অধ্যায়-১২ সিনাই পর্বতে ঐশ্বরিক সঙ্গ এবং তাওরাত লাভ

অধ্যায়-১২ সিনাই পর্বতে ঐশ্বরিক সঙ্গ এবং তাওরাত লাভ

লোহিত সাগরে ফারাওয়ের বাহিনী ডুবে মারা যাবার পর ওপারে পৌঁছে যাওয়া বনী ইসরাইল আনন্দে মেতে উঠলো, এবং কাওয়ালি গাইতে লাগলো। হযরত মূসা (আ) ও হারুন (আ) এর পাশাপাশি এ উৎসবে তাদের বোন মরিয়মও অংশ নেন। উল্লেখ্য, ইহুদী ধর্মে এই দুই ভাইয়ের পাশাপাশি মরিয়মকেও নবী হিসেবে বিশ্বাস করা হয়।

হ্যাঁ, অবাক হবার কিছু নেই। ইসলাম ধর্মে মহিলা নবীর ধারণা না থাকলেও ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মে আছে। ‘নবী’ শব্দটি একইসাথে আরবি ও হিব্রু। আর হিব্রুতে মহিলা নবীকে ডাকা হয় নাবীয়াহ। মূসা (আ) এর বড় বোন মরিয়ম, দেবোরাহ, হুলদাহ, নবী ইশাইয়া (আ) এর স্ত্রী, আন্না প্রমুখ নারী নবীর নাম দেখা যায় বাইবেলে।

যা-ই হোক, এরপর মূসা (আ) বনী ইসরাইলকে লোহিত সাগর থেকে এগিয়ে যেতে বললেন, তাতে তারা শূর মরুভূমিতে গমন করলো। আর তারা তিন দিন মরুভূমিতে যেতে যেতে পানি পেল না। আর যখন পেল তখন তা পান করতে পারলো না, কারণ সেই পানি ছিল খুবই তিক্ত। তখন লোকেরা মূসা (আ) এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বললো, “আমরা কী পান করবো?”

তাতে মূসা (আ) মাবুদের কাছে কান্নাকাটি করলেন, আর মাবুদ তাঁকে একটি গাছ দেখালেন। আল্লাহর নির্দেশে তিনি তা নিয়ে পানিতে নিক্ষেপ করলে পানি মিষ্ট হলো।

আড়াই মাস পর তারা এলীম নামের জায়গা পেরিয়ে সীন মরুভূমিতে উপস্থিত হলো, তা এলীমের ও তূর পর্বতের মধ্যবর্তী। তখন বনী ইসরাইলের সমস্ত দল।

মরুভূমিতে মূসা (আ) হারুনের (আ) বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো, “হায়, হায়, আমরা মিসর দেশে মাবুদের হাতে কেন মরিনি? তখন মাংসের হাঁড়ির কাছে বসতাম, তৃপ্তি পর্যন্ত রুটি ভোজন করতাম, তোমরা [মূসা (আ) ও হারুন (আ)] তো এ দলটিকে ক্ষুধায় মেরে ফেলবার জন্য আমাদেরকে বের করে এই মরুভূমিতে নিয়ে এসেছো।’

তখন আল্লাহ মূসা (আ)-কে বললেন, “দেখ, আমি তোমাদের জন্য বেহেশত থেকে খাদ্যদ্রব্য বর্ষণ করবো। লোকেরা বাইরে গিয়ে প্রতিদিন সেই দিনের খাদ্য কুড়াবে। তবে তারা আমার শরীয়ত অনুসারে চলবে কি না, তা আমি তাদের পরীক্ষা নেব।” শর্ত থাকলো- দিনের খাবার দিনেই শেষ করতে হবে, পরের দিনের জন্য জমিয়ে রাখা যাবে না (শুক্রবার ব্যতীত, কারণ শুক্রবার দিন তুলে আনা খাবার দিয়ে শনিবারও চলতে হতো)।

কুরআন ও বাইবেল উভয় গ্রন্থেই বর্ণিত আছে- আল্লাহ বনী ইসরাইলের মরুবাসের সময় দুটি বেহেশতি খাবার অবতীর্ণ করতেন। সেগুলো ছিল মান্না ও সালওয়া।

চল্লিশ বছর ধরে আল্লাহ মান্না বা মানা পাঠাতেন। ধনে পাতার বীজের মতো আকারের সাদা সাদা গোল খাবার ছিল এটি। আঠা আঠা শিশিরকণা বা শিলার সাথে মিল ছিল মান্নার।

“আর আমি তোমাদের উপর ছায়া দান করেছি মেঘমালার দ্বারা এবং তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি মান্না ও সালওয়া। সেসব পবিত্র বস্তু তোমরা ভক্ষণ করো, যা আমি তোমাদেরকে দান করেছি। বস্তুত তারা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে।” (কুরআন, সুরা বাকারা, ২:৫৭ )

আর সালওয়া ছিল একপ্রকার পাখি, চড়ুই পাখি থেকে একটু বড়, মতান্তরে কবুতরের সমান। অনেকটা লাল। দখিনা বাতাস এসে পাখিগুলোকে জড়ো করতো। বনী ইসরাইল সেগুলো ধরে জবাই করে খেত।

সন্ধ্যাবেলা সালওয়া পাখিতে ভরে যেত বনী ইসরাইল শিবির, আর ভোরবেলা শিশিরের মতো মান্নাতে। মূসা (আ) বলে দিলেন, “তোমরা কেউ সকাল বেলার জন্য এর কিছু রেখো না।”

তবুও কেউ কেউ মূসার (আ) কথা না মেনে সকাল বেলার জন্য কিছু কিছু রাখলো, তখন তাতে কীট জন্মালো ও দুর্গন্ধ হলো; আর মূসা (আ) তাদের উপরে ক্রুদ্ধ হলেন। এভাবে প্রতিদিন খুব ভোরে তারা নিজ নিজ ভোজনশক্তি অনুসারে কুড়ালো, কিন্তু রৌদ্র প্রখর হলে তা গলে যেত।

সাব্বাথ বা বিশ্রামদিবসে (শনিবার) কিছু লোক গেল খাবার কুড়াতে, গিয়ে দেখলো কোনো খাবার আসেনি।

পরে বনী ইসরাইলের সমস্ত দল সীন মরুভূমি থেকে যাত্রা করে রফীদীমে গিয়ে শিবির স্থাপন করলো। সেই স্থানে লোকদের পান করার পানি ছিল না। এজন্য লোকেরা মূসার (আ) সঙ্গে ঝগড়া করে বললো, আমাদেরকে পানি দাও, আমরা পান করবো। মূসা (আ) তাদেরকে বললেন, “কেন আমার সঙ্গে ঝগড়া করছো? কেন মাবুদকে পরীক্ষা করছো? তখন লোকেরা সেই স্থানে পানির পিপাসায় ব্যাকুল হলো, আর মূসার (আ) বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বললো, তুমি আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের ও পশুগুলোকে তৃষ্ণা দ্বারা মেরে ফেলতে মিসর থেকে কেন আনলে? তখন মাবুদ মূসাকে (আ) বললেন, তুমি লোকদের আগে যাও, ইসরাইলের কয়েকজন প্রাচীনকে সঙ্গে নিয়ে, আর যা দিয়ে নদীতে আঘাত করেছিলে সেই লাঠি হাতে নিয়ে যাও। দেখ, আমি হোরেবে সেই শৈলের উপরে তোমার সম্মুখে দাঁড়াবো; তুমি শৈলে আঘাত করবে, তাতে তা থেকে পানি বের হবে, আর লোকেরা পান করবে।” (তাওরাত, হিজরত ১৭)

কুরআনে বলা আছে, “আর মূসা যখন নিজ জাতির জন্য পানি চাইলো, তখন আমি বললাম, স্বীয় যষ্ঠির দ্বারা আঘাত কর পাথরের উপরে। অতঃপর তা থেকে প্রবাহিত হয়ে এলো বারটি ঝর্ণা। তাদের সব গোত্রই চিনে নিলো নিজ নিজ ঘাট।” (কুরআন ২:৬০ ) এরপর মূসা (আ) গিয়ে তার শ্বশুরের সাথে দেখা করে আসলেন। ফিরে এসে তিনি প্রতিটি গোত্রে একজন করে কাজি বা বিচারক নিয়োগ করলেন। তারপর সকলে মিলে রওনা দিলেন পবিত্র তূর পর্বতের দিকে। সেখানে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবার কথা মূসা (আ)-এর, কিন্তু পাহাড়ে উঠবার অধিকার অন্যদের ছিল না।

তাওরাত অনুযায়ী, ভোর হলে মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎ এবং পর্বতের উপরে ঘন মেঘ হলো, আর খুব জোরে তূরীধ্বনি হতে লাগলো; তাতে শিবিরের সমস্ত লোক কাঁপতে লাগল। পরে মূসা (আ) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য লোকদেরকে শিবির থেকে বের করলেন, আর তারা পর্বতের তলদেশে দণ্ডায়মান হলো; তখন সমস্ত তূর পর্বত ধোঁয়ায় ভরা ছিল; কেননা মাবুদ আগুনের মধ্যে তার উপরে নেমে আসলেন, আর ভাটির ধোঁয়া মতো তা থেকে ধোঁয়া উঠতে লাগলো এবং সমস্ত পর্বত ভীষণ কাঁপতে লাগল। আর তূরীর আওয়াজ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো। তখন মূসা (আ) কথা বললেন এবং আল্লাহ বজ্রের মতো আওয়াজে তাকে জবাব দিলেন। মাবুদ তূর পর্বতের চূড়ায় নেমে আসলেন এবং মূসাকে সেই পাহাড়ের চূড়ায় ডাকলেন; তাতে মূসা উঠে গেলেন।

তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, তুমি নেমে গিয়ে লোকদেরকে দৃঢ়ভাবে হুকুম কর, যেন তারা মাবুদকে দেখবার জন্য সীমা লঙ্ঘন করে তাঁর দিকে না যায় ও অনেকে মারা না পড়ে। অবশ্য, কেউই আল্লাহকে দেখত পেত না। (হিজরত ১৯)

সেদিনই মূসা (আ) এর উপর নাজিল হয় বেহেশটি ফলক, যাতে লিখিত ছিল বিখ্যাত টেন কমান্ডমেন্ডস বা দশ আদেশ, যা ইহুদী ধর্মের গোড়াপত্তন করে। এ দশ আদেশ ছিল যথাক্রমে-

১) শিরক করো না।

২) তুমি তোমার জন্য খোদাই করা মূর্তি তৈরি করো না; উপরোস্থ আসমানে, নিম্নস্থ দুনিয়াতে ও দুনিয়ার নিম্নস্থ পানির মধ্যে যা যা আছে, তাদের কোনো মূর্তি তৈরি করো না; তুমি তাদের কাছে সেজদা করো না এবং তাদের সেবা করো না; কেননা তোমার আল্লাহ মাবুদ আমি স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী আল্লাহ; আমি পিতৃগণের অপরাধের প্রতিফল সন্তানদের উপরে বর্তাই, যারা আমাকে অগ্রাহ্য করে, তাদের তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত বর্তাই; কিন্তু যারা আমাকে মহব্বত করে ও আমার সমস্ত হুকুম পালন করে, আমি তাদের হাজার পুরুষ পর্যন্ত অটল মহব্বত প্রকাশ করি।

৩) তোমার আল্লাহ মাবুদের নাম অনর্থক নিও না, কেননা যে কেউ তাঁর নাম অনর্থক নেয়, মাবুদ তাকে দোষী করবেন।

৪) তুমি বিশ্রামবার স্মরণ করে পবিত্র করো। ছয় দিন পরিশ্রম করো, তোমার সমস্ত কাজ করো; কিন্তু সপ্তম দিন তোমার আল্লাহ মাবুদের উদ্দেশে বিশ্রামবার। সেদিন তুমি বা তোমার পুত্র বা কন্যা, বা তোমার গোলাম বা বাঁদী, বা তোমার পশু, বা তোমার তোরণদ্বারের মধ্যবর্তী বিদেশী, কেউ কোনো কাজ করো না।

৫) তোমার পিতা ও মাতাকে সমাদর করো, যেন তোমার আল্লাহ মাবুদ তোমাকে যে দেশ দেবেন, সেই দেশে তোমার দীর্ঘ পরমায়ু হয়।

৬) খুন করো না।

৭) ব্যভিচার করো না।

৮) চুরি করো না।

৯) তোমার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না।

১০) তোমার প্রতিবেশীর বাড়িতে লোভ করো না; প্রতিবেশীর স্ত্রীর প্রতি, কিংবা তার গোলাম বা বাঁদীর প্রতি, কিংবা তার গরুর উপর বা গাধার উপর, প্রতিবেশীর কোনো বস্তুতেই লোভ করো না।

শুধু এ দশ আদেশই নয়, আরও অসংখ্য আদেশ নির্দেশ বা আইন তথা শরীয়ত তিনি পাহাড়চূড়ায় লাভ করেন, যা তাওরাত নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য, হিব্রু তৌরা শব্দের অর্থই হলো ‘আইন’।

কিন্তু মূসা (আ) দীর্ঘদিন পাহাড়ের ওপর ছিলেন, বলা হয় তার পবিত্রতা অর্জনের জন্য চল্লিশ দিন রোজা রাখতে হয়েছিল। এত দীর্ঘ সময় মূসা (আ) এর অনুপস্থিতি বনী ইসরাইলকে প্রলুব্ধ করে দশ আদেশের প্রথমটিই অমান্য করতে। সেই কাহিনীই আসবে পরের অধ্যায়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *