—কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা, ব্রিলিয়েন্ট সব ছাত্ররা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। ফতিমা সোনাবাবুর বাড়ি গিয়ে ঠিক করেনি—সন্ত্রাস চলছে। গাড়ির হাল খারাপ থাকলেই তিনি এখন খুশি থাকেন। ফতিমাকে অন্তত এখন গাড়ি ঠিক নেই বলে বাসায় আটকে রাখা যাবে। একটা দুশ্চিন্তার রেখাও কপালে দেখা যাচ্ছে তাঁর। বেগম সাহেবার বায়না—সোনাবাবুর বাড়িতে তাঁকে যেতে হবে। তিনি দূতাবাসের দায়িত্বে আছেন, তাঁর যে যেখানে সেখানে যাওয়া শোভন নয় ফতিমা কিছুতেই মানতে রাজি না।
তাছাড়া সোনাবাবু সেদিন তো সারাক্ষণ ফতিমার সঙ্গে বালকের মতো ঝগড়াই করলেন। সাপে নেওলে যারে কয়—কথা নাই, বার্তা নেই, সোনাবাবুর অভিযোগ, তর চোপাখান দেখছি আগের মতোই আছে।
তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, সাহেব আপনি সহ্য করেন কী করে! পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
আলমের মুখে হাসি ফুটে উঠল। আসলে শৈশব বড় প্রীতির কথা বলে। দু’জনের মুখেই পদ্মাপারের ভাষার খই ফুটছিল।
আলম সাব বলেছিলেন, বছর দশেক হয়ে গেল। মাথা ঠিক আছে। তবে কতদিন থাকবে বলতে পারব না। সোনাবাবু আপনি ঠিকই বলেছেন। উনি এখন ছ-দফার স্বপ্ন দেখছেন। সোনাবাবু ঠাট্টা করে বলেছিল, মাত্র ছ-দফা।
হুঁ। ছ-দফা।
আমি তো ভাবলাম বিশ দফা।
ওটা আস্তে আস্তে হবে। বলে আলম সাব ফতিমার দিকে আড়চোখে তাকিয়েছিলেন। যেন বিবি তাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না—টেবিল সাজানো তাঁর অনেক বেশি জরুরী। দামি লেসের টেবিলে ঢাকনা সাজিয়ে দিচ্ছেন। চিনামাটির প্লেট সাজিয়ে রাখছেন। গাছ কোমর করে শাড়ি পরা। বাঙ্গাল মেয়েদের স্বভাবই এরকমের। আলম সাবের তাই মনে হয়—যখন ঝড় উঠবে, তখন ডালপালা ভেঙে বাতাসে উড়িয়ে নেবে। কেবল সোনাবার : সামনে মুখ খুলতে পারছেন না। সোনাবাবুও বেইমান। সবসময় তাঁর পক্ষ নিলে বিবির তো গোসা হবারই কথা।
আসলে সেদিন সোনাবাবু একবারও বলেননি, আলম সাব আসবেন। বেশি দূর না ফতিমাকে নিয়ে আসবেন। সেদিন তো নিজেই বাবুটিকে বাসায় দিয়ে আসার জন্য বের হয়েছিলেন। তারপর ফিরেও এসেছিলেন—কোনো কথা না, কথা বলতে গেলেই ফুঁসে উঠেছেন।
আবার একদিন একাই চলে গেলেন।
বাসায় দুটো শিশু। একটা কাজের মেয়ে। সোনাবাবুর স্ত্রী কোথায় কোন গাঁয়ে পড়ে আছেন। সত্যি জ্বালা! কেন পড়ে আছেন! আরে ওটা তো সোনাবাবু বুঝবেন। তাঁর স্ত্রী শিশুদের রেখে থাকতে পারেন, আর যত মাথাব্যথা আপনার! সারাক্ষণ নাকি পিসি পিসি করেছে। বাড়ির ভিতরও ঢোকেনি। সিঁড়িতে বসেছিল। কী যে অবুঝ বলে কিনা, আপনাকে নিয়ে যাব। সোনাবাবুর বাসায় গেলে মনেই হবে না, কলকাতায় আছেন। গাড়ি ঘোড়ার শব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। রাজপ্রাসাদ—সত্যি রাজপ্রাসাদ—প্রাসাদের পেছনে সামনে বিশাল পুকুর। বড় বড় সব কদম গাছ, দেবদারু গাছ, দুটো বড় তাল গাছও আছে। সদরে সেপাই। এ-যেন আলাদা একটা দেশ। চল্লিশ পঞ্চাশ বিঘে নিয়ে প্রাসাদ। ঢুকতেই বুক কাঁপছিল। মুশকিল সোনাবাবু বললে কেউ চেনে না। দেশ ছেড়ে এসে অতীশ দীপঙ্কর হয়ে গেছেন। রাজার কারখানার ম্যানেজার। বাড়ি রাত করে ফেরেন। এমন দুটো ফুটফুটে বাচ্চাকে ফেলে কেউ থাকতে পারে বাইরে! কষ্ট হয় না! আপনার হতো না!
জানি না হতো কিনা! হলে বুঝতে পারতাম। তারপর আলম সাব হেসে বলেছিলেন, আপনার হতো কিনা বলেন!
কী জ্বালা! কী বলছি আর কি শুনছে। আপনার হতো কিনা বলেন। মুখ ব্যাজার ফতিমার।
এই হলো ফতিমা বিবি। নিজের হতো কিনা বলবে না। আলমের হলে খুশি।
আলম সাব অগত্যা বলেছিলেন, সত্যি নিষ্ঠুর।
নিষ্ঠুর। নিষ্ঠুর বললেও ক্ষমা করা যায়। সোনাবাবু অমানুষ!
বলছেন কি! আপনার স্বপ্নের মানুষ! সাদির পরে তো একখানাই কথা, আমারে কলকাতায় নিয়া চলেন।
কলকাতায় কেন!
হ, চলেন। আপনের কাছে আমার একখানাই আর্জি।
লন্ডন প্যারিসে পোষাল না।
ধুস ওগুলো মানুষের শহর নাকি! ঠান্ডায় প্যাঁচার মতো মুখ হইয়া যায়।
তারপরই কেমন ছেলেমানুষের মতো ফতিমার চোখ ছলছল করে উঠত। আলম সাবকে নিয়ে ফতিমা তার দেশের বাড়িতেও গেছে। সোনাবাবুদের দেশের বাড়িঘর না দেখলে বেহেস্তে যাওয়ন যায় না। আর আশ্চর্য সে গিয়ে দেখেছে বাবুদের বাড়িতে বেগুনের খেত শুধু। সামনে পুকুর, কচুরিপানা ভর্তি। অর্জুন গাছ, বড় বড় হরফ, সোনাবাবুর হস্তাক্ষর—সব জ্বল জ্বল করে উঠেছিল—উদাস ফতিমা, চুল উড়ছিল শীতের হাওয়ায়।
ঐ যে ওখানটায়। ঠাকুরঘর। কার্তিক পুজোয় ধনমামী শ্রীঘট দিতেন হাতে। ঐ যে ওখানটায় বড় ঘর ছিল। এই যে এখানটায় সোনাবাবুর উপনয়ন। হলুদ মেখে স্নান। ধুতি খুলে গেছিল বলে কাঁদছিল। আমাকে দেখেই ক্ষেপে গেছিল, এই ছ্যামরি তুই এখানে ক্যান—যা। ধুতি খুলে যাওয়ায় উলঙ্গ সোনাবাবুর যত রাগ আমার উপর। দাওয়াত খেতে দেবে না। বলেন মানুষ!
এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, দাওয়াত খেলেন!
আরে খামু কি! আমারে বসাইয়া রাখছে বড় মামী। এক হাঁড়ি রসগোল্লা দিব। যাই কী কইরা? নানীর লাইগা মিষ্টি। নানী ত কমরের বিষে জর্জর। লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটে। নানীর লগে আমি। সোনাবাবু আমারে মানুষ মনে করত না।
হিন্দুগ ঐ স্বভাব।
ব্যস ফতিমা বিবির মুখ রাগে গর গর করে উঠত—কী দোষ হিন্দুগ। আপনেগ কোন কসুর নাই!
তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করলে লীগের তখন এত রমরমা হতো না জানেন। মুসলমানরা যবন। ছুঁলে জাত যায়।
জী আপনেরা যে কন হিন্দুরা কাফের!
সাধে কই। আপনাকে ছুঁয়ে দিলে সোনাবাবুর চান করতে হতো! এটা কত বড় অপমান বোঝেন!
আমরা যে গরু খাই।
গরু খাইলে বুঝি মানুষের ইমান থাকে না! মানুষ অচ্ছুত হয়ে যায়। এত দেশে গেছেন, গরু খায় না, এমন একটা দেশ দেখেছেন। যত দোষ মাছরাঙ্গার।
আসেন, আসেন—ঐ যে দেখছেন নদী, নদীর চর। সোনাবাবুদের কী বিশাল তরমুজ খেত ছিল। দু-হাত ছড়িয়ে বালিকার মতো বলেছিল, এত্ত বড় বড়। তরমুজের উপর বসে আমরা সুর্যাস্ত দেখতাম। ঈশম চাচা তখন তার ছই-এর ভিতর বসে নামাজ পড়ত। তরমুজ খেত ছাড়া চাচার জানেন, আর কোন অস্তিত্ব ছিল না।
কত কথা। বাড়িটায় রোজ সকালে চলে যেত তাঁকে নিয়ে। ঘুরত ফিরত। লেবুর জঙ্গলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে একদিন কি কান্না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
আলমের মনে হয়েছিল, সত্যি মানুষের ঘরবাড়ি পরিত্যক্ত হলে জঙ্গল গজিয়ে যায়।
আলম সাব দেখলেন, দৈনিক পাকিস্তানে বড় বড় হরফে লেখা—জঙ্গী জমানার শেষে ইয়াইয়ার হুমকি—প্রতিটি হিন্দুস্থানী কামানের জন্য চাই একটি পাকিস্তানী কামান, প্রতিটি হিন্দুস্থানী জওয়ানের জন্য চাই একজন পাকিস্থানী জওয়ান, নাটকীয় ভঙ্গীতে এক নেতা ঘোষণা করেছেন—আমরা পাকিস্তানীরা বরঞ্চ চানা মটর ভক্ষণ করে গ্রাসাচ্ছাদন করব, তবুও আমাদের পয়লা নম্বরের দুশমন হিন্দুস্থানের সঙ্গে লড়তে পেছপাও হব না।
কাগজটা সরিয়ে রাখলেন। পূর্ব পাকিস্তানে ধরপাকড় চলছে। রাজাকার বাহিনীর কাজ। সরকারের তল্পিবাহক। আলম সাবের এমনই মনে হলো। পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন নিয়ে কিছু জল্পনা-কল্পনা। রমনার মাঠে মুজিব সাহেবের সভা। পাতা উল্টে গেলেন। ভিসা নিয়ে যাঁরাই আসছেন, ন্যাপ আর আওয়ামী লিগ শেষ পর্যন্ত কী করবে, আঁতাত না আলাদাভাবে লড়বে এমন সব জল্পনা-কল্পনা। তিনি শোনেন। কোনো মন্তব্য করেন না। তবে ফতিমার এক কথা, সব টাকা পাচার করে নিচ্ছে। বিশ বাইশ বছরে দেশের কিছু রাস্তাঘাট ছাড়া কী হয়েছে বলেন!
আলম সাব তখনও চুপ করে থাকেন,। আলম সাব কী ভেবে উঠে গেলেন ভিতরে। দেখলেন, ফতিমা চাল ভাজা খাচ্ছে। সকালে চালভাজা সরষের তেল মেখে ব্রেকফাস্ট। রুটি, ফল, কেক, ডিমের পোচ না, চাল ভাজা। ঝকঝকে দাঁত। ছোলা মটর ভাজা সাপ্লাই করার একমাত্র নফর কুদ্দুস মিঞা। কাঁচালংকা কামড়ে খাচ্ছে, আর হুস হাস করছে। সোনাবাবুর খোঁজ পেয়েই সে আরও কেমন বেশি ছেলেমনুষ হয়ে গেছে। আলম সাবকে দেখেই লুকিয়ে ফেলল। সাহেব বললেন, সত্যি দেশপ্রীতি বলি! নানা-নানীর পছন্দ ভুলতে পারেন না দেখছি। পেট খারাপ হলে জানি না।
ফতিমা বলল,, এই দেখুন বেশি না। কলকাতায় এসে সব শখ পুষিয়ে নিচ্ছি। নিজের মানুষ সব। বিদেশে আছি মনে হয় না জানেন! খাবেন? বলে এক মুঠ চালভাজা দিতে গেলে বললেন, অত শখের দরকার নেই। দাঁতগুলি যাবে।
–জানেন দাঁত শক্ত হয়।
–কে বলল!
–নানীর একটাও দাঁত পড়েনি। ইন্তেকালের সময় সবকটা দাঁত ছিল। নানীর চালভাজা খাইলেন না, কি কমু, ফুরফুরে জুঁইফুল জানেন।
বালিকার মতো চালভাজা কোঁচড়ে নিয়ে হাঁটছে, খাচ্ছে —একে ওকে ফরমাশ করছে। প্লেট ধোওয়া- মোছা, সায়া-শাড়ি কাচাকাচির যা কিছু বাথরুমের পানিতে ভিজিয়ে দিচ্ছে। একদন্ড বিশ্রাম নেই। ওয়ারড্রোব থেকে তাঁর পোশাক বের করে দেবার সময় ফতিমা বলল, আমি বের হব। ফিরতে দেরি হবে।
–বের হবেন! কোথায়! জানেন বোমাবাজি চলছে। পুলিশ খুন।
–সোনাবাবুর বাড়ি। আমি তো পুলিশ না। আমাকে খুন করবে কেন?
–কেউ তো থাকবে না। গিয়ে কী হবে! আলম বিরক্ত।
–বা, আজ টুটুল মিণ্টুর ছুটি। ওদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাব ভাবছি।
–আপনার কী মাথা খারাপ আছে!
–মাথা খারাপের কি দেখলেন।
–বাড়িতে ঢুকলেন না। সোনাবাবুর সঙ্গে দেখা হলো না। কথা নেই বার্তা নেই বাচ্চা দুটোকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাবেন ঠিক করলেন! রাস্তাঘাট ভাল না।
মুখে অদ্ভুতভাবে চালভাজা ছুঁড়ে দিয়ে ফতিমা বলল, সোনাবাবু কিছু বলবেন না। কাজের মেয়েটাকে বললেই হবে। রাস্তাঘাটে ঝামেলা দেখলে ফিরে আসব।
জী আপনি যে বললেন, নামধাম পর্যন্ত জানাননি। পাকিস্তানের পিসি বলেছেন। আলম মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে তাকালেন।
আশ্চর্য সরল চোখে ফতিমা তাকিয়ে থাকল আলম সাবের দিকে। আলম সাব পাশের সোফায় বসে পড়েছেন। বড় একগুঁয়ে, কারো কথা শোনে না—এই সরল চোখ দেখলে আলম সাব সত্যি ভয় পান। ঘাবড়ে যান। এমন চোখ দেখলে আর জেহাদ ঘোষণা করতে পারেন না। ফতিমা বিছানার চাদর টেনে দিয়ে বলল, পাকিস্তানের পিসির কত জোর দেখুক। সোনাবাবুর সাহস আছে! আমি গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে টুটুল মিণ্টু। সোনাবাবু তাদের কে!
হেমন্তের সকাল। রোদে তেজ নেই। এই সকালে বের হয়ে কখন ফিরবে কে জানে। তারপরই—ইস, ভুলেই গেছিলেন, আলম সাব বললেন, হবে না। শিয়ালদায় পুলিশ খুন হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি- ঘোড়া বন্ধ। সোনাবাবুর বাসায় তো শিয়ালদা ধরে যেতে হবে।
ফতিমা পাশের সোফায় বসে কী ভাবল। তারপর তড়াক করে লাফিয়ে বারান্দায় চলে গেল। রেলিঙে ঝুঁকে ডাকল, গহর ভাই, শোনেন।
গহর নিচে গুলতানি করছিল কার সঙ্গে। বড় বেশি বদমেজাজী ছোকরা। যদি মনে করে আলম সাবের পছন্দ না বিবি গাড়ি নিয়ে বের হোক, তবে সোজা বলে দেবে, জী সাহেব ডাকছেন! না আপনে!
আমি ডাকছি।
ওপরে উঠে চুপি দিয়ে সাবের মুখ দেখবে গহর। সাব ইশারা করলে তবে সব ঠিক, ইশারা না করলে, গাড়ির কলকব্জা বেঠিক হয়ে যায়, ফতিমা জানে।
ফতিমা তক্কে তক্কে থাকে।
উপরে গহর উঠে আসতেই দরজা আড়াল করে দাঁড়াল ফতিমা। বসার ঘরে যেন উঁকি দিতে না পারে—দিলেই হিসাবে গোলমাল সব। সে বলল, কুমারদহ রাজবাটী চেনেন গহর ভাই?
গহর অবশ্য ঠিক চেনে না। তবে রাস্তার নাম বললে চিনতে পারবে। আলম নিজেও পড়েছেন বিপাকে—উঠে গিয়ে কিছু বললেই বিবিজান মুখ গোমড়া করে ফেলবে। পাঁচ-সাত মাসে বিবি নিজেও কিছু কম চেনে না।
ফতিমা নিজেই রাস্তা বাতলে দিল। বলল, সি আই টি রোড ধরে যাব। বেলেঘাটা হয়ে ফুলবাগান। তারপর রাজাবাজারের রাস্তা ধরব। কী ঠিক বলছি না?
–জী মেমসাব।
–আপনি তো গেছেন গহর ভাই!
–গহর অস্বীকার করতে পারল না। সে গেছে, সে জানে বেলেঘাটা হয়ে গেলে রাস্তা ঠিকঠাক থাকবে। কেমন নিমরাজি গলায় বলল, গাড়ি বের করতে বলছেন?
আলম বুঝতে পারছেন রোখা যাবে না। তিনি ঘড়ি দেখে বুঝলেন, তাঁরও বের হবার সময় হয়ে গেছে। পাঁচটার আগে তিনিও বাসায় ফিরতে পারছেন না। একলা এত বড় বাড়িতে হাঁপিয়ে ওঠার কথা—এটা আগেও ছিল, সাহেব অফিস বের হলে, সে কেনাকাটা করতে কিংবা বন্ধু বান্ধবদের বাড়িতে গাড়ি নিয়ে চলে যেত। এখানটায় সে-ভাবে তার এখনও কোনো পরিচিত মানুষজনের হদিস মেলেনি। সোনাবাবুকে আবিষ্কার করার পর তার যেন সব মিলে গেছে। টুটুল মিণ্টুকে দেখার পর আসল মেহমান পেয়ে গেছে। আলম চুপচাপ দাড়ি কামালেন। হাতের সামনে সব ঠিকঠাক রাখার কাজে ফতিমার তুলনা হয় না। এই যে বের হবে তার আগে, সব ঠিকঠাক রেখে যাবেন। কোনো অসুবিধা রাখার বান্দা এ-মেয়ে নয়।
তিনি শুধু বললেন, কখন ফিরবেন!
এই তো চিড়িয়াখানায় যাব। টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে ঘুরব চিড়িয়াখানা। কতক্ষণ আর লাগবে!
আলম টের পান নারীর কোমল এক ক্ষতস্থানে অহরহ রক্তপাত হচ্ছে সেই কবে থেকে। ডাক্তার, কবিরাজি, হেকিমি-দানরি, কবচ-ওবচ, দরগায় সিন্নি—না, কিছুতেই কিছু হয়নি। পাগলের মতো যেখানে যে যা বলেছে ছুটেছে। তাকেও সঙ্গে নিয়েছে। মাথাটা গেছে—একসময় এমন ভাবতেন আলম সাব—আব্বা যার এত বড় নেতা আওয়ামী লীগের তার যে জেদ একটু বেশিমাত্রায় থাকবে—আর এক কন্যা সার হলে যা হয়—বাপজানের সোহাগী কন্যা—বর্ষার জলের মতো ঘরবাড়ি ভাসিয়ে দেয়, আবার টান ধরলে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়—জল থাকে না, জমি জেগে যায়, উর্বরা শস্যক্ষেত্র বিবি তখন—জীবনের এমন সব শতেক কুট কামড়ে অস্থির—বিবির ইচ্ছের বিরুদ্ধেও যেতে পারেন না। শক্ত কথা একদম সহ্য করতে পারে না। ফুঁফিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
আলম সাব সাফসুতরো হয়ে এবার নিজের জামাপ্যান্ট তুলে নিলেন। সোনাবাবুর সঙ্গে দেখা হবার পর কেমন যথার্থই বালিকার মতো আচরণ—জানেন কামরাঙ্গা পেলাম। সেদিন নিউ-মার্কেট থেকে এক কেজি কামরাঙ্গা এনে বললেন, দ্যাখেন কী আনছি। আলম ছুটে গিয়ে অবাক—কটা কামরাঙ্গা বেশ দামি প্যাকেটে সাজিয়ে এনেছে। সোনাবাবুকে দেখার পরই তার কামরাঙ্গা খেতে ইচ্ছে হয়, চালভাজা খেতে ইচ্ছে হয়, আশ্চর্য!
―খান। ফতিমা নুন এনে নিজে কচকচ করে খেতে থাকে। তাঁকেও দিল। কী আহ্লাদ ফুটে উঠেছে ফতিমার চোখে। জানেন, আমীর ফলয়ালা কথা দিয়েছিল, আমাকে কামরাঙ্গা খাওয়াবে। লটকন ফল পাচ্ছে না। পেলে দেবে। ও কথা দিলে কথা রাখে।
একদিন গভীর রাতে আলম সাব জেগে গিয়ে অবাক। খত লিখছে বিবি! আব্বাজানকে নয়, চাচাদের নয়—রোকেয়া খাতুনকে। একসঙ্গে কলেজে পড়ত।
এত রাতে জেগে আছেন!
জী মনটা ভাল না, জানেন!
কেন কী হয়েছে?
আপনে আমারে লটকন ফল আইনা দিতে পারলেন না সাহেব। কইলাম দেশ থাইকা ঘুইরা আসি। কইলেন, ছুটি ছাটা পাওনা নাই। একলা গ্যালে আমারে খাইয়া ফেলব!
খেয়ে ফেলবে কেন! আপনি না থাকলে ভাল লাগে না। শীতের সময় যাব।
কতক্ষণ লাগে কন। ঘন্টাখানেকও না। দু-দিন থাইকা আইলে দ্যাশের বাড়িতে যাইতে পারতাম। বর্ষাকালে কত লটকন ফল হয় জানেন! আবার বর্ষাকাল না আইলে পাওয়া যাইব না। রোকেয়াকে লেখলাম, যদি থাকে, শীত আইসা গেল, পাওয়া যাইব বইলা মনে হয় না। বেহায়ার মত লিখলাম, পাইলে যেন পাঠাইয়া দেয়।
চালভাজা খায়। কোত্থেকে পাতিল তেতে গেলে নুন মেশানো ভেজা
সোনাবাবুর সঙ্গে দেখা হবার পর ফতিমার অদ্ভুত সব শখ—যোগাড় করে এনেছে। বালি। গ্যাসের উনুনে পাতিলে বালি ফেলে চাল ভেজে নিয়ে চালভাজা করে বোয়ামে তুলে রেখেছে। কাজগুলি করে তাঁর অজ্ঞাতে। তিনি যখন অফিসে থাকেন—ঠিক তখন।
কুদ্দুস গোপনে সাহেবকে সব বলে দেয়। আলম ভেবে পান না তখন কী ভাবে বিবিকে বলবেন, শেষে চালভাজায় এসে ঠেকলেন। মাথাটা সত্যি গেছে।
আর তখন বোঝা যায়, কী মুখরা! সোনাবাবুর ভাষায়, তর চোপাখান দেখছি আগের মতোই আছে—চোপার ডরেও আলম সাব গুটিয়ে থাকেন। মাথা খারাপ বললে ক্ষেপে লাল!—দরগায় যাবেন। যান। কিচ্ছু হবে না।
কী কইলেন, হাসনপীরের দরগা—জানেন হিন্দু মুসলমান সবার মানত দরগায় সিন্নি দিলে পূরণ হয়? আপনে ইমানদার আদমি, আপনের মুখে আটকাইল না। আমার মাথা খারাপ, না আপনের মাথা খারাপ!
সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর, ফতিমার যা ভাল লাগবে, আলম সারকেও তাই ভাল লাগতে হবে।
কামরাঙ্গা নিয়ে কম হুজ্জোত গেছে! কম মন কষাকষি চলেনি!
কী মিষ্টি না!
টক কামরাঙ্গা—মিষ্টি কী করে বলে! আলম না বলে পারেননি, আমি খেতে পারছি না।
কী কন জী, খেতে পারছেন না!
জিভে জল আসে ফতিমার! আর আলম সাব বলছেন খেতে পারছেন না। ভালবাসার মানুষ তার ভাললাগার দাম বোঝেন না।
এই ধরেন নুন। নুন মাখান। তারপর ফতিমা একটু নুন আলগা করে কামরাঙ্গায় লাগিয়ে দিয়ে বলছে, মুখে দ্যান। কী রস না! রসে মুখ ভইরা যায়।
দাঁত টকে যাচ্ছে, একটা আস্ত কামরাঙ্গা শেষ করতে। শেষ না করেও উপায় নেই। জ্বালা কী একটা। না খেলেই বলবে, আপনে আমারে দেখতে পারেন না, যামু যেদিকে দুচোখ যায় বাইর হইয়া।
অগত্যা নিষ্কৃতি পাবার জন্য বলতেই হলো, বুক জ্বালা করছে।
জী বুক জ্বালা করছে বলছেন। অম্বল হয় নাই ত!
মনে হয় তাই হইছে।
থাউক। রাইখ্যা দ্যান। এই কুদ্দুস ভাই তাড়াতাড়ি আসেন।
কুদ্দুস ছুটে এলেই বলেছে, জিলোসিলের শিশিটা দ্যান।
তারপর দু-চামচ জেলুসিল ঢেলে, জল মিশিয়ে বলছে, খান।
আলম জানেন এটাই তাঁর কামরাঙ্গার হাত থেকে একমাত্র আত্মরক্ষার উপায়।
অধীর মুখে বলছে ফতিমা, কেমন লাগছে? বুক জ্বালা করছে নাতো!
নিষ্কৃতি পেয়েছেন ভেবেই মনটা খুস হয়ে গেছিল। তিনি বলেছিলেন, না বুক জ্বালা করছে না। ওযুধে কাজ দিয়েছে। তারপর ফতিমা আর কখনও কামরাঙ্গা খেতে বলেনি। চালভাজা দিলে আলম বলেছেন, দাঁতে লাগে।
ফতিমার আফসোস—ইস, চালভাজা খাওয়ানো গেল না! কী মজা, তেল নুন মেখে চালভাজা, আস্ত একটা কাঁচালঙ্কা দু-আঙুলে গোলাপ ফুলের মতো ধরা। ঘরে বিদেশী আতরের গন্ধ—এটা ফতিমার তখন মনঃপূত নয়, গন্ধটা চালভাজার ঘ্রাণ নষ্ট করে দিচ্ছে—কুদ্দুসকে ডেকে বলে দিল, স্প্রে করবেন না ভাই। দু-একটা মশার কামড়ে জাত যায় না।
কুদ্দুস একদিন না পেরে আলম সাবকে নালিশ দিল, মেমসাব সকালে নুন পাত্তা নিয়া বসলেন! আলম শুনে থ!
ফতিমা চুপি চুপি কাজ সারে। সাহেব টের পেলেই বলবেন, অসুখ-বিসুখ হবে আর কি। আমার কি! আমার কথা শোনে কে!
তারপর কুদ্দুস ফিরিস্তি দিল, যা শুনে আলম হতবাক। গহরকে দিয়ে লেবুপাতা আনিয়েছে। লঙ্কা পুড়িয়েছে। লেবুপাতা দিয়ে পোড়া শুকনো লঙ্কা আর পাস্তা এক শানকি বাসায় শানকি ছিল না, ঠিক খুঁজে পেতে সংগ্রহ করেছে—কালো রঙের শানকি পাথরের উঁচু থালার মতো দেখতে, চীনে মাটির বাসনের পাশে যত্ন করে রেখে দিয়েছে।
আরে ওটা কী! কালোমতো! আলমারির শোভাবর্ধন করছে!
কাচের আলমারি। মিনা করা কাচের গায়ে মসজিদের ছবি। তার ভিতর রঙবেরঙের কাচের গ্লাস, জাপানী কাচের প্লেট, সোনার জলে কাজ করা এবং ফাঁকে মাটির শানকি—যেন এই মাটির শানকিটাই সবচেয়ে খুবসুরত আর মহার্ঘ—কাচের চীনেমাটির দামি গ্লাস প্লেট ডিশ সব অর্থহীন শানকি না থাকলে।
ফতিমা বেশ লজ্জায় পড়ে গেছিল সাবের কথায়! সাব কি চেনে না! নামাজ রোজা বদনা চেনে, শানকি চেনে না। নাকি বড় জায়গায় উঠে গিয়ে ইচ্ছে করেই ভুলে থাকতে চায় সব! পাকিস্তানী আপনে, জানেন না, ওটারে কি কয়! আপনের নানা দাদা শানকিতে ভাত খায় নাই! আমারে রে জিগান, এটা কি!
আলম সাব তারপরে বলেছেন, শানকিখান খুবই মজবুত মনে হয়।
ফতিমা বলেছিল, হ, ভাঙে না।