অধ্যায়-৩১ রোমান শাসনে দমিত ইসরাইল

অধ্যায়-৩১ রোমান শাসনে দমিত ইসরাইল

খ্রিস্টপূর্ব সে সময়টায় জেরুজালেমকেন্দ্রিক ইহুদীদের অবস্থা বেশ দোটানায়। একদিকে তাদের ধর্মীয় টানাপোড়েন, অন্যদিকে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। বর্তমানে যা ইতালি, সে অঞ্চলের একটি রাজনৈতিক অস্তিত্ব থেকে শুরু করে লম্বা একটি সময় পেরিয়ে একসময় ভূমধ্যসাগর এলাকা পুরোটাই দখলে চলে আসে রোমানদের। অর্থনৈতিক এবং সামরিক- দুই রকম কারণই ছিল এ রাজ্যবিস্তারের পেছনে। ইহুদীদের চোখে রোমানরা ছিল অপরাজেয়, তাদের নতি স্বীকার করতেই হবে অসহায়ভাবে, তাই বাধা দেবার তেমন কোনো প্রয়াসই দেখা যায়নি। অবশ্যই পরাক্রমশালী রোমানদের তুলনায় ইহুদীদের সামরিক ক্ষমতাও তেমন ছিল না। সকলেই হেরোদকে রাজা মানতো বটে, কিন্তু এটাও মনে মনে সকলেই জানত যে, আসল কলের কাঠি নাড়ছে রোম, হেরোদ সেখানে পুতুল মাত্র। এই অপমানজনক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দেবার জন্য ইহুদীদের একজন ত্রাতা যে আসবেন, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করাই ছিল, তাকে ডাকা হবে ‘মসিহ’ (মেসায়া)। তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস তথা জেরুজালেম থেকে সারা পৃথিবী শাসন করবেন।

হেরোদ যখন মারা গিয়েছিলেন তখন খ্রিস্টপূর্ব ৪ সাল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর এহুদিয়া বা জুদিয়া রাজ্য তার তিন পুত্র ভাগ করে নেন। এক পুত্র হেরোদ অ্যান্টিপাস গালিলির উত্তর দিক আর জর্ডান নদীর পূর্ব দিক নিলেন; আরেক পুত্র ফিলিপ নিলেন যে এলাকা বর্তমানে গোলান হাইটস নামে পরিচিত, অর্থাৎ গালিল সাগরের পূর্ব দিক। আর তৃতীয় ছেলে আর্কেলাস নিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে জেরুজালেম পড়েছিল। কিন্তু এই তৃতীয় ভাই তার বাবা হেরোদের মতো তেমন আহামরি রাজা ছিলেন না। এটা রোমের নজরে এসেছিল। দশ বছরের মধ্যেই তাকে সরিয়ে দেন রোমান হোমড়াচোমড়াগণ। তার বদলে জেরুজালেমে নিয়োগ হতে শুরু করলো রোমান ‘প্রিফেক্ট’ বা গভর্নর। এরকমই একজন প্রিফেক্ট বা গভর্নর ছিলেন পন্টিয়াস পাইলেট, যার জেরুজালেমে শাসন করবার ব্যাপারটি প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত।

বলা বাহুল্য, এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ইহুদীরা চাইতো না এমন কোনো কিছু ঘটুক, যা তাদের জেরুজালেমে থিতু হয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে নড়বড়ে করে দেয়। আসলেই, তাদের আর কী চাই, মাথার ওপর রোমান সাম্রাজ্যের মতো পরাক্রমশালী অভিভাবক আছে, নবনির্মিত বাইতুল মুকাদ্দাস বা সেকেন্ড টেম্পল আছে (আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট নেই যদিও, তা ইতিহাস থেকে বিলীন হয়ে গিয়েছে বহু আগেই), আছে ইহুদী ইমাম বা র‍্যাবাইদের স্থানীয় ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি। কেন তারা চাইবে যে নতুন কোনো আন্দোলন বা কিছু এসে তাদের আরামে ব্যাঘাত ঘটাক?

বলাই বাহুল্য, পর্দার আড়ালের ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যাওয়া ধর্মগুরুদের মাঝে তখন দুর্নীতি ঢুকেছিল ভালোভাবেই। ঐতিহাসিক অনেক নথিই পাওয়া যায় যেখানে তৎকালীন ধর্মগুরুদের দুর্নীতির বিস্তারিত উল্লেখ আছে, এবং তারা কোনোভাবেই এমন কাউকে বরদাশত করতেন না যারা তাদের নীতি বা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। তাই প্রতিটি আন্দোলনই ছিল তাদের জন্য ভয়ের।

ইহুদী ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্বাসটি রয়েছে মসিহের আগমন সম্পর্কে তার ফায়দা নিয়ে নেয় অনেকেই। সেই সেকেন্ড টেম্পল যুগে অনেকের আবির্ভাব হয় যারা নিজেদেরকে মসিহ বলে দাবি করতে থাকে, সবাইকে সতর্ক করতে থাকে ঈশ্বরের রাগ আর বিচার সম্পর্কে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এদের দমন করতে সিদ্ধহস্ত ছিল ইহুদী ধর্মগুরুরা। আর যেকোনো মুভমেন্ট দমালে রোম বরং খুশিই থাকে। তাই যে-ই না কোনো নতুন আন্দোলনের নায়ককে দণ্ডিত করে রোমানদের হাতে তুলে দেয় তারা শাস্তির জন্য, প্রায় বিনা বাক্যব্যয়ে সেই শাস্তি দিয়ে দিত রোম। অশান্তি চায় কে? এটাই ছিল তাদের নীতি। যেমন ধরুন, নবী দাবি করা থেওডাস নামের একজনের প্রায় ৪০০ অনুসারী জুটে গিয়েছিল, রোমানরা তাকে ধরে এনে শিরশ্ছেদ করে ফেলে।

রাজা হেরোদ ‘ম্যাসাকার অফ দ্য ইনোসেন্টস’ (ম্যাথিউ ২:১৬-১৮) খ্যাত এক ঘটনা ঘটান বলে বর্ণিত আছে, খ্রিস্টপূর্ব চার সালে। বাইবেল বলছে, সে সময় দু’বছর বা তার কম বয়সী সকল ছেলে শিশুকে হত্যার আদেশ দেন হেরোদ এই ভয়ে যে, এদের মাঝেই কেউ মসিহ (খ্রিস্ট) হবেন ভবিষ্যতে। তিনি চাইতেন না তার রাজত্বের হুমকি হয়ে কেউ আসে।

আরেকজন আছেন যার নাম আমরা জানতে পারি না, কেবল জানা যায় তিনি ছিলেন মিসরীয়; তো সেই মিসরীয় ‘মসিহ’ এক দল অনুসারী জুটিয়ে ফেলেন মরুভূমিতে, তাদেরকে কচুকাটা করে রেখে যায় রোমান বাহিনী।

খ্রিস্টপূর্ব চার সালে এক রাখাল তার মাথায় মুকুট চড়িয়ে দাবি করে বসে, সে ‘ইহুদীদের রাজা’। নির্মমভাবে তাকে আর তার অনুসারীদের হত্যা করে রেখে যায় রোমানরা।

আরেক ভদ্রলোক যাকে আমরা চিনি ‘সামারিটান’ বলে, তাকে খোদ পন্টিয়াস পাইলেট ক্রুশবিদ্ধ করেন, যদিও তার কোনো অনুসারীই ছিল না; তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় জানাবার উদ্দেশ্য ছিল কোনো রকমের স্বর্গীয় বা নেতাগোত্রের দাবিদাওয়া নিয়ে আসা কাউকে বরদাশত করাই যাবে না, পাছে সে ভবিষ্যতে ক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

এরকম করে ডাকাতসর্দার খ্যাত হেজেকিয়া, পেরেয়া থেকে আগত সাইমন, গালিলি থেকে আসা জুডাস, জুডাসের নাতি মেনাহেম, গিওরা থেকে আগত আরেক সাইমন, কোচবার ছেলে অন্য আরেক সাইমন- সবাই নিজেদেরকে প্রতিশ্রুত মসিহ বা ত্রাতা হিসেবে নিজেদের অবস্থান করেন আর নিজেদের ঠাঁই পান পরপারে, ধন্যবাদান্তে রোমক বাহিনী আর ইহুদী ধর্মগুরুরা।

তাই এত ভণ্ড মেসায়া বা মসিহের ভীড়ে রোমান কর্তৃপক্ষ আর সমসাময়িক ইহুদী গুরুরা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে নাসরত গ্রাম থেকে আসা কোনো এক ত্রিশ বছরের যুবক কাঠমিস্ত্রী আসবেন মসিহ হিসেবে। তাঁর গুটি কয়েক অনুসারীকে দমন করবার জন্য সেই ‘মসিহ’কে ক্রুশে চড়িয়ে দেয়াটাই তাই তারা ভেবেছিলেন সহজতম সমাধান। তাদের ধারণায় ছিল না, এই মানুষটির একদিন দুশো কোটিরও বেশি অনুসারী হয়ে যাবে। যাকে প্রায় চারশো কোটি মানুষ বিশ্বাস করবে প্রতিশ্রুত ‘মসিহ’ হিসেবেই।

তিনি আর কেউ নন- যীশু খ্রিস্ট, বা হযরত ঈসা মাসিহ (আ)। ঈসা তার নাম, উপাধি তার খ্রিস্ট (Christ) বা আল-মাসিহ।

আমাদের ইহুদী জাতির খ্রিস্টপূর্ব ইতিহাসের এখানেই সমাপ্তি। কারণ, যীশুর জন্ম থেকেই শুরু হয় ইহুদী জাতির আরেক অধ্যায়, যার পরবর্তী দু’হাজার বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে প্রয়োজন আরেকটি বই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *