অধ্যায়-২৮ জেরুজালেম ধ্বংসের ভবিষ্যৎবাণী

অধ্যায়-২৮ জেরুজালেম ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী

হিব্রু নবীদের মাঝে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নবী ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের এজেকিয়েল, হিজকীল বা ইহিস্কেল (x২]?)। তার মা বৃদ্ধা বয়সে বাচ্চার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, এবং আল্লাহর দয়ায় জন্ম নেন হিজকীল (আ)। তিনি তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর জন্য বিখ্যাত, যেখানে তিনি জেরুজালেম ধ্বংস, ইসরাইল রাষ্ট্রের আবির্ভাব এবং সেখানে সর্বশেষ থার্ড টেম্পল স্থাপনের কথা বলেছেন। সম্ভবত তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬২২ সালে জন্ম নেন এবং ৫১-৫২ বছর বেঁচে ছিলেন।

বুজ্জির ছেলে হিজকীল (আ) ইমাম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন ত্রিশ বছর, তখন তিনি প্রথম ঐশীবাণী পান। তখন ব্যবিলনীয় নির্বাসনের পাঁচ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে চেবার নদীর তীরে তেলআবিবে থাকতেন। তাঁর কোনো সন্তানাদির খবর পাওয়া যায় না।

তাঁর প্রথম ঐশী অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের লেখনি থেকে বর্ণনা না করে উপায় নেই। তিনি এক অদ্ভুত যানের কথা লিখেছিলেন-

“ত্রিশ বছরের চতুর্থ মাসের পঞ্চম দিনে, বাদশাহ যিহোয়াখীনের নির্বাসনের পঞ্চম বছরের ঐ মাসের পঞ্চম দিনে, ইহিস্কেল (হিজকীল) ইমামের কাছে মাবুদের কালাম নাজেল হলো। আমি দৃষ্টিপাত করলাম, আর দেখ, উত্তর দিক থেকে ঘূর্ণিবাতাস, বিরাট মেঘ ও তার মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এবং তার চারদিকে তেজ ও তার মধ্যস্থানে আগুনের মধ্যবর্তী জ্বলন্ত ধাতুর মতো ঝকমক করছিল। আর তার মধ্য থেকে চারটি প্রাণীর মূর্তি প্রকাশ পেল। তাদের আকৃতি এই; তাদের রূপ মানুষের মতো। আর প্রত্যেকের চারটি মুখ ও চারটি পাখা। তাদের পা সোজা, পায়ের তলা বাছুরের পায়ের তলার মতো এবং তারা পরিষ্কার করা ব্রোঞ্জের উজ্জ্বলতার মতো উজ্জ্বল। তাদের চারপাশে পাখার নিচে মানুষের হাত ছিল; চারটি প্রাণীরই এরকম মুখ ও পাখা ছিল; তাদের পাখা পরস্পর সংযুক্ত; গমনকালে তারা ফিরতো না, প্রত্যেকে সম্মুখদিকে গমন করতো। তাদের মুখের আকৃতি এই; তাদের মানুষের মুখ ছিল, আর ডানদিকে চারটি সিংহের মুখ এবং বামদিকে চারটি গরুর মুখ, আবার প্রত্যেকেরই ঈগল পাখির মুখ ছিল। উপরিভাগে তাদের মুখ ও পাখা বিচ্ছিন্ন ছিল, একেকটির দুটি পাখা পরস্পর সংযুক্ত ছিল এবং আর দুটি পাখা দ্বারা শরীর আচ্ছাদিত ছিল। আর তারা প্রত্যেকে সামনের দিকে গমন করতো; যে দিকে যেতে রূহের ইচ্ছা হত, তারা সেই দিকে গমন করতো; গমনকালে ফিরতো না। এই আকৃতিবিশিষ্ট প্রাণীদের আভা জ্বলন্ত অঙ্গার ও মশালের আভার মতো; সেই আগুন ঐ প্রাণীদের মধ্যে গমনাগমন করতো, সেই আগুন তেজোময় ও সেই আগুন থেকে বিদ্যুৎ বের হত। আর ঐ প্রাণীদের দ্রুত যাতায়াত বিদ্যুতের ঝলকের আভার মতো।

আমি যখন ঐ প্রাণীদেরকে অবলোকন করলাম, দেখলাম, ভূতলে ঐ প্রাণীদের পাশে চার মুখের একেকটির জন্য একেকটি চাকা ছিল। চারটি চাকার আভা ও কাঠামো বৈদূর্যমণির মতো উজ্জ্বল; চারটির রূপ একই এবং তাদের আভা ও রচনা চাকার মধ্যেকার চাকার মতো ছিল। গমনকালে ঐ চারটি চাকা চারপাশে গমন করতো, গমনকালে ফিরতো না। তাদের নেমি উঁচু ও ভয়ঙ্কর এবং সেই চারটি নেমির চারদিক চোখে পরিপূর্ণ ছিল। আর প্রাণীদের গমনকালে তাদের পাশে ঐ চাকাগুলোও গমন করতো; এবং প্রাণীদের ভূতল থেকে উপরে উঠবার সময়ে চাকাগুলোও উপরে উঠত। যেকোনো স্থানে রূহের ইচ্ছা হত, সেই স্থানে তারা যেত; সেই দিকেই রূহের যাবার ইচ্ছা হত; আর তাদের পাশে পাশে চাকাগুলোও উঠতো, কেননা সেই প্রাণীর রূহ্ ঐ চাকাগুলোর মধ্যে ছিল। ওরা যখন চলতো, এরাও তখন চলতো; এবং ওরা যখন থামত, এরাও তখন থামত; আর ওরা যখন ভূতল থেকে উপরে উঠতো, চাকাগুলোও তখন পাশাপাশি উপরে উঠতো, কেননা সেই প্রাণীর রূহ্ ঐ সমস্ত চাকার মধ্যে ছিল।

আর সেই প্রাণীর মাথার উপরে এক শূন্যস্থানের আকৃতি ছিল, তা ভয়ঙ্কর স্ফটিকের আভার মতো তাদের মাথার উপরে বিছানো ছিল। সেই শূন্যস্থানের নিচে তাদের পাখা সকল পরস্পরের দিকে সোজাভাবে মেলে দেওয়া ছিল, প্রত্যেক প্রাণীর এই দিকে দুই, ওই দিকে দুই পাখা ছিল, সেগুলো তাদের শরীর আচ্ছাদন করেছিল। আর তাদের গমনকালে আমি তাদের পাখাগুলোর ধ্বনিও শুনলাম, তা মহাজলরাশির কল্লোলের মতো, সর্বশক্তিমানের রবের মতো, সৈন্যসামন্তের ধ্বনির মতো তুমুল ধ্বনি। দণ্ডায়মান হবার সময় তারা নিজ নিজ পাখা শিথিল করতো। তাদের মাথার উপরিস্থ শূন্যস্থানের উপরে একটি শব্দ হচ্ছিল; দণ্ডায়মান হবার সময়ে তারা নিজ নিজ পাখা শিথিল করতো।

আর তাদের মাথার উপরিস্থ শূন্যস্থানের উপরে একটি সিংহাসনের, নীলকান্তমণির মতো আভাবিশিষ্ট একটি সিংহাসনের মূর্তি ছিল; সেই সিংহাসন- মূর্তির উপরে মানুষের আকৃতির মতো একটি মূর্তি ছিল, তা তার উপরে ছিল। তাঁর কোমরের আকৃতি থেকে উপরের দিকে আমি জ্বলন্ত ধাতুর মতো আভা দেখলাম; আগুনের আভা যেন তার মধ্যে চারদিকে ছিল; এবং তাঁর কোমরের আকৃতি থেকে নিচের দিকে আগুনের মতো আভা দেখলাম এবং তাঁর চারদিকে তেজ ছিল। বৃষ্টির দিনে মেঘে উৎপন্ন ধনুকের যেমন আভা, তাঁর চারদিকের তেজের আভা সেরকম ছিল। এ মাবুদের মহিমার মূর্তির আভা। আমি তা দেখামাত্র উবুড় হয়ে পড়লাম এবং কথা বলছে এমন একজন ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।” (ইহিস্কেল ১)

২২ বছর ধরে তিনি নবীত্ব পালন করেন। তার প্রথম ভবিষ্যৎবাণী তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন, অর্থাৎ জেরুজালেমের পতন। তার সমসাময়িক নবী ছিলেন ইয়ারামিয়া (আ); ইয়ারামিয়া (আ) ছিলেন জেরুজালেমে, কিন্তু হিজকীল ছিলেন ব্যবিলনে।

কুরআনে এ ঘটনাটির উল্লেখ আছে যা ধারণা করা হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত জেরুজালেম নিয়ে-

“তুমি কি সে লোককে দেখনি যে এমন এক জনপদ দিয়ে যাচ্ছিল যার বাড়িঘরগুলো ভেঙে ছাদের উপর পড়ে ছিল? সে বলল, কেমন করে আল্লাহ মরণের পর একে জীবিত করবেন? অতঃপর আল্লাহ তাকে মৃত অবস্থায় রাখলেন একশ বছর। তারপর তাকে উঠালেন। বললেন, কতকাল এভাবে ছিলে? বলল, আমি ছিলাম, একদিন কিংবা একদিনের কিছু কম সময়। বললেন, তা নয়; বরং তুমি তো একশ বছর ছিলে। এবার চেয়ে দেখ নিজের খাবার ও পানীয়ের দিকে- সেগুলো পচে যায়নি এবং দেখ নিজের গাধাটির দিকে। আর আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি। আর হাড়গুলোর দিকে চেয়ে দেখ যে, আমি এগুলোকে কেমন করে জুড়ে দেই এবং সেগুলোর উপর মাংসের আবরণ পরিয়ে দেই। অতঃপর যখন তার ওপর এ অবস্থা প্রকাশিত হলো, তখন বলে উঠল- আমি জানি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।” (কুরআন সুরা বাকারা ২:২5৯)

বলা হয়, এ ঘটনাটিতে বর্ণিত মানুষটি হযরত ইয়ারামিয়া (আ) বা হযরত হিজকীল (আ)। তার সম্পর্কে এর চেয়ে বিস্তারিত আসলে জানা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *