অধ্যায়-৩ হযরত ইউসুফ (আ)- দাসবালক থেকে মিসরের উজির

অধ্যায়-৩ হযরত ইউসুফ (আ) দাসবালক থেকে মিসরের উজির

খ্রিস্টান বিশ্বে যিনি জোসেফ নামে খ্যাত, মুসলিম আর ইহুদীদের কাছেই তিনি নবী হযরত ইউসুফ (আ) – অনিন্দ্য সুন্দর যে পুরুষ তিন ধর্মের মানুষের কাছেই সম্মানিত। এ তিন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ মোতাবেক, হযরত ইউসুফ (আ) হলেন সেই ব্যক্তি যার মাধ্যমে ইসরাইল জাতি স্থান লাভ করে মিসরে। কিন্তু তাঁর আজ ফকির তো কাল রাজা হবার যে নাটকীয় ঘটনা- সেটি জনবিদিত। আর সেই সাথে জননন্দিত হলো ইউসুফ-জুলেখার কাহিনী।

ইহুদী জাতির ইতিহাস তুলে ধরা এ বইতে ইউসুফ (আ)-এর জীবনের পাশাপাশি ইউসুফ-জুলেখার মূল একপক্ষীয় সম্পর্কের ঘটনাও বর্ণনা করা হবে। তবে সেক্ষেত্রে আমরা এমন সব পুরনো নথিও খুঁজে বের করব, যেগুলোর কথা অনেকেই জানেন না।

ইউসুফ শব্দটি এসেছে হিব্রু একই শব্দ থেকে যার অর্থ ‘বৃদ্ধি করা’। হযরত ইউসুফ (আ) ছিলেন বারো ভাইয়ের একজন। তাঁর বাবা ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ), যাকে খ্রিস্টানরা জ্যাকব বলে থাকেন। তাঁর অন্য নাম ছিল ইসরাইল। বড় দশ ভাইয়ের প্রায় সকলেই ছোট ইউসুফ (আ)-কে হিংসা করত, কারণ তাদের বাবা তাঁকে সবচেয়ে বেশি আদর করতেন। এজন্য তারা সিদ্ধান্ত নিল, ইউসুফ (আ)-কে সরিয়ে দেবে। এ ব্যাপারে তিন ধর্মই একমত। পবিত্র কুরআনের আয়াত (১২:৪) অনুযায়ী, ইউসুফ (আ) স্বপ্নে দেখেন, চাঁদ, সূর্য ও এগারোটি তারকা তাঁকে সিজদা করছে। কিন্তু, তাঁর পিতা তাঁকে মানা করেন এ স্বপ্ন ভাইদের জানাতে। উল্লেখ্য, বাইবেলের আদিপুস্তকে (৩৭:১-১১) এ স্বপ্ন দেখার সময় ইউসুফ (আ) এর বয়স ১৭ বছর ছিল বলে জানানো হয়েছে।

হযরত ইয়াকুব (আ) এর একাদশ পুত্র হযরত ইউসুফ (আ) এর মা ছিলেন রাহেলা, যার গর্ভে আরেক সন্তান বিনইয়ামিন জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি দশ পুত্রের জন্ম ইয়াকুব (আ) এর অন্য স্ত্রী লিয়ার গর্ভে। এজন্য বাকিরা ইউসুফ (আ) এর সৎ ভাই হলেও, বিনইয়ামিন ছিলেন তাঁর আপন ভাই।

ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে বড় ভাইয়েরা তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা আটে। পিতাকে ব্যাপক অনুরোধ করে হিতাকাঙ্ক্ষী সাজা ভাইয়েরা ইউসুফ (আ)-কে নিয়ে গেল। তারা তাঁকে হত্যা করেনি, কারণ সবার বড় ভাই রুবেন প্রাণে বধের ব্যাপারে বাধ সাধে। তার কথায় শেষপর্যন্ত ইউসুফ (আ)-কে এক শূন্য কুয়ায় ফেলে দেয়া হলো। তারা রাতে পিতার কাছে ফিরে জানালো, তারা যখন দৌড় প্রতিযোগিতা করছিল এবং ইউসুফ (আ)-কে মালপত্রের নিরাপত্তার জন্য রেখে গিয়েছিল, তখন এক নেকড়ে

এসে তাঁকে খেয়ে ফেলে। তারা ইউসুফের বানোয়াট রক্তমাখা জামাও পেশ করল প্রমাণ হিসেবে, কিন্তু পিতা ইয়াকুব (আ) তাতে অবিশ্বাস করলেন।

ওদিকে এক যাত্রীদল কুয়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, এবং তারা পানি পান করবার জন্য বালতি নামাতেই দেখে এক সুপুরুষ বালক। তারা তাঁকে মাত্র কয়েক দিরহামের জন্য বিক্রি করে দিলো। এতটাই নির্লোভ ছিল তারা ইউসুফ (আ) এর ব্যাপারে। এখানে ‘তারা’ কে সে বিষয়ে রয়েছে মতভেদ। ইবনে ইসহাক (র) বলেন, ভাইয়েরা আশপাশে থেকে লুকিয়ে দেখছিল, কী ঘটে ইউসুফ (আ) এর ভাগ্যে। ইবনে কাসির (র) এর তাফসিরে বর্ণিত, ইবনে আব্বাস (রা) এর মতে, ইউসুফ (আ)-কে কুয়া থেকে তোলার ঘটনা দেখে ভাইয়েরা এগিয়ে এসে তাঁকে যাত্রীদলের কাছে বিক্রি করেছিল খুব কম দামে, কারণ তাদের মূল লক্ষ্য ছিল আপদ বিদায় করা, অর্থ উপার্জন নয়। বাইবেলের আদিপুস্তক মোতাবেকও, ভাইয়েরাই বিক্রি করেছিল মিসরগামী এ মাদায়েনি বণিকদলের কাছে। তবে, কাতাদা (র) এর মতে, ‘তারা’ বলতে যাত্রীদলকেই বোঝানো হয়েছে।

মিসরে যে লোকটির কাছে ইউসুফ (আ)-কে বিক্রি করা হয় দাস হিসেবে তিনি ছিলেন ধনী। পবিত্র কুরআনে তাঁর নাম উল্লেখিত নেই, কিন্তু বলা আছে (১২:২১ আয়াত) যে, সেই ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে বলেছিলেন, তারা বালকটিকে নিজেদের ছেলে হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, লোকটির নাম ছিল কিতফীর। তিনি ছিলেন মিসরের উজির। তাঁকে আজিজ মিসরিও ডাকা হয়, যা একটি উপাধি, নাম নয়। আজিজ (xic) বর্তমানে জনপ্রিয় আরবি নাম হলেও এর প্রচলন সেমিটিক, ফিনিশিয়, আরামায়িক ও হিব্রু ভাষাতেও ছিল। বাইবেল বা তাওরাতেও কিতফীরের ‘ত-ফ-র’-এর কাছাকাছি নামই উল্লেখ করা হয়েছে ‘পতিফার’ (Potiphar)। মিসরীয় নিজস্ব ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে এটা বোধগম্য যে পতিফার একটি খাঁটি প্রাচীন মিসরীয় নাম। তখন মিসরীয় দেব-দেবীদের সাথে নাম মিলিয়ে রাখা হত, যেমন পতিফেরা অর্থ ‘যাকে দেবরাজ রা দান করেছেন’। মিসরে যে একত্ববাদী ধর্ম তখন ছিল না। সে ব্যাপারে সকলেই একমত। বাইবেলে পতিফারকে মিসররাজের নিরাপত্তাকর্মীদের প্রধান বলা হয়েছে। তবে আজিজের স্ত্রীর নাম বাইবেল বা কুরআন কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। লোককথায় তার নামগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘জুলাইখা’।

এ পর্যায়ে এসে আমরা বহুল প্রচলিত ইউসুফ-জুলেখার কাহিনীর সম্মুখীন হই। কিন্তু আমাদের পরিচিত কাহিনীর চেয়েও অনেক অজানা কিছু অধ্যায় আমরা পাঠকদের জানাতে চাই বিধায় এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত এ অধ্যায়ে না জানিয়ে পরের অধ্যায়ে জানাতে চেষ্টা করা হবে, যার পুরোটাই হবে জুলাইখার কাহিনী নিয়ে। কুরআন কতটা জানায়, বাইবেল কতটা জানায়, এবং এর বাইরে আর কী কী জানা যায়? এবং অতি অবশ্যই আমরা ইউসুফ-জুলেখা নামক ইরানি টিভি সিরিজের চিত্রনাট্যের অনুসরণে যাব না, যেখানে গল্পের খাতিরে চিত্রনাট্যকারেরা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন।

ইউসুফ (আ) দেখতে এতটাই অপরূপ ছিলেন যে জুলাইখা তাঁর প্রেমে পড়ে যান। এমনকি বর্ণিত আছে, অন্যান্য মহিলারা “ছিঃ ছিঃ” রব তুললে তাদের সামনেও কৌশলে তাঁকে হাজির করেন জুলাইখা, এবং তাঁর রূপ দেখে সে মহিলাদের হাতে থাকা ছুরির ধারে হাত কেটে যায়। তবে ইউসুফ (আ) জুলাইখার কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় জুলাইখা জোর করেন, এবং শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে তাঁকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেন। ফলে তাঁর জেল হয়ে যায় (জুলাইখার বিস্তারিত কাহিনী পরের অধ্যায়ে)।

তাঁর সাথে আরো দুজন কয়েদী ছিল। ইউসুফ (আ) আল্লাহ কর্তৃক স্বপ্ন ব্যাখ্যার গুণ পেয়েছিলেন 1 কয়েদী দুজন স্বপ্ন দেখেছিল। তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে দিলেন ইউসুফ (আ)। সত্যি সত্যি সেটা মিলে গেল, তার ভবিষ্যদ্বাণী মাফিক, একজন ছাড়া পেয়ে মিসরের রাজার মদ পরিবেশক হলো, আরেকজন ক্রুশবিদ্ধ হলো। মুক্তিপ্রাপ্তকে ইউসুফ (আ) অনুরোধ করেছিলেন যেন সে তার প্রভুকে জানায় ইউসুফ (আ) এর কথা।

এদিকে মিসররাজ নিজেও এক স্বপ্ন দেখলেন নিজের শয়নকক্ষে। দেখলেন, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন নীল নদের তীরে। পানি কমতে কমতে কাদা হয়ে যাচ্ছে। মাছ লাফিয়ে কাদায় উঠে পড়ছে। হঠাৎ নদী থেকে সাতটা মোটা গরু উঠে এলো, পেছনে সাতটা শীর্ণ গরু। এরপর আজব ব্যাপার হলো। ঐ সাতটা শীর্ণ গরু খেয়ে ফেলল সাতটা মোটা গরুকে! তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। নদীর পাড়ে সাতটা শস্যদানা দেখা গেল, রঙ সবুজ। এরপর সেগুলো কাদায় মিশে গেল। এরপর ঠিক ওখানেই সাতটা শুকনো শস্য পড়ে রইল।

তাঁর ঘুম ভেঙে গেল, অস্থির হয়ে গেলেন। তিনি লোক ডাকলেন, ডাকলেন জাদুকরদের। কী অর্থ এই স্বপ্নের? কেউ বলতে পারল না। বলল, “আরে, এটা দুঃস্বপ্ন।” রাজার মদপরিবেশক যখন এই কাহিনী শুনল, তখন তার মনে পড়ে গেল, কয়েক বছর আগে সে যখন জেলে ছিল, তখন তার সাথের কয়েদী, যার নাম ইউসুফ, স্বপ্ন শুনে বলে দিয়েছিল যে সে মুক্তি পেয়ে ফারাওয়ের মদপরিবেশক হবে! রাজাকে এটি বলার পর, তিনি ইউসুফকে (আ) জিজ্ঞেস করতে পাঠালেন।

ইউসুফ (আ) জানালেন, সাত বছর অনেক শস্য ফলবে, প্রয়োজনের বেশি এগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ এরপর সাত বছর চলবে খরা। তখন সেই শস্য ব্যবহার করতে হবে। এরপর এক বছর প্রচুর বৃষ্টি হবে।

রাজা তাঁকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে বললেন। তিনি আবারও তদন্ত করলেন ইউসুফ (আ) এর মামলার, এবং জানতে পারলেন আসলে তিনি নির্দোষ।

এরপর ইউসুফ (আ)-কে নিজের একান্ত সহচর করে নিলেন। ইউসুফ (আ) তাঁর কাছ থেকে কোষাগারের দায়িত্ব চেয়ে নিলেন। ধীরে ধীরে আরো উঁচু পদে উঠতে লাগলেন তিনি। একসময় তিনি হলেন রাজার অধীনে মিসরের উজির। এক দাসবালক থেকে মিসরের রাজদরবারের গণ্যমান্য একজন!

আসলেই ৭ বছর অনেক শস্য ফলল। উদ্ধৃত্ত পুরোটা জমা করলেন ইউসুফ (আ)। আর এরপর শুরু হলো ৭ বছরের খরা। এত ভয়াবহ খরা যে আশপাশের সব দেশ পর্যন্ত আক্রান্ত হলো। এমনই একদিন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ১০ জন লোক এলো মিসরে। তারা শুনেছে, মিসরে এক দূরদর্শী লোকের কল্যাণে অনেক জমানো ফসল আছে, তারা খরাতে খুবই আক্রান্ত। তারা শস্য ভিক্ষা করতে এসেছে বুড়ো বাপকে দেশে রেখে।

দরবারে তারা এসে দাঁড়াতেই, ইউসুফ (আ) এর চোখে বুঝি পানি চলে এলো। এ যে তারই সেই ১০ ভাই, যারা তাকে কুয়াতে ফেলে গিয়েছিল! যার কাছে খাবার ভিক্ষা করতে তারা এসেছে, সে-ই তাদের ভাই, এখন মিসরের উজির! তিনি তাদের থলে ভর্তি করে শস্য দিতে বললেন। ইউসুফ (আ) কথাচ্ছলে তাদের থেকে তাদের সৎ ভাই বিনইয়ামিনের কথাও জেনে নিলেন।

ইউসুফ (আ) বললেন, “তোমরা কি সত্যবাদী?”

তারা অবাক হয়ে বলল, “মিথ্যে কেন বলব?”

“ঠিক আছে, পরেরবার তোমাদের ছোট ভাইটাকে নিয়ে আসবে। ঠিক আছে? না হলে এক দানা শস্যও পাবে না।”

ভাইয়েরা রাজি হয়ে গেল। চলেও গেল।

তারা জানলো না, ইউসুফ (আ) যে একজনকে দিয়ে গোপনে তাদের শস্যের বস্তার ভেতরে রেখে দিয়েছেন সেসব জিনিস যার বিনিময়ে তারা শস্য কিনেছিল। ভাইদের থেকে অর্থ তিনি নেননি। পুরোটাই তাদের অজান্তে তাদের সাথেই দিয়ে দিলেন। তাদের চলে যাবার পথের দিকে চেয়ে রইলেন, তাদের আবার আগমনের প্রতীক্ষায়। সাথে থাকবে তাঁর আপন ভাই।

মিসর থেকে নিজের দেশে দিরে এলো ১০ ভাই, সাথে এতগুলো উট বোঝাই শস্য। কিন্তু পরেরবার শস্য আনার শর্তটা বাবাকে জানালো তারা, ছোট ভাই বেঞ্জামিন (বেনইয়ামিন/বিনইয়ামিন) যদি পরেরবার সাথে না যায়, তাহলে উজির আর শস্য দেবেন না।

ভাইয়েরা বস্তা খুলেই দেখলো, তাদের টাকা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। সবাই খুশি হয়ে গেল। কিন্তু কেন এমনটা করা হলো সেটা বুঝলো না। এই টাকা দিয়ে পরে আবার শস্য কেনা যাবে মিসর থেকে।

যখন শস্য ফুরিয়ে এলো, তখন তারা আবার প্রস্তুত হলো মিসর থেকে শস্য কিনতে। এবার বিনইয়ামিনকে সাথে নিতে হবে। কিন্তু বাবা ইয়াকুব (আ) অস্বীকৃতি জানালেন, তিনি তার ছোট ছেলেকে যেতে দেবেন না। কারণ, ইউসুফ (আ)-কে ভাইয়েরা দেখে রাখতে পারেনি। ছেলেদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে ইয়াকুব (আ) রাজি হলেন, তবে কথা দিতে হলো, যেকোনো মূল্যে বিনইয়ামিনকে ফেরত আনতে হবে।

শুরু হলো তাদের দীর্ঘ ভ্রমণ।

মিসরে পৌঁছালে পরে উজির তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। বিনইয়ামিনকে দেখেই তার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু পারলেন না। তাই ইউসুফ (আ) পরিকল্পনা করলেন।

তাদের সম্মানে একটি ভোজসভা দিলেন। সেখানে সবাইকে জোড়ায় জোড়ায় বসতে হবে। ফলে ১১ ভাইয়ের ১০ জন জোড়ায় জোড়ায় বসল, কিন্তু জোড়া ছাড়া রয়ে গেলেন বিনইয়ামিন। এটাই চেয়েছিলেন ইউসুফ (আ)। ফলে ইউসুফ (আ) আর বিনইয়ামিন বসলেন একসাথে।

কথিত আছে, ভোজের একপর্যায়ে দেখা গেল, বিনইয়ামিনের চোখে পানি। অশ্রুর কারণ জিজ্ঞেস করলেন ইউসুফ (আ), উত্তরে বিনইয়ামিন বললেন, “আমার এক ভাইকে আমি হারিয়েছি ছোট বেলায়। ও যদি এখানে থাকত, তার পাশেই বসতাম আমি।”

সেদিন রাতে, ইউসুফ (আ) বিনইয়ামিনকে ডেকে নিলেন এক কক্ষে। এরপর বললেন, “আমিই তোমার সেই ভাই। ইউসুফ।” কিন্তু, আপাতত ব্যাপারটা গোপন রাখতে বললেন। ইউসুফ (আ) কর্তৃক নিজের পরিচয় ভাইকে জানাবার ঘটনা ইবনে কাসির (র) এর তাফসিরে লিখিত আছে।

পরদিন যখন উটের পিঠে চড়ানো হচ্ছিল শস্যের বস্তা, তখন ইউসুফ (আ) এর আদেশে একজন গোপনে রাজার সোনার পাত্র শস্যের থলেতে ঢুকিয়ে রাখল। যখন ভাইয়েরা রওনা দিয়ে দিল, তখনই প্রধান ফটক আটকে দেয়া হলো।

পাহারাদাররা চিৎকার করে উঠলো, “তোমরা চোর!”

হঠাৎ এমন অভিযোগে অবাক হলো ভাইয়েরা। কারণ তারা তো চুরি করেনি। তারা বলল, “আমরা কেবল শস্য নিতে এসেছি।”

তাদের জিজ্ঞেস করা হলো, “চোরের শাস্তি কি তোমাদের আইনে?”

তারা উত্তর দিল, “যার সম্পদ চুরি করা হয়েছে, তার দাস হয়ে থাকবে চোর। যে ধরা পড়বে তাকে যেন শাস্তির জন্য আটক করা হয়।”

চিরুনি অভিযানের পর তাদের এক বস্তা থেকে আসলেই রাজার সোনার পাত্র খুঁজে পাওয়া গেল। বিনইয়ামিনের থলেতে। তখন অন্য ১০ ভাই বলে উঠল, “এ চুরি করতে পারে, এর ভাইটাও (জোসেফ) চোর ছিল!” তারা জানত না, সেই ভাই এখানেই আছে!

নিয়মমাফিক, বিনইয়ামিনকে রেখে যেতে হবে। তখন বড় ভাইদের মনে পড়ল, বাবার কাছে কী কথা দিয়ে এসেছিল তারা। তারা অনুরোধ করল, বিনইয়ামিনের জায়গায় আরেকজনকে রেখে দেয়া হোক। কিন্তু ইউসুফ (আ) মানলেন না।

সবচেয়ে বড় ভাই তখন রয়ে গেলেন, বাকি ভাইদের পাঠিয়ে দিলেন, বাবাকে খবরটা জানাতে। অন্যদিকে, ইউসুফ (আ) তার ভাই বিনইয়ামিনকে বলে দিলেন আসলে এটা তারই পরিকল্পনা। নিজের কাছেই তাকে রাখলেন তিনি।

সেই অনেক কাল আগে ইয়াকুব (আ) ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অন্ধই হয়ে গিয়েছিলেন। আজ আরেক সন্তান হারিয়ে আরও কষ্ট পেলেন।

কিন্তু কী করবে বুঝতে না পেরে, পেটের তাড়নায় আবার এলো ভাইয়েরা মিসরে। এবার রীতিমত ভিক্ষা করল তারা শস্যের জন্য।

এবার আর পারলেন না জোসেফ নিজেকে ধরে রাখতে। মিসরের ভাষা বাদ দিয়ে তার ভাইদের ভাষাতে বলে উঠলেন, “তোমরা তোমাদের ভাই ইউসুফ আর বিনইয়ামিনকে কী করতে মনে আছে?” (কুরআন ১২:৮৯)

উজিরের দিকে তাকিয়ে তারা অবাক হয়ে বলল, “তুমি ইউসুফ!”

“হ্যাঁ, আমিই ইউসুফ। আর আমার ভাই বিনইয়ামিন এই যে।”

ভাইয়েরা একেবারে ভয়ে যবুথবু হয়ে গেল। এখন কী করবেন তাদেরকে

ইউসুফ (আ)? এত অপরাধের শাস্তি না জানি কত ভয়াবহ হয়!

কিন্তু ইউসুফ (আ) তাদের ক্ষমা করে দিলেন। জড়িয়ে ধরলেন তাদের। আনন্দের অশ্রু বিসর্জন করলেন।

এর পরের কাহিনী সংক্ষেপে, ইয়াকুব (আ)-এর চেহারা বা মুখমণ্ডলের ওপর ইউসুফ (আ) এর একটি জামা রাখবার পর পরই তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে। তাঁকে মিসরে নিয়ে আসা হলো, ইউসুফ (আ) এর মাকেও (মাকেও আনা হয়েছিল, সেটি কুরআনে উল্লেখিত। কিন্তু বাইবেল মতে, মা আগেই মারা গিয়েছিলেন।)। পুরো পরিবার আবার একত্রিত হলো। রাজার সাথেও পরিচিত করিয়ে দেয়া হলো তাদেরকে। (অবশ্য ইবনে কাসিরের তাফসিরে রয়েছে যে, এরকম মতবাদও আছে, আসলে তাঁর মা বিনইয়ামিনকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাননি, বরং জীবিত ছিলেন। কুরআনে বলা হয়নি যে আসল মা নাকি সমা এসেছিলেন। কিন্তু কোনো মা এসেছিলেন বটে। তাফসিরে এ মতবাদও উল্লেখিত আছে যে, আসলে ইউসুফ (আ) এর মা নয়, বরং খালা লিয়া এসেছিলেন। কিন্তু লিয়া যেহেতু ইয়াকুব (আ) এর আরেক স্ত্রী, তাই তিনিও ইউসুফ (আ) এর মা, সৎ মা।)

ইউসুফ (আ) তাঁর পিতা-মাতাকে উচ্চ আসনে বসালেন। এরপর উপস্থিত সকলেই, অর্থাৎ ভাইয়েরাও ইউসুফ (আ) এর সামনে সিজদায় পড়ে গেলেন। তখন ইউসুফ (আ) বললেন, তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আল্লাহ সেটি সত্য করেছেন। (কুরআন 1২:1০০)

তখন থেকেই মিসরে বসবাস শুরু করল ইয়াকুব (আ) এর পরিবার, তার ১২ সন্তান। এই ১২ সন্তান পরবর্তীতে হিব্রু বা ইসরাইলের ১২ গোত্র হয়ে দাঁড়ায়। বনী ইসরাইল।

১১০ বছর বয়সে মারা যান ইউসুফ (আ)। মারা যাবার আগে তিনি অনুরোধ করেন, তাঁর লাশ যেন তার পূর্বপুরুষদের সাথে দাফন করা হয়। কোনোদিন যদি মিসর থেকে তারা চলে যায়, তবে যেন সাথে নিয়ে যায় তাঁর লাশ। পাঠকদের এ কথাটা মনে রাখতে হবে পরবর্তী এক পর্বের জন্য, যখন মূসা (আ) বনী ইসরাইলকে নিয়ে মিসর ত্যাগের পর্ব আসবে।

ইউসুফ (আ) এর মিসর-বাস ও উচ্চপদের কারণে বাইবেল গবেষকগণ মত প্রকাশ করেন যে, নিশ্চয়ই এত উচ্চপদস্থ একজনের রেকর্ড পাওয়া যাবে মিসরীয় প্রাচীন নথিতে। তবে অবশ্যই হিব্রু ইউসুফ নামে নয়, কারণ তিনি তো এ নামে নিশ্চয়ই মিসরে পরিচিত হননি দাস হিসেবে আসবার পর। তাই তাঁকে খুঁজতে হবে অন্য নামে। যেমন- আদিপুস্তকে (৪১:৪৫) বলা আছে যে, মিসরের রাজা ইউসুফ (আ) এর নাম দিয়েছিলেন- যাফনাথ পানেহ (Zaphnath Paaneah); উচ্চারণ শুনে বোঝা যায় মিসরীয় নাম। তবে আমরা এর অর্থ জানি না নিশ্চিতভাবে।

অনেকেই ফারাও জোসারের (Pharaoh Djoser) উজির ইমহোতেপকে (Imhotep) ইউসুফ (আ) বলে ধারণা করেন। এ নামের সাথে ইউসুফ নামের মিল আছে কি না সে নিয়েও হয়েছে গবেষণা। তবে, এ দুজনকে এক ব্যক্তি হিসেবে দাবি করার পেছনে অন্য কারণ হলো, সিহিয়েল দ্বীপে পাওয়া এক খোদাই করা লেখনিতে জানা যায়, তাঁর সময় সাত বছর প্রচুর ফসলাদি এবং সাত বছর খরা হয়েছিল। ইমহোতেপই সমাধান দিয়েছিলেন ফসল জমিয়ে খরার সময় ব্যবহার করার ব্যাপারে।

ইমহোতেপ আরেকটি কারণে বিখ্যাত, কারণ তিনি প্রথম পিরামিড বানান, তবে সেটা সমাধি হিসেবে নয়। মিসরের সাক্কারাতে জোসারের পিরামিড বা স্টেপ পিরামিড নামে খ্যাত সেই পিরামিডের উদ্দেশ্য ছিল শস্য জমা রাখা! এখানে জমাকৃত ফসল দিয়েই খরার বছরগুলো পার করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

তবে ইমহোতেপের হযরত ইউসুফ (আ) না হবার ব্যাপারেও অনেকে যুক্তি দিয়েছেন। ইমহোতেপ যে-ই হোন না কেন, ইহুদী ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলামের ইতিহাসে ইউসুফ (আ) একটি বড় ও গুরুত্ববহ জায়গা জুড়ে আছেন। কিন্তু যে বিষয়টি অনেকেই পুরোপুরি জানেন না সেটি হলো, যে ইসরাইলিদের এত সাদরে মিসরে থাকতে দেয়া হয়েছিল, সেই একই ইসরাইলিরা বা হিব্রুরা কীভাবে নির্যাতিত দাস হয়ে উঠলো? কেন তারা অত্যাচারিত হত? কেনই বা তাদেরকে মিসর থেকে উদ্ধার করা এত জরুরি হয়ে পড়েছিল? কী হয়েছিল মাঝের শত শত বছরে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *